Friday - April 25, 2025 6:45 PM

Recent News

সময়ের পরশ পাথর

সময়ের পরশ পাথর

: ড. মোহাম্মদ আমীন সম্পাদিত :

ভূ মি কা
ভূমিকা গ্রন্থের সারসংক্ষেপ। বড় কিছু ছোট করে প্রকাশ করা কঠিন কাজ। একটি বাক্যে যখন অনেক কথা, অনেক জ্ঞান, অনেক তথ্য ও গভীর দর্শন প্রকাশ পায়Ñ তখন সেটি বাণী হয়ে ওঠে। মূল বক্তব্য সহজবোধ্য করে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে বাণীর ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। সে হিসেবে ভূমিকা গ্রন্থের বাণী। ছয় শতাধিক পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটিকে কয়েক পৃষ্ঠায় নিয়ে আসার চিন্তা আরও ছয় হাজার পৃষ্ঠার একটি বই রচনার চেয়ে সময়সাপেক্ষ ও শ্রমসাধ্য। ভূমিকায় গ্রন্থের সারসংক্ষেপ প্রকাশের মত দক্ষতা আমার নেই। তাই নিজের অদক্ষতা আড়াল করার জন্য শুধু পটভূমিতে বিবরণ সীমাবদ্ধ রাখলাম।

২০০৫ খ্রিস্টাব্দের এক শীতের কথা। পিকনিকে গিয়েছি। সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনবিদ, বিচারক, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, গায়কসহ বিভিন্ন পেশার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষে জমজমাট। স্পটে পৌঁছার পর এক অংশগ্রহণকারী একটা নতুন প্রতিযোগিতার ধারণা দিলেন। এখনও জীবিত এমন লোকের মধ্যে কে কার ‘প্রিয় মানুষ ও আদর্শ ব্যক্তিত্ব’ এবং কেনÑতা সংক্ষেপে লিখতে হবে। বিচারকমণ্ডলী শ্রেষ্ঠ বিবেচনায় তিনজনকে বিজয়ী ঘোষণা করবেন।

আমি এমন কখনও ভাবিনি। শিশু বেলায় আমার প্রিয় মানুষ ও আদর্শ ব্যক্তিত্ব ছিলেন মা-বাবা। কলেজে এসে আহমদ ছফা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আদর্শ মানুষ ও প্রিয় ব্যক্তিত্বের ধারণা আরও ব্যাপকতা পায়। যাকেই পড়ি শ্রেষ্ঠ মনে হয়। কর্মজীবনে এসে তা আরও বিস্তৃত হয়। রবীন্দ্রনাথ নাকি নজরুল; সেক্সপিয়র নাকি ফ্রান্সিস বেকন, বঙ্গবন্ধু নাকি আব্রাহাম লিংকন, সক্রেটিস নাকি আইনস্টাইন, মহাত্মা গান্ধী নাকি মাদার তেরেসা, কনফুসিয়াস না গৌতম বুদ্ধ! সবাই গত। বঙ্গবন্ধু জীবিত নেই। তাহলে লিখে দিতাম বঙ্গবন্ধু। এখন কার নাম বলি! বেশিক্ষণ ভাবতে হয়নি। কয়েক মিনিটের মধ্যে জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে আমার প্রিয় মানুষ ও ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ করে নিলাম।

আমার ‘প্রিয় মানুষ ও আদর্শ ব্যক্তিত্ব’ বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও সহনশীল রাজনীতির প্রবক্তা, বিশিষ্ট শিল্পপতি, দানবীর ও লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন। কেন তিনি আমার প্রিয় মানুষ ও আদর্শ ব্যক্তিত্ব তা লিখতে মোটেও বেগ পেতে হল না। লিখেছিলাম: ‘তিনি স্ববিকশিত অনুপ্রেরণা। সুন্দর অবয়ব, চমৎকার ব্যবহার। ব্যক্তিত্বে আকর্ষণীয়, সদাহাস্যে অনুপম। অহঙ্কারের লেশমাত্র নেই। সমস্যা ও কারণ দুটোই দ্রুত এবং যথার্থ প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে চিহ্নিত করতে পারেন। বুদ্ধিমান, ধীর ও স্থির। তাঁর রাজনীতি, চিন্তা-চেতনা ও আর্থ-সামাজিক দর্শন সার্বজনীন মূল্যবোধের নির্লোভ মমতায় সৌরালোকের মত উদ্ভাসিত ও বাতাসের মত প্রসারিত। তিনি প্রকৃতির মত সহনশীল, শিশুর মত সরল, জ্ঞানের মত বিশাল আর বৃষ্টির মত নির্লোভ। ক্ষমাশীলতার নান্দনিক ছন্দে আলোড়িত; বুদ্ধি, প্রখর দৃষ্টিভঙ্গীÑ তাঁর রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা ও বিমর্ষতাকে চিরতরে মুছে দিয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের মাঝে আনন্দ খুঁজে পান। দান তাঁর পেশা, শিক্ষাবিস্তার নেশা। তিনি দেশপ্রেমিক, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। রাজনীতিকে ব্যক্তিস্বার্থে নয়, ত্যাগের মহিমায় লাস্যময় করার প্রতিযোগিতায় নিবেদিত। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের প্রতি অপরিসীম মমতায় তিনি সদা সচেতন। কারও সাথে দুর্ব্যবহার করেন না। ধমনীতে উচ্চবংশীয় পবিত্র রক্তের প্রবাহ। তিনি সফল ব্যবসায়ী, খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষণধর্মী লেখক, তুলনাহীন দাতা, অনাবিল শিক্ষানুরাগী। তিনি পরিশ্রমী, তেজি ও আত্মপ্রত্যয়ী। শত্র“কে বন্ধু বানিয়ে বিনাশ করেন। তিনি ধর্মপ্রাণ কিন্তু অসাম্প্রদায়িক, ধনী কিন্তু নিরহঙ্কারী। শিক্ষিত কিন্তু উন্নাসিক নন। চিত্ত ও বিত্ত দুটোই তার উচ্চ শিক্ষার মত সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের আর কোন জীবিত ব্যক্তি নেই যিনি এতগুলো প্রত্যয় ও বিশেষণে ঋদ্ধ। এসব গুণাবলীর পরিপূর্ণতা তাঁকে হৃদযোগীতে পরিণত করেছেন। তাই সৈয়দ আবুল হোসেন আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব।’

প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হয়েছিলাম। সেদিনই আমি সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিয়ে একটি গ্রন্থ লেখার সিন্ধান্ত নিই। ভেবেছিলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখব। বন্ধুবর ওসমান গণির পরামর্শে তা আপাতত স্থগিত রেখে সৈয়দ আবুল হোসেনের পরিচিত বিভিন্ন ব্যক্তির লেখা নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করব তা স্থির করি। আমার শিক্ষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. আবদুল করিমের পরামর্শ নিয়ে কাজ শুরু করি ২০০৬ সাল থেকে। কয়েক জনের লেখাও সংগ্রহ করি। তবে ওয়ান-ইলেভেন আমার কাজ পিছিয়ে দেয়। দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে আবার শুরু করি। বিভিন্ন সময়ে অনেকের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করে একত্রিত করি। এ সংগ্রহের কাজ চলে ২০১২ সাল পর্যন্ত। এই ৬ বছরের সাধনার ফসল এ সংকলন। লেখা সংগ্রহের সময় যাঁরা যে পদে আসীন ছিলেন বইটির লেখক পরিচিতিতে সেই পদমর্যাদাই ব্যবহার করা হয়েছে।

এটি ব্যক্তি নিয়ে বিবর্ধিত আমার প্রথম সংকলন। ভেবেছিলাম সহজ কাজ। কাজে নেমে বুঝলাম সহজ নয়। বিশেষ করে, জীবিত ব্যক্তির ওপর স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা কত যে কঠিন তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝতে পারবেন না। গ্রন্থে নির্ধারিত ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিফলন ও অবিকলন উপস্থাপন আবশ্যক। নইলে তিনি নিজেই এটি প্রত্যাখ্যান করবেন। অধিকন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনের মত অতি উঁচু মননশীলতার একজন ব্যক্তিত্বকে তাঁর জীবদ্দশায় আমার মত সাধারণ একজনের প্রয়াসে বিকশিত করাÑ পুরো পৃথিবী উল্টে দেয়ার মতই অসাধ্য ব্যাপার। তবু সাহস করলাম, ষাট শতাংশ নম্বর পেলেই তো প্রথম বিভাগ!

কত জনের কাছে কত জায়গায় যেতে হল। কালকিনি ঘুরলাম, কত জনের সাক্ষাৎকার নিলাম তার ইয়ত্তা নেই। সৈয়দ আবুল হোসেনের আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রিজীবনের সহকর্মী এবং নিকটতম লোক ছাড়াও অনেকের সাথেÑ এমনকি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী অনেকের সাথেও কথা বলেছি। প্রায় সবাই সহযোগিতা করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। কেউ বা আবার এড়িয়ে গিয়েছেন। দু’একজন নিরুৎসাহিতও করেছেন। আমি হতাশ হইনি। হতাশ না হওয়ার কৌশলটা আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছ থেকে রপ্ত করেছি।

যদি কেউ অন্যের অভাব কিংবা কষ্টে নির্বিকার থাকেন, তখন লোকে তাকে নিষ্ঠুর, কৃপণ ইত্যাদি কু-বিশেষণে বিশেষায়িত করে। আবার যদি উদার হাতে এগিয়ে আসেন তখন বলে, প্রচারের জন্য করছে, নাম-লোভী। এটি বাঙালি চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমার এ সংকলনকে অনেকে তোষামোদ বলে ভাবতে পারেন। প্রত্যেকের নিজস্ব ভাবনার অলঙ্ঘনীয় স্বাধীনতা আছে। কারও ভাবনা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। আমার চোখে যেটি সুন্দর, মোহনীয় সেটি উচ্ছ্বসিত ভাবালুতায় প্রকাশ করতে কোন অবস্থাতে দ্বিধা করব না, পিছিয়ে যাব না।

সৈয়দ আবুল হোসেন আমার প্রিয় মানুষ ও আমার চোখে তিনি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাই আমি তাঁকে নিয়ে সংকলনটি প্রকাশ করলাম। এখানে কারও প্রশংসার প্রত্যাশা যেমন করি না, তেমনি করি না নিন্দার শঙ্কা। আমার প্রিয় মানুষকে আমি প্রকাশ করব আমার আনন্দের জন্য। এ ছাড়াও সংকলন প্রকাশের অন্য একটি উদ্দেশ্য আছে। সেটি হল, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মায় না। দেশে অনেকের স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; তাদের কয়জনই বা সার্বিক বিবেচনা ও চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সৈয়দ আবুল হোসেনের মত চিত্ত-বিত্ত ও মননশীলতায় তাঁর কাছাকাছি হবার যোগ্যতা রাখেনÑ সে বিষয়ে আমার ভাল ধারণা আছে। যে সকল গুণ মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়কÑ তার সবগুলো গুণ সৈয়দ আবুল হোসেনে বর্তমান।

অনেকে বলেন, মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী। কথাটা আমি পুরোপুরি মেনে নিতে সংশয় বোধ করি। আমার মতে, ব্যক্তিবিশেষ বুদ্ধিমান হতে পারেন, সামষ্টিকভাবে মনুষ্য জাতি শ্রেষ্ঠ নয়। পৃথিবীতে এখনও অনেক মানুষ আছেন যারা বুদ্ধিমত্তা, দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তাচেতনায় পশুর চেয়ে অধম। ধর্মীয় উন্মাদনায় হায়ে না। মানুষ যদি বুদ্ধিমান প্রাণী হত তাহলে নিউটন, আর্কিমিডিস, সক্রেটিস, এরিস্টটল, আইনস্টাইন, সেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্টিফেন হকিং-এর পাশে ভূত-প্রেত বা ঝাড়-ফুঁকে বিশ্বাসীদের অবস্থান দেখা যেত না। বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের নিরক্ষরাধিক্য দেশে তা আরও প্রবল। হয়ত তাই সৈয়দ আবুল হোসেন শিক্ষা বিস্তারের আন্দোলনে নেমেছেন। শিক্ষাকে সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে তিনি মানুষকে প্রকৃত অর্থে সৃষ্টির সেরা জীবে পরিণত করার প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত।

সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে ঘনিষ্ঠ এমন অনেককে তাঁর সম্পর্কে কিছু লিখতে অনুরোধ করেছি। প্রচুর সাড়া পেয়েছি। অনেক লেখা এসেছে। তা থেকে বাছাই করে কয়েকটি মাত্র প্রকাশ করা হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন আমাকে পরোক্ষভাবে উপহাস করেছেন। একজন নিজেকে সৈয়দ আবুল হোসেনের বন্ধু দাবি করেন। তিনি বরেণ্য শিক্ষাবিদ। তাকে একটা লেখা দেয়ার জন্য অনুরোধপত্র দিয়েছিলাম। অনেকদিন হয় জবাব না পেয়ে ফোন করলাম। বললেন, সময় নেই। অথচ বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চিঠি দেয়ার তিন দিন পর তিনি লেখা পাঠিয়ে দেন।

খুব উঁচু পদে আছেন এমন একজন বললেন, এত লোক থাকতে সৈয়দ আবুল হোসেন আপনার প্রিয় ব্যক্তিত্ব হল কেন? সবিনয়ে বলেছিলাম, আমার বিবেচনা আমার কাছে। বলেছিলাম, এমন একটি সদ্গুণের কথা বলেন যেটি সৈয়দ আবুল হোসেনের নেই, এমন একটি ক্ষেত্রের কথা বলেন যেখানে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং এমন একটি দোষের কথা বলেন যেটি সৈয়দ আবুল হোসেনের আছে। তিনি অনেকক্ষণ ভেবে বললেন, ‘আমি আপনাকে যাচাই করার জন্য এটি বলেছি। আপনি সঠিক। তাকে আবার আমার কথা বলবেন না যেন।’ আমি বলেছিলাম, আমি তার কাছ থেকে এমন দীক্ষা পাইনি। সৈয়দ আবুল হোসেনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন ব্যক্তি না পাওয়া পর্যন্ত তিনি আমার জীবনে জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রিয় মানুষ ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হয়ে থাকবেন। তাঁর সম্মাননা গ্রন্থ আমাকে এক বার নয় বারবার, হাজার বার চয়ন করতে হবে।

সৈয়দ আবুল হোসেন সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশ করছি জেনে অনেকে আমাকে বাহবা দিয়েছেন। অনেকে আবার মুখটা কালো করে ফেলেছেন। দুটোই আমার কাছে ভাল লেগেছে। যারা বাহবা দিয়েছেন তারা সৈয়দ আবুল হোসেনকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যারা এড়িয়ে গেছেন তারা এটি করেছেন ঈর্ষাবশত। তার মত হতে না পারার যাতনায় মুখটা কালো করে ফেলেছেন। দুটোই সৈয়দ আবুল হোসেনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। আমি উভয় দলের চোখেমুখে সৈয়দ আবুল হোসেন যে একজন অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব তার স্বীকৃতি পেয়েছি। এটি আমার প্রয়াসকে যথার্থ প্রমাণিত করেছে। দ্বিতীয় দলের প্রতি আমার নিবেদন, বড় হওয়ার মধ্যে কোন লজ্জা নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়, যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য সম্মান প্রদর্শন মহানুভবতার পরিচায়ক। যারা মহানুভব তারাই কেবল এ কাজটি করতে পারেন।

সংকলনটি প্রণয়নে যাঁরা আমাকে লেখা, ছবি, সাক্ষাৎকার, তথ্য, বুদ্ধি ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছেন তাদের সবার প্রতি রইল কৃতজ্ঞতা। বিভিন্ন ব্যক্তির লেখার সমন্বিত প্রয়াস বলে পুনরাবৃত্তি লক্ষণীয়। লেখকের লেখার প্রতি সম্মান জানিয়ে তা মেনে নেয়া হয়েছে। তথ্যগত বিভ্রান্তি থাকাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাছাড়া মুদ্রণজনিত প্রমাদ অনেকটা মানব জীবনের ভুলের মতই অবশ্যম্ভাবী! এ সব বিষয়ে সদাশয় পাঠকের কাছ থেকে ক্ষমা, পরামর্শ ও সঠিক তথ্য প্রার্থনা করছি।

ড. মোহাম্মদ আমীন
ইস্কাটন রোড, ঢাকা

দ্বি তী য় সং স্ক র ণে র ভূ মি কা

সময়ের পরশ পাথর গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে। বইটি এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে ভাবা যায়নি। পত্রপত্রিকায় সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে; যত আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে তাতে কিন্তু এমনটি ভাবাই উচিত ছিল। যার বিরুদ্ধে এত সমালোচনা তার অনুকূলে কী প্রশংসা থাকতে পারে, সময়ের পরশ পাথর গ্রন্থে এমন কী পরশ আছে; অন্যদিকে যিনি দেশের একজন অদ্বিতীয় দানবীর, ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসহ শতাধিক শিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠাতা তার বিরুদ্ধে এত সমালোচনা কতটুক যৌক্তিক সে সম্পর্কে সবার আগ্রহই ছিল গ্রন্থটির মূল আকর্ষণ। সৈয়দ আবুল হোসেনের সমালোচকরা গ্রন্থটি নিয়েছেন। তেমনি নিয়েছেন বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, আলোচক এবং সাধারণ মানুষ। প্রথম আলো পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বইটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সমালোচনা হয়েছে। যা অনেককে গ্রন্থটির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। একজন বিচারপতি (প্রাক্তন), কয়েকজন সামরিক-বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা; সাহিত্যিক, কলামিস্ট, শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, পেশাজীবী ফোন করে বইটি সংগ্রহের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। অনেকে পত্র দিয়েছেন, মেইল করেছেন, ফোন করেছেন, ব্লগে লিখেছেন। কেউ করেছেন প্রশংসা। অনেকে বইটির বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে চমৎকার পরামর্শ দিয়েছেন। এদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

পৃথিবীতে কোন কিছু পরিপূর্ণ নয়। তাই সমালোচনা অনিবার্য। কিন্তু সমালোচনা অনেকে সহ্য করতে পারেন না। তবে সমালোচনা কখনও খারাপ নয় বরং কল্যাণকর। এ জন্য বিশ্ব জ্ঞানমণ্ডলে সমালোচনা একটি সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। একটি কথা খেয়াল রাখা দরকার, হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা উদ্দেশ্যপ্রসূত বক্তব্য কখনও সমালোচনা নয়। সমালোচনাকে অনেকে নিন্দা বা কুৎসার সমার্থক মনে করে থাকেন। তবে সমালোচনা আর কুৎসার পার্থক্য আকাশ পাতাল। সমালোচনা গবেষণাময় পর্যবেণের অভিক্ষেপ এবং যুক্তির ভাবার্থ। অন্যদিকে নিন্দা অবিবেচনাপ্রসূত মন্তব্য; যার উৎস রাগ আর ঈর্ষা।

গ্রন্থটির সমালোচনা করতে গিয়ে প্রথম আলো পত্রিকায় শওকত হোসেন লিখেছেন- “সৈয়দ আবুল হোসেনের সব সময়ের সঙ্গীদের কথা বইটিতে আছে। কিন্তু টিসিবিতে চাকরিকালীন কোনো সহকর্মীর স্মৃতিচারণ এখানে নেই।” এটি অত্যন্ত যৌক্তিক সমালোচনা। অনেক খুঁজে এমন একজনকে পাওয়া গেল। তিনি হচ্ছেন মার্কিন প্রবাসী টিসিবির প্রাক্তন পরিচালক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য জনাব মোবারক এ মোল্লা। তার কাছে সময়ের পরশ পাথর গ্রন্থটির একটি কপি ও প্রথম আলোর সমালোচনা পাঠিয়ে মন্তব্য করার অনুরোধ জানানো হয়। তিনি ই-মেইলে একটি মন্তব্য পাঠান। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় প্রথম আলোর সমালোচনা ও মোবারক এ মোল্লার মন্তব্য দ্বিতীয় সংস্করণে প্রদান করা হল। অনেকগুলো মন্তব্য, সমালোচনা ও আলোচনা পেয়েছি। কলেবর বৃদ্ধি রোধ করার লক্ষ্যে ইচ্ছা থাকা সত্বেও এ সব পত্রস্থ করা সম্ভব হল না। তবে প্রফেসর ফারজানা জে চৌধুরীর ই-মেইলটা দেয়ার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না।

এ সংস্করণের জন্য লেখা আহবান করা না হলেও ইতোপূর্বে প্রাপ্ত অনেক লেখা জমা হয়েছিল। তারপরও অনেক লেখা পেয়েছি। কিন্তু কলেবর বৃদ্ধি প্রতিহত করার জন্য অনেক উত্তম লেখাও যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এগুলোর জন্য আর একটি নতুন বই প্রকাশ করতে হবে। তবে পাঠকদের সমালোচনা ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় কবি অসীম সাহার “অপরাধী জানিল না কি বা অপরাধ তারÑ বিচার হইয়া গেল”, অর্ণব রায় এর “শুধু তার বেলা কেন?” এবং সাংবাদিক নির্মল চক্রবর্তীর ‘সৈয়দ আবুল হোসেন, পদ্মাসেতু ও বিশ্বব্যাংক’ শিরোনামের তিনটি রচনা নতুনভাবে যুক্ত করা হয়েছে। অনেকে ছাপার ভুলগুলো সংশোধন করার তাগিদ দিয়েছেন। অনেকে ফোন করে কোথায় ছাপার ভুল হয়েছে তা বলে দিয়েছেন। গ্রন্থে দৃশ্যমান বানান কিংবা কারণিক ত্র“টিগুলো সংশোধন করার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরও যদি কোন ভুলভ্রান্তি থেকে যায় তা সহৃদ্যতয়র সাথে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার নিবেদন করছি। আশা করি প্রথম সংস্করণের ন্যায় দ্বিতীয় সংস্করণেও গ্রন্থটি পাঠক প্রিয়তা পাবে।

যে সকল মহৎপ্রাণ ব্যক্তির লেখা দিয়ে গ্রন্থটির অবয়ব গ্রন্থের অবয়ব অখণ্ড একটি বিষয় চয়ন করা চরিত হয়েছে এখানে শব্দ ব্যবহার শুদ্ধ নয় এটা রচনা নির্মাণ গঠন জাতীয় শব্দ দিলে সঙ্গত হত। হয়েছে তাদের প্রতি আবারও রইল কৃতজ্ঞতা। যারা গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেছেন, ব্যক্তিগতভাবে ফোন কিংবা ই-মেইল বা সামনা-সামনি উপদেশ দিয়েছেন তাদের ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। সবার প্রতি রইল শ্রদ্ধা। গ্রন্থটি সম্পর্কে যে কোন পরামর্শ ও সমালোচনা কৃতজ্ঞতার সাথে গৃহীত হবে।

ড. মোহাম্মদ আমীন
তারিখ : ৩০ মার্চ ২০১৩ নিউ সার্কুলার রোড
ঢাকা

সূ চি প ত্র

প্র থ ম অ ধ্যা য় : সৈয়দ আবুল হোসেন : জীবন ও কর্ম ……………………..
ড. মোহাম্মদ আমীন

সৈয়দ আবুল হোসেনের জন্মস্থান কালকিনির ইতিকথা ২৩
কালকিনির ইতিহাস ২৭
কালকিনির জনমিতি ও ঐতিহ্য ৪১
আধুনিক কালকিনির জনক ৪৮
সৈয়দ আবুল হোসেনের বংশ পরিচয় ৫২
সৈয়দ আবুল হোসেনের বংশলতিকা ৬০
সৈয়দ আতাহার আলী ও সৈয়দা সুফিয়া খাতুন ৬৪
সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষাজীবন ৬৯
সৈয়দ আবুল হোসেনের পারিবারিক ও কর্মজীবন ৭৯
সৈয়দ আবুল হোসেনের কৃতিত্ব, অবদান ও স্বীকৃতি ৮৩
জনতার চোখে সৈয়দ আবুল হোসেন ৯৩
সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনের মহামানবীয় কয়েকটি ঘটনা ১০০
সৈয়দ আবুল হোসেন : তেজময় সিংহপুরুষ ১০৬
আলাপচারিতায় দার্শনিক নান্দনিকতা ১১২

দ্বি তী য় অ ধ্যা য় : সময়ের পরশপাথর …………………………………………

সৈয়দ আবুল হোসেনের জন্য শুভেচ্ছা কবীর চৌধুরী ১২৫
ধন্যবাদ সৈয়দ আবুল হোসেন বেগম সুফিয়া কামাল ১২৮
শুভেচ্ছা আনিসুজ্জামান ১৩০
নিপাট ভদ্রলোক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৩১
আমার ভালোলাগা একজন আবদুল মান্নান সৈয়দ ১৩৩
সৈয়দ আবুল হোসেন : ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হাসনাত আবদুল হাই ১৩৯
অপরাধী জানিল না কি বা অপরাধ তারÑ 
বিচার হইয়া গেল অসীম সাহা ১৪৪
সৈয়দ আবুল হোসেন, মান্যবরেষু ইমদাদুল হক মিলন ১৫০
পদ্মা সেতু প্রকল্প এবং আমাদের করণীয় আইনুন নিশাত ১৫২
সৈয়দ আবুল হোসেন গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার নির্মল চক্রবর্তী ১৫৭
সুশোভিত সুমন আতাউর রহমান খান কায়সার ১৬৯
পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রাসঙ্গিক বাস্তবতা মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া ১৭৪
সৈয়দ আবুল হোসেন : আপনাকে মো. মোজাম্মেল হক খান ১৯৩
বলতে চাই তারই কথা ড. এম এ মাননান ১৯৭
কিছু স্মৃতি কিছু কথা শফিক আলম মেহেদী ২০১
একজন স্বয়ংসিদ্ধ মানুষ সম্পর্কে আবদুল গাফফার চৌধুরী ২০৪
সৈয়দ আবুল হোসেনের রাজনীতিক দর্শন ড. আবদুল করিম ২০৬
সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা এম মতিউর রহমান ২১৬
বন্ধু আমার উদার নিদাঘ আকাশ আবুল হাসান চৌধুরী ২২২
বিশ্বব্যাংকের পিঠটান : 
বাংলাদেশের উত্থান মুন জনি ২৩২
শুধু তার বেলা কেন? অর্ণব রায় ২৩৬
মহাঋত্বিক মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ ২৪৬
যেমন তাকে দেখেছি সৈয়দ আলমগীর ফারুক চৌধুরী ২৫৩
মননে উদ্ভাসিত অনুজপ্রতীম এম আজিজুর রহমান ২৫৭
একটি দরদি হাত রয়েছে বাড়ানো অজয় দাশগুপ্ত ২৬২
বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া ও 
সৈয়দ আবুল হোসেন অজিত সরকার ২৭৭
মিসরের আসওয়ান বাঁধ এবং পদ্মা সেতু মেজর জেনারেল এ কে
মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) ২৮৬
আমার আলেকজান্ডার অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মো. 
তমিজ উদ্দিন ২৯২
সৈয়দ আবুল হোসেন, 
পদ্মা সেতু ও বিশ্বব্যাংক মোবেশ্বের হোসেন ৩০৪
অবগুণ্ঠনে খুঁজে ফিরি কে এম ইফতেখার হায়দার ৩১৪
আবুল হোসেনের সৌভাগ্য বনাম 
পদ্মা সেতুর দুর্ভাগ্য গোলাম মাওলা রনি এমপি ৩১৭
পদ্মা সেতু উপাখ্যান : সত্য বনাম কল্পনা ড. মোজাম্মেল খান ৩২২
সতত বিভাময় মোহাম্মদ মোস্তফা ৩২৬
বহুমাত্রিক প্রজ্ঞা সিরাজ উদ্দীন আহমেদ ৩৩৩
সময়ের বরপুত্র ড. হাসমত আলী ৩৩৭
ম্যাগনেটিক ব্যক্তিত্ব ফরহাদ রহমান ৩৪০
পঞ্চমণি ড. মো. আবদুল জলিল ৩৪৬
পদ্মা সেতু প্রকল্প বৃত্তান্ত জামিলুর রেজা চৌধুরী ৩৫৩
শতাব্দীর স্মৃতি আব্দুল কাদের ৩৫৭
বিশাল মনের মাটির মানুষ মজিবর রহমান ৩৬৫
মহান এক মানুষ ওসমান গণি ৩৬৮
সৈয়দ আবুল হোসেনকে যেমন দেখেছি তরুন তপন দেওয়ান ৩৭২
অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক অনন্য ব্যক্তিত্ব অধ্যক্ষ হযরত মৌলানা 
মো. ইউনুস আলী ৩৭৬
এক আদর্শ সংসদ সদস্যের কথা অধ্যাপক মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ ৩৮৩
মহাকালের যাত্রী দুলাল সরকার ৩৯০
মনের মুকুরে আবদুল আজিজ হাওলাদার ৩৯৬
নেতার মতো নেতা আলহাজ্ব উপাধ্যক্ষ মুহাঃ 
জালাল উদ্দিন ৪১১
আধুনিক কালকিনির বিনির্মাতা অধ্যক্ষ মো. খালেকুজ্জামান ৪১৮
আমার ভাই আমার আদর্শ ড. সৈয়দ এ হাসান ৪২৪
সার্বজনীন রাজনীতিবিদ ড. একেএম আখতারুল কবীর ৪৩৪
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু অধ্যাপক ইবনে হাসান আলম ৪৪০
আমার বাল্যবন্ধু মো. লাল মিয়া ৪৪৩
প্রেরণাদায়ী সহধর্মিনী খাজা নার্গিস আহমদ হোসেন বীরপ্রতীক ৪৪৯
ছাত্রনং অধ্যয়নং তপোঃ মো. শামশুল আলম মিয়া ৪৫৫
আমার দেখা সৈয়দ আবুল হোসেন অধ্যক্ষ মো. জসিম উদ্দিন ৪৫৯
খুঁজে বেড়াই তারে অধ্যাপক মনোরঞ্জন দাশ ৪৭০
মহানুভব এক মহানায়ক অধ্যক্ষ প্রকাশ চন্দ্র নাগ ৪৭৪
মননশীল ভাষা বিজ্ঞানী নির্মল চন্দ্র পাল ৪৮৪
পরিশ্রমী এবং করিৎকর্মা একজন 
ব্যক্তির প্রতিকৃতি ফোরকান বেগম ৪৮৮
সৈয়দ আবুল হোসেন : কাছ থেকে দেখা সমীর রঞ্জন দাস ৪৯৩
গধহ ড়ভ ফুহধসরংস, ঢ়ৎঁফবহপব ধহফ 
ধংংরফঁড়ঁং অযসঁফঁষ ঐধংধহ ৪৯৭
সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ খোয়াজপুর মো. রফিকুল ইসলাম কোতোয়াল ৫০৪
কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন 
বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ জিয়াউল হাসান ৫০৯
ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী 
একাডেমি এন্ড কলেজ মো. শফিউল আজম ৫১৪
দার্শনিক নান্দনিকতা শফিকুল ইসলাম ইউনুস ৫২০
সময়ের পরশপাথর মোহাম্মদ আমীন ৫৩০
সৈয়দ আবুল হোসেনের বাণী এস এম আবীর চৌধুরী মীম ৫৪৭

তৃ তী য় অ ধ্যা য় : সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ …………

মানবাধিকার অরুণাভ সরকার ৫৫৭
এক স্বপ্নজয়ী মানুষের জন্য আসাদ মান্নান ৫৫৮
তুমি মো. মনিরুজ্জামান ৫৬০
চিরগঙ্গাতীরে মুহম্মদ নূরুল হুদা ৫৬১
ভালো মানুষ আলম তালুকদার ৫৬২
মুঠোগুলো খাঁচা হয়ে যায় মাহমুদ কামাল ৫৬৩
ধৃতিতত্ত্ব রহমান হেনরী ৫৬৪
এই এখনো নাসির আহমেদ ৫৬৫
সেদিন প্রকাশ চন্দ্র নাগ ৫৬৬
যাঁর মন আছে এস এম নুর মোহাম্মদ ৫৬৭
তোমার নি®প্রাণ ছবিটি মো. বরকত উল্লাহ্ পাঠান ৫৬৮
হে শ্রদ্ধাভাজন রোমেনা আফরোজা ৫৬৯
সুহৃদ প্রাজ্ঞ বিদগ্ধ জন ফয়সল শাহ ৫৭০
হৃদ্যিক চয়ন সিন্থিয়া অণুপ্রভা ৫৭১
অনিমেষ সদাসয় আহম্মদ কামাল ৫৭২
পহেলা আগস্ট এস এম আবীর চৌধুরী মীম ৫৭৩
মহামহিম রফিকুল ইসলাম ৫৭৪

চ তু র্থ অ ধ্যা য় : সৈয়দ আবুল হোসেনের কলম থেকে ……………………

বঙ্গবন্ধু ও ইসলাম ৫৭৭
খেলার সাথী থেকে জীবন সাথী ৫৮২
অন্তরঙ্গ আলোকে শেখ হাসিনা ৫৮৫
নেতৃত্ব ও উন্নয়ন ৫৯২
তারুণ্য ও শিক্ষা ৫৯৫
একুশের নতুন প্রেক্ষিত : ভাষা নীতির স্বপক্ষে ৬০১
সত্য ও ন্যায়ের দাঁড়িপাল্লায় আমি নির্দোষ ৬০৪
কালকিনি : আমার প্রেম ৬২৯

গ্রন্থালোচনা ৬৩৪

প্র থ ম অ ধ্যা য়

সৈয়দ আবুল হোসেন : জীবন ও কর্ম

ড. মোহাম্মদ আমীন

সৈয়দ আবুল হোসেনের জন্মস্থান 
কালকিনির ইতিকথা

কালকিনির নামকরণ প্রবাদ
১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার ডাসার গ্রামে সৈয়দ আবুল হোসেন জন্মগ্রহণ করেন। আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের জন্মস্থান নদীলালিত কালকিনি ভূখন্ডটির প্রাচীন নাম কি ছিল, তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দেখা যায় কৃষ্ণনগর, গোপালপুর, গোপাল সেন, লক্ষিপুর, বিভাগদি, রামনগর ইত্যাদি এ অঞ্চলের প্রাচীন নামসমূহের অন্যতম। রাঢ় গোষ্ঠীভুক্ত জনসংখ্যার বসতির জন্য কালকিনি একসময় রাঢ় বা আড়–য়াকান্দি নামেও পরিচিত ছিল। কোনো কোনো ঐতিহাসিক এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, পুয়ালি বর্তমান কালকিনি অঞ্চলের একটি প্রাচীন নাম। পুণ্ড্র শব্দের আঞ্চলিক অপভ্রংশ পোদ বা পুয়া হতে পুয়ালি শব্দের উৎপত্তি। এ অঞ্চলে পুণ্ড্রগণ বসতি স্থাপন করায় নাম হয় পুয়ালি। বস্তুত, তখন পুরো মাদারীপুর অঞ্চলটিই পুয়ালিভিত্তিক ছিল। কালকিনির আর একটি প্রাচীন নাম ভাটবিলা, বর্তমানে যা ভাটবালি নামে পরিচিত। মাগধ জনগোষ্ঠীভুক্ত লোক ভাট নামে পরিচিত ছিল। মাগধ জনগোষ্ঠীভুক্ত লোকজন যে এলাকায় বসতি স্থাপন করত তা ভাটবিলা বা মাগধ জনগোষ্ঠীভুক্ত লোকের এলাকা নামে পরিচিত হতো।
ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলন প্রতিহত এবং নদীবিধৌত দুর্গম এলাকায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে খেজুরতলা নামক স্থানে একটি থানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তৎকালীন ধনাট্য ব্যবসায়ী আবদুল করিম সরদার থানা প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রশাসনের ঊর্ধ্বমহলের সাথে বহুদিন যাবৎ আলোচনা করে আসছিলেন। প্রয়োজনীয় জমি ও অবকাঠামোর প্রতিষ্ঠার ব্যয়ভার তিনি নিজে বহন করেন। ফলে থানাঞ্চলের নাম রাখা হয় করিমগঞ্জ।
কালকিনির বর্তমান নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন প্রবাদ প্রচলিত। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের চর পলার্দি নদীর পশ্চিম তীরে চর পাঙ্গাশিয়া, চর বিভাগদি ও ঝাউতলা সমন্বয়ে একটি থানা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ক্যালির নামানুসারে স্থানটির নাম কালকিনি হয়েছে মর্মে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। মিস্টার ক্যালি ১৮৭০-১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফরিদপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। কিন্তু থানা করা হয় ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে। সুতরাং তাঁর নামে নামকরণের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। অধিকন্তু ক্যালি হতে কালকিনি হবার সম্ভাবনা প্রায় অবিশ্বাস্য। সর্বোপরি কালকিনি নাম ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের অনেক পূর্বে, এমনকি সুলতানি আমলেও ছিল। সুতরাং এটি নিছক প্রবাদ মনে হয়।
অনেকে মনে করেন, রানী কঙ্কাবতী হতে কালকিনি নামের উৎপত্তি। এটিরও কোনো ভিত্তি নেই। আবার অনেকের মতে, কোলাহাকানি শব্দ হতে কালকিনি শব্দের উৎপত্তি। কোলাহা শব্দের অর্থে নদীর কোণে অবস্থিত। কানি শব্দের অর্থ ভূখণ্ড বা ভূমি। নদীর কোণে অবস্থিত ভূখণ্ড তাই নাম কোলাহকানি, যার অপভ্রংশ কালকিনি। ‘কাল কাহিনী’ শব্দ হতে কালকিনি শব্দের উৎপত্তি হবার কথাও অনেকে বলে থাকেন। কাল শব্দের অর্থ সময়, আবার কালো বর্ণকেও বোঝানো হয়ে থাকে। ধ্বংসকারীকে কাল বলা হয়। এলাকাটি যমুনা নদীর কোলঘেঁষে বিদ্যমান ছিল। বাকলা, ত্রিপুরা, ফরিদপুর ও বিক্রমপুরÑ এ চারটি প্রভাবশালী রাজ্য ও উন্নত সভ্যতার মধ্যিখানে ছিল কালকিনি। এ তিন রাজ্যের বহু কালের বহু কাল-কাহিনীর সাথে জড়িত ভূখণ্ডটি কাল-কাহিনী নামে পরিচিত। এ ভূখণ্ডটি নিয়ে প্রভাবশালী রাজ্যগুলোর মধ্যে লড়াই লেগেই থাকত। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হত, কাল হতো জনগণের। কাল বা ধ্বংসের কাহিনী হতে নাম হয় কালকিনিÑ এটি অনেকের ধারণা।
কারও কারও মতে, কুলিক শব্দ হতে কালকিনি নামের উৎপত্তি। কারুশিল্পীদের বলা হয় কুলিক এবং কানি মানে স্থান। কুলিক সম্প্রদায়ের লোকজন এ স্থানে প্রথম নিবাস গড়ে তোলেন। তাই নাম কুলিককানি এবং অপভ্রংশে কালকিনি। অনেকে মনে করেন, কিঙ্কিণী শব্দ হতে কালকিনি। কিঙ্কনী শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রাকৃতিক লাস্যে বহুমাত্রিক শব্দ দ্যোতনায় বিভূষিত নৃত্যময় সঙ্গীতের যোজনা। কালকিনির প্রাকৃতিক পরিবেশের বহুমাত্রিক যোজনা তথা পাখির গানের সাথে নদী-সবুজের অনাবিল সুরে স্বর্গীয় সুরের সৃষ্টি করত বলে এটি কিঙ্কনী নামে পরিচিতি পায়, যা কালক্রমে কালকিনি।
কালকিনি একসময় পাটের ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিল। কলকাতা হতে পাট ব্যবসায়ীরা (মাড়–য়া) পাটক্রয়ের জন্য মাদারীপুরের বর্তমান কালকিনি নামে পরিচিত আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে আসত। মাড়–য়ারা টাকা শেষ হলে পাট কিনতে পারত না। পাটবিক্রেতারা পাট ক্রয়ের জন্য অনুরোধ জানালে তারা বলত: আজ নেহি, কাল কিনে গা। অনেকে মনে করেন, এ ‘কাল কিনে গা’, শব্দ হতে কালকিনি নামের উৎপত্তি।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বাকেরগঞ্জ, চন্দ্রদ্বীপ, বিক্রমপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কলকনি নাম হতে কালকিনি নামের উৎপত্তি হয়েছে। সদ্য উত্থিত চরের পাশে ছিল একটি নদী। গঙ্গার জল একদিক হতে অন্যদিকে গিয়ে আবার গঙ্গার শাখায় পতিত হতো। নদীর কলকল শব্দে চারিদিক মুখরিত হত। লোকে চরটির নাম তাই দিয়েছে কলকনি। অধিকাংশ লোকের মতে, এই কলকনি শব্দ হতে কালকিনি নামের উৎপত্তি।

সৈয়দ আবুল হোসেনের গ্রাম ‘ডাসার’
দেশখ্যাত শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ ও লেখক বর্তমান যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নিবাস হিসেবে খ্যাত ডাসার ইউনিয়ন কালকিনি উপজেলার একটি বিখ্যাত ইউনিয়ন। ডাসার একটি বিখ্যাত এলাকা। শাহ আলী বোগদাদী ও হযরত শাহ বোরহান লাহোরী এ অঞ্চলে আগমন করেন। শাহ আলী বোগদাদীর পুত্র হযরত শাহ সৈয়দ ওসমান। তিনি এমন কামেল ছিলেন যে, যে কোনো দায় বা বিপদাপদ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তার কাছে এলে সেরে যেত। তাই লোকে দায়সারার জন্য তার কাছে ছুটে যেতেন। তাই এলাকাটির নাম হয়ে ওঠে দায়সার, যার অপ্রভ্রংশ ডাসার। অনেকে মনে করেন, এখানে এক ধরনের বাঁশ পাওয়া যেত। এর নাম ছিল ডাসা বাঁশ। এ ডাসা বাঁশ হতে এলাকাটির নাম ডাসার হয়।
ডাসার ইউনিয়নের গ্রামগুলো হলো- গোপাল সেন, পশ্চিম কমলাপুর, ডোমরা, পূর্ব-কমলাপুর, আইসার, পূর্বদর্শনা, আড়–য়াকান্দি, পশ্চিম দর্শনা, ধামুসা, উত্তর খিলগ্রাম, দক্ষিণ খিলগ্রাম, ডাসার, বাকাই, বেতবাড়ি এবং পূর্ব বনগ্রাম।
কমলাপুর ডাসার ইউনিয়নের একটি বিখ্যাত গ্রাম। অতীতে এটি ছিল ব্যবসায়িক স্থান। হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর অপর নাম কমলা। সে সময় দেবী লক্ষ্মী স্থানীয়ভাবে কমলা নামে বেশি পরিচিত ছিল। তার নামানুসারে স্থানটির নাম হয় কমলাপুর। তবে অনেকে মনে করেন, দনুজমর্দন দেবর চতুর্থ অধস্তন ছিলেন জয়দেব, পিতা হরিবল্লভ। জয়দেবের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। তিনি মারা গেলে ত্বদীয় কন্যা কমলা দেবী কিছুদিন রাজ্য পরিচালনা করেন। কমলা ছিলেন অত্যন্ত প্রজাপ্রিয়। তাঁর নামানুসারে এলাকাটির নামকরণ করা হয় কমলাপুর। আবার কেউ কেউ মনে করেন, কালকিনি অঞ্চলে অনেক বিল ছিল। ঐ সকল বিল কুমলাবন ও বেতালোহায় সমাকীর্ণ ছিল। গ্রামীণ গরিব গৃহস্থগণ বিল হতে কুমলাবন সংগ্রহ করে খড়ের ঘর নির্মাণ করত। ঐ কুমলাবন হতে কমলাপুর। আধুনিক গবেষণায় জানা যায়, পর্তুগিজরা কালকিনি অঞ্চলে কমলা চাষের প্রচলন করে। এখানে এক পর্তুগিজ স্থায়ী নিবাস করে বিশাল এক কমলা বাগান সৃজন করে। তাই এলাকাটির নাম হয় কমলাপুর।
বাঁক শব্দ হতে বাকাই। নদীর বাঁকের গ্রাম। তাই নাম বাকাই। কাজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহ বোরহান লাহোরি নদীর বাঁকে বসতি স্থাপন করার পর বাকাই নাম পায়। বেতবাড়ি নামে পরিচিত অঞ্চলটি বেতালোহা ও বেত-এর জন্য বিখ্যাত ছিল। তাই নাম বেতবাড়ি। অনেকে মনে করেন, এখানে এক সময় বেত দিয়ে বাড়ি তৈরি করা হতো তাই বেতবাড়ি। খিল শব্দের অর্থ চাষাবাদের অযোগ্য জমি বা চাষাবাদে আংশিক যোগ্য কিন্তু চাষ করা হয় না, এরূপ অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিকে বোঝায়। এরূপ খিলভূমিতে বসতিস্থাপন করায় নাম হয় খিলগ্রাম। খিলগ্রামের উত্তরাংশ উত্তর খিলগ্রাম এবং দক্ষিণাংশ দক্ষিণ খিলগ্রাম।
অনেকে মনে করেন, আড়–য়াকান্দি নামটি নাকি আড়াইয়াকান্দি হতে সৃষ্ট। আড়াইটি কান্দি নিয়ে এটি গঠিত। তাই আড়াইয়াকান্দি, অপভ্রংশে আড়ুয়াকান্দি। তবে এটি ঠিক নয়। বস্তুত রাঢ় গোষ্ঠীভুক্ত জনসংখ্যার বসতির জন্য কালকিনি একসময় রাঢ় বা আড়–য়াকান্দি নামে পরিচিত ছিল। দর্শন হতে দর্শনা নামের উৎপত্তি। এলাকাটিতে প্রাচীন পুরকীর্তিময় অনেক ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান ছিল। এগুলো দর্শন করার জন্য প্রচুর লোকজন আসত। তাই নাম দর্শনা। বন হতে গ্রাম, তাই বনগ্রাম। বন কেটে গ্রামের পত্তন ঘটানো হয়েছিল বলে বনগ্রাম। মুসলমান সুলতানগণ প্রায় শতাধিক বছর বাংলাদেশে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এ সময় সেন বংশের বিভিন্ন রাজকুমার ও উত্তরাধিকারীগণ বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। সেন রাজাদের প্রতিনিধি হিসেবে গোপাল সেন নামক এক রাজকুমার মাদারীপুর-কালকিনি অঞ্চল শাসন করতেন। পুরো ফরিদপুর ছিল তার শাসনক্ষেত্র। তিনি প্রথমে ইদিলপুর ও পরবর্তীকালে গৈলা-ফুল�শ্রীতে রাজধানী স্থাপন করেন। গোপাল সেন-এর নামানুসারে এলাকাটির নাম হয় গোপাল সেনপুর। গোপালপুর ইউনিয়নও তার নামানুসারে হয়েছে।

কালকিনির ইতিহাস
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দের মধ্যভাগে বাকলা অঞ্চল মৌর্য শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। চতুর্থ শতকে কালকিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। বৃহত্তর ফরিদপুর ও বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকায় সমুদ্রগুপ্তের (৩৪০-৩৮০ খ্রি.) এলাহাবাদ স্তম্ভের শিলালিপি ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তযুগের স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কার হয়েছে। এ আবিষ্কার কালকিনিতে গুপ্ত রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রমাণ বহন করে। কোটালীপাড়ায় আবিষ্কৃত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত আমলের স্বর্ণমুদ্রা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকে আরও সুদৃঢ় করে। বৃহত্তর ফরিদপুর ও বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকায় যে সকল তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে প্রতীয়মান হয় যে, ষষ্ঠ শতকে কালকিনি ধর্মাদিত্যের বিশাল সাম্রাজ্যের আওতাধীন ছিল। ধর্মপ্রাণ ও দয়ালু সম্রাট ধর্মাদিত্য প্রজাদের পানীয়জলের সুবিধার জন্য কালকিনিতে অনেক পুকুর খনন করেছিলেন। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণ বিবরণ অনুযায়ী সপ্তম শতকে কালকিনি ও আশেপাশের এলাকা রাজা শশাঙ্ক ও হর্ষবর্ধনের রাজ্যভুক্ত ছিল। তৎকালীন কালকিনিসহ বর্তমান বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকায় তাদের রাজ্য ও শাসনের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন এখনও দেখা যায়। গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া হতে তিন চতুর্থাংশ মাইল দূরে গোয়াখোলা গ্রামের সোনাকান্দুরী মাঠ খননকালে প্রাপ্ত মুদ্রা এ সব তথ্য প্রমাণের নির্ভরযোগ্যতার স্মারক।
৮১৫ খ্রিস্টাব্দ হতে কালকিনি এলাকায় বৌদ্ধ রাজত্ব শুরু হয়। বৌদ্ধদের রাজ্য শাসন দশম শতকের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বলবৎ ছিল। প্রায় দুইশত বছর কালকিনি বৌদ্ধ রাজত্বের অধীনে ছিল। ভাটি অঞ্চলে বৌদ্ধ রাজবংশের প্রভাবশালী কেউ নিবাস গড়ে তোলার প্রয়াস নেয়নি।। বৌদ্ধ শাসকেরা পুরোনো হিন্দু কর্মচারী দিয়ে রাজ্য পরিচালনা করেছেন। কয়েকটি এলাকায় বৌদ্ধ রাজকর্মচারীদের কেউ কেউ অস্থায়ী নিবাস গড়ে তুললেও পরবর্তীকালে হিন্দু রাজাদের আমলে রাজরোষের কারণে এলাকা ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বাধ্য হয়। ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে বৌদ্ধ রাজাদের রাজধানী ছিল। তাঁরা চন্দ্র নামে খ্যাত ছিল। ইদিলপুর ও কেদারপুরে বৌদ্ধযুগের চন্দ্র আমলের তাম্রলিপি পাওয়া গেছে।১ হিন্দু আগ্রাসনের কারণে দশম শতকের শেষভাগে বৌদ্ধ যুগের অবসান ঘটে। এরপর ক্ষমতায় আসে বর্মণ রাজবংশ। ৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে কালকিনি এলাকায় ব্রাহ্মণ রাজাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালকিনিতে ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণœ থাকে। পরবর্তী ৯৩ বছর কালকিনি বিভিন্ন সামন্ত রাজা ও জমিদারদের অধীনে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে শাসিত হয়। এ সময় কোনো একক রাজা বা ভূ-স্বামী কালকিনির ওপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
১১৫০ খ্রিস্টাব্দে সেন রাজবংশ ক্ষমতা দখল করার কিছুকাল পর, ফরিদপুরসহ কালকিনিতে সেনবংশের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১১৫০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালকিনি প্রথমে সেন এবং পরে পাল রাজাদের অধীনে শাসিত হয়। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বঙ্গদেশ দখল করে নদিয়ায় রাজধানী স্থাপন করেন। নদিয়ায় সেনবংশের পতন ঘটলেও কালকিনি বখতিয়ার খিলজির নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে ছিল। সে সময় কালকিনি লক্ষ্মণ সেনের অনুগত সামন্তশাসক দ্বারা শাসিত হতে থাকে। নদিয়া হতে লক্ষণ সেনের রাজ দরবারের অনেক অমাত্য কালকিনি অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বখতিয়ার খিলজির হাতে বাংলায় মুসলিম যুগের সূচনা। এরপর বাংলাদেশের ইতিহাসে মুহম্মদ তুঘলক, ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ, শামসুদ্দিন ইলিয়াশ শাহ, সিকান্দর শাহ, আজম শাহ, মাহমুদ শাহ প্রমুখ মুসলিম শাসকগণ বঙ্গদেশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেও, ভাটি অঞ্চল কালকিনির প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। আগ্রহ থাকলেও দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রশাসনিক সংকট ও নিরাপত্তার কারণে বাংলার মুসলিম শাসকগণ কালকিনিতে একচ্ছত্র প্রভাববলয় প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ফলে ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তারা বঙ্গদেশ শাসন করলেও কালকিনি সেন ও পাল বংশ প্রভাবিত বিভিন্ন হিন্দু জমিদার ও সামন্ত প্রভুদের নিয়ন্ত্রণে থেকে গিয়েছিল।
আরব বংশোদ্ভুত হুসাইন শাহ শাসন ক্ষমতা অধিকার করার পর ভাটি অঞ্চলের দিকে নজর দেন। ব্লককম্যানের ভাষ্য মতে, হুসাইন শাহ সিংহাসনে (১৪৯৩ খ্রিঃ-১৫১৯ খ্রিঃ) আরোহনের কিছুদিন পর ফরিদপুর দখল করে নেন। কয়েক মাসের মধ্যে মাদারীপুর হয়ে কালকিনি পর্যন্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। এরপর এখানে মুসলমানদের আনাগোনা ও নিবাস গড়ে তোলার প্রক্রিয়া জোরেসোরে শুরু হয়। ইতোমধ্যে ফতেয়াবাদ (বর্তমান নাম ফরিদপুর) দখল করে হুসাইন শাহ নতুন মুদ্রা চালু করেন। ক্ষমতাকে সুসংহত করার সাথে সাথে তিনি তাঁর ও তাঁর ভাইদের নামে খুলনা, যশোর, পাবনা, ফরিদপুর ও মাদারীপুরের বিভিন্ন পরগনার নামকরণ করেন। বৃহত্তর ফরিদপুর ও কালকিনির বিভিন্ন এলাকায় হুসাইন শাহের আত্মীয়স্বজনের নামকরণ সংবলিত এলাকা এখনও বিদ্যমান। তৎকালীন ফতেয়াবাদ ছিল হুসাইন শাহের অন্যতম প্রধান শহর। পরবর্তীকালে জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহ ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কালকিনি, ঢাকা ও বাকেরগঞ্জের কিয়দংশ, দক্ষিণ শাহবাজপুর এবং সন্দ্বীপ-হাতিয়া নিয়ে একটি সরকার গঠন করেন। উল্লেখ্য ‘সরকার’ বলতে বর্তমান বিভাগের মর্যাদাস¤পন্ন প্রশাসনিক এলাকা বোঝাত। নবরতেœর অন্যতম আবুল ফজল বিরচিত আইন-ই-আকবরি গ্রন্থের ভাষ্যমতে-এ সরকার অঞ্চলটির নাম ছিল মাহমুদাবাদ। সরকার মাহমুদাবাদে বৃহত্তর ঢাকা জেলা, ফরিদপুর, কালকিনি ও কুষ্টিয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এরপর কালকিনিতে মোগল যুগের সূচনা ঘটে। আকবরনামা অনুসারে, ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে মোগল সেনাপতি মুরাদ খান ফতেয়াবাদ ও সরকার বাকলা (বাকেরগঞ্জ) আক্রমণ করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বর্তমান ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর অঞ্চলকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। মুরাদ খান ফতেয়াবাদ হতে তেরো মাইল দূরে খানখানাবাদ গ্রামে আবাসস্থল নির্মাণ করেছিলেন। ছয় বছর পর তিনি খানখানাবাদ প্রাসাদে মারা যান। প্রবাদ আছে, ভূষণা ও ফতেয়াবাদের হিন্দু জমিদার মুকুন্দ দাওয়াত করেন মুরাদ খানকে । মুরাদ খান সপরিবারে দাওয়াত গ্রহণ করে মুকুন্দ রায়ের বাড়িতে এলে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাঁদের হত্যা করা হয়। সম্রাট আকবরের শাসনামলে কালকিনিতে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের পূর্বপুরুষ শাহ ওসমানের আগমন ঘটে।
মোগল সম্রাট আকবর উপমহাদেশে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও তাঁর শাসনের মধ্যভাগ পর্যন্ত বঙ্গদেশের সর্বত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। ষোড়শ শতকে বারো ভুঁইয়া নামে পরিচিত বারোজন জমিদার বঙ্গদেশকে বারোটি ভাগে বিভক্ত করে প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন করতে শুরু করেন। বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম চাঁদ রায় এবং কেদার রায় তাদের রাজ্যসীমা ঢাকার রাজবাড়ি হতে শুরু করে কালকিনি হয়ে শরীয়তপুর জেলার পালং থানার অন্তর্ভুক্ত কেদারবাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সম্রাট আকবরের পর সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৬০৬-১৬২৭খ্রি.) দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। বঙ্গদেশে নিয়োজিত গভর্নর ইসলাম খান পূর্ববঙ্গে মোগল শাসনকে সুসংহত ও বিস্তৃত করে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস নেন। বস্তুত ইসলাম খানই প্রথম ফরিদপুর-কালকিনি অঞ্চলে মোগল সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর পূর্বে বঙ্গদেশে মুসলিম সম্রাটগণ রাজ্য শাসন করলেও বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত কালকিনি ছিল মুসলমান সম্রাটদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখানে হিন্দু জমিদারেরাই ছিল প্রকৃত শাসক। ইসলাম খান গভর্নর হয়ে আসার স্বল্প সময়ের মধ্যে ফরিদপুর দখল করে নেন। এরপর তিনি অতি দ্রুত বৃহত্তর ফরিদপুর এলাকার সর্বত্র ক্ষমতা সুসংহত করে নিতে সক্ষম হন। তখন হতে কালকিনি এলাকা প্রকৃত অর্থে মুসলমান শাসকদের নিয়ন্ত্রণে আসে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের পর থেকে মোগলদের পতন পর্যন্ত কালকিনি মোগল শাসকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ইংরেজ ও পাকিস্তান আমল
আলিবর্দি খান (১৭৪০-১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ) দেশে রাজনীতিক স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হন। ব্রিটিশ, ফারসি ও ডাচ বণিকেরা তাঁর শাসনকে দুরূহ করে তোলে। পলাশির যুদ্ধে সিরাজউদৌল্লা পরাজয় বরণ করার পর বঙ্গদেশে ইংরেজ শাসন প্রসারিত হওয়ার পথ সুগম হয়। মীর জাফর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে চব্বিশ পরগণা অঞ্চলটি উপহার দেন। চব্বিশ পরগণার জমিদারি লাভের পর ইংরেজরা এলাকার ঐশ্বর্য বিশেষ করে কাষ্ঠ সম্পদের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। চব্বিশ পরগণার কালেক্টর ক্লড রাসেল ও টিলম্যান হেঙ্কেলসহ আরও কয়েকজন ইংরেজ শাসক কালকিনি এলাকার অনাবাদি জমি আবাদের উদ্যোগ নেন। ক্লড রাসেল ১৭৭০ হতে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কিছু জমি লিজ দেন। জঙ্গলাবৃত জমি জমিদারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে হেঙ্কেলের নেতৃত্বে কালকিনির জমিকে ছোট ছোট প্লটে বিভক্ত করে কৃষকদের মধ্যে বিতরণের প্রস্তাব দেয়া হয়। হেঙ্কেল কালকিনির জমিগুলোকে ভবিষ্যৎ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভাবনায় বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন। জঙ্গল পরিষ্কার করে যারা চাষাবাদ শুরু করবেন হেঙ্কেল তাদের অগ্রাধিকার দেয়ার কথা ঘোষণা করলে অনাবাদি জমি চাষের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। হেঙ্কেলের অনুমোদন নিয়ে অধীনস্তরা জমি বিলিবণ্টন করা শুরু করেন। বণ্টিত জমিকে খাস আবাদ তালুক ও হেঙ্কেলের তালুক বলা হতো। তালুকগুলোর শাসন ও রাজস্ব সংগ্রহের জন্য চৌকি স্থাপন করা হয়। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে হেঙ্কেলের প্রস্তাব গভর্নর জেনারেলের অনুমোদন লাভ করে। প্রস্তাবে প্রথম তিন বছরের জন্য জমি চাষে কোনো রাজস্ব আরোপ করা হয়নি। চতুর্থ বছর বিঘা প্রতি দু’আনা দু’সিক্কা রাজস্ব নির্ধারিত হয়। বছর বছর রাজস্ব বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব সিরাজউদৌল্লাার পরজয়ের পর বঙ্গদেশে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত ঘটে। তবে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেনি। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন লর্ড ক্লাইভ মীর জাফর আলী খানকে গদিতে বসান। সপ্তাহব্যাপী রাজনৈতিক শূন্যতায় রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও অন্যান্য সম্পদের ব্যাপক লুটতরাজ হয়। সিরাজউদৌল্লার পতনের পর মুসলমানগণের প্রভাব ও আভিজাত্য হ্রাস পেতে থাকে। 
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর ইংরেজ কোম্পানি মীর জাফরের জামাতা মীর কাশিমের সাথে গোপন আঁতাত করে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। চুক্তি অনুযায়ী সিংহাসনের পরিবর্তে বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম এ তিনটি জেলার বিনিময়ে নবাবের কাছে পাওনা অর্থ পরিশোধ হয়েছে মর্মে ঘোষণা করা হয়। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের ২০ অক্টোবর মীর কাশিম নবাব ঘোষিত হয় কিন্তু তিনি পুতুল নবাব হিসেবে থাকার পাত্র ছিলেন না। ইংরেজদের সাথে তাঁর দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর বক্সারের যুদ্ধে সেকেলে রণকৌশল ও প্রাচীন অস্ত্রাধিকারী সম্মিলিত বিশাল বাহিনী স্বল্প সংখ্যক অথচ আধুনিক রণকৌশল ও মারণাস্ত্রের অধিকারী ইংরেজদের হাতে পরাজয় বরণ করে। ইংরেজগণ মীর জাফরকে পুনরায় নবাবের গদিতে বসায়। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ডক্লাইভ দিল্লি গিয়ে বাদশাহ শাহ আলমকে প্রচুর নজরানা ও রাজস্ব আদায়ের লোভ দেখিয়ে এলাহাবাদ দিওয়ানি চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। চুক্তির ফলে ইংরেজগণ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে।
লর্ড ক্লাইভ সৈয়দ মোহাম্মদ রেজা খানকে দিওয়ানি শাসন পরিচালনার পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করেন। ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ মে নবাব নাজমউদৌল্লার মৃত্যু হয়। নতুন নবাব সাইফউদৌল্লাহ অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিলেন। এ অজুহাতে তাঁর ভাতা হ্রাস করা হয়। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে সাইফউদৌল্লাাহ মারা গেলে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মোবারকউদৌল্লা নবাব হন। ব্রিটিশ আধিপত্যকে কলকাতা-মুর্শিদাবাদ হতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তারের লক্ষ্যে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট প্রতি জেলায় একজন করে ইউরোপীয় সুপারভাইজার নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। যশোর জেলায় মিস্টার হেঙ্কেলকে নিয়োগ দেয়া হয়। উল্লেখ্য, এ সময় গোয়ালন্দ মহকুমা ও গোপালগঞ্জের কিছু অংশ যশোর জেলার অধীন ছিল।
নবাবের সঙ্গে কোম্পানির ক্ষমতা ভাগাভাগির ফলে দেশে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। জমিদারগণ ইচ্ছেমতো খাজনা আদায় ও প্রজাদের ওপর শোষণ চালাতে থাকে। প্রশাসন ভেঙে পড়ে, জনজীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। চাষাবাদসহ আর্থনীতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসে। কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসার প্রসারের জন্য রাজনীতিক ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করে। তারা নিজেদেরকে আইনের ঊর্ধ্বে গণ্য করে মফস্বলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তাদের সাথে যোগ দেয় জমিদার ও স্বার্থান্বেষী দেশীয় কিছু লোক। ফলে ১৭৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দে দেখা দেয় মহাদুর্ভিক্ষ। কালকিনির এক তৃতীয়ংশ লোক দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করে। ইংরেজরা দুর্ভিক্ষের জন্য রেজা খানকে দায়ী করে। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ এপ্রিল রেজা খানকে বহিষ্কার করে দুর্নীতির দায়ে বন্দি করা হয়। নায়েব দিওয়ানের পদ বিলুপ্ত করে দিওয়ানি দপ্তর কলকাতায় স্থানান্তর করা হয়। দিওয়ানি শাসন সরাসরি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ হতে মুর্শিদাবাদের মসনদ প্রহসনে পরিণত হয়। নবাব ক্ষমতাহীন সাজসর্বস্ব পুতুল হয়ে যায়। ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট হতে প্রশাসন থেকে দেশীয় কর্মকর্তাদের উচ্ছেদ করে ইউরোপীয় কর্মকর্তা নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৭৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস রেজা খানসহ দেশীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করে ইউরোপীয়ানদের সমন্বয়ে একটি প্রশাসনিক কাঠামো নির্মাণ করেন। তিনি প্রতি জেলায় একজন ইউরোপীয় কালেক্টর ও কয়েকজন ইউরোপীয়ান কর্মকর্তা নিয়োগ করে ইংরেজ শাসনকে আরও সুসংহত করেন। প্রতি জেলায় ইউরোপীয়দের পাশাপাশি সমমর্যাদার একজন দেশীয় দিওয়ান পদ সৃষ্টি করে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়।
১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে রেগুলেটিং এ্যাক্ট-এর অধীনে ভারতে কোম্পানির বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করা হয়। গভর্নর জেনারেলকে সভাপতি করে চার সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিল গঠন করা হয়। কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে রেজা খানকে মুক্তি দিয়ে নায়েব সুবা ও নায়েব দিওয়ান নিযুক্ত করা হয়। ফৌজদারি আদালত পুনরায় কলকাতা হতে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করে মুর্শিদাবাদকে সুবার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। রেজা খান এবার আগের মতো স্বাধীনচেতা হওয়ার সাহস দেখাতে পারলেন না, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য হন। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস দিওয়ানি ও নেজামত ক্ষমতা পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করতে শুরু করেন। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে জেলা সুপারভাইজার নিয়োগের মাধ্যমে প্রশাসনে প্রথম শ্বেতাঙ্গদের অনুপ্রবেশ ঘটে। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ হতে পুনরায় ইউরোপীয় প্রশাসক নিয়োগ শুরু হয়। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে কর্নওয়ালিস সকল দেশীয় কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে ইউরোপীয় কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। জেলা কালেক্টরকে জেলার রাজস্ব, পুলিশ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা দেয়া হয়। ব্রিটিশ স্টার্লিং হারে একজন জেলা কালেক্টরের বেতন ছিল মাসিক দুই হাজার úাউন্ড, যা ব্রিটেনের সর্বোচ্চ সচিবের বেতনের দ্বিগুণ।
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হলে তাদের জমিদারি নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা করে সূর্যাস্ত আইন জারি করা হয়। এ নীতিতে কালকিনির অনেক জমিদারের জমিদারি হস্তচ্যুত হয়। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিসের ব্যবস্থায় নবাবের ফৌজদারি ক্ষমতা সম্পূর্ণ রহিত করে তাঁকে পেনশন ভোগীতে পরিণত করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দশ বছরের মধ্যে বর্ধমান রাজার জমিদারি ব্যতীত বঙ্গদেশের সকল বড়বড় জমিদারি এস্টেট নিলামে ওঠে। কালকিনির জমিদারগণের অর্ধেকের বেশি জমিদারি নিলামে ওঠে এবং অল্প সময়ের মধ্যে অস্বাভাবিক দ্রুততায় তারা অনেকে প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়ে। লাখেরাজ সম্পত্তি ব্যতীত অনেক জমিদারের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তারপরও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কালকিনিসহ বঙ্গদেশে যথাযথ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়। তারা বুঝতে পারে যে, সরকারি রাজস্বের বেশির ভাগ মাদাদ-ই মাআশ নামের ফন্দিবাজ জমিদারেরা বাগিয়ে নিচ্ছে। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে সপ্তম আইন জারির মাধ্যমে জমিদারগণকে খাজনা আদায়ের জন্য কৃষকদের মালামাল, গরুবাছুর, শস্য ইত্যাদি ক্রোক করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমিদারগণ গ্রেফতারের অধিকারও লাভ করে। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে প্রজাকে গ্রেফতারের ক্ষমতা রহিত করা হলেও ফসল আটকের ক্ষমতা বহাল থাকে। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে সূর্যাস্ত আইন পাশ করা হয়। এ আইন অনুসারে ৩০ চৈত্রের মধ্যে বার্ষিক রাজস্ব খাজনা প্রদানের সর্বশেষ তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এ আইন জারির ফলে জমিদারগণ যে কোনো উপায়ে প্রজাদের নিকট হতে খাজনা আদায় করে রাজস্ব প্রদানের ব্যবস্থা করতেন। ফলে প্রজা সাধারণ আরও নিগৃহীত হতে থাকে।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস গঠিত হয়। মুসলমানগণ ক্রমশ সচেতন হয়ে ওঠে এবং নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়াস নেয়। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে নবাব আহসানউল্যার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নবাব সলিমুল্লাহ এস্টেটে গদিনশিন হন। মুসলমানদের সহানভূতির প্রত্যাশায় সরকার তাঁর প্রতি যথেষ্ট অনুকূল ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষণার পরপরই কংগ্রেসের নেতৃত্বে হিন্দু সম্প্রদায় আন্দোলন শুরু করে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ করা হলে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে ওঠে। কংগ্রেস ও হিন্দুসম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গ রোধ করার জন্য আন্দোলন শুরু করে এবং ব্রিটিশ পণ্যবর্জনের ডাক দেয়। মুসলমানেরা বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নিলে দুই সম্প্রদায় মুখোমুখি হয়। কালকিনির হিন্দু সম্প্রদায় অর্থবিত্ত ও শিক্ষাদীক্ষায় মুসলমানদের থেকে অনেক এগিয়ে থাকায় হিন্দুদের সাথে পেরে ওঠা কষ্টকর হচ্ছিল। ইতোমধ্যে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগ গঠন করা হয়। কালকিনির অনেক প্রভাবশালী লোক কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লিগে যোগদান করেন। হিন্দু জমিদারগণের অত্যাচার ও নিপীড়নে অতিষ্ঠ মুসলমানেরা মুসলিম লিগে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের মুক্তির পথ খোঁজে।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করে। কিন্তু কালকিনির মুসলমানগণ পরম ধৈর্যে পরিস্থিতি অবলোকন করে। হিন্দু জমিদারগণ মুসলমানদের বঙ্গভঙ্গ রদের বিপক্ষে আন্দোলন না-করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। জমিদারগণ কৃষকদেরকে আন্দোলন হতে বিরত না-থাকলে উচ্ছেদ করার হুমকি দেয়। অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গভঙ্গের পক্ষে প্রকাশ্যে আন্দোলন করা হতে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। হিন্দুরা বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়ে মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিদেশি পণ্য বিক্রয়ে বাধা প্রদান করে। এ অবস্থায় কালকিনির নেতৃবৃন্দ সংগঠিত হয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোাগানের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের প্রয়াস নেন। জামালপুরে মুসলমানদের আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। বকশীগঞ্জ হতে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তি বাংলাদেশের অনেক জায়গায় প্রচার করা হয়। এতে লেখা ছিল-

“মুসলমান ভাইদের এতদ্বারা বলা হচ্ছে যে, তারা সকলে জানে কি করে জামালপুরের মুসলমানেরা আহূত হয়ে স্বদেশী আন্দোলনে নিযুক্ত হিন্দুদের দমন করেছে। হে মুসলমান ভাইয়েরা, তোমরা কি জানো যে, সরকার এবং নবাব সলিমুল্লাহ সাহেব সম্পূর্ণভাবে আমাদের সমর্থক? সুতরাং, আমরা আর কার পরোয়া করবো? লাঠি ধর, হিন্দুদের বিতাড়িত কর, খামা হিন্দুদের মাথা ভেঙ্গে দাও এবং ধুলায় মিশিয়ে দাও। যে এ বিজ্ঞপ্তি ছিড়বে সে তার মাকে অপহরণ করেছে বলে সাব্যস্ত করা হবে।” 
এতকিছুর পরও কালকিনির কোনো মুসলমান হিন্দুদের ওপর কোনো আক্রমণাত্মক ব্যবহার করেনি।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কৃষক প্রজা পার্টির নেতা এ কে ফজলুল হক বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নিয্ক্তু হন এবং ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ফজলুল হকের নেতৃত্বে দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বহাল থাকেন। এরপর নাজিমুদ্দিন মুখ্যমন্ত্রী হন। তিনি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৪৫ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। তিনি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন। ১৯৪৩ হতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম লিগ বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন থাকে। ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ও কৃষিখাতক আইন; ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মহাজনি আইন এবং ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় চাকুরি নিয়োগ বিধি বা সম্প্রদায়ভিত্তিক বণ্টনবিধি আইন জারি করে সাধারণ মানুষের প্রভূত কল্যাণ সাধন করেন। প্রজাস্বত্ব আইন পাশ করে জমিদারদের জমি হস্তান্তর সংক্রান্ত ফি, জমিদারদের জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার, সার্টিফিকেট প্রথার মাধ্যমে খাজনা আদায় ও চাষিদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ আদায় বা আবওয়াব প্রথা বাতিল করা হয়। বিশ বছর সময় অতিক্রান্ত হওয়ার আগে মাত্র চার বছরের খাজনা পরিশোধ করে চাষিরা সিকস্তি জমি পুনরুদ্ধারের সুযোগ লাভ করে। বকেয়া খাজনার ওপর ধার্যকৃত সুদের হার ১২.৫% হতে ৬.২৫% নামিয়ে আনা হয়। জমির ওপর খাজনা বৃদ্ধি দশ বছরের জন্য স্থগিত ও ঋণসালিসি বোর্ড গঠন করা হয়। বঙ্গীয় মহাজনি আইন পাশ করে সুদের হার স্থির করে দিয়ে সকল মহাজনের জন্য ট্রেড লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়। সাম্প্রদায়িক বণ্টনবিধি অনুসারে ৫০% চাকুরি মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। এসব আইনে সাধারণ কৃষক প্রজাগণ সন্তুষ্ট হলেও প্রভাবশালী মহল কৃষক প্রজাপার্টির উপর নাখোশ হয়। ফলে এ কে ফজলুল হক ও কৃষক প্রজাপার্টির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। পরবর্তী নির্বাচনে কৃষক প্রজাপার্টি পরাজিত হয়।
তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর লেখা কয়েকটি গ্রন্থ ও প্রবীণ ব্যক্তিবর্গের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ত্রিশ-চল্লিশের দশকেও কালকিনিতে মুসলমানগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থা শোচনীয় ছিল। জমিদার ও অভিজাত হিন্দুদের নিপীড়ন, নির্যাতন, অবহেলা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করার সুযোগ ছিল না। সিরাজউদৌল্লার পতনের পর হতে আস্তে আস্তে মুসলমানদের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থনীতিক অবস্থার পতন হতে হতে বিশের দশকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে আসে। জমিদারগণ কৃষকদের নিকট হতে নির্ধারিত খাজনা ছাড়াও প্রতিনিধির বকশিস, খালবন্দি (বাঁধ খরচ), দাখিলা খরচ (খাজনা আদায় খরচ), পোল খরচ (সেতু তৈরি), ডাক খরচ, ভাণ্ডারি খরচ (হাটবাজারের রক্ষণাবেক্ষণ), শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খরচ, চিকিৎসালয় ও বেগার খরচ (মজুরিবিহীন শ্রম) ইত্যাদিসহ আরও বহুবিধ খাজনা আদায় করতেন। এছাড়া ব্যক্তিগত পালকি ব্যবহারের অনুমতি লাভের জন্য ১০ হতে ২৫ টাকা, ছাতা ব্যবহারের জন্য ২ হতে ৫ টাকা, হাতিতে চড়ার অনুমতি লাভের জন্য ৩০ হতে ৪০ টাকা, পুকুর খনন করার অনুমতির জন্য ২০ হতে ৪০ টাকা, কোনো বড় অনুষ্ঠান করার অনুমতির জন্য ১৫ টাকা খাজনা প্রদান করতে হতো। এক কথায়, মুসলমান কৃষকদের সর্বপ্রকার সামন্তবাদী বৈষম্যমূলক নিপীড়ন বিনা প্রতিবাদে সহ্য করতে হতো। জমিদারগণের আইন অমান্য করলে বেত কিংবা জুতো দিয়ে পেটানো হতো। ফরিদপুর কালেক্টরেটের জমির মালিকানা দলিল পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কালকিনিতে ১৩৫টি গ্রামে ৮৯০ জন গাঁতিদারের মধ্যে মুসলমান গাঁতিদার ছিল মাত্র ১৯৭ জন। তাও ক্ষুদ্র গাঁতিদার। জমির পরিমাণ বিবেচনায় সমস্ত জমির মধ্যে মুসলমানগণের মালিকানাধীন জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৪.০৯ শতাংশ। অধিকাংশ মুসলমান ছিল হিন্দু মালিকদের জমির ভাগচাষি ও দিনমজুর। হিন্দুরা মুসলমানদের নিম্নশ্রেণির হিন্দু হতে ধর্মান্তরিত হিসেবে গণ্য করত। নিচু শ্রেণি হতে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে আরও নিচুশ্রেণিতে পরিণত হওয়ায় তাদের সামাজিক মর্যাদা বলে কিছু ছিল না। জমিদারগণ হিন্দু ডোমদের চেয়েও মুসলমানদের নিকৃষ্ট মনে করতেন। কোনো মুসলমান ব্রাহ্মণের বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে পারত না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমান ছাত্রদের পেছনের ভাঙা বেঞ্চে বসতে দেয়া হতো। হিন্দু ছেলেরা তাদেরকে চণ্ডালের চেয়েও ঘৃণার চোখে দেখত। কয়েকজন হিন্দু জমিদার দাড়ির জন্য প্রতি বছর ২ টাকা খাজনা আদায় করতেন। যারা খাজনা দিতেন না, তাদের দাড়িতে গরম আলকাতরা লাগিয়ে শাস্তি দেয়া হতো। গ্রামে প্রকাশ্যে কোনো গরু জবাই করতে দেয়া হতো না। জমিদার বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানের দাওয়াতে মুসলমান গাঁতিদারদের নিচু শ্রেণির হিন্দু দিনমজুরদের সাথে মাদুরে বসতে দেয়া হতো; অন্যদিকে মুসলমান কৃষকদের মাটিতে কিংবা শুকনো ঘাসের উপর বসতে দিত। কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে গরু জবাই করতে হলে জমিদারকে প্রায়শ্চিত্য স্বরূপ ৩০ টাকা খাজনা দিতে হতো। তাও সহজে অনুমতি পাওয়া যেত না। জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে জুতো পায়ে ও ছাতা মাথায় চলা নিষিদ্ধ ছিল। কেউ আদেশ অমান্য করলে জমিদার বাড়ির অন্ধ কুটিরে বন্দি করে রাখা হতো। অন্ধকুটিরে প্রজাদের বন্দি করে বিভিন্ন কায়দায় শাস্তি দেয়া হতো। জমিদারগণ ধর্মের ষাঁড় ছেড়ে মুসলমান প্রজাদের ক্ষেত খাইয়ে দিত। প্রতিবাদ করলে তাঁকে উচ্ছেদ করার হুমকি দেয়া হতো।
পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলমান সম্প্রদায় এরূপ নির্যাতন হতে মুক্তি পাওয়ার প্রত্যাশায় আনন্দ উচ্ছ্বাসে উদ্বেল হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট মধ্য রাতে পাকিস্তান রাষ্ট্র ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে রাত বারোটায় কালকিনির হাজার হাজার লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে নারায়ে তাকবির- আল্লাহু আকবর মিছিল সহকারে বাড়ি হতে বেরিয়ে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করে। আনন্দ উচ্ছ্বাসবহুল মিছিল-সমাবেশ সপ্তাহব্যাপী বহাল থাকে। ঘরে ঘরে মিষ্টি ও শিরনি বিতরণ করা হয়। মহিলারাও গ্রামে গ্রামে নিজস্ব পরিমণ্ডলে আনন্দ শুরু করে। আবালবৃদ্ধবণিতার চোখে মুখে ফুটে ওঠে স্বস্তির নিশ্বাস। এতদিন পর কালকিনির মানুষের মুখে হাসি ফোটে। বিপুল সংখ্যক উঁচু বর্ণের হিন্দু কালকিনি ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গ চলে যায়। নিচু বর্ণের অনেক হিন্দুও ভারত চলে যায়। এখানে প্রবল প্রতাপ ও সহায় সম্পদ থাকার পরেও সামাজিক পরিস্থিতি, ধর্মীয় ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির শঙ্কা এবং পূর্বেকার আচরণের কথা ভেবে তারা বাংলাদেশ ত্যাগ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সিংহভাগ শিক্ষক ছিল হিন্দু। তাদের গণহারে দেশত্যাগের ফলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও ছাত্রশূন্য হয়ে পড়ে। অনেকগুলো মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। মুসলমানদের মধ্যে এমন শিক্ষিত ছিল না, যাদের দিয়ে স্কুল পরিচালনা করা সম্ভব। অভিজাত হিন্দুদের গণহারে দেশত্যাগের পর চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তবু মানুষ সামাজিক নিপীড়ন ও ধর্মীয় বাস্তবতায় উদ্বেল হয়ে ওঠে। তাদের অতীত বিষাক্ত, ভবিষ্যতের স্বপ্নীল প্রত্যাশার ডাক বিভোর করে রাখাটা অপ্রত্যাশিত কিছু ছিল না।
অল্পদিনের মধ্যে মানুষের আনন্দ উচ্ছ্বাস আফসোসে পরিণত হয়। অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যেতে থাকে। বেড়ে যেতে থাকে বেকারত্ব। অনেক মুসলমান পশ্চিমবঙ্গ হতে এখানে চলে আসে। হাজার হাজার রিফিউজি কালকিনির বিভিন্ন খাস ও পরিত্যক্ত জমি দখল নিয়ে বসতবাড়ি গড়ে তোলে। পশ্চিমবঙ্গে যারা চাকুরি করত তারা চাকুরি ছেড়ে এখানে চলে আসে। দেশ বিভাগের পূর্বে নেতৃবৃন্দ যে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন তা সোনার হরিণে পরিণত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত অধিকাংশ সময় জুড়ে পাকিস্তান ছিল সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক আইন জারি করা হলেও, এর পূর্বে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদানের জন্য বেশ কয়েকবার স্থানীয় পর্যায়ে স্বল্পমেয়াদী সামরিক আইন জারি করা হয়েছিল। শাসকশ্রেণি পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে উপনিবেশ হিসেবে শাসন করতে শুরু করে। প্রথমে আঘাত হানে ভাষার ওপর। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে তারা ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্র“য়ারি ভাষার জন্য শহিদ হয় অনেকে। এখনকার মতো তখন এত পত্রিকা ছিল না। রাজধানীর পত্রিকার মধ্যে কালকিনি আসত শুধু দৈনিক আজাদ। ইত্তেফাক তখনও সাপ্তাহিক। মাঝে মাঝে আসত। শিক্ষিতদের কেউ কেউ স্টেটসম্যান পড়তেন। রেডিওতে আন্দোলনের কোনো খবর আসত না। তবু কালকিনিবাসী বিভিন্নভাবে খবর সংগ্রহ করে নেয়। ২১ ফেব্র“য়ারি কালকিনিতে পরিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। পাকিস্তানি উপনিবেশ হতে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে প্রত্যেকটি আন্দোলনে কালকিনির নেতৃবৃন্দ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

প্রশাসনিক বিবর্তন
ব্রিটিশ শাসনামলের প্রারম্ভে ফরিদপুরের উত্তর-পশ্চিমাংশ রাজশাহী জমিদারির আওতাভুক্ত করা হয়েছিল। অন্যদিকে কালকিনিসহ ফরিদপুরের বাকি অংশ একজন নায়েব সুবেদার বা নায়েব নাজিমের আওতায় “ঢাকা নিয়াবত”-এর অধীনে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলন হলে গোয়ালন্দ ও গোপালগঞ্জের অধিকাংশ এলাকা যশোর প্রশাসনিক এলাকার সাথে যুক্ত করা হয়। বৃহত্তর ফরিদপুরের বাকি অংশ ঢাকা-জামালপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ঢাকাকে সদর দপ্তর করে ঢাকা, বাকেরগঞ্জ ও ফরিদপুরের অংশ নিয়ে ঢাকা-জামালপুর জেলা গঠন করা হয়। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জকে ঢাকা-জামালপুর হতে বিচ্ছিন্ন করে নতুন জেলা গঠন করা হয়। অন্যদিকে, ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা-জামালপুর থেকে সদর দপ্তর ফরিদপুরে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় ঢাকা শহর ও ঢাকা জেলাকে ‘ঢাকা-জামালপুর’ জেলা হতে বিচ্ছিন্ন করা হয়। একই সাথে ফরিদপুর জেলার পশ্চিমাংশের কিয়দংশ যশোর জেলা হতে বিচ্ছিন্ন করে ফরিদপুর জেলার সাথে যুক্ত করা হয়। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলাকে নতুন কালেক্টরেট অঞ্চলের মর্যাদায় উন্নীত করে একজন সহকারী কালেক্টরের অধীনে ফরিদপুর জেলার শাসন ন্যস্ত করা হয়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলাকে পূর্ণাঙ্গ জেলার মর্যাদায় উন্নীত করে একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরেট নিয়োগ প্রদান করা হয়।
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে মাদারীপুর মহকুমা প্রতিষ্ঠা করা হয়। নবগঠিত মাদারীপুর মহকুমাকে বাকেরগঞ্জ হতে আলাদা করে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলার সাথে যুক্ত করা হয়। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলায় পূর্ণাঙ্গ জেলা জজ নিয়োগ করা হয়। সদর মহকুমা থেকে মকসুদপুর থানাকে, মাদারীপুর মহকুমা হতে গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়াকে বাদ দিয়ে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে গোপালগঞ্জ মহকুমা গঠন করা হয়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান শরীয়তপুর জেলাকে মাদারীপুর মহকুমার অংশ গণ্য করে বাকেরগঞ্জ জেলার অধীনে ন্যস্ত করা হয়। কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মাদারীপুর মহকুমা গোপালগঞ্জ, গোয়ালন্দ ও ফরিদপুর সদরকে নিয়ে ফরিদপুর জেলা গঠন করা হয়। মাদারীপুর, কালকিনি, শিবচর, রাজৈর, পালং, জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট নিয়ে মাদারীপুর মহকুমা গঠিত হয়েছিল। মহকুমা সদর দপ্তর মাদারীপুরে স্থাপন করা হলেও এটি পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল নামের দু’টি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। প্রশাসনিক সুবিধার্থে দু’জন আইসিএস অফিসার দ্বারা এ মহকুমার প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কালকিনির জনগণ প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার সাথে সাথে কালকিনির হাজার হাজার জনগণ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পথে নেমে আনন্দ উল্লাস শুরু করেছিল। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাদারীপুর মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করেন। ভেদরগঞ্জ উপজেলার এডভোকেট আবিদুর রেজা খান এমপি-কে জেলা গভর্নর নিয়োগ করা হয়। তবে, ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট কালোরাত্রির নৃশংস ঘটনার পর মাদারীপুর জেলাকে পুনরায় মহকুমায় পরিণত করা হয়। কালকিনি থানা পুনরায় ফরিদপুর জেলার আওতায় চলে যায়। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে মাদারীপুর মহকুমার পালং, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা, গোসাইরহাট থানা নিয়ে শরিয়তপুর মহকুমা গঠিত হয়। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট মাদারীপুর ও শরিয়তপুর দুটি পৃথক জেলায় উন্নীত হয়। কালকিনি সঙ্গতকারণে প্রথম বারের মত মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের আওতায় চলে আসে। জনাব আবদুর রশীদকে মাদারীপুর জেলার প্রথম জেলাপ্রশাসক নিয়োগ করা হয়। তিনি ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ হতে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত মাদারীপুর জেলার জেলাপ্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকরেন।
বর্তমান কালকিনি নামে পরিচিত উপজেলা ভূখণ্ডটির আয়তন ২৭৯.৯৮ বর্গ কিলোমিটার। উত্তরে মাদারীপুর সদর ও শরিয়তপুর সদর উপজেলা, দক্ষিণে গৌরনদী এবং মুলাদি উপজেলা, পূর্বে গোসাইরহাট, মুলাদি ও ডামুড্যা উপজেলা, পশ্চিমে কোটালীপাড়া ও গৌরনদী উপজেলা। প্রধান নদী পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ। বর্তমান কালকিনি থানা যেখানে অবস্থিত, সেটি এর পূর্বে খাজুরতলা নামে পরিচিত ছিল। ওখানে প্রচুর খেজুরগাছ ছিল বলে এলাকাটি খাজুরতলা নাম পায়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কালকিনি থানা প্রতিষ্ঠা হয় এবং ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯ অক্টোবর উপজেলায় উন্নীত হয়। আনোয়ার হুসাইন কালকিনি উপজেলার প্রথম উপজেলা নির্বাহী অফিসার। তিনি ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯ অক্টোবর হতে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট পর্যন্ত কালকিনির উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। বিখ্যাত আড়িয়াল খাঁ নদীর ঐশ্বর্যময় বাঁকে ৮টি ও পলারদি নদীর পশ্চিম পারের ৬টি মোট ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে বর্তমান কালকিনি উপজেলার অবয়ব। উপজেলাগুলো হচ্ছে: ১নং কয়ারিয়া, ২নং সাহেবরামপুর ইউনিয়ন, ৩নং রমজানপুর, ৪নং চরদৌলত খান ইউনিয়ন, ৫নং শিকারমঙ্গল ইউনিয়ন ৬নং বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন, ৭নং লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন, ৮নং এনায়েতনগর ইউনিয়ন, ৯ নং আলীনগর ইউনিয়ন, ১০নং গোপালপুর ইউনিয়ন, ১১ নং ডাসার ইউনিয়ন, ১২ নং নবগ্রাম ইউনিয়ন, ১৩ কাজি বাকাই ইউনিয়ন এবং ১৪নং বালিগ্রাম। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে কালকিনিতে একটি পৌরসভা প্রতিষ্ঠা পায়।

১. মাদারীপুর জেলা পরিচিতি, আবদুল জাব্বার মিয়া, প্রকাশকাল: ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪, পৃষ্ঠা: ৭।

কালকিনির জনমিতি ও ঐতিহ্য

২৭৯.৯৮ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট কালকিনি উপজেলার মোট জনসংখ্যা ২,৭২,১২০, তন্মধ্যে পুরুষ ও মহিলা যথাক্রমে ১,৩৮,৫৮০ ও ১,৩৩,৫৪০ এবং মোট পরিবার ৫৩,১৪০। ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্ক লোকের সংখ্যা ১,৩৫,৯৮০। মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২.৩ ভাগ লোক শহরে বাস করে।১ ১৯৯০ সালে কালকিনির লোকজনের শিক্ষার হার ছিল ২৮ ভাগ; সৈয়দ আবুল হোসেনের একক প্রচেষ্টায় যা ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ৪৪.৮৯ এবং ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে ৭৪ ভাগে এসে দাঁড়ায়।
কালকিনি পৌরসভার মোট ৬,৫৬০টি পরিবারের লোকসংখ্যা ৩০,৬৬০। তন্মধ্যে পুরুষ ১৫,৫৮০ এবং মহিলা ১৫,০৮০। পৌরবাসীর মধ্যে ৬৮.১৬ ভাগ পরিবার নিজ মালিকানাধীন বাসায় এবং ১৭.৭২ ভাগ লোক ভাড়া বাসায় বসবাস করে। ভাড়াহীন বাসায় থাকেন ১.৯০ ভাগ। গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে ৯৬.৮২ ভাগ লোক নিজ মালিকানাধীন বাসায় এবং ০.৭০ ভাগ লোক ভাড়া বাসায় এবং ১.৪৫ ভাগ লোক ভাড়াহীন বাসায় বসবাস করেন। পৌরসভা এলাকায় ৪৯.৫৪ ভাগ লোকের এবং গ্রাম এলাকায় ৭৬.৫৪ ভাগ লোকের নিজস্ব কৃষি জমি আছে।
গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে ৯৬.৮২ ভাগ লোক নিজ মালিকানাধীন বাসায়, ০.৭০ ভাগ লোক ভাড়া বাসায় এবং ১.৪৫ ভাগ লোক ভাড়াহীন বাসায় বসবাস করেন। শহর এলাকায় ৪৯.৫৪ ভাগ এবং গ্রাম এলাকায় ৭৬.৫৪ ভাগ লোকের নিজস্ব কৃষি জমি আছে। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে কালকিনি উপজেলার জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গমাইলে ১৯০ জন এবং ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তার ২১০- এ এসে দাঁড়ায়।২ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে কালকিনির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ০.৮৭, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ০.৫২, এবং ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ০.৬৮। তবে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের তা ১.৬৫ এ উন্নীত হয়। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.৯৯, যা ২০০১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে ১.৫৩ মর্মে দেখা যায়। এ উপজেলায় ০-৪ বছর বয়স্ক শিশু মোট জনসংখ্যা শতকরা ১৩.১ ভাগ। ৫-৯ বছর বয়স্ক জনসংখ্যার শতকরা ১৩.৬; ১০-১৪ বছর বয়স্ক জনসংখ্যা শতকরা ১২.৮। অন্যদিকে ২৫-২৯, ৩০-৩৪, ৩৫-৩৯ এবং ৪০-৪৪ বছর বয়স্ক জনসংখ্যা শতকরা যথাক্রমে ৮.৭, ৭.১, ৬.৫ এবং ৫। এ উপজেলায় সত্তরোর্ধ্ব জনসংখ্যার হার মোট জনসংখ্যা মাত্র শতকরা ২.৭ ভাগ।৩
কালকিনি উপজেলার শহর এলাকার ৮.৫০ ভাগ লোক ট্যাপ-এর পানি, ৭৭.৩৮ ভাগ লোক নলকূপের পানি, ১০.৬০ ভাগ লোক গভীর নলকূপের পানি, ০.৪৫ ভাগ লোক পুকুরের পানি এবং ৩.০৭ ভাগ লোক অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত পানি পান করে। গ্রাম এলাকার ০.২০ ভাগ লোক ট্যাপ, ৯১.৩৪ ভাগ লোক নলকূপ, ৪.৩২ ভাগ লোক গভীর নলকূপ, ১.১৭ ভাগ লোক পুকুর এবং ২.৯৭ ভাগ লোক অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত পানীয় জল ব্যবহার করেন। কালকিনি উপজেলার শহর এলাকায় ৫৫.৭৪ ভাগ এবং গ্রাম এলাকার ২৮.০০ ভাগ লোক বিদ্যুৎসুবিধা ভোগ করেন।
কালকিনির বাতাসের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৭.৯ কিলোমিটার এবং আদ্রতা সর্বনিু ৩৯% এবং সর্বোচ্চ ৮৫%। বৃষ্টিপাতের সর্বনিু ও সর্বোচ্চ পরিমাণ যথাক্রমে ২৭২০ মিলিমিটার ও ৪৭৯৪ মিলিমিটার। তাপমাত্রার পূর্বাপর রেকর্ড বিশ্লেষণে কালকিনির আঞ্চলিক তাপমাত্রা এ পর্যন্ত ৩৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেনি দেখা যায়। সর্বনিু তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত রেকর্ড হয়েছে। বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আদ্রতা ও বাতাসের স্বাভাবিক গতিবেগ বিবেচনায় কালকিনির আবহাওয়া মানুষের মন ও স্বাস্থ্যের অনুকূলে। তবে ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা মানুষের রঙকে কিছুটা মলিন করে দেয়। ১২.৭ হতে সর্বোচ্চ ৩৩ ফুট গভীরে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর বিন্যাস বিন্যস্ত। গড় স্তর দৈর্ঘ্য ২০ ফুট। তাই গভীর এবং অগভীর উভয় প্রকার নলকূপ এখানে স্বল্পব্যয়ে কার্যকর ও ক্রিয়াশীল।
ব্রিটিশ আমলে সারা উপমহাদেশে কালকিনি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিল। তাদের স্বাধিকার চেতনা ও দেশপ্রেম ব্রিটিশ সরকারকে তটস্থ রাখত। জনসাধারণের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিক ঐতিহ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, দেশপ্রেম ইত্যাদি কালকিনিকে বিখ্যাত করে তুলেছিল। আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহে কালকিনিবাসী মেধা-শ্রম ও মননশীলতার মাধ্যমে নিজেদের পরিপূর্ণ মাত্রায় বিকশিত করতে সক্ষম হয়েছিল। স্বাধীনতাপূর্ব ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে খ্যাত গোপালপুর ও ডাসার দ্বিতীয় চাঁটগা হিসেবে খ্যাত ছিল। উপমহাদেশের বিখ্যাত বিপ্লবীদের অনেকে আত্মগোপন কিংবা আত্মগোপনরত বিপ্লবীদের নিকট হতে দীক্ষা নেয়ার জন্য কালকিনি এসেছিলেন। মাস্টারদা সূর্যসেন, অধ্যাপক পুলিন দে, বাঘা যতীন, সুভাষ বসু, সরোজিনি নাইডু ও জওহরলাল নেহেরুর মত নেতাগণ এখানে অবস্থান করেছেন বলে প্রবাদ আছে। উৎস হিসেবে কালকিনি উপজেলার অধিকাংশ লোক বিক্রমপুর, ঢাকা, চাঁদপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল হতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে এসে বসতি গড়ে তুলেছে। এলাকাভিত্তিক অবস্থান অভিবাসন প্রক্রিয়া বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করত। কালকিনি উপজেলায় বরিশাল, ত্রিপুরা ও চাঁদপুর অঞ্চলের লোক বেশি।
উপজেলার বিভিন্ন অংশে বিক্রমপুর, ঢাকা ও ফরিদপুর অঞ্চলের লোকেরা অধিক সংখ্যায় নিবাস গড়ে তুলেছে। পৌরসভার আশেপাশের সবগুলো অঞ্চলের লোকের নিবাস লক্ষ করা গেলেও বিক্রমপুর, ফরিদপুর, বরিশাল ও চাঁদপুরের লোকদের প্রাধান্য অধিক। আন্তঃসাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি কালকিনি উপজেলার অধিবাসীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কিংবা স্বাধীনতার পূর্বে দেশে কয়েকবার হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। দাঙ্গায় বহু হিন্দু পরিবার দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকা হতে কালকিনি উপজেলাকে নিরাপদ ভেবে আশ্রয় গ্রহণ করে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলে। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লেও কালকিনিতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। অধিবাসীদের সহনশীলতা ও বহুজাতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে সাম্প্রদায়িকতা কোনো সময় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার অবকাশ পায়নি। তবে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের কারণে কিছু বনেদি হিন্দু পরিবার কালকিনি ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। 
মানসিক বিকাশ ও চেতনা বিবেচনায় কালকিনি এলাকার অধিবাসীরা সাধারণত প্রতিভাবান ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী। দৈনন্দিন জীবন পরিচালনায় প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা অন্নের সহজলভ্যতার কারণে লোকজন প্রকৃতিগতভাবে শ্রমকাতর। তবে যারা পরিশ্রমী তারা যেমন মেধাবী তেমনি অধ্যবসায়ী। শ্রম, মেধা, আভিজাত্য, জনপ্রিয়তা ও সাফল্য বিবেচনায় সৈয়দ আবুল হোসেন কালকিনিবাসীর গর্ব।
পদ্মা-মেঘনার মোহনা, কীর্তিনাশা ও আড়িয়াল খাঁ-এর কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা নদী ‘দুলালী’ কালকিনি যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব কেতন। অবস্থানগত কারণে ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও মাটিধস ইত্যাদি কালকিনির নৈমিত্তিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতি বছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ছোট বড় জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা ভূমিধ্বস কালকিনিকে আঘাত করে। ভূমি-ক্ষয় নদীবেষ্টিত কালকিনির স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মত জনজীবনকে বিষিয়ে রাখে। অনবরত ভাঙনের ফলে আয়তন ও আকার পরিবর্তন কালকিনির অন্যতম ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। চর এলাকার মানুষ ভাঙনকে ভয় পেলেও অস্বাভাবিক মনে করে না।
কালকিনি অঞ্চলের মাটি পলিমিশ্রিত বলে প্রাকৃতিকভাবে উর্বর। অধিকাংশ জমি দুই ফসলি। অতি সহজে প্রচুর পরিমাণ ধান ও অন্যান্য ফসলাদি উৎপন্ন হয়। ভাটি এলাকা বলে অধিকাংশ চাষযোগ্য জমি বছরের ৫ মাস পানির নিচে থাকে। মাটি যে কোনো ফসলের জন্য উপযুক্ত। চতুর্দিকে ছড়িয়ে প্রচুর সবুজ বৃক্ষ। তবে প্রাচীনকালের বয়স্ক কোনো বৃক্ষের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। ঝড় এবং ভাঙন সব শেষ করে দিয়েছে। প্রতিটি বৃক্ষ-লতাই ঘন সবুজ ও পুষ্ট। এখানকার নারিকেল দেশের অন্যান্য এলাকার নারিকেলের তুলনায় আকারে বড় ও সুস্বাদু। বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সহজলভ্যতা প্রাকৃতিক গর্ব। এটি স্রষ্টার অনবদ্য নৈবদ্য হিসেবে কালকিনিকে সমৃদ্ধতর করে রেখেছে।
জনসংখ্যার ৮০ ভাগ কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবী। মূলত কৃষি ও মাছ কালকিনির আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মূল বুনিয়াদ। প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখানে কোনো শিল্পকারখানা নেই। এমনকি কুটিরশিল্পও তেমন একটা চোখে পড়ে না। অথচ অভ্যন্তরীণ প্রায় আড়াই লক্ষ লোকের নিজস্ব প্রয়োজনে মাঝারি আকারের শিল্প কারখানা পর্যাপ্ত লাভজনক বলে গবেষণায় দেখা যায়। নদীভাঙন ও কষ্টকর যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না। কালকিনির বিভিন্ন লোক দেশের অন্যান্য অঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে তুললেও নিজ এলাকার দিকে নজর দিচ্ছে না। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এখানে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কাঁচা-মাল ও বিদ্যুতের অভাবে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা যাচেছ না বলে যোগ্যতাস¤পন্ন ও ইচ্ছুক কয়েকজন শিল্পপতি জানান। অনেক শিল্পপতি বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব হলে এখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। 
মাদারীপুরের অধিকাংশ লোক দরিদ্র। তবে ঢাকার ন্যায় চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করে এমন লোক নেই বললে চলে। অল্প পরিশ্রমে দৈনিক খরচের আয় উঠে আসে বলে কাউকে উপোস থাকতে হয় না। তাই এরা প্রকৃতিগতভাবে অলস ও সুখপ্রিয়। আর্থিক দীনতার কারণে ৪০% গার্ডিয়ান সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর চেয়ে ক্ষেতে বা জাল নিয়ে নদীতে পাঠিয়ে দিতে উৎসাহী। তবে সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষা প্রসার কালকিনির শিক্ষার হারকে দ্রুত বৃদ্ধি করছে। নারী শিক্ষায় এখনও কালকিনিবাসীর অবস্থান অনেক পিছিয়ে। শিক্ষার নিুহারের কারণে বহুবিবাহ, যৌতুকপ্রথা, অল্পবয়সে বিবাহ ও পারিবারিক বিবাদ সামাজিক জীবনকে অক্টোপাশের মত আঁকড়ে রেখেছে। কুসংস্কার যেন ৮০ভাগ শরীয়তপুরবাসীর সংস্কৃতি। জিন, ভূতপ্রেত ও ঝাড়ফুকের কবলে নিপতিত কালকিনিবাসীর গড় বয়স জাতীয় মাত্রার চেয়ে ৫ বছর কম। অথচ প্রাকৃতিক নির্মলতা ও প্রোটিন প্রাপ্তির সহজলভ্য উৎস বিবেচনায় গড়আয়ু জাতীয় হারের চেয়ে ১২ বছর বেশি হওয়াই ছিল সংগত। ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে গোঁড়ামিও লক্ষণীয়। তবে এ গোঁড়ামি অসাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করলেও নিজেদের আর্থ-সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত ব্যবস্থার প্রতি হুমকিস্বরূপ।
কালকিনির আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডের বুনিয়াদ মূলত কমবেশি ৩০০ পরিবারের আয়ত্ত্বে। কৃষি, মৎস্য ও যানবাহন সেক্টরসহ আর্থ-সামাজিক প্রক্রিয়ার প্রায় সবকিছু মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবারে সীমাবদ্ধ। এ তিনশ’ পরিবার কালকিনির মূল নিয়ন্ত্রক ও সামাজিক ব্যবস্থার প্রভাবক। বাকিরা তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইশারায় তাড়িত হয় বা হতে বাধ্য হয়। অধিকাংশ লোক মুসলিম, হিন্দুও রয়েছে। তবে এলাকায় কোনো ধর্মীয় সহিংসতা বা সাম্প্রদায়িকতা নেই। বিগত ৫০ বছরে এখানে কোনো ধর্মীয় হানাহানি হয়নি। লোকজন ধর্মভীরু। মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনামূলক প্রাধান্য লক্ষণীয়।
প্রাচীনকাল হতে কালকিনির অধিবাসীরা স্বাধীনচেতা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তারা অনাদিকাল হতে রাজনীতিকভাবে সচেতন ও দেশপ্রেমে উদ্বেল চেতনার অধিকারী ছিল। এ কারণে মোগলদের মতো শক্তিশালী পরাশক্তিও তাঁদেরকে সহজে পরাভূত করতে পারেনি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যে সকল অঞ্চল প্রথম গর্জে উঠেছিল তন্মধ্যে কালকিনি প্রথম সারিতে। এ এলাকার জনগণের রাজনীতিক সচেতনতা ব্রিটিশরাজ পর্যন্ত সমীহ করে চলত। প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা তাদেরকে যেমন সাহসী তেমনি আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার মতো কালকিনির রাজনীতিও কয়েকটি পরিবারে সীমাবদ্ধ। জমিদারি প্রথা না-থাকলেও এখনও তার পুরনো রেশ নতুন মাত্রায় ক্রিয়াশীল। সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের কোনো কার্যকর পরিকল্পনা বৃহৎ পরিসরে নেয়া হয়নি। এলাকার রাজনীতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাবও স¤পদশালী কয়েকটি পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। সারাদেশের ন্যায় এখানেও রাজনীতিক বিভক্তি আছে। তবে সুখের কথা যে, রাজনীতিক হানাহানি তেমন মারাত্মক রূপ পরিগ্রহ করে না। মাঝে মাঝে রাজনীতিক হানাহানির ঘটনা ঘটলেও তার মাত্রা নগণ্য। বলা যায় সহনীয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রতিকূল আবহাওয়া কালকিনিবাসীর সাহস ও ধীশক্তির উৎস। দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে কালকিনির বহুলোক সমৃদ্ধ অবস্থানে অবস্থান করছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকায় কালকিনিতে জন্মগ্রহণকারী ১০৮ জন কোটিপতি বসবাস করছে। অধিকাংশ লোক সহজ-সরল ও অতিথিপরায়ণ। প্রত্যন্ত এলাকার অনেক লোক এত সহজ-সরল যে, পিতার নাম পর্যন্ত মনে রাখা প্রয়োজন বোধ করে না। প্রত্যন্ত চর এলাকায় পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ২০ বছর হতে ৬৫ বছর বয়সী ১০০ জন লোকের মধ্যে ১১ জন তাদের জন্মদাতার নাম বলতে পারেনি। স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে তিন জনকে। এর মধ্যে ২ জন সম্পূর্ণ ভুলে গেছে পিতার নাম। বয়স বলতে পারেনি ৫৬ জন। মহাজন এবং মৎস্য দাদনের যাঁতাকলে দরিদ্র মৎস্যজীবীরা কুরে কুরে মরছে। এখানে বিদ্যার্জন ও আর্থিক সচ্ছলতা আভিজাত্য অর্জনের পূর্ব শর্ত। ‘জন্ম নয়, কর্মই বড়’ নীতি দ্বারা অভিজাত-অনভিজাত নির্ধারিত হয়। সহজে গাড়ি প্রবেশে সক্ষম পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা পায়খানার ব্যবস্থা সমন্বিত সামনে-পেছনে পুকুরওয়ালা বড় রাস্তার পাশে পাকা বা টিনের বাড়ি অভিজাত বাড়ি বলে পরিচিত। অভিজাত বাড়ির মালিক আভিজাত্যের মর্যাদা ভোগ করে থাকেন। তবে জমির অভাবে আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অভিজাত বাড়ি তৈরি করা দুঃসাধ্য। অভিজাত পরিবারের সাথে স¤পর্ক স্থাপন করাও আভিজাত্যের সোপান। অভিজাত-অনভিজাত বৈবাহিক স¤পর্ক এখন আগের মতো কড়াকড়ি না-হলেও বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। এমন অনেক পরিবার আছে যারা বৈবাহিক স¤পর্ক স্থাপনে আভিজাত্য তথা পূর্বপুরুষদের সামাজিক মর্যাদাটাকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আবার অনেকে মনে করেনÑ কর্ম ও বর্তমান অবস্থানই মূল বিষয়।
১৯৫০-এর দশকেও কেউ চরে বাড়ি করলে তাঁকে অনভিজাত ও চউররা বলে আখ্যায়িত করা হতো। বর্তমানে কিন্তু ‘চউররা’ বলে মুখ সিটকানোর বা অনভিজাত ভাবার দিন শেষ। এখন অভিজাতদেরও চরে বাড়ি না-করে উপায় নেই। মলঙ্গী এবং তেলীদেরকে মুসলমানদের মধ্যে নিচুজাত ভাবা হতো। অতীতে সারেং, ঘাটসারেং, সুকানী প্রমুখদের যথেষ্ট মর্যাদা ছিল। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের দিকে অবশ্য সারেং সুকানীদের মর্যাদা কমে যায়। চাকুরির সুলভতা, কতিপয় নাবিকের বিলাসিতা ও অসামাজিক আচরণ এর জন্য দায়ী। এখানে অনেকে জন্মসূত্রে অভিজাত দাবি করেন। জন্মসূত্রে অভিজাত দাবিদারেরা নিজেদেরকে মোগল বংশোদ্ভুত কিংবা মোগল শাসনামলে শাসক কর্তৃক জায়গির প্রাপ্ত সৈনিকদের বংশধর বলে মনে করেন। তবে সবচেয়ে অভিজাত সৈয়দ পরিবার। বিক্রমপুর কিংবা ত্রিপুরা জমিদারের বংশধর অথবা চাঁদরায় কেদার রায় এর রাজত্বে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীনদের উত্তর পুরুষগণও অভিজাত বলে স্বীকৃত। তাছাড়া আরব বংশোদ্ভুত পরিবারগুলোও সবচে অভিজাত হিসেবে চিহ্নিত।
ফরায়েজি আন্দোলন, ওহাবি আন্দোলন, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা আন্দোলন (সিপাহী বিদ্রোহ), সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের খেলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রয়াস, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের মুসলিম লিগ গঠন, ১৯৪০-১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতার দাঙ্গা হতে শুরু করে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে কালকিনিবাসীর অবদান ছিল অনন্য। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলনেও কালকিনিবাসী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্তফ্রন্ট সাধারণ নির্বাচনে কালকিনির জনগণের রাজনীতিক সচেতনতা ছিল বিস্ময়কর। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অ্যাডভোকেট আদিল উদ্দিন যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে কলকাতায় শপথ গ্রহণের পরপরই প্রেসিডেন্ট মন্ত্রিপরিষদ বিলুপ্ত করায় দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি ছিলেন কালকিনি প্রথম অধিবাসী, যিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন। দ্বিতীয় সৈয়দ আবুল হোসেন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচন ও ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ছয় দফা আন্দোলন হতে শুরু করে ১৯৬৮-৬৯ খ্রিস্টাব্দের গণআন্দোলনে কালকিনিবাসীর সচেতন জনগণের দেশপ্রেম অনন্য স্বকীয়তায় বিকশিত হয়েছিল। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচন ও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা যুদ্ধে কালকিনিবাসী সাহসী জনগণের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল দেশপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

১. ২০০১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি।
২. Estimated from Population Census, 2001.
৩. Population Census, 2001.

আধুনিক কালকিনির জনক
ডাসার একটি প্রত্যন্ত ইউনিয়ন, তবে এখন থানা। উল্লেখ্য গত ২ মার্চ ২০১৩ মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ডাসারকে থানায় উন্নীত করেন। এ জেলায় জনবসতির আগমন সম্পর্কে জানা গেছে, সুদূর অতীতে প্রখ্যাত আউলিয়া হযরত শাহ আলী বোগদাদী (র.)-এর জ্যেষ্ঠ সন্তান শাহ ওসমান (র.) বাঘের পিঠে চড়ে ডাসার এলাকায় শুভাগমন করে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন। সময়ের স্রোতে এ গ্রামে বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের জন্ম হতে থাকে, যাঁরা দেশ-বিদেশে মেধা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে খ্যাতিমান হয়েছেন। তবে শিক্ষার দিক হতে এলাকাটি পশ্চাতে পড়ে থাকে। যারা বড় হয়েছেন তারা আর গ্রামে থাকেননি, গ্রামের দিকে তাকাননি। উৎসমূলকে অবহেলায় রেখে শহরে চলে গেছেন জৌলুসময় জীবনে। তবে সৈয়দ আবুল হোসেন বড় হলেও গ্রামকে ভোলেননি। যে গ্রামের আলো-হাওয়ায় তিনি মানুষ, সে গ্রামকে যিনি ভুলে যান, অবহেলা করেন তিনি কখনও মহৎ হতে পারেন না। কালকিনির অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর উন্নয়নের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পূর্ণ নিজ অর্থায়নে কালকিনিতে একের পর এক নির্মাণ করেছেন রাস্তাঘাট। গড়ে তুলেছেন স্কুল-কলেজ, ক্লাব, কর্মমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মানুষের বিভিন্ন অভাব-অভিযোগের তাৎক্ষণিক সমাধানার্থে উদার হস্তে ব্যয় করেছেন অর্থ, সময় ও প্রজ্ঞা।
কালকিনির উন্নয়নে সৈয়দ আবুল হোসেনের অবদানের কথা বলতে গিয়ে কালকিনি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ মো. খালেকুজ্জামান সাহেব বলেন, ‘পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, পলারদি বিধৌত ফরায়েজি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হাজি শরিয়তল্লাাহর স্মৃতি বিজড়িত ও উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি শাহ মাদারের পুণ্যভূমি মাদারীপুর জেলার একটি প্রত্যন্ত উপজেলা-জনপদ কালকিনি। এটি সমুদ্র উপকূলবর্তী উপজেলা। নদীমাতৃক হওয়ায় বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল হতে অপেক্ষকৃত নিচু। ভৌগোলিক কারণেই এলাকাটি ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক অভিশাপে অভিশপ্ত। তাছাড়া রাজনৈতিক কারণেই এলাকাটি দীর্ঘ দিন জাতীয় উন্নয়নের সার্বিক অবস্থা থেকে অনেক অনুন্নত এবং পিছিয়ে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী বা পরবর্তীকালে সৈয়দ আবুল হোসেনের পূর্বে কালকিনি উপজেলার কোনো অধিবাসী সংসদ সদস্য ছিলেন না। অন্য এলাকার লোক সংসদ সদস্য ছিলেন। ফলে প্রত্যন্ত এ জনপদটির উন্নয়নের লক্ষ্যে আন্তরিকভাবে কাজ করার, এলাকার সমস্যা সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে কথা বলার মতো কেউ ছিল না। সংগত কারণে কালকিনি দেশের অন্যান্য এলাকা, এমনকি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের চেয়েও শিক্ষাদীক্ষা, যোগাযোগ, অবকাঠামো এবং আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। কালকিনির এ ক্রান্তিকালে প্রচণ্ড প্রতাপের সাথে আবির্ভূত হলেন চিরভাস্বর একটি নক্ষত্র, যাঁর নাম আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন।১
বিশ বছর আগেও কালকিনি ছিল সাংঘাতিক প্রত্যন্ত একটি পশ্চাদপদ গ্রাম। বিগত শতকের নব্বই-এর দশক হতে সৈয়দ আবুল হোসেনের একক প্রচেষ্টায় কালকিনি আবার সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় চলে আসে। বিশ শতকের নব্বই-এর দশকের আগে কালকিনি কেমন ছিল তা কালকিনির অধিবাসী ছাত্রনেতা জনাব ইকবাল হোসেনের জবানিতে শোনা যাক- ‘হারিকেনই ছিল আমাদের বিদ্যুৎ। কেরোসিন আনতে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হতো। বিদ্যুৎ জ্বলবে এটি ভাবতেও পারতাম না। জলে কুমির ডাঙায় বাঘ- এ ছিল কালকিনি।’ কালকিনি কীভাবে পশ্চাদপদতা ছেড়ে আধুনিকতার আবহে চলে আসে তাও ইকবাল হোসেনের জবানিতে শোনা যেতে পারে-‘এ রকম একটা প্রত্যন্ত এলাকা সৈয়দ আবুল হোসেনের মায়াময় ছোঁয়ার মধুর স্পর্শে আমার চোখের সামনে আধুনিক বিশ্বের যে কোনো মফস্বলের সাথে পাল্লা দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করল। আধুনিক জীবনযাত্রার সকল উপাদানে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল মধ্যযুগের কালকিনি। দশ বছর আগের কালকিনি আর বর্তমানের কালকিনির তুলনা করতে গিয়ে আমি অবিশ্বাসে হতবাক না-হয়ে পারি না। শিক্ষা, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, বিনিয়োগ, উৎপাদন, ঐক্য, প্রগতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, চিকিৎসা, বস্ত্র, বাসস্থানÑ এক কথায় বলতে গেলে আদর্শ জীবনযাপনের জন্য যা যা প্রয়োজন, সৈয়দ আবুল হোসেনের বদান্যতায় তার সব কিছু এখন কালকিনি-মাদারীপুরের জনগণের দোরগোড়ায়। কালকিনির লোক এখন ঢাকায় এসে অবাক হন না, বরং ঢাকার লোক কালকিনি গিয়ে অবাক হন।’
আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন দানে হাজি মহসিন, শিক্ষানুরাগে এক অনন্য ব্যক্তিত্ত্ব। আগের দিনে হিন্দু শিক্ষানুরাগীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতেন। বিশেষ করে, হিন্দু জমিদারদের অনেকে নিজ নিজ অধিকারভুক্ত জমিদারিতে একটি-দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতেন। সৈয়দ আবুল হোসেন তার চেয়ে বেশি। তিনি জমিদার নন, তবু নিজের শ্রমে অর্জিত অর্থ ব্যয় করে গড়ে তুলেছেন একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একটি নয়, দু’টি নয়- অসংখ্য, অগণিত। শিক্ষা বিস্তারে সৈয়দ আবুল হোসেন যে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন তা বাংলাদেশে বিরল। অল্প বয়সে তিনি ব্যবসা করে ধনবান হয়েছেন। তিনি শুধু ধনবান নন, মনবান এবং চরিত্রবানও বটে। তাঁর চরিত্র মহামানবের মতো মহীয়ান।
অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর আপোসহীন মনোভাব, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, স্বজনপ্রীতিহীন আপাদমস্তক নির্ভেজাল চিন্তা-চেতনা এবং সমাজে এর সঠিক বাস্তবায়ন- কালকিনি এলাকায় প্রশংসনীয় শান্তি বিরাজ করছে। অথচ এই এলাকা একদিন ছিল সন্ত্রাসীদের চারণভূমি, সর্বহারাদের শক্তঘাঁটি। তাঁর এই নিরপেক্ষতার কারণে, পূত-পবিত্র স্বচ্ছ চিন্তাধারার ফলে এলাকার মানুষ দলাদলি, হানাহানি ভুলে এক দলে পরিণত হয়েছে, এক ব্যানারে সমবেত হয়েছে। আর সে ব্যানার হচ্ছে- শান্তির ব্যানার, উন্নতির ব্যানার, প্রগতির ব্যানার, ভ্রাতৃত্বের ব্যানার এবং অহিংসার ব্যানার। সহনশীলতা, নিরপেক্ষতা, উদারতা, দানশীলতা, পরোপকারে নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, মূল্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, নিরহঙ্কার মনোভাব, ধর্মীয় চেতনায় সমৃদ্ধ নির্ভেজাল সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা- এ সমস্ত দুর্লভ ও প্রশংসনীয়।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী। শিক্ষার মাধ্যমে একটি গ্রাম, সমাজ তথা জাতিকে যত দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, অন্য কোনো কিছু দিয়ে তা সম্ভব নয়। সংখ্যায় অল্প হলেও শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখর লক্ষ্যে কিছু শিক্ষানুরাগী মহাপ্রাণ ব্যক্তি নিরলস ও আত্মনিবেদিতভাবে কাজ করেনÑ মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন এমপি তেমনই একজন। তাঁর নির্বাচনী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং করছেন। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাঙ্গনগুলোতে নিবিড় তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক প্রেক্ষাপটে এটি অসম্ভব বলে মনে করা হতো। ফলে প্রায় বছরই বোর্ড পরীক্ষায় তঁাঁর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মেধা তালিকার শীর্ষস্থানসমূহের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্থান লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত এরূপ একটি কলেজ। এটি তিনি তাঁর পিতার স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করেছেন। ডাসারের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি আজ প্রত্যন্ত নয়, স্বীয় সাফল্যে শিক্ষার নির্বাণ আলো ছড়িয়ে সারা দেশে বিখ্যাত হয়ে আছে।
এক সময় যে কালকিনিতে পায়ে হাঁটা পথেরও অভাব ছিল, সে কালকিনি এখন আধুনিক রাস্তাঘাটে সুসজ্জিত। জনস্বার্থে যেখানে যা প্রয়োজন, তা নিরলস প্রচেষ্টায় করে যাচ্ছেন সৈয়দ আবুল হোসেন-সরকারি সহযোগিতার জন্য বসে না থেকে নিজের অর্জিত অর্থ দিয়ে সংস্কার ও নির্মাণ করছেন রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কালভার্ট। অধ্যক্ষ মো. খালেক্জ্জুামানের ভাষায়, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন এককভাবে কালকিনির উন্নয়নের জন্য যে অবদান রেখেছেন তা আবুল হোসেনকে বাদ দিয়ে কালকিনির সকল জনগণের পক্ষেও সম্ভব হতো না। এলাকার উন্নয়নে তাঁর ইচ্ছা, প্রয়াস ও গতি যেমন অবিরাম, তেমন নিবিড় ও নিরলস। কালকিনিকে তিনি দিয়েছেন অনেক, দিয়ে যাচ্ছেন অবিরল।’ বস্তুত কালকিনিতে সৈয়দ আবুল হোসেন নামক মানুষটি জন্ম না-নিলে কালকিনি কখনও আধুনিকতার ছোঁয়া পেত না। তিনি এবং কেবল তিনিই আধুনিক কালকিনির বিনির্মাতা।
আজকের কালকিনি আগের সে প্রত্যন্ত কালকিনি নয়। আজকের কালকিনি আবুল হোসেনের কালকিনি, শিক্ষা, যোগাযোগ, উন্নয়ন, অবকাঠামো আর সমৃদ্ধির কালকিনি। সারা দেশের মধ্যে একটি অন্যতম উন্নত ও খ্যাতনামা উপজেলা। আর আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন নিষ্কলুষ গগনের মত চির উন্নত শিরে অনির্বাণ দিনমণি।২

১. অধ্যক্ষ খালেকুজ্জামান, আধুনিক কালকিনির বিনির্মাতা।
২. সৈয়দ আবুল হোসেন : আধুনিক কালকিনির বিনির্মাতা অধ্যক্ষ খালেকুজ্জামান, কালকিনি 
বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।

সৈয়দ আবুল হোসেনের বংশ পরিচয়
সৈয়দ আবুল হোসেন মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার ডাসার গ্রামে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আলহাজ্ব সৈয়দ আতাহার আলী ও মা আলহাজ্ব সুফিয়া খাতুনের তিন কন্যা ও তিন ছেলের মধ্যে সৈয়দ আবুল হোসেন তৃতীয়। আতাহার আলী ও সুফিয়া খাতুনের সন্তান-সন্ততিগণ হচ্ছেন যথাক্রমে সৈয়দা শামসুন নাহার, সৈয়দ আবুল কাশেম, সৈয়দ আবুল হোসেন, সৈয়দা জাহানারা বেগম, সৈয়দা মনোয়ারা বেগম এবং সৈয়দ হাসান। ডাসারকে এখন যতই প্রত্যন্ত এলাকা বলা হোক, চতুর্দশ শতকে পলার্দি-আড়িয়াল খাঁ তীরবর্তী এ জনপদটি ছিল জলপথে একটি উত্তম যোগাযোগ ব্যবস্থাসমৃদ্ধ উন্নত এলাকা। সাবলীল যোগাযোগ ব্যবস্থার সূত্র ধরে ডাসার ‘গঞ্জ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে এখানে নিবাস গড়ে তুলেছিলেন শাহ ওসমান। শাহ ওসমান কে? কী তার পরিচয়? তিনি কোত্থেকে এসেছেন? এ সব জানার আগে শাহ আলী বোগদাদীকে জানা প্রয়োজন। কারণ শাহ ওসমানের পিতা হচ্ছেন শাহ আলী বোগদাদী। যিনি বাংলাদেশে আগত সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রথম বংশধর এবং বর্তমানে মিরপুর মাজারে শায়িত।
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ মাদারীপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, “শাহ আলী বোগদাদী ইরাকের রাজধানী বাগদাদের ফোরাত নদীর তীরে কসবায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শাহ ফখরুদ্দিন রাযী। শাহ আলী বোগদাদীর বংশধর অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান একটি বংশ তালিকা দিয়েছেন এবং শাহ আলী বোগদাদীর জন্ম তারিখ নির্ণয় করেছেন।১ শাহ আলী বোগদাদী ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। ১৪১৯ খ্রিস্টাব্দে জনৈকা ধর্মানুরাগী রমণীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। ১৪২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি এক কন্যা সন্তানের পিতা হন। ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের বিখ্যাত সৈয়দ বংশের সদস্য সৈয়দ হাবিবুল্লাহর সাথে কন্যার বিয়ে দেন। ইতোমধ্যে শাহ আলী বোগদাদীর প্রথম স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেয়। তিনি সংসার কর্মে অনেকটা উদাসীন হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় পিতা তাকে দিল্লি গিয়ে ধর্মপ্রচারে মনোনিবেশের পরামর্শ দেন। মানসিক উত্তরণে পিতার পরামর্শ অত্যন্ত কার্যকর মনে করে শাহ আলী বোগদাদী ইরাক ত্যাগ করে দিল্লি যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।”২
পিতার অনুমতি নিয়ে শাহ আলী বোগদাদী ১৪৪৩ খ্রিস্টাব্দে চল্লিশজন সঙ্গী সমভিব্যাহারে দিল্লি আগমন করেন। চল্লিশ জন সহচরের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শাহ ওসমান। দলে হযরত শাহ আলী বোগদাদীর পর শাহ ওসমানের স্থান ছিল। উভয়ে ছিলেন পরস্পর আত্মীয় এবং একই বংশের। দিল্লির সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন আলম শাহ (১৪৪৫-১৪৫১ খ্রি.) তাদের সাদরে গ্রহণ করেন। শাহ আলী বোগদাদীর চারিত্রিক মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহ স্বীয় কন্যা আয়েশাকে তার হাতে সমর্পণ করার প্রস্তাব দেন। ১৪৪৪ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহ-এর কন্যা আয়েশার সাথে হযরত শাহ আলী বোগদাদীর শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। ১৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে শাহ আলী বোগদাদীর ঔরসে এবং সুলতান তনয়া আয়েশার গর্ভে এক পুত্র সন্তান জন্মলাভ করেন। তার নাম রাখা হয় সৈয়দ শাহ ওসমান। সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহের কন্যা আয়েশার গর্ভে ও শাহ আলী বোগদাদীর ঔরসে জন্মগ্রহণকারী এ শাহ ওসমানই হচ্ছেন ডাসারের শাহ ওসমান, যিনি আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের অন্যতম পূর্বপুরুষ।
সন্তান জন্মদানের পর সুলতান তনয়া আয়েশা অসুস্থ হয়ে পড়লে শাহ আলী বোগদাদী ১৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির বিখ্যাত ব্যবসায়ী গুল মুহাম্মদ সওদাগরের কন্যা বুজুর্গ বিবিকে বিয়ে করেন। এ বিয়েতে সুলতানের মত ছিল কিনা সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে আয়েশা এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। অবশ্য তখন পুুরুষের একাধিক বিয়েতে আপত্তি বা উচ্চবাচ্য করার কোনো রেওয়াজ ছিল না। পুরুষের বিয়েকে বিনা বাক্যে মেনে নেয়াই ছিল পুণ্য রমণীগণের অনিবার্য দায়িত্ব।
১৪৫১ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব হতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও লোদী বংশের সিংহাসন দখল করার প্রচেষ্টা রাজ্যে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। এ অবস্থায় সুলতান পরাজয় শঙ্কায় আত্মীয় পরিজনদের দিল্লি ত্যাগের পরামর্শ দেন। সুলতানের নির্দেশে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে শাহ আলী বোগদাদী তার দুই স্ত্রী, পুত্র সৈয়দ শাহ ওসমান, ভাগিনা সৈয়দ হাবিব এবং বাগদাদ হতে আগত চল্লিশ সহচরের অন্যতম শাহ ওসমানসহ আরও কয়েকজন অনুচর নিয়ে নৌপথে ফরিদপুর চলে আসেন। পাঠক একটু খেয়াল করলে বুঝবেন, এ দলে ওসমান নামের দুইজন ছিলেন। একজন শাহ আলী বোগদাদীর ছয় বছর বয়সী শিশুপুত্র এবং অন্যজন তার প্রধান সহচর। তারা ফরিদপুর এসে গেরদায় বসতি স্থাপন করেন। দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহ জামাতা শাহ আলী বোগদাদীকে ১২০০০ বিঘা লাখেরাজ ভূমি দান করেছিলেন।৩ ফলে তাদের সচ্ছল জীবন যাপনের পথে কোনো বাধা থাকল না।
গেরদায় বসতি স্থাপনের অল্প কিছুদিন পর লোদী বংশ সিংহাসন দখল করে নিলে সুলতান বাদায়ুনে আশ্রয় নেন। গেরদায় আসার পর ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দে শাহ আলী বোগদাদীর ঔরসে এবং গুল মুহাম্মদ সওদাগরের কন্যা বুজুর্গ বিবির গর্ভে এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হয় সৈয়দ মোহাম্মদ হানিফ। আয়েশার গর্ভে জন্মগ্রহণকারী শাহ ওসমান শাহ আলী বোগদাদীর দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণকারী সৈয়দ মোহাম্মদ হানিফ হতে সাত বছর বড়। উল্লেখ্য, দিল্লি হতে ফরিদপুর আসার পথে অসুস্থ আয়েশা বেগম মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ছয় বছর বয়স্ক শিশু শাহ ওসমান মাতৃহীন হয়ে বিমাতার হাতে পড়ে।
বৈমাত্রেয় ভাই হানিফ সৈয়দ শাহ ওসমানকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারছিলেন না। হানিফের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বড় ভাইয়ের প্রতি রুঢ় আচরণ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। শাহ ওসমান ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী, নির্লোভ ও ধৈর্যশীল। বিমাতা আর সৎ ভাইয়ের অত্যাচার দিন দিন বাড়লেও তিনি তা নীরবে সহ্য করে পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
তৎকালে ঢোল সমুদ্র পদ্মা নদীর সাথে সংযুক্ত ছিল। কথিত আছে, একজন ব্রাহ্মণ কন্যা ঢোল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে শাহ আলী বোগদাদী তাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু মুসলমান দ্বারা স্পর্শিত হওয়ায় হিন্দু সমাজ ব্রাহ্মণ কন্যাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। এ অবস্থায় শাহ আলী বোগদাদী অসহায় মেয়েটিকে বিয়ে করে নিজের ঘরে নিয়ে যান। কারও কারও অভিমত, হরিশচন্দ্র শাহ আলী বোগদাদীর গুণে মুগ্ধ হয়ে স্বীয় কন্যাকে তার সাথে বিয়ে দেন এবং তিনি নিজেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।৪
মজলিশ আবদুল খানের কন্যার সাথে সৈয়দ শাহ ওসমানের বিয়ে হয়। বুজুর্গ বিবির পুত্র তথা বৈমাত্রেয় ভাই হানিফ ও তার পুত্রদের সাথে সুলতানের কন্যা আয়েশা বিবির পুত্র সৈয়দ শাহ ওসমানের বিরোধ ক্রমশ বাড়তে থাকে। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও পিতা শাহ আলী বোগদাদী বিরোধ মেটাতে ব্যর্থ হন। সৈয়দ শাহ ওসমান ছিলেন ইসলামি জ্ঞানে ঋদ্ধ আধ্যাত্মিক প্রকৃতির একজন নিরীহ মানুষ। বিমাতার জন্য তিনি ঘরে শান্তি পেতেন না। তাই অধ্যয়নের মাধ্যমে অশান্তি ভুলে থাকার চেষ্টা করতেন। এ জন্য ছোট বয়সেই তিনি ইসলামি জ্ঞানে পারঙ্গমতা অর্জন করেন। বিষয় সম্পত্তির প্রতি তার কোনো আকর্ষণ ছিল না। তবু সৎ ভাইগণ তাকে শত্র“ ভাবতেন। ভ্রাতৃবিরোধ শাহ ওসমানকে অতিষ্ঠ ও বিষণœ করে তোলে। পিতা সৈয়দ শাহ আলী বোগদাদীও পুত্রদের বিরোধ মেটাতে না-পেরে মনোকষ্টে ভুগছিলেন। এ অবস্থায় শাহ আলী বোগদাদী প্রিয় সহচর শাহ ওসমানের ওপর গেরদার দায়িত্ব অর্পণ করে মিরপুর চলে যান। সাথে নিয়ে যান তার প্রিয় জ্যেষ্ঠ সন্তান শাহ ওসমানকে। মিরপুর এসে তিনি ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
শাহ আলী বোগদাদী গেরদা ত্যাগ করার কয়েক বছর পর ত্বদীয় সহচর শাহ ওসমান মৃত্যুবরণ করেন। গেরদায় তাকে সমাহিত করা হয়। পাঠক, এখানে আর একবার একটু দৃষ্টি দেয়ার অনুরোধ করছি। গেরদায় যে ওসমান শায়িত, তিনি শাহ আলী বোগদাদীর পুত্র নন, সহচর। ডাসারে যে ওসমান শায়িত, তিনি শাহ আলী বোগদাদীর পুত্র। যার মায়ের নাম আয়েশা বিবি। দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহ ডাসারে শায়িত শাহ ওসমানের মাতামহ।
শাহ আলী বোগদাদী সংসার ধর্ম হতে অনেক দূরে চলে যান। তিনি মিরপুর চিল্লায় সারাক্ষণ ধ্যানমগ্ন থাকতেন। কথিত হয়, চিল্লায় অবস্থায় একদিন শাহ আলী বোগদাদীর কক্ষ হতে সংঘর্ষের আওয়াজ ও আর্তচিৎকার শুনে কিছু ভক্ত দৌড়ে যান। দরজা খুলে দেখেন, শাহ আলী বোগদাদীর শরীর ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। দেখে মনে হয় জঙ্গল হতে বাঘ এসে তাকে হত্যা করেছে। অনেকে মনে করেন, আল্লাহর ধ্যানে তার দেহ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে। যাই হোক তার মৃত্যু রহস্যাবৃত থেকে যায়। এ বিষয়ে আরও বিভিন্ন মত রয়েছে। এর একটি এখানে উল্লেখ করা হলো: কথিত আছে, প্রায় চারশো বছর আগে শাহ আলী নামে বাগদাদের এক রাজপুত্র সংসারের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে চারজন শিষ্যসহ নানাদেশে ঘুরে ঘুরে ঢাকা মিরপুরের ছোট্ট একটি মসজিদে আশ্রয় নেন। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মসজিদের দ্বার রুদ্ধ করে ধ্যানমগ্ন থাকেন। নির্দিষ্ট সময় পূর্ণ হওয়ার একদিন আগে শিষ্যরা অস্পষ্ট শব্দ শুনে মসজিদের দ্বার খুলে দেখেন শাহ আলী সেখানে নেই। একটি পাত্রে রক্তমাংস পড়ে আছে। শিষ্যরা শাহ আলীর কণ্ঠে নির্দেশ পেল-পাত্রের রক্তমাংস সমাধিস্থ করার। হযরত শাহ আলীর সে সমাধিস্থলই মিরপুরের শাহ আলীর দরগা নামে পরিচিত।৫
বুজুর্গ বিবির পুত্র সৈয়দ মোহাম্মদ হানিফ, সৈয়দ হানিফের পুত্র সৈয়দ শাহনুর, ত্বদীয় পুত্র সৈয়দ শাহ ভিখ। সৈয়দ শাহ ভিখের পুত্র শাহ রাখি। সৈয়দ হানিফের উত্তর পুরুষগণের কয়েকজন ফরিদপুরের গেরদায় বসবাস করতে থাকেন। কয়েক জন যশোর চলে যান। গেরদা মসজিদের সংলগ্ন উত্তরে সৈয়দ হানিফ ও বুজুর্গু বিবির মাজার আছে। সৈয়দ শাহ আলী বোগদাদীর মৃত্যুর পর সৈয়দ শাহ ওসমান মিরপুর হতে গেরদা ফিরে আসেন। বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সাথে কোন্দল আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় সৈয়দ শাহ ওসমান গেরদা ত্যাগ করে স্ত্রীপুত্রদের নিয়ে কালকিনির ডাসার গ্রামে নিবাস গড়ে তোলেন। এখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। ডাসারে তাঁর মাজার রয়েছে।
উপরে বর্ণিত আলোচনায় দেখা যায়, সৈয়দ আবুল হোসেন দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহ এবং শাহ আলী বোগদাদীর রক্তাধিকারী। শাহ আলী বোগদাদীর পূর্বপুরুষের পরিচয় ও বংশলতিকা পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য। আগ্রহী পাঠকগণ তা অবলোকন করতে পারেন। বংশলতিকায় দেখা যায়, হযরত শাহ আলী বোগদাদী হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর চাচা হযরত আবু তালিবের পুত্র হযরত আলীর অধস্তন। হযরত আলীর স্ত্রী ছিলেন নবী তনয়া ফাতিমা। কথিত হয় শাহ ওসমান বাঘের পিঠে চড়ে ডাসার গ্রামে এসেছিলেন। সৈয়দ ওসমান সম্পর্কে বাংলাদেশ গেজেটীয়ারে লেখা আছে- অ ংধরহঃ ভৎড়স অৎধনরধ, ঝুবফ টংসধহ পধসব ঃড় ঃযরং ারষষধমব ধহফ ংবঃঃষবফ যবৎব. ওঃ রং ংধরফ যব ঁংবফ ঃড় ৎরফব ড়হ ঃরমবৎ. ঐরং মৎধাব রং ষড়পধঃবফ ধঃ উধংধৎ.৬
শাহ আলী বোগদাদীর বংশধর সৈয়দ আলী আহসানের বংশ লতিকায় দেখা যায়, শাহ আলী বোগদাদীর পুত্র সৈয়দ শাহ ওসমান দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক হন। প্রথম পুত্র সৈয়দ আবদুল ওয়াহিদ নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। দ্বিতীয় পুত্র সৈয়দ আবদুল কাদিরের একমাত্র পুত্র সৈয়দ আবদুর রশীদ। আবদুর রশীদের পুত্র সৈয়দ শাহ মোহাম্মদ যাকের একজন কামেল দরবেশ ছিলেন। মোহাম্মদ যাকের বিবাহিত জীবনে চার সন্তানের জনক হন। তার সন্তানগণ হচ্ছেন যথাক্রমে সৈয়দ মুহাম্মদ সাবের, সৈয়দ মুহাম্মদ হুসাইন, সৈয়দ মুহাম্মদ সাকের এবং সৈয়দ মুহাম্মদ হাফিজ।৭
যুবক হবার পর পৈত্রিক উত্তরাধিকারজাত সম্পত্তি দেখাশুনার জন্য সৈয়দ মুহাম্মদ সাবের, সৈয়দ মুহাম্মদ হুসাইন ও সৈয়দ মুহাম্মদ হাফিজ বাংলাদেশে তাদের প্রথম পিতৃনিবাস গেরদা চলে যান। তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। অন্যদিকে সৈয়দ মুহাম্মদ সাকের পিতা সৈয়দ শাহ ওসমানের সাথে ডাসার থেকে যান। গেরদার সৈয়দ বশারত আলী শাহ মোহাম্মদ যাকেরের অন্যতম এক অধস্তন। তার পুত্র শাহ ওয়াজেদ আলী কলকাতায় স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। তিনি কামেল দরবেশ হিসেবে সারা কলকতায় খ্যাত ছিলেন। পাবনার শাহ সুফি এনায়েতপুরী তার শিষ্য ছিলেন। তিনি তার নিকট হতে দীক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। তার বংশধরগণ এখন এনায়েতপুরী নামে পরিচিত। সৈয়দ আবুল হোসেনের স্ত্রী খাজা নার্গিস এনায়েতপুর দরবার শরিফের পির খাজা কামাল উদ্দিনের কন্যা।
শাহ আলীর সাথে দিল্লী হতে গেরদায় আগত ভাগ্নে শাহ হাবিব মামার মৃত্যুর পর ফরিদপুরের বোল মন্দিরায় বসতি স্থাপন করেন। এ বংশের অন্যতম অধস্তন পুরুষ সরোয়ারজান বরিশালের বামনার জমিদার ছিলেন। হযরত শাহ আলী বোগদাদীর সাথে শাহ হুসাইন তেগ বরহানা ও ত্বদীয় পুত্র শাহ হাবিবুল্লাও দিল্লী হতে ফরিদপুর এসেছিলেন। শাহ হাবিবুল্লা কামেল ছিলেন। তার সাথে ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে শাহ আলী বোগদাদীর কন্যার বিয়ে হয়। বর্তমানে তার বংশধরগণ বনমালীতে বসবাস করছেন। শাহ আলী বোগদাদীর অধস্তন সৈয়দ শাহ সাবের-এর বংশধরদের একটি প্রশাখা গেরদার নিকটবর্তী গটটি এলাকায় বসতি গড়ে তোলেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এ বংশের একজন বংশধর।
শাহ আলী বোগদাদীর মৃত্যুর ঘটনার ন্যায় মৃত্যু তারিখ নিয়েও মতভেদ ও রহস্য রয়েছে। ড. মোহাম্মদ এনামুল হকের মতে, শাহ আলী বোগদাদী পনেরো শতকে জীবিত ছিলেন এবং ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে মৃত্যুবরণ করেন। তবে মিস্টার বি.সি এলেন, ড. আহম্মদ হাসান দানি ও ড. মাহমুদুল হাসান মনে করেন শাহ আলী বোগদাদী ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। গেরদায় বসবাসকারী শাহ আলী বোগদাদীর কুরছিনামা অনুযায়ী ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর আসেন এবং ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। পারিবারিক বৃত্তান্ত অনুযায়ী শাহ আলী বোগদাদী ১২৪ বছর জীবিত ছিলেন। এত লম্বা সময় বেঁচে থাকার বর্ণনা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য। এ অবস্থায় ড. মোহাম্মদ এনামুল হকের মন্তব্য যথার্থ মনে হয়। অর্থাৎ শাহ আলী বোগদাদী ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় ইতিহাসবেত্তাগণ এ মর্মে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, তিনি সম্ভবত ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে বাঘের আক্রমণে মারা গিয়েছেন।৮
কুরছিনামা অনুসারে দেখা যায়, শাহ আলী বোগদাদীর পুত্র সৈয়দ শাহ ওসমান ভাঙ্গার মজলিশ আবদুল্লাহ খানের কন্যাকে বিয়ে করেছেন। মজলিশ আবদল্লাহ খানও বাগদাদ হতে এসে এখানে বসতি গড়ে তুলেছিলেন। তার সাথে শাহ ইসমাইল ও শাহ ইউসুফও বাগদাদ হতে এদেশে এসেছিলেন। সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ) মজলিশে আউলিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন। এ হিসেবেও দেখা যায়, শাহ আলী বোগদাদী ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে মৃত্যুবরণ করেন।
ঐতিহাসিক বিবরণ ও গবেষণা কর্মে সাধারণত ৪ পুরুষে একশ বছর গণনা করা হয়। সৈয়দ শাহ আলী বোগদাদী হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ চলছে। এ হিসেবে শাহ আলী বোগদাদী ১৭ শতকের প্রথমভাগে জীবিত ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে(১৬০৫-১৬২৭) বঙ্গদেশে প্রচুর মুসলিম ধর্মপ্রচারক ও আউলিয়া দরবেশের আগমন ঘটে। গেরদা মসজিদের শিলালিপিতে ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দ খোদিত। এ হিসেবে মনে করা যায়, শাহ আলী বোগদাদী সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ১৬ শতকে গেরদা আসেন এবং ১৭ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
মাদারীপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থে সিরাজ উদ্দীন আহমেদ লিখেছেন-‘ অনেকে বলেন, সৈয়দ ওসমান বড়পির আবদুল কাদের জিলানি ও হযরত শাহ আলী বোগদাদীর বংশধর। তারা বলেন সৈয়দ ওসমান হযরত শাহ আলীর পুত্র। সৈয়দ শাহ আলীর দুই পুত্র শাহ ওসমান ও হানিফ। দুই ভাইয়ের মাজার ফরিদপুর সদর থানার গেরদায় অবস্থিত। লেখক গেরদায় গমন করে দুই ভাইয়ের মাজার দেখেছেন। ডাসারের সৈয়দ ওসমান ও গেরদার শাহ ওসমান এক ব্যক্তি নয়। শাহ আলী বোগদাদীর বংশতালিকায় সৈয়দ ওসমানের উল্লেখ নেই। এক হতে পারে সৈয়দ ওসমান শাহ আলী বোগদাদীর বংশধর। অথবা তার সাথে তিনি এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসেন।
লেখক এখানে শাহ ওসমানের পিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। অধিকন্তু জনাব সিরাজ উদ্দীন আহমেদ দুই ভাইয়ের মাজার দেখেছেন না-বলে সৈয়দ ওসমান ও সৈয়দ হানিফের মাজার দেখেছেন বললে যথার্থ হতো। কারণ তিনি পরে লিখেছেন, “সৈয়দ ওসমান শাহ আলীর বংশধর হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।”শাহ আলী বোগদাদীর বংশ তালিকায় সৈয়দ শাহ ওসমানের নাম নেই উল্লেখ করা হলেও একই গ্রন্থের ১২৫ পৃষ্ঠায় প্রদত্ত শাহ আলী বোগদাদীর বংশ তালিকায় শাহ ওসমানের নাম রয়েছে। 
বস্তুত ডাসার এর সৈয়দ শাহ ওসমানই শাহ আলী বোগদাদীর পুত্র এবং গেরদায় শায়িত শাহ ওসমান শাহ আলীর সঙ্গী ছিলেন। উপরোক্ত আলোচনায় আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন শাহ আলী বোগদাদীর একজন উত্তরপুরুষ।
. মাদারীপুরের ইতিহাস, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, পঞ্চম অধ্যায় পৃষ্ঠা ১১৯।
২. মাদারীপুরের ইতিহাস, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, পঞ্চম অধ্যায় পৃষ্ঠা ১২০।
৩. মাদারীপুরের ইতিহাস, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ।
৪. মাদারীপুরের ইতিহাস, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, পঞ্চম অধ্যায় পৃষ্ঠা ১১৯।
৫. ৬৪ জেলা ভ্রমণ, লেয়াকত হোসেন খোকন, অনিন্দ্য প্রকাশ, দ্বিতীয় বর্ধিত সংস্করণ, 
ফেব্র“য়ারি, ২০০৯; পৃষ্ঠা-৩০।
৬. মাদারীপুরের ইতিহাস, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, লেখকের কথা।
৭. মাদারীপুরের ইতিহাস, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ।
৮. সৈয়দ সুলতানা বানু- পঁচাশি ও হযরত শাহ আলী বোগদাদীর জীবনী।

সৈয়দ আবুল হোসেনের বংশলতিকা ১
১. মাদারীপুর জেলার ইতিহাস, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, পির-আউলিয়ার দেশ ফরিদপুর-
মাদারীপুর, পৃষ্ঠা ১২৫-১২৬, প্রকাশকাল-২০০৬।

সৈয়দ আতাহার আলী ও সৈয়দা সুফিয়া খাতুন
সৈয়দ আলহাজ্ব আতাহার আলী (র) ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার ডাসার গ্রামে বিখ্যাত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হযরত সৈয়দ আজমত আলী এবং মা সৈয়দা লালমন। বংশগতভাবে ধর্মীয় ঐতিহ্য ও মর্যাদাময় রক্তাধিকারী সৈয়দ আতাহার আলী ইসলামি জ্ঞানে অত্যন্ত ঋদ্ধ ছিলেন। তিনি আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের পিতা।
দেশ বিভাগের পূর্বে সৈয়দ আতাহার আলী বর্ধমান জেলায় সেটেলমেন্ট বিভাগে চাকুরি করতেন। সেটেলমেন্ট বিভাগের চাকুরি ছিল অত্যন্ত লোভনীয়। এ বিভাগের চাকুরেদের প্রচুর অর্থ উপার্জনের সুযোগ ছিল। তবে তা অবৈধ পন্থায়। সৈয়দ আতাহার আলী ছিলেন অন্যরকম। তিনি কোনোদিন এক পয়সাও অবৈধভাবে অর্জন করেননি। ঘুষ গ্রহণকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতেন। সেটেলমেন্ট বিভাগে চাকুরি করলেও সৈয়দ আতাহার আলী ছিলেন অত্যন্ত সৎ এবং বিনয়ী। এ গুণগুলো পরিবাহিত হয়েছে তাঁর সুযোগ্য পুত্র-কন্যা ও নাতি-নাতনিদের ওপর। দেশ বিভাগের পর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে তিনি পাটের ব্যবসা করেন। তখন পাটের ব্যবসা ছিল যেমন সম্মানার্হ তেমনি লাভজনক। সৈয়দ আতাহার আলী পাটের ব্যবসা করে কিছু অর্থ জমা করেন। ঐ অর্থ দিয়ে গ্রামে কিছু জমিজমা ক্রয় করেন। অতঃপর পাট ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে কৃষি খামারে মনোনিবেশ করেন।১
উপমহাদেশে মুসলিম যুগের সূচনা ও বিস্তারে কালকিনির সৈয়দ পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। সৈয়দ আতাহার আলীর পূর্বপুরুষগণ আরব হতে বঙ্গদেশে ধর্মপ্রচারের জন্য এদেশে এসেছিলেন। মুসলিমগণ উপমহাদেশে শাসন ক্ষমতায় বরিত হবার সূচনালগ্ন হতে ডাসারের সৈয়দ পরিবারের পূর্বপুরুষেরা সম্রাট ও সুলতানগণের দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার ১১তম পূর্বপুরুষ শাহ আলী বোগদাদী ছিলেন দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহের (১৪৪৫-১৪৫১) দরবারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা এবং সুলতানের কন্যা আয়েশা বিবির স্বামী।২
সৈয়দ আতাহার আলীর পিতার নাম সৈয়দ আজমত আলী। তার পিতার নাম সৈয়দ কালু মিয়া মতান্তরে কান্দু মিয়া। সৈয়দ কালু মিয়ার ছেলে সৈয়দ হউদ বদু। তিনি এলাকায় সমাজসেবী ও সংস্কারক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। সৈয়দ হউদ বদুর পিতার নাম ছিল সৈয়দ মুহাম্মদ গনি এবং তার পিতার নাম মুহাম্মদ সাকের। মুহাম্মদ সাকের ছিলেন সৈয়দ শাহ মোহাম্মদ যাকেরের চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। সৈয়দ শাহ মোহাম্মদ যাকের-এর পিতার নাম আবদুর রশীদ এবং পিতামহের নাম আবদুল কাদির। আবদুল কাদির সৈয়দ শাহ ওসমানের দ্বিতীয় পুত্র এবং সৈয়দ শাহ ওসমানের পিতা হযরত শাহ আলী বোগদাদী। তিনি হযরত আলীর ছেলে হযরত ইমাম হুসাইনের অধস্তন।৩
সৈয়দ আতাহার আলী ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও দানবীর। ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী ও বিশ্বনবীর প্রিয়তমা কন্যা হযরত ফাতেমার পবিত্র রক্তের প্রবাহ যার শরীরে তিনি অমন না-হয়ে পারেন না। নবিজির মতো হযরত আতাহার আলীও ভিক্ষুকদের নিয়ে খেতেন। মাঝে মাঝে ভিক্ষুকের সংখ্যা এতো বেড়ে যেত যে নিজের ক্ষিদে মেটাতে পারতেন না। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বলা যায়। রমজান মাস। বাড়ির সদস্যসংখ্যা হিসেব করে ইফতারি তৈরি করা হলো। সৈয়দ আতাহার আলী ইফতার করে মাগরিবের নামাজ আদায় করতেন। একদিন বাইরে হাঁটতে গিয়ে মসজিদ হতে নামাজ আদায় করে বাসায় আসেন, সাথে পাঁচজন ভিক্ষুক। স্ত্রী সুফিয়া খাতুন শুধু একজনের ইফতারি রেখেছিলেন। পাঁচজন অতিরিক্ত লোক দেখে সুফিয়া আলী বললেন, ‘ইফতারি আছে এক জনের, ছয়জন কীভাবে খাবেন?’ আল্লাহ বরকত দেবেন বলে ইফতার শুরু করেন সৈয়দ আতাহার আলী। আশ্চর্যের বিষয়, সবাই ঐ দিন তৃপ্তি সহকারে ইফতার করেছিলেন। কারও কম হয়নি।
ভিক্ষুকদের প্রতি এত দয়া কেন প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন, ‘আল্লাহপাক পরীক্ষা করার জন্য আমার কাছে ভিক্ষুক পাঠান। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। স্ত্রী-পুত্র, সহায়-সম্বল, জমি-জিরাত সব অল্লাহর অনুগ্রহের দান। তা যদি হয় তো আমি কেন সামান্য বস্তু আল্লাহর জন্য ব্যয় করতে পারব না! সামান্য অসুখ হলে যেখানে আমরা কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করি না; সেখানে ভিক্ষুককে এক পয়সা না-দেয়ার জন্য বলি, ‘মাফ করেন’। এটি বড় লজ্জার, বড় আফশোসের।’ প্রতিবেশীরা সৈয়দ আতাহার আলীকে উদারতা বিবেচনায় হাতেম তাই-এর সাথে তুলনা করতেন। গ্রামের কেউ বিপদে পড়লে তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ এবং শত্র“-মিত্র নির্বিশেষে সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে যেতেন। তিনি বলতেন, ‘মানুষ মাত্র সমান। কে ভালো কে খারাপ, কে বেহেশতি এবং কে জাহান্নামিÑ এটি আল্লাহ বিচার করবেন। আমি তার নগণ্য বান্দা মাত্র।’ গরিব ও অসহায় পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য তিনি সাহায্য করতেন। গ্রামের দুস্থদের সৎকার, ছেলে-মেয়ের বিয়ে ও রোগশোকে তিনি ছিলেন সবার অভিভাবক। সেকালে ডাসার ছিল সর্বহারাদের নিরাপদ স্থল। তবে ডাসার গ্রামে সর্বহারা দল তেমন বেশি অত্যাচার করতে পারত না। সৈয়দ আতাহার আলীকে তারাও শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তিনি বলতেন, ‘একদিন এ গ্রাম সর্বহারা মুক্ত হবে।’ তার দোয়া সফল হয়েছে। তারই সুযোগ্য পুত্র সৈয়দ আবুল হোসেন কালকিনি হতে সর্বহারাদের অস্তিত্ব নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে। তবে অস্ত্র দিয়ে নয়, পিতা আলহাজ্ব সৈয়দ আতাহার আলীর মতো ভালোবাসা দিয়ে।
সৈয়দ আতাহার আলী ছিলেন মহান ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। মানুষ তাকে বুজুর্গ জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন। তবে তিনি নিজেকে মনে করতেন, একজন সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন অনেক লোক তার দোয়া নেয়ার জন্য আসতেন। অনেকে আসতেন পানি-পড়া নিতে। তিনি বলতেন: আমি আপনাদের মতো সাধারণ মানুষ। পবিত্র মনে সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনা করুন। সফলকাম হতে পারবেন। আল্লাহর রহমত পেতে হলে তার সৃষ্টির প্রতি রহমত-পরায়ণ হতে হয়।
সৈয়দ আতাহার আলী ছিলেন ইসলামি দর্শনের একজন বোদ্ধা। তিনি বলতেন, আমি আসছি খালি হাতে যাবও খালি হাতে। দুনিয়া আমার শস্যক্ষেত্র। এখানে যা ফলাব আখিরাতে তাই আমার সম্বল হবে। বাকিটুক শূন্য। তিনি তার অর্জিত ভূসম্পত্তির প্রায় সবই এলাকার শিক্ষা বিস্তারের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছেন। আতাহার আলী ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, আতাহার আলী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ এবং শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড ইউমেন্স কলেজে তার পুরো সম্পত্তি দান করে দেয়া হয়েছে।
সৈয়দ আতাহার আলীর স্ত্রীর নাম সুফিয়া আলী। তিনি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল জেলার বর্তমান আগৈলঝারা উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের সেরেল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পর্দানশীন ও ধর্মপ্রাণ মহিলা। তাঁর দুই ভাই যথাক্রমে আরজ আলী মল্লিক ও রাজ্জাক মল্লিক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর বেশি ছিল না। তবে প্রাকৃতিক শিক্ষায় তিনি ছিলেন যেমন ঋদ্ধ তেমনি উদার। সাধারণ মানুষ যা কল্পনা করতে পারতেন না, তা তিনি সহজে বাস্তবে পরিণত করতে পারতেন। সবকিছু ধীর মস্তিষ্কে পরিকল্পনা মাফিক করতে পারঙ্গম ছিলেন। তিনি ছিলেন পর্দানশীন এবং অত্যন্ত পরহেজগার। তাঁর বড় ছেলে চেয়ারম্যান ছিলেন, মেজ ছেলে মন্ত্রী, সেজো মেয়ে মনোয়ারা বেগম ঢাকা বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছেন, ছোট ছেলে সৈয়দ আবুল হাসান চক্ষু বিশেষজ্ঞ। সন্তান-সন্ততিদের এ অবস্থা দেখে তিনি খুশি হয়েছেন কিন্তু অবাক হননি। তিনি বলতেন, এতে অবাক হবার কিছু নেই। আমি আমার ছেলেদের ওভাবে গড়ে তুলেছি। কারও অনুগ্রহে নয় বরং যোগ্যতা আছে বলে তারা এ অবস্থানে।’৪ তাঁর মেজো ছেলে সৈয়দ আবুল হোসেন বড় ব্যবসায়ী। পরবর্তীকালে এম পি হয়েছেন; মন্ত্রী হয়েছেন। তার উত্তরণ দেখে মা সুফিয়া আলী অসম্ভব খুশি হয়েছেন। তবে অবাক হননি। বলতেন, ‘এটা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। আমি জানতাম আমার মেজো ছেলে অনেক বড় হবে। সে যা হয়েছে এর চেয়ে ঢের বড় হবার যোগ্যতা আমার আবুল হোসেনের আছে।৫
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি না-হলেও সুফিয়া আলী ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সুজ্ঞানী। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি ছিল কড়া নজর। তার কনিষ্ঠপুত্র ড. সৈয়দ আবুল হাসানের ভাষায়, ‘মা আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। ঠিক সময়ে খাইয়ে-দাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিতেন। স্কুল হতে আসলে খাতাপত্র গুছিয়ে রাখতেন। স্কুলের পড়া ঠিকমতো করেছি কিনাÑ সর্বদা সেদিকে নজর দিতেন। নারী শিক্ষার প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। বলতেন, ‘নারীপুরুষ সবার জন্য বিদ্যা অর্জন ফরজ। লেখাপড়ার জন্য আমাদের কাউকে তেমন বকা খেতে হয়নি। আমরা ভাইবোন সবাই লেখাপড়ার ব্যাপারে সজাগ ছিলাম।’
সুফিয়া আলী ছিলেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কোনো লোকের চোখের দিকে তাকালে ঐ লোককে সুফিয়া আলীর প্রতি শ্রদ্ধায় আনত হয়ে যেতে হতো । তিনি অনুচ্চস্বরে মায়া ভরা কণ্ঠে কথা বলতেন। কোনোদিন উঁ”ু কণ্ঠে কথা বলেননি। তাঁর কথার মধ্যে এমন একটি অলৌকিক গাম্ভীর্য থাকত যা কার্যকর করা ছাড়া শ্রোতার অন্য কোনো উপায় থাকত না। তিনি জীবনে কোনোদিন নামাজ ক্বাজা করেননি। বুদ্ধি হবার পর হতে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে আদায় করেছেন।৬ সুফিয়া আলী ছিলেন নারী শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী। জীবিতকালে তিনি ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজের দুই জন মহিলা শিক্ষককে দীর্ঘদিন নিজের কক্ষে রেখেছিলেন। উভয়ে ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তিনি তাদের সাথে একত্রে খেতেন, ঘুমোতেন। উভয়কে নিজের কন্যার মতো স্নেহ করতেন। এ ঘটনায় সুফিয়া আলীর উদার মনমানসিকতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে সহজে অনুভব করা যায় তিনি কত বড় ও কত উচ্চমানের মহিলা ছিলেন।
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর রোজ শনিবার আলহাজ্ব হযরত সৈয়দ আতাহার আলী (র.) ঢাকায় ৭১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাকে ডাসারে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। তার স্ত্রী সৈয়দা সুফিয়া আলী ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর শুক্রবার ঢাকায় ৭২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ডাসারে স্বামীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। সংসার জীবনের মতো মরণের পরও উভয়ে পাশাপাশি অনন্ত শয্যায় শায়িত। অষধিুং নব হরপব ঃড় ুড়ঁৎ পযরষফৎবহ নবপধঁংব ঃযবু ধৎব ঃযব ড়হবং যিড় রিষষ পযড়ড়ংব ুড়ঁৎ ৎবংঃ যড়সব.
সৈয়দ আবুল হোসেনের পিতামাতা উভয়ে সন্তানদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। সৈয়দ আতাহার আলীর মাজার এখন পুণ্যার্থীদের কাছে তীর্থস্থান। পিতা-মাতার ইচ্ছানুসারে সৈয়দ আবুল হোসেন পিতার মাজারের পাশে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করে দিয়েছেন। প্রতি পাঁচ ওয়াক্ত আজান পড়ে মসজিদে। সৈয়দ আতাহার আলী ও তার প্রিয়তমা স্ত্রী আলহাজ্ব সুফিয়া আলীর অন্তিম শয়ান আজানের পবিত্র দোলায় স্বর্গীয় মুর্ছনার আকাশ হয়ে ওঠে। তাঁদের সন্তান সৈয়দ আবুল হোসেনের পুণ্যময় কাজ তাদের নেকির খাতায় অনবরত পুণ্য যোগ করে যাচ্ছে এবং অনুরূপ যোগ করে যাবে অনন্তকাল।

১. সৈয়দ আতাহার আলীর কনিষ্ঠ সন্তান সৈয়দ এ হাসান। ৮/৬/২০১০ খ্রিস্টাব্দ তারিখ 
এক সাক্ষাৎকারে।
২. মাদারীপুর জেলার ইতিহাস, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ।
৩. মাদারীপুর জেলার ইতিহাস, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ।
৪. সুত্র: ড. সৈয়দ এ হাসান।
৫. সূত্র: ড. সৈয়দ আবুল হাসানের সাথে সাক্ষাৎকার, ৮/৬/২০১০ খ্রিস্টাব্দ।
৬. সূত্র: ড. সৈয়দ আবুল হাসানের সাথে সাক্ষাৎকার, ৮/৬/২০১০ খ্রিস্টাব্দ।
সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষাজীবন
জন্মস্থান ডাসার গ্রামের পাশে অবস্থিত নবগ্রাম প্রাইমারি স্কুলে সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি এ স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন। পিতা সৈয়দ আতাহার আলী তাঁকে ভর্তি করার জন্য স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। জীবনের প্রথম শিক্ষালয়ের অবস্থান হিসেবে নবগ্রামের স্মৃতি সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনের বর্ণীল ইতিহাস। প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের প্রথম দুই বছর এ বিদ্যালয়ে অতিবাহিত হয়। নবগ্রামের কথা উঠলে তিনি বলে থাকেন- জন্ম ডাসারে, অক্ষর জ্ঞান নবগ্রামে।
নবগ্রাম প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করে তিনি ডাসার প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে চতুর্থ শ্রেণি পাশ করে বর্তমান আগৈলঝারা উপজেলায় অবস্থিত মেধাকুল হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। মেধাকুল হাই স্কুল সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষা জীবনের আরেকটি স্মরণীয় পর্ব। এ স্কুল থেকে তিনি সপ্তম শ্রেণি পাশ করে গৌরনদী উপজেলায় অবস্থিত বিখ্যাত গৈলা হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। গৈলা হাই স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করে সৈয়দ আবুল হোসেন তৎকালীন মেধা পরিস্ফুটনের কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত গৌরনদী কলেজে ভর্তি হন। 
নোয়াখালী নিবাসী দুই যমজ ভাই ডাসার গ্রামে থাকতেন। জ্যেষ্ঠ জনের নাম ছিল ক্বারি বোরহান উদ্দিন। তিনি ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক ছিলেন। কনিষ্ঠ জনের নাম শামসুল আলম। তিনি সাধারণ্যে শামশু হুজুর নামে পরিচিত ছিলেন। বাংলা, আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষায় তার বিশেষ দক্ষতা ছিল। ইংরেজিও মোটামুটি জানতেন। শামসু হুজুর সৈয়দ আবুল হোসেনের বাড়িতে থেকে নবগ্রাম প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। নোয়াখালী নিবাসী ছোট যমজ হুজুরের নিকট সৈয়দ আবুল হোসেনের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি। হাতেখড়ির দিন পিতা-মাতা শিশু আবুল হোসেনকে ইসলামি শরিয়া মতে যতœসহকারে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে নতুন পাটিতে বসিয়ে দেন। ছোট হুজুর এসে তালপাতায় লিখিয়ে শিশু সৈয়দ আবুল হোসনকে হাতেখড়ি দেন। এ স্মৃতি তিনি এখনও রোমন্থন করেন: “পাটিতে বসিয়ে এবং তালপাতায় লিখিয়ে ছোট যমজ হুজুর বিছমিল্লাহহ বলে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন।” হাতেখড়ির পূর্বে তিনি বাড়িতে মা-বাবা ও অন্যান্য বড়জনদের কাছে ধর্মীয় পাঠ এবং বাংলা-ইংরেজি বিষয়ে প্রাথমিক অক্ষরজ্ঞান রপ্ত করে নিয়েছিলেন। শামশু হুজুরের অনুরোধে সৈয়দ আবুল হোসেনের পিতা-মাতা তাকে নবগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন।
ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রাথমিক বিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন আমার শ্রদ্ধাভাজন সুফিসাধক হযরত আতাহার আলীর সন্তান। সে কথা বলতে শেখার আগে আরবি শেখে। তাদের বাড়ির নারীপুরুষ সবাই ছিলেন পরহেজগার। আতাহার আলী এবং সুফিয়া আলী নিজেদের তত্ত্বাবধানে ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। তাদের বাড়িতে শামসু হুজুর লজিং থাকতেন। হুজুর সৈয়দ আবুল হোসেনকে নবগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। নবগ্রাম ডাসার থেকে তিন কিলোমিটার। আমি সৈয়দ আতাহার আলী সাহেবকে বলেছিলাম, নবগ্রাম অনেক দূর, আবুল হোসেনকে আমার স্কুলে ভর্তি করান। সৈয়দ সাহেব হেসে বলেছিলেন, শামসু হুজুর শিশু আবুলকে হাতেখড়ি দিয়েছেন, তার ইচ্ছা সে নবগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়–ক। দূরের পথ হেটে কষ্টসহিষ্ণু হোক। যাই হোক, দুই বছর পর আমি আবুল হোসেনকে আমার স্কুলে পেয়েছিলাম। সে আমার ছাত্র ছিল। তার আলোয় আজ কালকিনি আলোকিত। অবহেলিত ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয় সারা দেশে পরিচিত। আমি তার শিক্ষক ছিলাম, এটি আমার গর্ব। ভর্তি হবার আগে সৈয়দ আবুল হোসেন তার বড় ভাই সৈয়দ আবুল কাশেমের সাথে মাঝে মাঝে স্কুলে আসত। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসে সে আনুষ্ঠানিকভাবে নবগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। দুই বছর সেখানে পড়ে ডাসার প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়। যেদিন ডাসার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়, সেদিনের কথা এখনও আবছা মনে পড়ে। আতাহার আলী সাহেব আবুল হোসেনকে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার কলিজা। তাকে দেখিও, তোমার হাতে দিয়ে গেলাম।’১
সৈয়দ আবুল হোসেন ছাড়া তাঁর অন্য ভাইবোন ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেছিলেন। তিনি ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করেন। মেধাকুল হাই স্কুলে তিনি ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। তবে দুই মাস অধ্যয়ন করার পর ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে গৈলা উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল হোসেনের ছোট ভাই ড. এ হাসান বলেন, ‘আমার মামার বাড়ি বরিশাল জেলার গৈলার সেরেল গ্রামে। মামারা দুই ভাই, আরজ আলী মল্লিক ও রাজ্জাক মল্লিক। দাদা ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে চতুর্থ শ্রেণি পাশ করে মেধাকুল হাই স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তিন বছর পড়েন। তারপর গৈলা হাইস্কুল। দাদা মামা বাড়ি থেকে গৈলা হাইস্কুলে পড়তেন। মামা বাড়ির সবাই তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। গৈলা হাই স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাশ করেন। দাদা ছিলেন যেমন পড়–য়া তেমন সময়নিষ্ঠ ও অধ্যবসায়ী। মেধাকে তিনি শ্রমের সন্তান মনে করতেন। বড় মামা আরজ আলী মল্লিকের ছেলে মান্নান ভাই ছিলেন দুষ্টের শিরোমণি। লেখাপড়ায় মোটেও মনোযোগী ছিলেন না। দাদা মামাবাড়ি থেকে লেখাপড়া করবেন জানতে পেরে মামা-মামি খুব খুশি হয়েছিলেন। দাদা ছিলেন ভালো ছাত্র। তার দেখাদেখি মান্নান ভাইও ভালোভাবে লেখাপড়া শুরু করবেন- এটি ছিল তাদের আনন্দের বিষয়।’২
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি আগৈলঝারা উপজেলার বিখ্যাত গৈলা উচ্চ বিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করে গৌরনদী কলেজে বাণিজ্য বিভাগে আইকম ক্লাশে ভর্তি হন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ঐ কলেজ হতে কৃতিত্বের সাথে আই কম পাশ করার পর একই কলেজে বাণিজ্য বিভাগে বিকম ক্লাশে ভর্তি হন। সৈয়দ আবুল হোসেনের সহপাঠী আব্দুল কাদের এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘১৯৬৮ সালে আবুল ভাই আর আমি এইচএসসি পাশ করি। আমাদের ভাগ্য ভালো যে, এর দু বছর আগে ১৯৬৬ সালে গৌরনদী কলেজে কলা ও বাণিজ্য বিভাগ অনুমোদন লাভ করে। পূর্বের ন্যায় উভয়ে বাণিজ্য বিভাগে ডিগ্রি ক্লাশে ভর্তি হই।৩ গৌরনদী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন সাহেবের ভাষায়, ‘১৯৬৮ সনের জুলাই মাসে কলা ও বাণিজ্য শাখা দিয়া গৌরনদী কলেজে ডিগ্রি ক্লাশ শুরু হইল। সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ, খোয়াজপুর-এর মহান প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন ডিগ্রি ক্লাশের ১৯৬৮ ব্যাচের বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র ছিলেন।৪ ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আবুল হোসেন গৌরনদী কলেজ হতে বিকম পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ৫
প্রাথমিক বিদ্যালয় জীবনে সৈয়দ আবুল হোসেন
সৈয়দ আবুল হোসেন ডাসার প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং চতুর্থ শ্রেণি পাশ করে মেধাকুল হাই স্কুলে চলে যান। ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন শিশু আবুল হোসেন কেমন ছিলেন তা ঐ স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার সাহেব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন- ‘পাঁচ/ছয় বছর বয়সের শিশুরা স্বভাবতই চঞ্চল থাকে। শিশু আবুল হোসেন ছিল ধীর-স্থির। সে স্কুল কামাই করেছে এমন ঘটনা মনে পড়ে না। লেখাপড়ায় ছিল একাগ্র। এক সাথে সবগুলো বই নিয়ে স্কুলে আসত। কোনো ছাত্র বই না-আনলে তাকে সাহায্য করত। প্রতিটা বই আগাগোড়া মন দিয়ে পড়ত। পাঁচ বছরে আমি কোনোদিন তাকে কারও সাথে ঝগড়া করতে দেখিনি। কোনো রকম গালমন্দ, অশোভনীয় কথা মুখ দিয়ে বের হতো না। বকা দিলে মুখটা সামান্য মলিন করে হাসত। মলিন মুখটা সুন্দর হাসিতে আরও উদ্ভাসিত হয়ে উঠত। সে কোনো দিন মিথ্যা বলেনি।৬
ছোট-বেলা হতে সৈয়দ আবুল হোসেন সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতেন। বই, খাতা ও জামা-কাপড় সবসময় পরিষ্কার ঝকঝকে থাকত। শিশু আবুল হোসেন নিজে জামাকাপড় পরিষ্কার রাখতেন। বাড়িতে মা-বাবা ব্যস্ত থাকলে নিজ হাতে খাবার নিয়ে খেতেন। পড়ার টেবিল সবসময় থাকত সাজানো-গোছানো। নিজেই প্রতিদিনের পাঠ স্বেচ্ছায় শিখে নিতেন। স্কুলে আসা-যাবার পথে আবুল হোসেন খুব মার্জিতভাবে চলাফেরা করত। মুরুব্বিদের দেখলে সুন্দরভাবে সালাম দিয়ে পথের এক পাশে দাঁড়িয়ে পথ ছেড়ে দিতেন। শিক্ষক, ছাত্র, মুরুব্বি সবাই তাকে স্নেহ করতেন। তাঁর বাংলা লেখার চেয়ে ইংরেজি লেখা ছিল সুন্দর। খুব ভালো ইংরেজি জানত। অন্য ছেলেরা যখন দুষ্টমি এবং খেলায় মগ্ন থাকত সৈয়দ আবুল হোসেন তখন বসে বসে ওয়ার্ড মুখস্থ করত। যে সকল সহপাঠী লেখাপড়ায় কাঁচা ছিল তাদেরকে সে পড়া বুঝিয়ে দিত।৭
সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রাথমিক বিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী লাল মিয়ার ভাষায়, ‘স্কুলে যাবার পথে আমরা অনেক দুষ্টমি করতাম। প্রতিবেশীর গাব গাছে ঢিল- সুযোগ পেলে আম, জাম ইত্যাদি চুরি করে খেতে সংকোচ করতাম না, বরং চুরি করে খেতে পারলে গর্ব হতো। তবে আমাদের বন্ধু সৈয়দ আবুল হোসেন চুরি বা অন্য কোনো রকম দুষ্টমি সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলত। সে কোনো দিন কারও গাব গাছে ঢিল ছুঁড়েনি, আম পাড়েনি। আমরা ভাবতাম আবুল হোসেন বোকা। সে বলত, ‘চুরি করা পাপ, চুরির জিনিস খেলে কেউ বড় হয় না।’ তার মধ্যে একটা সম্মোহন ছিল। সে ছিল স্কুলের সবচেয়ে সুন্দর। ছোট বড় সবাই তাকে স্নেহ করত। তার ব্যক্তিত্ব আমাদের মোহিত করত। মুরুব্বিরা আমাদেরকে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো হতে উপদেশ দিতেন।৮
প্রাইমারি স্কুল জীবনে তিনি মনোরঞ্জনের জন্য সময় নষ্ট করতেন না। গ্রামে তখন যাত্রা, পালাগান ইত্যাদি দেখার জন্য শিশুরা কান্নাকাটি করত কিন্তু শিশু সৈয়দ আবুল হোসেনের এসব নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। তার আগ্রহ ছিল শুধু বই, বই আর বই।৯ ঠিক মার্ক টোয়েনের মতো।
মাদারীপুর ইউনাইটেড স্কুলে ভর্তি হবার ইচ্ছা এক সময় তাঁর কাছে প্রবল হয়ে উঠেছিল। সে সময় ঐ স্কুলটি এলাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। এ সময় তিনি মামা বাড়ি বেড়াতে যান। মামাত ভাইয়ের সাথে গৈলা হাই স্কুলে যান। ক্লাশে হানিফ নামের এক শিক্ষক ইংরেজিতে একটি প্রশ্ন করেন। ক্লাশের প্রথম ছাত্রটির অনেক আগে সৈয়দ আবুল হোসেন প্রশ্নটির উত্তর দিয়ে দেন। হানিফ স্যার অভিভূত হয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রধান শিক্ষকের রুমে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, একটি মেধাবী ছেলে আমাদের স্কুলে ভর্তি হতে এসেছে। তাকে বিশেষ মনযোগ দিয়ে দেখতে হবে। এরপূর্বে তিনি ইউনাইটেড স্কুল দেখতে গিয়েছিলেন। কেউ তাকে এমন অনুপ্রাণিত করেননি বা অমন কোন ঘটনাও ঘটেনি। গৈলা হাই স্কুলের ঘটনা তাকে উদ্বেল করে। তার মন থেকে ইউনাইটেট স্কুল মুছে যায়, তিনি গৈলা হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে যান।

উচ্চ বিদ্যালয়ে জীবনে সৈয়দ আবুল হোসেন
উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর সৈয়দ আবুল হোসেনের চারিত্রিক সৌন্দর্য আরও বিকশিত হতে থাকে। আব্দুল কাদের সৈয়দ আবুল হোসেনের উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ জীবনের বন্ধু। বন্ধু সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে শতাব্দীর স্মৃতি প্রবন্ধে আব্দুল কাদের লেখেন- আবুল ভাই মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতেন। তাঁর হাঁটার ভঙ্গী ছিল চমৎকার, মার্জিত এবং ব্যক্তিত্বময়। চলাফেরায় গতি ছিল, তবে কোনো চঞ্চলতা বা অস্থিরতা ছিল না। ছোটবড় সবার সাথে তিনি ভাল ব্যবহার করতেন। প্রতিটা কথা ছিল সাজানো, পরিমিত এবং সুরুচির পরিচায়ক। আধুনিক সাহিত্যের মতো ছোট ছোট সহজ বাক্যে তিনি কথা বলতেন। এটি ছিল তার অভ্যাস। কণ্ঠ ছিল মোলায়েম। বাক্যের প্রতিটা শব্দ স্পষ্টভাবে শোনা যেত। চড়া গলায় কখনও কথা বলতেন না। বিনয় মিশ্রিত ব্যক্তিত্ব ছিল তার কথাবার্তার অলঙ্কার। লেখাপড়া ছাড়া অন্য কিছুতে তেমন আগ্রহ ছিল না, তবে বিকেলে মাঝে মাঝে হাঁটতেন। বিল-ঝিল, নদীনালা, পাখি ইত্যাদি আনন্দের সাথে উপভোগ করতেন। প্রকৃতি হতে তিনি আহরণ করেছেন সৌন্দর্যবোধ ও পরিপাটিত্য এবং অধ্যয়ন হতে অর্জন করেছেন পরিমিতি বোধ ও সহনশীলতা।’
আবুল হোসেনের স্মরণশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। হাই স্কুল জীবনেই তিনি ইংলিশ-টু বেঙ্গলি অভিধানের প্রায় পুরোটা মুখস্থ করে নিয়েছিলেন। তাঁর এত বেশি ইংরেজি ওয়ার্ড মুখস্থ ছিল যে, প্রধান শিক্ষক শ্রীযুক্ত জর্জ অশ্র“ বাবু তাকে চলন্ত অভিধান ডাকতেন। কোনো শব্দের অর্থ নিয়ে সংশয় দেখা দিলে প্রধান শিক্ষক আবুল ভাইকে ডাকতেন। বলতেন, ‘হ্যালো মিস্টার ডিকশনারি, হোয়াট ইজ দ্যা মিনিং অব দিজ ওয়ার্ড?’১০
তিনি ছিলেন অত্যন্ত পড়–য়া এবং সময়নিষ্ঠ। কোনো অবস্থাতে অবহেলায় সময় নষ্ট করতেন না। তিনি কত সময়নিষ্ঠ ছিলেন তা একটি ঘটনা দ্বারা অনুধাবন করা যায়। সেরেলের মামাবাড়িতে সারাক্ষণ লোকজন আর সরগোল লেগে থাকত। ছুটির দিন তিনি ডাসার থাকলে বাড়িতে যখন ইচ্ছা তখন পড়তে পারতেন, মনোযোগ নষ্টের কোনো কারণ ঘটত না। মামা বাড়িতে দিনের বেলা সারাক্ষণ লোক গমগম করত। সরগোলের জন্য লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারতেন না। এক বন্ধের দিন তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। মামা-মামি অস্থির হয়ে পড়েন; আবুল হোসেন কোথায়! দুপুর গড়িয়ে গেল। তবু দেখা নেই। অনেক্ষণ খুঁজাখুঁজির পর মামাবাড়ির পাশের জঙ্গলে তাঁকে পাওয়া গেল। তিনি জঙ্গলের মাঝখানে এক টুকরো জমি পরিষ্কার করে পাটি বিছিয়ে একাগ্র মনে পড়ছেন। ছুটির দিন বৃষ্টি না-হলে তিনি অধ্যয়ন করার জন্য পাটি নিয়ে শন খেতে চলে যেতেন।১১
প্রাথমিক বিদ্যালয় জীবনের মতো কলেজ জীবনেও তাঁর কোনো বদভ্যাস ছিল না। তিনি পান কিংবা বিড়ি সিগারেট কোনো দিন স্পর্শ করেও দেখেননি। প্রতিদিন পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়তেন এবং আকর্ষণীয় ছাত্র হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন।১২

কলেজ জীবনে সৈয়দ আবুল হোসেন
১৯৬৬ সালে গৈলা উচ্চ বিদ্যালয় হতে আবুল হোসেন এসএসসি পাশ করে সদ্য প্রতিষ্ঠিত গৌরনদী কলেজে বাণিজ্য বিভাগে এইচএসসি ক্লাশে ভর্তি হন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঐ কলেজে অধ্যয়ন করেন। আবুল হোসেন কলেজের অনতিদূরে স্বাস্থ্য বিভাগের অর্ধনির্মিত একটি কমিউনিটি সেন্টারে ওঠেন। কমিউনিটি সেন্টারের পাশে কলেজের অধ্যক্ষ মো. তমিজ উদ্দিন স্যারের বাসা। তাঁর বন্ধু আবদুল কাদেরের ভাষায়, ‘অধ্যক্ষের কাছাকাছি থাকার জন্যই আবুল হোসেন কমিউনিটি সেন্টারে উঠেছিলেন।’ এসএসসি পাশ করার পর তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হবার সব প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন। কিন্তু গৌরনদী কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন তাকে এতই প্রভাবিত করেছিলেন যে, তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি না হয়ে গৌরনদী কলেজে ভর্তি হন। তমিজ সাহেবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন: একদিন তিনি পড়শি আনিস মামার সাথে তমিজ উদ্দিন সাহেবের বাসায় যান। দেখেন, একজন লোক বাগানে পানি দিচ্ছে। আনিস স্যার পায়ের জুতো খুলে সালাম দিলেন আমিও পায়ের জুতো খুলে তাকে সালাম দিলাম। পরে জানলাম তিনিই অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন।
গৌরনদী কলেজে ভর্তি হবার অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সকল শিক্ষক তাঁর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ছাত্র হিসেবেও আবুল হোসেন মনোযোগী ও মেধাবী ছিলেন। ব্যবস্থাপনার শিক্ষক মো. মাকসুদ আলী সৈয়দ আবুল হোসেনের আগ্রহ দেখে কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে বিনা বেতনে পড়াতেন।১৩ অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিনের ভাষায়, “আবুল হোসেন ছিলেন অধ্যয়নমুখী সতত সচেতন একজন তুলনাহীন চরিত্রের অধিকারী আদর্শ ছাত্র- মেধাবী, একাগ্র ও ভদ্র। ছাত্র হিসাবে গৌরনদী কলেজে তিনি এত ভালো গুণের অধিকারী ছিলেন যে, কেহ তাঁহাকে ভালো না-বাসিয়া পারিতেন না। ইংরেজি শিক্ষক আবদুল খালেক বলিতেন, সৈয়দ আবুল হোসেন ইংরেজির ডিপো। এমন কোনো ইংরেজি ওয়ার্ড নাই যা সে জানে না।’ তিনি ছিলেন পা হতে মাথা পর্যন্ত একজন আদর্শ ছাত্র। কলেজ পরিচালনা পরিষদ তাঁর ব্যবহারে অভিভূত ছিলেন তাই পুরষ্কারস্বরূপ তার সকল বেতন মওকুফ করে দেয়া হয়েছিল।”১৪
১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আবুল হোসেন আইকম পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আবেদন করেন। পুরো গৌরনদী কলেজের দুই জন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পান। তন্মধ্যে একজন সৈয়দ আবুল হোসেন, অন্যজন হলেন শাহ আলম। ভর্তির প্রক্রিয়া প্রায় সমাপ্তের পথে। এ সময় একদিন গৌরনদী কলেজের অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন এবং হিসাব বিজ্ঞানের শিক্ষক ঢাকায় চলে আসেন। তারা সৈয়দ আবুল হোসেন ও শাহ আলমকে গৌরনদী কলেজে ডিগ্রি শ্রেণিতে ভর্তি করার জন্য নিয়ে যেতে এসেছিলেন। সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন শিক্ষক অন্তপ্রাণ। যে দুজন শিক্ষক তাদের নিয়ে যেতে এসেছেন তারা উভয়ে তার প্রিয় শিক্ষক। তাদের কথা তিনি ফেলতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে তিনি গৌরনদী কলেজে ভর্তি হন। অবশ্য শাহ আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। 
ডিগ্রি ক্লাশে ওঠার পর মার্চের দিকে সৈয়দ আবুল হোসেন পুরোনো আবাসস্থল ছেড়ে গৌরনদী থানার নিকটবর্তী ভেটেরনারি বিভাগের একটি কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে ওঠেন। তাঁর সাথে ওঠেন পিঙ্গুলাকাটির নুরু। তাঁরা একত্রে নিজেরা রান্নাবান্না করতেন। একই রুমে থাকলে অনেক সময় রান্নাবান্না বা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আবুল ভাই ছিলেন অন্য রকম। তাঁর সাথে নুরুর কোনোদিন কোনো মনোমালিন্য হয়নি। নুরু বলতেন, ‘আবুল ভাইয়ের মেনে নেয়ার ক্ষমতা এবং বন্ধুবাৎসল্য সব কিছুর ঊর্ধ্বে। তাঁর মত রুমমেট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’১৫
কলেজ জীবনে অনেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, আবার অনেকে উচ্ছৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন এসব হতে যোজন মাইল দূরে। তাঁর কলেজ জীবন কত সুশৃঙ্খল এবং হৃদয়গ্রাহী ছিল তা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন সাহেবের জবানিতে বিধৃত করা হলো, ‘সেই সময় আবুল হোসেন ষোল-সতের বয়সের কিশোর। রবীন্দ্রনাথ এই বয়সকে বালাই বলিয়াছেন। এই বয়স ছিল দুষ্টামির বয়স। অন্য ছেলেরা কত দুষ্টুমি করিত, কোলাহল করিত, মিছিল করিত, ঝগড়া করিত। আবুল হোসেনকে আমি কোনোদিন এই সবের কাছাকাছিও যাইতে দেখি নাই। তিনি কলেজের নিয়মকানুন এবং শিক্ষকগণের উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলিতেন। শিক্ষকগণের উপদেশ-নির্দেশ তাঁহার কাছে ছিল অলঙ্ঘনীয়। ঐ বয়সে তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িতেন। ছাত্র রাজনীতির আড়ালে রাজনীতিক দলের লেজুড়বৃত্তি সৈয়দ আবুল হোসেন পছন্দ করিতেন না। তিনি বলিতেন, ‘আগে লেখাপড়া তারপর অন্য কিছু।’১৬ ছাত্ররাজনীতি তিনি পছন্দ করতেন না কারণ অধিকাংশ ছাত্ররাজনীতির আড়ালে দলের লেজুড়বৃত্তি করে এবং ছাত্র রাজনীতি বিভিন্ন কারণে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হবার ইন্ধন যোগায়। অবশ্য ছাত্রদের রাজনীতি যদি তাদের সামষ্টিক অধিকার সংরক্ষণ এবং ভবিষৎ নেতা হিসেবে গড়ে ওঠার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ হিসেবে পরিচালনা করা যায়, তাহলে সেরূপ ছাত্ররাজনীতিকে তিনি সানন্দে বরণ করে নেন।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সৈয়দ আবুল হোসেন
বিশ্ববিদ্যালয়ে আসায় সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রাথমিক, উচ্চ ও কলেজ জীবনের মার্জিত আচরণ এবং আকর্ষণীয় জীবনযাত্রা আরও শানিত হয়ে ওঠে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন একজন আদর্শ ছাত্র হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাশটি নিয়েছিলেন প্রফেসর দূর্গা দাস। কলেজ জীবনে দূর্গা দাসের গ্রন্থ পড়ে আই কম, বিকম পাশ করেছেন। দিব্য-চোখে এমন জ্ঞানী মানুষটাকে দেখে তার অনুভূতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে পড়েছিল। এটি তাঁর জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ তাঁকে আদর্শ ছাত্রের সাথে সাথে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে পরিণত করার উপাদানে বিভূষিত করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁর দৈনন্দিন জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তৎকালীন সহপাঠী ও বন্ধু ড. আবদুল মাননান বলেন, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন প্রচার-বিমুখ একজন নীরব বন্ধু, ব্যক্তিগত আড্ডায় ঝলমলে হাসিমাখা উচ্ছল এক দীপ্তি, নিজ এলাকায় গরীব-দুঃখীর কাছে বিনম্র মায়াভরা ভালোবাসার প্রতীক, আপামর জনগণের সুখে-দুঃখে বিপদে-আপদে একজন দানশীল সহযোগী, প্রসন্ন চিত্তের ও নিরহংকারী বিত্তের সমাহারে একজন বিনয়ী সুহৃদ। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমী, সৎ, কর্মনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত এবং বন্ধুবৎসল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনার কৃতি ছাত্র আমার সহপাঠী কালকিনির সৈয়দ বংশের কৃতিসন্তান, এনায়েতপুরের খ্যাতিমান পীর বংশের জামাতা সৈয়দ আবুল হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ছিল অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্যময় এবং বর্ণীল। একজন ছাত্রকে আদর্শ ছাত্র হতে হলে, যা যা করা প্রয়োজন কিংবা যে সকল কার্যাবলি হতে বিরত থাকা অপরিহার্য, তিনি তা অক্ষরে অক্ষরে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করতেন।১৭
তখনকার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন, “একদিন ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে আসছি। একটা ছেলে আমাকে দেখে তড়িঘড়ি চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। ছেলেটির এমন আচরণের কারণ প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম। ছেলেটি ছিল আমার জুনিয়র। সানগ্লাস পড়ে সিনিয়রদের সামনে দিয়ে হাঁটা শোভনীয় নয়। তাই তড়িঘড়ি সানগ্লাস খুলে ফেলেছিলো। ছেলেটির বাড়ি ছিল গোপালগঞ্জ। শিক্ষালয়ের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালে এখনও আমার গোপালগঞ্জের সে ছেলেটির কথা মনে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সে অনিন্দ্যসুন্দর শ্রদ্ধা ও স্নেহময় দিনগুলো বড় গভীর আবেগে টানে।”
বিশিষ্ট দার্শনিক অধ্যাপক মনোরঞ্জন দাশ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সৈয়দ আবুল হোসেনের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বললেন, সৌম্যকান্ত চেহারা, অনেকটা আমাদের সবচেয়ে সুদর্শন দেবতা কার্তিকের মতো। গোলাকার মুখে হাসি পুরো লেফটে। চোখে নিষ্পাপ যোজনায় সারল্যের মুখরতা। টিএসসি-র একটি আড্ডায় প্রথম তাঁকে দেখি। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে তাঁকে লক্ষ্য করছিলাম। আভিজাত্যময় ভঙ্গিতে ধীরস্থির হয়ে বক্তব্য শুনছেন। তার স্থিরতা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। এটি ব্যক্তিত্বের লক্ষণ। এমন ধীরস্থিরগণই শেষ পর্যন্ত সাফল্যের বরমাল্যে ভূষিত হন। ঐ বয়সে আমার সাথে তাকে তুলনা করলাম। আকাশ পাতাল তফাৎ। প্রথম দর্শনে সে আমাকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হলো। আমি বুঝলাম একটি কথা না বলেও মানুষ মানুষকে আর্কষণের জালে জড়িয়ে নিতে পারে। এ জন্য বলা হয়, ফেইস ইজ দ্যা ইনডেক্স অব মাইন্ড।১৮
মনোরঞ্জন দাশ আরও বলেছিলেন, ‘আমি আবুল হোসেনকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলাম। প্রথমে রাজি না-হলেও সবার অনুরোধে রাজি হলেন। সেদিন তিনি কী বলেছিলেন তা হুবহু বলতে পারব- এমন বলাটা মিথ্যা হবে। তবে যা বলেছিলেন তা আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। গ্রাম হতে সদ্য ঢাকায় আসা একটি ছেলে আমাদের মতো পোড় খাওয়া সিনিয়রদের অবাক করে দিয়েছিলেন। আমরা অবাক হয়ে তার কথা শুনেছিলাম। বক্তব্য শেষে প্রচন্ড তালিতে তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। তিনি খুব বেশি একটা আড্ডায় আসতেন না, তবে কোনো প্রস্তুতি ছাড়া যে কোনো বিষয়ে ইংরেজি ও বাংলায় সমান অনর্গলতায় বলে যেতে পারতেন।১৯

১. আমার ছাত্র আমার শিক্ষক, আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার।
২. আমার সহোদর, আমার আদর্শ, ড. এ হাসান।
৩. শতাব্দীর স্মৃতি, আব্দুল কাদের।
৪. আমার আলেকজান্ডার, আলহাজ্ব অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন।
৫. পঞ্চম জাতীয় সংসদ সদস্য প্রামাণ্য গ্রন্থ, সম্পাদনা আহমাদ উল্লাহ, পৃষ্ঠা- ২১৯।
৬. আমার ছাত্র আমার শিক্ষক, আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার, সাবেক প্রধান শিক্ষক, ডাসার 
প্রাথমিক বিদ্যালয়।
৭. মাঠ জরিপ।
৮. মো. মফিজুল হক মেম্বার, সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহপাঠী।
৯. মো. মফিজুল হক মেম্বার, সৈয়দ আবুল হোসেনের বাল্যবন্ধু ও ডাসার প্রাথমিক 
বিদ্যালয়ের সহপাঠী।
১০. শতাব্দীর স্মৃতি, আবদুল কাদের।
১১. আমার সহোদর, আমার আদর্শ; ড. এ হাসান; আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের কনিষ্ঠ 
ভ্রাতা।
১২. অজয় দাশগুপ্ত ও আবদুল কাদের সাহেবের সাথে সাক্ষাৎকার।
১৩. আবদুল কাদের-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও শতাব্দীর স্মৃতি প্রবন্ধ।
১৪. আমার আলেকজান্ডার, অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন।
১৫. আবদুল কাদের।
১৬. আমার আলেকজান্ডার, অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন।
১৭. ড. এম এ মান্নান: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং সৈয়দ আবুল 
হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু।
১৮. খুঁজে বেড়াই তারে, অধ্যাপক মনোরঞ্জন দাশ: সাবেক অধ্যাপক, লেখক, কলামিস্ট ও 
গবেষক।
১৯. খুঁজে বেড়াই তারে, অধ্যাপক মনোরঞ্জন দাশ: সাবেক অধ্যাপক, লেখক, কলামিস্ট ও 
গবেষক।

সৈয়দ আবুল হোসেনের পারিবারিক ও কর্মজীবন

পারিবারিক জীবন
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ অক্টোবর সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফিসাধক খাজা বাবা এনায়েতপুরী (রঃ)-এর সেজো ছেলে গদিনশিন সেজো হুজুর খাজা কামালউদ্দিন (রঃ)-এর সেজো কন্যা খাজা নার্গিসের শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়। সৈয়দ আবুল হোসেন ও খাজা নার্গিসের দাম্পত্য জীবন পারস্পরিক বোঝা-পড়ার অনাবিল উপন্যাস। এখানে শুধু হৃদয় নয়, আছে পরস্পর নৈকট্য লাভের আকুলতা, যা সবুজাভ অরণ্যের মতো অধরা-মাধুরী আর বিহ্বল ঐশ্বর্যে কাণায় কাণায় ভর্তি। শত ব্যস্ততার মাঝেও সৈয়দ আবুল হোসেন সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার আর রাতের ডিনার বাসায় স্ত্রী-কন্যাদের সাথে সারেন। এটি কাজের সাথে সংসারের প্রতিও সৈয়দ আবুল হোসেনের ঐকান্তিক আকর্ষণের একটি প্রমাণ। স্ত্রী-কন্যা; যাদের সময় নিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন এত বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, এত বিখ্যাত হয়েছেন- তাদের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার সীমা নেই, ভালোবাসার অন্ত নেই। এখানেই স্বার্থক খাজা নার্গিস। এটি অনুধাবন করতে পারেন বলেই খাজা নার্গিস তাঁর স্বামীর প্রতি এত ঐকান্তিক। এখানেই সৈয়দ আবুল হোসেনের স্বার্থকতা।১
ব্যক্তিগত জীবনে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। অমায়িক, ভদ্র, সজ্জন, পরোপকারী, দয়ালু ও দানশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাদৃত। তাঁর সহধর্মিণী বেগম খাজা নার্গিস হোসেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সুফিসাধক হযরত খাজা এনায়েতপুরী (রঃ)-এর পৌত্রী ও এনায়েতপুর দরবার শরীফের বর্তমান গদিনশিন হুজুর পাক হযরত খাজা কামাল উদ্দিন সাহেবের কন্যা। সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন ও সৈয়দা ইফফাত হোসেন নামে তাঁদের দু’টি কন্যা সন্তান রয়েছে। তারা উভয়ে অত্যন্ত মেধাবী এবং আমেরিকার খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চ ডিগ্রিধারী।
তাঁর বিনয় ও সৌজন্যবোধের বর্ণনা দিতে গিয়ে মো. মোজাম্মেল হক খান বলেছেন, সদাচরণের ক্ষেত্রে তিনি এক অনন্য মহান ব্যক্তিত্ব। জন্মগতভাবে ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক শিক্ষা এবং পরবর্তীকালে সামাজিকীকরণের অন্যান্য মাধ্যমে অর্জিত বিভিন্ন গুণের সমাহার তার চারিত্রিক মাধুর্যকে আরও বিকশিত করেছে। পদমর্যাদায় তাঁর কাছেও নেই এমন মানুষকে যে ভাষায় এবং আচরণে তিনি মোহবিষ্ট করছেন তার দৃষ্টান্তও বিরল। তাঁর অকল্পনীয়, অসাধারণ, মুগ্ধকর ব্যবহারের কৌশল ও সৌন্দর্য অবলোকন করার সুযোগ যারা পেয়েছেন তাদের অভিভূত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা তাঁর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত কোনো ব্যক্তিকে (যাঁদেরকে তিনি চেনেন) অথবা গর্হিত অপরাধ করে ফেলেছেন এমন কাউকেও কটু কথা বলতে শেখেননি। কি করে কথার যাদুতে তিনি বিরুদ্ধাচারীকেও বশীভূত করেন তা দেখে তাজ্জব বনে যেতে হয়। আমার সৌভাগ্য চাকুরির সুবাদে আমাকে প্রতিদিনই এগুলোর সাক্ষী হতে হচ্ছে। তাঁর সাহায্য প্রার্থনার জন্য এসেছেন এমন দর্শনার্থীকেও সিঁড়ির/লিফটের গোড়া পর্যন্ত গিয়ে অভ্যর্থনা ও বিদায় জানানোর যে কাজটি তার নিত্যকার ঘটনা তা আমার ২৮ বছরের চাকুরি জীবনে আর দ্বিতীয়টি চোখে পড়েনি।২
মো. মোজাম্মেল হক আরও বলেন, ‘সৌজন্য প্রদর্শন, শ্রদ্ধাবোধ, প্রটোকল এ গুলো ঊর্ধ্বগামী। যাদের থেকে এগুলো উৎসারিত, ত্যাগের আনন্দ ছাড়া বাকি সুফলগুলো বড়রাই ভোগ করেন। এখানেও তিনি ব্যতিক্রম। বয়স, পদমর্যাদা নির্বিশেষে এখানেও তিনি শুধু দাতা, ভোক্তা নন। ছোটদের প্রতিও স্বভাবসুলভ হাসি, আন্তরিকতা এবং যথোপযুক্ত শব্দসম্ভার প্রয়োগ করে তিনি মিথস্ক্রিয়াকে প্রাণবন্ত ও দীপ্তিমান করে তোলেন। ফলে সহযোগীদের কর্মস্পৃহা, পারস্পরিক সমঝোতা ও কর্মসহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে তা খুবই ফলদায়ক হয় । যার সুফল মন্ত্রণালয় ও আমরা প্রতিনিয়ত ভোগ করছি।৩
এ প্রসঙ্গে হাসনাত আবদুল হাই-এর বর্ণনা আরও হৃদয়গ্রাহী, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন প্রথম দৃষ্টিতেই নিকটের একজন হয়ে যান কোনো সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়াই। তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য, বিনয়ী ব্যক্তিত্ব এবং সদা হাস্যময় মুখ তাঁকে প্রিয় করে তোলে প্রথম পরিচয়েই। বয়সে, সামাজিক অবস্থানে এবং অন্যান্য পার্থক্য না-মনে রেখেই তিনি আলাপচারিতা করেন সবার সঙ্গে একইভাবে, প্রীতি, ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে। এমন অমায়িক, সরল ও আন্তরিক ব্যক্তিত্ব সহজেই মানুষকে কাছে টানে, সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনেও তাই হয়েছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তার মধুর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়নি, আন্তরিকতার স্পর্শে বিহ্বলতা জাগেনি, সহমর্মিতার অনুভবে একাত্মতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি, এমন অভিজ্ঞতায় তাঁকে যারা জেনেছেন ও চিনেছেন তাদের কারো হয়েছে এ কথা বলা দুষ্কর।’৪
সৈয়দ আবুল হোসেন রবীন্দ্র সংগীতের ভক্ত। এক সময় প্রচুর গান শুনতেন। এখন ইচ্ছা থাকলেও সময় পান না। অধ্যয়ন তাঁর নেশা, দান তাঁর পেশা। খ্যাতিমান ব্যক্তিদের জীবনী তাঁর প্রিয় পাঠ্যবিষয়। শিক্ষা বিস্তার এবং মানবসেবাই তার শখ।৫ দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি সৈয়দ আবুল হোসেনের আত্মনিবেদন দেখে আমার আপন মন বার বার বলে ওঠে: ও ৎবধষরুব ঃযধঃ ঢ়ধঃৎরড়ঃরংস রং হড়ঃ বহড়ঁময. ও সঁংঃ যধাব হড় যধঃৎবফ ড়ৎ নরঃঃবৎহবংং ঃড়ধিৎফং ধহুড়হব.

কর্মজীবন
মাস্টার্স পাশ করার পর আবুল হোসেন টিসিবি-তে কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করলেও অল্পসময় পর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। তখন সুতো ও সুতো-সম্পর্কিত রাসায়নিক দ্রব্যাদি টিসিবি-এর মাধ্যমে আমদানি করে বিসিক কর্তৃক তাঁতিদের মধ্যে বণ্টন করা হতো। ঢাকায় সুতোর গুদাম ছিল মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছনে নলগোলা নামক স্থানে। ১৯৭৪ সালের বন্যায় গুদামে পানি ঢুকে সুতো নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থায় ‘বঙ্গবন্ধু সরকার’ সুতো আমদানি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। অন্যদিকে নলগোলা গুদামের সুতো টেন্ডারে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সৈয়দ আবুল হোসেন, পাবনার আবদুল মান্নান ও আলহাজ্ব টেক্সটাইলের মালিক আবদুল হাই সম্মিলিতভাবে নলগোলা গুদামের সুতো ক্রয়ের টেন্ডার দেন। ভাগ্য ভালো তারা টেন্ডার পেয়ে যান। এ প্রাপ্তি আবুল ভাইয়ের জীবনের একটি মাইল ফলক। সুতো বিক্রি করে তিনি প্রচুর লাভ করেন। কিছু নগদ অর্থ হাতে আসে এবং এ অর্থ দিয়ে তিনি ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে সাকো ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলেন।৬
তিনি ব্যবসায় দ্রুত সফলতা লাভ করেন এবং উত্তরোত্তর এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। তাঁর ব্যবসায় সফলতার কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ হতে পরবর্তী সাত বছর এক নাগাড়ের বাণিজ্য সচিবের দায়িত্বপালনকারী এম মতিউর রহমান বলেন, ‘প্রথম যখন আবুল হোসেনের সাথে আমার পরিচয় হলো তখন তিনি এত বড় ব্যবসায়ী ছিলেন না। ব্যবসা শুরু করেছিলেন মাত্র। পুঁজিও ছিল যৎসামান্য অধিকন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও নীতিবান। তাহলে কীভাবে তিনি এত বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন? উত্তর, অনেস্টি ইজ দ্যা বেস্ট পলিসি। আসলে সততার মতো বড় মূলধন আর নেই। তাঁর আর্থিক পুঁজি কম ছিল, এটা ঠিক, তবে তাঁর এমন কিছু পুঁজি ছিল যা পৃথিবীর সকল অর্থ একত্রিত করলেও হার মানবে। এ পুঁজি হচ্ছে পরিশ্রম, সততা, সময়নিষ্ঠা আর ভদ্রতা।
পেশাগতভাবে সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও স্বচ্ছ। ব্যবহারে ছিলেন ব্যক্তিত্বময়, বিনয়ে পরিপূর্ণ মার্জিত। তিনি মিথ্যা বলতে পারেন- এমন কেউ ভাবতে পারত না। তাই সৈয়দ আবুল হোসেন যা বলতেন তা সবাই কোনোরূপ দ্বিধা ছাড়া সত্য মর্মে মেনে নিত। শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নয়, পুরো সচিবালয়ে এবং যাদের সাথে তিনি ব্যবসা করতেন, যারা তাঁর কাছে আসতেন-যেতেন, কথা বলতেন, কথা শুনতেন সবার কাছে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মানুষের পূর্ণ প্রতিচ্ছবির আদর্শিক নান্দনিকতায় গড়ে ওঠা একজন সৎ ব্যবসায়ী। সংগত কারণে তিনি পুরো সচিবালয়ে ছোটবড় সবার এবং পরিচিত সব মহলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। আমি মনে করি সৈয়দ আবুল হোসেনের বড় হবার পেছনে এটি কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ঢাকা বাণিজ্য ও শিল্প অনুষদ এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাথে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট এসোশিয়েশন, বাংলাদেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা বিভাগ এলাম নাই এসোশিয়শনের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। তিনি সাকো ডেভেলপমেন্ট সেন্টার নামে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সাহায্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এ বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে তিনি হাজার হাজার দুঃস্থ নরনারীকে স্বনির্ভর ও দক্ষ মানব হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অসংখ্য কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। এ সংস্থাটি সম্পূর্ণভাবে তাঁর নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত।
সৈয়দ আবুল হোসেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছেন। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বাসে অনুষ্ঠিত বিশ্ববাণিজ্য সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্ব করেন। একই বছর জাপানে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সোস্যাল ডেমোক্র্যাট সম্মেলনে তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে তাঁর মিডিয়া কভারেজের সার্বিক দায়িত্ব পালন করে দেশব্যাপী বিপুল সাড়া জাগান। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে আয়োজিত শিশু সংক্রান্ত সেমিনারের তিনি সফল উদ্যোক্তা। তিনি সমাজসেবা ও শিক্ষানুরাগিতার স্বীকৃতিস্বরূপ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর কর্ম, অধ্যবসায়, দেশপ্রেম ও সততার পুরস্কারস্বরূপ জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে দুই বার মন্ত্রী- একবার প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমানে পূর্ণমন্ত্রী পদে ভূষিত করেন।

১. প্রেরণাদায়িনী খাজা নার্গিস; আহমদ হোসেন বীরপ্রতীক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা 
যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত। তিনি এনায়েতপুরের গদিনশিন 
পির হযরত খাজা কামালউদ্দিনের অসংখ্য ভক্ত-শিষ্যদের একজন।
২. সৈয়দ আবুল হোসেন- আপনাকে, মো. মোজাম্মেল হক খান, সচিব, সড়ক ও রেলপথ 
বিভাগ।
৩. ঐ
৪. সৈয়দ আবুল হোসেন: ব্যক্তিগত মূল্যায়ন, হাসনাত আবদুল হাই।
৫. পঞ্চম জাতীয় সংসদ সদস্য প্রামাণ্য গ্রন্থ, সম্পাদনা আহমাদ উল্লাহ, পৃষ্ঠা- ২১৯।
৬. শতাব্দীর স্মৃতি, আবদুল কাদের।

সৈয়দ আবুল হোসেনের কৃতিত্ব, অবদান ও স্বীকৃতি
মানুষের জীবনে কর্ম, মর্ম, সফলতা, সুনাম ও খ্যাতির যতগুলো অভিধা রয়েছে তার সব ক্ষেত্রে সৈয়দ আবুল হোসেনের কৃতিত্ব ঈর্ষণীয় সাফল্যের অমিয় সুধায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ। তিনি একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ, দূরদর্শী সমাজ সংস্কারক, জনপ্রিয় নেতা, বিচক্ষণ আইন প্রণেতা, মহান দাতা, চৌকষ মন্ত্রী। দেশখ্যাত শিক্ষানুরাগীই শুধু নন, ভদ্রতা, অমায়িক ব্যবহার, সৌজন্যবোধ, উচ্চ শিক্ষা, অতি উঁচুমানের বংশমর্যাদা এবং শারীরিক অবয়বেও অতীব মনোহর একজন অসাধারণ ব্যক্তি। ইকবাল হোসেনের ভাষায়, ‘আমার নেতা সৈয়দ আবুল হোসেন বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক, শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদ, খ্যাতিমান লেখক। পারিবারিক ঐতিহ্য এমনকি চেহারা বিবেচনায়ও বাংলাদেশে আমার নেতার সাথে তুলনা করার মতো লোক খুব বেশি নেই। কেউ হয়ত বড় রাজনীতিক কিন্তু বড় ব্যবসায়ী নন; কেউ বড় দানবীর কিন্তু বড় ব্যবসায়ী বা রাজনীতিক নয়; কেউ-বা হয়ত রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং দাতা কিন্তু পারিবরিকি ঐতিহ্য নেই, শিক্ষা নেই। কিন্তু আমার নেতা সৈয়দ আবুল হোসেন এমন একজন রাজনীতিবিদ যিনি সবদিক দিয়ে পরিপূর্ণ। মানব চেতনার এমন কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই যা আমার নেতার কাছে নেই। তাই তিনি তুলনাহীন এবং অনন্য। আমার নেতা নিঃসন্দেহে তুলনাহীন মর্যাদার অধিকারী এক মহান ব্যক্তি।’১
আল্লাহ তাকে দিয়েছেন উজাড় করে। তিনিও মানুষকে দিয়ে যাচ্ছেন উদার হস্তে। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের প্রাকৃতিক দুর্যোগে উড়িরচর ও মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়ার দুর্গত মানুষদের তিনি যে উদার সাহায্য করেছেন তা এখনও সেখানকার মানুষের স্মৃতিপটে দেদীপ্যমান। পার্থিব বা অপার্থিব যাই হোক- মানুষ কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে দান করেন। তবে দানের পশ্চাতে সৈয়দ আবুল হোসেনের কোনো পার্থিব উদ্দেশ্য ছিল না। দুর্গত মানুষের কান্না তাঁর আত্মাকে বিগলিত করেছিল। অসহায় মানুষের সেবার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে মহাপ্লাবনের সময় মাদারীপুরের দুর্গত মানুষকে নিজের পরিবারের মতো নিবিড় মমতায় বুকে টেনে নিয়েছিলেন। দুর্গত মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য যা প্রয়োজন, তা বিলিয়েছেন অকাতরে। এখানেও তাঁর রাজনীতিক বা পার্থিব অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে সৈয়দ আবুল হোসেন দুর্গতদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। অসহায় মানুষকে তিনি যেভাবে সহায়তা করেন, তা কারও বিত্তের সাথে চিত্তের সুবিশাল সমন্বয় না-ঘটলে কখনও সম্ভব নয়।
দেশে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ও নিরক্ষরতা দূরীকরণে সৈয়দ আবুল হোসেনের ভূমিকা রূপকথার গল্পের মতো। বলা হয়ে থাকে, দেশে আর দশজন সৈয়দ আবুল হোসেন জন্ম নিলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটত। তাঁর একক প্রচেষ্টায় যতগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে, বাংলাদেশে আর কারও একক প্রচেষ্টায় এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়নি। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর পিতার নামে সৈয়দ আতাহার আলী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত পিতার নামে প্রতিষ্ঠা করেন সৈয়দ আতাহার আলী ইবতেদায়ি মাদ্রাসা। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে মাদারীপুরের খোয়াজপুরে প্রতিষ্ঠা করেন সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ। শিক্ষার মান, অবকাঠামো, পরিবেশ ও সফলতা বিবেচনায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের যে কোনো শ্রেষ্ঠ কলেজের সাথে পাল্লা দেয়ার সকল যোগ্যতার অধিকারী। বিশেষ করে, সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ, খোয়াজপুর-এর লেখাপড়ার মান এত উন্নত ছিল যে, প্রথম ব্যাচের একজন ছাত্র বাণিজ্য বিভাগে প্রথম স্থান এবং আর একজন চতুর্থ স্থান অধিকার করে।
মাদারীপুর জেলা লিগ্যাল এইড-এর প্রাক্তন কর্মকর্তা, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও শিক্ষাবিদ ড. একেএম আখতারুল কবীর বলেছেন, ‘আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলো এত সুনাম অর্জন করেছিল যে, মাদারীপুর এলাকার প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরোনো নাম পরিবর্তন করে সৈয়দ আবুল হোসেনের নামে নামকরণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। সবার মনে এমন বিশ্বাস জাগ্রত হয়ে উঠেছিল যে, সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের দায়িত্ব নিলে শিক্ষার্থীরা জাতীয় মেধা তালিকায় স্থান পাবে। তিনি শিক্ষক নিয়োগে এত নিরপেক্ষতা পালন করতেন যে, তার কলেজে মেধাবী শিক্ষকই সবসময় নিয়োগ পেত। সংগতকারণে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষার পরিবেশও থাকত মেধাময়।’২
কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি গর্ব। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি এ কলেজটি নতুন আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠা করেন। এমন চমৎকার পরিবেশ ও আভিজাত্যময় অবকাঠামো এবং আদর্শ ক্যাম্পাস বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। এ কলেজের শিক্ষার মান ও সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় সরকার কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীত করেছে। উল্লেখ্য, থানা পর্যায়ে বেসরকারি কলেজের মধ্যে এটি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীত হবার গৌরব অর্জন করে।
নিজ গ্রাম ডাসারে পিতার পুণ্য স্মৃতি রক্ষার্থে প্রতিষ্ঠিত ডি কে আইডিয়াল একাডেমিকে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন নিজ অর্থে কলেজে উন্নীত করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান নাম ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এন্ড কলেজ। পুরো মাদারীপুর জেলার মধ্যে এটাই একমাত্র কলেজ যেখানে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক শাখা ছাড়াও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা কোর্স চালু করা হয়েছে। গ্রামের একটি কলেজের এতদূর উন্নীত হবার পুরো কৃতিত্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের।
কালকিনির প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম কেউ মুছে দিতে পারবে না। তিনি মনে করেন, প্রাথমিক শিক্ষা সারা জীবনের শিক্ষার ভিত। এটি বিস্তৃত করা না-গেলে জাতিকে স্থবিরতা হতে মুক্তি দেয়া সম্ভব নয়।’ প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি ১০০টির অধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। স্থানীয় অংশগ্রহণকারীদের অংশ হিসেবে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে যত টাকা প্রয়োজন জনগণের পক্ষ হতে সমুদয় অর্থ সৈয়দ আবুল হোসেন একা পরিশোধ করেছেন। তাঁর এ অবদান কয়েক বছরের মধ্যে কালকিনির শিক্ষার হার ও মান দুটোকে বহুগুণে বর্ধিত করেছে। এক হিসেবে দেখা গেছে, তিনি এ পর্যন্ত প্রায় দুই শতেরও অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষভাবে অবদান রেখেছেন।
ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও উপাসনালয় প্রতিষ্ঠাতেও তাঁর অবদান অপরিসীম। সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর পিতার মাজার সংলগ্ন মসজিদ ও মাদ্রাসা ছাড়াও কালকিনি ও মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ৩৭টি মাদ্রাসা ও ৪৫টি মসজিদ প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন। তাঁর অর্থানুকূল্যে ২৯টি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হারিয়ে যাবার হাত হতে রক্ষা পেয়েছে। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সব দিকে তিনি শিক্ষার উন্নয়নে উদার। হাজার হাজার দরিদ্র মেয়ে তার দানে সংসার খুঁজে পেয়েছে।
তাঁর এলাকায় তিনি শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছেন। এসব বিদ্যালয়ের কমিউনিটি পার্টিসিপেশনের অংশ হিসেবে প্রতিটি বিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত সমুদয় অর্থ এলাকার জনগণের পক্ষ থেকে তিনি নিজ তহবিল থেকে দান করেছেন। পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজটির ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের বাসস্থানও নিজ অর্থে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদানের নিমিত্ত ‘সৈয়দ আবুল হোসেন কল্যাণ ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন।৩ এক গবেষণায় দেখা যায়, সৈয়দ আবুল হোসেন এ পর্যন্ত ৩৪১২ জন অসহায় দরিদ্র মহিলার বিয়েতে আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন। গত বিশ বছরে সৈয়দ আবুল ১৯৪৬৫ জন ছাত্রছাত্রীকে লেখাপড়ার জন্য সাহায্য করেছেন। তাঁর অর্থানুকূল্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩৭০০-এর অধিক।৪
শিক্ষা বিস্তারের কথা শুনলে সৈয়দ আবুল হোসেনের মন আপনা-আপনি উদার হয়ে যায়। তিনি সব কিছু বিলিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। তিনি মনে করেন, শিক্ষার চেয়ে ভালো বিনিয়োগ আর নেই। এটি অবিনশ্বর। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল হোসেনের একটি উদ্ধৃতি স্মর্তব্য-“আমি আমার মরহুম পিতা সৈয়দ আতাহার আলীর নামে ডাসার গ্রামে একাডেমি কলেজ, খোয়াজপুর কলেজ, কালকিনি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ডাসার শেখ হাসিনা একাডেমি কলেজ প্রতিষ্ঠা করি। দক্ষিণ বাংলার অনেক মেয়ে উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। অর্থের অভাবে তাদের কলেজে পড়া হয় না। নারী শিক্ষা বিস্তারে আমি দেশরতœ শেখ হাসিনা একাডেমি কলেজ প্রতিষ্ঠা করি। শত শত গরিব মেয়ে শেখ হাসিনা একাডেমিতে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। খোয়াজপুর কলেজ থেকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। কালকিনি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্স ও এমএ পড়ানো হয়। মফস্বলে বাংলাদেশে প্রথম অনার্স ও স্নাতকোত্তর ক্লাস মাদারীপুর জেলার কালকিনিতে শুরু হয়। নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য আমার চেষ্টায় অনেক বেসরকারি প্রাথমিক প্রাইমারি ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”৫
সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষানুরাগিতার কথা বলতে গিয়ে কালকিনি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ খালেকুজ্জামান বলেন, ‘কালকিনির এই রতœ আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের সবচেয়ে বড় সাফল্য কালকিনি অঞ্চলের শিক্ষা প্রসারে সীমাহীন অবদান। তিনি বিশ্বাস করেন, যে জাতি বা অঞ্চল যত বেশি শিক্ষিত সে অঞ্চল তত বেশি উন্নত। তাই সামর্থ্য অর্জনের সাথে সাথে তিনি শিক্ষার প্রসারে নিজেকে নিবেদিত করে দিয়েছেন। একক প্রচেষ্টায় ১৯৮৯ সালে মাদারীপুর থানাধীন অনুন্নত অঞ্চল খোয়াজপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের অন্যতম খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ। অতঃপর কালকিনি উপজেলা সদরে তৎকালীন ক্ষীণপ্রভার কালকিনি কলেজ তাঁর সার্বিক তত্ত্বাবধানে আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর সুরম্য ভবনের খ্যাতি দেশজোড়া। কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ এখন কোনো সাধারণ কলেজ নয়, দক্ষিণ বঙ্গের অন্যতম খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ ছাড়া উপজেলাধীন ডাসার গ্রামে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ, শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজ প্রতিষ্ঠিত করে প্রত্যেকটিকে খ্যাতি, অবয়ব ও শিক্ষার মান ও মননে শীর্ষে তুলে দিয়েছেন। তাঁর উদারতার ছোঁয়ায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে শশীকর শহিদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়, সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম কলেজ প্রভৃতির সার্বিক উন্নয়ন। এ বছরেই আড়িয়ালখাঁর অপর পাড়ের প্রত্যন্ত জনপদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন খাসেরহাট সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ। কলেজ ছাড়াও উপজেলার সব মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয় তাঁরই তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া তিনি শতাধিক স্বল্পব্যয়ী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাদরাসা শিক্ষার প্রসারেও তাঁর ভূমিকা অনন্য। তাঁর একক প্রচেষ্টা সমগ্র অঞ্চলকে নিরক্ষরতা মুক্ত আলোকপ্রাপ্ত অঞ্চলে পরিণত করেছে।’৬
‘কালকিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন’ তৈরিতে সৈয়দ আবুল হোসেনের একক অবদান সবচেয়ে বেশি।৭ কালকিনি উপজেলা এখন আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতাভুক্ত। যে কালকিনিতে নৌকা ছাড়া চলাচল অবিশ্বাস্য ছিল, সৈয়দ আবুল হোসেনের ছোঁয়ায় তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। গত ১৫ বছরে তিনি কালকিনি উপজেলা সদর হতে বিভিন্ন ইউনিয়নে যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে ১৪ টি সড়ক প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন করেছেন। স্থাপন করেছেন অসংখ্য রাস্তা, ব্রিজ ও কালভার্ট। যুব সমাজের নৈতিক ও সাংগঠনিক শ্রীবৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি অনেকগুলো পাঠাগার, ক্লাব, সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন ও প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছেন।৮ কালকিনির আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক উন্নয়নে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যা সৈয়দ আবুল হোসেনের উদারতায় সমৃদ্ধ হয়নি।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতিজ্ঞা ও প্রয়াস দুটোই আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্ববহ। সৈয়দ আবুল হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘গ্রামই আমাদের আসল ঠিকানা। অথচ এই গ্রাম আজ অবহেলিত। শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। কিন্তু গ্রামের লোকের লেখাপড়ার প্রতি কারও তেমন মনোযোগ নেই। গ্রামের জনগোষ্ঠীর শিক্ষার বিপুল চাহিদা মেটানের লক্ষ্যেই আমার এ প্রয়াস।’৯
লেখক ও সম্পাদক হিসেবেও সৈয়দ আবুল হোসেন স্মরণীয় ও বরণীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি ‘দি পলিটিসিয়ান’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। দেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন এবং এখনও লেখেন। আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন বোদ্ধা সমাজে দূরদর্শী রাজনীতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত। তিনি কবি সাহিত্যিকের পৃষ্ঠপোষকতার জন্যও খ্যাত। তার অর্থানুকূল্যে অনেকের রচিত বই আলোর মুখ দেখেছে।১০
সৈয়দ আবুল হোসেন একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ৯ নং সেক্টরের আওতায় থেকে হানাদারের বিরুদ্ধে বেশ কটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। একবার তিনি গ্রেনেডসহ গৌরনদীতে ধরা পড়েন। তবে ভাগ্যক্রমে রক্ষা পান।১১ তবে হানাদার বাহিনী তাঁর ওপর নির্যাতন চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় আছেন তা বলে দেয়ার জন্য নির্যাতন। তিনি বলেননি, দেশপ্রেমের অনুভূতি সব নির্যাতনকে ফুলেল ভালোবাসায় আরও তেজি করেছে। রাজাকার-আলবদরগণের নির্যাতনে সৈয়দ আবুল হোসেনের বাম হাত ভেঙে গিয়েছিল। এখনও হাতে সে চিহ্ন আছে। এটি যাতে দেখা না যায় এ জন্য তিনি সবসময় ফুলশার্ট পরে তা ঢেকে রাখেন।১২
সৈয়দ আবুল হোসেন এসডিসি নামক একটি এনজিও-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এর প্রধান অফিস মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার ডাসার গ্রামে অবস্থিত। এ প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে তিনি প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার মান উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবেশের উন্নয়ন, গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক অবদান রেখে যাচ্ছেন। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান রয়েছে। তিনি গণচিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংগঠন বোয়াও ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন
সৈয়দ আবুল হোসেন লেখক হিসেবে কেমন? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক ড. এ মাননান বলেন, দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলতে চাই, তিনি একজন মননশীল সৃজনশীল চিন্তাবিদ, চিন্তনে-লিখনে যাঁর রয়েছে অগাধ ব্যুৎপত্তি। লেখায় যাঁর সাবলীলতা ঈর্ষণীয় বিষয়। যাঁর লেখায় পাওয়া যায় কান্নার সুর, যখন তিনি কালির আঁচড়ে বলেন স্বাধীনতার জনক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর লড়াকু জীবন আর দেশদ্রোহী ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে শহিদ হওয়ার কাহিনি। যাঁর লেখনীর গুণে জীবন্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্্রষ্টা কোটি কোটি বাঙালির প্রাণ-পুরুষ সিংহ-হৃদয় ‘বাংলার মুজিব’-এর সংগ্রামী জীবন, তাঁর জীবনের বঞ্চনার কাহিনী, নৃশংসভাবে তাঁকে সহ তাঁর পরিবারের শাহাদাত-বরণের কথা। আমি তাঁরই কথা উচ্চকণ্ঠে বলতে চাই, যাঁর লেখায় দীপ্ত হয়ে উঠেছে বাংলার জনগণের চরম বিপদে সদা-সর্বদা সংগ্রামী মন নিয়ে আপোসহীন এগিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু-তনয়া সংগ্রামী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি যিনি প্রবল বিরূপতার মধ্যে থেকেও সততার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। আমি তারই কথা বিনা দ্বিধায় বলতে চাই যাঁর শানিত লেখায় বাক্সময় হয়ে উঠেছে বঙ্গজননী বেগম ফজিলাতুন্নেছার সংগ্রামময় পারিবারিক জীবন এবং শত কষ্টের মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর জেল-জীবনের সময়ে মাসুম সন্তানদের গড়ে তোলার ইতিকথা। শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর এখানেই, তাঁর লেখার মধ্যে।
আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন একজন মননশীল গ্রন্থকার হিসেবে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত। লেখক ছাড়াও তিনি সাহিত্যানুরাগী হিসেবে অনেক কবি-সাহিত্যিককে গ্রন্থ প্রকাশে সহায়ত করেছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সমাজ চিন্তামূলক অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলো উল্লেখযোগ্য :

১. স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান;
২. শেখ হাসিনা সংগ্রামী জননেত্রীর প্রতিকৃতি;
৩. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন;
৪. গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট;
৫. আওয়ামী লীগের নীতি ও কৌশল- শিল্পায়ন ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশ;
৬. শেখ হাসিনার অক্ষয় কীর্তি- পার্বত্য শান্তি চুক্তি;
৭. বঙ্গজননী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব;
৮. শেখ হাসিনার অসামান্য সাফল্য এবং
৯. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুবর্ণ জয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ।

সৈয়দ আবুল হোসেনের গ্রন্থের সমালোচক ড. আবদুল জলিল বলেছেন, তাঁর প্রতিটি গ্রন্থ ভিন্ন স্বাদ ও ব্যতিক্রমী যোজনায় পরিসজ্জিত। রাজনীতি, স্বাধীনতা, আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড, পররাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত জীবন পরম্পরায় মানবিক মূল্যবোধ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে জীবনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত কণিকা সৈয়দ আবুল হোসেনের লেখায় অপূর্ব ব্যঞ্জনায় দ্যোতিত। আবেশিত লেখা বাস্তবতার কোড়কে পরিশুদ্ধ করা গেলে তা কী পরিমাণ কার্যকর হয়, তা পাঠকমাত্রই অনুধাবন করতে পারেন। সৈয়দ আবুল হোসেনের গ্রন্থগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। মনের মাধুরী মিশিয়ে অনেক বড় বড় গ্রন্থ লেখা যায়, কিন্তু বাস্তবতার লেশমাত্র পাওয়া যায় না। সে বিবেচনায় সৈয়দ আবুল হোসেন ব্যতিক্রমী। গ্রন্থগুলোকে লেখক তথ্য, ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্র, গ্রহণযোগ্য উদ্ধৃতি দিয়ে সত্যিকার অর্থে মণির মতো আকর্ষণীয় আলেখ্যে উদ্ভাসিত করেছেন। চোখ বুলালে বোঝা যায়, প্রতিটি বই লিখতে সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রচুর পড়তে হয়েছে। কিছু কিছু বিষয় আরও চমৎকার, যা পড়ে অর্জন করা যায় না। এগুলো জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার মধুর প্রাপ্তির প্রগাঢ় অনুভব ছাড়া হয় না। পরিসরে ছোট হলেও তথ্য-তত্ত্ব ও বিষয়াবলিতে বেশ সুস্বাদু ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ প্রতিটি বই, যা পাঠকের মনে দাগ কাটতে বাধ্য।১৩

স্বীকৃতি
সাহিত্য, সমাজ, রাষ্ট্র ও দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান এবং শিক্ষা প্রসারের জন্য সৈয়দ আবুল হোসেন জাতি ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। শিক্ষা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তিনি শেরে বাংলা পদক, মোতাহার হোসেন পদক এবং জাতীয় স্বীকৃতিসহ অসংখ্য সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সার্বিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আমেরিকার বায়োলজিক্যাল ইন্সটিটিউট তাঁকে ‘ম্যান অব দ্যা মিলেনিয়াম’ পদকে সম্মানিত করে। সেবামূলক কাজে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান পুরস্কার লাভ করেন।১৪ তাঁর বন্ধু ও সাকো ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রাক্তন কর্মকর্তা জনাব আব্দুল কাদিরের ভাষায়, সৈয়দ আবুল হোসেন কমপক্ষে বাইশটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার বা সম্মাননা পেয়েছেন।
জীবনের প্রথম সংসদ নির্বাচনে তিনি মাদারীপুর-৩ নির্বাচনী এলাকা হতে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন মোল্লাকে ৩৬ হাজার ভোটে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ছিল ৬২ হাজার।১৫ ঐ নির্বাচনের সময় তিনি শুধু একবার নির্বাচনী এলাকায় গিয়েছিলেন। তাও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সাথে। তবু তিনি জয়ী হয়েছেন। কারণ তিনি ক্ষমতার জন্য নির্বাচনে যাননি, জনসেবার প্রাতিষ্ঠানিক ভিতকে মজবুত করে জনকল্যাণে শক্তিশালী ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে জনগণের কাছ হতে ভোট চাওয়ার চেয়েও জনগণের মনের গভীরে তার অবস্থান কতটুকু রেখাপাত করেছে তা সর্বাগ্রে জানা প্রয়োজন। তাঁর ভাষায়: “আমি সমাজ উন্নয়নের সাথে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে জড়িত আছি। জনগণের আহবানে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আমি ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে কালকিনি উপজেলা ও মাদারীপুর উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছি।”১৬
২০১২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্র“য়ারি মাসে গ্রন্থটি যখন প্রকাশিত হয় তখন সৈয়দ আবুল হোসেন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সংখ্যা ছিল একটি। এখন তিনটি। এ কয়েক মাসের মধ্যে তিনি স্বীয় একক প্রচেষ্টায় প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে আরও দুটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীত করেছেন। বাংলাদেশে এমন আর কোন নজির নেই। কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাড়া তিনি যে দুটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীত করেছেন সে দুটি কলেজ হলো : (১) মাদারীপুর সদর থানার খোয়াজপুর গ্রামে অবস্থিত সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ এবং কালকিনি উপজেলার ডাসার গ্রামে অবস্থিত শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজ। সরকার যখন কলেজ দুটিকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীত করে তখন সৈয়দ আবুল হোসেন মন্ত্রী ছিলেন না; কলেজ দুটির সামগ্রিক অবকাঠামো, অবয়ব, শিক্ষার মান ও অনবদ্য পরিবেশ বিবেচনায় নীতিমালার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীত করা হয়েছে। কাজ করতে হলে মন্ত্রী হওয়া যে অত্যাবশ্যক নয় তার জলন্ত প্রমাণ সৈয়দ আবুল হোসেন। তিনি মন্ত্রীত্ব হতে পদত্যাগ করার পরও দেশ ও জাতির শিক্ষা ব্যবস্থায় অনবদ্য অবদান রেখে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, ব্যক্তি আবুল হোসেন মন্ত্রী আবুল হোসেনের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য, সামর্থ্যবান ও কর্মোদ্যম।
শুধু শিক্ষা কেন, প্রশাসনিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও সৈয়দ আবুল হোসেন আপন আলোয় চিরন্তন।মন্ত্রীত্ব হতে পদত্যাগ করার পর তার জনকল্যাণমূলক কাজের গতি কোনভাবে কমেনি। বইটি প্রকাশকালে ডাসার ছিল একটি ইউনিয়ন। সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রচেষ্টায় ডাসার এখন পূর্ণাঙ্গ থানা। গত ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবগঠিত ডাসার থানার শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করে সৈয়দ আবুল হোসেনের অনবদ্য কৃতিত্বের স্বীকৃতি প্রদান করেন। 
সৈয়দ আবুল হোসেনের নির্বাচনী এলাকা মাদারীপুর-৩ কালকিনি উপজেলা এবং মাদারীপুর সদর উপজেলার ৫টি থানা যথা : মোস্তফাপুর, খোয়াজপুর, কেন্দুয়া, ঘটমাঝি এবং ঝাউদি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। তাঁর নির্বাচনী এলাকার আইনÑশৃঙ্খলা, যোগাযোগ অবকাঠামো, অধিবাসীগণের জীবনযাত্রার মান এবং মৌলিক চাহিদার প্রাচুর্য্য দেশের অনুরূপ অন্যান্য এলাকার চেয়ে যে কোন বিবেচনায় সন্তোষজনক। সৈয়দ আবুল হোসেনের বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও নিঃস্বার্থ জনকল্যাণমূলক কাজের ফলে তার পুরো নির্বাচনী এলাকা আধুনিকতার মহারথে সাবলীল গতিতে এগিয়ে। নিরাপত্তা ও শান্তি বিবেচনায় তার নির্বাচনী এলাকা আদর্শস্থানীয় হিসেবে বিবেচিত।

১. আমার নেতা, তুলনাহীন মর্যাদা, ইকবাল হোসেন।
২. ড. আখতারুল কবীর, তার চেম্বারে এক সাক্ষাৎকারে; তারিখ- ৩/৬/২০১০ খ্রিস্টাব্দ। 
৩. পঞ্চম জাতীয় সংসদ সদস্য প্রামাণ্য গ্রন্থ, সম্পাদনা আহমাদ উল্লাহ, পৃষ্ঠা- ২১৯।
৪. মাঠ জরিপে প্রাপ্ত তথ্য।
৫. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ-এর মাদারীপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থে সৈয়দ আবুল হোসেনের 
লেখা ভূমিকায়।
৬. সৈয়দ আবুল হোসেন: আধুনিক কালকিনির বিনির্মাতা অধ্যক্ষ খালেকুজ্জামান, কালকিনি 
বিশ্বদ্যিালয় কলেজ।
৭. ফরহাদ হোসেন, সাবেক জেলাপ্রশাসক, মাদারীপুর, তিনিই এ শহিদ মিনারটি ১৯৯১ 
খ্রিস্টাব্দে উদ্বোধন করেছিলেন।
৮. কালকিনি উপজেলা প্রশাসনের নথি হতে সংগৃহীত।
৯. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা- ৮০ তারুণ্য ও শিক্ষা।
১০. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, মাদারীপুর জেলার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৪৫৯।
১১. পঞ্চম জাতীয় সংসদ সদস্য প্রামাণ্য গ্রন্থ, সম্পাদনা আহমাদ উল্লাহ, পৃষ্ঠা- ২১৯।
১২. সৈয়দ আবুল হোসেন নিজ এবং কালকিনির যুদ্ধকালীন কমান্ডার ও কমান্ডার কালকিনি 
উপজেলা কমান্ড এস্কান্দার শিকদার।
১৩. ড. মো : আবদুল জলিল: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামি ইউনিভার্সিটি, 
মালেশিয়া; গবেষক ও লেখক।
১৪. পঞ্চম জাতীয় সংসদ সদস্য প্রামাণ্য গ্রন্থ, সম্পাদনা আহমাদ উল্লাহ, পৃষ্ঠা- ২১৯।
১৫. পঞ্চম জাতীয় সংসদ প্রামাণ্য গ্রন্থ, সুচয়ন প্রকাশন, আগস্ট- ১৯৯২, পৃষ্ঠা ২১৯।
১৬. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ-এর মাদারীপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থে সৈয়দ আবুল হোসেনের 
লেখা ভূমিকায়।

জনতার চোখে সৈয়দ আবুল হোসেন
আমরা জানি, সৈয়দ আবুল হোসেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ব্যাংকার। নিজ হাতে গড়া সাকো ইন্টারন্যাশনাল দেশের পরিধি ছড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিধিতে বিস্তৃত। তিনি রাজনীতিক, এমপি এবং মন্ত্রী। বিত্ত ও চিত্তে আকাশের মতো উদার। খ্যতিমান প্রাবন্ধিক, বিচক্ষণ বিশ্লেষক। বংশে বড়, কর্মে পরিচ্ছন্ন। চৌকষ কাজে, বিনয়ী ব্যবহারে। দর্শনে স্বচ্ছ। যারা সৈয়দ আবুল হোসেনকে কাছ হতে দেখেন তারা তাঁকে এভাবে মূল্যায়ন করেন। যে সকল মানুষ, বিশেষ করে, তাঁর নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ, যাঁরা তাঁকে কাছ হতে দেখার সুযোগ বেশি পাননি সে সকল মানুষের দৃষ্টিতে সৈয়দ আবুল হোসেন কেমন তা জানা প্রয়োজন ছিল। এটি জানার জন্য তাঁর নির্বাচনী এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি গবেষণা জরিপ পরিচালনা করা হয়। এ জরিপে কৃষক, কুলি, মজুর, জেলে, রিক্সাচালক ও ভিক্ষুক হতে শুরু করে শিক্ষক, ছাত্র, পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিগণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জরিপে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আলোচ্য অধ্যায় চয়িত।
মাদারীপুর জেলা শাখার যুবলীগ নেতা এমদাদুল হক সর্দার। তার কাছে সৈয়দ আবুল হোসেন একজন অসাধারণ নেতা। কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন: সৈয়দ আবুল হোসেন জাতিকে শিক্ষিত করার প্রত্যয়ে অনড়। যে কাজ গত ৫০০ বছরে কালকিনির সব লোক সম্মিলিতভাবে পারেননি, সৈয়দ আবুল হোসেন তা দশ বছরে একাই সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তিনি আমার কাছে অসাধারণ নেতা। নেতার সব গুণাবলী তাঁর মধ্যে রয়েছে। কালকিনির ইতিহাসে তাঁর মতো দেশপ্রেমিক আর জন্মায়নি। ভবিষ্যতেও জন্মাবে কিনা সন্দেহ।
কালকিনি সার্কিট হাউজের নৈশ প্রহরী উজ্জ্বল। সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম শুনে শ্রদ্ধায় মাথাটা অবনত করে বললেন: তার মতো লোক আমি দেখিনি। তিনি ভোরে উঠে নামাজ পড়েন। মন্ত্রীরা ক্ষমতার দাপট দেখায়, সন্ত্রাসী লালন করে। সৈয়দ আবুল হোসেনকে ক্ষমতার দাপট দেখাতে কখনও দেখিনি। আমাদের মতো সাধারণ লোকের সাথেও তিনি বিনয়ের সাথে কথা বলেন। কেয়ার-টেকার রেজাউল করিমের ভাষায়: সৈয়দ আবুল হোসেনকে আমি কোনোদিন রাগতে দেখিনি, বড় করে কথা বলতেও দেখিনি। আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে কথা বলেন। গরিব-দুঃখীদের জন্য তাঁর হাত সবসময় অবারিত থাকে। তিনি কালকিনিবাসীর সার্বজনীন গার্ডিয়ান।
লুৎফর রহমান জেলা পর্যায়ের একজন নেতা। সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন: কালকিনির মাটি ও মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক নিবিড়। কালকিনির জনগণ তাঁকে কত ভালোবাসে, তা তিনি নিজেও জানেন না। কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেনকে বেশি দিয়েছে নাকি সৈয়দ আবুল হোসেন কালকিনিকে বেশি দিয়েছে? এর উত্তরে লুৎফর সাহেব বললেন: কালকিনিকেই সৈয়দ আবুল হোসেন বেশি দিয়েছেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ হতে কালকিনির জন্য, কালকিনির জনগণের জন্য যে অর্থ তিনি ব্যয় করেছেন তা ব্যবসায় লাগালে তিনি আরও তিনটি সাকো প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। অথচ এ দানের পেছনে তাঁর কোনো রাজনীতিক উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি কোনো দিন এমপি হতে চাননি। কালকিনির আপামর জনগণ অনশন করে তাকে এমপি ইলেকশনে রাজি করিয়েছে।
একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী। নাম প্রকাশ না-করে বললেন: আমি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বডিগার্ড ছিলাম। এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। আমার চিকিৎসার জন্য সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে নগদ এক লক্ষ টাকা দিয়েছেন। এ কথা আমি ভুলব না। আমি হয়ত বাঁচব না কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেন আমার মৃত্যুকে তাঁর দয়া দিয়ে জীবনের আলোয় ভরিয়ে দিয়েছেন। শুধু আমাকে নয়, অনেক লোককে তিনি এমন সাহায্য করেছেন। তিনি তাঁর দানকে গোপন রাখতে চান। এমনভাবে দান করেন যেন, দাতা আর গ্রহীতা ছাড়া আর কেউ জানতে না-পারেন।
শেখ হাসিনা উইমেন্স কলেজ এন্ড একাডেমি-এর বাবুর্চি লুৎফর রহমান হাওলাদার। তার কাছে প্রশ্ন ছিল: সৈয়দ আবুল হোসেন কেমন মানুষ? আবেগাপ্লুুত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন মানুষ নন, ফেরেশতা। কলেজ পরিদর্শনে আসলে আমাদের রান্নাঘরে চলে আসেন। মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো!’ শিক্ষার জন্য তিনি নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকেন।
খুলনা নিবাসী শেখ হাসিনা উইমেন্স কলেজ এন্ড একাডেমির পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শিবপদ মণ্ডলের মতে, সৈয়দ আবুল হোসেন একজন আদর্শ মানুষ। তাঁর চরিত্রে যে গুণাবলী রয়েছে তার সহস্রাংশও কারও মধ্যে প্রকাশ পেলে তিনি মহামানব হয়ে উঠতে পারেন। নারী শিক্ষার প্রতি সৈয়দ আবুল হোসেনের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন, আমি চাই না নারীরা শুধু পাশ করুক; আমি চাই পাশের সাথে সাথে তারা কিছু জেনে পাশ করুক। তাদের পাশ যেন শুধু অলংকার না হয়, পাশ যেন তাদের সত্যিকার ক্ষমতায়নে সহায়ক এবং স্বনির্ভর হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
মো. মোস্তাফিজুর রহমান শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজের ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক। বাড়ি কুষ্টিয়া। তাঁর মতে সৈয়দ আবুল হোসেন শিক্ষার আলো, বিশেষ করে, নারী শিক্ষাকে প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য অজপাড়া গায়ে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ কলেজের ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেলে থাকা-খাওয়া হতে, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে যাবতীয় ব্যয় তিনি বহন করেন। এটি আমাকে বিমোহিত করেছে। আমি নিজ দেশ ছেড়ে এখানে পড়ে আছি। তাঁর মহান কাজের সহযোগী হতে পারায় নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে। এমন লোকের সহযোগী হতে পারা যে কোনো মানুষের জন্য ভাগ্যের ব্যাপার।
সৈয়দ আলমগীর কালকিনি উপজেলা ভূমি অফিসের এমএলএসএস। তাঁকে সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি শ্রদ্ধায় নুইয়ে পড়েন। জোরালো কণ্ঠে বললেন, ‘আমি একজন জঘন্য খারাপ লোক ছিলাম। সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে মানুষ করেছেন। তাঁর বদান্যতায় আমার এক ছেলে এখন গ্র্যাজুয়েট। সৈয়দ আবুল হোসেন কালকিনিতে জন্ম না নিলে আমার ছেলের মতো হাজার হাজার ছেলে উচ্চ শিক্ষা হতে বঞ্চিত হত। আমি প্রত্যহ পাঁচ বার নামাজ পড়ে তাঁকে দোয়া করি।’
মীরা বাড়ির আনিসুর রহমানের বয়স পঁয়ষট্টি। কোনো কাজ করতে পারেন না। লুঙ্গি পরে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের সামনে একটি টুলে বসে বিড়ি টানছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো: সৈয়দ আবুল হোসেনকে আপনার কেমন লাগে? তিনি বললেন, ভালো লাগে। কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে আনিসুর রহমান বললেন, তিনি ভালো লোক তাই ভাল লাগে। তিনি এত ভালো যে কেন ভালো লাগে বলতে পারব না। তিনি আমাদের চামড়ার মতো, আমাদের মাংশের মতো, আমাদের রক্তের মতো, চোখের মতো। এ রাস্তা, এ দোকান, এ কলেজ সব আবুল হোসেনের অবদান। তাঁকে বাদ দিলে কালকিনি আমার মতো অথর্ব এক বুড়ো। আল্লাহ্ তাঁকে আরও বড় করুক।
আবু সাইদ মো. দিদারুল আলম ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজের শিক্ষক। ডাক নাম মুরাদ। তিনি বললেন: শিক্ষকের প্রতি সৈয়দ আবুল হোসেনের শ্রদ্ধা অপরিসীম। ঢাকায় তাঁর সাথে দেখা করতে গেলে যতই ব্যস্ত থাকুন, সব ব্যস্ততা ছেড়ে আমাদের সময় দেন। শিক্ষকদের প্রতি তাঁর সম্মান, শ্রদ্ধা ও মমত্ব প্রবাদপ্রতীম। তিনি বলেন: শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষার মেরুদণ্ড শিক্ষক। তাই শিক্ষাকে কার্যকরভাবে পরিব্যাপ্ত করতে হলে শিক্ষককের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় জাতি মূর্খ হয়ে থাকবে। শিক্ষকের প্রতি সৈয়দ আবুল হোসেনের এমন শ্রদ্ধা আমাকে অভিভূত করে, শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। শিক্ষক নিয়োগে তিনি মেধা ও যোগ্যতা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করেন না।
আলমগীর সর্দারের বাড়ি পাঙ্গাসিয়া। তিনি একজন দিনমজুর। কথায় কথায় এক ফাঁকে বলে ওঠেন: সৈয়দ আবুল হোসেন ছাড়া আর কেউ এখানে এমপি হবে না। তিনি যদি মারা যান তার ছেলেকে আমারা এম পি বানাব। তার কোনো ছেলে নেই বলতে আলমগীর সর্দার বললেন: ছেলেমেয়ে একই কথা। তার বংশের কলাগাছ দাঁড়ালেও এমপি হবে। তিনি কি আপনার কোনো উপকার করেছেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, দেশের উপকার করাই আমার উপকার। তিনি না থাকলে আমি কি এ রাস্তা পেতাম, আপনি কি গাড়ি চড়ে ঢাকা হতে আসতে পারতেন? আমি দিনমজুর কিন্তু আমার মেয়ে কলেজে পড়ে। তিনি আমার মেয়ের শিক্ষা সংক্রান্ত সব খরচ বহন করছেন।
এনায়েতনগর ইউনিয়নের মাঝেরকান্দির মনির হোসেন একজন সাধারণ লোক। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো: আপনি সৈয়দ আবুল হোসেনকে চেনেন? আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘ঐ দেখুন আকাশ। ওটাকে চেনেন? তিনি আমাদের জীবনের আকাশ, আমাদের বাতাস। তাকে ছাড়া আমরা কিছু বুঝি না।’ মনির হোসেনের কাছে এমন উপমা অবিশ্বাস্য। আসলেই কালকিনির মানুষের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেন আকাশের মতো বিশাল।
দেলোয়ার হোসেন কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক। বাড়ি ঝিনাইদহ। তিনি বললেন, কোনো বেসরকারি কলেজে তদ্বির ছাড়া, ঘুষ ছাড়া চাকুরি হয় এটা আমি বিশ্বাস করতাম না। ঝিনাইদহ হতে এসে এখানে কোনো তদ্বির ছাড়া শুধু মেধার জোরে চাকুরি পেলাম। এটি এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। সৈয়দ আবুল হোসেন আমার ধারণা পাল্টে দিয়েছেন। তেমনি পাল্টিয়ে দিয়েছেন আমার মতো অনেকের সনাতন ধারণা। তাঁর মতো সৎ, নির্লোভ ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি বাংলাদেশে আর আছে কিনা জানি না।
সবুজ হোসেন একজন গ্র্যাজুয়েট। গরিব ঘরের ছেলে। সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘এ লোকটি আমাদের ত্রাণকর্তা। তিনি জন্মগ্রহণ না-করলে আমি গ্র্যাজুয়েট হতে পারতাম না। তিনি কলেজ প্রতিষ্ঠা না করলে আমি পিতা-মাতার মতো আমিও মূর্খ থেকে যেতাম। আমি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছি। মন্ত্রী মহোদয়কে বলবেন, আমার জন্য যেন একটু দোয়া করেন। আমি যেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতার চাকুরিটা পেয়ে যাই। বলবেন তো!
আবুল বাশার, বাড়ি রাজদি, পেশা শিক্ষকতা। আবুল হোসেনের সাথে তার কোনোদিন কথা হয়নি। দূর হতে দেখেছেন। তবু তিনি সৈয়দ আবুল হোসেনের ভক্ত। তিনি বললেন, বর্তমান যুগে তাঁর মতো মানুষ হয় না। সৈয়দ আবুল হোসেনের হিংসা নেই, প্রতিহিংসা নেই। শত্র“কে বন্ধু বানিয়ে চিরদিনের মত অবসান ঘটান শত্র“তার। রমজানপুরে আওয়ামী লীগ- বিএনপি-এর মধ্যে একবার তুমুল সংঘর্ষ হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সদস্যরা সৈয়দ আবুল হোসেনকে বিএনপি-এর লোকদের উচিত শাস্তি দেয়ার অনুরোধ করেন। সৈয়দ আবুল হোসেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বললেন, ‘এমনভাবে মীমাংসা করবেন যাতে বিএনপি-দলীয় লোকজন নিজেদের বঞ্চিত না ভাবেন। আমার দলের লোক বঞ্চিত ভাবলে আমার আপত্তি নেই। কারণ তারা ক্ষমতাসীন। বিএনপি-র লোকজন ন্যায় বিচার হতে যেন বঞ্চিত না-হয়। আইন অনুযায়ী কাজ করবেন।’
পাঙ্গাসিয়ার জাহিদুর রহমান সৈয়দ আবুল হোসেনের একজন ভক্ত। সৈয়দ আবুল হোসেনের বক্তব্য তাঁকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। তার ভাষণ খুব সুন্দও, প্রতিটি কথা হৃদয় কেড়ে নেয়ার মতো। বক্তব্যে সৈয়দ আবুল হোসেন নিন্দুকদের উদ্দেশে একটি কথা প্রায় বলে থাকেন। সেটি হলো: নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো, যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো। তিনি শুধু বক্তব্যে নয়, কাজের মধ্য দিয়েও এটি প্রমাণ করেন। যারা এক সময় তাঁর ঘোর বিরোধী ছিল, তারা এখন তাঁর বন্ধু। সৈয়দ আবুল হোসেন ভালোবাসা দিয়ে সকল শত্র“কে বন্ধু বানিয়ে নিয়েছেন।
পাঙ্গাসিয়ার সেকান্দর আলী উকিল একজন নিরীহ মানুষ। বয়স পঁচাত্তর। ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না। অস্পষ্ট কণ্ঠে বললেন: সৈয়দ আবুল হোসেন গরিবের বন্ধু। জনারদন্দির মোশাররফ হোসেন হাওলাদার-এর বক্তব্য অবাক করার মতো, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন এত বড় মানের মানুষ যে, তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করার মতো জ্ঞান আমার নেই। কালকিনির তিন লক্ষ লোক সম্পর্কে বলা সম্ভব হতে পারে কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পর্কে নয়। কারণ তিনি কালকিনির তিন লক্ষ লোকের অভিভাবক।’ তিনি কালকিনিতে জন্মগ্রহণ না-করলে কালকিনির বর্তমান উন্নয়ন আরও একশ বছরেও হতো না। তিনি আমাদের কমপক্ষে একশ বছর এগিয়ে দিয়েছেন।
দক্ষিণ রাজর্দির আবদুল মালেক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সৈয়দ আবুল হোসেনকে তিনি শান্তির পায়রা অভিহিত করে বললেন, ‘কালকিনি এক সময় ছিল সন্ত্রাসী এলাকা। সর্বহারাদের ভয়ে কেউ বের হতে পারত না। দিন-দুপুরে খুন হতো। এখন কালকিনি সন্ত্রাসবিহীন এলাকা। চাঁদাবাজি নেই, টেন্ডারবাজি নেই, নেই মারামারি ও সর্বহারার উৎপাত। এখানে সব দলের নেতা-কর্মীরা সৌহার্দ্যময় পরিবেশে পরম সম্প্রীতিতে বাস করেন। গত দশ বছরের আইন শৃঙ্খলার খতিয়ান দেখলে সহজে বোঝা যাবে, এ উপজেলার অপরাধ কত কমেছে।’ এগুলো করার জন্য সৈয়দ আবুল হোসেন কাউকে হাজতে দেননি। শুধু ভালোবাসা দিয়েছেন।
তিনি মুক্তিযোদ্ধা। আওয়ামী লীগ সমর্থক নন, তারপরও আবুল হোসেনকে শ্রদ্ধা করেন। নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বললেন, আবুল হোসেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রভূত সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। একদিন রাজাকারদের সহায়তায় পাক সেনারা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। মু্িক্তযোদ্ধাদের খবর দেয়ার জন্য তার উপর প্রচণ্ড অত্যাচার চালানো হয়। কিন্তু তিনি কোনো কিছু ফাঁস করেননি। তাদের অত্যাচারে সৈয়দ আবুল হোসেনের বাম হাত ভেঙে যায়। এ চিহ্ন তাঁর হাতে এখনও স্পষ্ট। এজন্য তিনি সবসময় ফুল-শার্ট পরেন। এ বিবেচনায় তিনি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাও বটে।
মো. সাইদুর রহমানের বাড়ি ভবানীপুর। ইজি ওয়াকারের ড্রাইভার। তার তিন মেয়ে স্কুলে পড়েন, ছেলে কলেজে। কীভাবে সম্ভব? তার সহজ উত্তর, কালকিনিতে সৈয়দ আবুল হোসেনের এলাকার লোকের জন্য এটি খুবই সহজ। তিনি শিক্ষার সকল উপায় এবং উপকরণকে আমাদের কাছে সহজলভ্য করে দিয়েছেন। আজম একজন মাছ বিক্রেতা। তিনি বললেন, ‘আমি কোনোদিন তাঁকে দেখি নি তবে যেখানে যাই সেখানে তাঁকে পাই- রাস্তায়, শিক্ষায়, রাজনীতিতে, অফিসে, আদালতে, কথায় এবং সবখানে।’ তার কথা শেষ হবার সাথে সাথে বাঁশগাড়িয়ার জেলে তাপস জলদাস বললেন, ‘তিনি ঈশ্বরের মতো সর্বত্র বিরাজমান। তাঁর ছায়া সবাতে সমভাবে পরিব্যাপ্ত। আমাদের কাছে তিনি দেবতা। ঈশ্বর তার মঙ্গল করুন।’
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি রফিক কোতোয়াল বলেন, তিনি অত্যন্ত পাংচুয়াল। প্রতিদিন সকাল নয়টার পূর্বে মন্ত্রণালয়ে আসেন। যেখানে যখন যাবার সময় নির্ধারিত থাকে, ঠিক সে সময় হাজির হন। তিনি ব্যবহারে বিনয়ী, আচরণে অমায়িক। কাজের প্রতি একাগ্রতা, উন্নয়নের কৌশল প্রণয়নে বিচক্ষণতা আমাকে আকৃষ্ট করে। আওয়ামী লীগের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং উদার সহায়তার যে প্রমাণ আমি পেয়েছি তা স্বচক্ষে না-দেখলে বিশ্বাস করার মতো নয়। তিনি নেত্রী আর দলের প্রতি এত অনুগত যে, নেত্রী বললে হাসতে হাসতে জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর মতো উদার ও সহনশীল নেতা আমাদের এখন বড় প্রয়োজন।
সিডি খান ইউনিয়নের নুরুল ইসলাম ফুটপাথে বসে আতর বিক্রি করছিলেন। তিনি বললেন, ‘আবুল হোসেন ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য কিছুই করেননি। তবে আমার ছেলেমেয়ে, আমার আত্মীয়-স্বজন যারা লেখাপড়া করার কথা কোনো দিন ভাবেনি, তারা এখন পান্তাভাত খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমার ছেলেও তাঁর কলেজ হতে ডিগ্রি পাশ করেছে। আমার ছেলে-মেয়েরা তার গড়া রাস্তায় হাঁটে, তার গড়া স্কুলে পড়ে। এর চেয়ে বেশি কী করবেন তিনি!
মাদারীপুর জেলার প্রাক্তন জেলাপ্রশসক আবদু সাত্তার। আবুল হোসেন সম্পর্কে তার মন্তব্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। তিনি বললেন, ‘যে বয়সে বাঙালিরা আকামে অর্থ ব্যয় করে, কুপথে খরচ করে, ফুর্তিতে মেতে থাকে, বিদেশ গিয়ে টাকা উড়ায়, সে বয়সে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো বিপুল অর্থের মালিক শহর-ছেড়ে প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় ছুটে এসেছেন দুর্গতদের সেবায়; এ আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে। তিনি বিয়ের আগে হজ করেছেন। হজ অনেকে করেন। আমি মনে করি তিনি নিজের বিবেককে আরও সচেতন ও সতর্ক রাখার জন্য অল্প বয়সে হজ করেছেন। আমি স্কুল কলেজে ছাত্রদের যে পুরস্কার দিতাম তা ক্রয় করে দিতেন আবুল হোসেন। বক্তৃতায় বলতাম, আমার দেয়া জিনিসগুলো কিনে দিয়েছেন সৈয়দ আবুল হোসেন। আমার আনন্দ আমি একজন ভালো লোকের জিনিস আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারছি।’
টুঙ্গীপাড়ার হাজি মো. চান মিয়াকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘সৈয়দ আবুল হোসেনের একটি ভালো দিক বলবেন? তিনি বললেন: তার ভালো দিক এত বেশি যে, আমি তার ভালো দিকের কথা এত অল্প সময়ে বলতে পারব না। তবে তার কোনো খারাপ দিক নেই, এটি নির্দ্বিধায় বলতে পারি। তার ভালো দিক এত বেশি যে, তা বলতে অনেক সময় লাগবে। অনেক দিন। এর চেয়ে এক কথায় বলি, তিনি সর্বাঙ্গীন সুন্দর মনের একজন আদর্শ মানুষ।’
জরিপের আরও অনেকের কথা লেখা যেত। কিন্তু পরিসর বড় করার সুযোগ নেই। বাকি যাদের কথা পৃথকভাবে লেখা হলো না তাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে জরিপ দল সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পর্কে নিম্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে: সৈয়দ আবুল হোসেন ঝড়ের আশ্রয়, বিপদের বন্ধু। তিনি ছাতার মতো সবার মাথার উপর স্থির অপলক। তিনি রোদের আশ্রয়। যার ছাতা যত বড় সে ছাতায় তত বেশি লোক আশ্রয় নিতে পারে। বিশাল ছাতা বহন করার যোগ্যতা যার আছে, সেই বিশাল ছাতা বহন করতে পারে। আবুল হোসেনের বিশাল ছাতা বহন করার ক্ষমতা রয়েছে। সৈয়দ আবুল হোসেনের এ ছাতা শুধু বিশাল নয়, মহাবিশাল। তাঁর কাছে সবাই সমান। শিকারমঙ্গলে জামায়াতের লোক বেশি। তারা সবসময় সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন। নির্বাচনে জেতার পর তিনি প্রথমে শিকারমঙ্গলের উন্নয়নে হাত দিয়েছেন। এত বড় বিশাল মনের অধিকারী ব্যক্তিকে কী বলে সম্বোধন করা যায় তা আমাদের জানা নেই। এক কথায় বলতে পারি তিনি একজন মহামানব।

সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনের 
মহামানবীয় কয়েকটি ঘটনা
উইলিয়াম ওয়ার্ডস ওয়ার্থ-এর একটি বিখ্যাত ও স্বতঃসিদ্ধ উক্তি- The best portion of a good man’s life, His nameless and remembered acts of kindness and of love. সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনে মানুষকে দয়া ও ভালোবাসা দেখানোর এমন অনেক ঘটনা আছে যা কেউ জানেন না, দেখেননি। এরূপ ঘটনা অসংখ্য, অগণিত। সুতরাং ওয়ার্ডস ওয়ার্থের ভাষায় বলা যায়Ñ তার পুরো জীবনের সিংহভাগই শ্রেষ্ঠ। প্রত্যেক মহামানবের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা সাধারণ মানুষের জীবনে ঘটার অবকাশ হয় না। এ সকল ঘটনা একদিকে শিক্ষণীয় এবং অন্যদিকে জনকল্যাণমূলক। অধিকন্তু, এ সব দুর্লভ ঘটনা পৃথিবীর মানুষকে চিন্তাচেতনা ও মননশীলতায় সমৃদ্ধ করে মানুষের মানবীয় গুণাবলীর লালনে সহায়তা করে। সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনেও এমন কিছু ঘটনা আছে যা শুধু বিস্ময়কর নয়, তারও অধিক। এ সকল ঘটনার কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো :

১.
আবদুর রশিদ কালকিনিতে একটা ছোট্ট টং দোকানের মালিক। তিনি সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেবের কাছে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠির ভাষা যা মনে আছে বলছি- ‘আপনার কর্মী মজিদ (ছদ্মনাম) আমার দোকান থেকে নগদ টাকা এবং বাকিতে কাপড়-চোপড় কিনিয়া গরিবের মধ্যে বিলি করিয়াছে। বলেছিল টাকা সাহেবের কাছ থেকে আনিয়া পরিশোধ করিবে। অনেকদিন হইয়া গেল আজ পর্যন্ত টাকা পরিশোধ করে নাই। আপনি কালকিনি আসিলে আপনার সামনে দাঁড়াইয়া টাকা চাহিব। না দিলে পেপারে লেখালেখি করিব। মোট পঞ্চাশ হাজার টাকা।’ মজিদ ছিলেন আবুল হোসেন সাহেবের একজন কর্মী। চিঠিটা হাতে নিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে বললেন, ‘রশিদ আর মজিদ দু’জনেই সাংঘাতিক দুষ্ট। ষড়যন্ত্র করে কাজটা করেছে, যাতে আমি টাকাটা দেই। দিলে উভয়ে ভাগ করে নেবে। তাদের চালাকি বুঝতে পারলেও আমি টাকা দিয়ে দিয়েছি। তবে তারা বুঝতে পারেনি, তাদের চালাকি আমি ধরে ফেলেছি। আমিও বুঝতে দেইনি। লজ্জা দিলে কী ভালো হতো! নেতা হলে অনেক সময় সমর্থকদের সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে হয়। মজিদের দোষ আছে, তবে গুণও তো আছে! কী বলেন মাস্টার সাহেব?’১

২.
জনসভার বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সদর উদ্দিন (ছদ্মনাম) সৈয়দ আবুল হোসেনকে বললেন: জনসভায় আপনি এ কথাটা বলেছেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন বললেন: আমি বলিনি।
উপস্থিত তিনজন লোক সদর উদ্দিনের পক্ষে সাক্ষ্য দিলেন। প্রত্যেকে উপজেলা পর্যায়ে মোটামুটি গণ্যমান্য ব্যক্তি। আবুল হোসেন কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাদের তিনজনের কাছে জানতে চাইলেন: সত্যি কি আমি এমন কথা বলেছি?
তিনজন সমস্বরে বললেন: জি।
সৈয়দ আবুল হোসেন হেসে বললেন, ‘বক্তৃতায় নিজের অজান্তে হয়ত এ কথাটি আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমার কিন্তু মনে পড়ছে না। আমি একজন, আপনারা তিনজন। একজনের স্মরণশক্তি তিনজনের চেয়ে কম। যদি অমন কথা বলে থাকি তো অজান্তে বলে ফেলেছি। মনে কিছু নেবেন না। আবারও বলছি অমন কথা আমার মুখ দিয়ে বের হবার নয়।’
প্রকৃতপক্ষে সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব অমন কথা বলেননি। ঐ জনসভায় আমি আবদুল আজিজ মাস্টার নিজে উপস্থিত ছিলাম। আমি শুনিনি তারা কীভাবে শুনলেন? পরে সৈয়দ আবুল হোসেন আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি অমন মন্তব্য করেছিলেন কিনা। আমি বলেছিলাম, ‘কখনও না।’ সৈয়দ সাহেব বলেছিলেন, ‘আমিও জানতাম তবু তাদের ছোট করতে ইচ্ছা করছিল না। আমি নিজে ছোট হয়ে গেলাম। এটি আমাকে আরও সতর্ক করল। ছোট না-হলে আমি বড় হবার কৌশল রপ্ত করব কীভাবে বলুন তো মাস্টার সাহেব!’২

৩.
খোয়াজপুরে আবুল হোসেন কলেজ প্রতিষ্ঠা হলো। প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল হোসেন। কলেজের প্রথম ব্যাচের দুই জন ছাত্র সবাইকে অবাক করে দিয়ে জাতীয় মেধা তালিকায় প্রথম ও চতুর্থ স্থান দখল করে নিল। কলেজ এখনও অনুমোদন পায়নি। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনসহ যাবতীয় খরচ সৈয়দ আবুল হোসেন একাই বহন করে চলেছেন। বিজ্ঞানাগারের যন্ত্রপাতি পর্যাপ্ত নয়। গভর্নিং বডির সদস্যরা অধ্যক্ষ হিসেবে আমাকে বিষয়টি সৈয়দ আবুল হোসেনকে অবগত করানোর পরামর্শ দেন। আমি বলেছিলাম, ‘আর কত চাইব, সব কিছু তো তিনি দিচ্ছেন, লজ্জা করে।’ প্রয়োজন লজ্জা মানে না। একদিন সাকো অফিসে গিয়ে বললাম, ‘কলেজের জন্য সায়েন্সের যন্ত্রপাতি লাগবে।’ একটু থেমে আবার বললাম, ‘অবশ্য পরে হলেও চলবে। তাড়া নেই।’ আমার কথা শেষ হতে না-হতে সৈয়দ আবুল হোসেন বিনয় মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন: ‘পরে কেন, এক্ষুনি নয় কেন। আগামীকাল কখনও আসে না স্যার। কত টাকা লাগবে নিয়ে যান। যন্ত্রপাতির জন্য আমার ছেলে-মেয়েরা পড়তে পারবে না, তা হয় না।’৩

৪.
সৈয়দ আবুল হোসেনের একজন ভক্ত, নাম ধরুন আফজাল (ছদ্মনাম)। আর একজন শত্র“। তিনি ইউপি চেয়ারম্যান, নাম ধরুন হিরণ (ছদ্মনাম)। আফজাল জানতে পারল সৈয়দ আবুল হোসেন হিরণকে তার চেয়ে বেশি সাহায্য করেন। ক্ষুব্ধ আফজাল একদিন সৈয়দ আবুল হোসেনকে বললেন, ‘হিরণ সবখানে আপনার বদনাম করে বেড়ায়। সারাক্ষণ আপনার ক্ষতির চিন্তা করে। কীভাবে আপনার বিপদ হয় সে চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে। আপনি তাকে একের পর এক সাহায্য করে যাচ্ছেন। শুধু তাকে নয়, যারা আপনার শত্র“, তাদের প্রত্যেককে আপনি একের পর এক সাহায্য করে যাচ্ছেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন বললেন, ‘আমি তার উপকার করছি।’ আফজাল বললেন, ‘আমি তো সবসময় আপনার পক্ষে কথা বলি। আপনার ভালো চাই। আপনি আমাকে অত সাহায্য করেন না।’ সৈয়দ আবুল হোসেন বললেন: তুমি আমার উপকার করেছ, আমিও তোমার উপকার করেছি। এটি বিনিময়। হিরণ আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে, সে আমার শত্র“। তবু আমি তাকে সাহায্য করছি। এটি বিনিময় নয়, উপকার। তোমারটা বাণিজ্য আর তারটা দান। শত্র“র উপকার করে আমি তাকে আমার বন্ধু বানিয়ে নিতে চাই।
কিছুদিন পর আফজাল অবাক হয়ে দেখলেন হিরণ চেয়ারম্যান সৈয়দ আবুল হোসেনের ভক্ত হয়ে গেছে। আরও কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর আফজাল হতবাক। কালকিনির যে সকল লোক সৈয়দ আবুল হোসেনকে বন্যায় সাহায্য দিতে বাধা দিয়েছিল এবং কালকিনিতে কলেজ প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিল তারাও সৈয়দ আবুল হোসেনের পরম ভক্ত হয়ে গেছে।৪

৫.
রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন কালকিনি আসবেন। সৈয়দ আবুল হোসেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রী মহোদয় কালকিনি সার্কিট হাউজে। একজন লোক অনেকদিন হতে তার সাথে দেখা করতে চাইছিলেন। পারছিলেন না। ঢাকা যাবার সামর্থ্য তার নেই। আজ যেভাবে হোক দেখা করবেই। কিন্তু ভেতরে আসতে পারছিল না। হঠাৎ আবুল হোসেনের চোখ যায় গেইটের দিকে। দেখামাত্র ভিড় ঠেলে ধীরপদে নিচে নেমে সোজা গেইটের কাছে চলে যান। লোকটির হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে আসেন। সে ছিল একজন বুড়ো ভিক্ষুক। নাম কানা জলিল। সৈয়দ আবুল হোসেন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কানা জলিল বলল: আমাকে একশ টাকা দেন। সৈয়দ আবুল হোসেন তাকে একশ টাকা নয়, এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন।৫

৬.
জমকালো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কঠোর নিরাপত্তা। প্রধানমন্ত্রী আসার সময় হয়ে গেছে। অনুষ্ঠানে সৈয়দ আবুল হোসেনও এসেছেন। প্রবীণ এক লোক সৈয়দ আবুল হোসেনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘আবুল হোসেন, তোমার ব্লেজারটা ভারী সুন্দর। প্রবীণ লোকটির কথা শেষ হতে-না-হতে সৈয়দ আবুল হোসেন নিজের শরীর হতে ব্লেজারটা খুলে প্রবীণ লোকটার গায়ে চড়িয়ে দিলেন। জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আপনাদের জন্যই আমার ব্লেজার এত সুন্দর হয়েছে। আপনারাই আমার ব্লেজারকে সুন্দর করেছেন। আপনাদের স্বীকৃতিই আমার গৌরব। আমি আলো আপনারা সলতে। আপনারা জ্বলেন বলেই আমি আলোকিত। আপনাদের ঋণ শোধ আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনাদের আলো দিয়ে অন্যকে আলোকিত করতে পারলে ঋণভার হয়ত কিছুটা শোধ হবে।’৬

৭.
২০০১ খ্রিস্টাব্দ। সৈয়দ আবুল হোসেন গাড়িতে। শেরাটনের সামনে সিগন্যাল পেয়ে গাড়ি থেমে যায়। একটা লোক খোঁড়াতে খোঁড়াতে গাড়ির কাছে আসে। তার হাতে কিছু বই, কিছু ম্যাগাজিন। সৈয়দ আবুল হোসেন জানালা নামিয়ে খোঁড়া লোকটার হাতে দশ হাজার টাকা দিলেন। ব্যাপার কী জানতে চাইলে সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছিলেন: কিছু দিন আগে এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সিগন্যাল পেয়ে ড্রাইভার গাড়ি থামায়। ঐ লোকটির কাছ হতে একটা ম্যাগাজিন নিই। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করলে জানায় মাদারীপুর। লোকটি খোঁড়া। তবু ভিক্ষা না-করে অনেক কষ্টে হেঁটে হেঁটে বই আর ম্যাগাজিন বিক্রি করছে। আমার ভালো লাগল। বসে বসে এ ব্যবসা করলে কত টাকা লাগবে জানতে চাইলে সে ছয়-সাত হাজার টাকার প্রয়োজন বলে জানায়। আজ দিয়ে দিলাম। বসে বসে ব্যবসা করুক। অত কষ্ট করে হাঁটতে হবে না।৭

৮.
অজয় দাশগুপ্ত। নামকরা সাংবাদিক। কে না চেনে তাকে। তার আরও একটি পরিচয় আছে। তিনি সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে গৈলা স্কুলে একই সাথে পড়েছিলেন। বন্ধু অজয় দাশগুপ্তের ছেলে স্কলারশিপ নিয় আমেরিকা যাবে। আমেরিকা যেতে হলে পর্যাপ্ত ব্যাংক ব্যালেন্স দেখাতে হয়। এত টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স দেখানো অজয় দাশগুপ্তের পক্ষে সে মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছিল না। এখন উপায়! ঘটনার আগাগোড়া জানতে পেরে সৈয়দ আবুল হোসেন অজয় দাশগুপ্তকে ডেকে নিয়ে বললেন: টাকার জন্য ছেলের স্কলারশিপ বাতিল হতে পারে না। সৈয়দ আবুল হোসেন অজয় দাশগুপ্তের ছেলের নামে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার একটা একাউন্ট করে চেক-বহিসহ অন্যান্য কাগজপত্র অজয় দাশগুপ্তের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সৈয়দ আবুল হোসেন এরূপ মহানুভবতার সাথে এগিয়ে না-আসলে ছেলেকে আমেরিকা পাঠাতে পারতেন কিনা সন্দেহ ছিল।৮

৯.
সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন ঢাকা হতে কালকিনি যাবার সহজ উপায় ছিল লঞ্চ। ঢাকার লঞ্চ বরিশাল হয়ে মাদারীপুর যেত। একদিন সৈয়দ আবুল হোসেন বাড়ি যাবার জন্য লঞ্চে ওঠেন। অসাবধানতাবশত লঞ্চ ভাড়া দিতে ভুলে যান। বাড়িতে ঢোকার পর লঞ্চ ভাড়া না-দেয়ার কথা মনে পড়ে এবং মনে পড়ার সাথে সাথে কাপড়-চোপড় না-খুলে আবার লঞ্চঘাটে চলে যান। যে লঞ্চে এসেছিলেন সেটি ততক্ষণে চলে গেছে। আর একটি লঞ্চে করে তিনি ঢাকা ফেরেন। ঢাকায় এসে ঐ লঞ্চটি খুঁজে নেন। তারপর প্রাপ্য ভাড়া মিটিয়ে পরের লঞ্চে আবার গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।৯
১০.
আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের ছোট ভাই ডা. সৈয়দ এ হাসানের জবানিতে একটি ঘটনা শোনা যাক- ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পরের ঘটনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। চারিদিকে অভাব। পাকিস্তানি বাহিনির অত্যাচারে হিন্দুদের অবস্থা শোচনীয়। আমাদের গ্রামের হিন্দুদের অবস্থাও এর বাইরে নয়। এক হতদরিদ্র হিন্দু ভদ্রলোক আমাদের বাড়ির পাশে বর্ষার জলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতেন। সন্ধ্যায় বড়শি দিয়ে যেতেন। সকাল-বেলা এসে মাছ তুলতেন। একদিন সকালে মাছ তুলতে এসে হাজি চাচার ভিটির পেঁপে চুরি করতে যান। আওয়াজ পেয়ে লোকজন বেরিয়ে এসে তাকে বেঁধে রাখে। অনেক লোক জড়ো হয়। খবর পেয়ে আমিও যাই। চোর দেখার আগ্রহই ছিল আলাদা। শুনতাম চোর ধরলে মাথার চুল কেটে দেয়া হয়। আমি আরও কয়েকজন বন্ধু চোরের মাথার চুল কেটে দেই। ঐদিন দাদা (সৈয়দ আবুল হোসেন) ঢাকা হতে বাড়ি এসেছিলেন। আমাকে বাড়ি না-পেয়ে জানতে চান আমি কোথায়। খবর পেয়ে বাড়ি যাই। আমার কাছে ঘটনা শুনে দাদা আঁতকে ওঠেন। তাড়াতাড়ি হাজি চাচার উঠোনে এসে চোরের বাঁধন খুলে দিয়ে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসেন। আমাকে দিয়ে চোরের পা ধরিয়ে ক্ষমা চাওয়ান। হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করে চোরকে পেট পুরে খাইয়ে দেন। অতঃপর হাতে টাকা দিয়ে নাপিতের দোকান হতে চুল কাটানোর ব্যবস্থা করেন।১০

১. সূত্র কালকিনি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আবদুল আজিজ মাস্টার।
২. সূত্র কালকিনি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আবদুল আজিজ মাস্টার।
৩. সূত্র: মো. তমিজ উদ্দিন. সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষক এবং প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সৈয়দ 
আবুল হোসেন কলেজ, খোয়াজপুর
৪. সূত্র কালকিনি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আবদুল আজিজ মাস্টার এবং 
মাঠ জরিপ।
৫. সূত্র : কালকিনি সার্কিট হাউজের কেয়ারটেকার রেজাউল করিম।
৬. এমদাদ হাওলাদার, সহসভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি।
৭. ইকবাল হোসেন, ছাত্রনেতা, কালকিনি; তিনি ঐ গাড়িতে সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে 
ছিলেন।
৮. তথ্য সূত্র: অজয় দাশগুপ্ত এবং অজিত; তারিখ ১/৬/২০১০ খ্রিস্টাব্দ।
৯. ড. এ হাসান, সৈয়দ আবুল হোসেনের ছোট ভাই।
১০. ঐ

সৈয়দ আবুল হোসেন : তেজময় সিংহপুরুষ
অহঙ্কার পতনের মূল
খোয়াজপুর সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অবকাঠামো সম্পন্ন হয়ে গেছে। অনেক ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগও চূড়ান্ত। কলেজ ক্যাম্পাস মুখরিত। তবু সবার মনে একটা দুঃখ খচ্খচ্ করছে। কলেজ অদ্যাবধি এমপিও-ভুক্ত হয়নি। সৈয়দ আবুল হোসেন চেষ্টা করছেন। শিক্ষামন্ত্রী এ কলেজকে এমপিও-ভুক্ত করার প্রচণ্ড বিরোধী। একদিন পত্রিকায় খবর বের হলো- খোয়াজপুর কলেজ সরকার এমপিও-ভুক্ত করবে না। খবর পড়ে ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকদের মাথায় হাত। শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ হতাশায় নিমজ্জিত। সৈয়দ আবুল হোসেন ত্রিশ লক্ষাধিক টাকা এ কলেজের পেছনে ব্যয় করেছেন। টাকা ব্যয় না হয় পূরণ করা যাবে। ছাত্রছাত্রীদের জীবনের যে অমূল্য সময় নষ্ট হলো তা তো কোনো কিছু দিয়ে শোধ করা যাবে না। এখন উপায়!
আব্দুল কাদের, আজিজ মাস্টার ও অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিনসহ অনেকে সৈয়দ আবুল হোসেনকে গিয়ে ধরলেন। এখন কী হবে? খোয়াজপুর কলেজকে সরকার অনুমোদন দেবে না। ছাত্রছাত্রী যারা ভর্তি হয়েছে তাদের নাকি ফিরে যেতে হবে। অনেকে হাসাহাসি করছে। ছাত্রছাত্রীদের উত্যক্ত করছে। কী করি? এর চেয়ে তো মরে যাওয়া ভালো। আবুল হোসেন তাদের কথা শুনে কোনোরূপ হতাশ প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। হেসে বললেন: আমি কলেজ দিয়েছি, অনুমতি ছাড়া আর সব কিছুতে পরিপূর্ণ। আপনারা ভালোভাবে কলেজ পরিচালনা করুন। বাকিটা আমি দেখছি। আমার নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান আমার সন্তানের মতো। আমার সন্তানের অকাল মৃত্যু আমি কিছুতেই মেনে নেব না।
আজিজ মাস্টার বললেন: শিক্ষামন্ত্রী পরিষ্কার বলে দিয়েছেন এ কলেজের অনুমতি তিনি দেবেন না। তিনি শিক্ষামন্ত্রী থাকলে এ অনুমতি হবে না। বিষয়টা জটিল হয়ে গেল না? সৈয়দ আবুল হোসেন আবারও হাসলেন, তার স্বভাবসিদ্ধ অমায়িক হাসি। এ হাসিতে কোনো হতাশা নেই, কোনো ক্ষোভ নেই, কোনো ঘৃণা নেই, আছে শুধু সৃষ্টির উল্লাস, প্রত্যয়ের ঝাণ্ডা। বললেন, ‘কলেজ অনুমতি পাবে। আর শিক্ষামন্ত্রী সাহেব যদি মনে করেন তিনি শিক্ষামন্ত্রী থাকলে আমার কলেজ এমপিও-ভুক্ত হবে না, তাহলে তিনি অন্য মন্ত্রণালয়ে চলে যাবেন।’ আশা-নিরাশার দোলা নিয়ে সবাই ফিরে যান। ঠিক একমাস পর সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, শেখ শহিদ আর শিক্ষামন্ত্রী নেই। গুটি কয়েক শত্র“র মুখে ছাই দিয়ে এবং ছাত্রজনতার মুখে হাসি ফুটিয়ে এ ঘটনার কয়েকদিন পর খোয়াজপুর কলেজ এমপিও-ভুক্ত হয়ে যায়।১

কে বড়?২
আগস্ট, ১৯৮৯। সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ, খোয়াজপুর-এর উদ্বোধন উপলক্ষে একটি ক্রোড়পত্র বের করা হবে। আব্দুল কাদের এবং মমতাজ সাহেব তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহিদের কাছে যান। উদ্দেশ্য ক্রোড়পত্রের জন্য একটি বাণী নেবেন। আব্দুল কাদের সবিনয়ে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে তাদের আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেন। তিনি আব্দুল কাদের সাহেবের পরিচয় জানতে চান। আবদুল কাদের বললেন, ‘আমার বাড়ি আগৈলঝারা। সৈয়দ আবুল হোসেনের মালিকানাধীন সাকো ইন্টারন্যাশনাল লিঃ-এর একজন কর্মকর্তা।’
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বিরক্তিস্বরে বললেন, ‘আপনার বাড়ি আগৈলঝারা, আপনি কালকিনির কেউ নন। আমার সংসদীয় এলাকায় কলেজ করার জন্য এত মাথাব্যথা কিসের আপনার?’ কাদের সাহেব সবিনয়ে বললেন, ‘শিক্ষার কোনো এলাকা নেই। এটি আলোর মতো। আপনার এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, এ তো আপনারই লাভ। আপনার এলাকা উন্নত হবে। অনুগ্রহপূর্বক একটা বাণী দিলে বাধিত হব স্যার।’ শিক্ষামন্ত্রী বললেন, ‘আমি বাণী দেবো না।’ অনেক অনুনয় করেও শিক্ষামন্ত্রীকে রাজি করানো গেল না। তিনি বাণী দেবেন না। এ তার শেষ কথা।
বিফল হয়ে তারা চলে আসেন। সৈয়দ আবুল হোসেন সব শুনতে পেয়ে বললেন, ‘আপনারা মনে কষ্ট পাবেন না। আমি ভেবেছিলাম স্মরণিকায় মাননীয় শিক্ষমন্ত্রীর বাণীকে মুখ্য রাখব। তা আর হলো না। আপনারা স্মরণিকার বাকি কাজ সম্পন্ন করে ফেলুন। আমি বাণীর কী হবে তা দেখছি। তারপর একটু থেমে বললেন, ‘আচ্ছা শিক্ষামন্ত্রী বড় না রাষ্ট্রপতি বড়? প্রধানমন্ত্রী বড় না শিক্ষামন্ত্রী বড়? আমার শিক্ষামন্ত্রীর বাণী আর চাই না। ক্রোড়পত্রে রাষ্ট্রপতির বাণী যাবে।
কিছুদিন পর সৈয়দ আবুল হোসেন একজন বাহক দিয়ে অধ্যক্ষের কাছে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ, প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন-এর ছবিসহ চারটি বাণী পাঠিয়ে দেন। তাদের বাণী নিয়ে স্মরণিকা বের হয়ে যায়।

যারা করিছে প্রত্যাখ্যান
কালকিনিতে কোনো ভালো কলেজ নেই। নিজের এলাকায় লেখাপড়া করতে পারার মজাই আলাদা। যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে সৈয়দ আবুল হোসেনকে গৌরনদী গিয়ে পড়তে হয়েছে। এ দুঃখ তিনি ভুলতে পারেননি। ছাত্রজীবন হতে তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল, সামর্থ্য হলে কালকিনির এ অসহায়ত্ব তিনি দূর করবেন। উদ্দেশ্য সৎ ছিল বলে তা পূরণের যোগ্যতা অর্জন করলেন সৈয়দ আবুল হোসেন।
কালকিনি কলেজের অবস্থা করুণ। নেই ভবন, নেই ভালো শিক্ষক, নেই সুচারু পরিবেশ। তিনি কলেজটিকে জাতীয়মানের একটি শিক্ষালয়ে পরিণত করতে চাইলেন। সনটি ১৯৮৮-এর শেষ প্রান্ত। কলেজ কমিটি এবং এলাকার গণ্যমান্যদের ডেকে কলেজটির আমূল পরিবর্তন ও আধুনিকায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করার প্রস্তাব দিলেন। ভেবেছিলেন এলাকাবাসী খুশি হবেন কিন্তু তাকে হতবাক করে দিয়ে কলেজ পরিচালনা কমিটি ও এলাকার গণ্যমান্য হিসেবে পরিচিত কিছু লোক তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এ ঘটনায় সৈয়দ আবুল হোসেনের মনে বিরাট দাগ কাটে তবু তিনি নিজেকে সংবরণ করেন। সংবরণ করলেও মনের ইচ্ছা সংবরণ হয়নি। এ পর্যন্ত তিনি যা চেয়েছেন তা হয়েছে, করেছেন। কারণ তার চাওয়ার মধ্যে, ইচ্ছের মধ্যে কোনো ফাঁক ছিল না, কোনো লোভ ছিল না, কোনো পাপ ছিল না।
সাকো অফিসে এ নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে সৈয়দ আবুল হোসেন বললেন, ‘আমার মনে কোনো লোভ নেই, আমি এলাকায় শিক্ষা বিস্তার চেয়েছি। কালকিনিবাসী আমার ইচ্ছাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। দেখবেন, অচিরে কালকিনিবাসী, যারা আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তারাই আমার প্রস্তাব বাস্তবায়নের অনুরোধ নিয়ে আসবেন। আমি কিন্তু সেদিন তাদের ফেরাব না।’
খোয়াজপুর মাদারীপুর-শরিয়তপুর-কালকিনির মিলনস্থল খোয়াজপুর টেকেরহাট একটি অবহেলিত অঞ্চল। শিক্ষা-দীক্ষায় মারাত্মক পিছিয়ে। বিল ছাড়া কিছু নেই। সৈয়দ আবুল হোসেন ওখানে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন। নিজের টাকায় জমি কিনে সাত/আট হাত গভীর বিল ভরাট করে অল্প সময়ের মধ্যে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেন। এলাকাবাসী কলেজের নাম দিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ।
১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মহা আড়ম্বরে কলেজ উদ্বোধন করা হলো। যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকার নিরলস শ্রমে কলেজটির সুনাম অল্পদিনে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ব্যাচের পরীক্ষায় নব প্রতিষ্ঠিত এ কলেজের একজন ছাত্র মেধা তালিকায় প্রথম ও আরেকজন চতুর্থ স্থান লাভ করে। কলেজের সুনাম এত ছড়িয়ে পড়ে যে, কালকিনি কলেজে ঐ বছর ছাত্র ভর্তির সংখ্যা ২৩ এ গিয়ে দাঁড়ায়। এবার টনক নড়ে কালকিনির সে সকল লোকদের। যারা সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তারা বুঝতে পারল অচিরে সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রস্তাব গ্রহণ না-করলে কালকিনি কলেজ বন্ধ হয়ে যাবে। নাই অর্থ, নাই ভবন, নাই ভালো শিক্ষক। কীভাবে চলবে কলেজ! ছাত্রছাত্রীরা সব খোয়াজাপুর সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজে চলে যাচ্ছে।
একদিন সৈয়দ আবুল হোসেন আমিন কোর্টের সাকো অফিসে কাজ করছিলেন। এ সময় কালকিনির দেড় শতাধিক গণ্যমান্য লোক এসে সৈয়দ আবুল হোসেনকে ঘিরে ধরেন। তারা বললেন, ‘আমাদের ভুল হয়েছে। আপনার প্রস্তাব আমরা সসম্মানে গ্রহণ করলাম। আপনি কালকিনি কলেজকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিন।’
এলাকাবাসীর ওপর অভিমান করে থাকতে পারলেন না মহামহিম সৈয়দ আবুল হোসেন। শুরু হলো আর এক ইতিহাস। সে ইতিহাস গড়ার ইতিহাস; শিক্ষা বিস্তারে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের ইতিহাস, কালকিনি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইতিহাস। যার অনুপম সুদৃশ্য ভবন পথচারীদের দৃষ্টি থমকে দেয়।৩ সৈয়দ আবুল হোসেন প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলো এত ভালো ফল করছিল যে, শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থা হয়ে গিয়েছিল, দক্ষিণাঞ্চলের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সৈয়দ আবুল হোসেনের নামে নামায়িত করার জন্য জনগণ উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। চারিদিকে সৈয়দ আবুল হোসেন নামের একটা হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। লোকজন ভাবত সৈয়দ আবুল হোসেন-এর কলেজে পড়াতে পারলেই তাদের সন্তানের ভালো ফল নিশ্চিত হয়ে যাবে।৪

ইতিহাসের প্রারম্ভ
১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ। মহাপ্লাবনে কালকিনিসহ মাদারীপুরের অধিকাংশ এলাকা সাত/আট হাত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। কোথাও আশ্রয়ের মতো এক টুকরো মাটি নেই। সব পানির নিচে। দুর্গত মানুষের কান্নায় আকাশ আরও ভারি হয়ে জল ফেলছে। এ অবস্থায় মানব দরদি আবুল হোসেন নিজেকে ঢাকার আয়েশে আটকে রাখতে পারলেন না। মাত্র তিনজন সহচর নিয়ে কালকিনি রওয়ানা দিলেন।
তখন জাতীয় পার্টি ক্ষমতায়। সৈয়দ আবুল হোসেন সাহায্য করতে এসেছেন শুনে ক্ষমতাসীন প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরশাসক-গোষ্ঠীর আঁতে ঘা পড়ে। সৈয়দ আবুল হোসেনকে সাহায্য দিতে দেবে না। কারণ সৈয়দ আবুল হোসেন আলোর ন্যায় সমুজ্জ্বল, ভালোবাসার ন্যায় অনাবিল, যেদিকে তাকান জয় করে নেন। লোকজন ক্রমশ তাঁর ভক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাঁকে সাহায্য দিতে দিলে শোষণ, সন্ত্রাস আর ভোট ডাকাতির রাজনীতি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ সৈয়দ আবুল হোসেন কোনো রাজনীতিক উদ্দেশ্য নিয়ে সাহায্য করতে আসেননি। তিনি নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য দিতে এসেছেন। তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে কিছু লোক সৈয়দ আবুল হোসেনকে বাধা দেন। আবুল হোসেন বললেন: আমি আমার এলাকায় দুর্গত মানুষদের সাহায্য দিতে এসেছি, আপনারা বাধা দেবেন কেন?
যাদের উদ্দেশ্য শুধু বাধা দেয়া তারা যুক্তির ধার ধারে না। বাধা পেয়ে তিনি থানায় আশ্রয় নেন। আস্তে আস্তে এ কথা সর্বত্র জানাজানি হয়ে যায়। সাধারণ লোক তাঁর উদারতার সম্পর্কে অনেক পূর্ব হতে অবগত। তিনি অনেক লোককে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করেছেন। চারিদিক হতে তাঁর ভক্তরা ছুটে আসতে থাকেন। থানার সামনে অনেক লোক জড়ো হয়ে যায়। সৈয়দ আবুল হোসেনকে তারা এক নজর দেখতে চান। তিনি বেরিয়ে আসেন। লোকজন উল্লাসের সাথে তাঁকে স্বাগত জানায়। সমবেত লোকদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘আমি আপনাদের সাহায্য করতে এসেছি। এর বেশি কিছু না। কালকিনি আমার জন্মস্থান। আমার এলাকার লোকজন আজ অসহায়। আমি কি দুর্গত লোকদের সাহায্য করতে পারব না? আমি আপনাদেরই লোক, আমি আপনাদের সাথে থাকব। উপস্থিত জনগণ সমস্বরে বললেন, ‘আমরা আপনার পক্ষে আছি। অবস্থা বেগতিক দেখে পালিয়ে যায় প্রতিক্রিয়াশীলরা। সৈয়দ আবুল হোসেনকে দুর্গত লোকজন পরম আদরে বুকে টেনে নেন। শুরু হয় আর এক ইতিহাস। এ ইতিহাস শুধু রাজনীতির নয়, দানের; স্বার্থের নয় ত্যাগের।’৫

নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো৬
কালকিনিতে সৈয়দ আবুল হোসেন একটা সভায় যোগদান করতে এসেছেন। সভার পূর্বে একটি কক্ষে বসে কলেজের উন্নয়ন সম্পর্কে আলোচনা করছেন। সে সময় কয়েকজন লোক সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে এ মর্মে অভিযোগ করলেন যে জনৈক ব্যক্তি তাঁর নিন্দা করছেন। তারা এমনভাবে কথাগুলো বলছিলেন যেন সৈয়দ আবুল হোসেন উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তিনি উত্তেজিত হলেন না, কোনো পরিবর্তনও তার চোখেমুখে দেখা গেল না। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, ‘তোমরা যাও। বিষয়টা আমি দেখব।’ বক্তৃতার সময় তিনি বললেন: আমাকে যারা ভালোবাসেন তার শুনে রাখেন, যারা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রচনা করেন তারা আমার গায়ের ময়লা তাদের নিজের শরীরে মেখে নিয়ে আমাকে পরিষ্কার করে দেন। এতে আপনাদের খুশি হবার কথা, মন খারাপ করার প্রশ্নই আসে না। মনে রাখবেন- নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো; যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো।

মহান যার অনুভব৭
জনৈক ব্যক্তির লাশ পরিবহন ও দাফন-কাফনের জন্য কয়েকজন লোক সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে সাহায্য চাইতে আসেন। মহান দাতা সৈয়দ আবুল হোসেন স্বভাবসুলভ সরলতায় তাদেরকে কাক্সিক্ষত অর্থ প্রদান করে বিদায় করেন। কয়েক বছর পর এক অনুষ্ঠানে সৈয়দ আবুল হোসেন দেখলেন- সেদিন যে লোকটির লাশ পরিবহন ও দাফন-কাফনের জন্য তাঁর কাছ হতে টাকা নেয়া হয়েছিল সে লোকটি দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছেন। তিনি এ বিষয়ে সাহায্যপ্রার্থীদের কিছু বলেননি। শুধু মুচকি হেসেছিলেন।

১. সূত্র কালকিনি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আবদুল আজিজ মাস্টার, সৈয়দ 
আবুল হোসেনের বন্ধু ও সাকোর প্রাক্তন কর্মকর্তা আব্দুল কাদের এবং সৈয়দ আবুল 
হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ মো. তমিজ উদ্দিনের প্রদত্ত তথ্য।
২. আব্দুল কাদের, খোয়াজপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা সৈয়দ আবুল হোসেনের বন্ধু এবং সাকো- 
এর প্রাক্তন কর্মকর্তা।
৩. আবদুল আজিজ মাস্টার, প্রাক্তন শিক্ষক কালকিনি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এবং প্রাক্তন 
সভাপতি, কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগ।
৪. ড. একেএম আখতারুল আলম, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, প্রাক্তন কর্মকর্তা লিগ্যাল এইড, শরীয়তপুর।
৫. আজিজ মাস্টার, আবুল কালাম আযাদ, আব্দুল কাদের।
৬. ফরহাদ হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও জেলাপ্রশাসক মাদারীপুর।
৭. ঐ

আলাপচারিতায় দার্শনিক নান্দনিকতা
এ অধ্যায়ে বর্ণিত ঘটনা ও বক্তব্যগুলো মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রীর আলাপচারিতার বিভিন্ন সময়ের কথাবার্তা থেকে সংগৃহীত। এগুলো কোনো বিশেষায়িত বক্তব্য নয়। দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কথাবার্তার টুকিটাকি মাত্র। এসব কথাবার্তায় ছিল না কোনো পূর্বপরিকল্পনা, ছিল না কোনো সমীকরণ। নিতান্তই স্বাভাবিক, নিঃশ্বাসের মতো, প্রশ্বাসের মতো। সাধারণ কথাবার্তায় একজন লোকের প্রকৃত পরিচয় ফুটে ওঠে। মানুষ সভাসমিতিতে নিজেকে লুকিয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু স্বাভাবিকতা ভিন্ন। এ সব খোলামেলা কথাবার্তা ও আলাপচারিতায় ব্যক্তি, নেতা, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসক হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনের আদর্শ ফুটে উঠেছে। সংকলনে প্রকাশের উদ্দেশ্যে তথ্যগুলো বিভিন্ন উৎস হতে সংগ্রহ করা হয়েছে।

নেতৃত্ব
কালকিনির লোক। মন্ত্রী মহোদয়ের সমবয়সী। কথাবার্তায় মনে হলো ঘনিষ্ঠ। মাঝে মাঝে তাকে দেখা যায় মন্ত্রণালয়ে। কি একটা তদ্বির নিয়ে এসেছেন। তদ্বিরের বিবরণ শুনে মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বললেন, ‘এটি আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ লোকটি বললেন, ‘আপনি মন্ত্রী, আপনার মন্ত্রণালয়ের কাজ। সম্ভব নয় কেন?’ মন্ত্রী বললেন, ‘তুমি একজন শিক্ষিত লোক। কোন কাজটি করা আমার উচিত, কোনটি উচিত নয় সে বিষয়ে তোমার ধারণা থাকা উচিত। প্রত্যেকের সীমাবদ্ধতা আছে। We are all something, but none of us are everything.’ ‘আপনি এত বড় নেতা, এত বড় পদে আছেন, বলে দেন, কাজ হয়ে যাবে।’ মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বললেন, খবধফবৎংযরঢ় রং ধপঃরড়হ, হড়ঃ ঢ়ড়ংরঃরড়হ. আমার দায়িত্ব কাজ, তদ্বির করা নয়। লোকটি বললেন, তদ্বির না-করলে হয় না। মন্ত্রী মহোদয় বললেন, যেগুলো হবার সেগুলোই আমি তদ্বির করি। যেগুলো হয় না সেগুলোর তদ্বির করি না।
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো
মন্ত্রী মহোদয়ের কক্ষ। বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্য উপস্থিত আছেন। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলছিল। মন্ত্রী মহোদয় এক সময় বললেন: কেউ একদিনে বড় হয় না, হতে পারে না। আছাড় না খেয়ে কেউ হাঁটতে শেখেনি। বিঘœ ছাড়া কেউ লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারেনি। একদিন আমাকে অনেকে উপহাস করেছে, ঢিল ছুড়ে আমার প্রত্যাশাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। আমি আমার প্রতি নিক্ষিপ্ত ইট দিয়ে সফলতার ভিত্তি বানিয়েছি। ঐ ইটগুলো আমাকে রক্তাক্ত করার জন্য নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আমি সযতেœ নিজেকে রক্ষা করেছি। প্রতিটি ইট সংগ্রহ করে আস্তে আস্তে ভিত মজবুত করেছি। যারা আমাকে ঢিল ছুড়েছিল তারা এখন ফুল ছোড়ে। এখন আমি তাদের দিয়ে আমার ভবনের বাকি কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছি। পৃথিবী ভয়ঙ্কর জায়গা, আমি জানি। তবে এটি খারাপ লোকদের জন্য নয়; বরং তাদের জন্য, যারা কোনো কিছু না-করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তামাসা দেখে। সহনশীলতা ছাড়া এখানে টিকে থাকার কোনো উপায় নেই। যতবার আমি বাধাগ্রস্ত হয়েছি ততবার আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছি। যে আমার নিন্দা করেছে সে নিন্দার সূত্র ধরে আমি কাক্সিক্ষত পথ খুঁজে পেয়েছি। তাই আমি বিভিন্ন বক্তৃতায় প্রায় বলে থাকি:
‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো,
যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো
যিনি আমার প্রশংসা করেন তাকে আমি অগ্রাহ্য করি না, যিনি নিন্দা করেন তাকে ঘৃণা করি না। দু’জন আমার দুটো দিক তুলে ধরেন। দুটোই আমার জন্য প্রয়োজন। প্রশংসা আমাকে উজ্জীবিত করে এবং নিন্দা করে সতর্ক।

আত্ম-পরিবর্তন
রবি বার। নয়টা বাজার পনেরো মিনিট বাকি। ইতোমধ্যে মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী অফিসে এসে গেছেন। তিনি প্রত্যহ নয়টার আগে অফিসে আসেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ যাতে তাকে অনুসরণ করেন এ জন্য এ ব্যবস্থা। নিয়ম-নীতি ও ব্যক্তি চরিত্র সম্পর্কে আলোচনাপ্রসঙ্গে মন্ত্রী মহোদয় বললেন: পৃথিবীর সবাই পরিবর্তন চায়। কিন্তু অবাক হয়ে দেখি কেউ নিজেকে পরিবর্তন করছে না। তাহলে পৃথিবী কীভাবে পরিবর্তন হবে! নিজেকে পরিবর্তন করলে পৃথিবীর পরিবর্তন স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যাবে। আসলে নিজেকে পরিবর্তন করা খুবই কঠিন। শিক্ষিত হলে মনের পরিবর্তন আসে। আমি মনে করি শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনোভাবে আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন সম্ভব নয়। শিক্ষা এমন একটি শক্তিশালী অস্ত্র যা আমরা অতি সহজে আমাদের মনমানসিকতা ও সমাজকে পরিবর্তন করার জন্য ব্যবহার করতে পারি। শুধু শিক্ষা যথেষ্ট নয়, প্রায়োগিক শিক্ষা প্রয়োজন। শিক্ষা জ্ঞান দেয় বটে; তবে জ্ঞান আমার লক্ষ্য নয়, আমার লক্ষ্য প্রয়োগ। গ্রন্থগত বিদ্যার মতো প্রয়োগহীন জ্ঞানও অর্থহীন।

চাওয়া-পাওয়া
সৈয়দ আবুল হোসেন তখন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী। মানুষের চাওয়া-পাওয়া, প্রত্যাশা ও লোভ সম্পর্কে আলোচনার এ পর্যায়ে তিনি বললেন, আমি তা-ই করি, যা করতে পারি, তা-ই চাই যা আমার আছে, আমি তা হতে চাই যা আমি ইতোমধ্যে হয়ে আছি। এর বেশি কিছু চেয়ে হতাশ হতে চাই না। হতাশা মানুষের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব নষ্ট করে দেয়। আমি হতাশ হই না, কারণ আমি হতাশ হবার মতো কোনো উচ্চাকাক্সক্ষায় নিজেকে জড়াই না। তাই আমি সবসময় প্রফুল্ল থাকি। আমার হাসি আমার প্রফুল্লতার প্রকাশ। আমাকে আমার কর্ম দ্বারা বড় হতে হবে। আপনাকে কেউ বড় হবার জন্য অনুগ্রহ করবে না। আপনার দক্ষতাই আপনাকে সহায়তা দেবে। আমার পিতামহ কত লম্বা ছিল সেটি কোনো বিষয় নয়, আসল বিষয় আমি কতটুকু লম্বা হতে পেরেছি। আপনার বোঝা আপনারকে বহন করতে হবে। আপনার শরীরের কষ্ট আপনার নিজের। কেউ এর ভাগ কখনও নেয়নি, নেবে না এবং নিতে পারে না।১

সমালোচনা
সৈয়দ আবুল হোসেন বাস্তববাদী মানুষ। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষ মাত্রই ভুল করবে। এর ব্যতয় ঘটতে পারে না। ভুল আছে বলে কোনো কিছু পরিপূর্ণ নয়, কোনো কিছু ভুলের ঊর্ধ্বে নয়; তাই কোনো কিছু সমালোচনার ঊর্ধ্বেও নয়। আমি সমালোচনাকে ভয় করি না। আমি যে কাজ করছি সমালোচনা তা প্রকাশ করে। আমি যদি সমালোচনা এড়াতে চাই তাহলে আমার উচিত কিছু না-করে বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকা। এটি আমার পক্ষে সম্ভব নয়। লাশের পক্ষে সম্ভব। কীর্তিমানের লাশও সমালোচনায় পড়ে। তাই বলে কী কীর্তিমানেরা চুপ করে ঘরে বসে থাকে! আমি সমালোচনাকে স্বাগত জানাই। Without debate, without criticism, no administration and country can succeed and no republic can survive.২
কাজের কোনো শেষ নেই
প্রত্যেক মানুষ নিজস্ব বলয়ে একজন শিল্পী। শিল্পীর কাজ কখনও শেষ হয় না। একজন শিল্পী যখন তার একটি শিল্পকর্ম শেষ করেছেন বলেন, তখন মূলত তা তিনি এটি সাময়িক বন্ধ রাখেন কিংবা পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন মাত্র। যতদিন জীবন ততদিন কাজ। কাজহীন মানুষ লাশের নামান্তর। কাজ করতে গেলে ভুল হয়। ভুল কাজের অংশ। তার ভুল হয় না যে কোনো দিন কোনো কিছু করেনি। তাই আমি ভুলকে সৃষ্টির অনিবার্য অংশ মনে করি। তবে দেখতে হবে ভুল যেন মাত্রাতিরিক্ত না-হয়। এ জন্যই প্রয়োজন জ্ঞান, অধ্যয়ন, বিচক্ষণতা এবং সততা। তাড়াহুড়ো চিন্তার সময়কে সীমিত করে, বাড়িয়ে দেয় ভুলের মাত্রা। ফলে অনেকে মাঝপথে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। আমি ধীরে হাঁটি তবে পিছু হাঁটি না। যদি কখনও পিছোই তাহলে ধরে নিতে হবে আগুয়ান হবার জন্য পরিকল্পনামাফিক পিছু হাঁটি।৩

পরিবর্তন ও প্রগতি
নেতা হতে হলে পরিবর্তনশীল মানসিকতা থাকতে হবে। সংস্কার মানেই পরিবর্তনশীলতা। তবে এটিও মনে রাখতে হবে, সকল আন্দোলন যেমন উন্নয়ন নয়, তেমনি সকল পরিবর্তনও কল্যাণকর নয়। আমার যা পছন্দ হয় নাÑ তা আমি পরিবর্তন করার চেষ্টা করি। যা আমি পরিবর্তন করতে পারি নাÑ তা আমি গ্রহণ করার জন্য নিজের মনকে পরিবর্তন করে ফেলি। তবে যেটি পরিবর্তন করলে আমার ভালো লাগলেও অধিকাংশ লোকের ক্ষতি হয়, সেটি আমি পরিবর্তন না-করে মেনে নেয়ার চেষ্টা করি। আমি জানি যা আসার তা আসবেই। একটি শক্তিশালী সেনা আক্রমণকে রোধ করা যায় কিন্তু একটি ধারণা যার আসার সময় হয়ে গেছে তা কোনোকিছু দিয়ে রোধ করা যায় না। সুতরাং অনড়তা নয় বরং বিচক্ষণ পরিবর্তনশীলতাই প্রগতির লক্ষণ।

সকল শান্তির উৎস
পরিবারের শান্তি সবচেয়ে বড় শান্তি। একজন মানুষ যতই ধনী হোক না কেন, অসুস্থ হলে কোনো শান্তি উপভোগ করতে পারে না, কিছুতে আনন্দ পায় না। তেমনি একজন লোক যতই ধনী, যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, পারিবারিক শান্তি না-থাকলে তার সবকিছু ব্যর্থ হতে বাধ্য। আমি পারিবারিক জীবনে একজন সুখী মানুষ। আমার সুখের বিনির্মাতা আমি, আমার স্ত্রী, আমার দুই কন্যা। আমি তাদের পর্যাপ্ত সময় দেই, ভালোবাসা দেই। তারাও দেয়। এটি বিনিময় নয়, মর্যাদার অনুভবে ভালোবাসায় সন্তরণ। যেখানে মর্যাদা নেই সেখানে ভালোবাসা নেই। আমি আমার স্ত্রীর প্রতি সর্বদা বিশ্বস্ত এবং মর্যাদাশীল আচরণে অভ্যস্ত। সন্তানদের প্রতি আমি সবসময় সুন্দর ব্যবহার করি। আমি জানি, আমার মৃত্যুর পর তারাই আমার শেষ ঠিকানা স্থির করবে। আমার স্ত্রী পুত্র আমার আনন্দ, বেঁচে থাকার প্রেরণা। এমনকি মৃত্যুর পরও।৪

সূর্য ও জীবন
প্রতি সেকেন্ড আমার কাছে নতুন, প্রতিটি নতুন সূর্য আমাকে একটি নতুন জীবন উপহার দেয়। তাই আমি বর্তমানকে গুরুত্বের সাথে বরণ করি, আনন্দের সাথে উপলব্ধি করি। প্রতিটি মুহূর্তকে অবস্থা বিবেচনায় অভিযোজনীয় কৌশলে উপভোগ্য করে তুলি। শিশুকাল, কৈশোর, যৌবন ও বৃদ্ধকাল- প্রতিটির আনন্দ আছে, সার্থকতা আছে। আমার উপলব্ধিই আমার উপভোগ। মানুষ এককভাবে বাস করতে পারে না। প্রত্যেককে নিয়ে আমি, আমাদের নিয়ে সমাজ, দেশ ও জাতি। আজ যাকে পাব কাল তাকে নাও পেতে পারি। তাই আমার সাথে যারা আছে, যাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, সবাইকে জীবনের অংশ মনে করে যথাযোগ্য গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করি।

রাগ পাশবিকতার আগুন
আমার মা আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। রাগ সংবরণ করতে হয়। এক সেকেন্ডের রাগ কারও পুরো জীবনকে বিষিয়ে তুলতে পারে। যে ব্যক্তির ধৈর্য নেই, তার আত্মাও নেই। যার আত্মা নেই, সে মানুষ নয়। রাগ পাশবিকতার নামান্তর। অধৈর্য মানুষকে পশুতে পরিণত করে। মানুষ কেন রাগে? মানুষ যখন ভুল করে এবং সে ভুল স্বীকার করে না, স্বভাবতই তখন সে রেগে যায়। অগভীর মানুষের রাগ বেশি। রাগ অশান্তিকে প্রসারিত করে। রাগের জন্য মানুষের শাস্তি হয় না, তবে রাগ শাস্তি দিয়েই ছাড়ে। তাই আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার অভ্যাস রপ্ত করে নিয়েছি। আমার পিতামাতা এভাবে আমাকে গড়ে তুলেছেন। ভদ্রতা দিয়ে মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। মহাত্মা গান্ধীর ভাষায় বলতে পারি: In gentle way, you can shake the world. রাগ পোশাকের নিচে লুকিয়ে থাকা বিষধর সাপের মতো। এটি পরিহার করতে পারলে নিরাপত্তা ও শান্তিÑ দুটো বহুলাংশে নিশ্চিত হয়ে যায়।
ন্যায় বিচারের গুরুত্ব
এমনভাবে কাজ করবেন যাতে কোনো ব্যক্তি অযথা হয়রানির স্বীকার না-হয়। আমাকে যে বিষয় কষ্ট দেবে, যা করলে আমার ক্ষতি হবে, তা যেন অন্যের বেলাতেও না-হয়। সহকর্মীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন। এটিই ন্যায়বিচার। আমরা যদি ন্যায়বিচারের মাধ্যমে অন্যকে রক্ষা না-করি, তাহলে ন্যায়বিচারও আমাদের রক্ষা করবে না। যে ফাঁদে আমি অন্যকে আটকাব, সে ফাঁদে একদিন আমিও আটকে যাব। মনকে বড় করতে হবে। বড় মন ছাড়া ক্ষমতা, অর্থ, বিত্ত সব কুৎসিত ভিক্ষুকের প্রতিচ্ছবি। ন্যায়বিচার যারা লঙ্ঘন করে, তারাও একদিন অন্যায়ের শিকারে পরিণত হয়। তাই আমাদের উচিত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।৫

সংশয়ে সতর্কতা
এক প্রকৌশলী যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে বললেন: আপনি নিশ্চিত থাকেন আমি সফল হব স্যার। জীবনে এ পর্যন্ত কোনো কাজে ব্যর্থ হইনি। মন্ত্রী বললেন: আমি নিজেও একজন ব্যবস্থাপক। আমার প্রতিষ্ঠানে আপনার মতো অনেক প্রকৌশলী কাজ করে। দেখুন, চিন্তাভাবনা করে আমাকে বলুন। পরে যেন লজ্জায় পড়তে না-হয়। জীবনে ব্যর্থ হয়নি তারা, যারা জীবনে কোনো কাজই করেনি। প্রকৌশলী বললেন: আমি পারব স্যার। মন্ত্রী মহোদয় বললেন: আমার মনে হয়, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। কেন স্যার? প্রকৌশলীর প্রশ্নের জবাবে মাননীয় মন্ত্রী বললেন: কারণ যে নিশ্চিত হয়ে অগ্রসর হয়, তার সমাপ্তি ঘটে সংশয় আর পরাজয়ে; যে সংশয় নিয়ে শুরু করে তার শেষ হয় নিশ্চয়তা আর সাফল্যে। কারণ, সংশয় তাকে সব সময় সতর্ক থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রকৌশলী সাহেব বললেন: আমি স্যার সতর্ক থাকব। আপনাকে যথাসময়ে কাজটি করেই দেবো।” কিন্তু বেচারা কাজটি যথাসময়ে সম্পন্ন করতে পারলেন না। সামান্য কারণে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। মন্ত্রী বললেন : আমি আপনাকে প্রথমেই বলেছিলাম। আপনার নিশ্চয়তা এবং কথা দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি পারবেন না। A dog is not considered a good dog because he is a good barker. A man is not considered a good man because he is a good talker.

অসুন্দরে নয়, সুন্দরে
এক অফিসার মন্ত্রী মহোদয়কে বললেন: সাদেক সাহেব (ছদ্মনাম) ভালো অফিসার নন। দুর্নীতিপরায়ণ।
মন্ত্রী মহোদয়: তিনি দুর্নীতিপরায়ণ এরূপ কোনো প্রমাণ আপনার কাছে আছে?
অফিসার: এ সব কেউ প্রমাণ রেখে করে না।
মন্ত্রী মহোদয়: তাহলে এমন কথা বলা উচিত নয়। আমার এ বিষয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর আমাকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করে প্রচণ্ড হয়রানি করা হয়েছিল। মামলা পর্যন্ত করা হয়েছে। আমি কী দুর্নীতিবাজ ছিলাম? আমি কোনোদিন অসৎ পথে আয় করিনি। আমার প্রতিটি পয়সা হালাল। তবু আমাকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করে হয়রানির চেষ্টা করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমি প্রমাণ করতে পেরেছি যে, আমি দুর্র্র্নীতিবাজ নই। ততক্ষণে অনেক হয়রানির শিকার হয়ে গেছি। আমাদের উচিত আগে অন্যের ভালোটার দিকে তাকানো। তাহলে পৃথিবী অনেক সুন্দর হয়ে যাবে। কারণ, মানুষ তখন নিজের সুন্দরকে আরও বিকশিত করার প্রতিযোগিতায় নামবে।৬

শত্র“ বিনাশের উপায়
ওয়ান-ইলেভেনের সময় পুরো বাংলাদেশ একটি নরকে পরিণত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। মানবাধিকারের বালাই ছিল না। তবু আমি আশা ছাড়িনি। কারণ, আমি জানি পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকারও ছোট্ট একটি মোমবাতির আলোকে ঢেকে রাখার সামর্থ্য রাখে না। এ সময় আমাকে অনেকে বিপদে ফেলার জন্য চেষ্টা করেছে। এমন অনেকে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে যাদের আমি একদিন উপকার করেছিলাম। আমি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। আমি জানি, The best way to destroy my enemy is to make them my friend. শত্র“কে বন্ধু বানিয়ে নেয়া মানে শত্র“কে শেষ করে দেয়া। ওয়ান ইলেভেনে যারা আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে, তাদের সবাইকে আমি জানি। আমি প্রতিশোধ নেব না। প্রতিশোধ এক ধরনের বন্য বিচার, পাশবিকতা। আমি ভালোবাসার মাধ্যমে প্রতিশোধ নেব। এমন প্রতিশোধের পরিণতি খুবই মধুর হয়। শত্র“তা কখনও শেষ হয় না। কারও জীবন শেষ করে দেয়ার জন্য একজন শত্র“ই যথেষ্ট। তবে শত্র“ এমন একটা শক্তি যে, এটাকে শত্র“তা দিয়ে কোনোদিন শেষ করা যায় না। শত্র“ বিনাশের একমাত্র উপায় তাদের বন্ধু বানিয়ে নেয়া।

সহনশীল রাজনীতি, সন্ত্রাস ও শিক্ষাঙ্গন
উন্নয়নের জন্য, শিল্পায়নের জন্য, গণতন্ত্রের সুফল পরিপূর্ণভাবে পরিব্যাপ্ত করার জন্য রাজনীতিক সহনশীলতা অত্যাবশ্যক। রাজনীতি থাকবে রাজনীতির স্থানে। সমাজের বিনির্মাণে রাজনীতির কৌশল প্রতিফলিত হতে হলে তা হবে দলমতের ঊর্ধ্বে। 
যদি “চোখের বদলে চোখ, হাতের বদলে হাত” নীতি বিদ্যমান থাকে তাহলে পৃথিবীর সব মানুষ অন্ধ ও ল্যাংড়া হয়ে যাবে। তাই আমি সহনশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সন্ত্রাসী জনপদ হতে সুশীল সন্তান পাওয়া যায় না। তাই আমি শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাস ও রাজনীতিমুক্ত রেখে আমার প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছি। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে কাউকে ক্ষমা করি না। সহনশীল রাজনীতি, সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ ও এ দু’য়ের পরিচর্যায় শিক্ষাঙ্গন পরিচালনা করা গেলে একটি জাতির আর কিছুর প্রয়োজন হবে না।৭

নিরাপত্তা বনাম শান্তি
বুদ্ধিমান লোক সবার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়। জ্ঞানী ব্যক্তির উদ্দেশ্য শান্তি নিশ্চিত করা নয়, কষ্টকে এড়িয়ে চলা। কষ্টকে এড়িয়ে চলা সম্ভব হলে শান্তি আপনা-আপনি জেগে ওঠে। ক্ষোভকে প্রশমন করা গেলে বিচক্ষণতা আসে। আর বিচক্ষণতা এমন একটি গুণ যা মানুষকে সচেতন ও সজীব রাখে, বিপদ হতে উদ্ধার করে। তাই সবার উচিত আগে নিরাপত্তার দিকটা ভেবে দেখা। নিরাপত্তার সাথে যোগাযোগের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কারণ, যোগাযোগ পারস্পরিক বিনিময়, সহায়তা ও সম্মিলনের পথকে প্রসারিত করে।৮

যোগাযোগ ও উন্নয়ন
যোগাযোগ ছাড়া কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। মানুষ যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সভ্যতার দেখা পেয়েছে। যোগাযোগ শুধু প্রতিষ্ঠা করলে হবে না। প্রকৃত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষ যখন নিজেকে নিরাপদ মনে করবে তখনই প্রকৃত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা পাবে। এ জন্য আমি নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। আপনারা আমাকে সহায়তা দেবেন। কারণ, যোগাযোগ কোনো একক বিষয় নয়, অনেকগুলো বিষয়কে সমন্বয় করে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কোনো সংস্থার পক্ষে এককভাবে প্রকৃত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যোগাযোগ প্রত্যেকের জন্য, প্রত্যেকের উন্নয়নের জন্য কোনোরূপ সন্দেহ ব্যতিরেকে সার্বজনীন। তাই সবার উচিত সাবলীল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা।৯

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু
সৈয়দ আবুল হোসেন বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। এককভাবে শতাধিক বার চিন ভ্রমণ করেছেন। জাপান, আমেরিকা, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, লন্ডন, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড- অনেক অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন: মানুষের চেয়ে বড় সম্পদ আর নেই। জাপানের প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু তারা এখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী দেশ। আমি মনে করি, পৃথিবীতে সম্পদ পর্যাপ্ত নয়। আমি মনে করি, There is enough for everybody`s need, but not enough for everybodys greed. লোভ পাপ আনে, পাপ মৃত্যু ঘটায়। লোভ সংবরণ করা গেলে পাপ কমে যাবে। পাপ কমে গেলে শান্তি প্রসারিত হবে। আপনারা যদি কোনো কিছু প্রকৃতই করতে চান তাহলে অবশ্যই করতে পারবেন। যদি না-চান তাহলে পাবেন একটি অজুহাত।১০

সফলতার অন্ত নেই
প্রবীণ এক রাজনীতিবিদ মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রীকে বললেন: আপনি একজন সফল ব্যক্তি। আর কী চাওয়ার আছে আপনার, আল্লাহ আপনাকে সব দিয়েছেন।
স্মিতহাস্যে মাননীয় মন্ত্রী বললেন: সফলতা গন্তব্যস্থল নয়। ভ্রমণের প্রারম্ভ মাত্র। তাই সফলতা মানুষকে আরও সক্রিয় আরও সাবধান, আরও অধিক পথ পরিক্রমায় দায়বদ্ধ করে তোলে। যারা সফলতার সন্তুষ্টি নিয়ে আত্মতুষ্টিতে আত্মহারা হয়ে থেমে যান, তারা পক্ষান্তরে প্রাপ্ত সফলতাকে গলা টিপে মেরে ফেলেন। সফলতা সন্তানের মতো। একে প্রতিনিয়ত আপন স্নেহে লালন করতে হয়।

শিক্ষক ও শিক্ষা
অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষক, আবার খোয়াজপুর সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। এক সাক্ষাৎকারে সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পর্কে অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন বললেন, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে খুব ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, বিশ্বাস করেন। তার মতে আমি নাকি ভালো শিক্ষক। আমি মনে করি, সে ভালো ছাত্র বলেই আমি ভালো শিক্ষক।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি আমাকে এত শ্রদ্ধা করো কেন?’
সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছিলেন, ‘আপনি আমার শিক্ষক।’
আমি বলেছিলাম, ‘তোমার তো আরও অনেক শিক্ষক আছে।’
এর উত্তরে সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছিলেন, ‘তিনিই শিক্ষক যিনি কঠিন জিনিস সহজভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। তিনিই শিক্ষক যিনি শিক্ষক-ছাত্র দূরত্বকে জ্ঞানের রশ্মি দিয়ে একাকার করে দেন। আপনার সে যোগ্যতা আছে।’১১

অন্যায় যে করে
তদ্বির আর তদ্বির। মাঝে মাঝে তদ্বিরকারীদের জ্বালায় মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রাত্যহিক জরুরি কাজেও সময় দিতে পারেন না। তদ্বিরের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি আমার স্বাধীন চিন্তায় বিঘœ ঘটায়। আমি ম্যানেজার এবং লিডার। তার চেয়ে বড় কথা আমি পরবর্তী জেনারেশনকে আমার জেনারেশনের চেয়ে আরও প্রগতিশীল, উন্নত এবং আকর্ষণীয় দেখতে চাই। Management is doing things right; leadership is doing the right things. আমি ঠিক কাজটাই করব। কোনো প্রভাবের কাছে মাথা নত করব না। একজন প্রকৃত আওয়ামী লীগার কখনও অন্যায় প্রভাবের কাছে মাথা নত করেন না। বঙ্গবন্ধু করেননি, আমার নেত্রী শেখ হাসিনা করেননি। আমি তাঁদের অনুসারী। আমিও করব না। তবে আমি এ সমাজের একজন মানুষ। সমাজকে উপেক্ষা করে চলতে পারি না। তবু যেটি আমি উচিত নয় বলে মনে করি সেটি না-করার চেষ্টা করি। যেটি অন্যায় বলে মনে হয়, সেটি প্রতিহত করার চেষ্টা করি। আমি যেসব পারি বা পারব তা নয়, কিন্তু তাই বলে আমাকে চুপ মেরে বসে থাকলে চলবে না।
অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।

দেশের চেয়ে বড় কিছু নেই
আলোচনা হচ্ছিল বিভিন্ন বিষয়ে। এক সময় আলোচনায় চলে আসে রাজনীতি ও গণতন্ত্র। আলোচনাক্রমে চলে আসে রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কের কথা। মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বললেন, আমি রাজনীতি করি সেজন্য রাজনীতিবিদ। তবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আমি শুধু রাজনীতিবিদ নই, স্টেটসম্যানও বটে। তাই আমাকে আমার ভোটার, পরবর্তী নির্বাচন ও পরবর্তী প্রজন্ম তিনটার দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। A politician looks forward only to the next election. A statesman looks forward to the next generation. আমার রাজনীতি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, বর্তমানের জন্য এবং ভবিষ্যতের জন্য। আগে দেশ তারপর রাজনীতি। নেত্রী আমাকে এ শিক্ষাই দিয়েছেন। দেশের উন্নতি ঘটলে জনগণের উন্নয়ন আসবে। বঙ্গবন্ধুর জীবন হতে আমি এ শিক্ষা পেয়েছি যে, দেশের চেয়ে বড় কিছু নেই। তাই দেশকে গড়ার লক্ষ্যে আমি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছি।

ক্ষমতা
ক্ষমতার বহু সংজ্ঞা আছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। দাতা, শিক্ষানুরাগী, রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এবং সর্বোপরি ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার হিসেবে তিনি বহুমাত্রিক ক্ষমতার অধিকারী। এরূপ ব্যক্তিবর্গ সাধারণত ক্ষমতাকে সুসংহতরূপে ব্যবহার করতে পারেন না। সৈয়দ আবুল হোসেন প্রাত্যহিক জীবনে ক্ষমতার প্রয়োগ ও ব্যবহারে যেমন সচেতন তেমনি জনকল্যাণমুখী। তিনি মনে করেন- Power is the ability to do good things for others.

১. এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন অফিসারদের সাথে অনানুষ্ঠানিক আলাপে।
২. কালকিনিতে জনগণের বিশাল সংবর্ধনা দেয়ার পর পত্রিকায় সমালোচনা হলে 
তদপরিপ্রেক্ষিতে আলাপ প্রসঙ্গে।
৩. মন্ত্রণালয়ে কয়েকজন অফিসার ও রাজনীতিবিদের সাথে আলাপ প্রসঙ্গে।
৪. কমিউটর ট্রেন উদ্বোধনের লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জ যাবার পথে ট্রেনে কথাপ্রসঙ্গে 
আলাপক্রমে।
৫. মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সৈয়দ আবুল হোসেন।
৬. মন্ত্রণালয়ের অফিসকক্ষে সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের সাথে আলাপ প্রসঙ্গে।
৭. মন্ত্রণালয়ে নিজস্ব অফিস কক্ষে, ৯/৬/২০১০ খ্রিস্টাব্দ।
৮. গোপালগঞ্জ যাবার পথে গাড়িতে।
৯. বসিলায় তৃতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আসার পূর্বে কয়েকজন নেতা 
ও প্রকৌশলীগণের সাথে আলাপ।
১০. আবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
১১. অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন, সাক্ষাৎকারে।

দ্বি তী য় অ ধ্যা য়

সময়ের পরশপাথর

সৈয়দ আবুল হোসেনের জন্য শুভেচ্ছা
কবীর চৌধুরী

রাজনীতি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ক্ষেত্র। এতে লক্ষ্য থাকে, উদ্দেশ্য থাকে, থাকে তা পূরণের কৌশল, পদ্ধতি ও কার্যক্রম। যে বিষয়টি এককভাবে সম্ভব হয় না, যা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে সর্বসাধারণের সমর্থন প্রয়োজন, সেটি মানুষ রাজনীতিক দলের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পূরণের চেষ্টা করে। এর মাধ্যমে এক দল মানুষ আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোসহ দৈনন্দিন জীবনের সাবলীল পরিসঞ্চালনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি ও স্বাচ্ছ্যন্দময় সমাবেশ ঘটানোর মাধ্যমে জীবনযাত্রা শান্তিপূর্ণ করে তুলতে চেষ্টা করে।
যত মত তত পথ- এ প্রবাদের মতো রাজনীতিক দলও বহু। মতভিন্নতার কারণ দলভিন্নতা। এতে ক্ষতি নেই, বরং আছে বৈচিত্র্য, যা পৃথিবীকে নানা সম্ভারে সমৃদ্ধ করেছে। বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্র পরিচালনার জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে গণতন্ত্র। এটি নিয়ে যতই আলোচনা-সমালোচনা থাকুক না কেন, এখনও এর চেয়ে উত্তম কোনো উপায় মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। আব্রাহাম লিংকনের ভাষায়- গভর্নমেন্ট অব দি পিপল, বাই দি পিপল অ্যন্ড ফর দি পিপল- শব্দগুলিই গণতন্ত্রের ভিত্তি। তাই এখানে প্রয়োজন পরমত সহিষ্ণুতা প্রকাশের মতো উদার মন।
রাষ্ট্র সবার জন্য, ধর্ম ব্যক্তির। রাষ্ট্রকে ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ করে দিলে সমষ্টির সামষ্টিকতা ব্যক্তির মতো ক্ষুদ্র গণ্ডিতে এসে অর্থহীন হয়ে যায়। রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য উন্নয়ন সহায়ক ঐক্য। যেখানে ব্যক্তি সমষ্টিতে এসে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আত্ম-অহমিকা ও গোঁড়ামি ঐক্যকে নষ্ট করে দেয়। ধর্মীয় গোঁড়ামি, উগ্রজাতীয়তাবাদ ও আত্ম-অহমিকা মানুষকে হিংস্র পশুর চেয়েও নৃশংস করে তোলে। এটা আমরা দেখেছি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, পঁচাত্তরের কালো রাত্রে, ২১ আগস্টে। ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি ও মৌলবাদীরা পৃথিবীর অন্যতম শত্র“, প্রগতির বাধা। এরা স্বাধীন চিন্তার লোকদের বিকশিত হতে দেয় না।
রাজনীতিতে দলীয়করণের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না, যেমন অস্বীকার করা যায় না জাতীয়তাবাদের তত্ত্বকে। তবে অতিমাত্রার দলীয়করণ উগ্র-জাতীয়তাবাদের মতোই ভয়ঙ্কর। গণতন্ত্রে রাজনীতিক দলের উদ্দেশ্য থাকে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অধিক লোকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এটি কার্যকরভাবে নিশ্চিত করতে হলে অতিমাত্রায় দলীয়করণ অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। নিজের দলের লোকের সাথে সাথে ভিন্নমতাবলম্বীদেরকেও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। তাদের কাছে টেনে আনার প্রয়াস সযতেœ অব্যাহত রাখতে হবে। সবার প্রতি সহনশীল মনোভাব পোষণ না-করলে, ভিন্নমতাবলম্বীদের গুরুত্ব না-দিলে, গণতন্ত্র কেন, সব তন্ত্র নিষ্ফল হতে বাধ্য। রাজনীতির রুক্ষ মাঠে খেলতে গিয়ে অনেক রাজনীতিবিদকে ভণ্ডামির আশ্রয় নিতে দেখি। রূপ বদলায় প্রতিনিয়ত, সংকীর্ণ স্বার্থের জন্য আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতে, এমনকি মানবতার কলঙ্ক ঘটাতেও, দ্বিধাবোধ করে না তারা সৈয়দ আবুল হোসেনের মধ্যে এমন ভণ্ডামি নেই। তিনি রাজনীতি আদর্শের জন্য কারও প্রতি তার বিদ্বেষ নেই। দল মত ও জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার প্রতি সম-আচরণ দ্বারা এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন তিনি দেখেন, যেখানে সহনশীল অবস্থানের মাধ্যমে প্রত্যেকে অপরকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করার পরিবেশ খুঁজে পাবে।
গ্রাম দেশের প্রাণ। কিন্তু আমরা অনেকে ভুলে যাই গ্রামের কথা, গ্রামের মানুষের কথা। এটি আমাদের দেশের শহরমুখী প্রবণতার অন্যতম কারণ। ফলে গ্রামগুলি আজ অনেকটা মেধাশূন্য, কর্মশূন্য। ভালো শিক্ষালয় নেই গ্রামাঞ্চলে। নেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির উপযুক্ত ক্ষেত্র। ঢাকা আজ মানুষের চাপে প্রায় বিধ্বস্ত। এ অবস্থার জন্য শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে দায়ী করলে চলবে না। গ্রামের প্রতি বুদ্ধিমান ও সামর্থ্যবান মানুষের অবহেলাও কম দায়ী নয়। মানুষের অত্যাবশ্যকীয় সুবিধাসমূহ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারলে, শহরের উপর মানুষের চাপ কমবে। উন্নয়ন বিকশিত হবে সর্বত্র। কেবল তখনি দেশ প্রকৃত উন্নয়নের স্বাদ পাবে। সৈয়দ আবুল হোসেন নিজ গ্রামে আধুনিক মানসম্পন্ন স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল এবং অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সে পথে অগ্রসর হচ্ছেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তিনি ৬টি কলেজ এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার এ উদ্যোগ দেশের পশ্চাদপদ এলাকা মাদারীপুর-কালকিনি ও নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহের নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান- সন্ততিদের শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দিয়েছে। বিত্তবানরা সৈয়দ আবুল হোসেনের উদাহরণ অনুসরণ করলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
সৈয়দ আবুল হোসেন প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহের মধ্যে ডিকে সৈয়দ আতাহার আলী অ্যাকাডেমি অ্যান্ড কলেজ অন্যতম। কলেজ প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। কলেজে দু’জন মহিলা শিক্ষিকার থাকার মতো কোনো সুবিধাজনক আবাস ছিল না। তারা ভীষণ অসুবিধায় পড়ছিলেন। বিষয়টা জানতে পেরে সৈয়দ আবুল হোসেনের মা সুফিয়া খাতুন শিক্ষিকা দু’জনকে নিজের ঘরে কন্যার মতো স্থান দেন। শিক্ষিকা দু’জন ছিলেন হিন্দু। সুফিয়া খাতুন প্রাচীন কালের মহিলা। লেখাপড়া বেশি করেননি। এ রকম অবস্থায় ডাসারের মতো অজপাড়া গাঁয়ে তিনি তাঁর কক্ষে দু’জন হিন্দু মহিলাকে রাখার যে স্বতঃস্ফূর্ত সাহসিকতা দেখান তা বিস্ময়কর। তারই গর্ভে জন্ম সৈয়দ আবুল হোসেনের। মায়ের মৃত্যুর পর সৈয়দ আবুল হোসেন মায়ের সে ঘরটিকে পরিণত করেছেন শিক্ষিকা হোস্টেলে। সৈয়দ আবুল হোসেন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি। তিনি জানেন, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ন্যাক্কারজনক। মানুষের বড় পরিচয় মনুষ্যত্বে।
ভদ্র, মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, সহৃদয় ও সুশীল আচরণ মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের প্রধান উপায়। মানুষ ও পশুর মধ্যে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন, আচরণ দ্বারাই বোঝা যায়, কে মানুষ আর কে পশু। শক্তি পশুকে যেমন হিংস্র করে তোলে, তেমিন অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতাও অনেক মানুষকে হিংস্র করে তুলতে দেখা যায়। ইতিহাসে এর অনেক প্রমাণ আছে। কিন্তু যারা মানুষ, মনুষ্যত্ববোধে যাদের অন্তর উজ্জীবিত, তারা অর্থ ও ক্ষমতা অর্জনের সাথে সাথে বিনয়ী হয়ে ওঠে। শুধু পরিব্যাপ্তি নয়, পরিব্যাপ্তির সাথে সাথে গভীরতা থাকতে হয়। গভীরতাহীন পরিব্যাপ্তি ও পরিব্যাপ্তিহীন গভীরতা দুটোই বিপজ্জনক। সৈয়দ আবুল হোসেন যেমন গভীর তেমনি পরিব্যাপ্ত। তিনি অমায়িক। ক্ষমতা ও বিত্ত তাঁকে বিনয়ী করেছে। এক সময় তাঁর সঙ্গে আমার মোটামুটি ভালো পরিচয় ছিলো। পরে তা শিথিল হয়ে যায়। কিন্তু এখনও আমি তাঁর বিভিন্ন কর্ম ও উদ্যোগের খবর রেখেছি। আমি তার জনকল্যাণমূলক কাজের সফলতা কামনা করি।

কবীর চৌধুরী : জাতীয় অধ্যাপক

ধন্যবাদ সৈয়দ আবুল হোসেন
বেগম সুফিয়া কামাল
বিস্তারিত সিন্ধুর মতো মানব জীবন। কত বর্ণে, ছন্দে-হিল্লোলে, তরঙ্গে তরঙ্গে তার গতি। তেমনি প্রত্যেক মানুষেরই জীবন প্রবাহ বিচিত্ররূপে প্রবাহমান। তারই মধ্যে ব্যতিক্রমও আছে, এক একটি মানুষের জীবন থেকে সহস্রদল পদ্মের মতো বিকশিত বিস্তারিত হয় নানাবর্ণ। নানা রূপ, নানা কথা, হয়ে ওঠে ইতিহাস, হয়ে যায় কিংবদন্তি। সেই মানুষের কয়েক জনের মধ্যে একজন জন্মেছিলেন যার নামই ইতিহাস। সেই নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচয় দিতে বা তাঁর জীবনী আলোচনা করার জন্যে তার কথা বলা হচ্ছে না, বাংলাদেশকে স্বাধীন করে আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়ে শূন্য হাতে তিনি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে রেখে গিয়েছেন। 
শেখ হাসিনা আজ সর্বজন প্রিয় সংগ্রামী নেত্রী। আমাদের একান্ত আপন। সকলের মিলিত মঙ্গল প্রার্থনা তার জন্য সতত উচ্চারিত হচ্ছে। তার গুণগ্রাহীর অভাব নেই, তেমনি তার দোষ ত্র“টি নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রƒপ করার লোকেরও অভাব নেই। বিশ্বে যারাই প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন, তাদের জীবনের এ ঘটনা অপরিহার্য।
শেখ হাসিনার জীবন ঘটনাবহুল। বড় দুঃখ, বড় সংকটের মধ্য দিয়ে তার পদচারণা। তাকে নিয়ে আজ আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন যে প্রশস্তি রচনা করেছেন, তাতে করে হাসিনার প্রতি হোসেন সাহেবের অপরিসীম মমতা ও শ্রদ্ধার অনাবিল প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু হাসিনার জীবন বহু কর্তব্য, বহু বক্তব্য, বহু কর্মকাণ্ডে এখন ব্যস্ত; বিকশিত, বিস্তারও হবে। কঠোর, কুটিল, বক্র, সর্পিল পথ ধরে বহন করে হাসিনার বহমান জীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের উপহার দিবেন প্রত্যাশা করি।
এ গ্রন্থে সৈয়দ আবুল হোসেন আমাদের যতটুকু দিয়েছেন, তার জন্য বার বার তাকে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছা হয়। আল্লাাহ তাকে এ পথযাত্রায় সাহসী পাথেয় দান করুন, এ প্রার্থনা করি।

বিশেষ দ্রষ্টব্য : আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের লেখা ‘শেখ হাসিনা সংগ্রামী জননেত্রীর প্রতিকৃতি’ নামক গ্রন্থের ভূমিকায় বাংলাদেশের প্রখ্যাত মহিলা কবি বেগম সুফিয়া কামাল।

শুভেচ্ছা
আনিসুজ্জামান
সৈয়দ আবুল হোসেনের সম্মাননায় একটি সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। সেই উপলক্ষে দু’টি কথা।
তিনি যখন প্রথম দফায় বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী নিযুক্ত হন, তখন তাঁর সঙ্গে আমার যথাযথ পরিচয় ঘটে। তাঁকে সদালাপী ও সুরসিক মনে হয়।
তারপর কী এক গোলযোগে তিনি পদত্যাগ করলেন। ব্যাপারটা যে গুরুতর নয়, তা বোঝা গেল মন্ত্রীর পদে তিনি দ্বিতীয়বার অধিষ্ঠিত হওয়ায়। এবার তিনি নিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণায়ের দায়িত্ব। তারপর একদিন বললেন, তিনি যাত্রাবাড়ি ঘুরে এসেছেন, কোথাও যানজট পাননি। আমরা হতবাক।
এক আমন্ত্রণে তাঁর দেখা পেয়ে কথাটা পাড়লাম। জানতে পারলাম, তিনি খুব সকালে অফিসে রওয়ানা হন, বেশ রাত করে ঘরে ফেরেন। তাই যানজট দেখতে পান না। মনে প্রশ্ন এলো, দিনের মধ্যে কখনো কি তাঁকে বের হতে হয় না? মনে এলেও প্রশ্নটা আর করা হয়নি।
আমার আগের প্রশ্নের উত্তর যে তিনি প্রসন্নভাবে দিলেন, তাতেই বাধিত হলাম। তারপর আবার যখন দেখা হয়েছে, সহাস্যবদনেই তিনি আলাপ করেছেন। বোঝা যায়, তিনি অতি ভদ্র মানুষ।
এখন জানছি, শুধু তাই নয়, তিনি একজন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিও। তাঁর এলাকায় তিনি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, জ্ঞানের আলো ছড়াতে সাহায্য করেছেন। শুধু ধন থাকলেই যে মানুষ সৎকাজ করতে পারে, তাই নয়। মনও থাকা চাই। সৈয়দ আবুল হোসেনকে তাই আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। জনহিতে তিনি নিরলস থাকুন, দীর্ঘজীবী হোন।

আনিসুজ্জামান : এমেরিটাস অধ্যাপক ও গবেষক

নিপাট ভদ্রলোক
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার আমগাঁও গ্রামে আমার জন্ম। প্রশাসনিক বিবর্তনে আমগাঁও এখন মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলায় ঠাঁই পেয়েছে। এটি সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেবের সংসদীয় এলাকা। দেশ বিভাগ না-হলে আজ আপনাদের মতো আমিও বলতে পারতাম- আমার দেশ বাংলাদেশ।
প্রত্যন্ত আমগাঁও ছিল সবুজ শ্যামলে অপরূপ। মনে হয় এখনও তেমন আছে। মনে পড়ে আমগাঁও; ছোট ছোট মেটো পথ, সারি সারি গাছ, নদীর তীর, পাখির নীড়। দেখতে পাই সহজ সরল কৃষাণ-কৃষাণীরা রূপোলি ধানের হাতছানিতে ছুটে যাচ্ছে মাঠে। মনে পড়ে শীতের সকাল, শরতের দুপুর। সোদা গন্ধভরা বাংলাদেশ আমাকে এখনও টানে, জন্মভূমির টান, নাড়ির টান। ভুলতে পারি না ছেলেবেলার সে আমগাঁও, পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি। কত সুখ, কত স্মৃতি, কত বন্ধু, কত প্রীতি ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশে। সময়ের স্রোতে অনেক কিছু আস্তে আস্তে স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। শুধু জেগে আছে কান্নায় মোড়া একঝাঁক দুঃখ।
সৈয়দ আবুল হোসেন বয়সে আমার ছোট। তাঁকে আমি কয়েক বার দেখেছি। উনি খুবই শ্রদ্ধেয় এবং বিরাট মাপের মানুষ। শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ আমাকে মুগ্ধ করেছে। অর্থ আর ক্ষমতা অনেককে অহমিকার অন্ধকারে নিমজ্জিত করে দেয়। সৈয়দ আবুল হোসেন অর্থ ও ক্ষমতা দুটোর অধিকারী। তবু তিনি বিরাট মনের নিপাট ভদ্রলোক। কোনো অহমিকা নেই। শিশুর মতো সরল। জ্ঞানীর মতো বিনয়ী। যতবার দেখেছি তাই মনে হয়েছে। সদাহাস্য প্রফুল্ল মনের এ মানুষটির মুখ আমার স্মৃতিকে নাড়া দেয়। মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের কথা, বাংলাদেশের মুখ।
উনি উচ্চ শিক্ষিত আবার স্বশিক্ষিত। তাই মনটা অনেক বড়। যারা বড় মনের তারা অন্যকেও বড় ভাবতে পারেন। জ্ঞানী ও যোগ্য লোককে সম্মান দিতে জানেন। আমি মাদারীপুর গিয়েছিলাম। তার আতিথেয়তার কথা ভুলব না। বাংলাদেশের মানুষ আমাকে উজাড় করে দিয়েছিলেন সবটুকু ভালোবাসা।
সৈয়দ আবুল হোসেন একজন জনদরদি নেতা। সাধারণ মানুষের প্রতি রয়েছে গভীর ভালোবাসা। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। তাই শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি গ্রামাঞ্চলে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। শিক্ষার মাধ্যমে জাতিকে মুক্তির প্রচেষ্টা সৈয়দ আবুল হোসেনকে স্মরণীয় করে রাখবে।
শিক্ষা মানুষকে উদার করে। সৈয়দ আবুল হোসেন একজন শিক্ষিত মানুষ। তাই উদারমনা। তিনি ধর্মপরায়ণও বটে। ধর্মপরায়ণতা অনেককে সংকীর্ণ করে তোলে। তবে উনাকে সংকীর্ণ করতে পারেনি বরং উদার করেছে। প্রকৃত ধার্মিকেরা জ্ঞানীর মতোই উদার। অসাম্প্রদায়িক চেতনা উনাকে আরও বড় করেছে। আমি যখন মাদারীপুর গিয়েছিলাম তখন দেখেছি দলমত ধর্মনির্বিশেষে সবাই সৈয়দ আবুল হোসেনকে কেমন গভীর শ্রদ্ধা করেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন সম্মাননা গ্রন্থ ‘সময়ের পরশপাথর’ প্রকাশ একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এটি সময়ের একটি দাবি পূরণ করল। যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য সম্মান প্রদর্শন মহানুভবতার পরিচায়ক। যারা মহানুভবÑ তারাই কেবল এ কাজটি করতে পারেন। গুণীর কদর কম হলে গুণীর সংখ্যাও কমে যায়। সৈয়দ আবুল হোসেনকে সম্মান প্রকাশের এ উদ্যোগে আমি খুশি হয়েছি। তার সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশ উপলক্ষে আমাকে স্মরণ করায় সবাইকে সবিনয় শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমি এ শুভ উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি। দীর্ঘায়ু কামনা করি সৈয়দ আবুল হোসেনের।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : কবি ও উপন্যাসিক

আমার ভালোলাগা একজন
আবদুল মান্নান সৈয়দ
মফিজ চৌধুরী ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য। ভদ্রলোক ভালো লিখতেন, ভালো বলতেন। কয়েকটি বিদেশি ভাষা জানতেন তাই ভালো অনুবাদকও ছিলেন। তবে অনুবাদ করতেন জাহাঙ্গীর চৌধুরী নামে। বয়সে বড় হলেও ছিলেন অনেকটা বন্ধুর মতো। আড্ডায় মাঝে মাঝে সৈয়দ আবুল হোসেনের কথা বলতেন; বলতেন- মাদারীপুরের ছেলে, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষানুরাগী। মফিজ চৌধুরীর মুখে আমি প্রথম সৈয়দ আবুল হোসেনকে জানার সুযোগ পাই। এরপর পত্র-পত্রিকা বা পর্দায় সৈয়দ আবুল হোসেন প্রসঙ্গ আসলে মনোযোগ না-দিয়ে পারতাম না।
১৯৮৯ সালে মাদারীপুর জেলার খোয়াজপুরে সৈয়দ আবুল হোসেন একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন- মফিজ চৌধুরীর কথাটি আমি খুব হালকাভাবে নিই। কলেজ অনেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। তাই প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গটি তেমন গুরুত্বের দাবি রাখে না। তবে এ কলেজটি গুরুত্বের দাবি রাখে। এর কারণ প্রতিষ্ঠাগত নয়, প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী ফলগত, পরিচর্যা এবং উদ্দেশ্যগত। ১৯৯১ সালে কলেজটির ছাত্রছাত্রীরা প্রথম বারের মতো বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নেয়। প্রথম বারেই বাজিমাত। বোর্ডের মেধা তালিকার দু’টি শীর্ষ স্থান দখল করে নেয়- সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ, খোয়াজপুর। সারা বাংলাদেশে সাড়া পড়ে যায়, আসলে সাড়া পড়ারই ঘটনা। এর পরের বছর আরও ভালো রেজাল্ট করে কলেজটির ছাত্র-ছাত্রীরা, পরের বছর আরও, পরের বছর আরও…। সংগত কারণে ১৯৯২ সাল হতে সৈয়দ আবুল হোসেন দেশব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠে তার সৃষ্টির মাধ্যমে। এ জন্য বলা হয়-
স্রষ্টার কৃতিত্ব সৃষ্টি
জাতির ঐতিহ্য কৃষ্টি।
সাকো ইন্টারন্যাশনাল লিঃ সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। 
বিশ্বস্ততা ও দক্ষতার জন্য বিদেশেও এর সুনাম রয়েছে। শুধু ব্যবসা করার জন্য তিনি সাকো প্রতিষ্ঠা করেছেন, এটি ঠিক নয়। সাকো প্রতিষ্ঠার পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল জনকল্যাণ। তাই সাকো শুধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। একই কারণে সৈয়দ আবুল হোসেনও অন্য দশজন ব্যবসায়ীর মতো শুধু ব্যবসায়ী নন। অনেকে মুখে বড় বড় বুলি আউড়ে থাকেন, কিন্তু কাজের সময় ডুমুরের ফুল হয়ে যায়। ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা- এ বিষয়ে বড় সেয়ানা। মুখে বলেন একটা, কাজ করেন অন্যটা। সৈয়দ আবুল হোসেন কিন্তু কথা ও কাজে এক। দেশে তার চেয়ে ধনী অনেক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি আছেন। তাদের কয়জন সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন?
ছাত্রজীবন শেষ করে (১৯৭২) টিসিবি-তে কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। বেশিদিন চাকুরি করেননি। চাকুরি করে ভাত খাওয়া যায়, খাওয়ানো যায় না কাউকে। যারা খেতে ও খাওয়াতে চান তাদের জন্য চাকুরি উপযুক্ত পেশা হতে পারে না। মনে হয় তিনি এটি বুঝেছিলেন। তাই সময় থাকতে চাকুরি ছেড়ে ব্যবসায় নেমেছিলেন। সরকারি চাকুরি করে অঢেল অর্থের মালিক হয়েছেন- এমন অনেক লোক দেখা যায়। অভিজাত এলাকায় আলিশান বাড়ি, বিদেশে পরিবার, বিলাসবহুল গাড়ি…। সরকারি চাকুরি করে এসব করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ চাকুরেদের বেতন টেনে-টুনে খেয়ে-পরে চলার পক্ষেও যথেষ্ট নয়। তো ওগুলো আসবে কোত্থেকে? সুতরাং তাদের কেউ ঐ ধন বৈধ পথে আয় করেনি। অবশ্য জানতে চাইলে বলেন- শ্বশুর দিয়েছেন, শ্যালিকার স্বামী দিয়েছেন। মিথ্যা কথা। অবৈধ আয় কখনও ভালো কাজে ব্যয় করা যায় না, মিথ্যুক জন সৎ কাজ করতে পারেন না। যাদের ভালো কাজ করার ইচ্ছা থাকে, তারা ঘুষ নিতে পারেন না। যদি কোনো ঘুষখোর কিংবা অবৈধ উপার্জনকারী কল্যাণমূলক কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন, তার উচিত ঘুষ কিংবা অবৈধ উপার্জন ত্যাগ করা। তাদের জন্য এর চেয়ে ভালো কাজ আর কিছু হতে পারে না।
এবার প্রসঙ্গে ফেরা যাক। অর্থ উপার্জন করে সমাজ সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য সৈয়দ আবুল হোসেন ব্যবসায় নেমেছেন- এটি তার নিজের উক্তি। অন্যান্য ব্যবসায়ীর মতো তার উক্তি শুধু শব্দমালায় সীমাবদ্ধ থেকে যায়নি। অন্তত পরবর্তী কার্যক্রম তা-ই বলে। সমাজসেবায় উৎসর্গিত হবার জন্য তিনি ব্যবসায় নেমেছেন- এটি তিনি কার্যে পরিণত করে প্রমাণ করেছেন। রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর মতো সৈয়দ আবুল হোসেন কথা ও কাজের মধ্যে ফাঁক রাখতে পারেননি। এ জন্য তার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল, প্রচ্ছন্ন একটা শ্রদ্ধাবোধও ছিল।
১৯৯৪ সালের শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সৈয়দ আবুল হোসেনের সহমর্মিতা শিক্ষক সমাজে তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন। বিরতিহীনভাবে সাত দিন চলেছিল সমাবেশ। সে আন্দোলনের মঞ্চে উপস্থিত হয়ে তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, ক্ষুধার্ত শিক্ষকদের খাবার ও ঔষধ পথ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। অনশনরত শিক্ষকগণের বৃষ্টিতে ভেজার খবর পেয়ে ব্যবস্থা করেছিলেন পলিথিনের। বরিশাল হতে সমাবেশে আসার পথে একজন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সৈয়দ আবুল হোসেন সে শিক্ষকের স্ত্রীকে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রদান এবং সন্তান-সন্ততিদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার এসব কাজ শিক্ষকগণ অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ করেছিলেন। যা তাকে শিক্ষক সমাজে মহানুভব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। শিক্ষক সমাজের প্রতি সৈয়দ আবুল হোসেনের শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধের কথা অনেক সহকর্মী আমাকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসার সাথে বলেছেন। শিক্ষক হিসেবে এটি আমাকে অভিভূত করেছে। শিক্ষকদের কেউ গুরুত্ব দেয় না- সৈয়দ আবুল হোসেন গুরুত্বহীন শিক্ষকদের গুরুত্ব দিয়েছেন, বিপদে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাই তিনিও গুরুত্বের দাবি রাখেন। এ বিষয়টি শিক্ষক হিসেবে আমাকে তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলেছে। তাই তাকে আমার ভালো লাগে।
প্রায় সাড়ে তিনশ শিক্ষক-কর্মচারী তার বিভিন্ন কলেজে অধ্যয়ন পেশায় নিয়োজিত। শিক্ষকগণ তার অধীনস্ত। তবে তিনি তাদের অধস্তন মনে করেন না, মনে করেন তার শিক্ষক। তাই সব শিক্ষককে নিজের শিক্ষকের মতো শ্রদ্ধা করেন, গুরুত্ব দেন, তাদের জাতি গঠনের কারিগর আখ্যায়িত করে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দেন। ছাত্রজীবনেও তিনি শিক্ষক-অন্ত-প্রাণ ছিলেন। মন্ত্রী হয়েও পা ছুঁয়ে সম্মান দেখান শিক্ষকদের. বিপদে-আপদে সহায়তা দেন আন্তরিক আগ্রহে। শিক্ষক সমাজ এখন ছাই ফেলার ভাঙা কুলোর মতো, শিক্ষক পেশাকে ভাবেন ঢেঁকি গেলা। ক্ষমতা ও বিত্ত অর্জনের ক্ষেত্র কম থাকায় সাধারণ লোকেরাও শিক্ষকদের গুরুত্ব দেন না। গুরুত্বহীন শিক্ষক সমাজের প্রতি যার সহমর্মিতা রয়েছে, শ্রদ্ধা রয়েছে তিনি ভালো লোক না-হয়ে পারেন না। তাই তাকে আমার ভালো লাগে।
রাজনীতিবিদগণের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যেমন নিষ্ঠুর তেমন দীর্ঘস্থায়ী। সামন্ত যুগ, রাজা-বাদশা ও জমিদারগণের শোষণ এখনও রূপকথার শিউরে ওঠা প্রচ্ছদ। ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায়। পাকিস্তান আমলে তা রুদ্ররূপ ধারণ করেছিল। সদ্য স্বাধীন কিন্তু বিধ্বস্ত বাংলাদেশের বিনির্মাণে সহায়তার পরিবর্তে দেশদ্রোহী ও ধর্মান্ধদের নৃশংসতার কথা জাতি কখনও কী ভুলতে পারবে? সামরিক আইনের পর সামরিক আইন গণতন্ত্রকে বিপন্ন করেছে বার বার। কয়টা নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে বাংলাদেশে? রাজনীতিবিদগণের অহংবোধ, ক্ষমতার আস্ফালন, অপব্যবহার, ধর্মীয় গোঁড়ামি কোনোটি জনগণ ভালো চোখে দেখেননি। রাজনৈতিক হানাহানি এক সময় বর্গী আতঙ্কের চেয়েও প্রকট হয়ে উঠেছিল। এ কারণে অধিকাংশ রাজনীতিবিদ জনগণের আস্থার বাইরে রয়ে গেছে। এ সময় সৈয়দ আবুল হোসেন একজন রাজনীতিবিদ হয়েও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংসদীয় এলাকা এবং কর্মক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা, সহনশীল অবস্থান ও উদার মনের পরিচয় দিয়েছেন। প্রতিপক্ষকে বুকে টেনে নিয়েছেন। তা আমাকে অভিভূত না-করে পারেনি। এ জন্য তাকে আমার ভালো লাগে।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হলেও সাকো আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এটি প্রমাণ করে যে, সাকো শুধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং দেশের আর্থসামাজিক ভিত মজবুত করার একটি খুঁটি। যেটি শক্ত হাতে ধরে রেখেছেন সৈয়দ আবুল হোসেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ এনজিও সেবার আড়ালে ভোগের ক্যাসিনো, কাবুলিওয়ালাদের মতো সুদের কারবারে নিয়োজিত। চোখে তো তাই দেখি। এক্ষেত্রে এসডিসি একটি সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান- আয়ের জন্য নয়, ত্যাগের জন্যই যেটি নিবেদিত। বিভিন্ন সামাজিক সমস্যায় জনমত সংগ্রহ, প্রতিবেদন তৈরি এবং প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনা করে সমস্যার উৎস খুঁজে বের করা এর আরেকটি উদ্দেশ্য। শিক্ষা আলোকিত সমাজ ও উন্নত জাতি গঠনের পূর্বশর্ত। শিক্ষা মানুষের পাশবিক গুণাবলীকে দুরীভূত করে মানুষকে যৌক্তিক করে তোলে। আগামী প্রজন্মকে শিক্ষিত ও দক্ষ জনসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে নারী শিক্ষার বিকল্প নেই। সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন, ‘দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। অর্ধেককে অন্ধকারে রেখে কোনো জাতির প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সার্বভৌম আর্থ-সামাজিক ভিত প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন। কেবল শিক্ষার মাধ্যমে সর্বোত্তম উপায় ও সর্বনিম্ন সময়ে নারীর ক্ষমতায়ন টেকসই করা যায়।’ ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি একটি শিক্ষিত জাতি দেব’- নেপোলিয়নের এ উক্তিটি সৈয়দ আবুল হোসেন খুব গুরুত্বের সাথে মনে রাখেন। একজন শিক্ষিত মায়ের পক্ষে এক জন সন্তানকে যত দক্ষ ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব, একজন শিক্ষিত পিতার পক্ষে তা সম্ভব নয়। কারণ, শিশুরা মায়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও নিবিড় পরিচর্যা যত বেশি সময় পায় পিতার নিকট হতে তত সময় পায় না। তাই সৈয়দ আবুল হোসেন মনে করেন, শিশুদের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মা তথা নারীর বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। সৈয়দ আবুল হোসেন আরও মনে করেন, ‘যিনি আত্মসচেতন, পারিপার্শ্বিকতা যথাযথ বিশ্লেষণ করতে পারেন এবং নিজের জীবন সম্পর্কে নিজেই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম, তিনিই ক্ষমতাবান। এ সব উপাদান পেতে হলে একজন নারীকে শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষিত হলে আত্মসচেতনতা আসে, পরিপুষ্ট হয় আর্থিক স্বাধীনতা।’ এ লক্ষ্য অর্জনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তিনি এসডিসি-এর মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের কর্মমুখী শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করে তুলছেন। আমি নিজেই নারীর ক্ষমতায়নের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক। সৈয়দ আবুল হোসেন আমার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন। তাই রাজনীতি করলেও তাকে ভালো লাগে।
সৈয়দ আবুল হোসেন ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এন্ড কলেজ, শেখ হাসিনা উইমেন্স কলেজ এন্ড একাডেমি, ডাসার, কালকিনি; কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, কালকিনি; সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ খোয়াজপুর, টেকেরহাট এবং খাসেরহাট সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ নামক পাঁচটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। নারী শিক্ষার প্রসারে শেখ হাসিনা উইমেন্স কলেজ এন্ড একাডেমি (১৯৯৫) বৃহত্তর বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এখানে অধ্যয়নরত প্রায় সাড়ে পাঁচশ ছাত্রীর ভর্তি ফি, পাঠ্যপুস্তক ও বেতন ফ্রি। ভালো ফল অর্জনকারী ছাত্রীদের খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত ফ্রি করে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠাতা। প্রত্যেক ছাত্রীর খাট, মেট্রেস, লেপ, তোষক, বালিশ, টেবিল, চেয়ার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া হয়। লোডশেডিঙের সময় জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক মিনিটের জন্যও মেয়েদের অন্ধকারে থাকতে হয় না। কন্যা সন্তানের জন্ম গ্রামীণ পরিবারে সাধারণত অবাঞ্চিত। মেয়েদের লেখাপড়ায় অভিভাবকদের নিরুৎসাহ সর্বজনস্বীকৃত। মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর চেয়ে পাত্রলগ্ন করাকে উত্তম মনে করা হয়। অন্যদিকে অনেক মেয়ে অর্থাভাবে আইবুড়ো হয়ে থেকে যায়। দীর্ঘদিন অবিবাহিত থাকায় সামাজিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়। এ সকল সমস্যা সমাধানে সৈয়দ আবুল হোসেন বিভিন্ন প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বাল্যবিবাহ রোধকল্পে এসডিসি নিবিড় গণসচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। গত দুই দশকে সৈয়দ আবুল হোসেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, দক্ষতাবৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক সহায়তার মাধ্যমে ১০ হাজারের অধিক নারীকে স্বনির্ভর হিসেবে গড়ে তুলে ক্ষমতায়নের পথকে প্রশস্ত করেছেন।১ এদের উত্তরণ উৎসাহিত করেছে আরও অনেককে। নাড়া দিয়েছে গোটা সমাজকে। তাই সৈয়দ আবুল হোসেন একজন সমাজ সংস্কারকও বটে। সমাজ সংস্কারকদের অনেকে পছন্দ করেন না কিন্তু আমি জানি সংস্কার ছাড়া কোনো জাতি সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে না। সৈয়দ আবুল হোসেন সংস্কারের কাজে নিয়োজিত- এ জন্য তাকে আমার ভালো লাগে।
সৈয়দ আবুল হোসেন শুধু শিক্ষানুরাগী, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ নন, একজন লেখকও বটে। তার কয়েকটি বই পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। রাজনীতি ও সমাজ সংস্কার বিষয়ক লেখা। প্রতিটি লেখা ক্ষুরধার যুক্তি আর হৃদয়গ্রাহী উদ্ধৃতি পরিচ্ছন্ন প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়। এটি তাকে আমার ভালো লাগার অন্য আর একটি কারণ। যার মাঝে আমার ভালো লাগার এতগুলো কারণ রয়েছে তাকে ভালো না-বেসে, শ্রদ্ধা না-করে পারা যায় না।
নারীর ক্ষমতায়নে সৈয়দ আবুল হোসেনের একাগ্রতা প্রশংসনীয়। তিনি দুই কন্যার গর্বিত পিতা। উভয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং উদার মনের অধিকারী। আমার মনে হয়, নারীদের প্রতি তার সহমর্মিতা পিতৃস্নেহ উৎসরিত একটি নিখাদ প্রেরণা, অবিরাম প্রবাহ। তার এ প্রেরণায় লক্ষ্যে পৌঁছার তাগিদ আছে কিন্তু অন্ত নেই। তিনি অমায়িক, বিনয়ী ও নিরহঙ্কার চরিত্রের একজন বড় মনের মানুষ- আমার সহকর্মী শিক্ষকগণ এভাবে তাকে মূল্যায়ন করেন। আর কিছু না-হোক, অন্তত কর্ম ও আচরণ তাকে বাঁচিয়ে রাখবে।

আবদুল মান্নান সৈয়দ : শিক্ষাবিদ, কবি ও কথাসাহিত্যিক

১. গবেষণা জরিপ, জনগণের মানুষ।

অপরাধী জানিল না কি বা অপরাধ তারÑ
বিচার হইয়া গেল
অসীম সাহা
গত ৩১ জুলাই (২০১২) ‘দৈনিক কালের কণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘কালান্তরের কড়চা’য় একটি উপসম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে, যার শিরোনাম ‘আক্রান্ত আবুল হোসেনÑটার্গেট শেখ হাসিনা’। লেখাটি পড়ে আমার ভালো লাগল এ জন্যে যে, গত এক বছর যাবৎ প্রাক্তন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে টার্গেট করে কতিপয় পত্রিকা এবং বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্ট যেভাবে তাকে তুলোধুনো করে ছাড়ছিল, তার কিছুটা মোক্ষম জবাব দিয়ে তিনি অন্তত এইসব জ্ঞানপাপীদের মুখে কিছুটা হলেও কালি লেপন করে দিয়েছেন। গাফ্ফার ভাই এমন একজন কলামিস্ট, যার কলম থেকে সত্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো বেরিয়ে আসে, আর সেজন্যেই সকল পত্রিকায় তাঁর কলামের এত কদর। 
সৈয়দ আবুল হোসেন যখন ভেতর এবং বাইরে থেকে চতুর্মুখী আক্রমণে দিশেহারা, তখনই আমার মনে হয়েছিল, তাকে নিয়ে কিছু একটা লিখি। ভাবতে ভাবতে গাফ্ফার ভাইয়ের লেখাটা আমাকে অনুপ্রাণিত ও প্ররোচিত করলো আবুল হোসেন সম্পর্কে কিছু সত্য কথা তুলে ধরতে। 
শুরুটা হয়েছিল গত ঈদে যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা নিয়ে। সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা তখন এতটাই নাজুক ছিল যে, ঈদে ঘুরমুখো মানুষের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে প্রায় সকল পত্রিকা একযোগে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, তখন টেলিভিশন চ্যানেলে এবং পত্রপত্রিকায় রাস্তাঘাটের করুণ দশা দেখে আমিও বিব্রত বোধ করেছিলাম। আর চতুর্মুখী আক্রমণে বাধ্য হয়ে ঈদে চলাচলের উপযোগী রাস্তা সংস্কারের কাজে আজকের যোগাযোগ মন্ত্রীর মতো সৈয়দ আবুল হোসেনও রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন। তাতে রাস্তাঘাটের সার্বিক উন্নতি না হলেও কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছিল। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব পাবার পরপরই কেন রাস্তাঘাট সংস্কারের কাজে নামেননি? এই প্রশ্নের উত্তরে এটা বলা যায়, বিএনপির পাঁচ বছর আর সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছরসহ মোট সাত বছর সারা বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের হাল কী ছিল? তখন কি সবগুলো পথঘাট সোনা দিয়ে বাঁধানো ছিল? আমরা কি তখন বাংলাদেশে ছিলাম না? আমরা কী দেখিনি, তখনও রাস্তাঘাটের করুণ এবং দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা? সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রী হবার পরই তো বাংলাদেশের সকল রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযোগী হয়ে ওঠেনি। এতগুলো রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ চলাচলের উপযোগী করে তোলা কি দু’ছরের মধ্যে কারও পক্ষেই সম্ভব? তা হলে এর দায় শুধু তার ওপরই চাপিয়ে দেয়া হলো কেন? আগে যারা এইসব রাস্তাঘাটের উন্নয়নের কাজে তেমন কোনও ভূমিকাই রাখতে পারেনি, তারা কেন এইসব তথাকথিত পত্রিকা, সমালোচক এবং উগ্রপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনার হাত থেকে বেঁচে গেলেন? তারা আওয়ামী লীগের মন্ত্রী নয় বলে? আসলে গাফ্ফার ভাই যথার্থই বলেছেন, এদের মূল টার্গেট আসলে সৈয়দ আবুল হোসেন নয়, শেখ হাসিনা।
সামান্য ছিদ্র পেলেই তাতে আঙুল দেয়া যাদের স্বভাব, তারা আবুল হোসেন কেন, আওয়ামী লীগের যে কোনও কাজের খুঁৎ ধরতে পারলে একমুহূর্ত দেরি না করে তাতে আঙুল চালিয়ে দিতে বেশ পছন্দ করেন। এরা আবার নিরপেক্ষতার ভান করেন, প্রগতিশীলতার দোহাই পেড়ে আসলে তলে তলে মৌলবাদের ছাতার নিচে বসে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে হলেও তাদের গুণগান করতে কসুর করেন না। আসলে আওয়ামী লীগ নামেই এদের মধ্যে অরুচি। তাদের ভাব দেখলে মনে হয়, আওয়ামী লীগের এই সাড়ে তিন বছরের আগে যে সকল সরকার ক্ষমতায় ছিলেন, তারা দেশটাকে একেবারে সোনার দেশে পরিণত করে ফেলেছিলেন। মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী দেশ হিসেবে যে দেশটি বিশ্বের মানুষের কাছে ছিল ধিকৃত, সাত সাতবার বিশ্বের এক নম্বর দুর্নীতিবাজ দেশ হিসেবে যারা দেশের কপালে কলঙ্কতিলক লেপন করেছিল, হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করেছিল, তাদের চেয়েও কি আওয়ামী লীগ দেশটাকে অনেক বেশি জাহান্নামের আগুনে ঠেলে দিয়েছে? সাম্রাজ্যবাদের টাকায় ললিত-পালিত এসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের সেটা মনে হতেই পারে।
তারই আর একটি সর্বশেষ দৃষ্টান্ত পদ্মাসেতু নিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ নিয়ে তার ওপর আদাজল খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করেছে, তবে আর পায় কে? সাম্রাজ্যবাদের টাকায় লালিত কিছু পোষ্য পত্রিকা এবং তার সম্পাদক ও চ্যালাচামুণ্ডারা পারলে তাকে জবাই করে ছাড়ে। টেলিভিশন চ্যানেল খুললে একটাই আলোচনা, পদ্মাসেতু নিয়ে আবুল হোসেনের দুর্নীতি। এসব চ্যানেলের ‘টক শো’গুলোর সবচাইতে উত্তপ্ত আলোচনার বিষয়ও তাই। আর এতে অংশগ্রহণ করছেন কারা? চিহ্নিত আওয়ামী বিরোধী এবং প্রাক্তন পিকিংপন্থী অর্থাৎ বর্তমানের নব্য রাজাকাররা। আর অদ্ভুত ব্যাপার এটাই যে, এইসব চ্যানেলগুলো যেন দেশে কথা বলার মতো আর কোনও লোকই খুঁজে পায় না। দু’একদিন পরপরই, তারা এমন সব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে আসে, আওয়ামী লীগকে ধসিয়ে দেয়াতেই যাদের আনন্দ। এটা যে উদ্দেশ্যমূলক, সেটা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হবার কথা নয়। আমি প্রায় প্রতি রাতেই এইসব টক শো দেখি। সেখানে অধিকাংশ সময় একজন বা দু’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. থাকেন, থাকেন একজন পিকিংপন্থী প্রাক্তন বিপ্লবী ও সাংবাদিক এবং বর্তমানে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের ঘোরতর সমর্থক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষক আর একটি ইংরেজি দৈনিকের দাঁত খিঁচোনো সম্পাদক। প্রতিদিন এরা গরু রচনার মতো আওয়ামী লীগের মুণ্ডুপাত করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিকভাবে আওয়ামী লীগকে টেনে এনে ধোলাই দিতে না পারলে এদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেতে পারে, এ কথা ভেবে যতটা সম্ভব আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। 
এদের মনে একটাই প্রতিজ্ঞা থাকে, যে কোনও উপায়ে আওয়ামী লীগকে ধূলিসাৎ করে দিতে হবে। আর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জবাই করার জন্য এরা সব সময় জিভে ধার দিয়েই রাখেন। এর মধ্যে একদিন রাতে কোনও একটি চ্যানেলে পদ্মাসেতুর দুর্নীতির ব্যাপারে আবুল হোসেনকে আক্রমণের এক পর্যায়ে তিনি যে আগেই থেকে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, তার উল্লেখ করে এতো অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কী করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলেন, সে ব্যাপারে ক্রূর একটি প্রশ্ন উত্থাপন করলেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই আবুল হোসেন দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন, সেক্ষেত্রে তিনি একথা ভুলে গেলেন কী করে সৈয়দ আবুল হোসেনের চেয়ে অনেক কম সময়ে তার জানের জান তরুণ এক নেতা দুর্নীতি করে, ভয় দেখিয়ে এবং ব্ল্যাকমেইল করে হাজার হাজার কোটি টাকাই শুধু কামানইনি, তা দেশ থেকে পাচার করে এখন কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বিদেশে আরাম-আয়েসে জীবনযাপন করছেন? তার কথা সেই ড. সাহেবের একবারও মনে হলো না কেন? কারণ দুর্নীতিবাজ হলেও তিনি যে ড. সাহেবের পেয়ারের লোক। বাংলাদেশে এক সময় একটি ছবি হয়েছিল ‘সাধু শয়তান’ নামে। এদের কথাবার্তা শুনলে ভঙ্গমি দেখলে আমার বারবার সেই ছবিটার কথাই শুধু মনে পড়ে।
তাই তারা তাদের পেয়ারের লোকদের সম্পর্কে কিছু বলবেন না। বলবেন শুধু বলীর পাঁঠাদের।! কারণ তাদের আসল উদ্দেশ্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা নয়, আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলার জন্য পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া। এরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে গলাগলি ধরে যখন তারা অন্যের দুর্নীতি খুঁজতে যান, তখন সেসব দেখে আমার খুব কৌতুক বোধ হয়। আবুল হোসেনকে এরা চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ বলেন। কেন আবুল হোসেন ছাড়া এদেশে আর চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ নেই? রাতের ঘুম হারাম করে যখন এইসব টকাররা বিভিন্ন চ্যানেলে আওয়ামী লীগের গিবত গাওয়ার জন্য যান এবং অনুষ্ঠান শেষে পকেটে দু’তিন হাজার টাকার চেক বা ক্যাশ টাকা নিয়ে বাড়িতে ফেরেন, তার সব টাকাই কি তুলসী পাতায় ধোয়া থাকে? ওর মধ্যে দুর্নীতির ছোঁয়া নেই? সেটা যখন পকেটে পুরে ঘরে ফেরেন, তখন দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আপনারাও যে গাঁটছড়া বাঁধেন, তখন কি আপনাদের কণ্ঠে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা মানায়?
এই যে এতদিন ধরে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে একেবারে বেদবাক্যজ্ঞানে অন্তরে ধারণ করে ক্রমাগত সৈয়দ আবুল হোসেন, আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তুলোধুনো করে যাচ্ছেন, আপনারাও জানেন, তার মধ্যে সত্যাসত্য কতটুকু। বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুতে দুর্নীতির আশংকা করেছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা প্রমাণ দিতে পারেনি, দুর্নীতিটা কোথায় হয়েছে। আমাদের এইসব জ্ঞানপাপীরা শুধু আওয়ামী সরকারের ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ব্যাপারে যে অভিযোগ তুলেছে, তা প্রকাশ করতে। আওয়ামী লীগ তো বলেছে এ ব্যাপারে কোনও দুর্নীতি হয়নি। যেখানে পদ্মাসেতুর ব্যাপারে কোন টাকাই ছাড় দেয়াই হয়নি, সেখানে দুর্নীতির প্রশ্নই তো অবান্তর। সৈয়দ আবুল হোসেনও একই কথা বলেছেন। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার তা প্রকাশ করবে না, সেক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকই তা প্রকাশ করছে না কেন? তাদের হাতে যদি দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ থাকে তা হলে তা প্রকাশ করতে তাদেরই বা বাধা কোথায়? যদি ধরে নেয়া যায় দুর্নীতির কাজটি মৌখিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে অর্থাৎ আবুল হোসেন পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে ঘুষ নেয়ার জন্য কোন বিশেষ প্রতিষ্ঠানের কাছে ঘুষ চেয়েছেন, তা হলে সেটাকে কেউ যুক্তিসঙ্গত বলে মানবেন? উপযুক্ত দালিলিক প্রমাণ ছাড়া শুধু মুখের কথার ওপর ভিত্তি করে যে কাউকে অভিযুক্ত করা যায় না, এটা বিশ্বব্যাংক বোঝে না, তা কোনও পাগলেও বিশ্বাস করবে?
আসলে বিশ্বব্যাংকই যে দুর্নীতিবাজ এটা আগেও প্রমাণিত হয়েছে, এখনও নতুন করে প্রমাণিত হচ্ছে। তাদের নিজেদের ইচ্ছেমতো অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বাংলাদেশকে চাপের মধ্যে রেখে আসলে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করাই যে তাদের লক্ষ্যের মধ্যে ছিল, তা এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের বিশেষ বিশেষ কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্যই যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর তারা এ ধরনের চাপ সৃষ্টি করে থাকে, একজন ব্যক্তি আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুতে তাদের অর্থায়ন বাতিল করার মধ্য দিয়ে তাদের হীনতা, দীনতা, ক্ষুদ্রতা এবং সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার নগ্ন বহিঃপ্রকাশই ঘটেছে, আবুল হোসেন সেখানে বলীর পাঁঠা মাত্র। যদি তা না হতো, তা হলে আবুল হোসেন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে, বিভিন্ন মিথ্যে সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়ে, পদ্মাসেতুর ব্যাপারে তার স্বচ্ছতার নানা প্রমাণ হাজির করে এবং শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে বিশ্বব্যাংকের মন সামান্য নরম করতে পারলেও সাম্রাজ্যবাদের দোসরদের মন কিছুতেই গলাতে পারেননি। তাই তাকে নিয়ে এখনও ব্যক্তি-আক্রমণ ঘটেই চলেছে।
আর বিএনপি তো তলোয়ারে ধার দিয়ে বসেই ছিল। বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মাসেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে, তখন আর যায় কোথায়? সবার আগে লাফিয়ে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের পক্ষে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা এবং সৈয়দ আবুল হোসেনকে একহাত নিয়েই তবে তাদের শান্তি। আর শেখ হাসিনা লন্ডনে গিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের পক্ষ নিয়ে যেই তাকে ‘দেশপ্রেমিক’ বলে আখ্যায়িত করলেন, তখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করলেও তাঁর দলেরই আর এক কেউকেটা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সঙ্গে সঙ্গে বলে বসলেন সৈয়দ আবুল হোসেন দেশপ্রেমিক নন, তিনি হলেন ‘বেহায়া’। খবরটি দেখে আমার চক্ষু কপালে উঠে গেল। ড. সাহেব নাকি একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, তার মুখে এরকম অরুচিকর, অভব্য এবং অশ্লীল শব্দের ব্যবহার দেখে আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটলো না। আমি ভাবলাম, তার ঐ অভব্য শব্দের পাল্টা শব্দ ব্যবহার করে সৈয়দ আবুল হোসেন যদি তাকে আক্রমণ করতেন, তাহলে তিনি সেটাকে কীভাবে নিতেন। আসলে এ জাতীয় অভব্য লোকেরা আমাদের রাজনীতির শীর্ষস্থানে অবস্থান করছেন বলেই বাংলাদেশের রাজনীতির আজ এই অবস্থা। আমি সৈয়দ আবুল হোসেনকে ধন্যবাদ দেই এ জন্যে যে, তিনি তথাকথিত ‘দুর্নীতিবাজ’ হওয়া সত্ত্বেও ড. মোশাররফের মতো অসভ্য হতে পারেননি।
আসলে এটা হয়তো অনেকের পক্ষেই বোঝা মুশকিল, সৈয়দ আবুল হোসেন কী করলে এদের অপপ্রচার এবং ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা থামবে। আমার ধারণা, এটা সহজে থামবে না। এদের জিভে যতদিন ধার থাকবে, ততদিন তারা সৈয়দ আবুল হোসেন, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে আক্রমণ করতেই থাকে। আর আক্রমণ করতে করতে যদি জিভের ধার কমে যায়, তা হলে আবার জিভে শান দিয়ে নতুন করে আক্রমণ করতে শুরু করবে। এদের লক্ষ্য, শেখ হাসিনার জীবন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার সময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকার ফলে বেঁচে যাওয়াতে এদের মধ্যে যে যন্ত্রণার বিষ জমা হয়ে ছিল, এখন তা উগ্ড়ে দেবার জন্য তারা অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। হাসিনা যে বলেছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাঁর জীবন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, সেটা এদের তৎপরতা দেখলেই বোঝা যায়। এরা এক একটা বিষধর সাপ। এরা হাসিনাকে রক্তাক্ত ছোবল দেয়ার জন্য বারবার চেষ্টা করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। তাদের লক্ষ্যই সেটা। গাফ্ফার ভাই যে বলেছেন ‘আক্রান্ত আবুল হোসেনÑটার্গেট শেখ হাসিনা’Ñএর চেয়ে চরম সত্যটি এর আগে এমন করে কেউ বলেননি। এ কথা বলে তিনি শেখ হাসিনাকে সাবধান হতে বলেছেন। সেই সূত্র ধরে আমি সৈয়দ আবুল হোসেনকেও সাবধান হতে বলি। আপনি যতই সৎ হোন, যতই শিক্ষানুরাগী হোন, মানুষের জন্য যতোই আপনার হাত উদার করুন, এরা আপনাকে ছাড়বে না। সে আপনি মন্ত্রীই থাকুন, আর মন্ত্রিত্বের বাইরেও থাকুন। শুধু প্রস্থত থাকুন, নেত্রী শেখ হাসিনাকে যেন ওরা ছোবল না দিতে পারে। ওদের সমালোচনায় ভড়কে যাবেন না। যদি আপনি মনে করেন, আপনি সৎ আছেন, তা হলে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান। আওয়ামী লীগের প্রতিটি নিবেদিতপ্রাণ কর্মী এবং দেশের জনসাধারণকে নিয়ে ওদের ষড়যন্ত্রকে রুখে দিন। শহরের অসন্তষ্ট এবং সুবিধাবাদী কিছু বুদ্ধিজীবীর কথায় হতচকিত হয়ে গেলে আখেরে ওদেরই লাভ হবে। সেটা আপনি হতে দেবেন কেন? 
আর বিশ্বব্যাংক? 
সেটা শুধু পাশ্চাত্যের ধনবাদী আগ্রাসী দেশগুলোর পিতৃসম্পত্তি নয়, এখানে আমাদেরও অংশীদারিত্ব আছে। অতএব ওদের রক্তচক্ষু দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। যে জাতি ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্ত ও দু’লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে মাত্র নয় মাসে নিজেদের দেশকে স্বাধীন করেছে, তারা বিশ্বব্যাংকের অন্যায় সিদ্ধান্তের কাছে নতজানু হবে কেন? পদ্মাসেতুর জন্য বরাদ্দ অর্থ বাতিল করে তারা যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মানুষ একদিন তার দাঁতভাঙা জবাব দেবে। অতএব সৈয়দ আবুল হোসেন, আপনাকে বলি, যদি আপনি সত্যি সত্যি স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করে থাকেন এবং কোনরকম দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকেন, তা হলে আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শুধু সময়ের জন্য একটু অপেক্ষা করুন।

অসীম সাহা : কবি ও সাংবাদিক

সৈয়দ আবুল হোসেন, মান্যবরেষু
ইমদাদুল হক মিলন
সৈয়দ আবুল হোসেনের পাঁচটি গ্রন্থ আমার হাতে পড়েছে। সুন্দর প্যাকেট, সুন্দর করে প্রকাশিত হওয়া বই। সবগুলোই রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী আলেখ্য। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট, গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, আওয়ামী লীগের নীতি ও কৌশল শিল্পায়ন ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশ, শেখ হাসিনা সংগ্রামী জননেত্রীর প্রতিকৃতি, স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সবগুলো বই আমার পড়া হয়নি। তবে ধীরে ধীরে প্রতিটি বই-ই আমি পড়তে চাই। দুটো বই আমি একটু ঘেঁটে ঘেঁটে দেখেছি, দুয়েকটি লেখা পড়েছি, আমার ভালো লেগেছে। সৈয়দ আবুল হোসেনের কোনও লেখা এর আগে আমি পড়িনি। যে লেখকের ভাষা খারাপ তাঁর লেখা আমি পড়তে পারি না। কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনের ভাষা সুন্দর, তরতর করে পড়ে যাওয়া যায়। বহু তথ্য এবং উদ্ধৃতি তাঁর রচনার মান বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজনীতির বাইরে তিনি কিছু লেখেননি। যেহেতু তিনি নিজে একজন রাজনীতিবিদ, সেহেতু রাজনীতি নিয়ে লেখাই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী রচনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অতি খটোমটো হয়ে থাকে, সামন্য পড়েই পাঠক ক্লান্ত হয়ে যান। সৈয়দ আবুল হোসেনের রচনায় এই ত্র“টি নেই। আমি যেটুকু পড়েছি, পড়ে তাঁর পাঁচটি বই পড়ার আগ্রহই আমার মধ্যে তৈরি হয়েছে। একজন পাঠককে এইভাবে আকৃষ্ট করবার ক্ষমতা যার আছে, তিনি যে ধরনের লেখাই লিখুন না কেন, তাঁকে অবশ্যই আমি ভালো লেখক বলবো। রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী লেখার ক্ষেত্রে সৈয়দ আবুল হোসেন অবশ্যই একজন অগ্রগণ্য লেখক। এই লেখককে আমি অভিনন্দন জানাই।
বাঙালি জাতির সবচাইতে বড় গৌরব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরে এই মাপের নেতা জন্মান না। আমাদের সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দেশে জন্মেছিলেন। এই মহান নেতাকে নিয়ে বহু গল্প কবিতা নাটক গান রচিত হয়েছে। বাঙালি জাতির শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে মিশে আছেন এই নেতা। আমরা জাতি হিসেবে অকৃতজ্ঞ বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে প্রাণ দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড বাঙালি জাতির ললাটে “পিতৃহত্যাকারী” শব্দটি খোদাই করে দিয়েছে। বাঙালি জাতি যতদিন টিকে থাকবে, এই জঘন্য অপরাধ তাদের বয়ে বেড়াতে হবে। চে গুয়েভারাকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি কবিতা লিখেছিলেন, “চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।” বঙ্গবন্ধুর জন্য চিরকাল বাঙালি জাতি এরকম করে বলবে, “বঙ্গবন্ধু, তোমার মৃত্যু আমাদেরকে অপরাধী করে দেয়।” অনন্তকাল ধরে আত্মগ্লানিতে জ্বলবো আমরা।
এই মহান নেতাকে নিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন লিখেছেন, “স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা এ যাবৎ রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে সৈয়দ আবুল হোসেনের এই গ্রন্থ এক বিশিষ্ট সংযোজন।
আমি শুনেছি সৈয়দ আবুল হোসেন বহুগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক হিসেবে তিনি শ্রদ্ধেয়। মাদারীপুরের এক বনেদী মুসলমান পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা অতিশয় ধর্মপ্রাণ মানুষ। এলাকার মানুষের শ্রদ্ধারজন। কৃতি ছাত্র ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর মনোনিবেশ করেন ব্যবসায়। ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন ‘সাকো ইন্টারন্যাশনাল’ নামে বিশাল এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এই সব প্রধান পরিচয়ের পাশাপাশি তার অন্যরকম কিছু পরিচয়ও আছে। একজন লেখক হিসেবে আমার কাছে সেই পরিচয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ্। তিনি ধর্মপ্রাণ, তিনি মানুষ ভালোবাসেন। জাতির দুর্যোগে তো বটেই অন্যান্য নানা প্রকার দুর্যোগের সময় বিপন্ন মানুষের পাশে তিনি তার সবটুকু সামর্থ্য নিয়ে দাঁড়ান। মানুষের কথা ভাবেন এবং তাদের পাশে দাঁড়ান, সেই মানুষকেই আমি মহান মানুষ মনে করি। সততা, নির্লোভ, অকারণ উচ্চাকাক্সক্ষা ইত্যাদি সৈয়দ আবুল হোসেনকে কখনও ম্লান করতে পারেনি। এটাই তার জীবনের মূল সার্থকতা। বাংলাদেশের জন্য যে রকম মানুষের খুব প্রয়োজন, সৈয়দ আবুল হোসেন তেমন একজন মানুষ। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তার সততা, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ এবং দেশ ও জাতির কল্যাণের কাজে নিয়োজিত থাকবেন, এই আমার প্রার্থনা।

ইমদাদুল হক মিলন : কথাসাহিত্যিক

পদ্মা সেতু প্রকল্প এবং আমাদের করণীয়
আইনুন নিশাত
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে অনেক জল ঘোলা হওয়ার পর আমার কথা একটাই। সরকার যেভাবে নিজস্ব উৎস থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলছে, সেটা সম্ভব হলে এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমি গর্বই বোধ করব। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে পারেনÑ এমন বিশেষজ্ঞের অভাব নেই এ দেশে। কিন্তু আমাদের ঘাটতি রয়েছে অর্থে ও প্রযুক্তিতে। প্রযুক্তির বিষয়টি ঠিকাদারের মাথাব্যথা। সরকারের উচিত হবে সম্পূর্ণ অর্থ জোগাড়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া; অর্থের সংস্থান হলেই কেবল নির্মাণ কাজের ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া।
পদ্মা সেতু নিয়ে সমকালের পাতায় কয়েকদিন আগে অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর একটি মূল্যবান নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। জামিল স্যার আমার ক্লাসরুম শিক্ষক শুধু নন; তার সঙ্গে পরে বহু প্রকল্পে কাজ করেছি এবং করছি। জটিল কারিগরি জিনিস সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে তার জুড়ি পাওয়া দায়। তদুপরি স্যারের মনে রাখার ক্ষমতা এবং বিভিন্ন ঘটনার পরম্পরা বজায় রেখে বর্ণনা করার দক্ষতা অপরিসীম। বলাবাহুল্য, স্যারের ওই লেখাতেও তার ছাপ স্পষ্ট ছিল।
পদ্মা সেতু প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজের ঠিকাদার ও পরামর্শক নির্বাচন প্রক্রিয়া কীভাবে এগোচ্ছিল, অধ্যাপক চৌধুরী তার লেখায় তা গুছিয়ে বলেছেন। ওই নিবন্ধের আলোকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে এসএনসি লাভালিনকে সুপারভিশন কনসালটেন্ট হিসেবে নিযুক্তিতে বিশ্বব্যাংকের কোনো আপত্তি ছিল না। বরং উল্টোটাই ঘটেছিল বলা চলে। বাংলাদেশি মূল্যায়নকারীদের মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক লিখিতভাবে অনুমোদন করেছে এবং সেই প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের একজন সাবেক কর্মকর্তাও যুক্ত ছিলেন।
আমি আজকে কলম ধরেছি এসব বিষয়ে আরও কিছু কথা বলার জন্য। বলে রাখা ভালো, বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনের সময় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে আমিও জড়িত ছিলাম। একইভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পেরও আমরা কাজ করেছি। যমুনা সেতু প্রকল্পের অভিজ্ঞতার আলোকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক বা ঠিকাদার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোথায় কোথায় বিশেষ নজর দিতে হবে, সে সম্পর্কে আমাদের পূর্বধারণা ও অভিজ্ঞতা কাজে এসেছে।
অনেকেই হয়ত জানেন, পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনের জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) বা আইডিবি (ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক)Ñ সবারই রয়েছে পৃথক পৃথক নীতিমালা। অর্থাৎ কোনো প্রকল্পে যারা অর্থায়ন করবেন তারাই নির্ধারণ করে দেন যে কোন কোন দেশের পরামর্শক বা ঠিকাদাররা দরপত্র জমা দিতে পারবেন। এরপর আসে দরপত্রে কী কী বিষয়ে নজর দেওয়া হবে এবং কী পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হবে, তার নিয়মাবলি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেই নিয়মাবলি প্রণয়নের দায়িত্বে ছিল ডিজাইন কনসালটেন্ট বা নকশা প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রণীত নিয়ম ও শর্তাবলি প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা অনুমোদন করেন এবং এরপর তা দাতা সংস্থার বিশেষজ্ঞের দ্বারা পর্যালোচিত এবং অনুমোদিত হয়। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি) অনুমোদন পাওয়ার পরই দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
দরপত্রের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে প্রাক-যোগ্যতার ভিত্তিতে কারা দরপত্র দিতে পারবেন, তা নির্ধারণ করা। পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ ও জটিল প্রকল্পে কেবল তাদেরই দরপত্র দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, যাদের এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। অর্থাৎ আগ্রহী ঠিকাদার অথবা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের অভিজ্ঞতা, আর্থিক সচ্ছলতা, দক্ষ কর্মকর্তার তালিকা ইত্যাদি জমা দেন। সেসবের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ক্ষেত্রে বড় তিনটি চুক্তি বা কন্ট্রাক্ট করা প্রয়োজন ছিল। প্রথম চুক্তি হচ্ছে মূল সেতুটি নির্মাণ বিষয়ে। এ কাজে ঠিকাদারদের প্রাক-যোগ্যতা নিরূপণের পর নির্বাচিতদের তালিকা বিশ্বব্যাংকের দফতরে রয়েছে। তারা অনুমতি দিলে তবেই মূল দরপত্র আহ্বান করা হতো। তার মানে, মূল দরপত্র এখনও আহ্বান করা হয়নি। কাজেই ঠিকাদার নির্বাচনের বিষয়টি অনেক পরের বিষয়।
দ্বিতীয় চুক্তি বা কন্ট্রাক্ট হচ্ছে নদীশাসন সংক্রান্ত। মূল সেতুর মতো এ কাজটিও অত্যন্ত জটিল এবং এতে দক্ষ ঠিকাদার প্রয়োজন। এ কাজটিরও কেবল প্রাক-দক্ষতা যাচাই কাজ শেষ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের দফতরে এই কাজের জন্যও প্রাক-দক্ষতা যাচাইয়ের পর মূল্যায়িত ঠিকাদারদের তালিকা জমা দেওয়া আছে। অর্থাৎ এ কাজেও এখন পর্যন্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।
তৃতীয় কন্ট্রাক্টটি হচ্ছে অ্যাপ্রোচ রোড। অর্থাৎ সেতু সংযোগকারী রাস্তার নির্মাণ বিষয়ে। ওই কাজটির অর্থায়ন করবে আইডিবি। কাজেই তাদের নিয়ম মেনে প্রাক-যোগ্যতার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ঠিকাদার নির্মাণের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। আইডিবির অনুমোদনের জন্য কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। এ দরপত্র মূল্যায়নে বিশেষ জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
এবার আসি কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্টের বিষয়ে। এ কনসালটেন্টের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতুটি নির্মিত হবে আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি মেনে। সংক্ষেপে বলা হয়েছে (ঋওউওঈ) ‘ফিডিক’ মেনে। এর পুরো নাম হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্স। মূল নামটি ফরাসি। এরা বিশ্বজুড়ে যে কোনো নির্মাণ কাজে শর্তাবলি ও কন্ট্রাক্ট বাস্তবায়নের পদ্ধতি ঠিক করে দেয়। এদের নিয়মের বাইরে কোনো আন্তর্জাতিক কন্ট্রাক্ট পরিচালিত হতে পারে না।
ফিডিকের নিয়ম অনুযায়ী কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্টের (সিএসসি) তত্ত্বাবধানে কন্ট্রাক্ট সম্পর্কিত সব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ কারণে সিএসসি নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কাজ শুরু হলে এদের সিদ্ধান্ত অর্থায়নকারী সংস্থাগুলো প্রায়ই মেনে নেয় এবং প্রকল্পের মূল মালিক, অর্থাৎ সরকারও মানতে বাধ্য হয়। ঠিকাদারের দাবি যদি সিএসসি অনুমোদন করে, কিন্তু সরকার পক্ষ যদি সেই দাবিকে অযৌক্তিক মনে করে তাহলে সিএসসির সিদ্ধান্তই বলবৎ হবে। পরে সরকার এ বিষয়ে মামলা করতে পারে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সিএসসি হিসেবে নিযুক্তির জন্য পাঁচটি কোম্পানি তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছিল। ইতিপূর্বে নির্ধারিত নিয়মাবলি মেনে দরপত্রগুলো মূল্যায়িত হয়। এ মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক মেনে নিয়েছিল। পরে নির্বাচিত কনসালন্টিং ফার্মের কোনো কাজে বিশ্বব্যাংক ক্ষুব্ধ হয়েছে এবং তাদের কালো তালিকাভুক্ত করেছে। মোদ্দাকথা, আমি বলতে চাচ্ছি, নির্বাচন পদ্ধতি বা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কোনো আপত্তি ছিল না। যে কারণে এখন জটিলতা দেখা দিয়েছে, তা হলো পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা।
এবার আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই সেটি হচ্ছে, যে কোনো প্রকল্পে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, অংশীদারিত্ব বজায় রাখার প্রচণ্ড তাগিদ আছে বিশ্বজুড়ে। কোনো একটি দেশের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ বা কোনো আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারক প্রতিষ্ঠানের অর্থ সবার মধ্যে সব পদক্ষেপে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অর্জনের কথা বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে যোগ হচ্ছে যে কোনো কর্মকাণ্ডে প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ এবং সব স্টেকহোল্ডার বা অংশীদারের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ।
বিশ্বের বিভিন্ন অঙ্গনে কথায় কথায় সুশাসন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও আইনের শাসনের কথা এখন উচ্চারিত হয়। সেই আলোকে, সবাই এখন মানে, যে কোনো দাতা দেশ বা দাতা সংস্থা তাদের সব স্টেকহোল্ডারের কাছে এসব বিষয়ে জবাবদিহি করতে বাধ্য। বিশ্বব্যাংক এবং এডিবিতে সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধিরা নিয়মিতভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে। কাজেই কোনো কারণে কেউ যদি সন্দেহ পোষণ করে যে, এ প্রকল্পে দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে বিশ্বব্যাংক বিশেষ নজরদারি করতে বাধ্য। বিশ্বব্যাংকের অফিসে পদ্মা সেতুসহ ৫-৬টি বড় প্রকল্পের জন্য একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। তার কাজই হচ্ছে এ প্রকল্পগুলো বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করা, যাতে করে কোনো ধরনের অভিযোগ না আসে। আমি যতদূর জানি, পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের বিষয়টি তারা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং সরকারের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। আমার জানা মতে, বাংলাদেশ সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও তার কাউন্টারপার্ট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের বিশেষ তদারকির কথা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তার জানা ছিল না। তারপরও দুর্ঘটনা ঘটে গেল।
খবরের কাগজে পড়ছি, সরকার বিকল্প উৎস থেকে অর্থ পাওয়ার চেষ্টা করছে। সরকারের এমন প্রচেষ্টা অস্বাভাবিক নয়। কারণ দেশের লোকজন সেতুটি দ্রুত নির্মিত হওয়া দেখতে চায়। গত নির্বাচনের অঙ্গীকার এবং সামনের নির্বাচনে সাফল্য তুলে ধরার কথাও ভাবতে হচ্ছে সরকারকে। তার ফলেই বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ জোগাড় করার কথা বলা হচ্ছে।
সত্যি বলতে কি, বিভিন্ন মহলের এ তৎপরতা দেখে আমার ভালো লাগছে। তবে মনে রাখতে হবে, টাকায় কুলাবে না। লাগবে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার, ইউরো, ইয়েন, পাউন্ড ইত্যাদি। পুরো অর্থের বন্দোবস্ত করে তবেই মাঠে নামতে হবে। দেশে যেভাবে নির্মাণ কাজ হয়, আমরা দেখি, অর্থের অভাবে ঠিকাদারদের অনেক সময় বসে থাকতে হয়। এটি কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক ঠিকাদারদের সঙ্গে চলবে না। ফিডিক আইন অনুযায়ী ঠিকাদার তার রানিং বিল জমা দিলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তা পরিশোধ করতে হবে। কোনো কারণে ঠিকাদারকে কাজ বন্ধ করতে বলা যাবে না। কারণ ঠিকাদার তার যন্ত্রপাতি, লোক-লস্কর মোবিলাইজ করেছেন। সরকারের কারণে কাজের গতি শ্লথ হলে বিপুল পরিমাণ অর্থদণ্ড দিতে হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে অনেক জল ঘোলা হওয়ার পর আমার কথা একটাই। সরকার যেভাবে নিজস্ব উৎস থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলছে, সেটা সম্ভব হলে এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমি গর্বই বোধ করব। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে পারেনÑ এমন বিশেষজ্ঞের অভাব নেই এ দেশে। কিন্তু আমাদের ঘাটতি রয়েছে অর্থে ও প্রযুক্তিতে। প্রযুক্তির বিষয়টি ঠিকাদারের মাথাব্যথা। সরকারের উচিত হবে সম্পূর্ণ অর্থ জোগাড়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া; অর্থের সংস্থান হলেই কেবল নির্মাণ কাজের ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া।

ড. আইনুন নিশাত : সাবেক অধ্যাপক বুয়েট। পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও পানি বিজ্ঞানী, উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।

সৈয়দ আবুল হোসেন গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার
নির্মল চক্রবর্তী
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের আনীত তথাকথিত দুর্নীতি নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। সব লেখা মূলত সৈয়দ আবুল হোসেনকে ঘিরে। বছরাধিক কাল যেন পত্রিকায় প্রকাশের জন্য বাংলাদেশে আর কোন বিষয় ছিল না। অধিকাংশ প্রতিবেদনে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে মর্মে বিশ্বব্যাংকের অযৌক্তিক দাবিকে প্রমাণের চেষ্টা করে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়েছে। এ সকল প্রতিবেদনে আবেগ ছিল যুক্তি ছিল না, রসালো বিবরণ ছিল কিন্তু বিশেষায়িত তথ্য ছিল না। যে সকল লেখায় তাঁর বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের কথিত দুর্নীতির শঙ্কাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে সে সকল প্রতিবেদনের লেখকগণ পদ্মা সেতু প্রকল্পের মত জটিল ও উচ্চ কারিগরি অবকাঠামোর পর্যায়ক্রমিক বিষয়টি বিবেচনায় আনেননি। হয়ত অমন ঋদ্ধতাও তাদের ছিল না। তাঁরা শুধু দুর্নীতির অভিযোগটি সত্য প্রমাণের ব্যর্থ প্রয়াসের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে, পক্ষান্তরে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করে তোলার চেষ্টা করেছেন। রাজনীতিক বক্তৃতার মত প্রতিপক্ষকে মনগড়া কাহিনী দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন। ঋণচুক্তি বাতিল হওয়ায় দেশের ক্ষতির সব দোষ তার উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। অথচ সৈয়দ আবুল হোসেন দুর্নীতি করেছেন কিনা কিংবা তার পক্ষে কথিত দুর্নীতি করা আদৌ সম্ভব ছিল কিনা তা অধিকাংশ প্রতিবেদক এড়িয়ে গিয়েছেন। কোন্ পরিস্থিতিতে কখন বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির শঙ্কা প্রকাশ করেছে, যে সময়ে দুর্নীতর শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে সেটি আদৌ যৌক্তিক ছিল কিনা তাও বিবেচনা করা হয়নি। বিষয়ের গভীরে না গিয়ে ‘কাক কান নিয়ে গিয়েছে’ গল্পের মত সবাই কাক এর পেছনে ছুটেছে। গালের পাশে কানটি আছে কিনা কেউ হাত দিয়ে দেখেননি, দেখার চেষ্টা করেননি। সব লেখা তার বিপক্ষে গিয়েছে তা নয়। পদ্মা সেতুর মত বৃহৎ ও জটিল বিষয়ে জ্ঞানসমৃদ্ধ আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞগণের লেখায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতি যেমন হাস্যকর তেমনি অযৌক্তিক। বিশেষজ্ঞ লেখকগণ পদ্মা সেতু প্রকল্পের সবকটি পর্যায় বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, দুর্নীতি হবার কোন অবকাশ এখানে ছিল না। এরূপ বিশ্লেষণমূলক লেখা যারা লিখেছেন তাদের মধ্যে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. আইনুন নিশাত, মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার, পিএসসি (অব.), রাহাত খান, হায়দার আকবর খান রনো, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মিলু শামস এবং আবদুল গাফফার চৌধুরী সহ আরও অনেকের নাম উল্লেখ করা যায়। 
সাংবাদিক হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। পেশাগত কারণে তাঁকে নিয়ে বি¯তৃত ঘটনাবলী গভীর মনযোগের সাথে অবলোকন করেছি। সৈয়দ আবুল হোসেনের আকর্ষণীয় ব্যক্তি চরিত্র ও আদর্শের সাথে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখালেখির কোন মিল খুজে পাই না। শুধু আমি নই; যারা সৈয়দ আবুল হোসেনকে জানেন সবার একই কথা। তাহলে এ সব কেন? তা ভালোভাবে জানার জন্য প্রকাশিত ঘটনার সাথে রটনা, বাস্তবতার সাথে কল্পনা এবং কার্যকরণের সাথে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদ ও প্রতিবেদনগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি। একজন সাংবাদিক হিসেবে কাছ থেকে, দূর থেকে সৈয়দ আবুল হোসেন এবং আনুপূর্বিক ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করে আমি নিশ্চিত যে, সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে পদ্মাসেতু প্রকল্প ও অন্যান্য বিষয়ে প্রকাশিত অভিযোগ সারবত্তাহীন এবং গভীর ষড়যন্ত্রের নিকৃষ্ট উদাহরণ। 
পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনের জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি প্রত্যেকের পৃথক নীতিমালা রয়েছে। যে সংস্থা অর্থায়ন করে সে সংস্থা পরামর্শক বা ঠিকাদারগণের দরপত্র সংক্রান্ত যোগ্যতা নির্ধারণ করে থাকে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ক্ষেত্রেও এ সকল নিয়মাবলী অনুসৃত হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের বিশেষ কতগুলো পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায় হচ্ছে প্রাক-যোগ্যতা। এ পর্যায়ে প্রাক-যোগ্যতার ভিত্তিতে কোন প্রতিষ্ঠান দরপত্র প্রদান করার যোগ্যতা সম্পন্ন এবং দরপত্র প্রদান করতে হলে কী কী যোগ্যতা আবশ্যক তা নির্ধারণ করা হয়। পদ্মা সেতুর ন্যায় উচ্চ-কারিগরী ও জটিল অবকাঠামোগত প্রকল্পে শুধু সে সকল প্রতিষ্ঠানকে দরপত্র জমা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়, যাদের বর্ণিত কার্য সম্পাদনের পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রের সাথে তাদের অভিজ্ঞতা, আর্থিক যোগ্যতা, দক্ষতা, কর্মকর্তাগণের তালিকাও জমা দিতে হয়। প্রতিটি বিষয় দাতা সংস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তদারকি এবং নির্দেশনায় উপস্থাপিত দলিলাদির ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনটি অত্যাবশ্যক বৃহৎ ও জটিল চুক্তির প্রয়োজন ছিল। তম্মধ্যে প্রথম ও প্রধান চুক্তিটি ছিল মূল সেতু নির্মাণ কার্যক্রম। এ কাজে প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণের পর যোগ্য নির্বাচিত ঠিকাদারগণের তালিকা বিশ্বব্যাংকের দপ্তরে জমা দেয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক অনুমতি প্রদান করলে মূল দরপত্র আহ্বান করা হতো। কিন্তু বিশ্বব্যাংক অনুমোদন না দেয়ায় মূল দরপত্র আহ্বান করা যায়নি। ঠিকাদার নির্বাচনের বিষয়টি ছিল আরও অনেক ধাপ পরের বিষয়। দ্বিতীয় চুক্তিটি ছিল নদীশাসন। এখানেও দক্ষ ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণ প্রয়োজন ছিল। এটার কেবল প্রাক-যোগ্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। এ কাজের প্রাক-দাতা যাচাইয়ের পর ঠিকাদারগণের তালিকা বিশ্বব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে। তা বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে রক্ষিত আছে। বিশ্বব্যাংকের অনুমোদন না পাওয়ায় সেটিরও দরপত্র আহ্বান করা সম্ভব হয়নি। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাংলাদেশ সরকার অতি অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করে অনুমোদনের জন্য পাঠালেও বিশ্বব্যাংক অনুমোদন না করে দীর্ঘদিন ফেলে রাখে। এ দীর্ঘসূত্রিতায় কী বিশ্বব্যাংকের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে! তৃতীয় হচ্ছে সংযোগ সড়ক নির্মাণ। এ কাজের অর্থযোগান ও দায়িত্বে ছিল আইডিবি। আইডিবির বিধিবিধান অনুসারোক-যোগ্যতার কাজ সম্পন্ন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ঠিকাদার নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন করার পর আইডিবির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। এটিরও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। 
২০০৭ সালে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের জন্য এডিবি বাংলাদেশকে কারিগরি সহায়তা দেয়ার উদ্যোগ নেয়। সরকার আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পরামর্শকদের কাছ থেকে প্রস্তাব আহবান করে। ছয়টি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দাখিল করে। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় অবস্থিত সদর দফতরে এডিবি নিজেদের বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রস্তাবগ্রলো মূল্যায়ন করে। একই সাথে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি এডিবির নিদের্শনা মোতাবেক প্রস্তাবগুলোর মূল্যায়ন চালিয়ে যায়। বাংলাদেশের মূল্যায়নে এডিবির মূল্যায়ন সমীক্ষায় কিছু ভুল ধরা পড়ে। এডিবি ভুলগুলো সংশোধনপূর্বক তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে। তদভিত্তিতে নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মনসেল, কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান নর্থ-ওয়েস্ট হাইড্রোলিক ও অস্ট্রেলিয়ান প্রতিষ্ঠান স্মারক পদ্মা সেতুর পরামর্শক নির্বাচিত হয়। সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রী হবার অব্যবািহত পর এডিবির মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদন করে চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের প্রস্তুতি কাজে ১০ বছর লেগেছে কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনের বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনার কারণে পদ্মা সেতুর প্রস্তুতি ২ বছরে শেষ করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি একটি বিরল ঘটনা। 
পদ্মা সেতু নির্মাণ একটি জটিল, বৃহৎ ও উচ্চ কারিগরি প্রকল্প। ডিজাইন চূড়ান্ত করার পূর্বে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহসহ অসংখ্য পরস্পর অবিচ্ছেদ্য জটিল উপাদানের সমন্বয়ে নির্ভুল ডিজাইন প্রণয়ন ছিল অত্যাবশ্যক। এ সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০১০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সেতুর ডিজাইন প্রণয়ন শুরু করা হয়। সময় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে একই সাথে প্রকল্পের অত্যাবশ্যক প্যাকেজগুলোর পরামর্শকদের প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণের প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা প্যাকেজসমূহের প্রাক-যোগ্যতার শর্তাবলী নির্ধারণের প্রতিটি পর্যায়ে উপস্থিত ছিলেন। সবার সাথে আলোচনাপূর্বক ঐকমত্যের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতার স্বার্থে ২০০৯ সালের মধ্যভাগে প্রকল্পের কারিগরি বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদানের জন্য দশ সদস্য বিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করা হয়। প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত বিশেষজ্ঞগণের মধ্যে তিনজন জাপানি, একজন নরওয়েজিয়ান বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এদিকে ডিজাইন পরামর্শক সংস্থাসমূহ প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল কিছু সুপারিশ প্রদান করে। সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে পদ্মা সেতুর ডিজাইন মোটামুটি চুড়ান্ত করা হয়। উল্লেখ্য, প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণের জন্য সরকার আরও একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিল। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা সর্বসম্মতক্রমে অনুমোদন করে।
বিশ্বব্যাংক প্রথমে বলেছিল, সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিলে সেতুর কাজ চালিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু তাঁকে সরানো হলেও বিশ্বব্যাংক স্থগিত কার্যক্রম শুরু করেনি। মন্ত্রণালয় পরিবর্তনের পর তারা জানায়, কানাডায় এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সেতুর কাজ শুরু হবে না। পদ্মা সেতু প্রকল্পে কর্মরত বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিমত ‘এ পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে তার স্বচ্ছতা সম্পর্কে অভিযোগ নেই।’ এডিবি ও জাইকাসহ অন্য সহযোগী সংস্থা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুঃখ প্রকাশ করে। ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে প্রেসনোট জারি করে। এর ভাষা ও অভিযোগ ছিল বাংলাদেশের জন্য যেমন বিব্রতকর তেমনি অপমানজনক। কোনরূপ তথ্য প্রমাণ ছাড়া বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তা বিরল। সৈয়দ আবুল হোসেন ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি যোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। দায়িত্ব গ্রহণের অল্প কিছুদিন পর থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সাথে আলোচনা শুরু করেন। বিশ্ব ব্যাংক বিভিন্ন অজুহাতে বিলম্ব করছিল। সৈয়দ আবুল হোসেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্র“ত সময়ের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি বিশ্বব্যাংককে দ্রুত অর্থ ছাড়ের জন্য তাগিদ দিয়ে যাচ্ছিলেন। মূলত: এটাই হয়েছে তার কাল এবং যাবতীয় সমালোচনার উৎস। 
সৈয়দ আবুল হোসেন ৫ ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন। এ-সময় পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ভুমি অধিগ্রহণ, সাইট প্রিপারেশন, স্টক ইয়ার্ড নির্মাণ, তিগ্রস্তদের পূর্ণবাসনসহ প্রস্তুতিমূলক সকল কাজ শেষ করা হয়েছে। মূল সেতু, নদী শাসন এবং সংযোগ সড়কের কাজের জন্য প্রাক-যোগ্য দরদাতাদের নির্বাচন শেষ করা হয়েছে। প্রকল্পের নির্মাণ তদারকি পরামর্শক (ঈড়হংঃৎঁপঃরড়হ ঝঁঢ়বৎারংরড়হ ঈড়হংঁষঃধহঃ) নিয়োগের লক্ষ্যে কারিগরি মূল্যায়নসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ম-কানুন, ক্রয়নীতি, বিশ্ব ব্যাংক ও দাতা সংস্থাদের গাইডলাইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ ব্যতীত প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংকের সম্মতির পর পরবর্তী কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে। এ সকল কাজ চলাকালীন দাতা সংস্থার কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। দুর্নীতির কোন নিশানা তারা পাননি। হঠাৎ করে দুর্নীতির তথ্য পেয়ে গেলেন, তাও আবার নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগে, যা কখনও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগের জন্য বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত নিয়মাবলী অনুসরণ করে প্রথমে আবেদনকারী পরামর্শকদের সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। এরপর তা অনুমোদনের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়। বিশ্ব ব্যাংক অনুমোদন করলে সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে দরপত্র আহবান করা হয়। দরপত্রগুলো ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একদল বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে। কমিটিতে ড. আইনুন নিশাতও ছিলেন। বিশ্ব ব্যাংকের মনোনীত সিনিয়র কনসালটেন্ট ড. দাউদও কমিটির সদস্য ছিলেন। জামিলুর রেজা চৌধুরী ও আইনুন নিশাত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিশেষজ্ঞ। বিশ্বব্যাংকের প্রত্যক্ষ তদরকিও ছিল। সৈয়দ আবুল হোসেন বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন কমিটির কোন সদস্য ছিলেন না। সুতরাং তারপক্ষে কোন পর্যায়ে কোনভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পকে প্রভাবিত করার সুযোগ ছিল না। তাহলে কেন এসএনসি লাভালিন তাঁকে প্রভাবিত করতে আসবেন? তারা এমন কারও কাছে যেতেন, যার প্রভাবিত করার সুযোগ ছিল। 
এসএনসি লাভালিনকে নির্মাণ তদারকি পরামর্শক হিসেবে নির্বাচনের জন্য নাকি দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। অথচ যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর তারা কোন অবস্থাতে পদ্মা সেতুর নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগ কমিটিকে প্রভাবিত করার যোগ্যতা রাখেন না। পদ্মা সেতু প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজের ঠিকাদার ও পরামর্শক নির্বাচন প্রক্রিয়া যেভাবে এগিয়ে নেয়া হয়েছে তা পর্যালোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। এসএনসি লাভালিনকে নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নির্বাচন ও নিয়োগে বিশ্বব্যাংকের কোনো আপত্তি ছিল না। আপত্তি থাকলে লাভালিন বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেত না। কমিটির মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক লিখিতভাবে অনুমোদন করেছে। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ মূল্যায়ন সম্পন্ন হয়েছে তাতে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিও ছিলেন। সুতরাং এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, বিশ্বব্যাংক নিজেও এসএনসি লাভালিনের পক্ষে ছিল। তাহলে পরে কেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হল? এর সাথে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, উন্নয়নশীল দেশের প্রতি পুজিবাদী বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত আর্থিক সংস্থার ভূমিকা, প্রসাদ ষড়যন্ত্র প্রভৃতি ছাড়াও আরও অনেক বিষয় জড়িত। নইলে যে কারণ দেখিয়ে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করেছে তার নজির বিশ্বে আর নেই। সুতরাং পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির আশঙ্কা যেমন বৈপরিত্যমূলক তেমন সাংঘর্ষিক। এটি ছিল ঋণচুক্তি বাতিলের নিছক একটি অজুহাত মাত্র। 
এস.এন.সি-লাভালিন এর প্রতিনিধির সাথে বৈঠকের সূত্র ধরে বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র এবং তার সাথে সৈয়দ আবুল হোসেনের সম্পৃক্ততা উত্থাপন করেছেন। এটি যেমন অযৌক্তিক তেমনি হাস্যকর। মূল্যায়ন কমিটির সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার কোন এখতিয়ার সৈয়দ আবুল হোসেনের ছিল না। মূল্যায়নের প্রতিটি স্তরে বিশ্ব ব্যাংকের সম্মতির পর পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। পরামর্শক নির্বাচনে প্রচলিত বিধিবিধান ও বিশ্ব ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘নিরপেক্ষবিশেষ মূল্যায়ন কমিটি’ দরপত্র মূল্যায়নপূর্বক কার্যাদেশ প্রদানের সুপারিশ করেছে। মূল্যায়ন কমিটির কার্যক্রমের প্রতিটি স্তরে বিশ্ব ব্যাংক প্রত্যক্ষভাবে স¤পৃক্ত ছিল। ফলে পরামর্শক নিয়োগে কোন অনিয়ম, ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতির সুযোগ সৈয়দ আবুল হোসেনের ছিল না। মন্ত্রীরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে আইনের মধ্যে থেকে জনস্বার্থে নানাবিধ কাজ করে থাকেন। দেশের জনসাধারণ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, বিদেশি ডেলিগেট ও কুটনীতিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন মন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে সৈয়দ আবুল হেসেন মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন জনের সাথে বিভিন্ন সময়ে সরল বিশ্বাসে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। এটি ছিল তাঁর দায়িত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অধিকন্তু তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। বৈদেশিক বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষায় এ ধরণের আলোচনা শিষ্টাচার হিসেবে গণ্য। ফলে এ রকম শিষ্টাচার পালনের নিমিত্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনার জন্য সৈয়দ আবুল হোসেনকে দায়ি করা কোন অবস্থাতে যুক্তিযুক্ত নয়। 
সাবেক প্রতিমন্ত্রী জনাব আবুল হাসান চৌধুরীর অনুরোধে এবং তাঁর উপস্থিতিতে সরকারি অফিসে এস.এন.সি-লাভালিনের প্রতিনিধির সাথে সৈয়দ আবুল হোসেনের সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। এস.এন.সি-লাভালিনের প্রতিনিধি ছাড়াও বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার প্রাক্তন হাইকমিশনারও দুইবার এস.এন.সি-লাভালিনের বিষয়ে মন্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন। প্রাক্তন ব্রিটিশ হাই কমিশনার এবং জাপানের রাষ্ট্রদূতও সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। সৌজন্য সাক্ষাতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে মন্ত্রী হিসেবে তিনি সকলকেই টেন্ডারের শর্ত, যোগ্যতা, মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ এবং বিশ্ব ব্যাংকের গাইড লাইন অনুযায়ী যথারীতি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হবে মর্মে আশ্বস্ত করেছেন। 
বিশ্ব ব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেল বলেছে, দরদাতা নির্বাচন ও কার্যাদেশ প্রদানে মন্ত্রী চুড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। প্যানেলের এ মন্তব্য সম্পূর্ণ ভুল। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে মন্ত্রী চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ নয়। ক্রয়নীতি অনুযায়ী যে কোন প্রকল্পের উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তি মূল্য সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তি মূল্য সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা হলে, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী অনুমোদন দিতে পারেন। চুক্তি মূল্য এর অধিক হলে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত্র মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপন করতে হয়। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের আনুমানিক চুক্তি মূল্য ৩০০ কোটি টাকার অধিক। তাই এ চুক্তি অনুমোদনে সৈয়দ আবুল হোসেন চূড়ান্ত অনুমোদনদাতা ছিলেন না। সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদই ছিল চুড়ান্ত অনুমোদনকারী। কাজে “মন্ত্রী চুড়ান্ত অনুমোদনকারী”- উল্লেখ করে কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সাথে সৈয়দ আবুল হোসেনের জড়িত থাকার ইঙ্গিত যথার্থ নয়। তাদের এ মন্তব্যের মধ্যে কাউকে দোষী করার ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ‘পরামর্শক নিয়োগ বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন কমিটি’র মূল্যায়ন ও সুপারিশ বিশ্ব ব্যাংকের অনুমোদনের পর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপন করার কথা। মন্ত্রিসভা কমিটি উপস্থাপিত সুপারিশ পর্যবেক্ষণপূর্বক চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদানের অধিকারী। বিধি অনুযায়ী মন্ত্রী মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন বা পুনঃর্মূল্যায়ন করতে পারেন না। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করেও দরপত্র পূনঃর্মূল্যায়ন করার এখতিয়ার মন্ত্রীর নেই। অতএব, বিশ্ব ব্যাংক প্যানেলের ধারণা অনুযায়ী মন্ত্রী হিসেবে কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে দর-কষাকষি করে কাজ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন সুযোগ ও এখতিয়ার সৈয়দ আবুল হোসেনের ছিল না। পরামর্শক নিয়োগের বিষয়টি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপনের জন্য কোন প্রস্তাব মন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর নিকট উপস্থাপন করা হয়নি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশের সাথে মন্ত্রী একমত হতে না পারলে মন্ত্রীকে মূল্যায়ন প্রতিবেদন অপরিবর্তিত রেখে নিজস্ব মত কিংবা পর্যবেক্ষণ সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ কমিটিতে প্রেরণ করতে হয়। এ অবস্থায় পিপিআর সম্পর্কে সামান্য জ্ঞাত কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কী কারণে মন্ত্রীকে উৎকোচ দিতে আসবেন তা কোনভাবে বোধগম্য নয়।
এস.এন.সি-লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি-প্রেরিত ই-মেইল নিয়েও সৈয়দ আবুল হোসেনের সংশ্লিষ্টতা খোঁজা হচেছ। ই-মেইল নাম্বার জানা থাকলে যে কেউ যে কারও কাছে ই-মেইল পাঠাতে পারেন। তাই কথিত ই-মেইল এর সাথে আবুল হোসেনের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণের চেষ্টা নিতান্তই হাস্যকর। ই-মেইল দাতা ও গ্রহীতাকে জিজ্ঞাসা করা হলে এর সত্যতা বেরিয়ে আসবে। যারা অভিযোগ প্রমাণের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন তারাও তো এমনটি কারতে পারে! এ বিষয়ে এত সমালোচনা সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অপপ্রয়াস বই কিছু নয়। ‘উর্ধ্বতন ব্যক্তি’ হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনকে ইংগিত করেও যদি ই-মেইল প্রদান করা হয়ে থাকে, তাহলেও প্রমাণের পূর্বে সৈয়দ আবুল হোসেনেকে দায়ি করার কোন সুযোগ নেই। কারণ যে কেউ এরূপ ই-মেইল প্রদান করতে পারেন। এ ধরণের ই-মেইল আদান প্রদানে অন্য কোন উদ্দেশ্যে রয়েছে কিনা- তা খুঁজে বের না করে শুধু সৈয়দ আবুল হোসেনকে সংশ্লিষ্ট করা গভীর ষড়যন্ত্রেরই চিহ্ন।
বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রেরিত চিঠিতে ‘সচিবের মধ্যস্থতা’ বলতে কি বুঝাতে চেয়েছেন- তা রীতিমত অস্পষ্ট। সাবেক প্রতিমন্ত্রীর অনুরোধে এবং তিনিসহ মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সৈয়দ আবুল হোসেন সরকারি অফিসে এস.এন.সি-লাভালিনের প্রতিনিধির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। মন্ত্রী ইচ্ছা করলে যে কোন বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের উপস্থিত থাকা নিতান্তই স্বাভাবিক। বরং তারা না থাকলে বিষয়টি দোষের হতো। এক্ষেত্রে ‘সচিবের মধ্যস্থতা’ – কথাটি হাস্যকর। কোন অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বৈঠকটি হয়নি। অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে মন্ত্রী গোপনে বেঠকটি করতেন।
রমেশ শাহের ডাইরিতে সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম অর্ন্তভূক্ত থাকার বিষয়টিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ ধরে নিয়ে আলোচনা করা যেমন হাস্যকর তেমনি বালসুলভ। কেউ নিজ ডায়রিতে যে কোন কিছু লিখতে পারেন। এ জন্য বিনা প্রমাণে কাউকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে হেনস্তা করা নৈতিকতা কিংবা মানবতা উভয়ের পরিপন্থি। রমেশ শাহের ডাইরিতে বর্ণিত- ‘পিসিসি’ তিনি কি উদ্দেশ্যে লিখেছেন তা তিনি নিজেই জানেন। রমেশ শাহকে জিজ্ঞাসা ব্যতীত সৈয়দ আবুল হোসেনকে অর্থ প্রদানের বিষয়টি সত্য ধরে আগাম দোষী সাব্যস্ত করা অন্যায়। কানাডায় পরিচালিত প্রাকমামলার কার্যধারা পর্যবেক্ষণ করে দুদক চেয়ারম্যান রমেশ শাহের ডায়েরিকে ‘বাজারের ফর্দ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ‘বাজারের ফর্দে’ যে পণ্যগুলো কেনা হবে তার সঙ্গে সঙ্গে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত আনুমানিক মূল্যও লিপিবদ্ধ থাকে। সাধারণত ক্রেতারা যান বাজারে পণ্যসমূহ কেনার উদ্দেশে; পণ্যেরা ক্রেতাদের কাছে আসে না নিজেদের বিক্রি করার মানসে। সুতরাং ক্রেতা বাড়িতে বসে যে ফর্দ তৈরি করে সে ফর্দ অনুযায়ী ক্রেতার কাছ হতে পণ্য ক্রয় না করা পর্যন্ত বিক্রেতা বা পণ্যের সাথে ক্রেতার সম্পর্ক সৃষ্টির প্রশ্নই আসে না। রমেশ শাহের যে ডায়েরিতে ঘুষ লেনদেনের লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের নাম লেখা রয়েছে বলা হচ্ছে সেটিও সত্যিকার অর্থে একটি বাজারের ফর্দ। কানাডিয়ান আদালতে এসএনসি-লাভালিনের যে দুই প্রাক্তন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রাকবিচার পরিচালিত হয়েছে তম্মধ্যে একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মোহাম্মদ ইসমাইল। যার অর্থ প্রদানের কোন মতাই ছিল না এবং অন্যজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত রমেশ শাহ। তারও উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া যে ধরণের আর্থিক লেনদেনের কথা উঠেছে সেটার প্রতিশ্র“ত দেয়ার প্রশ্ন আসে না। সুতরাং যে ডায়েরি নিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন বা বাংলাদেশি অন্যান্য কয়েকজনকে দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার কথা বলা হচ্ছে সেটি পুরোটাই কাল্পনিক, অযৌক্তিক এবং অন্যায্য। 
সমালোচকগণ এস.এন.সি-লাভালিন ২য় থেকে ১ম স্থানে উঠে আসার ব্যাপারেও অনিয়মের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে কোন অনিয়ম হয়েছে কিনা- তা সৈয়দ আবুল হোসেনের জানার কথা নয়। কাজটি বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে করা হয়েছে। এসএনসি লাভালিন কেন এবং কীভাবে প্রথম স্থানে উঠে এলো সেটি মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ হুবহু চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সেতু বিভাগ থেকে বিশ্ব ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশে সৈয়দ আবুল হোসেন কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা সংশোধন করেননি।এক্ষেত্রে সৈয়দ আবুল হোসেনের সংশ্লিষ্টতা খোঁজা শুধু অযৌক্তিক নয়; অজ্ঞতাও বটে। মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে সহজে জানা যাবে যে, মন্ত্রী থাকাকালীন সৈয়দ আবুল হোসেন মূল্যায়ন কমিটির কোন সদস্যেকে কোন বিষয়ে প্রভাব কাটানোর চেষ্টা করেছিলেন কিনা। এর জন্য দুদক কিংবা কানাডার প্রাক আদালতের প্রয়োজন নেই। 
এবার কমিটি গঠন-পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা করা যাক। অসৎ উদ্দেশ্যে নাকি বার বার কমিটি ভাঙ্গাগড়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কমিটি ভাঙ্গা-গড়া হয়নি। উপযুক্ততা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির স¦ার্থে কমিটি গঠন কিংবা পুনর্গঠন করা হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তা করা হয়েছে। মূল্যায়ন কমিটি গঠন বা পুনর্গঠনের ব্যাপারে বিশ্ব ব্যাংকের মতামত ও সম্মতিকে সবসময় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কমিটি গঠন বা পুনর্গঠনের তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা যায়, সর্বশেষ কমিটিই- পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য সর্বোত্তম বিশেষজ্ঞ কমিটি। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ সদস্যদের সমন্বয়ে ঐ গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আইনুন নিশাত, বুয়েটের সাবেক ভিসি ড. মো: সফিউল্লাহ, বিশ্ব ব্যাংক মনোনীত পরামর্শক ড. দাউদ আহমেদ ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী ফেরদৌস। এক্ষেত্রে সদস্য-সচিব ছাড়া কমিটির অন্য সদস্যরা সেতু বিভাগ বহিঃর্ভূত। 
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র নিয়ে কানাডার আদালতে মামলা চলছে। রমেশ শাহের ডায়েরিতে নাকি ঘুষ প্রদানের তালিকা লেখা আছে। যদিও মামলাটি করেছে কানাডিয়ান ফেডারেল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাধীন সংস্থা আরসিএমপি। এসএনসি-লাভালিনের দুই প্রাক্তন কর্মকর্তাকে আসামি করা হলেও কোম্পানিকে আসামি করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে বাংলাদেশকে। আরসিএমপি বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে তদন্ত শুরু করছে। এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, বিশ্বব্যাংক কোন দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান নয় এবং এক ঝাঁক দেবদূতও এটা পরিচালনা করছেন না। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলের শেষ ও মে মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রাকবিচার পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কাছেও ঐ ডায়েরির কোন কপিও ছিল না। সে অবস্থায় বিশ্ব ব্যাংক কোন দলিলের ভিত্তিতে দুদকের কাছে ডায়েরিতে যাদের নাম রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের দাবি জানিয়েছিল? পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে পরিমাণ ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের কথা উঠেছে সেটি মোট প্রকল্প ব্যয়ের মাত্র এক হাজার ভাগের এক ভাগ। পৃথিবীর অনেক দেশে বিশ্ব ব্যাংকের অনেক প্রকল্পে এর চেয়ে অনেক বেশি ঘুষ লেনদেন হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প বাতিল করা হয়নি। যারা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে বিশ্ব ব্যাংক প্রকল্প কাজ চালিয়ে যেত পারত। প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র একটি অজুহাত মাত্র। আসল লক্ষ্য বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনার সরকার। যার প্রথম শিকার সৈয়দ আবুল হেসেন। 
তদসত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিক এবং মিডিয়া অঙ্গনে পদ্মাসেতুর দুর্নীতি নিয়ে মহা তোলাপাড় শুরু করে দেয়। এর কারণ হলো ঘটনার বাদি বিশ্বের সর্বশক্তিমান আর্থিক সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক এবং আসামি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ। বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন স্বনির্ভর নয় যে, ঐ পরাক্রমশালী সংস্থাকে বিদায় জানাতে পারে। ফলে সংস্থাটির দেয়া বিষময় আর্থনীতিক প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশকে বিনাপ্রতিবাদে গলাধঃকরণ করতে হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটতো। অথচ বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশের কিছু সংবাদপত্রের জন্য তা হয়নি। গণতান্ত্রিক সমাজে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সত্য প্রকাশের দায়বদ্ধতা সমান্তরালভাবে চলার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা না বলে স্বেচ্ছাচারিতা বলাই সমধিক যুক্তিযুক্ত। নইলে কীভাবে বিশ্বব্যাংকের ধারণাভিত্তিক দুর্বল ও তুচ্ছ অভিযোগকে এমন ফুলিয়ে ফাপিয়ে তুলে!! দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, “রমেশের হাতে লেখা ডায়েরির এই বিশেষ পৃষ্ঠায় এসএনসি-লাভালিনের আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেসের স্বাক্ষর রয়েছে”। এটি কত হাস্যকর সহজে অনুমেয়। সামান্য অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন লোকও বলবে কারও ব্যক্তিগত ডায়েরিতে তার উর্ধতন কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকার কথা নয়। অনেক সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সুশীল সমাজের অনেকে তদন্ত কাজে ধীর গতির জন্য দুদকের সমালোচনায় কেঁদে কেটে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ দুদক সূত্রে জানা যায় কানাডার আরসিএমপিকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও রমেশ শাহের ডায়েরির কপি দুদককে দেয়া হয়নি। যে দলিলটি দুর্নীতি প”মাণের একমাত্র লিখিত সাক্ষ্য সেটা ছাড়া তদন্ত কাজে অগ্রগতি কোনভাবে সম্ভব নয়। 
বিশ্বব্যাংক প্যানেল প্রধান মেরিনো ওকাম্পো’র দুদক চেয়ারম্যানকে লেখা চিঠিতেও সৈয়দ আবুল হোসেনকে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তি ছাড়া শুধু দাতা সংস্থার নির্দেশে দুর্নীতির আশংকার সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে- এমন দাবি ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। অধিকন্তু, বিশ্ব ব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেল যখন দুদকে বৈঠক করেন, তখন বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশের প্রতিনিধি মিসেস গোল্ড স্টেইন উপস্থিত ছিলেন। যা নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে অগ্রহণযোগ্য। কারণ, বিশ্ব ব্যাংক নিজেই অভিযোগকারী। পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তিতে বিশ্ব ব্যাংককে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। তাই বিশ্ব ব্যাংকের কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে যথেচ্ছ আচরণ সবচেয়ে জঘন্য।
ঋণ সাহায্য সবসময়ই রাজনীতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তিটিও রাজনৈতিক কারণের বাইরে নয়। সংগত কারণে বাতিলও রাজনীতিক। আমেরিকার সঙ্গে বেশ কয়েকটি কারণে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঠিক সাবলীল যাচ্ছিল না। এক ধরনের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে আমেরিকার খোলামেলা পক্ষপাতিত্ব কারও অজানা নয়। একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর স্পর্ধা গরিবের বউ সবার ভাবী প্রবাদটি স্মরণ করিয়ে দেয়। নেপথ্যে তেল গ্যাস-কয়লা বিষয়টিও থাকতে পারে। গ্যাস রফতানির জন্য আমেরিকার চাপের কথা সবার জানা। বিশ্বব্যাংকের যে কোন বড় সিদ্ধান্ত আমেরিকার আঙ্গুল নাড়ার দিকে চেয়ে থাকে। সুতরাং ঋণ বাতিল সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনীতিক শক্তি, শক্তিধর লবিস্ট বহুজাতিক কোম্পানি ও হোয়াইট হাউসসহ অপরাপর শক্তির যোগসাজশ ছিল এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়।
নব্বুই এর দশকে রাজনীতিতে সক্রিয় হবার পর থেকে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে পত্রিকায় অসত্য খবর ও প্রতিবেদন প্রচার হতে শুরু করে। বিএনপি আমলে এসব অভিযোগ তদন্ত করা হলেও কোন সত্যতা খুজে পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে অসত্য খবর প্রকাশিত হয়েছে। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে এসব খবর নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়। এ নিয়ে বিএনপি সরকার ৫ বছর তদন্ত করে। তবে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ভয়ংকর ১/১১ এর সময় তার জন্ম থেকে শুরু করে তার বিরুদ্ধে প্রকাশিত খবর, বেনামি চিঠি ও বিএনপির শ্বেতপত্রের ওপরও তদন্ত হয়। এ শ্বেতপত্রে তার স্বাক্ষর জাল করেও পত্রিকায় ছাপানো একটি চিঠিও ছিল। সার্বিক তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। 
বিশ্বব্যাংক একটি অখ্যাত চায়না প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য বার বার তদ্বির করেছে। কমিটি তা অগ্রাহ্য করেছে। বিশ্বব্যাংকের মত প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানকে যেখানে পাত্তা দেয়নি সেখানে আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রভাব বিস্তার করার দাবি উদ্ভট।। বিশ্বব্যাংকের মত একটি প্রতিষ্ঠান এমন বোকামিপূর্ণ অভিযোগ কীভাবে আনয়ন করল তা ভাবতে আশ্চর্য লাগে। আসলে মিথ্যা কখনও গোপন রাখা যায় না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ দেয়ার ইচ্ছা থাকলে একজন দুইজনের দুর্নীতির জন্য ষোল কোটি মানুষকে বঞ্চিত করত না। যে প্রতিষ্ঠানটি দুই/তিনজন লোকের তথাকথিত দুর্নীতির ধুয়ো তুলে ঋণচুক্তি বাতিল করতে পারে সে প্রতিষ্ঠান যে কোন অবস্থাতে বিবেচক নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন কাজ করে বিশ্বব্যাংক কী বিবেচনপ্রসূত কাজ করেছে?
এর পরও যদি সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রভাব বিস্তার করার কৃতিত্ব দেয়া হয় তাহলে বলতে হয়, বিশ্বব্যাংকই সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে নতি স্বীকার করেছে। তাহলে বিশ্বব্যাংকের পক্ষে কীভাবে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা সম্ভব! যাদের মধ্যে একটু বিবেচনা বোধা আছে তারও এ অভিযোগ কখনও বিশ্বাসযোগ্য মনে করবেন না। এমন অবিশ্বাস্য অভিযোগের উপর ভিত্তি করে পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল ষোল কোটি মানুষের প্রত্যাশাকে হত্যা করা। এর চেয়ে বেশি অবিবেচনার কাজ, জুলুমের কাজ, দুর্নীতির কাজ আর হতে পারে না।

লৈখক পরিচিতি: কলামিস্ট, সাংবাদিক; দৈনিক উত্তরবঙ্গ সংবাদ, শিলিগুড়ি, ভারত।

সুশোভিত সুমন
আতাউর রহমান খান কায়সার
যোগাযোগ একটি বিশাল পরিধির মন্ত্রণালয়। এটি কেউ অস্বীকার করবেন না যে, যোগাযোগ অবকাঠামো বিনির্মাণ যে কোনো দেশের জন্য প্রাকৃতিক, আর্থিক ও কৌশলগত কারণে বেশ জটিল। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক একটি গরিব দেশের জন্য এটি মহাজটিল। অনেকগুলো মন্ত্রণালয়কে নিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে কাজ করতে হয়। অর্থের জন্য অন্য দেশের সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়, স্বভাবতই কার্যকর সমন্বয় সাধনের উপর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সফলতা বহুলাংশে নির্ভর করে। আমি মনে করি, সৈয়দ আবুল হোসেন অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও এ কাজগুলো সুচারুভাবে সম্পন্ন করে যাচ্ছেন।
তিনি কোনোরূপ প্রটোকল বা ইগোর তোয়াক্কা না-করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও কর্মকর্তা এমনকি অফিস সহকারীর সাথে সরাসরি আলাপ করে উদ্ভুত সমস্যা সমাধান করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নিজের ব্যক্তিগত অফিস সাকো-তেও এমন আচরণ লক্ষণীয়। এলাকার উন্নয়নের প্রশ্নে, প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রশ্নে, প্রয়োজন হলে, বিরোধী-দলীয় লোকদের সাথে কথা বলতেও তিনি সংকোচ বোধ করেন না। প্রকল্পের সাথে বৈদেশিক যোগসূত্র থাকলে তিনি তা দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে পারেন। সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের সহায়তায় আন্তঃদেশীয় বৈঠকের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত প্রকল্প যথাসময়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়নের সম্ভাব্য সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। বিদেশি সহায়তা সংগ্রহে তিনি অত্যন্ত কুশলী এবং যতœবান। এটি সবার জানা।
রাজনীতি গণিত নয়। এখানে ভুলত্র“টি থাকবেই। রাজনৈতিক প্রশাসনে একশ ভাগ মার্ক পাওয়ার দাবি করা এবং সে রকম কারও কাছ হতে প্রত্যাশা করা দুটোই হাস্যকর ও বোকামি। আমাদের দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কতটুকু আন্তরিকতার সাথে কাজ করছেন, তার উদ্দেশ্য এবং কার্যপদ্ধতি। আন্তরিকতা বিবেচনায় সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রচেষ্টায় কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবেন বলে মনে হয় না। পদ্মা সেতুর কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করার জন্য তার নিরলস প্রচেষ্টা সত্যি প্রশংসনীয়। এর সফলতা নির্ভর করবে সহায়ক শক্তিগুলো তাকে কতটুকু সহায়তা করে তার উপর। আশা করি, তিনি এ কাজে সফল হবেন।
মন্ত্রণালয়ের কাজে কোনো বিষয়ে জটিলতা দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে তা নিরসনে তিনি নিজেই এগিয়ে আসেন। যথার্থ সমালোচনাকে তিনি উপদেশ গণ্যে সাদরে গ্রহণ করেন। যা তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপকে সহজ করে দেয়। তবে সমালোচনা যদি শুধু সমালোচনার জন্য হয়, তাহলে তা অবশ্যই নিরুৎসাহের এবং মনোকষ্টের। এ নিয়ে তিনি কষ্ট পেলেও আবার সাহসী হয়ে ওঠেন।
রাষ্ট্রীয় এমনকি ব্যক্তিগত কাজেও যে কোনো সময় তাঁকে পাওয়া যায়। সমস্যার সমাধান করতে পারুন বা না-পারুন, চেষ্টা করেন এবং ভদ্রোচিত ব্যবহারে সবাইকে মুগ্ধ করেন। চট্টগ্রামের প্রতি তার দরদ রয়েছে। বাণিজ্য নগর এবং বারো আউলিয়ার পুণ্য-ভূমি, সর্বোপরি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে তিনি চট্টগ্রামের প্রতি, চট্টগ্রামের উন্নয়নের প্রতি তাকে আমি সবসময় আন্তরিক দেখতে পেয়েছি। চট্টগ্রামের উন্নয়নমূলক কাজে যখনই সহায়তা চেয়েছি, পেয়েছি।
বিভিন্ন সভায় সৈয়দ আবুল হোসেন নিজের দলের লোকের ন্যায় বিরোধী দলের লোকদের প্রস্তাবও গুরুত্বের সাথে শোনেন এবং বিবেচনার আশ্বাস দেন। আওয়ামী লীগ মনে করে আওয়ামী লীগের সব কাজ ভালো, আবার বিএনপি মনে করে বিএনপির সব কাজ ভালো। কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেন মনে করেন, দেশ ও জাতির কল্যাণ এবং সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য নিবেদিত সকল কাজই ভালো- তা যে দলই করুক না কেন। যারা কিংবা যে কাজ দেশ ও জাতির ক্ষতি করে, মানুষে মানুষে হানাহানি সৃষ্টি করে, সন্ত্রাস বাড়ায়- তা দল নির্বিশেষে কোনোরূপ প্রশ্ন ব্যতীত খারাপ কাজ। সংগতকারণে পরিত্যাজ্য।
আমি যতটুক জানি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বন্ধুসুলভ। সবার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে প্রশাসনিক ও কার্যগত সম্পর্কও চমৎকার। মন্ত্রী হিসেবে তাকে চারিপাশের মানুষ যতটুক সম্মান করেন তিনি তার চেয়ে বেশি সম্মান করেন তাদেরকে- যারা তার কাছে আসেন। এটি অবশ্য শুধু হোমরাচোমরাদের বেলায় করেন তা নয়, সবার প্রতি তিনি সৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তিনি অত্যন্ত প্রাণবন্ত, হাসিখুশি এবং ব্যক্তিত্বময়। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয় সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে ন্যায্য আচরণ করেছেন। বাইরের জগতের মতো তিনি সংসদেও সহনশীল, আন্তরিক ও রুচিশীল। প্রতিপক্ষ আহত হতে পারে কিংবা মনোকষ্ট পেতে পারে- এমন কথা বলতে শুনিনি। মিডিয়াতেও তার কথাবার্তা ও বাচনভঙ্গি আকর্ষণীয় এবং ব্যক্তিত্বময়। তাই দলমত নির্বিশেষে সবাই সৈয়দ আবুল হোসেনকে ভালো জানেন এবং ভালোবাসেন।
একটি মন্ত্রণালয় চালানো সহজ কথা নয়। একজন মন্ত্রীকে অনেক দূরদর্শী হতে হয়। তাঁর থাকতে হয়ে ধৈর্য, কমিটমেন্ট, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, সততা, স্বচ্ছতা এবং নেতৃত্ব প্রদানের দূরদর্শিতা। মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতিটি কাজে এ সকল গুণাবলীর সমাবেশ দেখা যায়। সর্বোপরি, একজন মন্ত্রীর সার্থকতা নির্ভর করে প্রশাসনিক দক্ষতার উপর। অনেকে মন্ত্রী আমলাদের প্রস্তাবে শুধু ডিটু মেরে যান, বোঝেন না; কিংবা বুঝলেও গভীরে যাবার চেষ্টা করেন না। সৈয়দ আবুল হোসেন তার কাজের ব্যাপারে যেমন অভিজ্ঞ, তেমন সচেতন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সকল নীতিমালা, বিধি, সাকুর্লার, সরকারি আদেশ ও পিপিআর সম্পর্কে তার অগাধ পাণ্ডিত্য রয়েছে। তার সাথে কাজ করেছেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে আমি এমনই শুনেছি। কাজে কাজেই তিনি প্রতি নথির আগাগোড়া সহজে বুঝে নিতে পারেন দেখার সাথে সাথে।
তার আত্মসংযম ক্ষমতা প্রবল। ফলে যে কোনো পরিস্থিতি তিনি খুব সহজে কোনোরূপ মনোমালিন্য ব্যতিরেকে সমাধান করতে পারেন। অনেকে দায়-দায়িত্ব অন্যের উপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেন এবং ব্যর্থতার দায়ভার অধস্তনদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে সাফাই নেবার চেষ্টা করেন। সৈয়দ আবুল হোসেনকে আমি এমন দায় এড়ানো মনোভাব নিয়ে কাজ করতে কখনও দেখিনি। মন্ত্রণালয়ের সবার একই মত- তার মতো মানুষ বেশি একটা দেখা যায় না, তার মতো মন্ত্রীও খুব কম। তিনি মন্ত্রণালয়ের কাজকে ব্যক্তিগত কাজের মতো গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থকে স্বচ্ছতার সাথে অথচ সর্বনিম্ন খরচে শুধু জনকল্যাণে ব্যয় করার চেষ্টা করেন। সৈয়দ আবুল হোসেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকেন না। নিবিড় তদারক করেন। কাজ আদায় এবং যথাসময়ে কাজটির সফল সম্পাদনের জন্য সবার সাথে নিজেও সামিল হয়ে যান কাজে এবং ব্যর্থতার দায়ভার অন্যের উপর চাপিয়ে না-দিয়ে নিজে বহন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। এটি একজন নেতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে আমি মনে করি।
সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ইত্যাদি পদালঙ্করিক হলেও মূলত এর প্রকাশ ঘটে মনে। কেউ মর্যাদা ও ক্ষমতায় যত বড় হোন না কেন, মানসিক দিক দিয়ে বড় না-হলে সে বড়ত্ব দামি অথচ বাসী খাবারের ন্যায় দুর্গন্ধ ছড়ায়, তাই পরিত্যাগ করা ছাড়া উপায় থাকে না। সৈয়দ আবুল হোসেন যত বড় তার চেয়ে বড় তার মন; তার চেয়ে উদার তার ব্যবহার। ফলে তার বড়ত্বে অহঙ্কার এসে বসতে পারে না। তিনি যত বড় হচ্ছেন তার মনে তত বেশি বিনয় শোভা পাচ্ছে। মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকে। শিশুর মতো নিষ্পাপ হাসির মাঝে সরলতার আলোর স্ফুরণ যে কাউকে বিগলিত করে দিতে পারে। তিনি চারিত্রিক অলঙ্করণে সুশোভিত মনের একজন সুন্দর মানুষ।
সৈয়দ আবুল হোসেনের যে গুণটি সবচেয়ে বেশি আমাকে আকর্ষণ করে সেটি হচ্ছে উদারতা। দল-নির্বিশেষে সবাইকে তিনি প্রশাসন ও আইনের দৃষ্টিতে অভিন্ন মনে করেন। বিশেষ করে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি সম্পদের বণ্টনকে সমভাবে বণ্টনের চেষ্টা করেন। হয়ত তার ইচ্ছামতো সব কিছু সম্ভব হয় না। কিন্তু তিনি চেষ্টা করেন- এ ব্যাপারে কারও কোনো সন্দেহ নেই। কালকিনি এলাকার উন্নয়নে সৈয়দ আবুল হোসেন দলীয় চেতনাকে কখনও গুরুত্ব সহকারে দেখেননি। তার মানে এ নয় যে, তিনি তার সমর্থকদের অবহেলা করেন। তিনি নির্বাচিত হবার পর শত্র“-মিত্র নির্বিশেষে সবাইকে কাছে টানার চেষ্টা করেন। এ যে চেষ্টা তা-ই বা কয়জন দেখাতে পারেন? মন্ত্রী হবার পর কালকিনিবাসী কর্তৃক প্রদত্ত বিশাল সংবর্ধনা সভায় তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছেনÑ তার একটি কপি আমি পড়েছি। এ বক্তৃতায় তিনি ওয়ান-ইলেভেনের সময় যারা তার প্রতি চরম ঘৃণ্য ব্যবহার করেছেন তাদেরকেও ক্ষমা করে দিয়ে জাতীয় উন্নয়নে একাত্ম হবার উদাত্ত আহবান করেছেন।
দলের প্রতি পূর্ণ অনুগত থেকেও সবার প্রতি ভালো আচরণ করা যায়- সৈয়দ আবুল হোসেন এর জ্বলন্ত উদাহরণ। শুধু জিহ্বাটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে- শত্র“র মনের গভীরেও রেখাপাত করা যায়; এটির উদাহরণও আমরা সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছ হতে নিতে পারি। অমায়িক ব্যবহার দিয়েও বঞ্চিত ভাবেন এমন কাউকে সন্তুষ্ট করা যায়-এটিও আমরা তার আচরণে দেখতে পাই।
বাংলাদেশে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার মতো সংস্কৃতি কিংবা পরিবেশ এখনও সৃষ্টি হয়নি। এটি আওয়ামী লীগ-বিএনপি বা অন্য যে কোনো দলের বেলায় প্রযোজ্য। যে ক্ষমতায় যায়, সে নিজেকে বড় ভেবে বসে, যে বিরোধী দলে থাকে সে নিজেকে বঞ্চিত ভেবে বসে। পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়ি, একে অন্যকে দোষারোপ ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এগুলো ঠিক নয়, তবু আমরা কেউ এগুলো ছাড়তে পারিনা। ভিন্ন মতাবলম্বীর দোষের সাথে সাথে গুণ প্রকাশের সংস্কৃতি চালু হলে গণতন্ত্রের ভিত আরও মজবুত হবে। সৈয়দ আবুল হোসেন এ দুটির সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেন। এটি শুধু দূরদর্শিতা নয়, মহত্তের পরিচায়কও বটে।
ব্যক্তি বিবেচনায় মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন একজন চমৎকার মানুষ। সততা, বিশেষ করে, অর্থিক সততা একজন মন্ত্রীর সুনাম ও সফলতার জন্য অপরিহার্য। আর শুধু সৎ হলে হয় না, সততার সাথে থাকতে হয় নিষ্ঠা, স্বচ্ছতা ও দ্রুততা। সৈয়দ আবুল হোসেন সততার সাথে নিষ্ঠার সমন্বয় ঘটিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে একটি কার্যকর মন্ত্রণালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যোগ্য লোককে যোগ্যস্থানে অধিষ্ঠিত করে যোগ্যতার যে মূল্যায়ন করেছেনÑ এটি আমাদের সবার জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। আমি তার সাফল্য কামনা করি।

আতাউর রহমান খান কায়সার : বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রাসঙ্গিক বাস্তবতা
মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া
ইদানিং দেশের প্রায় সব পত্রপত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পদ্মা-সেতু প্রকল্পের বিষয়ে বিস্তর লেখা-লেখি ও আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। দেশের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সিভিল সোসাইটি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও বিষয়টিতে কৌতুহলী হয়ে পড়েছেন। বিশ্বব্যাংক গত ২৯ জুন তারিখে প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল করায় বিষয়টিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে এবং এটি ‘টক অব দি কান্ট্রি’-তে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আলোচকবৃন্দ প্রাসঙ্গিক বাস্তবতা যথার্থভাবে না জেনেই ধারণাপ্রসূত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অসত্য, অর্ধসত্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে কাল্পনিক তথ্যাদি উপস্থাপন করছেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব পদে দু’বছর কাজের সুবাদে আমি সরকারি দায়িত্বপালনের কারণেই প্রত্যক্ষভাবে পদ্মা-সেতু প্রকল্পের বিষয়ে অবহিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। সময়ের প্রয়োজনে এবং দেশের স্বার্থে সে অভিজ্ঞতালব্ধ প্রাসঙ্গিক ঘটনাবলী জনসাধারণকে অবহিত করার লক্ষ্যে বিবেকের তাড়নায় এ লেখার প্রয়াস। বিনয়ের সাথে জানাতে চাই-দীর্ঘ ৩২ বছর ন্যূনতম কোন অভিযোগ ব্যতীত পরিপূর্ণ আন্তরিকতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে সরকারি চাকরির শেষ পর্যায়ে অসত্য, অর্ধসত্য এমনকি কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তিতে আমাকে জড়িয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নানাবিধ সংবাদ/নিবন্ধ এবং বিভিন্ন টেলিভিশনের ‘টক শো’-তে কতিপয় আলোচকবৃন্দের মন্তব্যে আমি মর্মাহত হয়েছি সত্য; তবে আত্মপক্ষ সমর্থন করা বা অন্য কাউকে দোষারোপ করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।

পদ্মা-সেতু প্রকল্পের কাজের শুরু
আমরা সকলেই জানি বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯ জানুয়ারি, ২০০৯ তারিখে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় পদ্মা সেতুর ডিজাইন পরামর্শক হিসেবে Maunsell AECOM Ltd.-কে নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজের সর্বোচ্চ মেয়াদ ছিল ২ বছর; তবে প্রতিষ্ঠানটি ১৭ মাসের একটি accelerated কর্মসূচি প্রণয়ন করে কাজ শুরু করে। বাস্তবে উক্ত সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন কৌশলে তাদের পরামর্শক সেবার মেয়াদ বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হলেও তাদেরকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যক্রম সম্পদান এবং ফবষরাবৎধনষবং হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হয়। পদ্মা-সেতু প্রকল্পে একাধিক উন্নয়ন সহযোগী থাকায় প্রকল্পের স্বার্থে তাদের মধ্যকার সমঝোতা ও সমন্বয়ের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কাজের শুরুতেই বিশ্বব্যাংক ও জাইকা’র মধ্যে মূলসেতু নির্মাণের ব্যাপারে একটি বড় কারিগরি বিষয়ে মতদ্বৈততার সৃষ্টি হয় এবং প্রায় অচল অবস্থা সৃষ্টি হলে সচিব হিসেবে আমার যোগদানের পর সেতু বিভাগের পক্ষ হতে উদ্যোগ গ্রহণ করে বিষয়টির সম্মানজনক সমাধান করা সম্ভবপর হয়। অবশ্য টেগর ডকুমেন্ট এর ক্লিয়ারেন্স প্রদানের পূর্বেই বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত করে।
এছাড়া, ০১ জুলাই, ২০১১ তারিখে বিশ্বব্যাংক সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত প্রিকোয়ালিফিকেশন প্রস্তাব অনুমোদন করে। তবে সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত (ডিজাইন পরামর্শক ও মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশে) টেন্ডার ডকুমেন্ট (বিড ডকুমেন্ট) অনুমোদন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। বিশ্বব্যাংক উক্ত ডকুমেন্টে শুধুমাত্র তাদের ‘নিজস্ব এন্টিকরাপশন’ গাইডলাইন এর নির্দেশাবলী অন্তর্ভূক্ত করে। এতে অন্য দুটি উন্নয়ন সহযোগি যেমন এডিবি ও জাইকা আপত্তি প্রদান করে এবং তাদের গাইডলাইনের নির্দেশাবলীও অন্তর্ভূক্ত করার দাবী জানায়। সেতু বিভাগ হতে ৩টি উন্নয়ন সহযোগি সংস্থার সাথে দীর্ঘ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে বিষয়টি সমঝোতা করা সম্ভবপর হয়। অবশ্য টেগর ডকুমেন্ট এর কিয়ারেন্স প্রদানের পূর্বেই বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত করে।

প্রকল্পে সম্পাদিত কার্যাদি 
পদ্মা-সেতু প্রকল্পের কাজে সময়ক্ষেপণ পরিহার করে একইসাথে বিভিন্ন কাজ এগিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল। একদিকে ডিজাইন প্রণয়ন, অন্যদিকে আনুষঙ্গিক কাজের প্রস্ততি যেমনÑ জমি অধিগ্রহণ ও এর মূল্য প্রদান, ৪টি পুনর্বাসন সাইট উন্নয়ন, পরিকল্পনা মাফিক রাস্তাঘাট ও ইউটিলিটি সার্ভিস স্থাপনসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থাকরণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রম স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সাথে সম্পাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। জমি অধিগ্রহণের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল শরিয়তপুর, মাদারিপুর ও মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উপর। দু’একটি ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের অর্থ প্রদান বিষয়ে অভিযোগ/আপত্তি উত্থাপিত হলে তাৎক্ষণিক জেলা প্রশাসকদের সাথে যোগাযোগ করে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অধিগ্রহণকৃত জমির সঠিক মূল্য পুণঃ নির্ধারণের ও প্রদানের ক্ষেত্রে সেতু বিভাগের পদক্ষেপ ও ভূমিকা মাওয়া ও জাজিরা সাইটের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ ও জনপ্রতিনিধিগণের নিকট বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। এ সব কাজে নূ্যূনতম কোন দুর্নীতি, অনিয়ম বা অভিযোগ ব্যতীত সরকারি বাজেটের প্রায় ১২০০ কোটি টাকারও বেশী ব্যয়িত হয়। বিশ্বব্যাংকসহ প্রকল্পের সকল উন্নয়ন সহযোগীর প্রতিনিধিবর্গ উক্ত কার্যাদি পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

বিশেষজ্ঞ কমিটি ও ডিজাইন পরিবর্তন
বিশ্বব্যাংক, এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাইকা প্রত্যেকেই পদ্মা সেতুর কাজের জন্য একজন করে প্রতিনিধি মনোনীত করেন। সার্বিক কাজ সমন্বয়ের জন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার মধ্যে বিশ্বব্যাংককে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। তদপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক তাদের একজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা জনাব মাসুদ আহমাদকে ‘টাস্ক টীম লিডার’ হিসেবে মনোনীত করে। উক্ত মনোনীত ব্যক্তিগণ সার্বক্ষণিক পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালকসহ অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারগণের এবং ডিজাইন পরামর্শকের সাথে যোগাযোগ ও সভার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় নিষ্পত্তি করেন। প্রকল্পের কারিগরি বিষয়াদি পর্যলোচনা ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে সহায়তার জন্য একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ টীম (চধহহবষ ড়ৎ ঊীঢ়বৎঃং) গঠন করা হয়। প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত উক্ত বিশেষজ্ঞ টীমে বুয়েটের আরও চারজন অধ্যাপক নিয়োজিত রয়েছেন; তারা হলেন প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত, ড. মু. সফিউল্লাহ, ড. ফিরোজ এবং ড. আলমগীর মুজিবুল হক। এ’ছাড়া জাপান, নেদারল্যান্ড ও নরওয়ের ৫ জন পানি বিশেষজ্ঞ এই প্যানেলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এদের অধিকাংশই বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নির্মাণকালীন সময়ে প্যানেল সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। ডিজাইন প্রণয়ন, সেতুর প্রতিটি প্যাকেজের ব্যয় নির্ধারণ, টেন্ডার প্রাক-যোগ্যতার ডকুমেন্ট তৈরী, মূল টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরী ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রণীত ডিজাইন/দলিলে উন্নয়ন সহযোগীদের কিয়ারেন্স গ্রহণ করা হয় যার নেতৃত্ব দেন বিশ্বব্যাংকের নিয়োজিত টাস্ক টীম লিডার। সেতু বিভাগের পক্ষ হতে দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রদান, নথি অনুমোদন, বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বয় ইত্যাকার বিষয় উন্নয়ন সহযোগী, প্যানেল অব এ্যাক্সপার্টস, ডিজাইন পরামর্শক এবং সর্বোপরি সরকারের নিকট ব্যাপক প্রশংসিত হয়। মূল সেতুর ঠিকাদার প্রাকযোগ্যতার জন্য টেন্ডার আহবান করা হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১১টি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দাখিল করে। এরমধ্যে মূল্যায়ন কমিটি ৫টি প্রতিষ্ঠানকে প্রাক্্যোগ্য হিসেবে নির্বাচন করে। টেন্ডার আহবানের পর ডিজাইন আংশিক পরিবর্তনের অজুহাতে বিশ্বব্যাংক পুণঃ টেন্ডার আহবানের প্রস্তাব দেয়। পূর্বের ডিজাইনে দরপত্রে অংশগ্রহণে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানসমূহের নদীতে ইড়ৎবফ এবং/অথবা জধপশরহম চরষরহম-এর অভিজ্ঞতা থাকতে হবে মর্মে উল্লেখ ছিল। পরবর্তীতে চূড়ান্ত ডিজাইনে শুধুমাত্র Racking Piling-এর প্রভিশন রাখা হয়। বিশ্বব্যাংকের সাথে বিবাদ এবং লেখালেখিতে সময়ক্ষেপন হতে পারে বিবেচনায় পুনঃটেন্ডার বিজ্ঞপ্তির প্রস্তাবে সম্মত হয়ে এপ্রিল’২০১০ এ পুনরায় টেন্ডার আহবানের প্রেক্ষিতে ১০টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয় এবং পূর্বের প্রাক-যোগ্য বিবেচিত ৫টি প্রতিষ্ঠানই মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক প্রাকযোগ্য বিবেচিত হয়।

প্রকল্পের কাজের মোটাদাগের প্যাকেজ, মূল্যায়ন কমিটি ও মূল্যায়ন
পদ্মা-সেতু সংশ্লিষ্ট কাজ (packages) গুলো হল-মূল সেতু, নদীশাসন, সংযোগ সড়কসহ যাবতীয় পূর্ত কাজ এবং Construction Supervision Consultant I Management Support Consultant নিয়োগ। 
আমার সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে যোগদানের পূর্বেই দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা থাকলেও স্বচ্ছ ও বস্থনিষ্ঠ মূল্যায়নের উদ্দেশে মাননীয় মন্ত্রী এবং উন্নয়ন সহযোগী সমন্বয়ক বিশ্ব ব্যাংকের সাথে আলোচনাক্রমে উক্ত কমিটি পরিবর্তন করে পদ্মা-সেতু সংশ্লিষ্ট কাজ যথা মূল সেতু, নদীশাসন, সংযোগ সড়কসহ যাবতীয় পূর্ত কাজের দরপত্র মূল্যায়নের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ এবং প্রশ্নাতীত সুনামের অধিকারী প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. আইনুন নিশাত ও ড. আবু সিদ্দিকসহ ৭ জন কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া Construction Supervision Consultant I Management Support Consultant দরপত্র মূল্যায়নের জন্য সচিবের নেতৃত্বে অপর একটি মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির অন্যান্য সদস্যগণ ছিলেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জনাব তরুণ তপন দেওয়ান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মকবুল হোসেন, বুয়েটের অধ্যাপক, ড. ইসতিয়াক আহমেদ ও পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক জনাব রফিকুল ইসলাম, ড. দাউদ আহমেদ এবং সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মোঃ ফেরদৌস। 
মূল সেতু, নদীশাসন, সংযোগ সড়কসহ যাবতীয় নির্মাণ প্যাকেজের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেন ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অঊঈঙগ। প্রথমে উক্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কারিগরি বিশেষজ্ঞগণ দর প্রস্তাবগুলো পুঙ্খনাপুঙ্খ পরীক্ষা করেন। অতঃপর অঊঈঙগ-এর নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াস্থ Principal Office -এর উচ্চ পদস্থ বিশেষজ্ঞগণের সম্মতি গ্রহণের পর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির নিকট উপস্থাপন করা হয়। মূল্যায়ন কমিটি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করেছে; তাঁদের কাজে কোনভাবেই কোন প্রভাব বিস্তার বা সেরূপ প্রচেষ্টা হয়নি; এমনকি মূল্যায়ন কমিটির কোন সিদ্ধান্ত বা মতামত সচিব কিংবা মন্ত্রী কর্তৃক কখনো অগ্রাহ্য করা হয়নি। দ্বিতীয় বার টেন্ডার আহবানের পর মূল সেতুর প্রাক্ যোগ্যতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন, ডিজাইন পরামর্শক এবং মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক চূড়ান্ত করার পর ০৮ জানুয়ারি, ২০১১ তারিখে বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করা হয়। প্রথম টেন্ডারের পর যে ৫টি প্রতিষ্ঠান প্রাক্্ যোগ্য বিবেচিত হয়েছিল দ্বিতীয় টেন্ডারের মূল্যায়নেও সে ৫টি প্রতিষ্ঠানই কমিটি কর্তৃক প্রাক্্ যোগ্য হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক উক্ত মূল্যায়ন প্রতিবেদন পরীক্ষান্তে টাস্ক টীম লিডারের ২৯ মার্চ ও ০৬ এপ্রিল তারিখের ই-মেইলের মাধ্যমে চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (ঈজঈঈ)-কে প্রাক্্ যোগ্য হিসেবে বিবেচনার অনুরোধ করে। মূল্যায়ন কমিটি তথা সেতু বিভাগ ০৭ এপ্রিল এক পত্রে (CRCC)-কে যোগ্য হিসেবে বিবেচনায় অসম্মতি জানায়। পুনরায় বিশ্বব্যাংক ১৩ এপ্রিল তারিখের ই-মেইলে CRCC-এর কাছ থেকে কিছু অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ করে প্রস্তাব পুনর্মূল্যায়নের অনুরোধ জানায়। তদপ্রেক্ষিতে সেতু কর্তৃপক্ষ ঈজঈঈ এর কাছে তাদের পূর্ব কাজের অভিজ্ঞতার স্বপক্ষে ড্রয়িং, ফটোগ্রাফ, নির্মাণ সামগ্রী এবং বৃহৎ ডায়মিটারের রেকিং পাইল-এ ব্যবহৃত হ্যামারের বর্ণনা দেয়ার জন্য চিঠি লেখেন। তারা যেসব তথ্য প্রেরণ করে তাতে ডিজাইন পরামর্শক ও মূল্যায়ন কমিটি বড় রকমের অসঙ্গতি দেখতে পায়। ঈজঈঈ অন্য প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ করা ব্রিজের ছবি পরিবর্তন করে ঈজঈঈ-এর নামে জমা দেয়। তাছাড়া পাইলিং ইকুইপমেন্টস্্ ও অন্যান্য কারিগরি বিষয়ে যেসব তথ্যাদি হাজির করে তাতে পদ্মা সেতুর মত বড় ব্রিজের পাইলিং করার মত যোগ্যতা প্রমাণ করে না। ০৭ মে, ২০১১ তারিখে ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তার প্রতিবেদনে উরেøখ করে যে, ঈজঈঈ মিথ্যা তথ্য ও অন্য প্রতিষ্ঠানের নির্মিত ব্রীজের ছবি প্রদান করেছে। এতদপ্রেক্ষিতে ঢাকাস্থ চীন দূতাবাসের ইকোনোমিক কাউন্সিলরকে ০৮ মে তারিখে বিবিএ অফিসে আমন্ত্রণ করে এনে ঈজঈঈ’র চিঠি দেখানো হলে তিনি জানান যে, চিঠিতে উল্লেখিত চীনা কর্মকর্তার নামের স্বাক্ষর চীনা ভাষার নকল স্বাক্ষর। ০৯ মে, ২০১২ তারিখে ঈজঈঈ সেতু কর্তৃপক্ষকে পত্র দিয়ে মূল সেতুর প্রাক যোগ্যতার আবেদন প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাদের স্থানীয় Venture International Limited এর এজেন্সিশীপ বাতিল করে। এতে প্রতিয়মান হয় যে, ঈজঈঈ-এর পক্ষে স্থানীয় এজেন্ট Venture International Limited CRCC এর একটি শাখা অফিসের মাধ্যমে বিভিন্ন জাল তথ্য পরিবেশন করেছে। ১৮ই মে, ২০১১ তারিখে পুনরায় ৫টি প্রতিষ্ঠানের প্রিকোয়ালিফিকেশনের সুপারিশ বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করা হয়। ঈজঈঈ প্রাক্্ যোগ্যতার প্রতিযোগীতা হতে নাম প্রত্যাহার করায় বিশ্বব্যাংক আর তাদের পক্ষে চাপ প্রয়োগ করেনি। 
নদীশাসন কাজের প্রি-কোয়ালিফিকেশন টেন্ডার ২৪ জুলাই, ২০১০ তারিখে আহবান করা হয়। টেন্ডার কমিটি ৬টি প্রতিষ্ঠানকে প্রি-কোয়ালিফিকেশনের মূল্যায়ন প্রস্তাব ২৪ ডিসেম্বর, ২০১০ তারিখে বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করে। বিশ্বব্যাংক আরও ২টি চীনা প্রতিষ্ঠানকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করতে বলে। ডিজাইন পরামর্শক ও মূল্যায়ন কমিটি বিশ্বব্যাংকের এ প্রস্তাবেও সম্মত হয়নি। অক্টোবর পর্যন্ত নদীশাসন কাজের প্রি-কোয়ালিফিকেশন চূড়ান্ত করা যায়নি। উল্লিখিত ২টি প্যাকেজে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ গ্রহণ না করার কারণে বিশ্বব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ মৌখিকভাবে যোগাযোগ মন্ত্রীকে দোষারোপ করেন, যদিও এব্যাপারে যোগাযোগ মন্ত্রীর কোন কিছু করার ছিলনা। ঈজঈঈ’র স্থানীয় এজেন্ট ঠবহঃঁৎব ওহঃবৎহধঃরড়হধষ খরসরঃবফ যোগাযোগ মন্ত্রী কর্তৃক মূল্যায়ন কমিটিকে প্রভাবিত করা হয়েছে মর্মে বিশ্বব্যাংকের নিকট অভিযোগ করে মর্মে অনেকে ধারণা করেন। 
কনষ্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্সির (ঈঝঈ) প্রস্তাব মূল্যায়ন বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। এ প্যাকেজের জন্য প্রকল্পে প্রায় ৩৪৫ কোটি টাকা (৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ধরা আছে। বিশ্বব্যাংকের গাইড লাইন অনুসরণ করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য ০৮.১২.২০০৯ তারিখে ঊীঢ়ৎবংংরড়হ ড়ভ ওহঃবৎবংঃ (ঊঙও) আহবান করা হলে প্রস্তাব দাখিলের শেষ দিন (১৪.০১.২০১০) পর্যন্ত ১৩ টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দাখিল করে। আমি সেতু বিভাগে যোগদান করার পূর্বে গঠিত প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটি ০৫টি প্রতিষ্ঠানকে ‘শর্ট লিস্টিং’ করে। এ ০৫টি প্রতিষ্ঠান হ’ল :
1. High Point Rendel Ltd. U. K. 2. Oriental Consultants Company Ltd, Japan. 3. Halcrow Group Ltd. UK 4. SNC- Lavalin International INC. UK, Canada. 5. AECOM Newzealand Ltd. প্রতিটি কোম্পানীর সাথে ৩/৪ টি করে দেশী-বিদেশী কোম্পানী জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানী হিসেবে সংযুক্ত রয়েছে। নির্ধারিত সময়সীমা অর্থাৎ ৩০.০৬.২০১০ তারিখ পর্যন্ত শর্ট লিস্টেড ০৫টি প্রতিষ্ঠানই ‘দুই ইন্্ভেলপ’ পদ্ধতিতে কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব দাখিল করে। জুলাই মাসেই আমার নেতৃত্বে গঠিত কমিটি মূল্যায়নের কাজ শুরু করে। প্রসঙ্গক্রমে বলা ভাল যে, কমিটিতে আমি একমাত্র নন্্টেকনিক্যাল ব্যক্তি। অন্যান্য সকলেই ইঞ্জিনিয়ার এবং অনুরূপ প্রস্তাব মূল্যায়নে অভিজ্ঞতা রয়েছে মর্মে দাবী করেন। ২/১টি সভা অনুষ্ঠানের পরই আমি মূল্যায়নের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বুঝতে পারি। তবে প্রায় ৪ মাস অতিক্রান্ত হলেও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় তেমন অগ্রগতি হয়নি। এর কারণ সকলেই দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। মূল্যায়ন করার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। বেশ কয়েকজন সদস্য বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপন করতে থাকেন। কয়েকজন সদস্যের মতামত ও কথাবার্তায় বুঝা যায় তারা একটি বিশেষ কোম্পানীকে সবচেয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন বিবেচনা করছেন। বুয়েটের অধ্যাপকসহ অন্য কয়েকজন সদস্য ভিন্ন মত পোষণ করেন, তবে তারা কেউই চূড়ান্ত মূল্যায়ন করে নম্বর প্রদান করেননি। আমি সময় বেঁধে দিলাম যে, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ২টি সভা করে সম্পূর্ণ মূল্যায়ন চূড়ান্ত করে বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করতে হবে। ইত্যবসরে দেখা যায় কয়েকজন সদস্য তাদের মূল্যায়ন ই-মেইলে আদান-প্রদান করছে। আমার ই-মেইলেও ২/১টি মূল্যায়ন পাওয়া যায়। উক্ত মূল্যায়ন খুবই পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। আমি দেখলাম, অন্য সদস্যগণ সুষ্ঠুভাবে মূল্যায়ন করলেও চূড়ান্ত মূল্যায়ণে স্বচ্ছতা আসবে না। সেকারণে মাননীয় মন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে আমি সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নি¤œরূপ একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করি :
১। অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, সাবেক অধ্যাপক, বুয়েট -আহবায়ক
২। অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত, ভিসি ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয় – সদস্য
৩। ড. মোঃ সফিউল্লাহ, সাবেক ভিসি, বুয়েট – সদস্য
৪। ড. দাউদ আহমেদ, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক মনোনিত পরামর্শক ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা – সদস্য 
৫। কাজী ফেরদৌস, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, পদ্মা সেতু প্রকল্প – সদস্য সচিব

উক্ত কমিটি পূর্বের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারে এবং নতুনভাবে মূল্যায়নের কাজ শুরু করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এ মূল্যায়নে ডিজাইন কন্্সালটেন্ট কর্তৃক কমিটিকে সহায়তার সুযোগ নেই, কারণ অঊঈঙগ নিজেই ঈঝঈ এর একজন প্রতিদ্বন্দ্বি। মূল্যায়ন কমিটি বেশ কয়েকটি সভায় মিলিত হয়ে তাঁদের কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন ডিসেম্বর, ২০১০ মাসে বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করে। বিশ্বব্যাংক ১০.০৩.২০১১ তারিখে উক্ত কারিগরি মূল্যায়নের উপর সম্মতি প্রদান করে। কারিগরি মূল্যায়নে HPR, Uk প্রথম স্থান, SNC-Lavalin, Canada দ্বিতীয় স্থান, AECOM, Newzealand তৃতীয় স্থান, Halcrow, UK চতুর্থ স্থান এবং Oriental, Japan পঞ্চম স্থান অধিকার করে। উক্ত কারিগরি মূল্যায়ন অনুমোদনের সময় বিশ্বব্যাংক বিবিএকে এমর্মে অনুরোধ করে যে, আর্থিক মূল্যায়নের স্কোর যোগ করে চূড়ান্ত মূল্যায়নের সময় মূল্যায়ন কমিটি যাতে সর্বোচ্চ নম্বরধারী প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত পরামর্শক সদস্যদের (Manpower) জীবনব”ত্তান্ত ভালভাবে পরীক্ষা কওে বিশ্বব্যাংক জানায়। বিশ্বব্যাংকের সম্মতি প্রাপ্তির পর মূল্যায়ন কমিটি আর্থিক প্রস্তাব উন্মুক্ত করে। বিশ্বব্যাংকের গাইড লাইন অনুযায়ী কারিগরি মূল্যায়নের উপর ৯০% এবং আর্থিক প্রস্তাবের উপর ১০% ‘ওয়েটেজ’ রাখা হয়। কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন ফলাফল সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সামনে ঘোষণা করা হয়। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনবৃত্তান্ত যাচাইকালে বেশ কিছু ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্তে কিছু অসংগতি পাওয়া যায়। ঐধষপৎড়ি আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে তাদের প্রস্তাবের অসংগতি স্বীকার করে। উল্লিখিত অসংগতি দূর করতে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি প্রস্তাব (SNC-Lavalin Ges Halcrow) আংশিক পুনঃমূল্যায়ন প্রয়োজন হয়। উক্ত মূল্যায়নে কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাবের গাণিতিক ভুল ও জীবন-বৃত্তান্তে উল্লেখিত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা পরীক্ষা করা হয়। কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব যুক্ত করে সার্বিক মূল্যায়নে এসএনসি-লাভালিন প্রথম হয়। এর কারণ কারিগরি মূল্যায়নে প্রথম স্থান অধিকারী ঐচজ-এর আর্থিক দর এসএনসি-লাভালিনের প্রায় দ্বিগুণ। মূল্যায়ন কমিটির চূড়ান্ত মূল্যায়ন আগস্ট, ২০১১ মাসে বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী কর্তৃক উক্ত মূল্যায়নের বিষয়ে লিখিত একটি নিবন্ধ গত ০২ জুলাই, ২০১২ তারিখ দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত নিবন্ধে তিনিও এ বিষয়ে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।

যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রসঙ্গ
তৎকালীন মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের কার্যক্রম বিষয়ে আমি কিছু উল্লেখ করতে চাই। সেতু বিভাগে যোগদান করার পর থেকেই আমি তাঁকে একজন ভদ্র, সদালাপী, অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী ব্যক্তি হিসেবে পেয়েছি। তিনি একদিন আমাকে বলেন, “আমরা যখন নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেই, সেদিন শপথ অনুষ্ঠান শেষে গাড়িতে উঠার সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বলেন, ‘আবুল, পদ্মা ব্রিজ করার দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে। তখনই আমি বুঝতে পারি আমাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হবে। এরপর থেকে আমি নিরলসভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হই”। বাস্তবেও তার কার্যকলাপে আমি তাঁর সদিচ্ছা ও নিরলস কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করেছি। যখনই তাঁকে বলতাম, ‘স্যার, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নথি আছে, আপনার অনুমোদনের প্রয়োজন; তখনই তিনি সেতু বিভাগে চলে আসতেন এবং নথি সই করে দিতেন। এমনকি বাসায় চলে গেলেও অসময়ে ফোন করলে বলতেন, “আমি কি আসবো?” পদ্মা সেতুর প্রতিটি স্টেজেই কাজের অগ্রগতি মনিটর করতেন, প্রয়োজনে মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করতেন। বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সিনিয়র কর্মকর্তা, রাষ্ট্রদূত, সাংবাদিক প্রমুখকে নিয়ে চলমান কাজ পরিদর্শন করেছেন। মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজের অগ্রগতি সম্পর্কে ডিজাইন পরামর্শক ও মূল্যায়ন কমিটির সাথেও আলোচনা করতেন। কমিটি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁকে খুটিনাটি ব্যাখ্যা করত। মন্ত্রী মহোদয় মূল্যায়ন কমিটির সদস্যগণ বিশেষ করে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। মূল্যায়নের বিষয়গুলো এমন টেকনিক্যাল ধরণের যে, মাননীয় মন্ত্রী কিংবা অন্য কারো মূল্যায়ন প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার কোন সুযোগ ছিল না। আমাদের কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাগণ মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রীর কর্মতৎপরতার প্রশংসা করেন, তবে কেউ কেউ ধারণা করেন, তিনি প্রকল্প পরিচালকের মাধ্যমে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে চেষ্টা করেন। এবিষয়টি তাঁরা আমাকেও বলেন। তাঁরা জানতেন যে, সৈয়দ আবুল হোসেন ‘সাকো ইন্টারন্যাশনাল’ নামক একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী। তাদের ধারণা, পদ্মা সেতুর কাজ পেতে আগ্রহী কোম্পানীগুলির সাথে মন্ত্রীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ থাকতে পারে। বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়া বা বিভিন্ন সংবাদপত্রে মাননীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালেখি হতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের হেড্্ কোয়ার্টারের কর্মকর্তাগণও বিষয়টি অবহিত হন। সংবাদপত্রে এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে লিখিত প্রতিবাদে মাননীয় মন্ত্রী জানান যে, সরকারের মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, যদিও তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ সে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে বহাল রয়েছেন। যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে নিয়োজিত হওয়ার পর থেকে মন্ত্রীর এ প্রতিষ্ঠানটি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কোন প্রকল্প কিংবা কোন পূর্ত কাজ বা পরামর্শক কাজে অংশ গ্রহণ করেনি। এদিকে প্রকল্প পরিচালক জনাব রফিকুল ইসলামের পূর্বতন চাকরিস্থল সড়ক ও জনপথ বিভাগে কথিত দুর্নীতির বিষয়েও সংবাদপত্রে ব্যাপক লেখালেখি শুরু হয়। পদ্মা প্রকল্পের পরিচালক নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে তিনি সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। ২০০৭-২০০৮ সালে কেয়ারটেকার সরকারের সময় সামরিক বাহিনী অন্যান্য প্রকৌশলী কর্মকর্তার সাথে তাঁকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করে। তিনি বেশ কিছুদিন জেলে ছিলেন। সংবাদপত্রে আরও খবর পরিবেশিত হয় যে, তিনি তৎকালে গঠিত “ট্রুথ কমিশন” সমীপে হাজির হয়ে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা পেয়েছেন। এরূপ খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর জনাব রফিকুল ইসলাম প্রতিবাদ পাঠিয়ে জানান যে, তিনি ’ট্রুথ কমিশনে’ যাননি। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তার সাথে সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন, তবে পরবর্তীতে সসম্মানে ছাড়া পান। বিশ্বব্যাংকের ঢাকায় নিয়োজিত কর্মকর্তাগণ এবং প্রকল্পের টাস্ক টীম লিডার আমাকে জানান যে, এরূপ একজন আতœস্বীকৃত ও চিহ্নিত দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত করা ঠিক হয়নি। মাননীয় মন্ত্রীর সাথে এ বিষয়ে আলাপ করা হলে তিনি জানান যে, ‘লোকটি কাজ বুঝে এবং ব্রিজ নির্মাণে তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁর চেয়ে ভাল লোক আমি সড়ক বিভাগে কোথায় পাব? অধিকাংশ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।’

বিশ্বব্যাংকের সাথে সম্পর্ক, কথিত অভিযোগ ইত্যাদি
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের সাথে মতদ্বৈততা হলেও আমার সাথে বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্পর্ক ছিল খুবই নিবিড়। এই সুসম্পর্কের কারণে সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে আমার ২০১০ এর এপ্রিল থেকে ২০১১ এর জুলাই পর্যন্ত কয়েকটি ভ্রমণে বিশ্বব্যাংকের ওয়াশিংটন সদর দপ্তরে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের নিকট থেকে প্রকল্পের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আদায় করা সম্ভব হয়। ২০১০ সনের এপ্রিল মাসে মাননীয় অর্থ মন্ত্রীসহ বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জয়েলিক এর সাথে দেখা করে বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রাপ্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করেন। 
মূল সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০০০ মিলিয়ন ডলার, নদী শাসন প্যাকেজের সম্ভাব্য ব্যয় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার এবং সুপারভিশন কনসালটেন্সি ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু শেষোক্ত প্যাকেজের কাজ পাওয়ার জন্যই প্রতিযোগীতা বেশী লক্ষ্য করা গিয়েছে। শুরুতেই ১টি কোম্পানীকে ‘ফেবার’ করার চেষ্টা আঁচ করতে পেরে মূল্যায়ন কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে পরবর্তী কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির মূল্যায়ন চলাকালীন সময়ে একটি মহল ই-মেইলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ডিপার্টমেন্টের সাথে যোগাযোগ করতে থাকে। ইন্টিগ্রিটি বিভাগের কর্মকর্তাদের দেয়া ই-মেইলের কপি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট জাপানী একজন কর্মকর্তার কাছেও পাঠানো হয়। শুরু থেকে না হলেও কয়েক মাস পর থেকে উক্ত ই-মেইলের কপি বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে আমার ই-মেইলে ফরওয়ার্ড করা হয়। দেখা যায় যে ২টি প্রতিষ্ঠান (এসএনসি-লাভালিন ও এইচপিআর) কারিগরি মূল্যায়নে বেশী নম্বর পেতে পারে বলে ঐ মহলটি আশংকা করে সেই প্রতিষ্ঠান ২টির বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকে। কোন কোন মেইলে তারা ঐধষপৎড়-িএর ও দোষত্র“টি তুলে ধরে। মূল্যায়ন কমিটির বিভিন্ন সদস্য, মন্ত্রী, সচিব এমনকি বিশ্বব্যাংকের মনোনীত পরামর্শক ও টাস্ক টীম লিডারকে জড়িয়ে বানোয়াট তথ্য প্রদান করে। উক্ত ই-মেইলে আদান-প্রদানের সাথে পদ্মা প্রকল্পের কোন কর্মকর্তা জড়িত থাকতে পারে মর্মে সহজেই অনুমান করা যায়। ইন্টিগ্রিটির কয়েকজন কর্মকর্তা ই-মেইল আদান-প্রদানে ও তথ্য সংগ্রহে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠে। ২০১১ সনে পদ্মা সেতুর গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমি ২ বার বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে গমন করি। প্রথমবার (মার্চ-এপ্রিল, ২০১১ মাসে) টাস্ক টীম লিডারকে জানাই যে, ইন্টিগ্রিটির জুনিয়র ২ জন কর্মকর্তা যেভাবে ই-মেইলের মাধ্যমে একটি ভুল বিষয়ের উপর যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ করছে তা নিরসনের জন্য আমি তাদের সাথে কথা বলতে চাই। টাস্ক টীম লিডার ইন্টিগ্রিটি বিভাগের সাথে যোগাযোগ করলে তারা বলে যে, এপর্যায়ে তারা আমার সাথে কোন কথা বলবেনা। দ্বিতীয়বার (জুন-জুলাই, ২০১১ মাসে) ভ্রমণে মাননীয় অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান নেতৃত্ব দেন। উল্লেখ্য ড. মসিউর রহমান ইতোমধ্যে পদ্মা প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি এড্্ভাইজার নিযুক্ত হয়েছেন। অনিয়মের কোন অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রতিকারের জন্য তাঁকে জানানোর কথা। এ সফরে তিনি ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠক করেন; কিন্তু কথিত অভিযোগ সমূহের বিষয়ে বৈঠকে কোন আলোচনা হয়নি। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট, মিস ইসাবেল গুরায়রা এর সাথে আমাদের সাক্ষাতের সময় আমি এ বিষয়টি পুনরায় উত্থাপন করি। তিনি জানান, ইন্টিগ্রিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে রিপোর্ট করেন। যে পদ্ধতিতে তারা কোন বিষয়ের তদন্ত করে তাতে আমাদের কোন কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে তাদের তদন্ত চলাকালীন সময়ে পদ্মা সেতুর কাজ থেমে থাকবে না। কাজ এবং তদন্ত – এ দু’টি ইস্যু সম্পূর্ণ পৃথক। শুধু ওয়াশিংটনে নয়, আমি ঢাকাস্থ কান্ট্রি ডাইরেক্টরকেও বিষয়টি অবহিত করি। পরবর্তীতে খবর পেলাম ইন্টিগ্রিটির কর্মকর্তাগণ ঢাকায় এসে অভিযোগকারীদের সাথে দেখা করেছে। বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় কর্মকর্তাগণকে আমি বললাম, ‘ইন্টিগ্রিটি যদি তদন্ত করে তবে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সকলেরই মতামত নিতে হবে’। তারা জানালেন, “ইন্টিগ্রিটি বিভাগের কাজের ব্যাপারে আমাদের বলার কিছু নেই”। জুলাই-আগস্ট, ২০১১ মাসের দিকে আমাকে জানানো হ’ল বিশ্বব্যাংক ইন্টিগ্রিটি সুপারভিশন কনসালটেন্সি ছাড়াও মূল সেতুর টেন্ডারের অনিয়মে মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও তদন্ত করছে। একপর্যায়ে তারা মাননীয় মন্ত্রীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালেও গমন করেন। তাদের অভিযোগ ‘এ প্রতিষ্ঠানটি প্রাক্্ যোগ্যতা বহির্ভূত ঈযরহধ জধরষধিু ১৫ ইঁৎবধঁ নামক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে তাদের প্রাক্্ যোগ্য করে দেয়ার প্রস্তাব দেয়’। পরবর্তীতে শুধু ১৫ ইঁৎবধঁ নয়, প্রাক্্ যোগ্য ০৫টি প্রতিষ্ঠানের সাথেও নাকি মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের লোক গিয়ে দেখা করে। এক পর্যায়ে কান্ট্রি ডাইরেক্টর আমাকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ গিয়েছে। তাঁকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে রেখে এ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। আমি বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে তাঁকে অবহিত করতে চাই’। আমি কান্ট্রি ডাইরেক্টরকে জানাই যে, আমরা যে পদ্ধতিতে পদ্মা সেতুর কাজ করে যাচ্ছি সে পদ্ধতিতে মাননীয় মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই। তিনি বর্তমান সরকারের একজন প্রভাবশালী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক তাঁকে সরানোর প্রস্তাব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভালভাবে নিবেননা। কান্ট্রি ডাইরেক্টর আমাকে বলেন, মন্ত্রিসভায় রদবদল করে তাঁকে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিলেও হবে। আমি মাননীয় মন্ত্রীর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ভুল ধারণা নিরসনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। সেপ্টেম্বর, ২০১১ মাসে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ইন্টিগ্রিটির একজন পরিচালকসহ বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে সরকারের সাথে দেখা করে আনুষ্ঠানিকভাবে কথিত দুর্নীতির চেষ্টার বিষয়টি অবহিত করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের সময় মাননীয় অর্থ মন্ত্রী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২ জন উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হতে দুর্নীতির স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থানের জন্য বলা হয়। ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন যে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আসন্ন সভায় প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্ক গেলে সেখানে প্রমাণ উপস্থাপন করা হবে। তারা প্রধানমন্ত্রীর নিকট নিউইয়র্কে কোন তথ্য প্রমাণ দেয়নি। তবে মাননীয় অর্থ মন্ত্রী একই সময়ে ওয়াশিংটন গেলে তাঁর নিকট একটি চিঠি দেওয়া হয়। উক্ত চিঠিতে মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে বটে, কিন্তু কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ দেয়া হয়নি। বিশ্বব্যাংক বিষয়টি দুদক এর মাধ্যমে তদন্ত করার অনুরোধ করে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রিন্ট মিডিয়ায় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তুমুল লেখা-লেখি শুরু হয়। বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি ও পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণা দেয়। সেতু বিভাগ তখন মূল সেতুর প্রি-কোয়ালিফিকেশনের পর টেন্ডার আহবানের জন্য প্রস্থত। আর সুপারভিশন কনসালটেন্সির চূড়ান্ত মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংকের বিবেচনাধীন। এ পর্যায়ে বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রচারিত হয় যে, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতায় রয়াল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এসএনসি-লাভালিনের অফিসে হানা দিয়ে তাদের কাগজপত্র জব্দ করে। যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মিডিয়ার অপপ্রচারে নতুন মাত্র যোগ হয় যখন উইকিলিকস্্ এর ফাঁস করা ১টি চিঠিতে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়াটি তাঁকে ‘লেস দ্যান অনেস্ট’ আখ্যায়িত করেন। মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে নিজের সততা ও স্বচ্ছতার কথা বলেন, কিন্তু মিডিয়াতে তা গ্রহণযোগ্য হয়না। সে সময়ে মাননীয় মন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আমি পিআইডিতে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করি। আমি পরিস্কারভাবে উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরি এবং জানাই, যেভাবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে সেতুর কাজ চলে আসছে তাতে মাননীয় মন্ত্রী কেন, তাঁর উর্দ্ধের কোন কর্তৃপক্ষেরও এখানে হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া যেখানে ঋণের কোন টাকাই ছাড় হয়নি সেখানে দুর্নীতির কোন প্রশ্নই আসেনা। আমার সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্য পরদিন মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায়। একই সময়ে আমি কয়েকটি টিভি চ্যানেলেও পদ্মা পকল্পের কাজে আমাদের স্বচ্ছতা এবং কতিপয় স্বার্থান্বেষি ব্যক্তির বেনামি অভিযোগের বিষয়টি তুলে ধরি এবং বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই মর্মে জোর দিয়ে উল্লেখ করি। সে সময়ে দেশে কোন কোন মহল আমাকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক তো আপনার (সচিবের) বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করছেনা। আপনি মন্ত্রীর পক্ষে সাফাই গাচ্ছেন কেন?’ আমি বললাম, প্রকল্পের কাজ যে স্বচ্ছতার সাথে সম্পাদিত হচ্ছে কোন অনিয়ম হয়নি আমি তা-ই জনসমক্ষে তুলে ধরছি। আমাদের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে মন্ত্রী কেন, আমরা সকলেই দায়ী হবো। তাছাড়া মাননীয় মন্ত্রীর সাথে কাজ করে আমি দেখছি এপর্যন্ত তিনি আমাদের কোন কাজে হস্তক্ষেপ করেননি, কোন অনৈতিক বিষয়ে সুবিধা দাবী করেননি। ভবিষ্যতে কিভাবে এ থেকে ফায়দা নিবেন তা আমার জানা নেই। তবে তাঁর ব্যক্তিগত চালচলন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা থেকে বুঝা যায় এ সরকারের মন্ত্রী হওয়ার পূর্ব থেকেই তিনি বেশ সম্পদশালী। কাজেই মন্ত্রীত্ব করে সম্পদ কামানোর জন্য তাঁর হাপিত্তেস আমার চোখে পড়েনি। তিনি প্রচলিত ধ্যানধারনার রাজনীতি করেননা। সে জন্য তাঁর দলের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিও তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফোরামে এমনকি সংসদেও বক্তব্য প্রদান করেছেন। যোগাযোগ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মিডিয়ার অপপ্রচার তুঙ্গে উঠে যখন দীর্ঘ দেড়মাস বৃষ্টিতে পানি জমে সারা দেশের রাস্তা-ঘাট তথা সড়ক যোগযোগ ভেঙ্গে পড়ে, যানবাহন ধর্মঘট হয় এবং দেশে বেশকিছু সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। একটি দুর্ঘটনায় আরিচা থেকে আসার পথে সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীর এবং চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ নিহত হন। উক্ত দুর্ঘটনা যদিও খারাপ রাস্তার কারণে হয়নি, তথাপি দেশের বুদ্ধিজীবি মহল মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবীতে সোচ্চার হন এবং ঈদের দিনেও শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে তাদের দাবীর স্বপক্ষে বিক্ষোভ করেন। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে যতই অভিযোগ থাকুক, দুর্নীতি কিংবা অদক্ষতার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া সরকার কোন ব্যবস্থা নিতে চাইলেন না। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে অফিসের স্বার্থ বিরোধী কাজের কিছু নমুনা পাওয়ায় মাননীয় মন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের প্রস্তাব করি। অবশেষে অক্টোবর, ২০১১ মাসের প্রথমদিকে তাঁকে প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে সরানো হয়। একই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমাকে সেতু বিভাগের সচিব পদ থেকে বদলী করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ এবং ওয়াশিংটনের কর্মকর্তাগণ এ বদলীর প্রেক্ষিতে বিস্মিত হন এবং মাননীয় অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ মহলে সেতু বিভাগ থেকে আমাকে বদলী না করার জন্য অনুরোধ করেন। অক্টোবরে বদলী করা হলেও মাননীয় অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগ মন্ত্রীর অনুরোধে আমি নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেতু বিভাগে দায়িত্ব পালন করি।

দূর্নীতির অনুসন্ধান ও পরবর্তী পরিস্থিতি
বিশ্বব্যাংকের পূর্বের প্রস্তাব ছিল জনাব আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরালেই সেতুর কাজ চালিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু পরবর্তীতে মন্ত্রীর পোর্টফলিও বদল করে তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার পরও তারা স্থগিত কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেনি। সরকারের উপরের মহল থেকে বিশ্বব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান বিষয়টি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জয়েলিকের হাতে। শোনা যায়, নীচের দিকে কিছু চেষ্টা হলেও জয়েলিকের অনিহার কারণে কাজ শুরু করা যায়নি। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেয় যে, কানাডিয়ান পুলিশ কর্তৃক এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সেতুর কাজ শুরু করা হবেনা। অক্টোবর, ২০১১ মাসে আমি সেতু বিভাগের সচিব থাকা কালীন বিশ্বব্যাংকসহ অন্যন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে পদ্মার কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার বিষয়ে কথা বলি। বিশ্বব্যাংকের যেসকল কর্মকর্তা আমাদের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন তাদের অভিমত এই যে, এপর্যন্ত প্রকল্পের যে কাজ হয়েছে তার স্বচ্ছতা সম্পর্কে আমাদের কোন অভিযোগ নেই। তবে আমরা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারিনা। এডিবি ও জাইকাসহ অন্যান্য সহযোগী সংস্থার কর্মকর্তাগণ উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দুঃখ প্রকাশ করেন। প্রকল্পের কার্যক্রমের মাঝ পথে অর্থ্যাৎ মূল সেতুর টেন্ডার আহবানের চূড়ান্ত মূহুর্তে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক কাজ বন্ধ করে দেয়া যৌক্তিক হয়নি মর্মে মত প্রকাশ করেন। তবে তারা এ-ও বলেন, বিশ্বব্যাংক যেহেতু প্রকল্পের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছে সেহেতু তাদের সিদ্ধান্ত আমাদেরও মেনে নিতে হয়। এদিকে সরকারের উপরের মহল বুঝতে পারে যে, পদ্মা সেতুর কাজে এ যাবৎ কোন দুর্নীতি হয়নি, তথাপি পদ্মা সেতুর কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের চাহিদা মাফিক মন্ত্রীকে বদল করা হল। তারপরও কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। এ পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়, যা বিশ্বব্যাংক-কে বিচলিত করে। সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকটি চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ এবং একজন মাননীয় উপদেষ্টার বিশ্বব্যাংক-এ গমন করে নেগোসিয়েট করা সত্ত্বেও কোন কাজ হয়নি। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংকের উত্থাপিত দুর্নীতির বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করে। তদন্তে মূল সেতুর বিষয়ে মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রীর কথিত দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্টতার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দুর্নীতি দমন কমিশন বিশ্বব্যাংকেও তাদের রিপোর্ট প্রেরণ করে। তবে সুপারভিশন কনসালটেন্সি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য না দেয়ার কারণে এবং বিশ্বব্যাংকে চিঠি লিখে সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়ার কারণে এর তদন্ত শেষ করা সম্ভব হয়নি। বিশ্বব্যাংক জানায় যে, নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ও তথ্য দিতে বিশ্বব্যাংক অপারগ। এ বছরের এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের নিকট একটি চিঠি লিখে এবং কনসালটেন্সি প্রদানের ক্ষেত্রে কথিত দুর্নীতির সাথে জড়িত কতিপয় সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে। এবারের চিঠিতে অভিযোগের তীর আমার প্রতিও বর্ষিত হয়। চিঠির কপি দুর্নীতি দমন কমিশনেও দেওয়া হয়। উক্ত চিঠিতেও দুর্নীতির কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। শুধুমাত্র এসএনসি-লাভালিনের কেস-এ কানাডিয়ান পুলিশের কাছে তথ্য আছে মর্মে এবং আরও কিছু সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য আছে মর্মে উল্লেখ করা হয়, যদিও সেসকল সূত্রের নাম প্রকাশ করা হয়নি। পত্রের সাথে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কিছু করণীয় নির্ধারণ করে দেয়। বিশ্বব্যাংকের সবগুলো দফা সরকারের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয় বিধায় সরকার যতটুকু মানা সম্ভব ততটুকু মেনে নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে নেগোসিয়েশন অব্যাহত রাখে। এ পর্যায়ে গত ২৯ জুন, ২০১২ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জয়েলিক-এর কার্যকালের শেষ দিকে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে একটি প্রেস নোট জারি করে। উক্ত প্রেস নোটটির ভাষা এবং অভিযোগ বাংলাদেশের জন্য খুবই বিব্রতকর ও অপমানজনক। বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যে আমার দৃষ্টিতে বেশকিছু অতিরঞ্জন ও অসত্য তথ্য দেয়া হয়েছে। বিগত সেপ্টেম্বর, ২০১১ মাসে দু’টি ইন্্ভেষ্টিগেশনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া হয়েছে মর্মে প্রেসনোটে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা একেবারেই সত্য নয় যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। এপ্রিল, ২০১২ মাসে ‘ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ ঈড়হংঢ়বৎরপু’-এর সুনির্র্দিষ্ট তথ্য দিতে না পারলেও কতিপয় ব্যবস্থা নিতে বলে যা একটি সার্বভৌম দেশের নিরপেক্ষ ইনষ্টিটিউশনের পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। তারা কথিত ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটি দেয়ার কথা বলে এবং দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংকের পূর্ণ খবরদারী করার ক্ষমতা চায় যা দুদক আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সরকার মনে করে যে, সরকারি কর্মকর্তাগণ সুনির্দিষ্ট আইন, বিধি ও নিয়মের অধীনে প্রজাতন্ত্রের কাজে নিয়োজিত। তদন্ত ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি ছাড়া কাউকে বিশ্বব্যাংকের কথায় ছুটি দেয়া বা বিদায় করা অযৌক্তিক, যেখানে পুরু অভিযোগটিই প্রশ্নবিদ্ধ। তাছাড়া মন্ত্রীদের বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়ার কোন বিধান নেই। সেক্ষেত্রে মন্ত্রীকে অপসারণ বা পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে। সরকারের উচ্চ মহলের সাথে নেগোসিয়েশন চলাকালে হঠাৎ করে ঋণ চুক্তি বাতিল করার বিষয়টি স্বেচ্ছাচারিতার শামিল। 
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কানাডিয়ান পুলিশ যখন এসএনসি-লাভালিনের অফিস রেইড্্ করে তখন উক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানের বিগত কয়েক বছরের কার্যক্রম অভ্যন্তরিন নিরীক্ষার ব্যবস্থা করে। উক্ত নিরীক্ষায় এ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিগত কয়েক বছরে লিবিয়াসহ কতিপয় আফ্রিকার দেশে কিছু টহফড়পঁসবহঃবফ ঊীঢ়বহফবঃঁৎব অর্থ্যাৎ আর্থিক লেন-দেন খুঁজে পায়। অবশ্য বাংলাদেশে কোন অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উক্ত অসঙ্গতির প্রেক্ষাপটে সিইওকে পদত্যাগ করতে হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। উক্ত সিইও বাংলাদেশে পদ্মা সেতুতে এসএনসি-লাভালিন কর্তৃক প্রস্তাব প্রনয়ণ, জমা দেয়া কিংবা এত্্দবিষয়ে বাংলাদেশে এসে কোন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেননি। আমি আগেও উল্লেখ করেছি কনসালটেন্সির বাজেট ছিল মাত্র ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে এসএনসির প্রস্তাব ছিল ৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাদের জয়েন্ট ভেঞ্চারে ছিল আরও ২টি বিদেশী প্রতিষ্ঠান এবং ২ টি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান। প্রায় ৬ হাজার দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ জনবলের ৫ বছর ব্যাপি ব্রিজ নির্মাণ কার্যক্রমের তদারকির কাজ। এ প্রেক্ষাপটে তাদের দ্বারা মোটা অংকের ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব আমার কাছে একান্তই অমূলক মনে হয়েছে। কারণ প্রতিষ্ঠানটি এ প্রকল্প থেকে মুনাফা করতে না পারলে নিজের পকেট থেকে বাংলাদেশে টাকা দেওয়ার কথা নয়। মূলতঃ মোঃ ইসমাইল নামক একজন বাংলাদেশী কানাডিয় ইঞ্জিনিয়ার এসএনসি-লাভালিনের পক্ষে অন্যান্য জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ প্রকল্পে প্রস্তাব দাখিল করেন মর্মে জানতে পেরেছি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও একই পদ্ধতিতে বাংলাদেশে এসে তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রস্তাব দাখিল করে। এসকল প্রস্তাব দাখিলের পর দরদাতা সকল প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে সেতু বিভাগের পদ্মা প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে তাদের প্রস্তাবের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। বৃটেন, কানাডা ও জাপানের মান্যবর রাষ্ট্রদূতগণও মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রীর সাথে অনুরূপ উদ্দেশ্যে দেখা করেন। এসব সাক্ষাতের সময় আমরা তাদেরকে বলেছি যে, একটি নিরপেক্ষ মূল্যায়ন কমিটি রয়েছে যার মাধ্যমে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হবে। কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। ‘এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাগণ সচিব-মন্ত্রীর সাথে কতিপয় ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে দেখা করেন’ খবরের কাগজে এ ধরনের সংবাদ চাঞ্চল্যকর সংবাদ নয় বলে আমি মনে করি; কারণ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সিইও/পরিচালকগণও তাদের বাংলাদেশী এসোসিয়েটদের নিয়ে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। উল্লেখ্য, দরপ্রস্তাবের কারিগরি মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক কতৃক অনুমোদিত এবং এ বিষয়ে কারো কোন অভিযোগ নেই। যদি মূল্যায়ন সঠিক থাকে, সেক্ষেত্রে কোন বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টির অভিযোগই অবান্তর। 
রমেশ সাহা নামক এসএনসির কর্মকর্তা তাদের প্রস্তাবের সাথে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন না। বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায়, ইতিপূর্বে তিনি বাংলাদেশে ২/১ টি প্রকল্পে এসএনসির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। তার ‘আউট-পুট’ ও আচরণ সুবিধের নয় বিধায় তাকে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করতে চায় না। সেজন্যই উক্ত কোম্পানি প্রথমে তাকে এ প্রকল্পের প্রস্তাব প্রণয়ন ও দাখিলের সাথে যুক্ত করেনি মর্মে প্রতীয়মান হয়। জনাব ইসমাইলের সাথে তার সদ্ভাব ছিল না। জানা যায় কারিগরি মূল্যায়নে এসএনসি প্রথম হতে না পারায় রমেশ সাহা কৌশলে এর ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে ইসমাইলকে কারিগরী মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরপরই (এপ্রিল, ২০১১ এর প্রথম দিকে) চাকরি থেকে সরিয়ে দেয় এবং তার পরিবর্তে নিজে বাংলাদেশে এসএনসি’র প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হয়। উক্ত দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি তার উর্দ্ধতন কর্মকর্তা মি. কেভিন ওয়ালেস এর সাথে একবার বাংলাদেশে আসেন। তার আচরণ এবং কাজের সুনাম না থাকায় এসএনসি-লাভালিন কাজ পেলে তার নিয়োগ গ্রহণযোগ্য হবে না মর্মে মি. ওয়ালেসকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মি. ওয়ালেসও এতে সম্মত হন। এসএনসি-লাভালিনের অনুরূপভাবে সম্মিলিত মূল্যায়নে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী ঐধষপৎড়ি এর সিইও বাংলাদেশে এসে আমার সাথে দেখা করলে তাকেও জানানো হয় যে, কাজ পেলে এ প্রকল্পে যোগ্য লোকবল নিয়োজিত করতে হবে। মিঃ রমেশের ডাইরিতে বা নোটবুকে কি লেখা ছিল বা কাদের নাম পাওয়া গিয়াছে তা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে আমি মনে করি। সে কাকে কী ‘প্রস্তাব’ দিয়েছিল বা তাকে কে কী ‘প্রস্তাব’ দিয়েছিল তা তদন্তের পর বুঝা যাবে। উক্ত ভারতীয় বংশোদ্ভুত মি. রমেশ যদি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে ‘কমিশন’ দেয়ার কথা বলে নিজেই ঐ কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের পরিকল্পনা করে থাকে এবং সে কারণেই অসৎ উদ্দেশ্যে নিজের অপরাধ আড়াল করার জন্য বাংলাদেশী কারো নামে কিছু বলে, সঠিক প্রমাণাদি ছাড়া তা স্বতঃসিদ্ধ সত্য হিসেবে বিবেচনা করা আদৌ সুবিবেচকের কাজ নয়। দচ্চতার সাথে আমি বলতে পারি তার নোটবুকে আমার নাম থাকা অবান্তর, কারণ কোন বিষয় নেগোশিয়েট (?) করার জন্য আমার কোন ‘প্রতিনিধি’ নেই। মি. রমেশ সাহা সম্পর্কে আরো জানা গিয়েছে যে, তিনি ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা জরিপ কাজে এসএনসি’র স্থানীয় এসোসিয়েট ইপিসিকে তাদের প্রাপ্য টাকা সম্পূর্ণ পরিশোধ করেননি। উক্ত অর্থ রমেশ এসএনসি’র নিকট থেকে গ্রহণ করে নিজে আত্মসাৎ করেছে কীনা তা জানা দরকার।

পরিলেখ
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য; ই-মেইলে অভিযোগকারীগণ বিশ্বব্যাংকের টাস্কটিম লিডার এবং বিশ্বব্যাংকের মনোনীত মূল্যায়ন কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্যের বিরুদ্ধেও বলেছে আমাদের সাথে নাকি তাদের যোগসাজশ রয়েছে। কিন্তু এসএনসি-লাভালিনকে ‘কাজ পাইয়ে দেয়ার’ জন্য আমরা যদি দায়ী হই তবে যোগসাজসের জন্য তাদেরও দায় থাকা উচিৎ। উল্লিখিত ‘অপরাধের জন্য’ এমনকি মূল সেতু প্যাকেজে একটি অযোগ্য চীনা কোম্পানিকে ‘কোয়ালিফাই’ করার জন্য যারা চাপ প্রয়োগ করেছিল বিশ্বব্যাংক কি তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিয়েছে? 
একটি সরকারি কাজে যদি পক্ষপাতিত্ব বা দুর্নীতি সন্দেহ করা হয় তবে প্রথমে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট প্রতিকার চাওয়া কিংবা অভিযোগ করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যারা গোপনে ই-মেইলের মাধ্যমে বিশ্ব ব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি কর্মকর্তাদের নিকট দিনের পর দিন অভিযোগ করেছে তাদের উদ্দেশ্য ছিল পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ করে দেওয়া। প্রকল্পের টাস্ক টিম লিডার তার জুন ’১১ মাসের একটি ই-মেইলে এরূপ আশঙ্কাই করেছিলেন। ই-মেইলগুলো পর্যালোচনা করলেই বুঝা যাবে কীভাবে একটি স্বার্থান্বেষী মহল ইন্টিগ্রিটি অফিসারদেরকে প্ররোচিত করেছে। একইভাবে ইন্টিগ্রিটি বিভাগের কয়েকজন জুনিয়র কর্মকর্তা শুধুমাত্র অভিযোগকারীদের কথা শুনে, প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতার মূল্যায়ন বিচার না করে এবং আমাদের কাগজপত্র দেখে সত্যাসত্য যাচাই না করে সরাসরি কানাডিয়ান পুলিশের নিকট অভিযোগ করে, যা বিশ্ব ব্যাংকের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অভিযোগকারীগণের ব্যবহৃত ঢ়ধফসধথনৎরফমব@ুসধরষ.পড়স ও ঢ়ধফসধথনৎরফমব@ুধযড়ড়.পড়স এর অনুসন্ধানও অভিযোগকারীদের সঠিক পরিচয় উদ্ঘাটনপূর্বক বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। তাদের কারণে আজ বিশ্বব্যাংক কথিত দুর্নীতির অভিযোগ এনে বাংলাদেশের মুখে কালিমা লেপনের সুযোগ পেল। আর এদেশের এক শ্রেণীর মানুষও সত্যানুসন্ধান না করে তথ্য প্রমাণ বিহীন বিশ্বব্যাংকের দেয়া অভিযোগ সঠিক বলে প্রচার শুরু করে যা তথ্য সন্ত্রাসের সামীল। কিছু মিডিয়া ও জ্ঞানপাপী আলোচক আরও একধাপ এগিয়ে “ঘুষ দেয়া-নেয়ার কাল্পনিক গল্পও তৈরি করে ফেলে, যেখানে বিশ্বব্যাংক বা কানাডীয় কর্তৃপক্ষও লেনদেনের অভিযোগ করেনি। 
সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই যারা বিনা তদন্তে তাদেরকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলেন তাদের উদ্দেশ্যে বলব, ‘নিজের অবস্থান থেকে বিচার করবেন। আপনি যদি আমার জায়গায় থাকতেন তাহলে কি এরূপ অন্যায় আবদার মেনে নিতেন?’ আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ এবং সৎ জীবন যাপন করি ও দেশ প্রেম বজায় রেখে নিরপেক্ষভাবে সরকারি কাজ করি। বত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে যে সকল সচিব, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সহকর্মীদের সাথে কাজ করেছি তারা সকলেই আমার সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সাক্ষী। চাকরির শেষ পর্যায়ে এসে ইন্্শাআল্লাহ্্ পদস্খলনের আর সম্ভাবনা নেই।

লেখক পরিচিতি : মোঃ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এনডিসি, সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

সৈয়দ আবুল হোসেন : আপনাকে
মো. মোজাম্মেল হক খান
আমার সীমাবদ্ধতাকে মার্জনা করবেন। তখনও আমি আপনাকে ভালোভাবে চিনে উঠিনি। অথচ সারা কালকিনি উপজেলা আপনার গুণগানে মুখরিত। মাদারীপুর জেলাতেও তার দোলা লাগছে। ক্রমান্বয়ে তা দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করছে। আপনার এ সুখ্যাতির হাজারো কারণ থাকলেও তার অন্যতম মূল কারণ শিক্ষার উন্নয়ন ও বিস্তারের ক্ষেত্রে আপনার অনতিক্রম্য, অসামান্য অবদান বলেই আমার মনে হয়।

প্রিয় শিক্ষানুরাগী,
দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার অপরিসীম গুরুত্বের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এ চিরন্তন সত্য উপলব্ধিটুকু অনেকের চেতনায় থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে তা বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগের সম্মিলনটি তাদের অনেকের মধ্যেই থাকে প্রায় অনুপস্থিত। ফলে এ সকল উন্নয়ন ভাবনা বাস্তবায়নের মুখ দেখে না। এ ক্ষেত্রে আপনি অসাধারণ ও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কালকিনি উপজেলার অসংখ্য মসজিদ, স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসহ) স্থাপনে আপনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সমর্থন, মূলত আর্থিক অনুদানের ক্ষেত্রে আপনার মুক্তহস্ত এলাকার মানুষকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। ফলে শিক্ষানুরাগের যে অনুপম দৃষ্টান্ত আপনি স্থাপন করেছেন, তা শুধু মাদরীপুরবাসীদের জন্যই নয়, সারাদেশবাসীর জন্যও এটি একটি বিরল অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এ ক্ষেত্রে আপনার কাছাকাছি কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তির উদাহরণ আপাতত আমার জানা নেই। এ মুহূর্তে ছোট একটি ঘটনা মনে পড়ছে। তা হলো প্রায় দু’দশক আগে একবার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু আর্থিক সাহায্যের জন্য আপনার নিকট একটি আবেদন পত্র প্রেরণ করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে আপনি প্রার্থিত অর্থের কয়েকগুণ টাকা (টাকার অংক মনে করতে পারছি না বলে দুঃখিত) বেশি প্রদান করেও দারুণভাবে অতৃপ্তিতে ভোগেন। তখন আপনার আর্থিক সমস্যার কথা জানিয়ে প্রদত্ত অর্থ আপনার বিবেচনায় যথেষ্ট নয় বলে আক্ষেপ ও দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। এটি কারও আমি কোনো একটি লেখায় পড়েছিলাম। আমার স্মৃতি আমাকে আজকে এতটা বেকায়দায় ফেলবে অনুমান করতে পারলে পঠিত লেখাটি সযতেœ হেফাজত করতে পারতাম।

সদাচরণের মূর্ত প্রতীক,
সদাচরণের ক্ষেত্রে আপনি এক অনন্য মহান ব্যক্তিত্ব। জন্মগতভাবে আপনার ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক শিক্ষা এবং পরবর্তীকালে সামাজিকীকরণের অন্যান্য মাধ্যমে অর্জিত বিভিন্ন গুণের সমাহার আপনার চারিত্রিক মাধুর্যকে আরও বিকশিত করেছে। পদমর্যাদায় আপনার কাছেও নেই, এমন মানুষকে যে ভাষায় এবং আচরণে আপনি মোহাবিষ্ট করছেন তার দৃষ্টান্তও বিরল। আপনার অকল্পনীয়, অসাধারণ, মুগ্ধকর ব্যবহারের কৌশল ও সৌন্দর্য অবলোকন করার সুযোগ যারা পেয়েছেন তাদের অভিভূত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা আপনার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত কোনো ব্যক্তিকে (যাদেরকে আপনি চেনেন) অথবা গর্হিত অপরাধ করে ফেলেছেন এমন কাউকেও আপনি কটু কথা বলতে শেখেননি। কি করে কথার যাদুতে আপনি বিরুদ্ধাচারীকেও বশীভূত করেন তা দেখে তাজ্জব বনে যেতে হয়। আমার সৌভাগ্য, চাকুরির সুবাদে আমাকে প্রতিদিনই এগুলোর সাক্ষী হতে হচ্ছে। আপনার সাহায্য প্রার্থনার জন্য এসেছেন এমন দর্শনার্থীকেও সিঁড়ির/লিফটের গোড়া পর্যন্ত গিয়ে অভ্যর্থনা ও বিদায় জানানোর যে কাজটি আপনার নিত্যকার ঘটনাÑ তা আমার ২৮ বছরের চাকুরি জীবনে আর দ্বিতীয়টি চোখে পড়েনি।
সৌজন্য প্রদর্শন, শ্রদ্ধাবোধ, প্রটোকল এগুলো ঊধর্ক্ষগামী। যাদের থেকে এগুলো উৎসারিত, সেবা বা ত্যাগের আনন্দ ছাড়া বাকি সুফলগুলো বড়রাই ভোগ করেন। এখানেও আপনি ব্যতিক্রম। বয়স, পদমর্যাদা নির্বিশেষে, আপনি শুধু দাতা, ভোক্তা নন। ছোটদের প্রতিও স্বভাবসুলভ হাসি, আন্তরিকতা এবং যথোপযুক্ত শব্দসম্ভার প্রয়োগ করে আপনি পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াকে প্রাণবন্ত ও দীপ্তিমান করে তোলেন। ফলে সহযোগীদের কর্মস্পৃহা, পারস্পরিক সমঝোতা ও কর্মসহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে তা খুবই ফলদায়ক হয়। যার সুফল মন্ত্রণালয় ও আমরা প্রতিনিয়ত ভোগ করছি।
প্রিয় বীর মুক্তিযোদ্ধা,
আপনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ যে কাউকেই আপনি আন্তরিক দৃষ্টিতে দেখেন। তাঁদের সুযোগ সুবিধা ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে আপনার আকুলতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর হাতে আপনার জীবন প্রায় বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। তাদের নির্মম আঘাত আপনাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। আপনার সৌম্যকান্তি, মার্জিত আচরণ, সদা প্রফল্ল হাস্যময় মুখশ্রী সে ক্ষতকে আড়াল করে রাখলেও আপনার হাতের কনুইয়ে যে ক্ষত রাজাকাররা সৃষ্টি করে গেছে, তা আজীবন আপনাকে বহন করতে হবে। জানি এ জন্য আপনার প্রকাশ্য কোনো দুঃখবোধ নেই। তথাপি অতীত স্মৃতি রোমন্থনে গিয়ে যখন আপনি মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ফিরে যান তখন নিশ্চয়ই ক্ষণিকের জন্য হলেও আপনি বিষণœতার শিকার হন।

প্রিয় কর্মবীর,
কাজের ক্ষেত্রে উদয়-অস্ত পরিশ্রমের যে সর্বোচ্চ মানদণ্ড নির্ধারিত হয়ে আছে, তাও আপনি অতিক্রম করেছেন। এ কর্মগুণ, কর্মদক্ষতা, কর্মস্পৃহা, কর্মপ্রেরণাই আপনাকে এতটা পথ এগুতে সাহায্য করেছে। সকাল থেকে যে কর্মযজ্ঞে আপনি নিমজ্জিত হন, ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। মন্ত্রণালয়, রেলভবন, সেতুভবন, সংসদভবন এগুলো আপনার নিজস্ব কর্মপরিধি সহায়ক সংস্থা ও মন্ত্রণালয়। বোধ করি আপনিই একমাত্র মাননীয় মন্ত্রী যিনি সরকারি কাজের প্রয়োজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে যে কোনো স্তরের কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হন। কঠিন ও সময়সাপেক্ষ কাজও আপনার কার্যকর হস্তক্ষেপে হয়ে যায় সহজ ও অনায়াসসাধ্য। দিবারাত্রি কর্মমুখরতা আপনাকে উজ্জীবিত রাখে। সর্বক্ষণ আপনি থাকেন প্রাণবন্ত। আর তাই ক্লান্তিও আপনার কাছে পরাভূত হয়।

প্রিয় সুজন,
আপনাকে নিয়ে অসংখ্য মধুর স্মৃতি আমার মানসপটে। প্রতিটিই মুগ্ধকর, প্রতিটিই শিক্ষণীয় এবং উদ্দীপ্ত আবেদনে ভরপুর। সেবার বিদেশ যাচ্ছি। আমরা একই ফ্লাইটের যাত্রী। লক্ষ করলাম সকল যাত্রীরা একে একে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কুশল বিনিময় করছেন। আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। দেখলাম যিনি কুশল বিনিময় করছেন তিনি সৈয়দ আবুল হোসেন। তিনি সে আবুল হোসেন যিনি বিদেশ যাত্রাকালেও সাধারণ যাত্রীদের সাথে কুশল বিনিময় করতে ভোলেন না। তিনি সেই আবুল হোসেন আকাশপথেও যার আজন্ম লালিত বিনয় আর অমায়িকতার প্রকাশ থেমে থাকে না। প্রকৃত বিনয় ও নির্মল অমায়িকতা স্থান-কাল-পাত্র মেনে চলে না। এটি সর্বগামী এবং সার্বজনীন।
রাজনীতি, আমলা এবং সুশীল সমাজ-এর একটি সভা কিংবা ছোট্ট সমাবেশ হচ্ছে। সেখানে অনেকেই কুশলাদি বিনিময় কিংবা সভার প্রাসঙ্গিক আলাপচারিতায় ব্যস্ত। তন্মধ্যে একজনের উপস্থিতি অধিকতর উজ্জ্বল, আন্তরিকতাপূর্ণ এবং প্রশান্তিময়। সেই মহান ব্যক্তিটিও আপনি। এ কথা শুধু আমার নয়। আপনাকে, আমাকে উভয়কে চেনেন এমন বহুজনের। মাননীয় মন্ত্রী আপনাকে নিয়ে বিদগ্ধজনের এরূপ মূল্যায়ন কিংবা মন্তব্য আমার জন্য বরাবরই উপভোগ্য হয়। পোশাক-আশাকসহ অন্য যে কোনো পছন্দের বিষয়ে আপনার রুচির প্রশংসা নাÑহয় আমি নাই বা করলাম। এ ক্ষেত্রেও আপনি অতুলনীয়, মার্জিত এবং মানানসই।

মাননীয় মন্ত্রী,
আপনি দীর্ঘজীবন লাভ করুন। যতদিন বেঁচে থাকুন সুস্থ, সাবলীল ও কর্মক্ষম থাকুন। এ প্রার্থনা যতটা না আপনার জন্য, তার চেয়ে বেশি জরুরি দেশের সে সব মানুষের জন্য; যাদের কল্যাণে আপনার সমস্ত মেধা, কর্ম, শ্রম ও ত্যাগ নিবেদিত। তাদের স্বার্থেই আপনার মতো সেবাপরায়ণ দানবীর, শিক্ষানুরাগী, কর্মী পুরুষের জীবনকাল দীর্ঘায়িত হওয়া প্রয়োজন।
আপনাকে আমার অবিনাশী বিনম্্র শ্রদ্ধা, অকুণ্ঠ গভীর ভালোবাসা ও লাল গোলাপ শুভেচ্ছা। আপনি আমাদের প্রিয় মানুষ, একান্ত সুজন, সর্বসময়ের পরীক্ষিত বন্ধু। আপনার জয় হোক।

মো. মোজাম্মেল হক খান : সচিব, সড়ক ও রেলপথ বিভাগ, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়

বলতে চাই তারই কথা
ড. এম এ মাননান
সেই মানুষটিকে নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই, যার সম্বন্ধে অনেক কিছুই বলা হয়নি, যাকে নিয়ে কথা হয় বন্ধুমহলেÑ উচ্ছ্বসিত আড্ডায় যার নাম আসে সর্বাগ্রে চা-এর টেবিলে কিংবা কফি হাউজে। তাকে নিয়েই কিছু বলতে চাই, যাকে দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ’৭৩-৭৪-এ, টিসিবি’র আঙিনায় ৭৫-৭৭-এ, সাকো’র কর্ণধার হিসেবে ৭৮ থেকে, রাজনীতির মঞ্চে ৯১ থেকে, মন্ত্রীপরিষদে ৯৬ থেকে, পূর্ণাঙ্গ নেতৃত্বে ২০০৮ থেকে। তাকে নিয়েই বলতে চাই, যিনি একাধারে একজন একনিষ্ঠ কর্মী; যিনি শুধু ব্যবস্থাপনার ছাত্রই ছিলেন না বরং একজন সফল ব্যবস্থাপক এবং উদ্যোক্তা; যিনি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক পরিমণ্ডলে একজন উজ্জ্বল সাংগঠনিক নেতাই নন, পাশাপাশি একজন রাজনৈতিক নেতাও বটে; যিনি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে নামকরা লবিস্ট এবং নেগোশিয়েটর – যিনি আন্তঃরাষ্ট্রীয় বন্ধুত্ব স্থাপনে অগ্রনায়ক, যার স্বাক্ষর এশিয়ান অঞ্চলের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ফোরাম ‘বোয়াও’।
যাকে নিয়ে আরও বলতে চাই, সে-ব্যক্তিটি প্রচারবিমুখ একজন নীরব বন্ধু, ব্যক্তিগত আড্ডায় ঝলমলে হাসিমাখা উচ্ছল এক দীপ্তি, নিজ এলাকায় গরিব-দুঃখীর কাছে বিনম্র মায়াভরা ভালোবাসার প্রতীক, আপামর জনগণের সুখে-দুঃখে বিপদে-আপদে একজন দানশীল সহযোগী, প্রসন্ন চিত্তের ও নিরহংকারী বিত্তের সমাহারে একজন বিনয়ী সুহৃদ। তারই কথা বলতে চাই যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম, সততা, দক্ষতা, কর্মনিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শত-সহস্র লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, সফল উদ্যোক্তা হিসেবে সুধীজনের প্রশংসা কুড়িয়েছেন, তুখোড় ব্যবস্থাপনাবিদ হিসেবে দেশে-বিদেশে সুখ্যাতি পেয়েছেন এবং পরিশ্রমলব্ধ সম্পদ এলাকার শিক্ষার উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণে অকাতরে ব্যয় করেছেন।
আমি বলতে চাই, তারই কথা, যিনি সময়ের নিয়ামক, কর্মের নির্ঘণ্টে নিষ্ঠার বর্তিকা; প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি সেকেন্ড যার হিসেবের খাতায় পরম যতেœ সজ্জিত, চরম আদরে শানিত। যিনি প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগান নিজের মাধ্যমে দেশের জন্য, জাতির জন্য, রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের জন্য। আমি বলতে চাই তারই কথা যিনি কর্মের নিবিড় আলয়ে সময়সজ্জিত জীবন-হিসেবের অমূল্য খাতায় নিষ্ঠা নামক অধ্যায়ের অধ্যবসায় নামক পাতায় জ্বলজ্বল সার্থকে ফুটে ওঠা স্বপ্রতিষ্ঠিত এক অনুপম উদাহরণ। আমি তারই কথা বলছি সাফল্য যাকে আরও বহুদূর এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত করে, যিনি বড় হবার সাথে সাথে কৃতজ্ঞতার অসীম বৈভবে বৈচিত্র্যময় হতে হতে আকাশের চেয়েও বিশাল হয়ে উঠেছেন।
আমি স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে তারই কথা বলছি, যিনি বিনয়ের মোহনায় প্রশান্তির ঢেউ, মার্জিত রুচির উৎপ্রাসে উৎপ্রাসে ব্যক্তিত্বের রঙন আর প্রকৃতি উদার হৃদয়ের নিপুণ বিন্যাসে অনন্ত সহানুভূতির নন্দিত নায়ক। যিনি নিজের জন্য যেমন ভাবেন তেমনি ভাবেন সবার জন্য, দেশের জন্য, পরিবারের জন্য, আত্মীয়র জন্য; যার ভালোবাসায় রয়েছে সার্বজনীন আহক্ষানের নিত্য সংস্কার এবং প্রগতির আলয়ে সমৃদ্ধির বারতা। যিনি কর্মকে বরণ করেন উৎসব মুখরতায়, জীবনকে বরণ করেন কল্যাণের নবলতায়। আমি তারই কথা বলছি যিনি এমনভাবে কাজ করেন যেন অনন্তকাল বাঁচবেন আর এমন ব্যবহার করেন যেন এক মুহূর্তও সময় নেই আর।
আমি সেই মানুষটির কথা বলতে চাই যে মানুষটি অনেক উঁচুতে উঠেও গ্রামের মাটিময় পরিবেশের কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেননি, ভুলতে পারেন নি মাটির মানুষগুলোর কথা, আগামী প্রজন্মের কথা, দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের কথাÑ তাই তাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে গড়ে তুলেছেন কর্মমুখী ও কারিগরি ব্যবস্থাসহ একের পর এক অনেকগুলো কার্যকর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
আমি তারই কথা বলতে চাই যে, লোকটির সাথে কেউ একবার কথা বললে, যে লোকটির কাছে কেউ একবার গেলে, যে লোকটিকে কেউ একবার কাছে পেলে বিগলিত হয়ে যেতে হয় শ্রদ্ধায়, মোহিত হয়ে যেতে হয় কৃতজ্ঞতায়, অবনত হয়ে যেতে হয় কৃতজ্ঞতায়। আমি তারই কথা বলতে চাই- যে লোকটি মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দীপ্ত প্রত্যয়ে অবিনাশী প্রতীক, সৃষ্টির সেবায় সতত বৈপ্লবিক আর উদারতার মোহনায় বৃষ্টি বৃষ্টি সুর।
আমি বলতে চাই তারই কথা, যার মধ্যে বংশপরম্পরায় রয়েছে নির্মল ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইসলামিক চিন্তাধারায় বিধৌত ধর্ম-নিরপেক্ষ মনোবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুরভিত মন, মানব-কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ, সহানুভূতির নিদাঘ পরশ এবং পরিবার-বান্ধব সংসারি দিল। তিনি সে-ই, যিনি পারিবারিক জগতে নিষ্ঠাবান দায়িত্বশীল কর্তা, বিশ্বস্ত পতি, স্নেহশীল পিতা, সংসারি গুরুজন।
দ্বিধাহীন কণ্ঠে তারই কথা বলতে চাই, যিনি একজন মননশীল মানুষ, সৃজনশীল চিন্তাবিদ-চিন্তনে-লিখনে যার রয়েছে অগাধ ব্যুৎপত্তি। লেখায় যার সাবলীলতা ঈর্ষণীয়, বিষয় নির্বাচনে অনুপম বোদ্ধা। যার লেখায় পাওয়া যায় কান্নার সুর- যখন তিনি কালির আঁচড়ে বলেন স্বাধীনতার জনক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর লড়াকু জীবন আর দেশদ্রোহী ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে শহিদ হওয়ার কাহিনি। যার লেখনীর গুণে জীবন্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্্রষ্টা কোটি কোটি বাঙালির প্রাণ-পুরুষ সিংহ-হৃদয় ‘বাংলার মুজিব’-এর সংগ্রামী জীবন, তাঁর জীবনের বঞ্চনার কাহিনি, নৃশংসভাবে তাঁকেসহ তাঁর পরিবারের শাহাদাত-বরণের কথা। আমি তারই কথা উচ্চকণ্ঠে বলতে চাই, যার লেখায় দীপ্ত হয়ে উঠেছে বাংলার জনগণের চরম বিপদে সদা-সর্বদা সংগ্রামী মন নিয়ে আপোষহীন এগিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু-তনয়া সংগ্রামী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি যিনি প্রবল বিরূপতার মধ্যে থেকেও সততার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। আমি তারই কথা বিনা দ্বিধায় বলতে চাই যার শানিত লেখায় বাঙময় হয়ে উঠেছে বঙ্গজননী বেগম ফজিলাতুন্নেছার সংগ্রামময় পারিবারিক জীবন এবং শত কষ্টের মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর জেল-জীবনের সময়ে মাসুম সন্তানদের গড়ে তোলার ইতিকথা। শ্রেষ্ঠত্ব তার এখানেই, তার লেখার মধ্যে।
আমি বলতে চাই সে মানুষটির কথা, যে মানুষটির কাছে অহঙ্কারের সবগুলো উপাদান কানায় কানায় তবু সাদাসিধে, যিনি নিরহঙ্কারের ডালা হাতে বরণের প্রতীক্ষায় থাকেন উঁচু-নিচু, জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমক্ষে শ্রদ্ধায় শ্রদ্ধায়, প্রমুগ্ধ তপস্যায়। যিনি বড় হতে হতে এত বড় হয়ে গেছেন যে যার স্বকীয়তা সবার মাঝে একাকার হয়ে গেছে ত্যাগের অনুভবে, মহিয়ান হতে হতে মিশে গেছেন প্রকৃতির লাস্যে নান্দনিক স্বপ্নের বিভাময় হাস্যে।
একদিন হয়ত তিনি হারিয়ে যাবেন রাজনীতি থেকে, হারিয়ে যাবেন জীবন থেকে, হারিয়ে যাবেন সবার থেকে কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন তার প্রকাশিত নয়টি গ্রন্থের মধ্যে, এমন সব গ্রন্থ যার মধ্যে তিনি দেশকে তুলে এনেছেন, মূর্ত করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামকে, উজ্জীবিত করেছেন গণতন্ত্রকে; স্বাধীনতার স্রষ্টাকে প্রাপ্য মর্যাদা-সহকারে দেদীপ্যমান আলোতে এনেছেন এবং দেশ-মাতৃকার প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরে নিজকেও সম্মানিত করেছেন। তিনি বেঁচে থাকবেন তার গড়া সে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঝে যেগুলো হতে প্রতি বছর হাজার হাজার গরিব ও অসহায় ছাত্রছাত্রী প্রায় বিনা খরচে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দেশ ও জাতির বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হবার সুযোগ। তিনি বেঁচে থাকবেন সে সকল অসহায় নরনারীর মাঝে, যারা তার বদান্যতায় মরতে মরতে বেঁচে থাকার উপায় পেয়ে হাস্যে-লাস্যে আবার শুরু করেন নতুন জীবন। তিনি বেঁচে থাকবেন সে সকল মানুষের মাঝে, যারা তার চারিত্রিক মাধুর্য্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তারই মতো দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত হবার প্রয়াস পান।
আমি যার কথা বলতে চেয়েও বলা শেষ করতে পারিনি তিনি হলেন এক কালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনার কৃতি ছাত্র আমার সহপাঠী কালকিনির সৈয়দ বংশের কৃতিসন্তান, এনায়েতপুরের খ্যাতিমান পির বংশের জামাতা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন – আমাদের সুপ্রিয় আবুল।

ড. এম এ মাননান : অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কিছু স্মৃতি কিছু কথা
শফিক আলম মেহেদী
আমি তখন পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। কোনো এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় ক’বন্ধু কক্সবাজারের হোটেল শৈবালে জমপেশ আড্ডায় মত্ত ছিলাম। মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের টেলিফোন পেয়ে প্রথম জানতে পারি, ওই মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে বদলির কথা। মাত্র সাত-আট মাসের কর্মস্থল আমার ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে। যদিও এর আগে ঐ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। তবে এবারকার অভিজ্ঞতা ভিন্নতর। কর্মস্থল সবসময় প্রীতিকর হয় না। স্মৃতিও সতত সুখের নয়। তাপরও নির্দ্বিধায় বলতে পারি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে কাজ এবং কাজের পরিবেশ দুটোই ছিল উপভোগ্য ও আনন্দময়।
একটি মন্ত্রণালয়ের প্রধান চরিত্র হলেন মাননীয় মন্ত্রী। তাঁকে কেন্দ্র করেই মন্ত্রণালয়ের সবকিছু আবর্তিত হয়। যেখানে মাননীয় মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের সবাইকে আপন করে নেন, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বিরাজ করে এক কর্মমুখর ও প্রাণচঞ্চল পরিবেশ। মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের চারিত্রিক বিশালতা ও হৃদ্যিক কমনীয়তার কারণে আমরা সবসময় কর্মমুখর ও প্রাণচঞ্চল পরিবেশে কাজ করতে পেরেছি।
মার্চ থেকে অক্টোবর ২০০৯ আমার কর্মজীবনের একটি স্মরণীয় অধ্যায়। স্মৃতির অ্যালাবামে যেন অনেক উজ্জ্বল সঞ্চয় জমা হয়ে আছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে যোগদানের প্রথম দিনেই জেনে নিই মাননীয় মন্ত্রীর দিনপঞ্জির নির্ঘণ্ট। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই তিনি পৌঁছে যান কর্মস্থলে। আমারও পুরোনো অভ্যেস অফিস শুরুর আগে অফিসে যাওয়া। মনে মনে স্থির করি, মাননীয় মন্ত্রীর মতোই অফিসে চলে আসব সাড়ে আটটার মধ্যে। তিনি থাকেন অফিস থেকে অনেক দূরে গুলশানে, আর আমি থাকি কাছের ইস্কাটন গার্ডেনে। সত্য স্বীকারে দ্বিধা নেই, মাননীয় মন্ত্রীর কাছে অফিসে পৌঁছার ব্যাপারে প্রায়শই হার মানতাম। মাননীয় মন্ত্রী প্রতিদিন অফিসে এসেই দিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয়ে সার্বিক প্রস্তুতি নিতেন। সকাল ন’টার পূর্বে তাঁর কক্ষে সাধারণত কোনো কর্মকর্তার ডাক পড়ত না। হঠাৎ একদিন তাঁর নজরে আসে অফিস সময়ের পূর্বেই আমার অফিসে পৌঁছার বিষয়টি। ডেকে জানিয়ে দেন, অফিস সময়ের আগে আমার আসার প্রয়োজন নেই অর্থাৎ আমি যেন সকাল ন’টায় অফিসে আসি। অবাক হই তাঁর এ মহানুভবতায়।
অফিস শুরু হলে মাননীয় মন্ত্রী জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রাত্যহিক অভ্যেসমতো চা খেতেন। দিনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনা সেরে নিতেন। সে সাথে পূর্বের দিনের কোনো কাজ অনিষ্পন্ন থাকলে সে বিষয়েও করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিতেন। কোনো কাজের বিষয়ে কর্মকর্তাদের ওপর নিজস্ব অভিমত চাপিয়ে দিতে কখনও দেখিনি তাঁকে। কোনো জটিল বিষয় হলে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আলাপ আলোচনা করে তিনি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পছন্দ করতেন। মন্ত্রণালয়ের সব কাজে ছিল স্বচ্ছতা। কোনো কাজে অস্পষ্টতা রাখতেন না। আবার তাঁর মতের বিপরীতে কোনো কিছু বললেও, তা যথামর্যাদায় বিবেচনা করতেন এবং যেটি অধিক উত্তম হতোÑ সেটিই গ্রহণ করতেন। কোনো অহঙ্কার তাঁর মধ্যে কাজ করত না। শুধু একটিই উদ্দেশ্য দেখতাম, সেটি হল মন্ত্রণালয়ের কাজ দ্রুত এবং সফলতার সাথে সম্পন্ন করে জনকল্যাণ নিশ্চিত করা।
ঐ মন্ত্রণালয়ের সচিব অবসরে যাওয়ায় আমি তখন সচিবের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলাম। সে সময় একদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সভায় যোগ দিতে যাই। সভা চলাকালে হঠাৎ শুনি মাননীয় মন্ত্রী সভাস্থলের বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তড়িঘড়ি করে গিয়ে দেখি তিনি একটি জরুরি নথি আমার স্বাক্ষরের জন্য নিজে নিয়ে এসেছেন। আমি সত্যিই অবাক হই সরকারি কাজের ব্যাপারে তাঁর এ ধরনের ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি দেখে। তিনি সব গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য কর্মকর্তাদের সময় বেঁধে দিতেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন না হলে তার খুব অস্বস্তি হতো।
আর একদিনের ঘটনা : মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল ভর্তি হয়েছেন। এ খবর পাওয়ামাত্রই তাকে দেখেছি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে। তিনি বলেছিলেন, ‘যত টাকা প্রয়োজন হয়, আমি দেবো। কিন্তু আমার অফিসারের সুচিকিৎসা যেন ব্যাহত না-হয়।’ পরে জেনেছি উক্ত কর্মকর্তার আত্মীয়স্বজনকে কিছু জানতে না-দিয়েই তিনি সমুদয় চিকিৎসা ব্যয় পরিশোধ করেছেন। এ ধরনের অনেক ঘটনা আছে, যা শুনলে আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। তিনি যতবার বিদেশ যান ততবারই সহকর্মীদের কথা মনে করে কিছ-না-কিছু উপহার নিয়ে আসেন। এমনকি আমি ঐ মন্ত্রণালয় থেকে বিদায় নেয়ার পরও তিনি আমার দু’মেয়ের কথা ভোলেননি।
মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন নিঃসন্দেহে একজন কর্মবীর, সে সাথে হৃদয়বান মানুষও। আমাদের এ ক্ষয়িষ্ণু সমাজে তিনি ভালো মানুষ ও নিরলস কর্মীর এক অপূর্ব যুগলবন্দি। কর্মসূত্রে এখন আমার অবস্থান অন্যত্র। তবু দূর থেকে তাঁকে জানাই আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও উষ্ণ অভিনন্দন।

শফিক আলম মেহেদী : সচিব, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, কবি ও গবেষক।
একজন স্বয়ংসিদ্ধ মানুষ সম্পর্কে
আবদুল গাফফার চৌধুরী
সৈয়দ আবুল হোসেন বাংলাদেশের একজন কৃতি সন্তান। পেশায় ব্যবসায়ী হলেও রাজনীতিতেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ব্যবসায়ে যেমন শীর্ষ স্থানে পৌঁছেছেন, তেমনি রাজনীতি করেও তিনি এখন একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। রাজনীতিতে তিনি সুযোগ-সুবিধার অন্বেষণ করেননি। বরং আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে দলটি নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই আওয়ামী লীগ ভিত্তিক রাজনীতি করেছেন, সেই আওয়ামী রাজনীতিই তিনি আঁকড়ে ধরে আছেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের গণতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠনের কাজে নিজেকে জড়িত রেখেছেন। কোন কোন ব্যবসায়ী যেমন ব্যবসার স্বার্থে ঘন ঘন দল ও মত পরিবর্তন করেন, আবুল হোসেন তা করেননি। এখানেই তার বৈশিষ্ট্য।
সৈয়দ আবুল হোসেনের জন্ম মাদারীপুরের কালকিনি গ্রামে। তিনি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিলেও সোনার চামচ মুখে জন্মাননি। নিজের চেষ্টায় তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেন এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। দেশের শিল্প উন্নয়নে তার যেমন অবদান আছে, তেমনি শিক্ষা বিস্তারে এবং সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়নেও তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
তিনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং জনহিতকর নানা প্রতিষ্ঠান স্থাপনেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন।
জননেত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভায় যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়াও আবুল হোসেন বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের জোরালো অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কাজেও চমৎকার ভূমিকা রেখেছেন। একই সঙ্গে ব্যবসায়, শিক্ষা এবং রাজনীতির অঙ্গনে আবুল হোসেন নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠা দানে সক্ষম হয়েছেন। 
সুনাম-দুর্নাম মানুষ মাত্রেরই থাকে। আবুল হোসেনের সুনামের পাল্লাটাই ভারি। এই সুনাম রক্ষায় তার আন্তরিক প্রচেষ্টা রয়েছে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাকে দেশের নানা ধরণের উন্নয়ন তৎপরতায় সাহায্য যোগাচ্ছে। এই মানুষটি ভবিষ্যতে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করে দেশ ও দশের ভাগ্য উন্নয়নে আরও সাফল্য দেখাতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। 
আমি তার দীর্ঘ জীবন ও এবং সকল তৎপরতার সাফল্য কামনা করি।

আবদুল গাফফার চৌধুরী : আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রচ্ছারি খ্যাত প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক।

সৈয়দ আবুল হোসেনের রাজনীতিক দর্শন
ড. আবদুল করিম
আমার ছাত্র মোহাম্মদ আমীন। এখন সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। কিন্তু কর্মকর্তা হিসেবে নয়, লেখক এবং ইতিহাসবেত্তা হিসেবে তার সাথে আমার হৃদ্যতা। সে অনেকগুলো ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছে। তার লেখার হাতিয়ার ইতিহাস, অভয়নগরের ইতিহাস এবং চকরিয়ার ইতিহাস আঞ্চলিক ইতিহাসের অনবদ্য সংযোজন বলে আমি মনে করি। এক সন্ধ্যায় সে আমাকে সৈয়দ আবুল হোসেনের উপর একটি লেখা দেয়ার অনুরোধ করে। ‘আমি ইতিহাসের ছাত্র। রাষ্ট্র নিয়ে, রাষ্ট্রনায়ক নিয়ে আমার কাজ। আমি ব্যক্তি নিয়ে লিখিনা। আমার উত্তরে হতাশ না-হয়ে আমীন বলল, ‘ইতিহাস ব্যক্তির কার্যকলাপের বর্ণনা। সৈয়দ আবুল হোসেন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। আপনার রাজা, সম্রাট, আকবর, জাহাঙ্গীর কারও চেয়ে তিনি কম নন। আপনার রাজা-সম্রাটগণ খৈ এর তেল দিয়ে খৈ ভাজেন। সৈয়দ আবুল হোসেন নিজের কষ্টার্জিত অর্থ উদার হস্তে দান করেন’। সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পর্কে আমি পত্র-পত্রিকায় পড়েছি। কোনোদিন তাকে অধ্যয়ন করিনি। তিনি একজন লেখকও বটে। তার অনেকগুলো কলাম আমি পড়েছি, বইও পড়েছি। বললাম: ঠিক আছে। তার এক সেট বই দিয়ে যাও, বই পড়লে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি জানা যায়। পরদিন আমীন আমাকে সৈয়দ আবুল হোসেনের কয়েকটি বই, তিন পাতার একটি জীবনবৃত্তান্ত ও কর্ম-পরিচিতি দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে লিখে ফেলার জন্য এমনভাবে অনুরোধ করল, মনে হলো তাৎক্ষণিক লিখে দেই। কিন্তু শরীর এত দুর্বল যে, মন তাকে কোনোভাবে বশ করতে পারল না। তারপরও লিখতে হবে, কারও কারও অনুরোধ না-রেখে উপায় থাকে না। আমীনকে বিদায় দিয়ে লিখতে বসলাম।
রাজনীতি সৈয়দ আবুল হোসেনের অস্থিমজ্জায় তবে তা দেশ ও জাতির জন্য, ব্যক্তির জন্য নয়। যদিও রাজনীতি তাঁর জীবনের কোনো পরিকল্পনা নয়, আকস্মিক ঘটনা মাত্র। তিনি নিজের জন্য রাজনীতিতে আসেননি, জনগণের দাবিকে সম্মান করে তাদের কল্যাণে রাজনীতিতে এসেছেন। তিনি মনে করেন, “সমাজ, সভ্যতা ও প্রগতির নিয়ামক হচ্ছে রাজনীতি। মহত্তর ও উন্নততর জীবনের সন্ধানেই মানুষ রাজনীতি করে থাকে। রাজনীতির পেছনে থাকে সুনির্দিষ্ট আদর্শ। যদি তা না-হতো তাহলে মানুষ রাজনীতি করতে গিয়ে জেল-জুলুম সহ্য করত না, বুলেট বেয়নটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারত না।”১ তবে রাজনীতি হতে হবে সুশৃঙ্খল, নীতিবদ্ধ। যা সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে পরিবর্তনশীল হবে, হবে কল্যাণমুখী। এ বিষয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার, “সব কিছুরই একটা নিয়মশৃঙ্খলা বা ব্যাকরণ থাকে। তেমনি রাজনীতিরও নিজস্ব ব্যাকরণ ও নিয়মশৃঙ্খলা রয়েছে। এটা ভঙ্গ করলে রাজনীতি হয় না, দলনীতি হয়। গণতন্ত্র হয় না, হয় দল ও ব্যক্তিতন্ত্র।২ সৈয়দ আবুল হোসেন এ উক্তিগুলো শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। প্রয়োগ করে চলছেন তার জীবনে, রাজনীতির মঞ্চে এবং সমাজ জীবনের অন্দরে অন্দরে। তাই তিনি রাজনীতি করতে গিয়ে মেনে চলেন রাজনীতির নিয়ম, রাজনীতির ব্যাকরণ। যা গণতন্ত্রকে পরিশীলিত করার লক্ষ্যে উজ্জীবিত করছে অনেককে।
সৈয়দ আবুল হোসেন সহনশীল রাজনীতির একনিষ্ঠ সমর্থক। রাজনীতিকে তিনি উন্নয়নের হাতিয়ার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মূল মাধ্যম মনে করেন। রাজনীতি ক্ষমতা দেয়, এ ক্ষমতা ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতিহত করার জন্য নয় বরং উন্নয়নের জন্য, মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। যে রাজনীতি ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতিহত করে, অন্যের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ও ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, সেটি রাজনীতি নয়, পশ্বনীতির নামান্তর। যাকে সাধারণভাবে স্বৈরাচার বলা হয়। তাঁর মতে, ‘গণতন্ত্র মানে জনগণের অংশীদারিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা।’৩ গণতন্ত্র রাজনীতির মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব পায়। যেখানে রাজনীতি অন্যকে দলিত করে সেখানে জনগণের অংশীদারিত্ব ব্যাহত হয়। সৈয়দ আবুল হোসেন বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করার কথা বলেন। বিঘœ দেখে দুঃখ পান কিন্তু হতাশ হন না। তার আক্ষেপ-‘… গণতন্ত্রের জন্য মানুষ দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করে আসছে। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে চলেছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত সে গণতন্ত্র আজও অ-ধরা রয়ে গেছে। জনগণের বিজয় বারবার ছিনতাই হয়ে যায়। যেমন হয়েছে পঁচাত্তরে।’৪ জন-বিজয় ছিনতাই হয়ে গেলেও সৈয়দ আবুল হোসেন তা পুনরুদ্ধারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং আশান্বিত। বাধা আসবে, বিঘœ থাকবে। এরই মধ্যে এগিয়ে যেতে হবে সামনে।
তাই আক্ষেপ করলেও তিনি হতাশ নন, প্রতিকূলতা দেখে মুষড়ে পড়েন না। তিনি জানেন, শান্ত সমুদ্র কোনো দক্ষ নাবিকের জন্য নয়। তাই তিনি উচ্ছ্বসিত প্রত্যাশায় উদ্বেল হয়ে বলতে পারেনÑ ‘আমি আশাবাদী। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম বৃথা যাবে না।’৫ তাকে দেখলাম তিনি প্রচণ্ড আশাবাদী এবং আত্মপ্রত্যয়ী। অন্যে যেখানে দুর্যোগ দেখেন সেখানে তিনি দেখেন সুযোগ। অন্যে যেখানে শোনেন কান্না, সেখানে তিনি দেখেন, কলকল ঝর্না। এ আশাবাদী মনোভাব তার উত্তরণের জ্বালানি- এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ নেই।
রাজনীতিকে ভালোবাসলেও রাজনীতির কুফল, বিশেষ করে, বাংলাদেশে এর অপব্যবহারে সৈয়দ আবুল হোসেন শঙ্কিত। ছাত্র রাজনীতি তিনি সমর্থন করেন, তবে তা কোনো রাজনীতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করতে নয়। রাজনীতি যদি ছাত্র সমাজের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায় ও ভবিষ্যৎ-নেতা হিসেবে নিজেদের গঠনের জন্য হয়, তাহলে কেবল তাই সমর্থনযোগ্য। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য যেমন গঠনমূলক তেমনি কার্যকর, ‘দেশের প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবন ও দেয়াল যেন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থক ছাত্র সংগঠনসমূহের রাজনৈতিক বিপণনের বিজ্ঞাপন বা বিলবোর্ডে রূপান্তরিত হয়েছে।৬ এর পরিবর্তন আবশ্যক। প্রত্যেক দলের এ দিকে খেয়াল দেয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তাই সৈয়দ আবুল হোসেন তার গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতি মুক্ত রেখেছেন। কলেজ অঙ্গন ও দেয়ালে রাজনীতিক শ্লোাগানের বদলে শোভা পাচ্ছে ­মনীষীদের অসংখ্য বাণী। আমি মনে করি, এটি একটি নতুন ধারণা, মানসিকতা পরিবর্তনের নতুন দর্শন। সৈয়দ আবুল হোসেনের এ দর্শনকে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করলে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশে আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। এ ব্যাপারে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরকার কাজে লাগাতে পারেন।
রাজনীতি করতে হলে দল প্রয়োজন। সৈয়দ আবুল হোসেন মনে করেন, আওয়ামী লীগ একটি গণমুখী দল। এর ব্যাখ্যাও তাঁর লেখায় পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত। এ দল জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্রষ্টা এবং রক্ষক। আওয়ামী লীগ জনগণের দল এবং জনগণই এর মালিক। তাঁর ভাষায়, ‘আওয়ামী লীগের জন্ম কোনো সামরিক ছাউনিতে নয়, আওয়ামী লীগের স্পন্দন জনগণের মনের গভীরে গ্রোথিত।৭ জনগণের সাথে আওয়ামী লীগ সবসময় একাত্মকরণ-এর স্পন্দন জনগণের হৃদস্পন্দনের সাথে অবিচ্ছেদ্য। জনগণের অবহেলা মানে আওয়ামী লীগের স্পন্দন থেমে যাওয়া। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা দিয়েছে, মুক্তি দিয়েছে, দুর্বলকে আশ্রয় দিয়েছে। সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগে তাদের নিরাপত্তা ও নিশ্চিত আশ্রয় খুঁজে পায়। তাই বাংলাদেশে এত দল থাকা সত্ত্বেও সৈয়দ আবুল হোসেন আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরক্ত। এটি নিঃসন্দেহে তাঁর প্রগতিশীল মনোভাবের পরিচায়ক। প্রগতিশলীলতা কোনো আকস্মিক উপলব্ধি নয়, গভীর আত্মদর্শন ও নিবিড় অধ্যয়নের বিষয়। উদার মনোভাবের সাথে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার বীজ অঙ্কুরিত হলে এ বোধ স্ফুরিত হয়।
নেতা হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেন দূরদর্শী। কথায় ও চালচলনে তিনি ধীরস্থির ও প্রজ্ঞাময়। বলার আগে ভাবেন এবং ভাবেন বলে অশালীন কোনো বাক্য বের হয় না তার মুখ দিয়ে। রাজনীতির চালক নেতা, তবে নেতা যদি নেতৃত্বের গুণাবলীতে বিভূষিত না-হন, তাহলে সে রাজনীতি দেশের কল্যাণ নয় বরং অকল্যাণই বয়ে আনে। নেতাকে কথা ও কাজে যেমন শালীন তেমন আন্তরিক হতে হয়। নইলে রাজনীতি মিথ্যানীতির জঞ্জালে পরিণত হয়। আমাদের দেশের নেতৃবৃন্দ অনেক সময় অশালীন ও রূঢ় মন্তব্য করে বসেন। এ দিকটার দিকে আঙুল দেখিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছেন, “একজন নেতা বা নেত্রীকে কথায় ও কাজে কেবল পারফেক্ট হলেই চলবে না, তাকে অনুকরণীয় গুণাবলীর অধিকারীও হতে হবে। তার কাছ থেকে মানুষ প্রেরণা পাবে। তিনি হবেন আদর্শ স্থানীয়। মানুষ তাকে অনুসরণ করবে। তাকে দেখে শিখবে, উজ্জীবিত হবে। সে জন্যে একজন নেতা বা নেত্রীকে মেপে মেপে কথা বলতে হয়। তিনি যা বলছেন তার তাৎপর্য, মর্ম এবং জনগণের কি সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে সম্পর্কে তার সঠিক ধারণা থাকতে হবে। কারণ রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তার প্রতিটি কথারই গুরুত্ব রয়েছে। তাই দৃষ্টি নন্দনের চেয়ে তাকে হতে হবে বেশি মাত্রায় উক্তি নন্দন। তাকে সবসময় স্মরণ রাখতে হবে তার অসংলগ্ন বা বল্গাহীন উক্তি তার ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে পারে।৮ হোসেন সাহেবের এ কথাটি আমার কাছে অত্যন্ত কার্যকর মনে হয়েছে। আমাদের নেতা-নেত্রীদের কথায় লাগাম টানার অপরিহার্যতা কী চমৎকার ভাষায় সৈয়দ আবুল হোসেন তুলে ধরেছেন!
নেতার আদিরূপ প্রজা। সাধারণ জনগণই ব্যক্তিকে সাধারণ পর্যায় হতে নেতায় রূপান্তর করে। অনেক নেতা ক্ষমতা পেয়ে নিজেকে সর্বাধিনায়ক ভেবে বসেন। মনে করেন তিনিই সব। যারা তাকে নেতা করেছেন, ক্ষমতায় এনেছেন তাদেরকে তুচ্ছ মনে করেন এবং নেতা হয়ে তাদের কথা ভুলে যান। সৈয়দ আবুল হেসেন এ নীতির বিরোধী তাই তিনি সবাইকে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় আগ্রহী। রাষ্ট্র সবার জন্য, সবাইকে সংশ্লিষ্ট করতে না-পারলে রাষ্ট্র পরিচালনায় কাক্সিক্ষত সাফল্য আসে না। তাঁর ভাষায়, ‘আমিই রাষ্ট্র, আমি যা ভালো মনে করব তাই হবে। আমরাই সব আর কেউ কিছু নয়, এসব মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা এখন সম্পূর্ণ অচল। গণতন্ত্রে জনগণই হচ্ছে সবকিছুরই নিয়ামক ও নির্ধারক।৯ আবুল হোসেন সাহেবের এ বিশ্বাস যথাযথভাবে কার্যকর করা আবশ্যক। তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনায় অধিকাংশ নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে। কেবল তখনই জাতির সার্বিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠা পাবে। মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন বলতে কোনো ব্যক্তি বা অঞ্চল বিশেষের উন্নয়ন বোঝায় না। এটি আলোর মতো সার্বজনীন কেতনে আপতিত না-হলে উন্নয়ন হয়ে উঠতে পারে প্রলয়ের চেয়ে ভয়ঙ্কর।
ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা গণতন্ত্র ও উন্নয়নের প্রতিকূল ধারণা। সৈয়দ আবুল হোসেন যাদের সমর্থনে নেতা হয়েছেন তাদের সুঃখ দুঃখের সাথে নিজেকে একাকার করে দেয়ার চেষ্টায় অবিরাম নিবিষ্ট থাকেন। এ বোধ যাদের থাকে, তারা সহনশীল, বিনয়ী ও নিরহঙ্কারী না-হয়ে পারেন না। নেতা মানে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। যিনি জনগণের কাজ করবেন, জনগণের কাজে দায়বদ্ধ থাকবেন। নেতা হয়ে যিনি যাদের জন্য নেতা তাদের ভুলে যান, নিজেকে নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়েন তারা নেতা নয়, ব্যথা।
ক্ষমতা একটা অদ্ভুত ধারণা। ক্ষমতা কুক্ষিগতকারী নেতৃত্ব ক্ষমতা সুসংহত করা নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকেন যে, নিজের বিপদ কোনো দিক দিয়ে চলে আসে সে বিষয়ে মোটেও সজাগ থাকার সুযোগ পায় না। তাই এত সতর্ক থাকার পরও শেষ পর্যন্ত নিজেদের রক্ষা করতে পারে না। জনবিচ্ছিন্ন নেতৃত্ব ক্ষমতার মোহে এত অন্ধ থাকে যে, কারও পরামর্শ গ্রাহ্য করে না। সৈয়দ আবুল হোসেন বিষয়টি খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীনরা কখনও কোনো সৎ পরামর্শ গ্রহণ করে না। সংকট সমাধানে নয়, সংকট সৃষ্টিতেই তারা বেশি পারদর্শী ও উৎসাহী।’ তিনি আরও মনে করেন, ‘যা অনিবার্য তার জন্য দুঃখ বা অনুশোচনা হয় না, কিন্তু যা পরিহার করা যেতে পারত, তা ঘটে গেলে বা ঘটতে দিলে অবশ্যই মনস্তাপ হবে, ক্ষোভ হবে, কষ্ট হবে।’১০
ইতিহাসে অনেক শিক্ষা থাকে কিন্তু কেউ গ্রহণ করে না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও সকল স্বৈরাচারকেই একদিন না একদিন বিদায় নিতে হয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। কিন্তু এ শিক্ষাটা কেউ নেয় না, নিতে চায় না। সে কারণেই বোধ হয় বার বার স্বৈরাচারের আবির্ভাব ঘটে।১১ এ রকম অদূরদর্শী নেতাগণের প্রতি তাঁর উপদেশ, ‘জনগণকে ভালোবাসুন, নিরাপত্তা আপনা আপনি নিশ্চিত হয়ে যাবে।’ তাই তিনি জনগণে বিলীন হয়ে নিজেকে সাধারণ্যের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান। এখানেই তার আনন্দ। এটাই তার প্রাপ্তি। সংগতকারণে জনগণও তাঁকে উজাড় করা ভালোবাসায় বার বার অভিষিক্ত করেন।
অনেকের কাছে নেতৃত্ব ক্ষমতা জৌলুসের বিষয়, গর্বের বিষয়। সৈয়দ আবুল হোসেন নেতৃত্ব ও দায়িত্বকে জৌলুসময় মনে করেন না। তার মতে, ‘একটি কার্য আর একটি বোঝা। এ বোঝা মূলত বাস্তবায়নের, দায়িত্বের এবং প্রতিজ্ঞার। …যে মস্তকে শোভিত হয় মুকুট, সে মস্তক কখনও নিশ্চিত থাকে না। হাজারও চিন্তাভাবনা, শত সমস্যার কণ্টকে সে মুকুট থাকে শোভিত। রাতের ঘুম, দিনের আরাম তখন বিলকুল হারাম হয়ে যায়। বাংলাদেশের মতো হতদরিদ্র দেশ হলে তো কথাই নেই। তাই দায়িত্ব পাবার আগে প্রত্যেকের উচিত দায়িত্ব বহনের সামর্থ্য অর্জন।’
‘সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রজ্ঞা।’১২ উপযুক্ত শিক্ষা আর ত্যাগী মনোভাব ছাড়া তা অর্জন করার কোনো উপায় নেই। তাই সৈয়দ আবুল হোসেন প্রজ্ঞাময় প্রজন্ম সৃষ্টির মানসে কার্যকর শিক্ষার বিস্তার ও প্রসারে সমর্পিত। এর মাধ্যমে মননশীল জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির সহিংস ক্ষেত্রকে সহনশীলতার উর্বর ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত করার ইচ্ছায় ব্যাকুল। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি যে সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, যেভাবে শিক্ষার প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন, সে রকম ব্যক্তি যদি অন্তত প্রতি জেলায় একজন করে হলেও থাকত, তো বাংলাদেশ এতদিনে যে কোনো উন্নত দেশের সাথে পাল্লা দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হতো।
সৈয়দ আবুল হোসেন মনে করেন, বাংলাদেশের সমস্যা গুড গভর্নেন্স, সুষ্ঠু ও সৎ শাসন ব্যবস্থা না-থাকা। তিনি সুশাসন বলতে সৎ ও প্রত্যয়দীপ্ত নেতৃত্ব; সুষ্ঠু নির্বাচন বা অংশীদারিত্বমূলক গণতন্ত্র এবং উপযোগী নীতিমালা গ্রহণপূর্বক এ সবের কার্যকর বাস্তবায়নকে বুঝে থাকেন। এ তিনটি বিষয়কে সমন্বিত করার জন্য তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এ কাজ করতে গিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। রাজনীতিক সদিচ্ছার অভাবের কারণে বার বার সুশাসন প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হয়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মৌলবাদ, কুসংস্কার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কার্যকলাপ, দলীয়করণ, যুক্তিহীন সমালোচনা ইত্যাদি কারণে সুশাসন বিকাশ হতে পারছে না। তার অভিজ্ঞতার প্রকাশ সত্যিকার অর্থে অকাট্য- ‘একটি সৎ ও সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারই কেবল এ সব সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সুশাসনের অন্যতম পূর্বশর্ত।’ তিনি বিশ্বাস করেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সুশিক্ষিত ও প্রজ্ঞাময় মানুষ এবং দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। এ জন্য তার দৃষ্টি সর্বাগ্রে শিক্ষার উপর। এ বিষয়ে তার বক্তব্য প্রত্যেকের অনুধাবন করা উচিত-
‘শিক্ষকতা একটি মামুলী পেশা নয়। শিক্ষকতা একটি ব্যতিক্রমধর্মী সম্মানিত পেশা। শিক্ষকতাকে অভিহিত করা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্রত ও মহানতম আদর্শ পেশা হিসেবে। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (দঃ) বলতেন, তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়Ñ তিনি মানব জাতির শিক্ষক। গ্রিক দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ প্লেটো শিক্ষাকে তুলনা করেছিলেন অন্ধকার গুহার মধ্যে অজ্ঞতার শিকলবদ্ধ মানুষের কাছে আলোক রশ্মির আকস্মিক বিকিরণের সাথে। সে অর্থে শিক্ষা হচ্ছেÑ তিমির অভিসারী ও আলো বিতরণকারী। শিক্ষকদের বলা হয়, মানুষ গড়ার রূপকার। মহাবীর আলেকজান্ডার বলেছিলেন, আমার জীবনের জন্যে, আমার জন্মের জন্যে আমি আমার পিতামাতার কাছে ঋণী। কিন্তু আমার বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের জন্যে; কৃতিত্ব, বীরত্ব ও গৌরবের জন্যÑ ঋণী হচ্ছি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এরিস্টটলের কাছে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হয়ে সন্তুষ্ট থাকেননি। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তিনি নিজেকে একজন নিবেদিত প্রাণ আদর্শ শিক্ষকে রূপান্তরিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। আধুনিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাওসেতুং প্রায় সময় বলতেন, তিনি একজন শিক্ষক মাত্র। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক হোয়াইটহেড বলেছিলেন, ঘড় ঝুংঃবস ড়ভ ঊফঁপধঃরড়হ রং ইবঃঃবৎ ঃযধহ ধ ঞবধপযবৎ. অর্থাৎ কোনো শিক্ষা ব্যবস্থাই শিক্ষকের চেয়ে উন্নত নয়। শিক্ষকই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণ। শিক্ষা প্রক্রিয়ার অন্তস্থলে শিক্ষকদের অবস্থান। দার্শনিক বার্টান্ড রাসেলের কথায়- শিক্ষক সমাজ হচ্ছে প্রকৃতই সমাজ ও সভ্যতার বিবেক। এজন্য শিক্ষকদের বলা হয় সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ার (ঝড়পরধষ ঊহমরহববৎ) বা সমাজ নির্মাণের স্থপতি।১৩
সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর ধারণা ও বিশ্বাসকে শুধু তথ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন না। যা বিশ্বাস করেন তা মনেপ্রাণে কার্যকর করার চেষ্টা করেন। তিনি শিক্ষক সমাজকে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করেন। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটি তাঁর ব্যবহার ও কার্য দ্বারা বার বার মূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি শুধু তাত্ত্বিক নন, একই সাথে প্রায়োগিকও বটে। পর্যবেক্ষণের পর সিদ্ধান্তে আসেন, সিদ্ধান্তের পর বাস্তবায়নে। হুজুগের মাথায় কোনো কিছু করা হতে প্রবল মানসিক চাপ সত্ত্বেও বিরত থাকার চেষ্টা করেন। তাঁর জ্ঞান ও দক্ষতাকে তিনি লুকিয়ে রাখেন না। সমাজের জন্য তা ব্যবহার করেন। এ রকম মানুষই সমাজের উপকার করতে পারেন। যে জ্ঞান নিজের মনে সীমাবদ্ধ থাকে সে জ্ঞান থাকা না-থাকা একই।
রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সমাজব্যবস্থা সব কিছুর লক্ষ্য উন্নয়ন। তবে উন্নয়ন একটি বহুমাত্রিক ধারণা। সৈয়দ আবুল হোসেনের ভাষায়, ‘গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন সমার্থক এবং পরস্পর গভীরভাবে সম্পৃক্ত। একটির উপর নির্ভর করে এদের সাফল্য।’১৪ তিনি মুক্ত অর্থনীতির সমর্থক। অর্থনীতিকে বন্দি করে রেখে খাঁচার পাখির মতো অথর্ব করে দেয়ার পক্ষপাতি নন তিনি। শিল্পায়নকে তিনি উন্নয়নের অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাত হিসেবে দেখতে চান। তিনি মনে করেন, ‘শিল্পায়ন ছাড়া জনগণের জীবনধারণের মান উন্নয়ন করা যায় না। শিল্পায়ন ছাড়া বেকার সমস্যার কার্যকর ও ফলপ্রসূ সমাধান সম্ভব নয়। এক কথায়, শিল্পায়নই হচ্ছে সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির সোপান। কৃষির মাধ্যমে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ, ভূমির একটি সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এ কারণেই আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই।’১৫ তাই বলে তিনি কৃষিকে অবহেলা করার কথা বলেন না। বলেন, কৃষিকেও আধুনিক প্রযুক্তির সামিল করতে। তাহলে কৃষিও শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।
ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তিনি শুরু হতে শঙ্কিত ছিলেন। তাই নিজের চেষ্টায় গড়ে তুলেছেন একের পর এক অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যা ছাত্র রাজনীতি নামক লেজুড়বৃত্তি হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। তিনি মনে করেন, ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ। আগামী দিনের নেতৃত্ব আসবে তাদের কাছ থেকেই। ছাত্রদের ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক কোন্দল, হানাহানি ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দিলে শিক্ষাব্যবস্থা যেমন হবে বিপর্যস্ত, তেমনি বিকশিত হতে পারবে না জাতির আগামী দিনের সম্ভাবনাময় তরুণ মেধা ও প্রতিভা।১৬ তাই তিনি তাঁর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণভাবে লেজুড়বৃত্তিময় রাজনীতি হতে মুক্ত রেখেছেন এবং এ ব্যাপারে অনড়।
সৈয়দ আবুল হোসেন একজন গণতন্ত্রমনা নেতা। গণতন্ত্রের অনেকগুলো সংজ্ঞার ক্ষেত্রে তিনি আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞাকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। তাঁর গণতন্ত্রে জনগণই সব। রাষ্ট্র পরিচালনায় যাতে সর্বাধিক লোকের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হয় সেভাবে তিনি রাজনীতিক কলাকৌশল নির্ধারণে আগ্রহী। তিনি মনে করেন, ‘সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ। জনগণের সম্মতি ও স্বার্থ অনুযায়ী শাসন করা সরকারের একটি মহৎ ও গৌরবজনক লক্ষ্য। জনপ্রিয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা ব্যতিরেকে এই লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না।’১৭ তিনি আরও মনে করেন, ‘গণতন্ত্রে ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ জ্ঞাপনের অধিকার আইনসম্মতভাবে স্বীকৃত।’১৮ তার মতে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সহনশীলতাই গণতন্ত্রের মূল কেন্দ্র। এ প্রসঙ্গে তার অভিমত খুবই অর্থবহ- ‘শিক্ষা তখনই প্রকৃত অর্থে আমাদের ঋদ্ধ করতে সক্ষম হয় যখন আমরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিনয়ী ও শ্রদ্ধাশীল হই। গণতন্ত্র হচ্ছে বৈচিত্র্যময় অনেকগুলো পথ-মতের সমাহার। গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয়, যখন প্রত্যেক মানুষ আপন দর্শনে স্থিত থেকে স্বাধীনভাবে উচ্চকিত হওয়ার পরিবেশ পায়। সহাবস্থান, সহনশীলতা ও শিক্ষার মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করা যায়। তাই ছাত্রদের উচিত আগে জ্ঞান অর্জন করা। জ্ঞান তখনই অর্জিত হবে বলে ধরে নেয়া যাবে, যখন ব্যক্তি নিজের সুখের জন্য অন্যের সুখ হরণকে অত্যন্ত গর্হিত মনে করবে। পক্ষান্তরে সবার সুখ নিশ্চিত করার জন্য আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হবে।’১৯
রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনীতিক উদ্দেশ্য হাওয়ায় বাস্তবায়ন করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন লাগসই নীতি, টেকসই প্রযুক্তি, দক্ষ জনবল, অদম্য স্পৃহা এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। সৈয়দ আবুল হোসেন মনে করেন, নিবেদিত প্রাণ সৎ, দক্ষ ও কঠোর পরিশ্রমী আমলাতন্ত্র ছাড়া সরকারের নীতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।২০ তিনি এগুলোর সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের লক্ষ্যকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য রাজনীতি করেন। সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য নন। ধর্ম বিষয়ে তার উদারতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত মানসিকতা সৈয়দ আবুল হোসেনের রাজনীতিক দর্শনের বিমল অলঙ্কার, বস্তুত সাম্প্রদায়িকতাহীন বলে তিনি এত উদার, সহনশীল এবং মহানুভব হতে পেরেছেন।
সৈয়দ আবুল হোসেনের কর্মকাণ্ড ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হয়েছে, তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ, যিনি জনগণের কল্যাণে সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত একজন সাধারণ মানুষ। জনগণ এমন একজন সহজ মানের অসাধারণ রাজনীতিবিদকে তাদের নেতা হিসেবে চান। এমন নেতাই দেশের ভাগ্য বদলে দিতে পারেÑ স্বপ্নীল আগামীর ভাবনায়। অনেক রাজনীতিবিদ মনে করেন ক্ষমতায় যেতে হলে সন্ত্রাসীদের সহায়তা প্রয়োজন। সৈয়দ আবুল হোসেন এটি মোটেও বিশ্বাস করেন না। তিনি মনে করেন, সন্ত্রাসীরা পক্ষান্তরে দলকে জনবিমুখ করে তোলে। জনগণের কাছে যেতে হলে জনগণের শত্র“ সন্ত্রাস আর সন্ত্রাসীকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছেন, কারও চারিত্রিক পূততা পরীক্ষা করতে হলে তাকে অর্থ বা ক্ষমতা দাও, তারপর দেখো তিনি কেমন। আমীন আমাকে গ্রন্থের সাথে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের একটি বায়োডাটা দিয়েছিল। তা পড়ে মুগ্ধ না-হয়ে পারলাম না। তাঁর জন্ম ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট। আশির দশকের শেষভাগ হতে তার জনসেবার অভিযাত্রার সূচনা। কতইবা বয়স, মাত্র পঁয়ত্রিশ। এ বয়সে কত বিত্তবান লোককে দেখেছি হোটেলে, ক্লাবে, দেশে-বিদেশে ফুর্তি আনন্দে মজা লুটতে; অসামাজিক কাজ করতে। সে ক্ষেত্রে সৈয়দ আবুল হোসেন স্কুল করেছেন, কলেজ করেছেন, বৃত্তি দিয়েছেন, গরিবদের দু’হাতে তুলে দিয়েছেন নিজের কষ্টার্জিত অর্থ। এটি আমাকে অভিভূত করেছে। তাঁর মতো মানুষ বাংলাদেশে বড় প্রয়োজন।

ড. আবদুল করিম : প্রাক্তন উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, লেখক, গবেষক; উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবেত্তা।

১. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ২৯
২. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, পৃষ্ঠা- ৪৩
৩. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রকাশকাল ফেব্রচ্ছারি, ১৯৯৬।
৪. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রকাশকাল ফেব্রচ্ছারি, ১৯৯৬।
৫. ঐ
৬. ঐ পৃষ্ঠা- ৩০।
৭. ঐ
৮. ঐ পৃষ্ঠা- ৪১।
৯. গণতন্ত্র নেতৃত্ব উন্নয়ন গ্রন্থের প্রবন্ধ, লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ৪৩
১০. গণতন্ত্র নেতৃত্ব উন্নয়ন গ্রন্থের প্রবন্ধ, লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন, ৪৫
১১. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, পৃষ্ঠা ৬৪
১২. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ৬৯।
১৩. শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থা, গণতন্ত্র নেতৃত্ব উন্নয়ন গ্রন্থের প্রবন্ধ, লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ২২।
১৪. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, সৈয়দ আবুল হোসেন।
১৫. শিল্পায়ন ও অর্থনীতির বিকাশ, সৈয়দ আবুল হোসেন, গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, পৃষ্ঠা ৩৮)
১৬. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, পৃষ্ঠা ৩৪
১৭. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, পৃষ্ঠা ৬৬
১৮. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, পৃষ্ঠা ৩২
১৯. সূত্র অধ্যাপক মনোরঞ্জন দাস।
২০. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ৭৬।

সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা
এম মতিউর রহমান
১৯৭৬ সালে আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের কয়েকদিন পর একজন ব্যবসায়ী আমার দপ্তরে আসেন। সুন্দর, সুঠাম ও আভিজাত্যময় চেহারা। নিপুণভঙ্গিতে আঁচড়ানো চুলে মাথা ভর্তি। ফর্সা মুখে সারল্যের হাসি। রুচিশীল টাই-স্যুট পোশাকে তাঁকে অপূর্ব লাগছিল। মানুষ হিসেবে আমিও কম সুন্দর নই। তবে যুবককে দেখে আমার সুন্দরটা নি®প্রভ মনে হলো। বিনয়ের সাথে সালাম দিয়ে বললেন: ‘আমার নাম সৈয়দ আবুল হোসেন। নতুন ব্যবসায় নেমেছি। ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমায় বাড়ি। আপনার সাথে পরিচিত হতে আসলাম।’ চেয়ারে বসতে বসতে আরও বলেছিলেন, ‘বাড়ি মাদারীপুর হলেও লেখাপড়া করেছি বরিশাল। গৌরনদী কলেজের ছাত্র ছিলাম।’
আমার বাড়ি বরিশাল (বর্তমান পিরোজপুর)। প্রশাসনিক বিভাজনের অবস্থানগত নৈকট্য মানুষের পরস্পর সম্পর্ক সৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমার নিজ জেলার পাশের জেলা ফরিদপুরের ছেলে সৈয়দ আবুল হোসেনের উপস্থাপনাগত সৌন্দর্যের সাথে ঠিকানাগত নৈকট্য আমাকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে। অনেকে এটাকে আঞ্চলিকতা বলবেন। আমি বলব আঞ্চলিকতা নয়, দেশপ্রেম। চ্যারিটি বিগেইনস এট হোম। চা পানের ফাঁকে ফাঁকে অনেক ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদান হয়ে গেল। তাঁর ব্যক্তিত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব, দেশপ্রেম, জীবনের লক্ষ্য এবং ব্যবসায় হিসেবে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার দৃঢ়তার সাথে সৎ থাকার অঙ্গীকার আমাকে মোহিত করে। শুধু অবয়বগতভাবে নয়, হৃদয়গতভাবেও তিনি মনকাড়া গুণাবলীর অধিকারী মনে করার যথেষ্ট কারণ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
গত বছর (১৯৭৫) সৈয়দ আবুল হোসেন ‘সাকো ইন্টারন্যাশনাল’ নামক একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। নতুন উদ্যোক্তা, অল্প বয়স। বলেছিলাম, ‘বাণিজ্য সচিব হিসেবে আপনাকে সহযোগিতা করা আমার কর্তব্য এবং নৈতিক দায়িত্ব।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার কথা শুনে আমি খুশি হলাম। তবে অনৈতিক কিছু আমি চাইব না এবং করব না; এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি।’ এ রকম প্রত্যয়দীপ্ত কথা প্রথমে অনেকের কাছে অহঙ্কার বা আস্ফালন মনে হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এখানে তাঁর অহঙ্কারের কিছু ছিল না। এর মাধ্যমে কেবল তাঁর সততার পরিচয়টা ফুটে উঠেছিল। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঔদার্যের সুযোগে মুনাফালোভী কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কালোবাজারি ও মজুদদারি করে দেশের যে ক্ষতি করেছিল তা ইতিহাসের পাতায় এখনও কলঙ্ক হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু এসব অসাধু, মুনাফাখোর ব্যবসায়ী ও কালোবাজারিদের অপকর্মে এতই ক্ষিপ্ত ছিলেন যে, বিভিন্ন বক্তৃতায় বারবার তাদের সতর্ক করে দিতেন। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী বাংলাদেশকে আধুনিক বিশ্বের উন্নয়ন স্রোতে সম্পৃক্ত হতে হলে সততার সাথে কোনো আপোষ করলে চলবে না- এটি সৈয়দ আবুল হোসেন সচেতনভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
সাত বছর আমি বাণিজ্য সচিব ছিলাম। এ দীর্ঘ সাত বছর সৈয়দ আবুল হোসেনকে একজন ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি হিসেবে নিবিড়ভাবে খুব কাছ হতে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছি। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব হবার পরও তাঁর সাথে আমার পরিচয়ের ছেদ নামেনি। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় অনেক বার তিনি আমার কাছে এসেছেন, একা এসেছেন, অনেককে নিয়ে এসেছেন। মাঝে মাঝে ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রণালয়ের সভায়ও যোগ দিয়েছেন। সবখানে তাঁকে আমি তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন একজন আদর্শ ব্যবসায়ী হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছি।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতার চাকুরি ছেড়ে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে আমি সরকারি চাকুরিতে যোগ দেই। দীর্ঘ চাকুরি জীবনে ভালোমন্দ অনেক অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। শুধু সিভিল সার্ভেন্ট ছিলাম না, সংসদ সদস্য হয়েছি, মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। একটি বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত তিক্ত সেটি হচ্ছে, নীতি-নৈতিকতা অবহেলা করে যেনতেন প্রকারে অর্থ উপার্জন করা এবং তাড়াতাড়ি ধনী হবার মানসিকতা। ব্যবসা যে শুধু অর্থ উপার্জন নয়, সাথে সাথে সমাজসেবা- এ ধারণা খুব কম ব্যবসায়ীই পোষণ করতেন। এ ক্ষেত্রে আমি সৈয়দ আবুল হোসেনকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম দেখতে পেয়েছি। লাভের জন্য ব্যবসা, এটি শতভাগ সত্য। তার মানে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অসৎ উপায়ে ব্যবসা পরিচালনা, প্রকৃত অর্থে ব্যবসা হতে পারে না। সৈয়দ আবুল হোসেনের দর্শন ছিল সমাজসেবার জন্য উপার্জন, কল্যাণের জন্য উপার্জন। মঙ্গলজনক কাজের উদ্দেশ্যে ধাবিত আয় কখনও অসৎ উপায়ে অর্জিত হতে পারে না। আর যারা অসৎ উপায়ে অর্জন করেন, তারা কখনও অবৈধ পন্থায় অর্জিত অর্থ কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতে পারেন না। নেকড়ের কাছ হতে কখনও কোকিলের গান পাওয়া যায় না।
অধিকাংশ ব্যবসায়ী অনৈতিক উপায়ে লাভবান হতে চাইতেন। সৈয়দ আবুল হোসেন অনৈতিক সুবিধা গ্রহণকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। তিনি শুধু আইনগতভাবে প্রাপ্য তার ন্যায্য অধিকারটুকু চাইতেন। তার চাওয়াটা ‘সুবিধা’ ছিল না, ছিল ‘অধিকার’Ñ দেশের নাগরিক হিসেবে যা রাষ্ট্র তাকে সাংবিধানিকভাবে প্রদান করেছে। এর বাইরে তিনি চাইতেন না। সৈয়দ আবুল হোসেনকে ভালো লাগার অন্য যত কারণই থাকুক না কেন, এ গুণটির জন্য জন্য আমি এ ব্যবসায়ী যুবকটিকে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের চেয়ে আলাদা চোখে দেখতাম। শুধু আমি নই, সবাই তাকে পছন্দ করতেন। তাঁর মধ্যে অন্যের পছন্দকে প্রভাবিত করার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে।
প্রথম যখন আবুল হোসেনের সাথে আমার পরিচয় হলো, তখন তিনি এত বড় ব্যবসায়ী ছিলেন না। ব্যবসা শুরু করেছিলেন মাত্র। পুঁজিও ছিল যৎসামান্য। অধিকন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও নীতিবান। তাহলে কীভাবে তিনি এত বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন? উত্তর- অনেস্টি ইজ দ্যা বেস্ট পলিসি। আসলে সততার মতো বড় মূলধন আর নেই। তাঁর আর্থিক পুঁজি কম ছিল এটা ঠিক- তবে তাঁর এমন কিছু পুঁজি ছিল যা পৃথিবীর সকল অর্থ একত্রিত করলেও হার মানবে। এ পুঁজি হচ্ছে পরিশ্রম, সততা, সময়নিষ্ঠা আর ভদ্রতা। তিনি কীভাবে এত বড় ব্যবসায়ী হতে পেরেছেন, মর্যাদায় পৌঁছোতে সক্ষম হয়েছেনÑ তা নিচের আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
মার্জিত আচরণ, সুললিত ভদ্রতা, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, নজরকাড়া আভিজাত্য, মোহনীয় রুচি সৈয়দ আবুল হোসেনকে অনেক বড় মাপের মানুষে পরিণত করেছে। যদিও এগুলো জন্মগতভাবে অর্জন করা কঠিন অবশ্য। পরে জানতে পেরেছি, এসব গুণাবলী অর্জনে সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যক্তিগত সাধনা ছিল, তদসাথে তার বংশমর্যাদা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। পেশাগতভাবে সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও স্বচ্ছ; ব্যবহারে ছিলেন ব্যক্তিত্বময়, বিনয়ে পরিপূর্ণ মার্জিত। তিনি মিথ্যা বলতে পারেন- এমন কেউ ভাবতে পারত না। তাই সৈয়দ আবুল হোসেন যা বলতেন তা সবাই কোনোরূপ দ্বিধা ছাড়া সত্য মর্মে মেনে নিত। শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নয়, পুরো সচিবালয়ে এবং যাদের সাথে তিনি ব্যবসা করতেন, যারা তাঁর কাছে আসতেন-যেতেন, কথা বলতেন, কথা শুনতেন সবার কাছে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মানুষের পূর্ণ প্রতিচ্ছবির আদর্শিক নান্দনিকতায় গড়ে ওঠা একজন। সংগতকারণে তিনি পুরো সচিবালয়ে ছোটবড় সবার পরিচিত সর্বমহলের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। আমি মনে করি, সৈয়দ আবুল হোসেনের বড় হবার পেছনে এটি অন্যতম কারণগুলোর অন্যতম।
সৈয়দ আবুল হোসেনের বড় পুঁজি সততা। সততার সাথে তিনি ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনায় সুবিধাভোগীদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। যাকে যেটুকু দেবার অঙ্গীকার করতেন, তার কম দিতেন না, বরং বেশিই দিতেন। ফলে অল্প সময়ে তাঁর ও তাঁর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সুনাম দ্র্রুত বেড়ে যায়। এটিও মূলত সততার পুরস্কার। ওয়ান-এলেভেনে তাঁকে হয়রানি করার চেষ্টা করা হচ্ছে শুনে বড় কষ্ট পেয়েছিলাম। কারণ, এমন একজন সৎ ব্যক্তিকে হয়রানি করা মানে সততাকেই হয়রানি করা।
ভোগের জন্য আয় এটা কেউ অস্বীকার করে না এবং পেশা এক ধরনের ভোগ। তবে ভোগের মধ্যে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। পশুরাও ভোগ করে, মানুষও ভোগ করে, আবার হিটলারও ভোগ করেছেন, মাদার তেরেসাও ভোগ করেছেন কিন্তু এ ভোগের পার্থক্য প্রবল, কারও ভোগ অন্যের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, আবার কারও ভোগ সমাজে বিস্তার করে শান্তি, বইয়ে দেয় আনন্দ। যাদের ভোগ অন্যকে কষ্ট দেয়, রীতিনীতি, আইন-কানুন বা নৈতিকতার সাথে সাংঘর্ষিক, তাদের ভোগ পাশবিকতাময়। ভোগের জন্য পশু হয়ে যেতে হবে এমন আচরণ কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মূলত এটিই পশু আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য। মানবীয় ভোগ মানবীয় সৌন্দর্যে বিভূষিত থাকতে হবে। নৈতিকতা বিবর্জিত কোনো মানুষের মাঝে মানবীয় ভোগ থাকতে পারে না। সৈয়দ আবুল হোসেন মানবীয় ভোগে বিদূষিত একটি অত্যত্তুম চরিত্র। তিনি আয় করেছেন একা, তবে তা শুধু একার উপভোগের জন্য নয়। তাঁর ভোগ প্রতিষ্ঠা করেছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, রাস্তা ইত্যাদি।
শুধু স্কুল কলেজ নয়, শিক্ষার যে কোনো ক্ষেত্রে তিনি উদার। তাঁর অর্থায়নে অনেক লেখক তাঁদের অপ্রকাশিত গ্রন্থ প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। এ সংবাদটি অনেকে জানেন না। আমার মনে হয়, সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব নিজেও জানেন না তিনি কয়জন লেখককে গ্রন্থ প্রকাশে কতভাবে সহায়তা করেছেন। আমি অনেকের নাম জানি। তবে দাতার মহত্ততার প্রতি সম্মান রেখে তা প্রকাশ নাই-বা করলাম। তিনি দান করতেন গোপনে, গ্রহীতাকে তা গোপন রাখার অনুরোধ করতেন। এ যে দান গোপন রাখার মতো মহৎ মন, কয়জনের আছে আমার জানা নেই।
অনেকে কম পরিশ্রম করে বেশি উপার্জনকে পেশাগত উন্নয়ন ও আর্থিক সফলতার সবচেয়ে উত্তম কৌশল বলে মনে করেন। সৈয়দ আবুল হোসেন মনে করেন, এটি সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং বিপজ্জনক পন্থা। যে গাছ দ্রুত বাড়ে সে গাছ সামান্য বাতাসে ভেঙে পড়ে। সময়ের আগে পাকা ফল লাল হতে পারে, পরিপক্ব হয় না, পাকার মতো মনে হলেও মুখে দিলে বিস্বাদের কষ্টে ছুড়ে দেয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। কম পরিশ্রম করে বেশি উপার্জনকারী ব্যক্তি অকালপক্ব ফলের ন্যায় বিরক্তিকর। কম শ্রমে বেশি উপার্জন করার ফন্দি মূলত অসৎ উপায় অবলম্বন করার নামান্তর। এ জন্য অনেকে অনৈতিক পথ অবলম্বন করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। সৈয়দ আবুল হোসেন কম পরিশ্রম করে বেশি উপার্জন করার কৌশল অবলম্বন করার কথা ভাবতেও পারতেন না। তিনি যতটুক পরিশ্রম করতেন ততটুক চাইতেন। তার চাওয়া শ্রম আর চেষ্টার সাথে সংগতিপূর্ণ থাকত বিধায় তিনি যতটুক চাইতেন ততটুক পেতেন। চাওয়া পাওয়ার সমান্তরাল বোধ তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল সে যুবা বয়সে। তাই দিন দিন তিনি হয়ে উঠেছেন শ্রম-বিশ্বাসী একজন আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ। শ্রমের যথাযথ মূল্য দিতে গিয়ে তিনি সময়নিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।
আমি যখন যোগাযোগ মন্ত্রী, তখনও সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে মাঝে মধ্যে কথা হতো, দেখা হতো। জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে সৈয়দ আবুল হোসেন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। একদিন তাঁর অফিসে এলাকার একটি কাজের জন্য তদ্বির করতে যাই। আমাকে দেখে তিনি এমন বিনীত ব্যবহার করলেন, যেন আমি বাণিজ্য সচিব এবং তিনি একজন ব্যবসায়ী। তাঁর বিনয়ী আচরণ আমাকে আবার মুগ্ধ করল। বিশ বছর আগে তাঁকে যে মূল্যায়ন আমি করেছিলামÑ তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে দেখে গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছিল। প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন আমার নিজ এলাকা পিরোজপুর জেলার কাউখালীর উন্নয়নে আমাকে যেভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন, তা তাঁর বিনয় আর কৃতজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি।
এখনকার আবুল হোসেন আগের সে অখ্যাত ব্যবসায়ী আবুল হোসেন নন। তিনি এখন রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, দানবীর, সংগঠক, শিক্ষাবিদ ও লেখক। দেশব্যাপী রয়েছে তার প্রচুর খ্যাতি। সাধারণত মানুষ বিখ্যাত হবার পর অহঙ্কারী হয়ে ওঠেন, বিনয়ের পরিবর্তে হামবড়া প্রকট হয়ে ওঠে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি সৈয়দ আবুল হোসেন যত বড় হচ্ছেন, যত বিখ্যাত হচ্ছেন, ততই তাঁর বিনয় প্রসারিত হচ্ছে। কোনো মানুষ বড় হবার সাথে সাথে যদি তার বিনয়-ভাব প্রসারিত হয়, ধরে নিতে হবে তিনি বড়ত্বের যোগ্য। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি গ্যাস ভরলে বেলুন ফেটে যায়। ঐ ফেটে যাওয়াটা অহঙ্কারের প্রতিক্রিয়া। যা আমাদের অনেক পদাধিকারীর মাঝে লক্ষ করা যায়। বর্তমানে সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রী। মাঝে মাঝে এলাকার বিভিন্ন কাজ নিয়ে তার অফিসে যাই। যোগাযোগ মন্ত্রীকে সবসময় ব্যস্ত থাকতে হয়। তবু যখনই তাঁর কাছে গিয়েছি, অনেক ব্যস্ততার মাঝেও সম্মানের সাথে কাছে ডেকে নিয়েছেন, যথা মর্যাদায় স্বাগত জানিয়ে এবং সময় দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন।
বাণিজ্য সচিব ও শিল্প সচিব হিসেবে আমি একটা কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সৈয়দ আবুল হোসেন কখনও সরকার বা অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হতে অনৈতিক কোনো সুবিধা আদায় করেননি কিংবা অনুরূপ আদায়ের চেষ্টাও করেননি। তিনি কাউকে ঠকাননি, কেউ তাঁকে ঠকালে বিস্ময়ের সাথে ভেবেছেন- মানুষ কীভাবে প্রতারক হতে পারে! এবং এ ভেবে লজ্জা পেয়েছেন। আমার চাকুরি জীবনে আমি যত ব্যবসায়ী দেখেছি, যত মানুষ দেখেছি তন্মধ্যে সৈয়দ আবুল হোসেন সততা, মানবতা, ভদ্রতা আর নিষ্ঠা বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ একজন।

এম মতিউর রহমান : প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জাপান এবং কোরিয়া; প্রাক্তন সচিব বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়; প্রাক্তন সংসদ সদস্য এবং প্রাক্তন মন্ত্রী যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

বন্ধু আমার উদার নিদাঘ আকাশ
আবুল হাসান চৌধুরী
সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সেরা করে সৃষ্টি করেছেন। তিনি তার সেরা সৃষ্টিকে সেরা জীবন উপভোগের জন্য অগণিত প্রাচুর্য দিয়েছেন, অনির্বাণ সৌন্দর্যে বিভূষিত করে দিয়েছেন চারিপাশ, পৃথিবীকে বৈচিত্র্যময় অবকাশের কুহুরে কুহুরে করে দিয়েছেন মুখরিত। কত নদী, কত সরোবর, আকাশ, বাতাস, তারা, পাহাড়, ফুল, ফল, মা-বাবা, বন্ধু, দেশ, জাতি, প্রতিবেশি- আরও কত কী দিয়েছেন তিনি আমাদের। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে যত কিছু দিয়েছেন তন্মধ্যে বন্ধু নামক শব্দটিকে আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়, সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী এবং সবচেয়ে প্রশান্তির মনে হয়। এ জন্যই বন্ধুর কথা উঠলে আমার মনে পড়ে যায় জন অস্টিনের স্বতঃসিদ্ধ উক্তি- ঋৎরবহফংযরঢ় রং ঃযব ভরহবংঃ নধষস ভড়ৎ ঃযব ঢ়ধহমং ড়ভ ফবংঢ়রংবফ ষড়াব.
মানুষের জীবনে বন্ধুর চেয়ে বড় আর কিছু নেই। ফ্রান্সিস বেকন বন্ধুকে মানব-মানবীর বহুমাত্রিক সম্পর্কের মধ্যে সর্ব বিবেচনায় উৎকৃষ্ট হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বেকন তার বিখ্যাত ফ্রেন্ডশিপ ‘বন্ধু’ নামক সম্পর্কটির শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ করতে গিয়ে বলেছেন- ণড়ঁ সধু ঃধশব ংধৎুধ ঃড় ড়ঢ়বহ ঃযব ষরাবৎ, ংঃববষ ঃড় ড়ঢ়বহ ঃযব ংঢ়ষববহ, ভষড়বিৎ ড়ভ ংঁষঢ়যঁৎ ভড়ৎ ঃযব ষঁহমং, পধংঃড়ৎবধস ভড়ৎ ঃযব নৎধরহং; নঁঃ হড় ৎবপবরঢ়ঃ ড়ঢ়বহঃয ঃযব যবধৎঃ, নঁঃ ধ ঃৎঁব ভৎরবহফ; ঃড় যিড়স ুড়ঁ সধু রসঢ়ধৎঃ মৎরবভং, লড়ুং, ভবধৎং, যড়ঢ়বং, ংঁংঢ়রপরড়ঁং, পড়ঁহংবষং ধহফ যিধঃংড়বাবৎ ষরবঃয ঁঢ়ড়হ ঃযব যবধৎঃ ঃড় ড়ঢ়ঢ়ৎবংং রঃ, রহ ধ শরহফ ড়ভ পরারষ ংযৎরভঃ ড়ভ পড়হভবংংড়হ. সত্যি, পৃথিবীর সব কিছুর তুলনা আছে, সব কিছুর বিকল্প আছে কিন্তু বন্ধু ও বন্ধুত্বের কোনো তুলনা নেই। যদি তা প্রকৃত বন্ধুত্বের বিনি সুতোয় প্রস্ফুটিত করা যায়। এজন্যই ইংরেজি ঋজওঊঘউ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে- ঋ- ভব,ি জ- ৎবষধঃরড়হ ও- রহ, ঊ- ঊধৎঃয, ঘ- হবাবৎ, উ-ফরব. এটি আসলেই দুর্লভ, সহজে পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলে ভোলা যায় না।
আমার পিতা আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হবার আগে তিনি দেশবিদেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। পিতার চাকুরি সুবাধে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও আমার অনেক সময় কেটেছে। সাধারণত মানুষ বড় পদ পেলে আত্মগর্বে এমন অন্ধ হয়ে যায় যে, নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায় না। আমার পিতা এ বিষয়টাকে খুব ঘৃণার চোখে দেখতেন। তিনি বলতেন, ‘যারা আপাত দৃষ্টে আমার অধস্তন তাদের জন্যই আমার সম্মান। তাই যিনি যত ছোট তাকে তত বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। কারণ, তারাই আমার সম্মানের ভিত্তি। ভবন যত বড় হোক না কেন, মাটির নিচে পুঁতে রাখা ভিতের উপর তার ঋজুতা।’ এ জন্য বাবা আমাদের এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যাতে কোনো মানুষকে অমর্যাদা করার কোনো ইচ্ছা আমাদের মনে জাগ্রত না হয়। পরিবার, পেশা, রাজনীতি এবং উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জিত শিক্ষার কারণে আমার পরিচিতের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সাধারণত পরিচিত মহলের মধ্যে যারা অধিকতর ঘনিষ্ঠ তাদেরকে আমরা বন্ধু বলে থাকি। তবে প্রকৃত অর্থে তারা সবাই বন্ধু নয়। সকল ঘনিষ্ঠ জন বন্ধু নয়, তবে সব বন্ধুই ঘনিষ্ঠ। মানুষ বহু কষ্টে মানুষ, পরিচিত বহু পরীক্ষায় বন্ধু।
আমার বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় সৈয়দ আবুল হোসেন। অবশ্য এ কথাটি আমি কখনও তাঁর সামনে প্রকাশ করিনি, অন্য কারও কাছেও এ পর্যন্ত প্রকাশ করিনি। শুধু নিজে নিজে অনুভব করে থাকি। কেন তিনি আমার প্রিয় বন্ধু? সহজ উত্তর: তিনি- ঝযধৎবং ড়ভ সু পধৎবং. অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, তার সাথে দীর্ঘ পরিচয় নেই, ঘনিষ্ঠতাও তেমন দেখি না, তবু কীভাবে আমার প্রিয় বন্ধু হন সৈয়দ আবুল হোসেন? তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি: উবঢ়ঃয ড়ভ ভৎরবহফংযরঢ় ফড়বং হড়ঃ ফবঢ়বহফ ড়হ ষবহমঃয ড়ভ ধপয়ঁধরহঃধহপব -এটি সম্পূর্ণ মনোগত এবং আচরণগত ব্যাপার। দুটো ইট হাজার বছর পাশাপাশি থাকলেও জোড়া লাগে না। দুটি মানুষ লক্ষ বছর কাছাকাছি থাকলেও বন্ধুত্ব জেগে ওঠে না; যদি-না তাদের মনোগত অনুভব পরস্পরকে ছুঁয়ে যায় ভালোবাসার তারল্যে।
১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমার্ধে সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে। আমি তখন স্টান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের কর্পোরেট ম্যানেজার আর সৈয়দ আবুল হোসেন সাকো ইন্টারন্যাশনাল নামক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী। ব্যাংকের সাথে ব্যবসার সম্পর্ক যেমন তেমনি ব্যাংকারের সাথে ব্যবসায়ীর সম্পর্ক। সুতরাং উভয়ের পরিচয়টা ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার সুযোগ কর্মগত কারণেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যা আমাদের দু’জনের বেলায়ও ঘটেছে। পূর্বে বলেছি ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সাথে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে। তবে এর বহু পূর্বে আমি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর নাম শুনেছি। শুনতে শুনতে পরস্পর প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অনেক আগেই সৈয়দ আবুল হোসেন নামটি আমার একটি প্রিয় নাম হয়ে ওঠে। প্রশ্ন আসতে পারে, নাম শুনে প্রিয় হবার পেছনে এমন কী কারণ ছিল? কারণ অবশ্যই ছিল। বন্ধুদের সাথে আলোচনা করতে গেলে সৈয়দ আবুল হোসেনের কথা উঠত, কথা উঠত তাঁর কাজের, নিষ্ঠার। রাজনীতি, ব্যবসা, অর্থনীতি, আদর্শ- যেটা নিয়ে আলোচনা হোক না, সৈয়দ আবুল হোসেনকে কোনোভাবে এড়ানো যেত না, কেউ তাকে বাদ দিতে পারত না। তিনি বাদ দিতে পারার মতো ছিলেন না।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ হতে দীর্ঘ অনেক বছর আমি লন্ডনে ছিলাম। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ইউরোপ শাখার সেক্রেটারি নির্বাচিত হই। জননেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি ও সভাপতিত্বে এ গুরু দায়িত্ব পেয়েছিলাম। সেক্রেটারি থাকাকালীন সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম আরও বেশি বেশি শুনতে পাই। খবর নিয়ে জানতে পারি, তিনি আওয়ামী লীগ করেন না। তবু দলের সবার মুখে তাঁর নাম এ বিষয়টি আমাকে তাঁর প্রতি আগ্রহী করে তোলে। তাঁকে ভালোভাবে জানার ও দেখার আগ্রহে উদগ্রীব হয়ে উঠি। পরবর্তীকালে যেটি জানতে পারলাম তা আমাকে বিস্ময় ও আনন্দে হতবাক করে দেয়। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে সৈয়দ আবুল হোসেন নামের যুবকটি উদার হস্তে এগিয়ে এসেছেন। আওয়ামী লীগের জন্য যখন যেখানে যা প্রয়োজন স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিকতায় দিয়েছেন। দল না-করেও দলের প্রতি এমন দরদি উদারতা ছিল আমার কাছে অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না। তবু দলের জন্য অসীম ত্যাগ সংগতকারণে তাঁকে আলোচনার মূল বিন্দুতে নিয়ে আসে।
সৈয়দ আবুল হোসেন মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রত্যক্ষ রাজনীতি না-করা সত্ত্বেও কেবল বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হিসেবে দৃঢ় প্রত্যয়, গভীর শ্রদ্ধা ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার তুলনাহীন ঔদার্যে আওয়ামী লীগকে সাহায্য করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এবং আওয়ামী লীগের প্রতি ভালোবাসা আমাকে সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতি অনুরক্ত করে তোলে। উভয়ের আদর্শিক সমতা, পরস্পরকে কাছে আসার; পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠ হবার সকল শর্ত পূরণ করে। ঘনিষ্ঠ হবার পর দেখতে পাই- ঐব রং ধ ঢ়ধৎঃ ড়ভ সরহব, ফলে নিজের অজান্তে আমার মন তাকে বন্ধু হিসেবে বরণ করে নেয়। তিনি একজন সুখী মানুষ; ডযড়বাবৎ রং যধঢ়ঢ়ু রিষষ সধশব ড়ঃযবৎং যধঢ়ঢ়ু, এ লোভটা ছাড়তে না-পেরে আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর বন্ধু হয়ে যাই। তার কাছে গেলে মনটা আপনা-আপনি বড় হয়ে ওঠে প্রশান্তির ঢেউয়ে।
আমার অনেক পরে সৈয়দ আবুল হোসেন রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। তবু আমার বহু পূর্ব হতে তিনি আওয়ামী অঙ্গনের একনিষ্ঠ শুভাকাক্সক্ষী ও নিঃস্বার্থ দাতা হিসেবে খ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। কোনোরূপ ক্ষমতা বা পদের লোভ না-করে জাতির জনকের প্রতি পিতৃশ্রদ্ধায় আবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে দুঃসময়ে যেরূপ উদারতায় সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, তা কৃতজ্ঞতার সাথে সবার মণিকোঠায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এখানে আর একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে, সেটি হচ্ছে- তিনি যখন আওয়ামী লীগকে উদারভাবে সাহায্য করে যাচ্ছিলেন তখন আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। এরূপ কেউ ভাবতেও পারতেন না। সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো বিশাল মনের লোকদের ভালোবাসায় আওয়ামী লীগ আস্তে আস্তে দুঃসময় কাটিয়ে এ অবস্থানে আসতে সক্ষম হয়েছে। এ জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের প্রবীণ নেতাগণ সৈয়দ আবুল হোসেনকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখতেন।
‘৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পূর্বে আমি স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে সক্রিয় হই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন হলেও ইউরোপের রাজনীতি এবং আমার পিতার পরিচিতি আমাকে কিছুটা হলেও অনুকূল পরিবেশ দিয়েছিল। সৈয়দ আবুল হোসেনের এমন কোনো গার্ডিয়ান ছিলেন না যিনি তাকে রাজনীতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে পারেন। তবে তিনিও গার্ডিয়ান-মুখাপেক্ষি ছিলেন না। নিজেই নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট ছিলেন। তাঁর আত্মশক্তি এত প্রবল ছিল যে সবাই তাঁর সহায়ক গার্ডিয়ান হয়ে যেতে বাধ্য হতেন। তিনি সবাইকে গুরুত্ব দিতেন এবং এমন ব্যবহার করতেন, যা হতে আমরা শেখতাম- ডব সঁংঃ ষবধৎহ ড়ঁৎ ষরসরঃং. ডব ধৎব ধষষ ংড়সবঃযরহম, নঁঃ হড়হব ড়ভ ঁং ধৎব বাবৎুঃযরহম.
প্রত্যন্ত ডাসার গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবার হতে এসে কোনোরূপ আত্মীয়-স্বজনের প্রণোদনা ব্যতীত সৈয়দ আবুল হোসেন নিজেকে ধ্র“ব তারার মতো উজ্জ্বল মহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি চাট্টিখানি কথা নয়। আমার পিতা প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তাঁর পিতা ছিলেন গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ। তখনকার আওয়ামী লীগে নতুনের এত জয়গান ছিল না এবং প্রবীণেরাই ছিল মুখ্য নিয়ামক। নেত্রী প্রবীণদেরই বেশি গুরুত্ব দিতেন। তবু কেন জানি ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মহীয়সী শেখ হাসিনা আমাকে মনোনয়ন দেন। একই সাথে সৈয়দ আবুল হোসেনও মনোনয়ন পান। শুনেছি সৈয়দ আবুল হোসেন মনোনয়ন নিতে চাননি। এলাকার লোকজন তাঁকে এক প্রকার বাধ্য করে রাজি করিয়েছেন। নির্বাচনে রাজি করানোর জন্য এলাকাবাসীকে অনশন পর্যন্ত করতে হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা অনুরোধ না-করলে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন কিনা সন্দেহ। মনোনয়ন পাবার পর আমাদের দু’জনের ঘনিষ্ঠতা আরও গভীর হয়। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। সৈয়দ আবুল হোসেন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী এবং আমি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাই। এ অবস্থায় দু’জন আরও কাছাকাছি চলে আসি। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও সভা-সমিতিতে দেখা হবার সুযোগ আরও অবারিত হয়।
১৯৯১ হতে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের কথা। জননেত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেত্রী। সৈয়দ আবুল হোসেন শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অনুজপ্রতীম সহকর্মী। নেত্রীর সাথে প্রায় সময় বিদেশে সফরে অংশ নেন। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এত মজবুত প্রস্ফুটিত, সুন্দর, উদ্দীপ্ত ও আন্তরিক হবার পেছনে সৈয়দ আবুল হোসেনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য এ সময় জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন। সৈয়দ আবুল হোসেনকে আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র বিষয়ক সম্পাদক করার পেছনে নেত্রীর একটি উদ্দেশ্য ছিল। নেত্রী তাঁকে এ পদের যোগ্য মনে করেছেন। সৈয়দ আবুল হোসেন আন্তরিকতা দিয়ে তাঁর দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। নেত্রীর এ নির্বাচন পরবর্তীকালে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করেন। এ সফরটি ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির ইতিহাসের একটি মাইল ফলক। এটি শুধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং গণচীনের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করেনি বরং বাংলাদেশের সাথেও গণচীনের সম্পর্ককে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর পেছনে যে ব্যক্তিটি অবিসংবাদিত ভূমিকায় মনে প্রাণে নিবেদিত ছিলেন তিনি সৈয়দ আবুল হোসেন। সাকো ইন্টারন্যাশনালের কারণে অনেক পূর্ব হতে গণচীনের প্রভাবশালী মহলের সাথে সৈয়দ আবুল হোসেনের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা ও সৈয়দ আবুল হোসেনের অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিষ্ঠাজাত কূটনীতিক কুশলতা গণচীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করার ক্ষেত্রে এক নুতন অধ্যায় সৃষ্টি করে।
প্রতিকূলতাকে জয় করার এবং প্রতিকূল অবস্থার সাথে অভিযোজিত হবার ক্ষমতা সৈয়দ আবুল হোসেনের মজ্জাগত প্রতিভা। সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁর উপর যে মারাত্মক বিপদ গেছে, আমি তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সে কথা মনে পড়লে এখন শরীর শিউরে ওঠে। তৎকালীন সরকারের উদ্দেশ্য ছিল সৈয়দ আবুল হোসেনকে দিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনয়ন করা। এ বিষয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন হিমালয়ের চেয়ে অনড়, জীবন দেবেন তবু নেত্রীর প্রতি আনুগত্য থেকে বিন্দুমাত্র নড়বেন না। তাঁকে বন্দি করার জন্য হন্য হয়ে খোঁজা হয়েছিল। রাতের পর রাত দিনের পর দিন চরম আতঙ্কে দিন কাটিয়েছেন তিনি। ইচ্ছা করলে অনেকের মতো বিশ্বস্ততা ভঙ্গ করে ও আনুগত্য খেলাপ করে দিব্যি আরামে থাকতে পারতেন। তিনি তা করেননি, তাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল কিন্তু কিছুর তোয়াক্কা করেননি। সর্ব প্রকার হুমকি অগ্রাহ্য করে নেত্রীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও আনুগত্য হতে এক বিন্দু বিচ্যুত হননি। তিনি বলেছেন, ‘প্রয়োজনে আমি জীবন দেবো। তবু নেত্রীর সম্মানের সামান্য ব্যাঘাত ঘটাব না।’
এমন দুঃসময়ে আমি তাঁকে ব্যথিত ও বিষণœ দেখলেও হতাশ দেখিনি কখনও। মুখের হাসিটা তখনও প্রত্যয়দীপ্ত অথচ শিশুসুলভ সারল্যে মোহনীয় হয়ে থাকত নতুন দিনের স্বপ্ন হয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন, আকাশের কালো মেঘ আগেও এসেছে, আবারও আসতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ থাকলে সূর্যের প্রখরতা একদিন না একদিন আকাশকে মেঘমুক্ত করবেই। আর একটি বিষয় অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য যে, সৈয়দ আবুল হোসেন কারও অনুগ্রহে বড় হননি। তিনি ঋড়ৎঃঁহব ভধাড়ৎং ঃযব নৎধাব দর্শনে বিশ্বাসী এবং এভাবে বড় হয়েছেন। তিনি সাহসী, তিনি যোগ্য, তিনি কুশলী তাই সৌভাগ্য তাকে অনুসরণ করে। তিনি সৌভাগ্যের পেছনে ছোটেন না, সৌভাগ্যই তার পেছনে ছোটে।
বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের যোগাযোগ মন্ত্রী কিন্তু আমি তাঁকে শুধু মন্ত্রী মনে করি না, হি ইজ মোর দেন মিনিস্টার। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে একটি বিশেষ রূপকল্প নিয়ে এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছেন। সৈয়দ আবুল হোসেন একটি আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শহিদি চেতনায় উদ্বুদ্ধ সৈনিকের মতো দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত আছেন। বিদেশে গেলে তিনি প্রায় সময় তাদের উন্নতি, দেশপ্রেম ও কর্মকাণ্ড দেখে আফসোস করতেন এবং বলতেন, ‘তারা পারলে আমরা পারব না কেন?’
আমরা না-পারলেও তিনি পেরেছেন। তিলের মতো একটা ছোট বিন্দুবৎ সাকো-কে তিনি বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত করেছেন। তাঁর অফিসের সাজসজ্জা, কর্মকাণ্ড, প্রত্যয়, দেশের প্রতি ভালোবাসা পৃথিবীর যে কোনো দেশের দেশপ্রেমিক নাগরিকের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। আজ দেশ গড়ার সুযোগ তিনি পেয়েছেন, তার কাঁধে আজ বিশাল দায়িত্ব; তবে তিনি পারবেন। এ কাজে সফল হতে হলে যে সকল গুণাবলীর প্রয়োজন, সবগুলো সৈয়দ আবুল হোসেনের আছে। তিনি নির্লোভ, পরিশ্রমী, সময়নিষ্ঠ, কর্মঠ, আন্তরিক, দেশপ্রেমিক, শিক্ষিত, বিচক্ষণ, দূরদর্শী, তেজি এবং নেত্রীর প্রতি আনুগত্যশীল। সফল হতে হলে এর বেশি প্রয়োজন নেই।
আমি আর সৈয়দ আবুল হোসেন একসাথে মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে অনেক বার বিদেশে গিয়েছি। দেখেছি বিদেশে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কত ব্যাপক। তাঁর বাস্তবমুখী দর্শন ও পরিশ্রমী প্রেরণা বিদেশিদেরকেও মোহিত করত। বিশেষ করে, গণচীনে সৈয়দ আবুল হোসেন একজন অতি পরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তি। ‘বোয়াও’ ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তিনি একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। এ ফোরামের সেক্রেটারির বেতন জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের সমান। তাঁকে এমন মর্যাদাময় পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তবে তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখান করে বলেছিলেন, ‘আমি নিজের দেশ ছেড়ে এখানে থাকতে পারব না। আগে দেশ, তারপর অর্থ ও সম্মান।’ বোয়াও ফোরামের সভায় তিনি এমন মর্যাদায় সভাপতিত্ব করেছিলেন যেখানে জাপান, থাইল্যান্ড বা ফিলিপাইনের মতো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ ছিলেন।
সৈয়দ আবুল হোসেনের ন্যায় তার স্ত্রী খাজা নার্গিসও একজন মহান রমণী। শিক্ষা, দীক্ষা, আচার, আচরণ ও সহানুভূতিতে এমন পরিপূর্ণ রমণী আজকের দিনে বিরল। সৈয়দ আবুল হোসেনের এত খ্যাতির পেছনে ভাবীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্ববহ। অনেক বিষয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন ব্যতিক্রম। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে পরিবার-প্রীতি। আমি রাত একটার পূর্বে ঘুমোতে পারি না, সৈয়দ আবুল হোসেন দশটার পর আর জেগে থাকতে পারেন না। তিনি প্রতি বেলা স্ত্রী, মেয়েদের সাথে আহার করেন। আমার দীর্ঘ রাত জাগা নিয়ে আমার স্ত্রী আবুল ভাবীকে একদিন বলেছিলেন: ‘আমার স্বামী আর আপনার স্বামীর সবদিকে মিল আছে, দু’জনের চরিত্র প্রায় অভিন্ন। কিন্তু একটা বিষয়ে বড় গরমিল এবং সেটি হচ্ছে আমার স্বামী নিশিত রাতে ঘুমোয়, আর ভাই দশটার পর জেগে থাকেন না।’ নার্গিস ভাবী একজন পরিশ্রমী ও দূরদর্শী মহিলা। তাদের দু’কন্যা ইফফাত ও রুবাইয়াত দু’জনে অত্যন্ত মেধাবী। রুবাইত আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খুবই উন্নতমানের আর্টিকেল লিখে থাকেন। বড় লোকের ছেলেমেয়েরা সাধারণত লেখাপড়ায় মেধাবী হয় না। নার্গিস ভাবী এটি বিশ্বাস করেন না। তার পরিচর্যায় দু’কন্যা মেধাবী ছাত্রী হিসেবে আমেরিকার মতো দেশেও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে। তিনি তাঁর দু’কন্যাকে আদর্শ মানের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
ছোট বেলায় আমরা একটা কবিতা পড়েছি, আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ, মেকস এ মেন হেলদি, ওয়েলদি এন্ড ওয়াইজ। সৈয়দ আবুল হোসেন তাড়াতাড়ি যেমন বিছানায় যান, তেমনি তাড়াতাড়ি উঠে পড়েন। সকাল পাঁচটার পর তিনি আর ঘুমান না। ফজরের নামাজ আদায় করে অধ্যয়নে বসেন। তারপর শুরু হয় দিনের কাজ। ভোরে ওঠেন বলে তার দিন হয় বড়। আর আমার দিন হয় ছোট। একদিন তাঁকে বলেছিলাম: ‘আমি মন্ত্রণালয়ে আপনার সাথে দেখা করতে যাব।’ বলেছিলেন: ‘আমি সকাল সাড়ে আটটায় মন্ত্রণালয়ে পৌঁছি এবং এগারোটার আগে বেরিয়ে পড়ি মিটিঙে, আপনি এগারোটার আগে ঘুম হতে ওঠেন না। এত সকালে ডেকে এনে বিরক্ত করতে চাই না বরং বন্ধের দিন আসবেন। গল্প করা যাবে।’
এবার আসি সৈয়দ আবুল হোসেন কেন আমার প্রিয় বন্ধু। এরিস্টোটলকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: ডযধঃ রং ধ ভৎরবহফ? এরিস্টোটল উত্তরে বলেছিলেন: অ ংরহমষব ংড়ঁষ ফবিষষরহম রহ ঃড়ি নড়ফরবং. সৈয়দ আবুল হোসেন আর আমি দুই আত্মা কিন্তু আমার চিন্তা চেতনার সাথে তার চিন্তা চেতনার মিল এত বেশি যে, আমি তাঁকে পৃথক ভাবতে পারি না। বিখ্যাত সাহিত্যিক ও দার্শনিক রালফাওয়ালডু ইমারসন বন্ধুর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, অ ভৎরবহফ রং ড়হব নবভড়ৎব যিড়স ও সধু ঃযরহশ ধষড়ঁফ। সৈয়দ আবুল হোসেন তেমনি একজন লোক, যাঁর সমানে আমি আমার চিন্তা-চেতনা ও দর্শনকে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করতে পারি। তিনি আমার সাথে একমত না-হতে পারেন কিন্তু আমার চিন্তা ও বাকস্বাধীনতাকে যথামর্যাদা প্রদান করেন। আমাকে উপদেশ দেন, আমার কথা হতে শেখেন, গুরুত্ব দেন এবং আমার ভালো কাজের প্রশংসা করেন, অন্যদিকে কোনো কাজ মনঃপূত না হলে তাও গোপন রাখেন না।
অহঙ্কার সকল সম্পর্কের শত্র“। অহঙ্কারী মানুষ যেমন কারও বন্ধু হতে পারে না, তেমনি কেউ তার বন্ধুও হতে পারেন না। সৈয়দ আবুল হোসেনকে যে-দিকে বিবেচনা করা হোক না কেন, তিনি একজন সফল ব্যক্তি। অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, রাজনীতি, পদ, চেহারা, বংশমর্যাদাÑসবদিকে তিনি পরিপূর্ণ। অথচ কোনো অহংবোধ তাঁর মাঝে নেই। জনগণের ভোটে নেতা হবার পর অনেকে ‘আমি কি হনুরে’ অহংবোধে অহঙ্কারী হয়ে ওঠেন কিন্তু আবুল ভাইয়ের কাছে আমি এ অহংবোধ কোনো দিন দেখিনি। মন্ত্রী আবুল হাসান আর সাধারণ আবুল হাসান দু’জনই সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে সমমর্যাদা পায়। এ রকম মানুষ কারও প্রিয় বন্ধু না-হয়ে পারে না।
সৈয়দ আবুল হোসেন সাধারণ কোনো মানুষ নন। তাঁর চরিত্রের দুটো বৈশিষ্ট্য আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। প্রথমত তিনি সকল প্রতিকুল অবস্থা বিচক্ষণতা ও ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করে প্রতিকূলতাকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার অবিশ্বাস্য কৌশলের অধিকারী। প্রতিকূলতা তাঁকে বিষণœ করে না, সতর্ক করে, বিপদ তাঁকে বিপর্যস্ত করে না বরং দক্ষ করে তোলে। ফলে তিনি আরও এগিয়ে যাবার দ্যোতনায় মেতে ওঠার পথ খুঁজে পান। অনেক সময় অনেক প্রতিকূল অবস্থায় তাঁকে দেখেছি কিন্তু মুখের সে সুন্দর হাসিটা কখনও মলিন হতে দেখিনি। বিপদে তার নিখাদ হাসিটা মেঘমালাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। দ্বিতীয়ত তিনি একজন মহান দাতা। এলাকা এবং দেশের জন্য নিজের অর্জিত অর্থ অকাতরে দান করেন। দান করার মধ্যে মানুষ যে এত আনন্দ পান তা সৈয়দ আবুল হোসেনকে না-দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না। তাঁর অবারিত দানের বিশালতা এত ব্যাপক যে, তা হাজি মুহসীন এবং আর পি সাহা-কে ছাড়িয়ে গেছে। অনেক বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তিনি করেছেন, লক্ষ লক্ষ মানুষকে আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন, কিন্তু কোনো দিন তা প্রকাশ করতে দেখিনি। দীর্ঘ বন্ধুত্বের কারণে আমি আস্তে আস্তে জানতে পেরেছি।
এডগারওয়াটসন হো-এর একটি কথা আমার মনে পড়ছে: ডযবহ ধ ভৎরবহফ রং রহ ঃৎড়ঁনষব, ফড়হ’ঃ ধহহড়ু যরস নু ধংশরহম রভ ঃযবৎব রং ধহুঃযরহম ুড়ঁ পধহ ফড়. ঞযরহশ ঁঢ় ংড়সবঃযরহম ধঢ়ঢ়ৎড়ঢ়ৎরধঃব ধহফ ফড় রঃ. এ রকম দেখেছি আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে। সাধারণত কেউ বিপদে পড়লে শুভাকাক্সক্ষীরা এগিয়ে এসে প্রয়োজনের কথা জানতে চান; জানতে চান কী প্রয়োজন, কতটুক প্রয়োজন। সৈয়দ আবুল হোসেনকে আমি এমন সাধারণ শুভার্থীর মতো আচরণ করতে কখনও দেখিনি। কেউ বিপদে পড়লে তিনি এসে যা প্রয়োজন তা করে দিয়ে যান স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো প্রশ্ন না-করে। এটি বন্ধু ছাড়া কেউ করতে পারে না।
সৈয়দ আবুল হোসেনের এমন কেউ ছিলেন না, যার উপর ভর করে তিনি এগিয়ে যেতে পারেন, তবে তাঁর এমন একজন গার্ডিয়ান আছে যা সব গার্ডিয়ানের সেরা। সেটি হলো একাগ্রতামণ্ডিত আত্মবিশ্বাস। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সততা। এগুলোর সম্মিলনে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন আদর্শ ফ্রেন্ড-এর সব উপাদানে বিভূষিত অপরিহার্য একজন মানুষ যার নিকট হতে কেউ বিমুখ হয়ে আসে না। স্যামুয়েল জনসনের ভাষায়: ঞযবৎব পধহ নব হড় ভৎরবহফংযরঢ় রিঃযড়ঁঃ পড়হভরফবহপব, ধহফ হড় পড়হভরফবহপব রিঃযড়ঁঃ রহঃবমৎরঃু. আমি অনেক সময় অনেক সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে ছুটে গিয়েছি। তিনিও এসেছেন, আমরা পরস্পরকে গভীরভাবে অনুভব করেছি ঠিকÑ ঋৎরবহফংযরঢ় রং ধ ংযবষঃবৎরহম ঃৎবব প্রবাদের মতো।
পৃথিবীতে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক বন্ধুত্ব এবং সবচেয়ে দুর্লভ সম্পর্কও বন্ধুত্ব। হয়ত দুর্লভ বলে এত শ্রেষ্ঠ, নয়ত-বা শ্রেষ্ঠ বলেই এত দুর্লভ। প্রাত্যহিক জীবনে অনেকের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা হয়ে থাকে। তাদের আমরা সাধারণভাবে বন্ধু বলে পরিচয় দেই। তবে বন্ধুর সংজ্ঞায় ফেললে কয়জন বন্ধু হবে? সৈয়দ আবুল হোসেন এমন একজন মননশীল ব্যক্তি, যার প্রতিটি ব্যবহার প্রতিটি আচরণ বন্ধুত্বের শালীন চমৎকারিত্বে উজ্জ্বল। তিনি বন্ধুর উত্থানে উৎফল্ল হন, বন্ধুত্বকে বন্ধুত্ব দিয়ে পরিশোধ করেন। ঘড় ঢ়বৎংড়হ রং ুড়ঁৎ ভৎরবহফ যিড় ফবসধহফং ুড়ঁৎ ংরষবহপব, ড়ৎ ফবহরবং ুড়ঁৎ ৎরমযঃ ঃড় মৎড়.ি
আমাদের নামের মাঝেও রয়েছে মিল। অনেকে আমাকে আর তাঁকে গুলিয়ে ফেলেন। আবার অনেকে আমাদের পরস্পরকে ভাই মনে করেন। এর কারণ সৈয়দ আবুল হোসেনের এক ছোট ভাই আছেন নাম আবুল হাসান। আবার আমার চেহারাও অনেকটা তাঁর ছোট ভাইয়ের মতন। মন্ত্রী থাকাকালীন অন্যকোনো রীতি বা বাধ্যবাধকতা না-থাকলে আমি আর সৈয়দ আবুল হোসেন প্রায় পাশাপাশি বসতাম। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। দু’জন কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতাম। আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক দেখে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা স্নেহমাখা কণ্ঠে আমাদেরকে হাসান হোসেন দুই ভাই বলে উৎসাহ দিতেন।
নেতৃত্বের প্রতি আমার দুর্বলতা জন্মগত। আমাদের দেশে সাধারণত রাজনীতি করলে নেতা নামে সম্বোধিত হয়। নেতা নামে পরিচিতি পায়। আসলে নেতা হওয়া সহজ নয়। আমি রাজনীতিবিদদের মাঝে নেতার বৈশিষ্ট্য খুঁজতে গিয়ে আবুল হোসেনের মাঝে তার প্রচ্ছায়া দেখতে পেয়েছি। তিনি নিজের চেয়ে নিজের ভোটারদের কথা, নিজের ভোটারদের চেয়ে দেশের কথা বেশি ভাবেন। তাই তিনি দলের হয়েও দেশের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারেন। তার মতো ত্যাগী এবং ধৈর্যশীল মানুষ খুব কম আছে। তাই ঝধুবফ অনঁষ ঐড়ংংধরহ, যব রং সু নবষড়াবফ ধহফ যব রং সু ভৎরবহফ.

আবুল হাসান চৌধুরী: প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

বিশ্বব্যাংকের পিঠটান : বাংলাদেশের উত্থান
মুন জনি
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। বাতিলের ঘোষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং সিদ্ধান্তটি অবিলম্বে কার্যকর হবে। বাংলাদেশ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাবার দাবি ডাহা মিথ্যা। দীর্ঘ তিন বছর বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছে। যারা পদ্মা সেতু প্রকল্পের সাথে জড়িত ছিলেন তারা জানেন বিশ্বব্যাংক ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের মত একটি সার্বভৌম সত্তা সাথে কেমন অপমানজনক আচরণ করেছে। এটি ঠিক হতদরিদ্র প্রতিবেশীর সুন্দরী কন্যার প্রতি ধনী প্রতিবেশীর বখাটে ছেলের আচরণের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বিয়ে করার অজুহাতে সব নিয়ে শেষ পর্যন্ত ছুঁড়ে দেয়া। বিচার চাওয়ার সুযোগ নেই, গরিবের কন্যা, বিচার চাইতে যাবে কীভাবে! বিচারে গেলে আরও বিপদ। বলা হবেÑ দেশে তো আরও অনেক মেয়ে আছে, তাদের প্রতি তো সাহেবের নজর যায়নি। নিশ্চয় তুমিই উসকে দিয়েছো!
পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের আকস্মিক পিঠটানের ঘটনাটি বাংলাদেশের মানুষকে হতভম্ব করে দিয়েছে। এতে অনেকের মধ্যেই নানা ধরনের প্রশ্ন জেগেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন যখন তদন্ত অব্যাহত রেখেছে, ঠিক সে মুহূর্তে বিশ্বব্যাংক কেন ঋণচুক্তি বাতিল করলÑ সেটি কোনভাবে মেলানো যাচ্ছে না। অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন এসে ভীড় করছে। দুর্নীতি করলে করেছে তিন/চার জন এবং তদন্তও চলমান। তারপরও ষোল কোটি মানুষের বুকে আঘাত কীভাবে কোন বিবেচনায় ন্যায্য হতে পারে?
এ বিষয়ে আমার অনেক বিদেশি বন্ধুর সাথে আলাপ হয়েছে। তারাও বিশ্বব্যাংকের এমন আচরণ সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিমতÑ বিশ্বব্যাংকের ঋণ দেয়ার কোন উদ্দেশ্য ছিল না। চুক্তির দুই বছর পর দুর্নীতির অভিযোগ তোলা এবং দুই বছর পর্যন্ত ঋণ প্রদানে গড়িমসি বিশ্বব্যাংকের অজুহাত তৈরির কৌশল ছাড়া আর কিছু ছিল না। অর্থমন্ত্রী স্বয়ং পদ্মা সেতু প্রকল্প বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে অভিহিত করেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন অনেক অর্থনীতিবিদ বিশ্বব্যাংকের এই কাজটিকে একই সঙ্গে দুর্ভাগ্যজনক, দুঃখজনক ও রহস্যজনক বলে বর্ণনা করেছেন। একটা জিনিস লক্ষণীয়, ২০১১ এর প্রথম দিক থেকে বিভিন্ন কারণে অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে ঠাণ্ডা লড়াই চলে আসছিল। উভয় মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বেশ টানাপোড়েনও ছিল। তারপরও অর্থমন্ত্রী দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেছেনÑ পদ্মা সেতু নির্মাণে কোন দুর্নীতি হয়নি। লক্ষ্য করে দেখুনÑ সামান্য দুর্নীতি হলেও অর্থমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে ছাড় দিয়ে কথা বলতেন না।
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের বিষয়ে যে ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে তা রীতিমতো আপত্তিজনক। অন্য কোন দেশ হলে এতদিন তোলাপাড় হয়ে যেত। পদ্মা সেতু নিয়ে প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতির কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এটি শুধু মুখের কথা না, বিশ্বব্যাংক নিজেও এখন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিব্রতকর অবস্থায় আছে। শুধুমাত্র একটি ‘সম্ভাব্য দুর্নীতি’র ধারণা ব্যক্ত করে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি বাতিল করা কতখানি বিচক্ষণতার কাজ? বিশ্বব্যাংকের মতো একটি অতিশয় দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এমন আচরণ কেউই প্রত্যাশা করেনি। বিশ্বব্যাংকের এ কাজটাকে আমার জনৈক মার্কিন বুন্ধ ডেভিট ভারহাট নৃশংস বলে আখ্যায়িত করেছেন। জার্মান অর্থনীতিবিদ মর্গান ফ্রে এর ভাষায়Ñ এটি একটি শিশুর প্রতি আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একজন সৈনিকের বেয়নেট চালিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করার সাথে তুলনা করা যায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একলা চল নীতির কথা বলতে ফ্রে বললেন: শিশুটি জেগে উঠেছে। উষ্ণ রক্ত তপ্ত হয়ে নিষ্ঠুর সৈনিকের বেয়নেটকে গলিয়ে দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তোমার বাংলাদেশ যদি এমন করতে পারে তাহলে আমার জার্মানকেও হার মানাতে পারবে।
অবশ্য কেউ কেউ পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংককে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ইতিবাচক সহায়ক শক্তি বলে মনে করেন। এ নিয়ে কারও সংশয় নেই, তবে সেটি কখন? যখন ঋণ দেবে তখন। বিশ্বব্যাংক যদি সাহায্য করে তাহলে তা সহায়ক শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে। সাহায্য না দিয়ে যদি শুধু উপদেশ দিতে থাকে, শুধু খোঁচা দিয়ে যায় তাহলে সেটি কখনও ইতিবাচক এবং সহায়ক হবে না। পদ্মা সেতুর ঋণ নিয়ে বিশ্বব্যাংক গত তিন বছরে যা করেছে তা সহায়তা নয়, খোঁচা। এমন খোঁচাকে যদি কেউ সহায়ক শক্তি বলে তাহলে তাকে পাগল ছাড়া আর কী বলা যায়। ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ মেখে স্বপ্ন দেখা যায় কিন্তু গাড়ি হাকিয়ে পদ্মা সেতু পার হওয়া যায় না। বিশ্বব্যাংক ঋণ না দিলে কী পদ্মা সেতু হবে না? আসওয়ান বাঁধ হয় নি? চিন কী বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়া আর্থিক পরাশক্তি হয়ে ওঠেনি? আমরা কী যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাংকের দিকে চেয়ে বসে থাকব? 
মালয়েশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ এবং আর্থিক সংস্থা পদ্মা সেতু নির্মাণে সহায়তার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ক্ষেত্রে কোন কোন বিশ্লেষকের ধারণা এরূপ ক্ষেত্রে সহায়তাকারীগণ নিজেদের আর্থিক স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেবে। ফলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। মালয়েশিয়া বা অন্য কোন আর্থিক সংস্থার সহায়তায় পদ্মা সেতু নির্মিত হলে সেতুর মালিকানা সুনির্দিষ্ট মেয়াদে বেসরকারি খাতে চলে যেতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের স্বার্থ ক্ষুণœ হতে পারে। এটি আংশিক সত্য হলেও পুরোপুরি সত্য নয়। বিশ্বব্যাংকের ঋণে সুদের হার কম হলেও কনসালটেন্ট নিয়োগ, যন্ত্রপাতি আমদানি, উপদেশ, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, অন্যান্য দেশীয় উৎপাদনমুখী শিল্পে নিরুৎসাহজনক তৎপরতার মাধ্যমে যে অর্থ নিয়ে যায় তার শতকার হার পঁচিশেরও বেশি। এ জন্য কোন দেশ বিশ্বব্যাংকের কোন প্রকল্প হতে প্রকৃতপক্ষে লাভবান হতে পারেনি। 
সৈয়দ আবুল হোসেন একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। বিদেশেও তিনি যথেষ্ট সুনামের অধিকারী। ‘বোয়াও’ ফোরামের মত আন্তর্জাতিক সংগঠনে তার প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবেও তার দক্ষতা সুবিদিত। শিক্ষা প্রসার ও সমাজ সেবায় তিনি প্রচুর অর্থ খরচ করেছেন। তার মত একজন লোক বিশ্বব্যাংকের কথিত সামান্য অর্থের জন্য লালায়িত হবেনÑ এমনটি যারা সৈয়দ আবুল হোসেনকে চেনেন তারা কখনও বিশ্বাস করবেন না। বিশ্বব্যাংকের মত একটি প্রভাবশালী সংস্থাকে তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, “বিন্দুমাত্র দুর্নীতি হয়নি, আমি কোন দুর্নীতি করিনি। করে থাকি তো প্রমাণ করে দেখান।” বিশ্বব্যাংক দেখাতে পারেনি। শুধু কান কথায় বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির কথা বলে যে চুক্তিটি বাতিল করল তা চরম পাশবিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
যত কিছুই হোক, বিশ্বব্যাংক আসুক বা না আসুক সরকারকে অবশ্যই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ চুক্তি বাতিল একটি সাময়িক বিপর্যয় মাত্র। এটাকে একটি সাময়িক বিপর্যয় হিসাবে মনে করাই ভাল। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সরকারকে অবশ্যই পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিষয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না। সরকারকে নতুন উদ্যোগে, নতুন উদ্যোমে অগ্রসর হতে হবে। বিশ্বব্যাংক ঋণ দেবে না, চলে গেছে এটি ভাল। আরও পরে হলেও ঋণ চুক্তি বাতিল করত। সে হিসেবে আগেভাগে আপদ বিদায় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজ উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের কঠোর সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। এটি বাংলাদেশের স্বনির্ভর হওয়ার একটি অনন্য মাইলফলক সিদ্ধান্ত। পরনির্ভর অর্থনীতি চিরকালই বিপর্যয় ডেকে আনে। তাই সবার উচিত পরনির্ভরতা এড়িয়ে চলা। পরনির্ভরশীল জাতি কখনও উন্নতির মুখ দেখে না। তাই আমাদের উচিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলা: পদ্মা সেতু প্রকল্পে এক পয়সাও দুর্নীতি হয়নি। সেই সঙ্গে পদ্মা সেতু নির্মাণে তার দৃপ্ত প্রত্যয়ে সার্বিক সহযোগিতা করা। বিশ্বব্যাংকের এ পিঠটান হতেই হবে বাংলাদেশের উত্থান। 
আমি বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী। এ দেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পরিচালকের মর্যাদা বাণিজ্যিক ব্যাংকের একজন শাখা ব্যবস্থাপকের চেয়েও অনেক নিচে!

মুন জনি: প্রজেক্ট ম্যানেজার, আইআরডিসি, নিউজিল্যান্ড।

শুধু তার বেলা কেন?
অর্ণব রায়
সড়ক দুর্ঘটনা পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে অনিবার্য আতঙ্ক। শুধু উন্নয়নশীল দেশ নয়, উন্নত দেশেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আমেরিকা, ফ্রান্স, লন্ডন, জাপান, সিঙ্গাপুর হতে শুরু করে বাংলাদেশের মত এশিয়া-আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোও সড়ক দুর্ঘটনা হতে মুক্ত নয়। বরং জনসংখ্যা, যানবাহন ও আধুনিক অবকাঠামো বিবেচনায় উন্নয়নশীল দেশে সড়ক দুর্ঘটনার তুলনামূলক ভয়াবহতা উন্নত দেশের তুলনায় তেমন ভয়ঙ্কর নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর অধিকাংশই উন্নত বিশ্বে ঘটেছে। এক হিসেবে দেখা যায়, ১৮৫০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় সারা বিশ্বে ২১৩০ জন্য বিখ্যাত ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তম্মধ্যে ৭০ ভাগই বিখ্যাত ব্যক্তিই উন্নত বিশ্বের লোক। তবে দুর্ঘটনার হার বিবেচনায় উন্নত বিশ্বে প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে কেবল ২টি গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রতি দশ হাজার গাড়িতে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত গাড়ির সংখ্যা ৫০ এর অধিক। বিশ্বব্যাংকের হিসেবমতে তা ৮৫.৬। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানে তা যথাক্রমে ২০ ও ১৭.৫। উন্নত বিশ্বে সংঘটিত দুর্ঘটনার অধিকাংশ ধনী ও দামি গাড়ি চালকের ক্ষতির কারণ হয় কিন্তু বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশসমূহে সংঘটিত দুর্ঘটনার মধ্যে ৫৪ ভাগ দুর্ঘটনার শিকার হন পথচারী এবং মৃত্যুর হার বিবেচনায় তা ৫৮ ভাগ। 
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২১৩০ জন বিখ্যাত ব্যক্তির মধ্যে কেবল কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে প্রবন্ধের ইতি টানা হবে। যাদের নাম উল্লেখ করা হবে তাদের অনেকে সুবিজ্ঞ পাঠকের কাছে পরিচিত। তবে অনেকে হয়ত জানেন না তারা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এ সকল বিখ্যাতদের মধ্যে রাষ্ট্্র প্রধান, সরকার প্রধান, রাজনীতিবিদ, নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, স্থপতি, প্রকৌশলী, খেলোয়ার, কবি-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, গণিতজ্ঞ, গায়ক, লেখক, দার্শনিক, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক, রেসলার, এ্যথেলেট, সাংবাদিক, শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও নভোচারীসহ আরও অনেক পেশার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিরা রয়েছেন। আমাদের বাংলাদেশেও অনেক বিখ্যাত লোক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিউট বাংলাদেশের সেরা দশটি চলচ্চিত্রের যে তালিকা করেছেন তাতে আলমগীর কবিরের ৩টি ছবি স্থান পেয়েছে। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া হতে ঢাকা আসার পথে বাংলাদেশের ইতিহাসে অর্থমন্ত্রী হিসেবে অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী জনাব সাইফুর রহমান (১৯৩২-২০০৯) সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন।
বিশ্বখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী ও নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী পিয়েরে কুরি (চরবৎৎব ঈঁৎরব, ১৮৫৯-১৯০৬) ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তার স্ত্রী মাদাম কুরী দুই বার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। ফ্রান্স ও বহিঃবিশ্বে সেকালে তার চেয়ে অধিক জনপ্রিয় বিজ্ঞানী খুব কম ছিলেন। ফরাসি দার্শনিক আলবার্ট ক্যামুর (অষনবৎঃ ঈধস) নাম জানেন না এমন শিতি লোক নেই বললেই চলে। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী এ সাহিত্যিক ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। ফরাসিরা বাংলাদেশির চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত ও অধিকার সচেতন। পিয়েরে কুরি ও আলবার্ট ক্যামুর মৃত্যু ফ্রান্সসহ সারা বিশ্বকে শোকে বিহবক্ষল করে তুললেও ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবীরা গলায় প্লেকার্ড বেঁধে যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ চাননি, অনশনও করেননি। শিশুদের বৃষ্টির মধ্যে দাঁড় করিয়ে পদত্যাগ চাই লেখা ঝুলিয়ে চীৎকার দিতে বাধ্য করেননি। ভল্টেয়ারের দেশ ফ্রান্সে বুদ্ধিজীবীর অভাব ছিল না। পিয়েরে ও আলবার্ট ক্যামুর মত লোকের মৃত্যুর পরও ফ্রান্সের কোন বুদ্ধিজীবী সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রীকে দায়ি করে কাফনের কাপড় পড়ে অনশনে নামেননি। অথচ তারিক মাসুদ ও মিশুক মুনীর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসবের দিন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক শহিদ মিনারে গিয়ে কিছু বুদ্ধিজীবী ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে যা করেছেন তা সত্যি অভাবনীয়। আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে যৌক্তিক কারণে কোন বিরোধী দল এমন হাস্যকর আন্দোলনে নামেনি। তখন সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সৃষ্ট আন্দোলন খারাপ মনে হয়নি। ভেবেছিলাম, বাংলাদেশের মানুষ জেগেছে। এবার হতে যে কোন দুর্ঘটনায় এমনটি হবে। কিন্তু অবাক লাগে যখন দেখি, সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় হতে সরে যাবার পর আর কোন আন্দোলন নেই, সবাই কেন জানি থেমে গেছে। আরও ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটার পরও কেউ আর শহিদ মিনারে শিশুদের গলায় প্লেকার্ড ঝুলিয়ে মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন না। তাহলে লক্ষ্য কী কী শুধু সৈয়দ আবুল হোসেন! 
নাইজেরিয়ান নেতা এডেগোক আদেলাবুর (অফবমড়শব অফবষধনঁ) জনপ্রিয়তা সম্পর্কে কম-বেশি অনেকের জানা। তিনি ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকাকালীন মাত্র ৪৩ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুবরণ না করলে তিনিই হয়ত দেশটির পরবর্তী সরকার প্রধান হতেন। তার লক্ষ লক্ষ ভক্ত ছিল। তারপরও সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যুর জন্য যোগাযোগ মন্ত্রী বা সরকারকে দায়ি করে কোন নাইজেরিয়ান স্মৃতিসৌধে গিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেননি। ইরাকের রাজা গাজি (১৯১২-১৯৩৯) ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে রাজা থাকাকালীন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এখানেও কাউকে সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের দাবির মত কোন ঘটনায় বাড়াবাড়ি করতে দেখা যায়নি। কারণ সবাই জানেন, ঘটনার পাশে দুর্ঘটন থাকবেই। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন টোগোর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস গ্র“নটিজকাই (১৯১৩-১৯৬৯)। নিহতকালীন ক্ষমতায় ছিলেন তার প্রতিপক্ষ। তারপরও গ্র“নটিজকাইয়ের অনুসারীরা যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেননি। দুর্ঘটনা নিয়ে সবাই মর্মাহত হয়েছেন। শোকে দক্ষ হয়েছেন, দুর্ঘটনা হ্রাসের ব্যবস্থায় উদ্দীপ্ত হয়েছেন কিন্তু এজন্য কারও পদত্যাগ দাবির মত অপ্রাসঙ্গিক ঘটনা ঘটেনি। সড়ক দুর্ঘটনা যদি যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগের করণ হয় তাহলে পৃথিবীর কোন দেশে কোন মন্ত্রী এক মিনিটও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
জুসেলিনো কুবিটসেক (১৯০২-১৯৭৬) ১৯৫৬ হতে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার শাসনকালকে ব্রাজিলের উন্নতির স্বর্ণযুগ বলা হয়। তিনি ব্রাসিলিয়ার প্রতিষ্ঠাতা। ‘পাঁচ বছরে পঞ্চাশ বছরের উন্নয়ন’ শ্লোগান নিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে শ্লোগানে দেয়া প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ব্রাজিলের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট হবার পূর্বে তিনি গভর্নর ও মন্ত্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। এখনও তিনি ব্রাজিলের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে খ্যাত। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার লোক সমবেত হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ঘটনার জন্য কোন মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়নি। ভারতীয় মন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা রাজেশ পাইলট ২০০০ খ্রিস্টাব্দে, আজেরবাইযান প্রজাতন্ত্র সরকারের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান জাফর সিভেরি (ঔধ’ভধৎ চরংযবাধৎর) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। কমিউনিস্ট যুগেও সোভিয়েত নেতা প্যইটর ম্যাসহেরভকে (১৯১৮-১৯৮০) সাধারণ মানুষের প্রাণ বলা হতো। চলার পথে হাজার হাজার লোক স্বতস্ফূর্ত ভালবাসায় তাকে সিক্ত করতেন। এমন জনপ্রিয় নেতা ম্যাসহরেভ ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের মত কট্টর দেশেও এজন্য কারও পদত্যাগ দাবি করা হয়নি। কারণ দুর্ঘটনা কাউকে এককভাবে দায়ি করার বিষয় নয়। কোন দুর্ঘটনার জন্য কাউকে এককভাবে দায়ি করা হলে সেটাকে দুর্ঘটনা বলা যায় না। বলতে হয় খুন। বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ঘটনার ৫৬ ভাগ সংঘটিত হয় চালকের অদক্ষতা এবং ২০ ভাগ সংঘটিত হয় বেপরোয়া গতির জন্য।
সিরিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হাফিস আল-আসাদের জ্যেষ্ঠপুত্র বাসেল-আল- আসাদ ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৪২ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরন করেন। সিরিয়ার সংবিধান অনুসারে প্রেসিডেন্টের জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে তিনি ছিলেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। মৃত্যুবরণ না করলে তিনি সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বশির-আল আসাদের স্থানে অধিষ্ঠিত থাকতেন। প্রজাসাধারণের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। সিরিয়ার বুদ্ধিপ্রাপ্ত সবাই তাকে চিনতেন এবং ভালবাসতেন। তারপরও তার মৃত্যুতে যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়নি। বেলজিয়ামের রাণী অস্ট্রিড অব সুইডেন (১৯০৫-১৯৩৫) ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩০ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও শিক্ষাবিদ। বেলজিয়ামের আবালবৃদ্ধবনিতা সবার নিকট তিনি পরিচিত ছিলেন। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন রাণী অস্ট্রিডের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বেলজিয়ামসহ পুরো ইউরোপকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছিল। তবু কোন বেলজিয়ান তাদের যোগাযোগ মন্ত্রী বা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে মিছিল-মিটিং কিংবা শোভাযাত্রা করেননি। তারা জানতেন দুর্ঘটনা জীবনের অনিবার্য বাস্তবতা। একে এড়ানোর চেষ্টা করা যায় কিন্তু সবসময় এড়ানো যায় না। দুর্ঘটনাকে যদি এড়ানো যেত তাহলে বেলজিয়াম, ফ্রান্স কিংবা আমেরিকার মত দেশে কী দুর্ঘটনা ঘটতো! 
যুগোশ্লাভিয়ার প্রিন্স ক্রিস্টোফার (১৯৬০-১৯৯৯) ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে সিড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। নভোচারী পিট কনরার্ড (চবঃব ঈড়হৎধফ. ১৯৩০-১৯৯০) চাঁদে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। একদিন মোটর সাইকেল চালিয়ে অফিসে যাচ্ছিলেন। পিছন থেকে একটি গাড়ি এসে ধাক্কা মারে। তিনি মারা যান। তার মৃত্যুতে আমেরিকা স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। তারপরও মার্কিন যোগাযোগ মন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চেয়ে বিরোধী দল বা বুদ্ধিজীবীরা স্ট্যাচু অব লিবার্র্টিতে জড়ো হবার খবর পাওয়া যায়নি। যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির জনপ্রিয় এম পি বব ক্রেয়ার ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তার অনুকূলে দুটি ইলেকট্রনিক চ্যানেল ছিল। তার উত্তরসুরীরা ইচ্ছা করলে ব্রিটেনের সবগুলো চ্যানেলে সংবাদ কিংবা টকশো দিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনেক অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিতে পারতেন। বাংলাদেশের মত ব্রিটেনের সবগুলো চ্যানেল স্বেচ্ছায় দল বেঁধে নিহতের সৎকারে নেমে যেতে পারতেন। কিন্তু নামেনি। বব ক্রেয়ারকে কম সম্মান দিয়ে সৎকার করা হয়েছে তাও কিন্তু নয়। তবে বাড়াবাড়িও করা হয়নি। অতিরিক্ত কোন কিছু ভালো না। বাড়াবাড়ি সৌন্দর্য্য নয়, সম্মানজনক তো নয়ই। তরকারিতে মসলা বেশি দেয়া স্বাদের লক্ষণ নয়, বিস্বাদের পরকাষ্ঠা। যেমন ব্যক্তিত্বের লক্ষণ নয় অতিরিক্ত সাজগোজ। বরং অতিরিক্ত সাজগোজ একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষকেও হাস্যকর করে তোলে।
ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সদস্য ডায়ানার (১৯৬১-১৯৯৭) জনপ্রিয়তা এখনও প্রবাদ প্রতিম। তিনি ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় ফ্রান্সে মৃত্যুবরন করেন। তার মৃত্যুতে শধু ব্রিটেন নয়, রীতিমত সারা বিশ্বের কিশোর-তরুণ, অবালববৃদ্ধবনিতা শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশেরা ফ্রান্সের সরকারকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ি করে আন্দোলনে নামতে পারতেন। রাণীর প্রসাদের সামনে গিয়ে শিশুদের গলায় প্লেকার্ড ঝুলিয়ে বলতে পারতেন-ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এর পদত্যাগ চাই, করতে হবে। কিন্তু এমন কোন হাস্যকর ঘটনা ঘটেনি। কারণ সবাই জানেন দুর্ঘটনা কারও প্রত্যাশিত নয়, অপ্রত্যাশিত কারণে এটি আকস্মিকভাবে ঘটে। এর জন্য গাড়িচালকসহ অসংখ্য নির্ধারিত-অনির্ধারিত কারণ জড়িত। রাস্তার জন্য যদি দুর্ঘটনা হতো, দক্ষমন্ত্রী যদি দুর্ঘটনার কারণ হতো তাহলে উন্নত বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতো না। ডায়ানার সাথে নিহত হয়েছিলেন মিশরের ধনকুবেরের ছেলে দোদি ফায়েদ (১৯৫৭-১৯৯৭)। একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে ধনকুবের পিতা মিশরের সৌধে সৌধে ফ্রান্স সরকারের পতন চেয়ে পুরো মিসরকে মাতিয়ে রাখতে পারতেন। কিন্তু সংগত নয় বলে করেননি।
রাশিয়ান কবি ও রক সঙ্গীতজ্ঞ ভিক্টর সয় (ঠরশঃড়ৎ ঞংড়ু, ১৯৬২-১৯৯০), জাপানি এ্যাথেলেট তমিউকি তানিগুচি (ঞড়সড়ুঁশর ঞধহরমঁপযর, ১৯৬১-১৯৯০), রুমানিয়ান লেখক মিহাইল সেবাস্টিয়ান (১৯০৭-১৯৪৫), জার্মান লেখক ডব্লিউ জি সেবাল্ড (১৯৪৪-২০০১), ইটালিয়ান ফুটবলার গ্যাটানো স্কিরিয়া (১৯৫৩-১৯৮৯), ডমিনিকান কুটনীতিবিদ প্রপিরিও রুবিরোসা (১৯০৯-১৯৬৫), বাংলাদেশি ক্রিকেটার মঞ্জুরুল ইসলাম রানা (১৯৮৪-২০০৭), জ্যামাইকান ফুটবলার স্টিফেন ম্যালকম (১৯৭০-২০০১), ব্রিটিশ জেনারেল টি ই লরেন্স (১৮৮৮-১৯৩৫) এবং অস্ট্রিয়ান রাজনীতিবিদ ক্যারিনথিয়ার গভর্নর জর্গ হায়ড্যের ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। দেশে বিদেশের তাদের জনপ্রিয়তা ও অবদান পাঠকমাত্রই অনুভব্য। তবু কী তাদের মৃত্যুতে যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে? মিসরীয় রাজনীতিক উপদেষ্টা, লেখক ও ক্রীড়াব্যক্তিত্ব আহমেদ হাসানেইন (১৮৮৯-১৯৪৬), মার্কিন জেনারেল জর্জ এস পাটুন (১৮৮৫-১৯৪৫), সাউথ আফ্রিকান গায়ক লেবো ম্যাথুসা (১৯৭৭-২০০৬), স্পেনিশ স্থপতি সিজার ম্যানরিখ (১৯১৯-১৯৯২) দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। সেখানেও এমন পদ্যত্যাগ দাবি দেখা যায়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালেও এমন ঘটনার নজির নেই। তাহলে সৈয়দ আবুল হোসেনের বেলায় কেন হলো?
রাশিয়ান গণিতজ্ঞ ইয়োগের ইভানোভিচ জোলোটারেভ (ণবমড়ৎ ওাধহড়ারপয তড়ষড়ঃধৎবা) ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৩১ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরতা শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশ ছিলেন জোলোটারেভের ভক্ত। অন্যদিকে সারা বিশ্বের গণিত শিক্ষার্থীদের কাছে তার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। তার মৃতু্যুতেও টকশোতে কিংবা রাস্তায় গালাগাল করা হয়নি কোন মন্ত্রী বা সরকার প্রধানকে। র‌্যায়ান ডুন আমেরিকান রিয়েলিটি শো এর প্রবাদ প্রতীম ব্যক্তিত্ব। তার শো উপভোগের জন্য শুধু আমেরিকা নয়, সারা বিশ্বের অবালবৃদ্ধবনিতার আগ্রহ উপচে পড়তো। তিনি ২০১১ খ্রিস্টাব্দে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। মার্কিন সঙ্গীত তারকা মাইকেল হেজেস (১৯৫৩-১৯৯৭) ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তখন একটি সঙ্গীত অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠছিলেন। হাজার হাজার ভক্ত দেখলেন তাদের প্রিয় তারকার রক্তাক্ত দেহ। যার কণ্ঠ হতে এতক্ষণ হৃদয় ছোঁয়া সুর বের হয়েছিল এখন তিনি মাংসপিণ্ড। সবাই শোকে নিথর। আমি জানি না ঘটনাটি বাংলাদেশে হলে এবং বাংলাদেশের যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন থাকলে কী হতো!! শুরু হতো গাড়ি ভাংচুর এবং যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি। যে গাড়িটি দুর্ঘটনার জন্য দায়ি সেটাতেও কেউ একটা ঢিলও মারেনি। তারিক মাসুদ ও মিশুক মুনীর যে গাড়িতে নিহত হয়েছিলেন সেটি ছিল টয়োটা কোম্পানির গাড়ি। জাপানের টয়োটা কোম্পানির চিফ টেস্ট ড্রাইভার ও প্রধান টেস্ট প্রকৌশলী হিরমু নারুস (১৯৪৪-২০১০) ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম যানবাহন প্রকৌশলী। তার হাতে যত গাড়ি টেস্ট হয়ে বাজারজাত করা হয়েছে সে রেকর্ড সহজে ভাঙ্গা যাবে না। তিনি নিজে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এ জন্য টয়োটা কোম্পানি শোক পালন করেছে। তারা ভক্তরা মর্মাহত হয়েছে। তাই বলে আর কাউকে মর্মাহত করার মত কাণ্ড ঘটাননি। 
তারিক মাসুদ ও মিশুক মুনীর জনপ্রিয় ছিলেন। উভয়ের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা রেখে বলছি, মৃত্যুর আগে তাদের পরিচিতি খুব বেশি ছিল না। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে উভয়ে রাতারাতি ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়ে উঠেন। এখন মনে হয় তাদের বিখ্যাত হবার পেছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বলি সৈয়দ আবুল হোসেনই কৃতিত্বের দাবিদার। ঐ সময় সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রী না থাকলে দুর্ঘটনাটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এত প্রচার পেতো না। এটা বলছি এ জন্য যে, ইতোপূর্বে তাদের চেয়ে অনেক জনপ্রিয় পরিচালক ও সাংবাদিক এবং রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তখন কোন ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে এমন তৎপর দেখা যায়নি। কোন বুদ্ধিজীবীকে, শিশু ও নারীদের শহীদ মিনারে জড়ো হয়ে গলায় প্লেকার্ড ঝুলিয়ে কোন মন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করা হয়নি। পরবতীকালেও এমনটা দেখা যায়নি। তাহলে শুধু সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রী থাকাকালীন কেন এমনটি করা হল? পুলিৎজার পুরষ্কার বিজয়ী মার্কিন সাহিত্যিক ডেভিড হলবার্সটাম (১৯৩৪-২০০৭) এর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে কারও সংশয় থাকার কথা নয়। সাংবাদিক হিসেবেও তিনি ছিলেন প্রবল জনপ্রিয়। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতেও অমন অভাবনীয় দৃশ্য চোখে পড়েনি। 
মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক এ্যালান ক্রসল্যান্ড (১৮৯৪-১৯৩৬), সোভিয়েত চলচ্চিত্র পরিচালক ল্যারিসা সেপিটকো (খধৎরংধ ঝযবঢ়রঃশড়) এবং মার্কিন সাংবাদিক জ্যাসিকা সেয়িচ স্বপেশায় শুধু দেশে নয় বিদেশেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। এ্যালান ক্রসল্যান্ড এর হাতে আধুনিক চলচ্চিত্রের বিকাশ। তিনি ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে সড়ক দুর্ঘটনায় তারিক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের ন্যায় নিহত হয়েছেন। ল্যারিসা সেপিটকো (১৯৩৮-১৯৭৯) ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্র জগতের আধুনিক ইতিহাস। তিনি ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ৪১ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। মার্কিন সাংবাদিক জ্যাসিকা সেয়িচ (ঔবংংরপধ ঝধারঃপয) ছিলেন খুব জনপ্রিয়। তিনি ৩৬ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। জীবত থাকাকালীন দেশের ৪০ ভাগ লোকের কাছে তারা পরিচিত ও ভালবাসার পাত্র ছিলেন। তারপরও সড়ক দুর্ঘটনায় তাদের মৃত্যুতে মার্কিন কিংবা সোভিয়েত মিডিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়েনি কিংবা কোন বুদ্ধিজীবী লাইন ধরে জাতীয় ঐতিহ্যময় স্থানে গিয়ে মন্ত্রী ও সরকারের পদত্যাগ দাবি করেননি।
বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ সেলিব্রিটি ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সদস্য প্রিন্সেস ডায়ানা (১৯৬১-১৯৯৭) ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট প্যারিসে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। রেবেল উইথআউট কজ, জায়ান্ট ও ইস্ট অব ইডেন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্বখ্যাতি অর্জনকারী হলিউড অভিনেতা জেমস ডিন (১৯৩১-১৯৫৫) ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর সড়ক দুর্ঘটনা মৃত্যুবরণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর প্রধান জেনারেল জর্জ স্মিথ (১৮৮৫-১৯৪৫) ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হন এবং ২১ ডিসেম্বর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। দ্যা কান্ট্রি গার্ল খ্যাত গ্রেস কেলি (১৯১৯-১৯৮২) ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। হলিউড অভিনেত্রী জ্যায়ান ম্যানসিফিল্ড (১৯৩৩-১৯৬৭) শারীরিক আকর্ষণ আর মুগ্ধকর অভিনয় শৈলীর উৎস। হলিউড অনিবার্যতা হিসেবে খ্যাত এ সেলিব্রেটি ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। বিখ্যাত গিটারিস্ট ও দ্যা এ্যালমান ব্রাদার্স ব্যান্ড এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ডুয়েন এ্যালমান (১৯৪৬-১৯৭১) ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। বিখ্যাত দৌড়বিদ স্টিভ প্রিপনটেইন (১৯৫১-১৯৭৫) ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের নিকট এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। মার্কিন সেলিব্রেটি জ্যাকস পোলক (১৯১২-১৯৫৬) ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। জেমসবন্ড খ্যাত পরপিরো রুবিরোজা (১৯০৯-১৯৬৫) ছিলেন অভিনয়কলার এক বিস্ময়। অনবদ্য খ্যাতির অধিকারী রুবিরোজা ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুলাই প্যারিসে একটি অনুষ্ঠান হতে বাসায় ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। সঙ্গীতে চার বার জার্মান অ্যওয়ার্ড অর্জনকারী লিজা লোপেস আকা (১৯৭১-২০০২) ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল হন্ডুরাসে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। দেশ বিদেশে তাদের খ্যাতি ছিল আকাশচুম্বী। তাদের মৃত্যুতে শোকের মাতম চলেছে কিন্তু কাউকে দায়ি করে পদত্যাগ দাবি করা হয়নি। মৃত্যু একটি শোকাবহ ঘটনা। দুর্ঘটনায় মৃত্যু আরও ভয়ঙ্কর। এমন পরিস্থিতিকে পুঁজি করে যার অযৌক্তিকভাবে কোন সংগত কারণ ব্যতিরেকে অন্যের ক্ষতি বা কষ্টের কারণ হয়, কারও পদত্যাগ দাবি করেন তারা বিবেচক হতে পারেন না। 
এতক্ষণ বললাম গৌরচন্দ্রিকা। এবার আসল কথায় আসা যাক। সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বের সর্বত্র ঘটে থাকে। আফ্রিকার পর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত জনসংখ্যা ও যানবাহনভিত্তিক বার্ষিক দুর্ঘটনা উপাত্তের দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে প্রদত্ত দুর্ঘটনা রিচার্স সেন্টার (এআরসি) এর এক হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১২০০০ সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫ হাজার লোক আহত হন। এক্সিডেন্ট রিচার্স সেন্টার (এআরসি) এর পরিচালক হাসিব মোহাম্মদের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১১ খ্রিস্টাব্দে সারা দেশে ১২২২৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৪৭ জন লোক মৃত্যুবরণ করে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, প্রতি ১০ হাজার গাড়ির মধ্যে ৮৫.৬টি গাড়ি মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয়। একই সময় পরিচালিত আর একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিদিন ২০ জন এবং বছরে ৮০০০ লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ+.৩ করেন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের হিসেবেমতে বাংলাদেশে প্রতিদিন ৩০ জন লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। যা সৈয়দ আবুল হোসেন যখন যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন সে সময়ের চেয়ে অধিক।
মানিকগঞ্জের সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীর নিহত হবার পর পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া যেভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল, যেভাবে যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের দাবি করা হচ্ছিল সে রকম কী এর পূর্বে করা হয়েছে বা এখন করা হচ্ছে? প্রকৃতপক্ষে সিংহভাগ দুর্ঘটনার ন্যায় এক্ষেত্রেও চালকের অসতর্কতা ও অতিবৃষ্টি ছিল মানিকগঞ্জের অবাঞ্ছিত ও শোকাতুর দুর্ঘটনার কারণ। দুর্ঘটনা স্থলের সড়কে কোন গর্ত বা খানখন্দক ছিল না। তারপরও এর জন্য যোগাযোগ মন্ত্রীকে দায়ি করে তার পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে। দাবির গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদ মিনারে ঈদের দিন শিশুদের গলায় মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি কী প্রকৃতপক্ষে দুর্ঘটনার প্রতিকারের জন্য করা হয়েছিল? যদি তা হয় তো কেন এখন তেমনটি করা হচ্ছে না! ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর ব্রিজ ভেঙ্গে একটি বাস নিচে পড়ে গেলে ৯ জন লোক নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়েছে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ঢাকায় একটি বাস দুর্ঘটনায় ১৫ জন লোক নিহত হয়। ১৬ মার্চ, ২০১৩ তারিখে কুমিল্লায় সড়ক দুর্ঘটনায় একই গ্রামের ৭ জন শিশু মৃত্যুবরণ করেছে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ হবিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় দায়িত্বরত পুলিশের একটি পিক্যাপ ভ্যান দুমড়ে-মুচড়ে ১৭ জন পুলিশ মারাত্মকভাবে আাহত হয়েছে। এ সামান্য পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে সৈয়দ আবুল হোসেন উত্তর দুর্ঘটনার সংখ্যা আবুল হোসেনকালীন দুর্ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি। তারপরও আবুল হোসেনের সময় দুর্ঘটনা নিয়ে যা করা হয়েছে এখন তা করা হচ্ছে না। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, দুর্ঘটনা নয়, আসলে সৈয়দ আবুল হোসেনই ছিল ফ্যাক্টর। বিদেশি প্রভুদের আশীর্বাদপুষ্ট কিছু সংবাদপত্র ও বুদ্ধিজীবী প্রভুদের নির্দেশে আবুল হোসেন নিধনে নেমেছেন। আবুল হোসেন নিধন হবার পর, আওয়ামী লীগ নিধন; তারপর মিশন শেষ। তাই দুর্ঘটনা ঘটলেও, রাস্তা আগের চেয়ে আরও খারাপ হলেও তা নিয়ে আর অনশন হয় না।
সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রীর পদ হতে সরে আসার পর আরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিনি যোগাযোগ মন্ত্রী থাকাকালীন যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার সংখ্যা ও ভয়াবহতা পরবর্তীকালে সংঘটিত দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ভয়াবহতার চেয়ে অনেক কম। তিনি মন্ত্রী থাকাকালীন প্রতিদিন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২০; বর্তমানে তা ত্রিশ। তার পদত্যাগের পর কিছুদিন পূর্বে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে এক সাথে ১৪ জন লোক নিহত হয়েছেন। অথচ মিডিয়া ছিল চুপ, বুদ্ধিজীবীরা ঘুমে। কাউকে দোষাররোপের জন্য কিংবা সৈয়দ আবুল হোসেনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য নয়, বাস্তবতা নিরিখে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যায় না। দুর্ঘটনা এখন আগের চেয়ে কী কমেছে? তাহলে সৈয়দ আবূল হোসেনের সময় দুর্ঘটনা বা রাস্তার খারাপ অবস্থা দেখে পত্রপ্রত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া কিংবা টকশোতে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা; সমালোচনা ও গালাগালি শুনা যেতো এখন তা শুনা যাচ্ছে না কেন? কেন বুদ্ধিজীবীরা শিশুদের নিয়ে শহিদ মিনারে কিংবা গভীর রাতে টেলিভিশনের টকশোতে যাচ্ছে না! প্রশ্নগুলো বিস্ময়বোধক চিহ্ন হয়ে তীরের ফলার মত মর্মাহত করার বিষয়। এমন আচরণ প্রমাণ করে যে, বুদ্ধিজীবীবর্গের সরবতা, মিডিয়ার প্রচারণা, শহিদ মিনারে পদত্যাগ দাবি ইত্যাদি দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে ছিল না। ছিল আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। এ জন্য আবুল হোসেন পদত্যাগ করার পর সব থেমে গেছে। যদিও দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। এর মানে সৈয়দ আবুল হোসেন ষড়যন্ত্রের শিকার।
গত দুই দশকে বাংলাদেশে যানবাহনের পরিমাণ ০.৪ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ১.৫ মিলিয়ন হয়েছে। জনসংখ্যাও প্রায় দেড়গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দশ বছর আগে সড়কে গাড়ি বৃদ্ধির হার ছিল ৪%, সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রী থাকাকালীন ২০১০ খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে হয়েছে ৮%। এ সকল কারণ অনিবার্যভাবে দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনার কারণ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সত্তর ভাগের অধিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ি চালক। কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যগ দাবিকারী কেউ এ সকল বিষয়টি একবারও উপস্থাপন করেনি। এটি কী তার প্রতি অবিচার হয়নি!! 
উপসংহারে বলছি, তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে। তাদের মৃত্যুতে সবার মত আমিও গভীর শোকাভিভূত ও মর্মাহত। আমার জীবনেও যে কোন সময় এমনটি ঘটতে পারে। এ জন্য আমিও দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াকে স্বাগত জানাই। তবে তা শুধু আবুল হোসেনের বেলায় নয়; সকল দুর্ঘটনার বেলায় যেন হয়। আমার প্রশ্ন একটাই: সৈয়দ আবুল হোসেনের সময় সংঘটিত দুর্ঘটনার জন্য যা করা হয়েছে এখন তা করা হচ্ছে না কেন? 
এ প্রশ্ন উঠলে আমার মনে পড়ে যায় অন্নদা শংকর রায় এর সে বিখ্যাত ছড়াÑ
তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর উপর রাগ করো­Ñ 
ভেবে পাই না সব তার বেলা কেন?

অর্ণব রায় : পরিচালক, তটিভি; সাংস্কৃতিক কর্মী এবং নাট্য পরিচালক ও নির্দেশক।

মহাঋত্বিক
মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ
দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণে চিন্তা করার এবং তদলক্ষ্যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার সময় ও মানসিকতা সব মানুষের থাকে না। এত বড় মন নিয়ে জন্ম নেয়া কিংবা অমন উদারতায় বেড়ে ওঠা সবার পক্ষে সহজ নয়। নিজের জীবন, কর্ম ও অর্জনকে দেশের কাজে নিবেদিত করার মতো ব্যক্তির সংখ্যা নেহাত কম। কম হলেও এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, যারা নিজেদের তিল তিল সাধনায় দেশ ও জাতির কল্যাণে উজাড় করে দেয়ার মহান ব্রতে উদ্বুদ্ধ, যারা তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে জাতির অন্ধকার দিকগুলোকে আলোময় করে তোলার চেষ্টা করেন। এমন অনেক মানুষ ও দাতা আছেনÑ যারা নিজের আত্মসুখকে সাধারণের সুখে একাকার করে দিয়ে তৃপ্তি পান। তবে এমন ব্যক্তিদের অনেকে চেনেন না, তাঁরাও নিজেদের প্রকাশের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন না। নেপথ্যে থেকে আলোর মতো ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে যান শুধু। বাংলাদেশের মতো সমস্যাসঙ্কুল দেশে এমন নিষ্ঠাবান সেবক, মহান দাতা ও ত্যাগী রাজনীতিবিদের অভাব বড় বেশি পরিলক্ষিত হয়। মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়ি। তবু হতাশার মাঝে আলোর ঝলকানিতে হৃদয় পুলকে পুলকে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। নিরাশায় মুষড়ে যেতে যেতে আবার প্রত্যাশায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে স্বপ্ন-যখন দেখতে পাই ক্ষণজন্মা কিছু নিঃস্বার্থবান প্রতিভা ত্যাগের মহিমায় নিজেদের উজাড় করে দিয়ে দেশমাতৃকার ক্রান্তিকে শান্তিতে এবং অন্ধকারকে আলোয় বিদূষিত করার সাধনায় রত আছেন। এমন মানুষগুলোকে শ্রদ্ধা না-করে পারা যায় না, পারা যায় না হৃদয়ের সব অঞ্জলি নিবেদিত না-করে। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণকারী সৈয়দ আবুল হোসেন এমনই একজন আত্মপ্রত্যয়ী, নিষ্ঠাবান, ত্যাগী, সৎ ও মহান ঋত্বিকÑ যাকে দেশ ও জাতির কল্যাণে পরিপূর্ণভাবে নিবেদিত একজন সাধক হিসেবে অভিহিত করা যায়।
সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় বেশি দিনের নয়, তবে পরোক্ষ পরিচয়ের মাধ্যমে মনোগত হৃদ্যতা আমার মনে হয় যুগান্তরের। ফরেন সার্ভিসে চাকুরি করার কারণে দেশের চেয়ে অধিকাংশ সময় আমাকে বিদেশে কাটাতে হয়েছে। তাই দেশের অনেক বিষয় আমাদের মতো ডিপ্লোম্যাটদের কাছে একটু হলেও বিলম্বে পৌঁছাত। নইলে আরও অনেক আগে সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটত, এটি নির্দ্বিধায় বলতে পারি। কারণ, তাঁর চিন্তা-চেতনা ও আমার চিন্তা-চেতনার মধ্যে অনেক মিল ছিল। উভয়ে ছিলাম বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত।
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ হতে সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যবসায় আগমন। সে সময় ঢাকার ব্যবসায়ী ও প্রশাসন সমাজে সৈয়দ আবুল হোসেনকে চিনতেন না, এমন লোক খুব একটা বেশি ছিল না। আমি যেহেতু দেশে কম থাকতাম, সেহেতু সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে সরাসরি পরিচয়ের সুযোগ ঘটেনি। তবে ব্যবসায়ী বন্ধু, সহকর্মী ও রাজনীতিক নেতাদের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের কথা বিদেশে বসেই এত বেশি শুনেছি যে, মনে হতো লোকটি আমার অনেক যুগের ঘনিষ্ঠ। অনেক বন্ধু ও সহকর্মীর বাসা এবং অফিসে সৈয়দ আবুল হোসেনের সাকো ইন্টারন্যাশনাল-এর শুভেচ্ছা স্মারক দেখেছি। শুনে শুনে সৈয়দ আবুল হোসেনেকে না-দেখেই আমার মুখস্থ হয়ে গেছে- তিনি একজন স্বপ্রতিষ্ঠিত মানুষ, সফল ব্যবসায়ী, উদার দানবীর, অপূর্ব দেহাবয়ব, মার্জিত, শিক্ষিত, বিনয়ী এবং বিচক্ষণ।
মানুষ হিসেবে তাঁর সর্বজনস্বীকৃত অকুণ্ঠ প্রশংসা আমাকে তাঁর সাথে পরিচয় হবার আগ্রহ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশিরা প্রশংসাকৃপণÑ এ রকম একটা কথা প্রায় শুনতে পাই। এটি নিষ্ঠুর হলেও সত্য। বিশেষ করে, কারও অবর্তমানে কেউ সহজে অন্যের প্রশংসা করতে চান না, এ রকম করলে নিজেকে ছোট করে দেয়া ভাবেন। এ অবস্থাতেও সৈয়দ আবুল হোসেনের বেলায় কাউকে আমি প্রশংসা-কৃপণ হতে দেখিনি। আমি দিব্য চোখে দেখতাম, এটি সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতি কারও অতিরঞ্জিত ধারণা নয়, এ ছিল তার অর্জন। তিনি ব্যবহার দিয়ে সর্ব মানুষের মনে একটি সম্মানীয় আসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে আমি ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে যোগদান করি। নয়াদিল্লি আমার অফিস। প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে ভারতে প্রচুর বাংলাদেশির সমাগম ঘটত। হাইকমিশনার হিসেবে আমার কাছে কম-বেশি সবাই আসতেন। আগতদের মধ্যে সর্বাধিক হতো ব্যবসায়ী। তারপর সরকারি কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ইত্যাদি। প্রত্যেকে মোটামুটি স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বিদেশের মাটিতে যারা বসবাস করেন, তাদের কাছে স্বদেশ কী রকম প্রেমময় অনুভূতির জন্ম দেয়, তা ভাষা কিংবা বর্ণনা, কোনো উপায়ে বোঝানো যাবে না। স্বদেশ কেন এত প্রিয়, স্বদেশের জন্য কেন পতঙ্গের মতো লাখ লাখ লোক হেসে হেসে জীবন দেয়, কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ লোক অকাতরে জীবন বিসর্জন করেছিল- তা অনুধাবন করতে হলে বিদেশে যাওয়া আবশ্যক। কথাটা এ জন্য বললাম যে, বিদেশের মাটিতে দেশের মানুষের দেখা পেলে, কারও সুনাম শুনলে, মনটা গর্বে ভরে উঠত।
হাইকমিশনার অফিসে আগত বাংলাদেশিদের সাথে দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে আলোচনা হতো। সেখানেও বিভিন্ন প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম চলে আসত। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের হিমালয়-সম সুদৃঢ় এক সৈনিক। তার বিপুল পরিচিতি ও প্রশংসাময় জনপ্রিয়তা আমাকে রীতিমতো ঈর্ষান্বিত করে তুলেছিল। যার এত প্রশংসা নিশ্চয় তিনি সাধারণ কেউ নন। আমি কূটনীতিক তিনি ব্যবসায়ী। দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা বেশি কাছাকাছির হবার কথা নয়। তবে তাঁর মতো আমিও বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। ফলে দু’জনের মধ্যে একটি অদৃশ্য সুতোর বন্ধন পরস্পরকে যেন গভীর আবেগে কাছাকাছি টেনে আনছিল।
সময়টা সম্ভবত ১৯৯৭ সাল। মোনায়েম সরকারের বাসা ছিল বুদ্ধিজীবী ও বড় বড় রাজনীতিবিদদের নির্মল আড্ডাশালা। একদিন মোনায়েম সরকারের বাসায় আওয়ামী লীগের বিখ্যাত ডোনারগণের তালিকার শীর্ষে সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম দেখে চমকে উঠলাম। বিদেশে যার কথা শুনেছি সে আবুল হোসেন। তাঁকে নিয়ে আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। আলোচনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের উত্তরণে সৈয়দ আবুল হোসেনের আর্থিক অনুদান ও বহুবিধ অবদান আমাকে বিস্মিত করে দেয়। মোনায়েম সরকার বললেন: ‘সৈয়দ আবুল হোসেন অত্যন্ত বড় মনের মানুষ। দেয়ার বেলায় তাঁর হস্ত এত উদার হয়ে যায় যে গ্রহীতার প্রত্যাশাকে প্রতি ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে যায়।’
২০০২ সালের প্রথম দিকে মোনায়েম সরকারের বাসায় সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটে। প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সূত্রপাত হলে পূর্বেকার পরোক্ষ পরিচয় আমাকে দ্রুত তার কাছাকাছি নিয়ে যায়। প্রথম দেখাতে আকৃষ্ট করার মতো একজন মানুষ। মোটা নয়, চিকনও নয় যেমনটি হলে একটা মানুষকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায় ঠিক তেমন গড়ন, তেমন রঙ, তেমন চেহারা। চ্যাপ্টা কপাল, দেখলে সহজে অনুমান করা যায় আরবীয় রক্তের ধারা বইছে দেহে। পরে জানতে পেরেছি, তাঁর পূর্বপুরুষ সুদূর আরব হতে এদেশে ধর্মপ্রচারের জন্য এসেছিলেন। মিরপুরের শাহ বোগদাদীর পুত্র সৈয়দ শাহ ওসমানের বংশধর তিনি। প্রথম দিন বেশিক্ষণ কথা না হলেও যা হয়েছে তা তাঁকে চেনার জন্য যথেষ্ট ছিল না, এটি বলা ভুল হবে। মানুষ নিয়ে কাজ করতে করতে মানুষ চেনা আমার পক্ষে তেমন কঠিন ছিল না। অল্পকথার মধ্য দিয়ে তিনি আমাকে মোহিত করে দিলেন। আমার চেয়ে বয়সে ছোট সৈয়দ আবুল হোসেনের চারিত্রিক মুগ্ধতায় আমি হতবাক হয়ে গেলাম।
আস্তে আস্তে অতি দ্রুত তাঁর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। মনের মিল এবং কারও প্রতি আকর্ষণ থাকলে সম্পর্ক সৃষ্টিতে সময় কোনো বিবেচনার দাবি রাখে না। এখন আমার মনে হয়, সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে পরিচয় না-ঘটলে জীবনে একজন প্রকৃত আদর্শ মানুষের সাহচর্য হতে বঞ্চিত থাকতম। তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে অল্প সময়ে বুঝতে পেরেছি, সৈয়দ আবুল হোসেন এমন একজন মানুষ, যাকে মনমানসিকতা, শ্রম, অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, হিউমার, হাসিখুশি সবদিক দিয়ে একটি উত্তম চরিত্র হিসেবে অভিহিত করা যায়। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে তাঁর জুড়ি নেই। কেউ সামান্য উপকার করলে এটি তিনি সহস্রগুণ বেশি করে ফেরত দেন। আর একটি গুণ যা না-বললে নয়, তা হচ্ছে ব্যক্তির প্রতিভাকে বিকশিত করা। প্রতিভা অন্বেষণে তাঁর মতো দূরদর্শী নেতা সত্য বলতে কী আমার চোখে পড়েনি। প্রতিভাবানদের সাথে তিনি এমন ব্যবহার করেন, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রতিভাকে আরও সহস্রগুণ বৃদ্ধি করে দেয়।
সৈয়দ আবুল হোসেন ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সহজ-সরল, বিনয়ী, মার্জিত, মৃদুভাষী ও বন্ধুবৎসল। আলাপ আলোচনায় তাঁর অমায়িক সরলতার মাঝে ফুটে ওঠে মুক্তচিন্তা ও তীক্ষè বুদ্ধিপ্রসূত দর্শন। তিনি সবসময় দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা ভাবেন এবং কাজ করেন। ভাবনায় সীমাবদ্ধ থাকার লোক তিনি নন। ভাবনাকে কাজের মধ্য দিয়ে বাস্তবে রূপায়িত করে ছাড়েন। তাঁর কথায় আছে আকর্ষণ, অন্যকে উজ্জীবিত করার অপূর্ব রসদ, আকৃষ্ট করার মনোরম সনদ। অত্যন্ত সুরুচিময় মনের এ মানুষটি কত সহজ সরল কিন্তু কত ব্যক্তিত্বময়, তা তাঁর কাছাকাছি না-আসা পর্যন্ত কেউ ধারণাই করতে পারেন না।
সৈয়দ আবুল হোসেন চিন্তাশীল মানুষ। কোনো কিছু করার আগে ভাবেন, ভালোমন্দ চিন্তা করে তারপর অগ্রসর হন। তবে জটিল চিন্তা তিনি সবসময় পরিহার করে চলেন। খাওয়া-দাওয়ায় তাঁর মতো সাধারণ ধনী বাংলাদেশে কেন, এত দেশ ঘুরেছি কোথাও দেখিনি। তিনি সবসময় পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকেন। তাঁর মতো পরিশ্রমী লোক বাংলাদেশে খুব কম আছে, সারাক্ষণ পরিশ্রম করেন। তবু তাঁর পোশাকে আমি কোনোদিন ভাঁজ পড়তে দেখিনি। আমরা একটা জামা এক ঘণ্টা পরলে কুঁচকে যায়, অথচ তিনি সারাদিন এত পরিশ্রম করার পরও মনে হয় জামাটি এ মাত্র ধোপার বাড়ি হতে আসল। এটি তাঁর পরিশ্রম ও ব্যস্ততার সাথে সুচারু একাগ্রতা আর ধীরস্থির মানসিকতার প্রমাণ।
জীবনে তারাই সফল হন, লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারেন যারা বিপর্যয়ে ধৈর্য হারান না। সৈয়দ আবুল হোসেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি কোনো অবস্থাতে ধৈর্য হারান না। অন্তত আমি দেখিনি। ওয়ান ইলেভেনের সময় তাঁর উপর প্রচণ্ড বিপর্যয় গিয়েছিল। অনেকে সে বিপর্যয়ের সামনে টিকতে না পেরে মাথা নুইয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন হিমালয়ের মতো অদম্য, সমুদ্রের মতো অজেয়।
তিনি যেমন কাজের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান, তেমনি সময়ের ব্যাপারে সদা সতর্ক। রাজনৈতিক কারণে অনেক সময় আমাদের এক সাথে কাজ করতে হয়, সভা-সমিতিতে যেতে হয়। কোনোদিন তাঁকে সময়ের এক মিনিট হেরফের করতে দেখিনি। প্রতিদিন সময়ের আগে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে হাজির হন। কারও পক্ষে কোনো কথা দিলে সেটি যে কোনো কিছুর বিনিময়ে রাখার চেষ্টা করেন। কোনো কাজ না পারলে সরাসরি বলে দেন। কাউকে প্রতিশ্র“তি দিয়ে ঘোরানো তাঁর স্বভাবে নেই। এ জিনিসটি আমাকে প্রবলভাবে মুগ্ধ করে।
বহুমুখী সফলতার বর সৈয়দ আবুল হোসেনের পদপ্রান্তে। জননেত্রী শেখ হাসিনার স্নেহধন্য নেতাদের মধ্যে সৈয়দ আবুল হোসেন অন্যতম। অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা, শিক্ষা, বংশমর্যাদা সবদিক দিয়ে তিনি পরিপূর্ণ। অথচ গরিমার লেশমাত্র তাঁর চরিত্রে নেই। 
সৈয়দ আবুল হোসেনের আমিত্ব আছে, এ আমিত্ব বিনয়ের, অভিজাত আর ব্যক্তিত্বের। সৈয়দ আবুল হোসেনের আমিত্ব সৃজনশীল জীবনবোধের অপূর্ব যোজনা। এর মাধ্যমে তিনি নিষ্ঠার বলয়ে প্রতিটি কঠিন ধাপ অতি সহজে উতরে উঠতে সক্ষম হন। ফলে ‘না’ শব্দটি তাঁর জীবন হতে একপ্রকার উধাও হয়ে গেছে বলা যায়। তিনি একদিন বলেছিলেন, ‘ফারুক ভাই, মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। শুধু প্রয়োজন ঐকান্তিকতা আর অধ্যবসায়।’ তিনি শুধু পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী ও নিখুঁত নন, সাথে সাথে উদারচেতাও বটে। তিনি নিজে পরিশ্রমী শুধু তাই না, জাতীয় জীবনে পরিশ্রমের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠায় তাঁর আশেপাশে যারা থাকেন তাদেরকেও পরিশ্রমী হতে উদ্বুদ্ধ করেন।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি ও ধর্ম অনেকটা আত্মকেন্দ্রিক। একদল আর একদলকে সহ্য করতে পারে না; এক ধর্ম সহ্য করতে পারে না আরেক ধর্মকে। এ বিষয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনে আমি যে উদারতা দেখতে পেয়েছি, তা আমাকে মুগ্ধ করেছে, বয়সে ছোট হলেও তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাকে অমিয় করেছে। সৈয়দ আবুল হোসেন আওয়ামী লীগ করেন, তিনি আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা, বড় শুভাকাক্সক্ষী। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে তার অবদান কারও কাছে অজানা নয়। আবার ধর্মীয় চেতনার দিক হতেও তিনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। বিয়ের আগে হজ করেছেন এবং হজ করার পর একজন আদর্শ হাজির ন্যায় জীবনযাপন করছেন। তবু কোনো রাজনীতিক বা ধর্মীয় গোঁড়ামি তাঁর মহৎ চেতনা এবং জনকল্যাণমূলক কাজে প্রভাব ফেলতে পারে না। সংকীর্ণ স্বার্থ চিন্তা ও রাজনীতিক সহিংসতার অনেক ঊর্ধ্বে উঠে তিনি মানুষের বৃহত্তর কল্যাণে কাজ করে যাওয়াকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। মনুষ্যত্ববোধে অনুপ্রাণিত সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবন ও কর্ম সবসময় দেখেছি মানুষের জয়গানে মুখরিত থাকে। কারও কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারেন না। তাই সবার কষ্ট নিবারণে এগিয়ে আসেন নিজের কষ্ট মনে করে। প্রকৃতি কাউকে ফেরত দিয়েছে, এটি বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেন কাউকে খালি হাতে ফেরত দিয়েছেনÑ এটি বিশ্বাস করা অনেক কষ্টকর। তাঁর উন্নয়ন ধারণা সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। উন্নয়নকে তিনি কখনও জাতি ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কার বা ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের বৃত্তে আবদ্ধ রাখেন না।
এত কাজ করেন, তবু তাঁকে ব্যস্ত মনে হয় না। তিনি শুধু পরিমাণগত দিকে নয়, গুণগত দিক দিয়েও অত্যন্ত সচেতন। সময়ের সীমাবদ্ধতার দোহাই দিয়ে অনেকে উৎকর্ষের দিকটা এড়িয়ে যেতে চায়। সৈয়দ আবুল হোসেন সময়ের সীমাবদ্ধতার নামে উৎকর্ষেকে এক বিন্দু ছাড় দিতে রাজি নন। তাই তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রেও আমাদের মাঝে একটি সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।
গণশক্তির নবজাগরণ, জনতার আত্মপ্রত্যয় এবং স্বীয় সামর্থ্য সম্পর্কে নিপুণ সচেতনতাকে সৈয়দ আবুল হোসেন বলিষ্ঠ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অত্যাবশ্যক মনে করেন। এগুলো জাগ্রত করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে উদার ও সহিষ্ণু করে। এ দু’টি গণতন্ত্রের প্রাণ। তাই তিনি রাজনীতিতে আসার বহু পূর্ব হতে শিক্ষা বিস্তারে উদারভাবে এগিয়ে এসেছেন। সৈয়দ আবুল হোসেন বাংলাদেশে শিক্ষা বিস্তারের এক জীবন্ত কিংবদন্তি।
সৈয়দ আবুল হোসেন একজন প্রতিভাবান সাংসদ। সংসদ যদি জাতির বিবেক হয়, তাহলে সৈয়দ আবুল হোসেনকে আমার আদর্শ সাংসদ সদস্য বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। ব্যক্তি জীবনের মতো তিনি সংসদেও মার্জিত, অমায়িক, ভদ্র, বিনয়ী এবং প্রজ্ঞাময়। কাউকে আহত না-করে কম কথার মধ্যে এত বেশি প্রকাশ করার মতো সংসদ সদস্য আমাদের দেশে বেশি একটা নেই। আমি অর্থনীতির ছাত্র। কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষকও ছিলাম। ব্যবস্থাপনার ছাত্র হয়েও সৈয়দ আবুল হোসেনের বাজেট বক্তৃতা আমাকে তীব্র আকর্ষণ করে। আমি তাঁর সবগুলো বাজেট বক্তৃতা শুনেছি এবং দুটি বাজেট বক্তৃতা পড়েছি। তা এত প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য যে, পাঠক ও শ্রোতাকে পরবর্তী লাইনে যাবার জন্য রোমাঞ্চকর উপন্যাসের মতো অভিভূত করে রাখে।
আমি ১৯৫৮-১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। আমার বিষয় ছিল অর্থনীতি। সৈয়দ আবুল হোসেনের স্ত্রী খাজা নার্গিসের বড় ভাই খাজা গোলাম সরোয়ার ছিলেন আমার বন্ধু। সৈয়দ আবুল হোসেন যে গোলাম সরোয়ারের ভগ্নিপতি, তা কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার আগে আমি জানতে পারিনি।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অসাম্প্রদায়িকতার নতুন প্রবক্তা। ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম নেতাদের নেতা। বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর মতো মহান হৃদয়ের বহুমুখী প্রতিভার নেতা আর নেই। সৈয়দ আবুল হোসেন বঙ্গবন্ধুর এ আদর্শে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত একজন দূরদর্শী নেতা। রাজনীতি করার ইচ্ছা না-থাকা সত্ত্বেও, শেষপর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের কাফেলায় সামিল হবার জন্য তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনার অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর চেতনা যার মনে অনুক্ষণ জাগরিতÑ তিনি মহান না হয়ে পারেন না।
মননে সৈয়দ আবুল হোসেনকে আমি সবসময় একজন দয়ালু ও পরোপকারী ব্যক্তি হিসেবে পেয়েছি। তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন অথচ তাঁর নিকট হতে উপকৃত হননি, এমন অপবাদ ঘোর শত্র“ও দিতে পারবেন না। এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললে নয়, ২০০৩ সালে আমি হার্টের বাইপাস সার্জারির জন্য দিল্লি যাই। সে সময় সৈয়দ আবুল হোসেন অন্য একটি বিশেষ জরুরি কাজে দিল্লি অবস্থান করছিলেন। কার নিকট থেকে তিনি আমার অসুস্থতার সংবাদ জানতে পারেন। সমস্ত জরুরি কাজ ফেলে রেখে তিনি আমাকে দেখার জন্য হাসপাতালে ছুটে এসেছিলেন। অসুখের সে দুঃসময়ে বিভুঁই বিদেশে তাঁর সান্নিধ্য, সহযোগিতা ও সহানুভূতি আমার জীবনে একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। অথচ সত্য বলতে কি, তখন তাঁর সাথে আমার পরিচয়ে ঘনিষ্ঠতার কোনো রেশই গড়ে ওঠেনি। এমন মহৎপ্রাণ আর কয়টি আছে বাংলাদেশে?
আমি যতটুক দেখেছি তার বিন্দুমাত্র সত্য হলেও নিঃসঙ্কোচে বলতে পারিÑ সততা, নিষ্ঠা, আত্মবিশ্বাস, শ্রম ও অধ্যবসায়প্রসূত জেদ সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনকে ফুলেল ভাবনার মতো অনুক্ষণ ঘিরে রাখে। অনমনীয় জেদ, অনিমেষ প্রেরণা ও সুন্দর জীবনধারা একটি মানুষকে সাধারণ অবস্থা হতে কতদূরে, কত বিশাল অনাবিলে নিয়ে যেতে পারে, তার প্রমাণ সৈয়দ আবুল হোসেন। কোনো জীবন সতত মসৃণ নয়, কোনো সফলতাই সর্বক্ষণ ফুলেল থাকে না; প্রতিটি জীবন কণ্টকময়, প্রতিটি সফলতাই ত্যাগ আর বিপর্যয়ের সমাহার। সৈয়দ আবুল হোসেন শ্রম, মেধা, অধ্যবসায় আর বুদ্ধি দিয়ে জীবন নামক কণ্টককে অতি সহজে ফুলেল বিছানায় পরিণত করতে পারেন।

মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ : জাতীয় সংসদ সদস্য, যশোর-২; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বার্মা, ভিয়েতনাম- লাওস, রাশিয়া- বেলারুশ, ইউক্রেইন, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, জর্জিয়া এবং প্রাক্তন হাইকমিশনার, ভারত।

যেমন তাকে দেখেছি
সৈয়দ আলমগীর ফারুক চৌধুরী
মানুষ জীবটা আয়তনে ছোট কিন্তু ব্যাপ্তিতে অসীম। তার মতো ধারণক্ষম কোনো জীব বিশ্বে আর নেই। অসীম তার ধারণ ক্ষমতা। বুদ্ধি হবার পর হতে মানুষ প্রতিমুহূর্তে ধারণ করেÑ বিকশিত হয় চিন্তা, চেতনা এবং অনুভব ইত্যাদি। এ জন্যই হয়ত বলা হয় মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কখন আমার বুদ্ধি হয়েছে তা ঠিক মনে পড়ে না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করি। অবসরে গেছি ২০০২ সালে, এখন তো জীবনের শেষ প্রান্তে। কিছু দিন আগে হয়ে গেছে মারাত্মক স্ট্রোক, মরতে মরতে বেঁচে গেছি। থাক এ সব কথা। কর্মজীবনে প্রবেশ করে দেখলাম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শেষটা প্রকৃত শিক্ষার শুরু মাত্র। শিশু আলমগীর ফারুকের বয়স দিন দিন বেড়েছে, পদমর্যাদাও বেড়েছে; বেড়েছে অভিজ্ঞতা। কিন্তু সাথে সাথে বেড়ে গেছে জানার আকুতি এবং না-জানার কষ্ট। অভিজ্ঞতা মানুষকে আরও অভিজ্ঞ হবার উদ্দীপনা দেয়। এ উদ্দীপনা হচ্ছে জানার আকাক্সক্ষা। শিক্ষার বহু ক্ষেত্র রয়েছেÑ বই, ভ্রমণ, চিন্তা, প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। তবে আমার মনে হয় শিক্ষার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র মানুষ। এক একটা মানুষ যেন অসীম অভিজ্ঞতার এক একটা চলন্ত বিশ্বকোষ। একজন স্বশিক্ষিত মানুষের কাছ হতে যা শেখা যায়, সহস্র গ্রন্থ হতেও তা শেখা সম্ভব হয় না। এ কারণে বইয়ের সংখ্যা যত বাড়ছে শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তাও তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আমি আমার চারপাশে যে সকল ব্যক্তির সমাগম ঘটে তাঁদের প্রত্যেককে গভীর আগ্রহে নিরীক্ষণ করি; যথামর্যাদায় অভিষিক্ত করি। সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে পরিচয় হবার পর আমার এ অভ্যাস আরও প্রবল হয়ে ওঠে।
মানুষের ক্ষমতা অসীম হলেও প্রত্যেকের বেলায় এটি প্রযোজ্য হয় না। তাই মানুষে মানুষে এত প্রভেদ। একই ক্লাশে পড়ে কেউ পায় নব্বই, আবার কেউ পায় নয়। অথচ একই শিক্ষকের নিকট হতে একই ক্লাশে বসে সবাই শিক্ষা লাভ করে। কর্মজীবনে অনেকের সাথে কাজ করেছি, অনেক অভিজ্ঞ, অনেক দক্ষ এবং অনেক মহানুভব মানুষের সান্নিধ্য আমাকে ধন্য করেছে, আলোকিত করেছে। এ সকল ব্যক্তির মধ্যে যে নামটি সবার প্রথমে উচ্চারণ করতে হয় সে নামটি হচ্ছে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন। সচিব হিসেবে লোকাল গভর্নমেন্ট ডিভিশনে কাজ করার সময় আমি আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছি। তবে বেশি দিন নয়, অল্প কিছু দিন। প্রতিমন্ত্রীর কাজ তেমন থাকে না, ক্ষমতাও। রুলস অব বিজিনেস প্রতিমন্ত্রীকে পদ দিয়েছে, কিন্তু দায়িত্ব তেমন দেয়নি। তারপরও সৈয়দ আবুল হোসেন নিজ যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বে তৎকালীন মাননীয় মন্ত্রী বর্তমানে মহামান্য প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের বিশেষ সুদৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে কাজ করার পর তাঁর অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির যে সুশীল কারুকাজ ও কর্মনিষ্ঠার যে সততা দেখেছি, তা আমাদের অনেকের মন-মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে এবং মন্ত্রণালয়ের কাজে এনেছে গতিশীলতা।
প্রাক্তন সেকশন অফিসার জনাব সেলিমুজ্জামান ছিলেন আমার বন্ধু। সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে সেলিমুজ্জামানের ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে সুবাদে সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে অনেক পূর্ব হতে আমার পরিচয় ছিল। তবে এটি ঘনিষ্ঠ পরিচয় বলা যাবে না। তারপরও বন্ধু ও সহকর্মীদের অনেকের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রশংসা শুনতাম। প্রতিমন্ত্রী হবার পর তাঁকে অল্প সময়ের জন্য হলেও কাছ হতে দেখার ও জানার সুযোগ পাই। সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন সময়নিষ্ঠ। জীবন সময়ের সমষ্টি আর সময় জীবনের আধার। এটি তার মনেপ্রাণে সবসময় জাগরুক থাকত এবং যার প্রতিফলন ঘটত তার প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে। ছোট বেলায় আমার এক বন্ধু তার পড়ার টেবিলের সামনে একটি বাণী লটকিয়ে রাখত – করষষ সব নবভড়ৎব শরষষরহম সু ঃরসব. সৈয়দ আবুল হোসেনের সময়নিষ্ঠ দেখে আমার প্রবাদটি বদলে বলতে ইচ্ছে করেছিল-করষষ সু ঃরসব, ওভ ুড়ঁ ধিহঃ ঃড় ফবংঃৎড়ু সু হধঃরড়হ. রাজনীতিক নেতাদের মধ্যে সময়নিষ্ঠা প্রায়শ তেমন গুরুত্ব পেতে দেখা যায় না। এর বহুবিধ কারণ রয়েছে, যেমন : কর্মের ব্যাপকতা, জনসংযোগ, যানজট, অপ্রত্যাশিত কর্মসূচি ইত্যাদিসহ আরও অনেক জানা-অজানা কারণে অনেকে সময় ঠিক রাখতে পারেন না। রাজনীতিক নেতা হলেও সৈয়দ আবুল হোসেন সময়ের ব্যাপারে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। কখনও তাকে অফিসে বা কোনো কর্মসূচিতে সময়ের হেরফের করতে দেখেছি এমন আমার মনে পড়ে না।
সময় ভালো ও মন্দ কাজে ব্যয় হতে পারে। আবার কোনো কাজ ছাড়া অলস উপায়েও এটি ব্যয় করা যায়। এ সকল ক্ষেত্রে অমূল্য সময় মূল্যহীন প্রতিভাত হয়ে ওঠে। ব্যক্তি, ব্যক্তির কাজ এবং দৃষ্টিভঙ্গির উপর সময়ের মূল্য নির্ভর করে। সৈয়দ আবুল হোসেন বিখ্যাত ব্যক্তি, অধিকন্তু বহুমাত্রিক পেশা ও অসংখ্য কাজে জড়িত। তিনি নিম্ন মধ্যবিত্ত হতে বিশাল ব্যবসায়ী হয়েছেন, হয়েছেন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, লেখক, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এগুলো তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পাননি, নিজেই নিষ্ঠার মাধ্যমে অর্জন করেছেন। সময়নিষ্ঠতার মাধ্যমে সময়কে অপব্যয় না-করে সৃজনশীল কাজে ব্যবহার করেছেন বলে তার পক্ষে এত বহুমাত্রিক সাফল্যে ভূষিত হওয়া সম্ভব হয়েছে। আমাদের উচিত তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করা।
চলতে ফিরতে পারিপার্শ্বিক কোনো বিষয়, তা যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন; কোনো বিষয় সৈয়দ আবুল হোসেনের দৃষ্টি এড়াত না। সৃষ্টির কোনো কিছু গুরুত্বহীন নয়, পরিবেশের সব কিছুর উপযোগিতা রয়েছে। সময় সীমিত, কাজ অসীম। এ দু’য়ের মধ্যে যিনি সমন্বয় ঘটাতে পারেন তিনিই হতে পারেন স্মরণীয়। দেখতাম কোনো কাজ ফেলে রাখাকে তিনি পছন্দ করতেন না। এ ব্যাপারে কারও গাফিলতিও তিনি সহ্য করতেন না। সবাইকে তিনি সময়নিষ্ঠ হবার উপদেশ দিতেন। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন যেমনটি বলেন- ঘবাবৎ ষবধাব ঃযধঃ ঃরষষ ঃড়সড়ৎৎড়ি যিরপয ুড়ঁ পধহ ফড় ঃড়ফধু.
সকালবেলা অফিসে এসে তিনি প্রথমে অফিসের কর্মকর্তাদের সাথে সারাদিনের কার্যপ্রণালি নিয়ে আলোচনা করেন। অত্যন্ত খোলামেলা আলোচনা। ঠিক দাপ্তরিক আবহে পারিবারিক সম্প্রীতি। সরকারের কাজ নয়, যেন নিজের কাজ। সবার সাথে পূর্বে গৃহীত প্রকল্পসমূহ নিয়ে আলোচনা করে ভুলভ্রান্তি, সমস্যা ও সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত হয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সর্বাধিক উপযুক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হবার চেষ্টা করতেন। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর নিজস্ব পছন্দ অপছন্দের কোনো ধার ধারতেন না। কোনো প্রকল্প গ্রহণ বা বর্জন কিংবা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে সর্বাগ্রে তিনি যে বিষয়টি বিবেচনা করতেন, সেটি হচ্ছে জনকল্যাণ তথা উন্নয়ন। তাঁর কাছে উন্নয়ন আর জনকল্যাণ ছিল পরস্পর সম্পূরক।
সৈয়দ আবুল হোসেন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তবে কাজের ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে আমাদের একজন সহকর্মী মনে করতেন। কোনো উন্নাসিকতা তাঁর মধ্যে দেখিনি কখনও। তিনি কখনও জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতেন না বরং কেউ কিছু না-পারলে বকাঝকা করার পরিবর্তে নিজে উদ্যোগী হয়ে সেটি করে দেয়ার জন্য এগিয়ে আসতেন। নতুনের প্রতি সবার আবেদন চিরন্তন। তবে অনেকে নতুন কিছু গ্রহণে সাহস পান না। একটা ভীতি কাজ করে। সৈয়দ আবুল হোসেন এ ব্যাপারে সাহসী ভূমিকার পরিচয় দিতে সক্ষম একজন দূরদর্শী প্রশাসক। তিনি নতুন কিছু গ্রহণে কখনও ভয় পেতেন না। অপ্রিয় সত্য কথা তিনি অমায়িক বচনে প্রিয়ভাবে বর্ণনা করতে পারতেন। ফলে যার অসন্তুষ্ট হবার কথা সে-ও তেমন অসন্তুষ্ট হতো না। এটি তাঁর একটি বড় গুণ ছিল।
কর্মপরিবেশ কর্ম সম্পাদনের অন্যতম নিয়ামক। আনন্দময় পরিবেশ কর্মকে অবসরের মতো অতুলনীয় করে তোলে। সৈয়দ আবুল হোসেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কর্মপরিবেশকে আনন্দময় করে তুলতে পারতেন। মনে হয় এ জন্য তিনি এত নিবিড় ও উদয়াস্ত পরিশ্রমের পরও ক্লান্ত হন না এবং তাঁর সহকর্মীরাও বিরক্ত বোধ করেন না। শুধু তাই নয়, কাজের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুব সচেতন। নথি ভালোভাবে দেখতেন এবং অতি সহজে কোনো ত্র“টি বা সমস্যা থাকলে তা খুব সহজে ধরে ফেলতেন।
স্বীকৃতি উদ্দীপনাকে বর্ধিত করে। কারও কাছ হতে শুধু চাপ আর ভয় দেখিয়ে কাজ আদায় করার কৌশল কোনো কালে সফলকাম হয়নি। বিশেষত বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ। সৈয়দ আবুল হোসেন বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখতেন। যিনি কাজ করেন, তাকে তিনি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতেন। সবার সামনে তিনি তাঁর প্রশংসা করতেন। তবে কারও ভুলটা ধরিয়ে দিতেও ভুল করতেন না। অনেক সময় মুখের উপর বলে দিতেন, তবে খুব ভদ্র ও মার্জিত ভাষায়।
তিনি মনে করেন, জীবন ও কর্ম শিকলের মতো। শিকলের প্রতিটি রিংই অপরিহার্য। কোনো একটি রিং দুর্বল হয়ে গেলে পুরো শিকলটাই দুর্বল হয়ে যেতে বাধ্য। তাই সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর কর্মীবাহিনীর প্রত্যেককে নিবিড় পরিচর্যায় দক্ষ করে তোলেন। আমি ২০০১ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি চাকুরি হতে অবসর গ্রহণ করেছি। এখন ২০১০ অনেক দিন তাঁর সাথে যোগাযোগ নেই। মাঝে মধ্যে টেলিভিশনের খবরে দেখি, সংসদে বক্তব্য দিতে শুনি। গত বাজেট অধিবেশনে তাঁর বাজেট বক্তৃতা শুনে আনন্দই লেগেছিল। আমার মনে হয়েছে, তিনি এখন আগের চেয়ে অনেক পরিপক্ব, অনেক দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ হয়েছেন। সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর সততা, নিষ্ঠা, মেধা ও আন্তরিকতা নিয়ে দেশের সেবায় এগিয়ে যাবেন সফলতার সাথে-এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

সৈয়দ আলমগীর ফারুক চৌধুরী : প্রাক্তন সচিব।

মননে উদ্ভাসিত অনুজপ্রতীম
এম আজিজুর রহমান
বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশে একা সরকারের পক্ষে শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ ও বিস্তার অবারিত করা সম্ভব হয় না। বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের জন্য কথাটি আরও ব্যাপক অর্থে সত্য। বাংলাদেশের জনসংখ্যার চাহিদা অনুপাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও বিস্তার সরকারের একার পক্ষে কখনও সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় কিছু মহৎপ্রাণ শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি নিজেদের উদ্যোগে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তাদের এ পদক্ষেপ বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারে সম্পূরক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। আমাদের দেশের শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ব্রিটিশ আমল থেকে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারের সূচনা সরকারিভাবে স্বীকৃত হলেও এর প্রকৃত বিস্তার ঘটেছে ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সম্রাট, রাজা, জমিদার শ্রেণির কিংবা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রয়াসের মাধ্যমে। এ সকল ব্যক্তি নিজস্ব উদ্যোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে আমাদের শিক্ষার প্রসারে অনন্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। যদিও সম্রাট, রাজা বা জমিদার শ্রেণি প্রজাকুলের প্রতি সহনশীল ছিল না, কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।
পেশাগত কারণে দেশ-বিদেশের অনেক বরেণ্য ব্যক্তি ও শিক্ষানুরাগীর সাথে পরিচয় হবার সুযোগ আমার হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত এর পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা বিস্তার ও দেশের সার্বিক কল্যাণে যে সকল ব্যক্তি অনন্য সাধারণ অবদান রেখেছেন, যাদের কথা এখনও আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি, সে সকল মহৎপ্রাণ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যে ব্যক্তিটির কর্মপরিধি ও আচার-আচরণ আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে, অভিভূত করেছে, গর্বিত করেছে তিনি হচ্ছেন মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলায় জন্মগ্রহণকারী অনুজ-প্রতীম আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন। কারণ, তিনি একজন ব্যক্তি হয়েও বহুমুখী প্রতিভা ও অমলিন মানবিক গুণাবলীর অধিকারী এমন একজন হৃদয়গ্রাহী মানুষ, যার অবদানের আলোকশিখা অনন্তকালের মহিমায় উদ্ভাসিত।
সৈয়দ আবুল হোসেন কর্মজীবনে প্রবেশের পূর্ব হতে শিক্ষাবিস্তার, সমাজসংস্কার ও মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মহান প্রত্যয়ে ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছিলেন। ১৯৮০ সাল হতে জনকল্যাণমূলক কাজে তার পদচারণা দীপ্ত ও সমুজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করে। পরবর্তী দশক ছিল মূলত বিকাশ কাল। ১৯৮৯ সালে খোয়াজপুর গ্রামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মধ্যে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনন্য এক শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে কালকিনির ডাসার গ্রামের সৈয়দ আবুল হোসেনের সুনাম। মাদারীপুর জেলার খোয়াজপুর গ্রামে সৈয়দ আবুল হোসেনের সম্পূর্ণ অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজটির উত্তরণ বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারের এক নব দিগন্তের সূচনা, মুগ্ধতার যাদুকরি ইতিহাস। খোয়াজপুর ছিল মাদারীপুর জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। ছিল না বিদ্যুৎ, ছিল না রাস্তা-শিক্ষাদীক্ষা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ছিটেফোঁটা চিহ্ন। চারিদিকে জলে-বিলে ডোবা গ্রামটির অধিবাসীগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত নাজুক। কোনো কলেজ দূরে থাক, কলেজ প্রতিষ্ঠার মতো ভূমিও তল্লাটে ছিল না- দিগন্তব্যাপী বিল আর বিল; জল আর জল। এরূপ একটি পশ্চাৎপদ এলাকায় সৈয়দ আবুল হোসেন গলা জলের উপর গড়ে তোলেন সুরম্য অট্টালিকা সমৃদ্ধ অপূর্ব অবকাঠামোয় দৃষ্টিনন্দন ও উন্নত মানের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- যার নাম সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ। প্রতিষ্ঠার পর হতে কলেজটির শিক্ষাগত মান ও বোর্ড পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফল দেশব্যাপী আলোড়ন তুলে দিয়েছিল। বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রতিষ্ঠাতার সুনাম। বিভিন্ন এলাকা হতে দলে দলে ছুটে এসেছিল মেধাবী শিক্ষার্থীরা, সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজে সন্তান-সন্ততির ভর্তি করানো মর্যাদা ও সফলতার প্রতীক হয়ে ওঠে। সারা বাংলাদেশ সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ এবং এর প্রতিষ্ঠাতার সাফল্য দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ সদ্য প্রতিষ্ঠিত, বিশেষ করে, এমন অজপাড়াগাঁয়ের একটি কলেজের পক্ষে স্বল্প সময়ে এমন কৃতিত্ব অর্জন সত্যি অবিশ্বাস্য ছিল।
সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের এরূপ সফলতার কারণ ছিল প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল হোসেনের উদার দৃষ্টিভঙ্গি, নিরপেক্ষ মনোভাব, দেশপ্রেম, উন্নয়নমুখী ধারণা, দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি ও আদর্শ নাগরিক গঠনে আপোষহীন দৃঢ়তা এবং মানবপ্রেমী অনুভব। সৈয়দ আবুল হোসেন ছাড়াও বাংলাদেশের অনেকে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান করেছেন। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠাতা তাদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আদর্শ শিক্ষালয় হিসেবে বিচারের মানদন্ডে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছোতে পারেননি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তার ও আদর্শ নাগরিক গঠন করা। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠাতা রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। সংগতকারণে প্রতিষ্ঠাতা তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষালয়কে রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য হাসিলের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়াস পান। ফলে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান ধরে রাখা সম্ভব হয় না। প্রতিষ্ঠাতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইন্ধনে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক কোন্দল ও প্রতিপত্তি বিস্তারের অশুভ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি- অনেক কলেজপ্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি কিংবা স্বজনপ্রীতির কারণে যোগ্য শিক্ষককে বাদ দিয়ে অযোগ্য শিক্ষককে নিয়োগ দিতে প্ররোচিত করতেও দ্বিধা করেন না। ফলে শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শিক্ষক হতে বঞ্চিত হন, যা তাদের উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণের পথ রুদ্ধ করে দেয়। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক প্রভাব বলয় সৃষ্টিতে প্রভাবশালীদের ইন্ধন আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে বইয়ের বদলে অস্ত্র, সেবার পরিবর্তে সংঘাত, সৃজনশীলতার পরিবর্তে ধ্বংস, চিন্তার পরিবর্তে কূপমন্ডুকতা, ত্যাগের পরিবর্তে স্বার্থপরতা, উদারতার পরিবর্তে সংকীর্ণতা এবং সার্বজনিনতার পরিবর্তে গোষ্ঠী-গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন করে দেয়। এ অবস্থায় কলেজ হয়ে ওঠে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুসারী ছাত্রছাত্রীগণের পারস্পরিক অবিশ্বাসের একটি উত্তপ্ত কুন্ডু। আমি শুধু একটি মানুষ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষালয়গুলোতে এ সব অবাঞ্ছিত বিষয়ের লেশমাত্র উপস্থিতি দেখিনি। সে ব্যক্তিটির নাম সৈয়দ আবুল হোসেন
সৈয়দ আবুল হোসেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চারটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং অনেকগুলো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও শতাধিক প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন কিংবা প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটি সৈয়দ আবুল হোসেনের নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাজনীতি ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত। তার অসাধারণ প্রজ্ঞাময় পরিচালনা ও দূরদর্শিতার কারণে তার প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলো বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কিংবা সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি হাসিলের কাজে ব্যবহার করেননি এবং করতেও দেননি। এ জন্যই সৈয়দ আবুল হোসেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেকটি শিক্ষালয় এক একটি আদর্শ শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সৈয়দ আবুল হোসেন প্রতিষ্ঠা করে থেমে থাকেন না, সন্তানের মতো অনবদ্য স্নেহে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে নিবিড় মমতায় লালন করে যান। এখানেই তার ত্যাগের সার্থকতা।
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সৈয়দ আবুল হোসেনের সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনের ইতিহাসে অনুসরণীয় উদাহরণ হয়ে আছে। তার মতে, ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। তবে এ মেরুদণ্ডের বাহক হচ্ছেন শিক্ষক।’ সে হিসেবে তিনি শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার বিষয়ে কোনো অবস্থাতেই কোনো দিন আপোষ করেননি। শুধু শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নয়, সর্বক্ষেত্রে সততার বিষয়ে তিনি নির্মমভাবে আপোষহীন। যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক পেলে তিনি তাদের উপযুক্ত সম্মানীর ব্যবস্থা করেন। শুধু আর্থিক বা বৈষয়িক নয়, সামাজিক ও আচরণগত সম্মান দিয়েও তিনি যোগ্য শিক্ষকদের প্রশংসিত করার চেষ্টা করেন। শিক্ষকেরা মানুষ গড়ার কারিগর কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেন শিক্ষক গড়ার কারিগর। তাই তিনি শুধু মানুষ গড়ার একজন কারিগর মাত্র নন- বরং কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজেকে মানুষ গড়ার কারখানায় পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা ও যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ শতভাগ নিশ্চিত করে তিনি প্রত্যেকটি শিক্ষালয়কে সত্যিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। শিক্ষক নিয়োগে তার মতো নিরপেক্ষতা ও যোগ্য ব্যক্তি যাচাইয়ে তার মতো দূরদর্শী লোক বাংলাদেশে বিরল না-হলেও খুবই কম। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সৈয়দ আবুল হোসেনের দৃষ্টান্ত অনুকরণীয় হতে পারে।
তিনি শুধু একজন শিক্ষানুরাগী ও দানবীর, সমাজ সংস্কারক হিসেবে নন, বরং আদর্শ মানুষ হিসেবেও উঁচু মননশীলতা ও উদার দর্শন প্রজ্ঞার অধিকারী। অতি সহজে অন্যের মনের গভীরে প্রবেশ করার অবিশ্বাস্য গুণাবলীর অধিকারী। তার মতো সজ্জন, নিরহঙ্কার ও অমায়িক লোক কদাচিত দেখা যায়। সদা হাস্যময় মুখ, বিনয়ী ব্যক্তিত্ব, শারীরিক সৌন্দর্য, রুচিশীল পোশাক, মধুর ব্যবহার, কমনীয় বাক্য, শিশুসুলভ মন তাকে প্রথম দর্শনে সবার প্রিয় করে তোলে। পদমর্যাদার তথাকথিত আনুষ্ঠানিকতা মানবতার আবরণ দিয়ে এমন মাধুর্যের সাথে ঢেকে দেন যে, তিনি হয়ে ওঠেন সবার আকর্ষণ, তুলনাহীন একজন। তার ব্যবহারে চমৎকৃত হয়নি, আন্তরিকতায় আপ্লুত হয়নি এবং সহমর্মিতার ছোঁয়ায় মুগ্ধ হয়নি- এমন লোক আছে বলে মনে হয় না। ব্যবহার দিয়ে তিনি শত্র“কেও বন্ধু বানিয়ে নেন গভীর ভালোবাসায়।
সফল মানুষের সংখ্যা দেশে কম নয়, কিন্তু সৎ মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা কয়জন হবে, আমার জানা নেই। শিশুবেলা হতে সৎ ও স্বচ্ছ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠেছেন সৈয়দ আবুল হোসেন। চরিত্রের অন্যান্য গুণাবলীর মতো সততার ক্ষেত্রেও তিনি প্রশ্নাতীত এবং অতুলনীয়। কারও দয়া-দাক্ষিণ্য কিংবা সহানুভূতিতে তিনি বড় হননি। তার উত্তরণ সততা, একাগ্রতা, সময়ানুবর্তিতা, পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর চারিত্রিক মাধুর্যের বিরল সমন্বয়ের অনিবার্য ফসল। তার সততা আমাকে আপ্লুত করে। কর্ম ও ব্যবহার তাকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখবে মানুষের মনে, অনাগত প্রজন্মের স্মৃতিতে আর ইতিহাসের পাতায়।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের একটা উদ্ধৃতি দিয়ে আমার লেখার সমাপ্তি টানব। প্রশ্নোত্তরমূলক ব্যতিক্রমী এ উক্তিটি হচ্ছেÑ ‘ডযড় রং রিংব? ঐব ঃযধঃ ষবধৎহং ভৎড়স বাবৎুড়হব. ডযড় রং ঢ়ড়বিৎভঁষ? ঐব ঃযধঃ মড়াবৎহং যরং ঢ়ধংংরড়হং. ডযড় রং ৎরপয? ঐব ঃযধঃ রং পড়হঃবহঃ. ডযড় রং ঃযধঃ? ঘড়নড়ফু.’ তবে সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনবোধ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের এ উক্তিটিকে বহুলাংশে হালকা করে দিয়েছে। সৈয়দ আবুল হোসেন এমন একজন প্রাজ্ঞজন, যিনি এখনও সবার নিকট হতে শেখেন, এমন একজন শক্তিশালী ব্যক্তি যিনি নিজেকে যে কোনো অবস্থায় সংবরণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন; তিনি এমন একজন অসাধারণ মানুষ যিনি আত্মসন্তুষ্টি এবং সকল পার্থিব লোভের ঊর্ধ্বে। তাই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ঘড়নড়ফু শব্দটির স্থানে আমি নিঃসংশয়ে লিখে দিতে পারিÑ ‘সৈয়দ আবুল হোসেন’।
সৈয়দ আবুল হোসেন পরিপূর্ণ ধারণা ও সার্থক মানুষের এক বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি একদিকে মানবতাবাদী, অন্যদিকে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক একজন মানুষ- যিনি ঐবহৎু উধারফ ঞযড়ৎবধঁ এর মতো ‘ঞযরহমং ফড় হড়ঃ পযধহমব; বি পযধহমব’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। বয়স বিবেচনায় তিনি তরুণ নন, তবে কর্ম, উদ্দীপনা, সৃজনশীলতা, পরিবর্তনশীলতা, সর্বোপরি, গ্রহণীয় মানসিকতার উদারতা বিবেচনায় তিনি এখনও তরুণের চেয়েও তরুণ, প্রকৃতির মতোই সৃজনশীল। তার মতো একজন তারুণ্যদীপ্ত ও সৃজনশীল ধ্যান-ধারণার মানুষ যে কোনো রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজের উজ্জ্বল ঐশ্বর্য। আমি তাঁর অনন্ত সুখময় দীর্ঘ জীবন কামনা করি।

এম আজিজুর রহমান : চেয়ারম্যান জাতীয় যাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ড; সাবেক সচিব ও সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার; কবি, কথা সাহিত্যিক ও গীতিকার

একটি দরদি হাত রয়েছে বাড়ানো
অজয় দাশগুপ্ত
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের পিএইচডি-র গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অমিয় দাশগুপ্ত। অমর্ত্য সেন একাধিক লেখায় তাঁকে উল্লেখ করেছেন ‘অনন্যসাধারণ মেধাবী’ ছাত্র হিসেবে। ১৯১৮ সালে তিনি গৈলা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স (এখন যা এসএসসি) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এরপর দু’বছর পড়াশোনা করেন বরিশাল বিএম কলেজে। ১৯২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেন। ১৯২৫ সালে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান। পরের বছর এমএ-তেও একই ফল। এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই অমিয় দাশগুপ্তকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। এমন একজন গুণী ব্যক্তির নিজের স্কুলটি কেমন ছিল? এ প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন লিখেছেন : ‘স্যার আমাদের বারবার বলেছেন, তার শিক্ষার ভিত রচিত হয়েছিল গৈলা স্কুলে।’ অমিয় দাশগুপ্তের কন্যা অলকানন্দা দাশগুপ্ত। তিনি তাঁর ভাই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান স্যার পার্থ দাশগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে ২০০২ সালে গৈলা এসেছিলেন বেড়াতে। সে সময়ে তারা তাদের বাবার স্কুল পরিদর্শন করেন। স্কুলের মিলনায়তনে তাদের দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দু’জনেই বলেছেন, ‘বাবা সবসময় আমাদের বলেছেনÑ তাঁর জীবনে যা কিছু অর্জন তার মূলে রয়েছে গৈলা স্কুলের শিক্ষা।’ সংবর্ধনা উপলক্ষে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা নাচ-গানের মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। এটা দেখার পর পার্থ দাশগুপ্ত বলেন, এ জন্যই তো গৈলার এত প্রশংসা শুনতাম বাবা ও ঠাকুরদার কাছে। নিভৃত গ্রামের একটি স্কুলে এমন সুন্দর অনুষ্ঠানের আয়োজন আমাকে অভিভূত করেছে।
তাঁর ঠাকুরদা পার্বতীকুমার দাশগুপ্ত পেশা উপলক্ষে অবস্থান করতেন ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। সেখানে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলের প্রথম ব্যবস্থাপনা কমিটিতে তাঁকে উদ্যোক্তা সদস্য রাখা হয়। পার্থ দাশগুপ্ত এবং তাঁর বোনসহ আমি ২০০২ সালের ডিসেম্বরে ওই বিদ্যালয়ে গেলে শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত স্কুল ম্যাগাজিনে এ সংক্রান্ত খবর দেখান প্রধান শিক্ষক। তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন পিতামহের স্মৃতিতে একটি বৃত্তি চালু করার অনুমতি লাভের জন্য। এর অর্থ সংস্থান তারা করেছেন। আমার দায়িত্ব হচ্ছে, প্রতি বছর ভাঙ্গা গিয়ে বৃত্তির অর্থ শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া। পার্বতী দাশগুপ্ত তাঁর অসাধারণ মেধাবী পুত্র অমিয় দাশগুপ্তকে পড়াশোনার জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, ১৯২২ সালে পাঠিয়েছিলেন মাত্র এক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ তখন ভাঙ্গা বা গৈলা থেকে ঢাকার তুলনায় কলিকাতার যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ ছিল। তিনি ভাঙ্গায় ছিলেন পেশাগত প্রয়োজনে। তারপরও গড়ে তুললেন স্কুল। এর প্রেরণা কোথায় পেলেন? কেন, গৈলার মাটির গুণে! শিক্ষালাভের পর যেখানেই যাও না কেন, শিক্ষা বিস্তারে অবদান রেখে যাও, মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলে নিজেকে নিয়োজিত রাখো। নিজেকে নিয়ে অবশ্যই ভাববে, তবে তার চেয়েও বেশি ভাববে অপরকে নিয়ে এবং সবাইকে নিয়ে।
এমন একটি স্কুলেই ১৯৬৪ সালে পড়তে এসেছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। নিজের বাড়ি থেকে অনেক দূরের এ স্কুলে কেন তিনি পড়তে এসেছিলেন, সেজন্য তাঁর অভিভাবকদের বিবেচনা অবশ্যই ছিল। কিন্তু তারা যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। সৈয়দ আবুল হোসেনও তাঁর জীবনপথে একের পর এক সাফল্যের সিঁড়ি অতিক্রমে গৈলা স্কুলের শিক্ষা এবং এর সুন্দর পরিবেশের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মুখে এখনও শোনা যায় এ স্কুলের স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য, খেলার মাঠ এবং অন্যান্য স্থাপনার প্রশংসা। এ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন কৈলাশচন্দ্র সেন। ১৮৯৩ সাল থেকে দীর্ঘ ৩৭ বছর তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। উচ্চ সরকারি চাকরির মোহ ত্যাগ করে নিভৃত পল্লিতে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তিনি নিজেকে পরিপূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছিলেন তা শতাব্দীকালের বেশি সময় অতিক্রম করে এখন শিক্ষা বিস্তারে অনন্য এক মডেল। তাঁর জীবনাবসানের পর স্কুলপ্রাঙ্গণে গড়ে তোলা হয়েছে স্মৃতিসৌধ। এতে এপিটাফে লেখা রয়েছে : ‘উবধঃয ফরারফবং, নঁঃ সবসড়ৎু ষরহমবৎং.’ গৈলা স্কুলের প্রজন্মান্তরের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় অধিবাসীরা এ মহান শিক্ষাবিদের অবদান বিস্মৃত হয়নি। মৃত্যু তাঁকে স্কুল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, কিন্তু স্মৃতি রয়ে গেছে অমলিন। একইভাবে তারা মনে রেখেছে স্কুলের সাবেক ছাত্র অমিয় দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক দুই মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও সুনীলকুমার গুপ্ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মন্ত্রী পদমর্যাদার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম এম মালেক এবং বাংলাদেশ সরকারের ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি গঠিত মন্ত্রীসভার সদস্য সৈয়দ আবুল হোসেনকে। জাতীয় সংসদের সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এ গৈলা গ্রামেরই অধিবাসী। একশ’ বছরের বেশি সময় ধরে এ স্কুল তৈরি করে চলেছে ‘কত জ্ঞানী-গুণী কত মহাজন…’। এ গ্রামের খ্যাতি কেমন, সেটা জানা যাবে ‘গৈলার কথা’ নামের একটি বই থেকে। এতে দেয়া তথ্যে দেখা যায়, ১৮৬৫ সালে এ গ্রামের চন্দ্রকুমার দাশ বিএ পাস করেন। ১৮৮৬ সালে এ গ্রামের গোবিন্দ চন্দ্র ঢাকা কলেজ থেকে বিএসসি অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। পরের বছর এমএসসিতেও হয়েছিলেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। সে সময় ঢাকা কলেজ ছিল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। অনার্স পরীক্ষার ফল বের হওয়ার কয়েকদিন আগে কলেজের প্রিন্সিপাল কলিকাতা গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর অতি প্রিয় ছাত্র গোবিন্দ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। আর প্রথম হয়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজের রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী। (পরবর্তী জীবনে বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক)। কিন্তু ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল গোবিন্দের মেধা ও প্রতিভার বিষয়ে এতটাই নিঃসন্দেহ ছিলেন যে তিনি চ্যালেঞ্জ করে বলেন. ‘গু এড়নরহফধ পধহহড়ঃ ংঃধহফ ংবপড়হফ.’ শেষ পর্যন্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের উত্তরপত্র পুনরায় নিরীক্ষণ করার পর দু’জনকেই প্রথম হিসেবে ঘোষণা করে।
সে সময় গৈলা থেকে কীভাবে ঢাকা বা কলিকাতা যাওয়া যেত? ‘গৈলার কথা’য় লেখা হয়েছে : ‘কলিকাতা যাইতে হইলে খুলনা হইয়া যাইতে হইত। কিন্তু ১৮৮৪ সালের পূর্বে বরিশাল হইতে কোন স্টীমার পথ ছিল না। এই বৎসর প্রথম খুলনা পর্যন্ত স্টীমার লাইন খোলা হয়। ঢাকা স্টীমার লাইন আরও কয়েক বৎসর পর খোলা হয়। নৌকায় খুলনা পৌঁছাইতে (গৈলা হইতে) ৩/৪ দিন লাগিত। ঢাকা যাইতে হইলে (গৈলার অধিবাসীদের) টরকি বন্দর হইতে বারুজীবীদের পানের নৌকায় ৭/৮ দিন ধরিয়া যাইতে হইত। পথও ছিল বিপদসঙ্কুল। এইসব অসুবিধা সত্বেও গ্রামের কতক যুবক বরিশাল, ঢাকা ও কলিকাতা গিয়া ইংরেজি শিক্ষালাভ করিতে আরম্ভ করেন।’
১৮৮৬ সালে গৈলার গোবিন্দ চন্দ্র কীভাবে ঢাকা পৌঁছেছিলেন? কীভাবেই বা ছুটিতে বাড়ি ফিরতেন? উত্তাল ও বিপদসঙ্কুল পদ্মা ও মেঘনা নদী কীভাবে পাড়ি দিতেন? শুধু তিনি নন, তাঁর মতো আরও অনেকেই এ পথ বেছে নিয়েছিলেন জ্ঞানের মশাল হাতে পাওয়ার জন্য। এসব নিয়ে এখনও গবেষণা হতে পারে। শিক্ষার জন্য যে-এলাকার অধিবাসীদের এমন আগ্রহ, সেখানে সৈয়দ আবুল হোসেন ছুটে আসবেন, তাতে আর বিস্ময় কী! তবে তাঁকে যাতায়াতের জন্য এতটা কষ্ট করতে হয়নি। তিনি স্কুল থেকে চার কিলোমিটার দূরে থাকতেন। মেঠোপথে পায়ে হেঁটে স্কুলে আসতেন প্রতিদিন। ক্লাস কামাইয়ের ঘটনা তেমন ঘটত না। কিন্তু কষ্টের সঞ্চয় তিনি গড়েছেন এবং তাঁর সুফল ভোগ করছে শুধু গৈলা নয়, অনেক অনেক এলাকার অনেক অনেক মানুষ।
এ গৈলা গ্রামেরই অধিবাসী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। ১৯২২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ্চাত্য দর্শনে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর রচিত ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস (পাঁচ খণ্ড) প্রকাশ করেছিল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর বাড়ির নাম ছিল কবীন্দ্র বাড়ি। এ বাড়ির অঙ্গনেই গড়ে উঠেছিল একটি সংস্কৃত কলেজ। ১৮৯৬ সালে এর প্রতিষ্ঠা। ওই সময় সুদূর চট্টগ্রাম থেকেও এ কলেজে পড়াশোনার জন্য ছাত্র এসেছিল। গৈলার কথা বইয়ে দেখা যায়, ১৯৫০ সালের আগে যারা ঢাকা ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এ দুই শহরের মেডিকেল ও প্রকৌশল কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তাদের সংখ্যা শতাধিক। সৈয়দ আবুল হোসেন গৈলা স্কুলে যে বছর পড়তে আসেন, সেই ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিকে এ প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায় অংশ নেয়া সব ছাত্রছাত্রী পাস করেছিল। এ বছর প্রথম বিভাগ পেয়েছিল মাত্র একজন শিক্ষার্থীÑ হরিহর দত্ত। শাহজাহান নবী, মোজাফ্ফর এবং আবদুল মান্নানÑ এই তিনজন ছাত্রও ছিলেন মেধাবী। মোজাফ্ফর-এর পিতা ছিলেন গৌরনদীর সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)। তাঁর সরকারি বাসস্থান ছিল গৈলা কালুপাড়া সেনের বাড়ি। এ পরিবারের সব ছেলেমেয়েই পড়াশোনার পাশাপাশি কোনো-না-কোনো শিক্ষা বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে পারদর্শী ছিল। যেমন খেলাধুলা, গান ও অভিনয়। শাহজাহান নবী ও আবদুল মান্নান স্কুল শিক্ষাজীবনে সৈয়দ আবুল হোসেনের চেয়ে দুই বছর সিনিয়র ছিলেন। তদুপরি তিনি এসেছেন অনেক দূরের একটি গ্রাম থেকে। কিন্তু সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তাদের সঙ্গে আবুল হোসেন নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন এবং তাদের মুরুব্বির মতো শ্রদ্ধা করেন। ১৯৬৪ সালে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মতিয়ার রহমান। তিনি এমএ পাস করেছিলেন। এমন উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে গ্রামের স্কুলে সে আমলে কেউ সাধারণত যেতে চাইতেন না। কিন্তু মতিয়ার রহমান গিয়েছেন এবং এক অনন্য রেকর্ড রেখে এলেন। তিনি ভালো ইংরেজি পড়াতেন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। ঢাকার বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরি নিয়ে তিনি চলে গেলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন জর্জ অশ্র“কুমার বিশ্বাস। তিনি যেদিন স্কুলে যোগ দেন, সেদিনই মতিয়ার রহমানকে বিদায় জানানো হয়। বিদায়ী ভাষণে কার্যত তিনি কিছুই বলতে পারেননি। ছিলেন অশ্র“সিক্ত। কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল ভারি। কেবল একটি বাক্য পূর্ণ করতে পেরেছিলেন পবিত্র গীতা থেকে : ‘শ্রীকৃষ্ণ বলতেনÑ আমার চেয়ে আমার শিষ্যরা এগিয়ে…।’
আমরা তখন স্কুলের সামনের মাঠে সমবেত হয়েছিলাম। সৈয়দ আবুল হোসেন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ বাক্য যে তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন তাতে আর সন্দেহ কী।
মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সব শিক্ষার্থীর উত্তীর্ণ হওয়া সে সময়ে ব্যতিক্রমী ফল হিসেবেই গণ্য হয়েছে। তবে গৈলা স্কুল বলে কথা! পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে পর পর দু’বছর এ প্রতিষ্ঠান থেকে ইস্ট পাকিস্তান বোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান করে নেন পরিতোষ দাস ও জহর দাশগুপ্ত। তাদের নাম এখনও গৈলা ও আশপাশের এলাকায় গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। ১৯৬৫ সালে গৈলা স্কুল থেকে এম শাহ আলম যশোর বোর্ডে সপ্তদশ স্থান অধিকার করেন। ওই বছর স্কুল থেকে তিনজন প্রথম বিভাগ লাভ করেন। অপর দু’জন হচ্ছেন খলিলুর রহমান ও বাসুদেব চক্রবর্তী। খলিলের বাবা মুন্সী নজিবুর রহমান (নাজেম মুন্সী নামে পরিচিত ছিলেন) বহু বছর স্কুলের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পুত্র মো. ইউসুফ হোসেন মোল্লাও দুই যুগ ধরে রয়েছেন স্কুল পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে। আমরা পরীক্ষা দেই ১৯৬৬ সালে। আমাদের ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল মধুর। পরস্পরের মধ্যে রেষারেষি ছিল না। সে বছর খলিলুর রহমান ( গৈলার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে আসা। এ এলাকার বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী পড়ত গৌরনদী স্কুলে। কিন্তু মেধাবীদের পছন্দে থাকত গৈলা স্কুল) ও অজয় দাশগুপ্ত প্রথম বিভাগ লাভ করেন। সৈয়দ আবুল হোসেন, টমাস মানস দাস, নুরুল ইসলাম, আশীষ দাশগুপ্ত প্রমুখ লাভ করেন উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগ। তাদের প্রত্যেকের নম্বর ছিল প্রথম বিভাগের কাছাকাছি। আমাদের আরেক সহপাঠী আবদুল কাদের। প্রায় পাঁচ দশক আমরা রয়ে গেছি একান্ত আপনজন হিসেবে। টমাস মানস দাসও অন্য এলাকা থেকে গৈলা স্কুলে পড়তে আসেন। পরবর্তী জীবনে গৈলা হয়ে ওঠে তাঁর প্রিয় এলাকা। আমরা যখন স্কুলের সাবেক ছাত্রছাত্রীরা শতবর্ষ ভবন নির্মাণে উদ্যোগী হই, তখন প্রথম সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন টমাস মানস দাস। তিনি তখন ডিয়াকোনিয়া নামে একটি সংস্থার কর্ণধার। তাঁর কাছে আমাদের পরিকল্পনা ব্যক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি উৎসাহ দেন এবং আর্থিক সহায়তার জন্য আবেদন করতে বলেন। দু’য়েকদিন যেতে-না-যেতেই জানালেন, দুই লক্ষ টাকা মঞ্জুর হয়েছে। শতবর্ষ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে আলোচনার জন্য একদিন হাজির হই আবদুল কাদের ও আমি। তাঁকে জানাই, গৈলা স্কুলের শতবর্ষ (১৮৯৩-১৯৯৩) উপলক্ষে সাবেক একদল শিক্ষক ও ছাত্র কয়েকটি সভা করেছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শতবর্ষ উপলক্ষে বিদ্যালয়ে একটি ভবন নির্মাণ করা হবে এবং এর পুরো অর্থ যোগান দেবে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা। আবুল হোসেন ততদিনে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত এবং রাজনীতিতে সক্রিয়। তাঁর সাকো ইন্টারন্যাশনাল ব্যবসায়িক অঙ্গনে একটি পরিচিত নাম। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কালকিনি আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন বিপুল ভোটে। এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে তিনি নানাভাবে অবদান রেখে চলেছেন। নিজের সাধনা ও কষ্টার্জিত অর্থে গড়ে তুলছেন একের পর এক প্রতিষ্ঠান। আমাদের পরিকল্পনা শুনে বললেন, ‘তোমাদের সাহস ও সংকল্প অসাধারণ। নিজের অর্থে কোনো কিছু করা সহজ। কারণ, অর্থ রয়েছে উদ্যোক্তার নিয়ন্ত্রণে। দশজনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা খুব কঠিন। তোমরা কঠিন পথটি বেছে নিয়েছ। আমি তোমাদের সঙ্গে রয়েছি।’
স্কুলের শতবর্ষ পালন উপলক্ষে আমরা ১৯৯২ সালের ২৩ জানুয়ারি (শততম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে) মতিঝিলের একটি কমিউনিটি সেন্টারে ঢাকাস্থ প্রাক্তন শিক্ষক ও ছাত্রদের সমাবেশ করি। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন সে সময়ের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এম ইউনুছ। তাঁর বাড়ি ছিল বরিশাল শহরে। অনুষ্ঠানে আসার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিসে তাঁকে টেলিফোনে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলি যে-এ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক চিঠি নিয়ে আমি সচিবালয়ে আসব। তিনি উত্তরে বলেন, গৈলা স্কুল এমনই একটি গর্বিত নাম এবং ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠান, যার অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য লিখিত চিঠির দরকার নেই। আমি অনুষ্ঠানস্থলে চলে আসব।’ তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন। সৈয়দ আবুল হোসেন এবং সে সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত এমএ মালেকসহ বিপুল সংখ্যক ঢাকাস্থ গৈলাবাসী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানের চিঠি গিয়েছিল মোল্লা মনসুর আহমদ মঞ্জু ও আমার নামে। আমাদের দু’জনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে শতবর্ষ উদযাপনের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। ভবন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করার জন্যও এ কমিটি উদ্যোগী থাকে। আমাদের এ কাজে সর্বক্ষণ যুক্ত ছিলেন প্রকৌশলী এম শাহ আলম ও প্রকৌশলী শিবশংকর দাস। তাঁরা সে সময়ে বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থায় কাজ করতেন। ওই প্রতিষ্ঠানের একজন প্রকৌশলীকে দিয়ে তারা গৈলা স্কুলের শতবর্ষ ভবনের (ষোলোশত বর্গফুট আয়তন) নকশা প্রণয়ন করেন। এ কাজের জন্য ওই প্রকৌশলী কোনো অর্থ গ্রহণ করেননি। টমাস মানস দাসের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা পাওয়ায় আমাদের উৎসাহ বেড়ে যায় এবং অন্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্থ দিতে থাকেন। সৈয়দ আবুল হোসেন একদিন আবদুল কাদের ও আমাকে ডেকে শতবর্ষ ভবনের কাজের অগ্রগতি জানতে চান এবং বলেন, ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের মালামাল কেনার জন্য যে অর্থ দরকার হবে সেটা আমি দিয়ে দেবো। তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন। এর ফলে আমাদের কাজ সহজ হয়ে যায়। ভবন নির্মাণের বিষয়টি প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গর্ববোধ সৃষ্টি করেছিল। যে যেভাবে পারে সহায়তার জন্যও এ মহতী উদ্যোগ তাদেরকে আগ্রহী করে তোলে। নির্মাণ কাজের শেষ পর্যায়ে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে কিছু অর্থের প্রয়োজন পড়লে আমরা একটি সভা আহ্বান করি সৈয়দ আবুল হোসেনের অফিসে। সেখানে দু’জন সাবেক ছাত্র প্রতিযোগিতা করে অর্থের পরিমাণ বাড়াতে থাকেন। এক পর্যায়ে একজন ঘোষণা দেন, ‘তুই যা দিবি, আমি তার দ্বিগুণ দেবো।’ এভাবে তাদের কাছ থেকে আমরা পেয়েছিলাম ৪০ হাজার টাকা। আরেকবার আবদুল কাদেরের জসিমউদ্দিন রোডের বাসভবনের এক সভা থেকে উঠেছিল ৩৫ হাজার টাকা। এ ধরনের সভায় আমাদের এলাকার মওলানা হারুনর রশীদ অগ্রণী ভূমিকা রাখতেন। তিনি বয়সে সবার বড় ছিলেন। কিন্তু উদ্দীপনা তরুণের মতো। গৈলা স্কুলে তিনি পড়েননি কিংবা শিক্ষকও ছিলেন না। কিন্তু গৈলার বাসিন্দা হিসেবে ছিল গর্ববোধ। বয়সের বাধা অতিক্রম করে তিনি আমাদের সঙ্গী থাকতেন সবসময়।
১৯৯৪ সালের মে মাসের প্রথম দিকে আমাদের স্বপ্নের শতবর্ষ ভবন উদ্বোধন করেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান জনাব হাসান ওয়াইজ। তিনিও আমাদের একটি টেলিফোন বার্তায় যশোর থেকে গৈলা ছুটে আসেন। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, কর্মজীবনে শিক্ষার প্রসারে অনেক উদ্যোগ দেখেছি। কিন্তু অনেকের মিলিত প্রচেষ্টার এমন মহৎ কীর্তি একেবারেই ব্যতিক্রমী। তিনি বলেন, অনেকে মিলে কাজ করায় সমস্যা থাকে। নানা মত এসে কাজে বিঘœ ঘটায়। কিন্তু আপনারা নিজেদের মধ্যে চমৎকার সমঝোতার মাধ্যমে কাজ করেছেন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য এটা অনন্য নজির। এ ভবনের কারণেই গৈলার কথা আমার বিশেষভাবে মনে থাকবে।
আমরা কেন এমন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারলাম? কারণ এখানে কেউ ব্যক্তিস্বার্থের কথা চিন্তা করিনি। কেউ নিজের নাম প্রচারের চেষ্টা করিনি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমরা স্কুল থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি, সেটাই কাজে লাগিয়েছি।
ষাটের দশকে গৈলা স্কুলে শিক্ষার পরিবেশ কেমন ছিল? আমাদের অঙ্ক ক্লাস নিতেন নলিনী সিমলাই। তাকে বলা হতো ‘অঙ্কের জাহাজ’। সারাক্ষণ অঙ্ক নিয়ে ভাবতেন। যারা অঙ্ক ভালো পারত, তাদের তিনি পরম যতেœ আগলে রাখতেন, øেহ-মমতায় ভাসিয়ে দিতেন। সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর প্রিয়ভাজনে পরিণত হতে সময় লাগেনি। অঙ্কে তাঁর আগ্রহ ছিল, আর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল ইংরেজিতে। তাঁর স্টকে প্রচুর শব্দ ছিল এবং প্রতিনিয়ত তা বাড়িয়ে চলতেন। পরীক্ষায় উত্তরপত্রে ইংরেজি ও বাংলা ভাষা থেকে সাবলীলভাবে উদ্ধৃতি বা কোটেশন উল্লেখ করতে পারতেন। একজন স্কুল ছাত্রের জন্য এটা বিশেষ গুণ হিসেবেই বিবেচিত হতো। সিমলাই স্যার আমাদের সবাইকে বলতেন, ‘অন্য কাউকে কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী ভাববি না। সবসময় নিজেকে মনে করবি নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং চেষ্টা করবি নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে।’ তাঁর এ উপদেশ সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনে কী চমৎকারভাবেই-না প্রতিফলিত হয়েছে! তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তাঁকে নিয়ে কিছু অনাকাক্সিক্ষত প্রশ্ন তোলা হলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এমন নজির এ দেশে বিরল। মন্ত্রী না-থাকলেও দলের কাজে থাকেন সক্রিয়। ২০০১ সালের শেষ দিকে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী যখন নানাভাবে হয়রানির শিকার, তখনও তিনি নির্ভিকভাবে দায়িত্ব পালন করে চলেন। মতিঝিলে তাঁর অফিস ছিল দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর জন্য অভয়াশ্রমের মতো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁর নিজের উপরও নেমে এলো অত্যাচারের খড়গ। কিন্তু অসম সাহসে তিনি পরিস্থিতি মোকাবেলা করলেন। দল ও সরকারের জন্য তিনি বিবেচিত হলেন অপরিহার্য ব্যক্তি হিসেবে। দলের পক্ষে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ নানা শক্তির সমাবেশ ঘটানোর কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। দেশের বাইরেও তাঁর এ কর্মকান্ড বিস্তৃত ছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং তার নেতৃত্বাধীন মহাজোট এর সুফল পেয়েছে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি গঠিত হলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার। তাঁকে এবার দায়িত্ব দেয়া হলো পূর্ণ মন্ত্রীর। ভার পেলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন তার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। গত দেড় বছরে গৈলা থেকে ভাঙ্গা হয়ে কয়েকবার ঢাকা এসেছি। এ সময়ে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু ফেরিঘাটে অপেক্ষমান সবার মধ্যেই গভীর আস্থা ও বিশ্বাস ব্যক্ত করতে শুনেছি : আবুল হোসেন সাহেব এ ব্রিজ বানাবেনই। তখন আর ঘাটে এভাবে অপেক্ষা করতে হবে না।
ফজলুর রহমান লাল মিঞা স্যার স্কুলে শিক্ষকতা করাকালেই প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ ও এমএ পাস করেন। তিনি বাংলা পড়াতেন চমৎকার। তাঁর নোট শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে ঘুরত। হাতের লেখাও ছিল সুন্দর। প্রমথ চৌধুরীর বর্ষা প্রবন্ধ ছিল আমাদের পাঠ্য। তিনি এ প্রবন্ধের ওপর আমাদের নোট তৈরি করে দিয়েছিলেন, যার প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল : ‘ইংরেজি সাহিত্যে বসন্ত ঋতুরাজ, বর্ষার কোনো স্থান নেই। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে বর্ষা অনন্ত যৌবনা।’ তাঁর এ বাক্যগুলো এখনো আমাদের অনেকেরই স্মরণ রয়েছে। হানিফ স্যারও ছিলেন ছাত্রদরদি ও আদর্শ শিক্ষক। আমাদের ইংরেজি বিষয়ে ক্লাস নিতেন। সমাজ পাঠও পড়াতেন। স্কুলের ফুটবল টিম গড়ে তোলায় তাঁর বিশেষ প্রয়াস ছিল। আমাদের ব্যাচের মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ে (১৯৬৬) প্রধান শিক্ষক ছিলেন জর্জ অশ্র“ কুমার বিশ্বাস এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হানিফ। আমাদের জীবনে যা কিছু অর্জন তার পেছনে এদের প্রত্যেকের রয়েছে অনন্য অবদান। সৈয়দ আবুল হোসেন অন্য এলাকা থেকে গৈলায় পড়তে এসেছিলেন। কিন্তু এলাকার পরিবেশের গুণে তিনি এলাকাটিকে নিজের গ্রামের মতো মনে করেছেন। মনসামঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্তের বাড়ি গৈলাতেই। তিনি এ কাব্যের স্বপ্নাধ্যায় অংশে লিখেছেন, ‘স্থান গুণে যেই জন্মে সেই গুণময়’। গৈলায় যারা কর্মসূত্রে কিংবা পড়াশোনার জন্য অথবা সংসার জীবনযাপনের জন্য এসেছেন, তাদের ক্ষেত্রেও এটা সত্যÑ প্রকৃতপক্ষে তারাও এক একজন হয়ে ওঠেন গুণী ব্যক্তি।
ষাটের দশকের মধ্যভাগে আমরা গৈলা স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমাদের শিক্ষকেরা ভালোভাবে পড়াতেন। কিন্তু বোর্ডের নিয়মকানুন সে সময়ে গ্রামের স্কুলে তেমন পৌঁছাতো না। নবম ও দশম শ্রেণির ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধ-গল্প-কবিতার বইয়ের সবগুলো যে সিলেবাসে থাকে না, সেটা আমাদের কেউ জানায়নি। এ কারণে আমাদের সবগুলোই পড়তে হয়েছে। দশম শ্রেণিতে ওঠার পর আমরা জানতে পারলাম, আমাদের বাংলা দ্রুত পঠন বা র‌্যাপিড রিডার বই পরিবর্তন হয়েছে। আগে নাম ছিল কথা ও কাহিনী, নতুন বই কথা বিচিত্রা। নতুন বইও আমরা কিনে ফেললাম। শিক্ষকরা এর গল্পগুলো পড়ালেন যতেœর সঙ্গে। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষার হলে গিয়ে প্রশ্নপত্রে দেখতে পাই নতুন বই নয়, বরং আগের ‘কথা ও কাহিনী’ থেকেই প্রশ্ন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের অনেকেরই গল্প পড়ার অভ্যাস থাকায় আগের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পাঠ্য কথা ও কাহিনীর সব গল্পই আমাদের ভালোভাবে পড়া ছিল। ফলে উত্তর দিতে তেমন সমস্যা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, ‘কথা বিচিত্রা’ বইটি পাঠ্য করা হয় আমাদের পরের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের জন্য। কিন্তু যশোর বোর্ড থেকে সেটা আমাদের স্কুলে ঠিকভাবে জানানো হয়নি। সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর নিজের এলাকায় অনেক স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এ অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চয়ই শিক্ষা নিয়েছেন। কালকিনি এলাকার অনেক শিক্ষার্থীর কাছে শুনেছি, বোর্ডের সিলেবাসে কী আছে এবং কী নেই সেটা তাদের আগেভাগেই জানা থাকত। বিষয় নির্বাচনেও ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা করেন স্কুল-কলেজের কর্তৃপক্ষ। কোন বিষয়ে বেশি নম্বর পাওয়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোন কোন বিষয় নিয়ে পড়লে সুবিধাÑ এসব বিষয়ে তাদের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। এ ধরনের সুবিধা তাঁর গড়ে তোলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রছাত্রীরা পেয়েছে এবং এখনো পাচ্ছে। কেবল শিক্ষার্থী ভর্তি করলেই চলে না, তাদের পরিচর্যা করতে হয়, তাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়Ñ এটাই সৈয়দ আবুল হোসেনের বার্তা।
কৈলাশচন্দ্র সেন গৈলা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থাকার সময়েই পাশের গ্রাম আগৈলঝাড়ায় ভেগাই হালদারের উদ্যোগে গড়ে ওঠা স্কুল প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দিয়েছিলেন। তাকেই নির্বাচিত করা হয়েছিল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। টানা এগারো বছর এ পদে সার্থকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সাধারণত এমনটি দেখা যায় না। পাশাপাশি দু’টি স্কুলের মধ্যে থাকে নানা বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কারণে-অকারণে তারা হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষ। কিন্তু কৈলাশচন্দ্র সেন সে পথে চলেননি। সৈয়দ আবুল হোসেন এ মহৎ হৃদয় মানুষটিকে দেখেননি। তবে স্কুলে থেকে জেনেছেন তাঁর সম্পর্কে। অনুপ্রাণিত হয়েছেন তাঁর আদর্শে। কর্মজীবনে প্রবেশ করে তিনি শিক্ষা বিস্তারে যে অনন্য অবদান রেখে চলেছেন, তাতে কৈলাশচন্দ্র সেনের প্রভাব সহজেই অনুভব করা যায়। তবে আবুল হোসেন এ ধারাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় উদ্যোগী হয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যাতে বোর্ডের পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারে সেজন্য সর্বদা থেকেছেন মনোযোগী। একইসঙ্গে সচেষ্ট ছিলেন তাদের মেধা ও মননের বিকাশে। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একাধিক কলেজ থেকে প্রতি বছর ঢাকা বোর্ডের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় কারও-না-কারও নাম থাকত। আমরা তা পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশন পর্দায় দেখে গর্ব অনুভব করতাম। এখন বোর্ডের ফলে মেধা তালিকা নেই। কিন্তু আবুল হোসেনের স্কুল-কলেজগুলো ভালো ফল করেই চলেছে। শুধু এলাকার নয়, অন্য এলাকা থেকে মেধাবী শিক্ষার্থী নিয়ে আসার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। নারী শিক্ষার জন্য রয়েছে তাঁর বিশেষ মনোযোগ ও উদ্যোগ। আবুল হোসেনের কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি অনেকের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আদর্শ হিসেবে গড়ে তোলার প্রেরণা সৃষ্টি করতে পারছেন। তাঁর ব্যবসায়িক অফিসে গেলে দেখা যায়, কালকিনি ও আশপাশের শুধু নয়, অন্য এলাকা থেকেও শিক্ষার্থীরা আসে সহায়তার জন্য, আশীর্বাদের জন্য। আর তিনি তেমন প্রশ্ন না-তুলেই দরদি উদার হাত বাড়িয়ে দেন। পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। মন্ত্রিসভার দায়িত্ব পালনের সময়ে তাঁর আর ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তাতে শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হয় না। তারা জানে, প্রয়োজনের সময়ে একটি দরদি হাত বাড়ানো রয়েছে তাদের জন্য। মাথার ওপর রয়েছে একটি বটবৃক্ষ, যা থেকে মেলে সুশীতল ছায়া, যার ওপর ভরসা করা যায়।
ষাটের দশকে গৈলা স্কুলের ফুটবল টিম গোটা বরিশাল মাতিয়ে বেড়াত। ফনি কর্মকার, বিমল দাস, মনীন্দ্র কর্মকার, মহসিন, আবদুর রব, নগেন্দ্রনাথ কর্মকার প্রমুখ খেলোয়াড়ের পরিচিতি আশপাশের অনেক স্কুলে ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্য এলাকার ভালো ফুটবলারদের গৈলা স্কুলে নিয়ে আসার জন্য শিক্ষকরা উদ্যোগ নিতেন। জর্জ অশ্র“ বিশ্বাস এক সময়ে কালকিনীতে শিক্ষকতা করতেন। সেখানে মতিউর রহমান নামে একজন ভালো ফুটবলার ছিল। তাকে আমাদের সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলাম জর্জ অশ্র“ বিশ্বাসের কারণেই। স্কুলে ক্রিকেট ও ভলিবল টিমও গড়ে উঠেছিল। প্রতিবছর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো জমজমাটভাবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও স্কুলের সুনাম রয়েছে। সৈয়দ আবুল হোসেন স্কুলের খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে খুব একটা অংশ নিতেন না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রতিটি উদ্যোগে থাকত তাঁর সক্রিয় সহযোগিতা। নিজের এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তিনি গৈলার শিক্ষা যে কাজে লাগিয়েছেন, সেটা আমরা দূর থেকেও অনুভব করতে পারি।
আমাদের ক্লাসের সবার সঙ্গে ছিল তাঁর সুসম্পর্ক। মুখে হাসি আর ব্যবহারে মাধুর্যÑ এটাই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। ক্লাসে আসতেন পরিষ্কার ও পরিপাটি পোশাক পরে। কখনো এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। বসতেন সামনের দিকে। নিজেকে জাহির করার জন্য কখনো ব্যাকুল থাকতেন না, কিন্তু তাঁর উপস্থিতি টের পেতেও সমস্যা হতো না। শিক্ষকের প্রত্যাশা ভালো করেই জানতেন। প্রস্তুত হয়ে আসতেন ক্লাসে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি ভালো করবেন, এটা সবার জানা ছিল। জীবনে তিনি উন্নতি করবেন, এটাও সে সময়েই অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।
মাধ্যমিকের গণ্ডি অতিক্রমের পর অগ্রজ আশীষ দাশগুপ্ত ও আমি ভর্তি হই চাখার ফজলুল হক কলেজে। আর সৈয়দ আবুল হোসেন ভর্তি হন গৌরনদী কলেজে। সেখানে তিনি গৈলার মতোই একজন জনপ্রিয় শিক্ষার্থী হয়ে ওঠেন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় আমরা দু’জনে উত্তীর্ণ হই ১৯৬৮ সালে। তারপর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে সম্মান প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হই। সৈয়দ আবুল হোসেন ১৯৭০ সালে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে অভিহিত এ প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য অনুষদে ভর্তি হন। আমাদের স্কুল সহপাঠীদের মধ্যে কেবল আমাদের দু’জনেরই এ সুযোগ মেলে। দু’জন দুই অনুষদের ছাত্র হওয়ায় দেখাশোনার সুযোগ কম মেলে। তবে আমি ছাত্র আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে নিয়মিত কলাভবনে যেতে হতো। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। স্বাধীনতার গৌরবময় সংগ্রামে আমাদের দু’জনেরই অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। ষাটের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠতে থাকে। এ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। কলাভবন ছিল তার কেন্দ্র। একবার কলাভবন বটতলার এক ছাত্র সমাবেশে আমি বক্তব্য রাখার সময় কিছুটা দূরে সৈয়দ আবুল হোসেনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। সভাশেষে কাছে এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানালেন। আমার বক্তব্যের বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় ছিল, তার চেয়েও ভালো ছিল বলার ভঙ্গি ও উপস্থাপনা, এটাই ছিল তাঁর বক্তব্য। স্কুল জীবনের বন্ধুর কাছ থেকে এ ধরণের প্রশংসা ভালো লেগেছিল। পরে তিনি একাধিকবার বলেছেন, ওই সভায় আমার বক্তব্য শুনে তাঁর মনে হয়েছিল যে, আমি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিলে সফল হবো। কিন্তু নিয়তি এমনই যে, সে সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় না থেকেও পরবর্তী জীবনে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং আমি সার্বক্ষণিক পেশা হিসেবে বেছে নিই সাংবাদিকতাকে। যার যার ক্ষেত্রে আমরা সফল, এটা এখন আমাদের স্কুলের সহপাঠীরা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন। আমার পেশাগত কাজ সম্পর্কে তিনি সর্বদা খোঁজ-খবর রাখেন। প্রেরণা দেন। গৈলা স্কুলের কল্যাণে কোনো অনুরোধ করলে বিনা দ্বিধায় তা রক্ষা করেন। গৈলা স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থীদের জন্যও সর্বদা তাঁর দুয়ার উন্মুক্ত। পড়াশোনা, চিকিৎসা বা অন্য কোনো প্রয়োজনে তাঁর কাছে গেলে বিমুখ হওয়ার অবকাশ ঘটে না। নিজের উদার হাতটি এমনভাবে বাড়িয়ে দেন যেন তিনি সেই ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ের মতো রয়েছেন গৈলাতেই।
ব্যক্তিগত সুবিধা কিংবা প্রয়োজনে তাঁর স্মরণাপন্ন সাধারণত হই না। একবার আমার পুত্রের যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার ভিসা পাওয়ার জন্য বড় অংকের ব্যাংক ব্যালান্স দেখানোর প্রয়োজন পড়ে। বিষয়টি জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এর ব্যবস্থা করে দেন। এ ক্ষেত্রেও তাঁকে তেমন কিছুই বলতে হয়নি। প্রসঙ্গটি তুলতেই তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে সংশ্লিষ্ট একটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তার কাছে নিয়ে যান এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে যায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। এমন উদারতা বিরল, তবে সৈয়দ আবুল হোসেন তা দেখাতে পারেন বার বার এবং এক বা দু’জন নয়, অনেকের ক্ষেত্রে।
১৯৯৩ সালে গৈলা স্কুলের শতবর্ষ পালন এবং প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে শতবর্ষ ভবন নির্মাণের পর থেকে ঢাকায় অবস্থানকারী সাবেক ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক এবং গৈলাবাসীদের মধ্যে যোগাযোগ বেড়ে যায়। এরপর থেকে প্রতি বছর আমরা বার্ষিক পুনর্মিলনীর আয়োজন করতে থাকি। প্রথম দিকে তা অনুষ্ঠিত হতো আবুল হোসেনের মতিঝিল অফিসের ছাদে প্লাজা রেঁস্তোরায়। ২০০০ সালে আমরা একটু বড় আকারে এর আয়োজন করি। স্থান নির্বাচিত হয় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে। ওই বছর এম এ মালেক বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমরা এ অনুষ্ঠানে তাকে সংবর্ধনা জানানোর সিদ্ধান্ত নিই। সৈয়দ আবুল হোসেনকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানালে সানন্দে রাজি হয়ে যান। অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে আবদুল কাদের আমাকে জানায়, তোমাকে সাকো ইন্টারন্যাশনাল অফিসে জরুরি ভিত্তিতে আসতে হবে। আমি সেখানে যাওয়ার পর নিয়ে যাওয়া হয় আবুল হোসেনের কক্ষে। তিনি বলেন, গৈলা স্কুলের জন্য সবসময় আমি গর্ব অনুভব করি। আমার জীবন পথকে কুসুমাস্তীর্ণ করেছে এ প্রতিষ্ঠান। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের অর্থে শতবর্ষ ভবন নির্মাণ করেছে। আমি তাতে কিছুটা অবদানও রেখেছি। কিন্তু যতটা করা উচিত ছিল, করা হয়নি। এখন বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছু করা যায় কি-না, ভেবে দেখার অনুরোধ করছি। সে দিন এ বিষয়ে আমি কিছু বলিনি। পরের কয়েকটি দিনও চুপ থাকি। আবদুল কাদের এ সময়ে জানতে চেয়েছে, আমি কিছু ভেবেছি কি-না। আমি কেবল হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়েছি। অনুষ্ঠানের দিন আমার বক্তব্যের সময় বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি চালু করার একটি পরিকল্পনা ব্যক্ত করি এবং তাতে অংশ নেওয়ার জন্য প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের প্রতি অনুরোধ রাখি। সেখানে কয়েকজন বক্তা ছিলেন। তারা বিদ্যালয়ের কল্যাণে নিজ নিজ সংকল্প ব্যক্ত করেন। তবে আমি এমন বক্তব্য কেন রেখেছিÑ সেটা সৈয়দ আবুল হোসেন ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর বক্তব্য রাখার এক পর্যায়ে বলেন, ‘অজয় ছোটবেলা থেকেই আমার বন্ধু। ও কী বলে, আমি সহজে বুঝতে পারি। আমার সঙ্গে যখন কোনো বিষয়ে কথা বলে, অল্প কথায় বলে। কিন্তু আমি বুঝে নিই ও কী বলতে চায়। আজও আমি বুঝে গেছি অজয়ের বার্তা। আমি জানি, মেধা-মননের পরিচর্যা দরকার, সুযোগ দরকার। এর অভাবে অনেক সম্ভাবনা অকালে ঝরে পড়ে। এজন্য গৈলা স্কুলের মেধাবীদের জন্য একটি বৃত্তি তহবিল গঠনে আমি ব্যক্তিগতভাবে পাঁচ লাখ টাকা দেবো। অর্থের অভাবে কেউ যেন শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না-হয়, তার লক্ষ্যেই আমার এ চেষ্টা।’
অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত সবার মধ্যে এ ঘোষণার শুভ প্রতিক্রিয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানের পরপরই ঢাকাস্থ গৈলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী ও গৈলাবাসীদের সংগঠন ‘গৈলা পরিষদ’ গঠন করা হয়। আবদুল হাকিম নির্বাচিত হন সভাপতি এবং আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয় সাধারণ সম্পাদকের। পরে আমি এ সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হই।
গৈলা পরিষদ গঠনের পরপরই আমরা আবুল হোসেনের ঘোষিত অর্থ কীভাবে ব্যবহার হবে, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করি। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে এ তহবিল ব্যবস্থাপনার নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়ন করার। আবুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ট্রাস্ট তহবিলের দলিল আমাকে এনে দেন। এর ভিত্তিতে আমি একটি খসড়া প্রণয়ন করে তাঁকে দেখাই এবং সেটা তাঁর পছন্দ হয়। ঠিক হয়, একটি ট্রাস্ট গঠন করা হবে এবং এর মাধ্যমেই বৃত্তির অর্থ বিতরণ করা হবে। আবুল হোসেন আমাকে জানান, ট্রাস্টের সদস্য হিসেবে যেন শাহজাহান নবী এবং এম শাহ আলমকে রাখা হয়। আমি বলেছি, আবদুল কাদেরকেও রাখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আবুল হোসেনের মন্তব্য: অজয় দাশগুপ্ত এবং আবদুল কাদের দু’জনকে তো রাখাই হবে। এ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয় সৈয়দ আবুল হোসেনকে। গৈলা স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এবং প্রধান শিক্ষক পদাধিকার বলে ট্রাস্টের সদস্য রয়েছেন।
২০০১ সালের ২ মে গৈলা স্কুলের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এ তহবিল থেকে প্রথম বৃত্তি প্রদান করা হয়। প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষায় প্রতিটি শ্রেণিতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট অংকের অর্থ পাচ্ছে। আমরা বছরে তিন-চার বার ঢাকা থেকে গৈলা স্কুলে গিয়ে বৃত্তির অর্থ ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেই। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় যারা ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়, তাদেরকেও এ তহবিল থেকে বৃত্তি দেয়া হয়। মাধ্যমিক পরীক্ষায় যারা জিপিএ-পাঁচ পায়Ñ তারাও এ তহবিল থেকে বৃত্তি পায়। আবুল হোসেনের এ বদান্যতায় গৈলা স্কুলের সঙ্গে আমাদের কয়েকজনের নিয়মিত সম্পর্ক রাখার যোগসূত্র সৃষ্টি হয়েছে। আবদুল হাকিম, শাহজাহান নবী, এম শাহ আলম, আবদুল কাদের, মোল্লা মনসুর আহমদ, এ বি এম সিদ্দিক, আইয়ুব খান, সুলতান-উল আবেদীন, সিরাজুল হক সরদার এবং আমিসহ কয়েকজন নিয়মিত স্কুলে যাইÑ বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে অংশ নিতে।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের বৃত্তি তহবিল রয়েছে। তবে এত বড় অংকের তহবিল কমই রয়েছে। এ তহবিল থেকে নবম শ্রেণি থেকে প্রথম হয়ে যে দশম শ্রেণিতে ওঠে, তাকে প্রতি মাসে দেয়া হয় ২০০ টাকা। বছরে ২৪০০ টাকা। আবার তৃতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম হয়ে ওঠা শিক্ষার্থী পায় মাসে ১০০ টাকা। এমনকি যে এ শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠে, তাকেও দেয়া হয় মাসে ৫০ টাকা। এমন কয়েকজন শিক্ষার্থী আমরা গত এক দশকে পেয়েছি, যাদের হাতে প্রতি বছর বৃত্তির অর্থ তুলে দিয়েছি। এটা যে কী পরিতৃপ্তির, তা বোঝানো কঠিন। এভাবেই তো মেধার লালন হয়ে থাকে। যার উৎস সৈয়দ আবুল হোসেন। তাকে অনাগতকাল পর্যন্ত স্মরণ রাখবে গৈলাবাসী। আমরা যারা এ বৃত্তি প্রদান কিংবা অন্য প্রয়োজনে গৈলা স্কুলে যাই, তারা ঢাকা থেকে যাতায়াতসহ যাবতীয় ব্যয় নিজেরাই বহন করি। শতবর্ষ ভবনের নির্মাণের সময়েও আমাদের কোনো ভাউচার কোথাও জমা পড়েনি। আগামীতেও পড়বে না। এ শিক্ষা আমরা আমাদের প্রিয় স্কুল থেকেই পেয়েছি।
স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ নিয়মিত থাকার কারণে আরও কিছু কর্মকাণ্ডে আমাদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ ঘটে। ২০০৭ সালের নভেম্বরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ আঘাত হানে। এতে আগৈলঝাড়ারও ব্যাপক ক্ষতি হয়। গৈলা স্কুল থেকে আমাদের জানানো হয়, মাধ্যমিক পরীক্ষায় যেসব ছাত্রছাত্রী অংশ নেবেÑ তাদের অনেকের বই নষ্ট হয়েছে। এ সময়ে আমাদের স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক জর্জ অশ্র“ বিশ্বাস এবং আমাদের ব্যাচের দুই ছাত্র খলিলুর রহমান ও সাইদুর রহমান তোতার মৃত্যুতে ঢাকায় আমার বাসায় একটি স্মরণসভার আয়োজন করেছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে সিডরে ক্ষয়ক্ষতির প্রসঙ্গটি তোলা হলে উপস্থিত সবাই সাধ্যমতো অর্থ প্রদানের ঘোষণা দেয়। কয়েকদিনের মধ্যেই প্রায় ৪০ হাজার টাকা আমাদের হাতে আসে। আমরা এ অর্থ গৈলা ও আশপাশের কয়েকটি স্কুলের ৮০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বিতরণ করি। এ উপলক্ষে আগৈলঝাড়ায় ভেগাই হালদারের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে গেলে শিক্ষকরা বলেন, গৈলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগ বাংলাদেশের সব স্কুল-কলেজে অনুসৃত হওয়া উচিত। সেখানের মেয়েদের স্কুলের সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রধান শিক্ষক সাহেব গৈলা স্কুলের তিন সাবেক ছাত্র শাহজাহান নবী, এম শাহ আলম ও আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং বলেন, জীবনে এদের মতো হতে হবে। এমন প্রশংসা পাওয়ার জন্য আমাদের ঋণ তো গৈলা স্কুলের কাছে। জয় হোকÑ এ মহতী প্রতিষ্ঠানের।
আমরা বড় কিছু করে ফেলেছি, এমন দাবি কখনো করিনি। সৈয়দ আবুল হোসেনও করেন না। তিনি যেমন সজ্জন, তেমনি বিনয়ী। তিনি এককালীন পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন গৈলা স্কুলের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদানের জন্য। কিন্তু এজন্য আত্মপ্রচারে কোনো আগ্রহ তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি। আমরা কয়েকজন ট্রাস্ট তহবিল পরিচালনা করছি। চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁকে আমরা যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত রাখি। কিন্তু আমাদের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে চলেছেন তিনি। আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে তাঁর কোনো উদ্বেগ কখনো প্রকাশ করেননি। যেন বলতে চান, গৈলা স্কুলের সাবেক ছাত্রদের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রাখা যায়।
হ্যাঁ, তিনি আস্থা রেখেছেন এবং এর সম্মান রাখা হবেই। আমরা সবাই যে গৈলা স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী! এ প্রতিষ্ঠান আমাদের গর্বের। সর্বক্ষণ এর মঙ্গল কামনা করি এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও এ ভাবনা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি।

অজয় দাশগুপ্ত : খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সভাপতি, গৈলা পরিষদ

বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া ও সৈয়দ আবুল হোসেন
অজিত সরকার
২০০১ সালে ক্ষমতার পালাবদলে সাংবাদিকতা পেশার উপর প্রচণ্ড আঘাত নেমে আসে। গণমাধ্যমের উপর হুমকি, সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন, চাকুরিচ্যুতির ঘটনায় দেশে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জর্জ বার্নার্ড শ-এর বিখ্যাত উক্তি  “অংংধংরহধঃরড়হ রং ঃযব বীঃৎবসব ভড়ৎস ড়ভ পবহংড়ৎংযরঢ়” এর যেন প্রতিফলন ঘটতে থাকে বাংলাদেশে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে সাংবাদিক নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে দেশের জাতীয় সংবাদ সংস্থায়। ২০০২ সালের এপ্রিলে কোনো কারণ ছাড়াই বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) থেকে আমাকেসহ ২৭ জন সাংবাদিককে চাকুরিচ্যুত করা হয়। এ অন্যায় চাকুরিচ্যুতির বিরুদ্ধে গোটা সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে । আমরা তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করলে তিনি এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। ঠিক এ সময়টিতে এক সাংবাদিক বন্ধুর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার প্রস্তাব পাই। সাংবাদিকতার সুবাদে সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে একাধিকবার কথা-বার্তা হলেও ব্যক্তিগত পরিচয় তেমন ছিল না। প্রথম সাক্ষাতে আমি তাঁর কাছে আমার করণীয় সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি চীনভিত্তিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ফোরাম ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’র কার্যক্রম সম্পর্কে আমাকে ধারণা দিলেন । সৈয়দ আবুল হোসেন অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার ২৬টি দেশ নিয়ে গঠিত এ সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বাংলাদেশের প্রধান প্রতিনিধি। তিনি আমাকে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটির আয়োজনে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা, সেমিনারের সংবাদ সংগ্রহ, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজের সাথে স¤পৃক্ত  হতে বললেন। কাজের গুরুত্ব ও ব্যাপকতার পরিচয় পেয়ে আমি রাজি হয়ে যাই।
২০০২ সালের ২ মে থেকে কাজ শুরু করি। দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি সৈয়দ আবুল হোসেনের নিজস্ব ধারায় বহুমুখী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজ করার ক্ষেত্রে দক্ষতা। ব্যবসা, রাজনীতি, সমাজসেবা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একযোগে কাজ করার যে পারঙ্গমতা আমি তার মধ্যে দেখেছিÑ তা এক কথায় অসাধারণ। তাঁকে দেখেছি একজন কর্মানুরাগী মানুষ হিসেবে। যিনি প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি প্রায় ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। একজন মানুষ এত কাজ করার পরও নির্বাচনী এলাকার মানুষ ও পরিবার পরিজনকে পর্যাপ্ত সময় দেন। কখনও ক্লান্ত হন না, বিরক্ত হন না। তাঁর কাজ শুধু কাজ নয়। এর মধ্যে রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য। আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, শ্রম এবং মেধার অপূর্ব সমন্বয়। কর্ম সম্পাদনে তাঁর নিজস্ব ধারা যেমন কার্যকর, তেমনি বৈচিত্র্যময়।
কাজে যোগ দিয়ে প্রথমেই আমি ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’ (বিএফএ) এর কার্যাবলী এবং ফোরামটিতে সৈয়দ আবুল হোসেনের অবদান ও সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে ধারণা নিতে চেষ্টা করি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি ‘বোয়াও’ ফোরামের সাথে জড়িত। ফোরামের উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে সৈয়দ আবুল হোসেনের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন ও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সুযোগ লাভ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁকে ব্যাপকভাবে পরিচিত করে তুলেছে। কেননা, অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের যুগে এ ফোরামটি ইতিমধ্যেই একটি কার্যকর ফোরাম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এ ফোরাম গঠনের একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। এসোসিয়েশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (অ্যাপেক), এসোসিয়েশন অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান ন্যাশনস (আসিয়ান)+চীন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া (১০+৩), ডেভোস ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামসহ বহু আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক ফোরাম এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এসব আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক ফোরাম সীমিত গণ্ডির মধ্য থেকে কাজ করে যাচ্ছে। এসব থেকে আলাদা কিছু করার লক্ষ্য নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এশিয়ার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’ গঠন করা হয়। আমি বুঝতে পারি, এটি সাধারণ কোনো ফোরাম নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফোরাম।
চীন তার দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নিতে চায়। এ লক্ষ্যে এশিয়ার দেশগুলোতে তারা তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও সুসংগঠিতভাবে সম্প্রসারিত করার তাগিদ অনুভব করে। এ জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি। এমনি এক বাস্তবতা থেকে চীন অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার ২৬টি দেশ এশিয়ান ফোরাম গঠনের উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত হয়। মূলত ১৯৯৮ সালে ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিডেল ভি. রামোস, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বব হক, জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মরিহিতো হোসাকাওয়া একটি কার্যকর এশিয়ান ফোরাম গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। চীনের আন্তর্জাতিক মর্যাদা, সম্ভাবনা এবং হাইনান প্রদেশের অপরূপ সৌন্দর্য ও পরিবেশের কথা বিবেচনায় নিয়ে ‘বোয়াও’ নামক স্থানে এ ফোরামের প্রধান কার্যালয় স্থাপনের জন্য নির্ধারণ করেন উদ্যোক্তারা। ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের তিন সাবেক রাষ্ট্রনায়কের কাছ থেকে এ ধরনের প্রস্তাব পাবার পর পরই চীন তা সাদরে গ্রহণ করে। হাইনান প্রদেশের ‘বোয়াও’-এর নামানুসারে গঠিত এ আন্তর্জাতিক সংগঠনটির নাম রাখা হয় ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’। অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার ২৬টি দেশ এ ফোরামের সদস্য। বাংলাদেশ, চীন, জাপান, ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এ ফোরামের সদস্য। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ থেকে এ ফোরামের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য সৈয়দ আবুল হোসেনকে মনোনীত করা হয়। এরপর থেকে ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’-এর উদ্যোগে আয়োজিত প্রতিটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সৈয়দ আবুল হোসেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। এ লেখার মধ্যে সম্মেলনগুলোতে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ভূমিকার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
২০০১ সালের ২৬ ফেব্রচ্ছারি চীনের হাইনান প্রদেশের বোয়াওতে শুরু হয় দুই দিনব্যাপী ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’-এর প্রথম সম্মেলন। এ উপলক্ষে বোয়াও সাজে বর্ণাঢ্য সাজে। অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার ২৬টি দেশের সাবেক ও বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধানসহ প্রায় দুই হাজার প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়োসোহিরো নাকাসোনে, ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিডেল ভি. রামোস, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বব হক, কাজাখিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সেরগেই টেরেকসেনকো, মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট পুনসালমা অরকিরবাট, চীনের প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহথির বিন মোহাম্মদ, নেপালের প্রয়াত রাজা বীর বিক্রম শাহ দেব, ভিয়েতনামের উপ-প্রধানমন্ত্রী নওয়েন মান ক্যাম। তাঁরা সবাই সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের বহু রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে অভিনন্দন বার্তা পাঠান।
বাংলাদেশ থেকে সৈয়দ আবুল হোসেনসহ কয়েকজন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এ সম্মেলনে যোগদান করেন। এ সম্মেলনেই সৈয়দ আবুল হোসেনকে ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’-এর প্রধান বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এশিয়ার বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান রাষ্ট্র প্রধানের উপস্থিতি গোটা সম্মেলনকে প্রাণবন্ত করে তোলে। এশিয়ার নেতৃবৃন্দ অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বার্থে একযোগে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। অধিকাংশ নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে ফোরাম গঠনের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য প্রকাশ পায়।
ফোরাম গঠনের উদ্যোক্তাদেরই একজন ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিডেল ভি. রামোস। তিনি ফোরাম গঠনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে বলেন, ‘‘এটা সত্য যে এশিয়াতে অনেক ফোরাম রয়েছে। কিন্তু তাদের কেউই এশিয়ার মেধা ও কূটনৈতিক অভিজ্ঞতার সমাবেশ ঘটাতে পারেনিÑ যেটা আমরা এ সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে ঘটাতে পেরেছি।” চীনের প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন বলেন, এই ফোরাম অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে সংলাপ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে একটি অভিন্ন উন্নয়নে এশিয়ার দেশগুলোর আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। এটা এখন সময়ের দাবি। কফি আনান এক বাণীতে ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’ এর ভূমিকা সম্পর্কে উঁচু ধারণা পোষণ করে বলেন, ‘যে সকল নেতৃবৃন্দ এই ফোরামের সাথে যুক্ত রয়েছেনÑ তাদের সম্মিলিত প্রয়াস শুধু এশিয়াকে নয়, সমগ্র বিশ্বকে উপকৃত করবে।’ এ সম্মেলনেই সিদ্ধান্ত হয় ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’ এর চার্টার। ঘোষণা (ডিক্লারেশন) অনুয়ায়ী প্রতি বছরই ফোরামের বার্ষিক সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথম বার্ষিক সম্মেলন হয় ২০০২ সনের ১২-১৩ এপ্রিল।
‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’-এর বার্ষিক সম্মেলন ছাড়াও সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে চীনের গুইলিনে পর্যটন সম্মেলন এবং তেহরানে জ্বালানি বিষয়ক সম্মেলন উল্লেখযোগ্য। চীনের গুইলিনে অনুষ্ঠিত পর্যটন সম্মেলনে ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’-এর স্পোকসপারসন হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেন বাংলাদেশ থেকে যোগদান করেন। ২০০২ সালের ১৮ নভেম্বর এ সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে সৈয়দ আবুল হোসেন সভাপতিত্ব করেন। এ সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনের দক্ষতা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়।
১৯ নভেম্বর ২০০২ সনের ছাব্বিশ দেশের প্রতিনিধি অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে গুইলিন ঘোষণা ২০০২ গৃহীত হয়। সমাপ্তি অধিবেশনেও সভাপতিত্ব করেন সৈয়দ আবুল হোসেন। অন্যান্যের মধ্যে ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’-এর সেক্রেটারি জেনারেল ড. ঝ্যাং সিয়াং বক্তব্য রাখেন।
বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া, চায়না ন্যাশনাল ট্যুরিজম এ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং এশিয়া কো-অপারেশেন ডায়ালগ যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করে। এশিয়ার ২৬টি দেশের পর্যটন মন্ত্রীসহ ৫ শতাধিক প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। বোয়াও ফোরামের স্পোকসপারসন এবং মাস্টার অব সেরিমনি হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেন ১৯ নভেম্বর গুইলিন ঘোষণা-২০০২ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার পর দু’টি পৃথক প্রেস কনফারেন্সে ট্যুরিজম সম্মেলনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং বিভিন্ন দিক সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন। এ সময় তাঁকে সহায়তা করেন চায়না ন্যাশনাল ট্যুরিজম এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ভাইস মিনিস্টার মি. সান গ্যাং, বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ইয়াও ওয়াং এবং গুইলিন মিউনিসিপ্যাল গভর্নমেন্ট-এর ভাইস মেয়র প্যান জিয়ানমিং।
গুইলিন ঘোষণা-২০০২ উপস্থাপনকালে চায়না ন্যাশনাল ট্যুরিজম এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের চেয়ারম্যান মি. হি গুয়াংওয়ে এশিয়ার দেশগুলোতে ভ্রমণকারীদের অবাধ চলাফেরা নিশ্চিত করার জন্য আঞ্চলিক এবং আন্তঃআঞ্চলিকভাবে বিদ্যমান সকল ধরনের বাধা অপসারণের আহ্বান জানান। গুইলিন ঘোষণায় আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে পরিবেশসম্মত ট্যুরিজম পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এতে সরকার, ব্যক্তিখাত পরিচালনাকরী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের মাঝে কার্যকর অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার উপর জোর দেওয়া হয়। সমাপনী ভাষণে সৈয়দ আবুল হোসেন যে বক্তব্য উপস্থাপন করেন তা হলো- “পর্যটন থেকে সর্বোচ্চ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য পর্যটন শিল্প এবং পর্যটন অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। আর কোনো বিষয় যাতে পরিবেশের ক্ষেত্রে পর্যটন শিল্পখাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে না পারে, সেজন্য দীর্ঘ মেয়াদি টেকসই পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক। পর্যটন হলো একটি তথ্য নির্ভর শিল্প। সেজন্য তথ্যের আদান প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক টুরিস্টদের আকৃষ্ট করে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক বিকাশ সাধন করা সম্ভব। পর্যটন শিল্পে গতিশীলতা আনয়ন এবং এ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার জন্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো, টুরিস্ট পণ্য উন্নয়ন এবং ট্যুরিজম সার্ভিসের আরও উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে।”
বিকেলে রাউন্ড টেবিল বৈঠকে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন অংশগ্রহণ করেন। শেষ দিনে ২৬টি দেশের অতিথিদের সম্মানে চীনের লী জিয়াং নদী ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়।
২০০৪ সালের ২৩ এপ্রিল। এদিন বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার ২৬টি দেশের বর্তমান এবং সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান, রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদরা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্য নিয়ে সমবেত হন চীনের হাইনান দ্বীপে । ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’ আয়োজিত হাইনানেন সোফিটাল বোয়াওতে চার দিনব্যাপী এ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন চাইনিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান জিয়া চিং লিং। বোয়াও ফোরামের প্রধান বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনকে ২৫ এপ্রিল ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ব্যবসায়ীদের সামাজিক দায়িত্ব’ শীর্ষক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার জন্য মনোনীত করা হয়।
এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ১ হাজার প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগ দেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে যারা এ সম্মেলনে যোগদান করেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেনÑ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দাতকু আবদুল্লাহ আহমেদ বাদাবি, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড, সিঙ্গাপুরের মন্ত্রী লি কুয়ান ইউ, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বব হক, নেপালের রাজা জ্ঞানেন্দ্র, ইউরোপিয়ান কমিশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোমানো প্রোদি, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফারুক লেঘোরি প্রমুখ। ২০টি অধিবেশনে বিভক্ত এ সম্মেলনের প্রথম প্লেনারি সেশানে ২৩ এপ্রিল তিনটি বিষয় উত্থাপন করা হয়। অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের কালে এশিয়ার ভূমিকা, সুনামি পরবর্তী পুনর্গঠন এবং এশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং এশিয়ার সামাজিক উন্নয়নের খাপ খাওয়ানো শীর্ষক তিনটি বিষয়বস্তুর ওপর মুখ্য আলোচক ছিলেন চীনের পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ঝিয়া চিং লিং, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ আহমেদ বাদাবি, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড, সিঙ্গাপুরের মন্ত্রী লি কুয়ান ইউ, নেপালি কাউন্সিল অব মিনিস্টার ও এর ভাইস চেয়ারম্যান কিরতি নিধি বিসতা। এর আগে ২২ এপ্রিল সৈয়দ আবুল হোসেন সম্মেলনে আগত ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিডেল রামোস, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বব হক, সিঙ্গাপুরের মন্ত্রী লি কুয়ান ইউ, মালয়েশিয়ার সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী দাতোস মুসা বিন হিতাম ও শ্রীলংকার দক্ষিণ অঞ্চলের গভর্নর কিংসলে উইক্রামারাতনে এবং চীনের পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ঝিয়া চিং লিং-এর সঙ্গে মত বিনিময়ের সময় দ্বি-পাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনায় তিনি বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সবার আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
২৪ এপ্রিল “ইকোনমিক গ্রোথ এন্ড এন্ট্রিপ্রিউনিয়ারস সোস্যাল রেসপনসিবিলিটিস এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন লেবার এন্ড চ্যারিটি” শীর্ষক সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সৈয়দ আবুল হোসেন। সেমিনারে বক্তারা এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি সামজিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। এশিয়ার দেশগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে যেভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা অতীতে আর কখনও দেখা যায়নি। অথচ সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে দেখা যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে গিয়ে পরিবেশকে বিনষ্ট করা হয়। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোর উন্নয়নের ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এশিয়ার দেশগুলোতে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। সেমিনারে বক্তারা বলেন, আমাদের সামনে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ। ধনী এবং দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ছে, দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যবসায়ীদের যথাযথ ভূমিকা রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সেমিনারে বক্তব্য রাখেন ইউপিএস এশিয়া এন্ড প্যাসিফিকের সভাপতি কেনেথ আর্থার তোরক, এনওয়াইকে চেয়ারম্যান এবং বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার বোর্ড অব ডিরেক্টর জিরো নেমেটো প্রমুখ।
২০০৪ সালের ২৬ এপ্রিল। চীনের হাইনান প্রদেশের বোয়াওতে বিএফএ এর উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ফোরামের সদস্যভুক্ত দেশের প্রায় ১ হাজার প্রতিনিধি ছাড়াও বিশ্বের কয়েকটি দেশের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। দুই দিন পরিব্যাপ্ত এ সম্মেলনকে চারটি অধিবেশনে বিভক্ত করা হয়। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা এ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেনÑ চীনের প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মীর জাফরুল্লাহ খান জামালি, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী সামদেদুন সেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিডেল ভি. রামোস, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বব হক, নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কিরতি নিধি বিসতা এবং পাকিস্তানের সাবেক পেসিডেন্ট ফারুক আহমেদ খান লেঘারি।
দুই দিনব্যাপী অধিবেশনের শেষ দিনে এশিয়ান কালচারাল এক্সচেঞ্জ এন্ড কো-অপারেশন শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এ বৈঠকে সভাপতি হিসেবে বৈঠক পরিচালনা ছাড়াও সৈয়দ আবুল হোসেনকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। বৈঠকে তিনি এশিয়ার দেশগুলোকে একে অপরের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ানোর পাশাপাশি সহযোগিতামূলক উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বৈঠকে তিনি সাংস্কৃতিক বিনিময়, পারস্পরিক সহযোগিতা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানের মাধ্যমে বিশ্বায়নকে পরিপূর্ণভাবে সার্থক  করে তোলার উপর গুরুত্ব দেন। সে-দিন তিনি বলেছিলেন:
“সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যক্তি এবং জাতি সমৃদ্ধ হয়। সংস্কৃতি সমৃদ্ধ এশিয়ার দেশগুলো প্রতিনিয়ত তা বিনিময়ের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান শতক শুধু অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের শতকই নয়, এটি সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের যুগ। এশিয়ার সংস্কৃতির মূলমন্ত্র হবে মানুষে মানুষে সাহচর্য, সমঝোতা, একে অপরের প্রতি সমবেদনা, মানুষের প্রতি ভালবাসা, সৌহার্দ্য, শান্তি ও সম্প্রীতি। এশিয়ার মানুষের কাছে এ মন্ত্র পৌঁছে দেওয়া আজ বড় বেশি প্রয়োজন।”
১৬ জুলাই ২০০৪। তেহরানে অনুষ্ঠিত হয় জ্বালানি বিষয়ক দিনব্যাপী সেমিনার। সেমিনারের বিষয়বস্তু “জ্বালানি এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন।” সেমিনারের অন্যতম আয়োজক ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’-এর পক্ষ থেকে সৈয়দ আবুল হোসেনকে আগে থেকেই সেমিনারের শেষ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার অনুরোধ জানিয়ে পত্র পাঠানো হয়। তিনি অনুরোধে সম্মতি প্রকাশ করেন। ইরানের জ্বালানি ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয় এবং ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’ যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করে।
১৭ জুলাই দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের শেষ দিনে ‘জ্বালানি এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ বিষয়ক সেমিনারে সৈয়দ আবুল হোসেন সভাপতি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। এ সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ইরানের জ্বালানি উপমন্ত্রী ড. আমরোল্লাহি, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ড. অরডেকোনিয়ান এবং আহমদিয়ান চায়না একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক ঝাই গুয়াংমিন। এ সম্মেলনে বক্তারা ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা পূরণে বিশ্বকে জ্বালানি খাতে আরও বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানান। তারা বলেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে জ্বালানি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সেমিনারে বক্তারা এশিয়ার দেশগুলোতে জ্বালানি চাহিদার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তারা বলেন, জ্বালানি সমস্যা সমাধানে এই মুহূর্তে এশিয়াব্যাপী একটি স্বচ্ছ এবং উন্মুক্ত জ্বালানি বাজার সৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য এবং টেকসই পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য জ্বালানি সক্ষম প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে এবং খনিজ সম্পদ আহরণে পরিবেশগত উন্নয়ন এবং পুনরুজ্জীবিত জ্বালানি প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিতে হবে।
বক্তারা বলেন, স্থানীয় পরিবেশ দূষণ এবং বিশ্ব পরিবেশগত সমস্যা যেমন এসিড বৃষ্টির মতো সমস্যার উদ্ভব না-ঘটায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একমাত্র ভূগর্ভস্থ জ্বালানির উপর বর্তমান নির্ভরতা কমাতে হবে। জ্বালানি ব্যবহার ও সংগ্রহে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া পরিহার করার কৌশল আবিষ্কারে উদ্যোগ নিতে হবে। টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে জ্বালানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এর আগে প্রথম অধিবেশনে ইরানের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী ড. আদেলি, পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী জানজেনেহ, বোয়াও ফোরামের মহাসচিব ইয়ং টু লং এবং অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বব হক বক্তব্য রাখেন।  
বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ায় সৈয়দ আবুল হোসেনের ভূমিকা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর কাজের ক্ষেত্রের একটি খণ্ডিত চিত্র মাত্র। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দলের ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্য তিনি প্রচুর কাজ করেছেন, যা একটি বা দু’টি লেখার মধ্য দিয়ে শেষ করা যাবে না। জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে চীন ও ইউরোপ সফর, চীনে সন্ত্রাস বিরোধী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করা এবং সম্মেলনে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা তুলে ধরে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে দিয়ে সর্বসম্মতভাবে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ, জননেত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র বিষয়ক সাব-কমিটির নিয়মিত সভা ও কূটনীতিকদের সাথে নিয়মিত বৈঠক করে দেশ ও দলের ভাবমূর্তি তুলে ধরাসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা কর্মকাণ্ডের দালিলিক রূপ দিতে হলে একটি বই লেখা যাবে। এক কথায় আমি বলতে পারি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের দল ও বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্য সৈয়দ আবুল হোসেন যে নিরলস শ্রম, বিচক্ষণ উদ্যোগ ও যুগোপযোগী ভূমিকা রেখেছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে।

অজিত সরকার : সাংবাদিক, প্রধান প্রতিবেদক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা; বিশিষ্ট কলামিস্ট

মিসরের আসওয়ান বাঁধ এবং পদ্মা সেতু
মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার, পিএসসি (অব.)
প্রতিটি জাতি-রাষ্ট্রের চলমান কালপ্রবাহের বাঁকে বাঁকে একেকটি ক্রান্তিকাল আসে। সে ক্রান্তিকালে জাতি যদি অদম্য সাহস ও ঐক্যবদ্ধভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে রাষ্ট্রের মোড় ঘুরে যায় এবং সর্বক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হয়। পরবর্তী পঞ্চাশ, শত কিংবা দু’শো বছরের পথ চলায় ওই রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় রশদ সম্ভারের আর কোনো অভাব হয় না। ইতিহাসে এরকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬-তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন যদি বর্ণবৈষম্য এবং দাসপ্রথা বাতিল ঘোষণা না করতেন এবং তার জন্য গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি না নিতেন তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি হতে পারত না। 
১৯৭১ সালের ভয়াবহ সংকটময় মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু যদি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেন এবং যথাসময়ে স্বাধীনতা ঘোষণা না করতেন তাহলে আজ আমরা বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হতে পারতাম না। যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের জীবন দিতে হবে, এ ভয়ে যদি সেদিন আমরা পিছিয়ে যেতাম তাহলে বাঙালি জাতিকে আজও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত পাকিস্তানের সঙ্গী হয়ে থাকতে হতো। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪১ বছর। অনেক অঘটনের পরও তুলনামূলক দৃষ্টিতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রগতি কোনো ক্ষেত্রেই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবে পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনা যদি না ঘটত, দেশ যদি পরপর দু’জন সামরিক স্বৈরশাসকের কবলে না পড়ত এবং একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত-শিবির যদি রাষ্ট্র ক্ষমতায় না যেতো তাহলে বাংলাদেশ আজ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা ভিয়েতনাম থেকে কোনো ক্ষেত্রেই পিছিয়ে থাকত না। 
২০১২ সালে এসে বাংলাদেশ এখন নতুন একটি ক্রান্তিলগ্নে উপনীত। বিগত প্রায় ৩-৪ বছর ধরে সব প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে এবং সব সিদ্ধান্ত গ্রহণে সর্বত্র তাদের প্রাধান্য বজায় থাকার পরও দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে বা দুর্নীতির পরিকল্পনা করা হচ্ছে- এ অজুহাত তুলে বিশ্বব্যাংক গত ২৯ জুন পদ্মা সেতু নির্মাণে তাদের প্রতিশ্র“ত ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে দেশের বৃহত্তম সেতু নির্মাণের জন্য প্রকল্পের আওতায় কর্মপরিকল্পনার পাঁচটি প্যাকেজের মধ্যে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ প্যাকেজে সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। 
বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ খাতে বড় আকারের দুর্নীতি হতে পারত। কিন্তু এ পর্যন্ত পুনর্বাসন প্যাকেজের কাজে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি, বা কোনো পত্র-পত্রিকায়ও তেমন কোনো সংবাদ দেখা যায়নি। পদ্মা সেতু নির্মাণ শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব শুধু তাদেরই, এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি জাতির জন্য শুভকর নয়। বিপুল সম্ভাবনাময় এ পদ্মা সেতু নির্মিত হলে তার সাফল্যের প্রচারণা চালিয়ে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হয়ত দক্ষিণাঞ্চলের কিছু ভোট টানতে পারবে, কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তন হবে দেশের ১৬ কোটি মানুষের। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নির্মাণ শেষ হলে সমগ্র দেশের কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, আমদানি-রপ্তানি এবং কর্মসংস্থানের যে সুযোগ সৃষ্টি হবে তা থেকে দেশের সামগ্রিক জিডিপিতে প্রতিবছরে প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা যোগ হবে। শুধু সেতুর জন্য দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে প্রায় শতকরা ২ ভাগ। দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং বিদেশ নির্ভরশীলতা বহুলাংশে কমে যাবে। 
সমগ্র জাতির সামনে আজ প্রশ্ন হলো, এতদূর অগ্রসর হওয়ার পর দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে শুধু এ অভিযোগে বাংলাদেশ কি সেতু নির্মাণের মধ্যপথে থমকে থাকবে, নাকি জাতীয় কল্যাণ ও মর্যাদা রক্ষায় যে কোনো ত্যাগের বিনিময়ে বিকল্প অর্থায়নে দ্রুত নির্মাণকাজ শুরু করবে। উন্নয়নকামী দেশের জন্য বিশ্বব্যাংক কর্তৃক এহেন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা নতুন কোনো ঘটনা নয়। স্থান-কাল ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও প্রাসঙ্গিকতার খাতিরে ঠিক এরকমই একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে তুলে ধরছি।
১৯৫২ সালে বিপ্লবের পর মিসরবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নীলনদের উজানে আসওয়ান নামক স্থানে হাই ড্যাম বা বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প বিপ্লবি সরকারের অন্যতম এজেন্ডা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিপ্লবকে সংহত করে ১৯৫৫ সালের মধ্যে আরব জাতীয়তাবাদের জাগরণী প্রবক্তা ও পুরোধা হয়ে আবির্ভূত হন জামাল আবদেল নাসের। অধিষ্ঠিত হন মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। নাসের বাঁধ নির্মাণের জন্য সব সমীক্ষা ও প্রস্তুতি সম্পন্ন করে অর্থের জন্য বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রস্তাব পাঠান। সমগ্র আরব বিশ্বে নাসেরের বিপুল জনপ্রিয়তার কথা চিন্তা করে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে কমিউনিস্ট বিস্তার রোধকল্পে এবং আরব-ইসরায়েল সংকট নিরসনে কাজে লাগাবার আশায় নাসেরের প্রস্তাবে রাজি হয়। বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ৮০ কোটি ডলারের মধ্যে ২০ কোটি বিশ্বব্যাংক এবং ৫.৮ কোটি যুক্তরাষ্ট্র দেবে বলে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্র“তি দিল নির্মাণকাজের অগ্রগতিতে আরও অর্থায়ন করা হবে। 
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত নাসের শুরু থেকে কমিউনিস্ট ব্লক বা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পুঁজিবাদী বিশ্ব বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমদূরত্ব নীতি গ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল দ্রুত ঋণ দিতে রাজি হলে নাসের নিরপেক্ষ অবস্থান ত্যাগ করে ১৯৫৫ সালে স্বাক্ষরিত বাগদাদ সামরিক জোটে যোগ দেবেন এবং সোভিয়েতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন। কিন্তু নাসের তার সমদূরত্বের নীতিতে অটল রইলেন। ইত্যবসারে নাসের খুবই সহজ শর্তে মিসরের উৎপন্ন তুলার বিনিময়ে সোভিয়েতের সহায়তায় চেকোশ্লোভিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কেনার ছোট একটি চুক্তি স্বাক্ষর করলেন। এ সংবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভয়ানকভাবে ক্ষুব্ধ হয় এবং আসওয়ান বাঁধের ঋণচুক্তি বাতিল ঘোষণা করে। বিশ্বব্যাংকও যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে। নাসের পড়লেন উভয় সংকটে। একদিকে রাষ্ট্রের নীতি ও আদর্শ, অন্যদিকে ইতোমধ্যে জনগণের ভেতরে যে পাহাড়সম প্রত্যাশার জন্ম তিনি নিজেই দিয়েছিলেন তার বাস্তবায়ন। সুয়েজ খাল তখন ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীনে। তার আয় থেকে খুব সামান্য একটা অংশ পেতো মিসর। নাসের সিদ্ধান্ত নিলেন সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করে তার থেকে যে আয় হবে তার একটা বড় অংশ দ্বারা আসওয়ান বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু করবেন এবং অন্য কোনো দেশ বা বিশ্ব সংস্থা যদি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ব্যতীত সহজশর্তে ঋণ দিতে রাজি হয় তবে তাদের থেকে অর্থায়ন করে নির্মাণকাজ শেষ করবেন। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। 
১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই প্রেসিডেন্ট নাসের হাজির হলেন আলেকজান্দ্রিয়া শহরে, জলস্রোতের মতো হাজির হওয়া আশান্বিত লাখো মানুষের জনসভায়। উৎসুক জনতার উদ্দেশে আবেগতাড়িত ও যুক্তিপূর্ণ ভাষণের শেষ দিকে বললেনÑ
‘আমেরিকা, ব্রিটেন ও বিশ্বব্যাংক আসওয়ান বাঁধের জন্য প্রতিশ্র“ত আর্থিক সাহায্য প্রত্যাহার করে আমাদের পদানত করতে চায়। তারা মিসরের আর্থিক মেরুদণ্ডকে দুর্বল রেখে অনাগতকাল মিসরকে তাদের কব্জায় রাখতে চায়। কিন্তু আমরা যে সংকল্প করেছি তা থেকে কারও ভয়ে বিচ্যুত হতে চাই না। কারও কাছে সাহায্যের জন্য ধরনা দেব না। খোদা আমাদের যে সম্পদ দিয়েছেন তা দিয়েই আমরা কাজে নামতে চাই। সে পথে আমাদের হাজারো বাধা আসবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আমাদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে জন্য আমাদের ভীত হলে চলবে না। অতিক্রম করতে হবে সব বাধা-বিপত্তি। ইন্শাআল্লাহ আমরা জয়যুক্ত হব।’ (আনিস সিদ্দিকী : মুক্তি সংগ্রামে নাসের)। 
উপস্থিত জনতা লাখো হাত উঁচু করে নাসেরের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। উৎফুল্ল জনতার হাত নামার আগেই নাসের উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন ‘আজ থেকে সুয়েজ খালের মালিক মিসরের জনগণ। সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করা হলো।’
নাসেরের ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হলো ব্রিটেন ও ফ্রান্স। সুয়েজ খালকে জাতীয়করণের ঘোষণার মাত্র তিন মাসের মাথায় ১৯৫৬ সালের ২৯ অক্টোবর ইসরায়েল অতর্কিতে মিসর আক্রমণ করল। দ্রুত সর্বাত্মকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স। যুক্তরাষ্ট্রের তখন নির্বাচন একেবারে দ্বারপ্রান্তে বিধায় প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ার পুননির্বাচনের কৌশল হিসেবে সবরকম বৈদেশিক সংকট থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। জাতিসংঘ ও সোভিয়েতের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বন্ধ হয়। যুদ্ধ শেষে সুয়েজ ছাড়তে বাধ্য হয় ব্রিটিশ বাহিনী। মুক্তি সংগ্রামে নাসেরের জয় হয়। মিসরবাসী তাদের ক্ষয়ক্ষতির কথা বিস্মৃত হয়ে নাসেরের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়। মিসর নিজের অর্থে আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। মাত্র ২% সুদে ৫৫ কোটি ডলার সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৬০ সালে বাঁধ নির্মাণ শুরু হয় এবং দুই ধাপে সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৭০ সালে। তারপর থেকে মিসরবাসীকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আসওয়ান বাঁধ ও সুয়েজ খাল মিসরবাসীর লাইফ লাইন এবং সমগ্র বিশ্বের কাছে মিসরকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। 
বর্তমান সময় পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য আসওয়ান বাঁধ থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছর পর বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে তাদের প্রতিশ্র“ত ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। এ এক বছরে পদ্মা নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের নতুন সামরিক কৌশল ঘোষণা করেছে। এর মধ্যেই বঙ্গোপসাগরের অফুরন্ত সম্পদের ওপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের ফলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে নতুন গতি এসেছে। বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তির ক্ষমতাবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পদ ছেড়ে দিতে হওয়ায় নোবেল বিজয়ী ড. মো. ইউনূস সারা বিশ্বে নালিশ দিয়েছেন। 
ভৌগোলিক অবস্থান এবং খনিজসম্পদের বিপুল সম্ভাবনার কারণে বাংলাদেশ এখন পরাশক্তির জন্য আকর্ষণীয় রাষ্ট্র। নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও আফগানিস্তান ব্যাপক প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী হয়েও আজ কেন বিশ্বের করুণার পাত্র হয়ে আছে তা আমাদের অনেকেরই জানা আছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের অভ্যন্তরে এখনো ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির প্রয়োগ করে যাচ্ছে তাদের নিজেদের স্বার্থ আদায়ের কৌশল হিসেবে। দুর্নীতি বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে এবং যে দেশে এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী স্বপ্রণোদিত হয়ে অবৈধ আয় এবং তদীয় কালো টাকাকে সাদা করার ঘোষণা দিতে পারেন, সে দেশের অভ্যন্তরে বিশ্বের ধনী দেশ ও শক্তিশালী সংস্থাগুলো তাদের লুকায়িত কোনো উদ্দেশ্যকে হাসিল করার জন্য নির্ধারিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে ব্যবহার করার মতো সহজ অন্য কোনো উপায় আর হতে পারে না। সঙ্গতকারণেই মানুষও সহজে তা বিশ্বাস করতে চায়।
বিশ্বব্যাংক কানাডিয়ান কোম্পানি এসএনসি লাভালিনকে কেন্দ্র করে যে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে তার তদন্ত কানাডিয়ান পুলিশ এখনো শেষ করেনি। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তও শেষ হয়নি। বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো ঋণদাতারা কোনো টাকা এখনো ছাড় করেনি। এমতাবস্থায় নির্ধারিত সময়ের এক মাস আগেই বিশ্বব্যাংক কর্তৃক একতরফা চুক্তি বাতিলের ঘোষণা বাংলাদেশের কোনো বিবেকবান ও জাগ্রত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ দল থেকে দেশের স্বার্থ অনেক ঊর্ধ্বে। ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের প্রশ্ন এখানে জড়িত। 
সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ২ জুলাই সমকালের সম্পাদকীয় পাতায় ‘পদ্মা সেতু প্রকল্প বৃত্তান্ত’Ñ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। দুর্নীতি হয়েছে কি হয়নি, সে বিষয়ে তিনি সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি কারিগরী টিমের প্রধান ছিলেন। সেই অবস্থান থেকে তিনি নকশা প্রণয়ন থেকে শুরু করে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রণীত কর্মপরিকল্পনার সব প্যাকেজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিক একটা প্রাঞ্জল চিত্র তুলে ধরেছেন। লেখাটি পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন কোনো প্যাকেজের কোনো প্রক্রিয়ায় কোথাও কোনো শটকার্ট বা কোনো নিয়ম-বিধির সামান্যতম ব্যত্যয় ঘটেনি বা ঘটার সুযোগও ছিল না। সব পর্যায়ে মাল্টি ডাইমেনশনাল চেক অ্যান্ড ব্যালান্স রাখা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক সব পর্যায়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে সব সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে এবং অনুমোদন দিয়েছে। 
বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অভিযোগ তাদের জন্মের কাল থেকেই আছে। বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন বিশ্বব্যাংকের সব পর্যায়ে এবং ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, অনভিজ্ঞ-অযোগ্য এবং ভুয়া সনদ জমাদানকারী একটি চীনা কোম্পানিকে মূল সেতু নির্মাণের ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে মূল্যায়ন কমিটি এবং বাংলাদেশ সরকারকে একাধিকবার চাপ প্রয়োগ করা হয়। প্রশ্ন হলো, এ একই কাজটি যদি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে করা হতো তাহলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করত সেরকম কোনো অভিযোগ যদি বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় তাহলে সেটি কি অমূলক হবে। আজ বিশ্বব্যাংকের উঁচু গলা শুনে বলতে ইচ্ছা হয়:

‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ…। ’

বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের জন্য উন্নয়ন সহযোগী প্রয়োজন। তাই বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্ব নয়; বরং নিজেদের সামর্থে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে জাতীয় গৌরব ও আত্মমর্যাদার অনন্য স্মারক স্থাপনের জন্য। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বউদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা, সাহস ও সময়োচিত সিদ্ধান্তের ফলে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। সেদিনও একদল বাঙালি নামধারী পাকিস্তানি দোসর বলেছিলেন, শেখ মুজিবের লাঠি আর বন্দুক দিয়ে দক্ষ পাকিস্তানি বাহিনীকে বাঙালি পরাস্ত করতে পারবে না। কিন্তু সেদিন বাঙালি জাতির জাগরণ ও আত্মশক্তির কাছে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়েছিল। একদল বাংলাদেশি নাগরিকের বিশ্বব্যাংকের দোসরের মতো কথা বলতে দেখে আজ একাত্তরের কথাই বারবার মনে পড়ছে। কিন্তু ৪১ বছর পর বাঙালি আবার আত্মশক্তিতে জেগে উঠলে তাকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার, পিএসসি (অব.)।

আমার আলেকজান্ডার
অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মো. তমিজ উদ্দিন
॥ এক ॥
১৯৫১ সনে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি লাভ করি। শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন স্তরে স্মরণীয় আমার শ্রদ্ধাস্পদ শিক্ষকদের জীবনধারা আমাকে অনুপ্রাণিত করিত। তাঁহাদের দেবতাসুলভ চরিত্র ও সহজ সরল জীবন পদ্ধতি আমার মনে আদর্শ হিসেবে দানা বাঁধে। অন্যকোনো চাকুরির মোহ আমার জন্মে নাই। আমার শিক্ষাজীবন খুব একটা কৃতিত্বপূর্ণ নয়। তবু ১৯৪৭ সনে দেশ বিভাগের পর পর এই ডিগ্রির বলে লোভনীয় কিছু একটা করার সুযোগ ছিল। কলেজ জীবনে শিক্ষকদের জীবনধারা আমার মাঝে এমন সাড়া জাগায় যে, আমাকে অন্য চিন্তা না-করিয়া শিক্ষক হইতে হইবে। তাই এই নন্দিত জীবনকে বরণ করিয়া নেই। যদিও আজ সমাজের মাপকাঠিতে এই পেশা নিন্দিত বলিয়া মনে হয়। শিক্ষাজীবন শেষে স্থানীয়ভাবে অনুরোধের ফলে নিজ এলাকায় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে মাস ছয়েক থাকিবার পর ১৯৫২ সনের নভেম্বর মাসে মাদারীপুর নাজিম উদ্দিন কলেজে যোগদান করি। আমি আমার ঈপ্সিত পদ ও পেশা পাইয়া গেলাম, ফলে আমার আর কিছু প্রাপ্তির কোনো লোভ থাকিল না।
১৯৫১ আমার জীবনের একটি স্মরণীয় বছর। ঐ সনে আমার প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করে। ঐ বছর আমি এমএ পাশ করি। সর্বোপরি, ঐ বছর আমার প্রিয় ছাত্র সার্বজনীন শিক্ষার দিশারী সৈয়দ আবুল হোসেন জন্মগ্রহণ করে। নাজিম উদ্দিন কলেজে বারো বছর চাকুরি করিবার পর ১৯৬৪ সনের জুলাই মাসে নব প্রতিষ্ঠিত গৌরনদী কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করি। শিক্ষক জীবনে অধ্যক্ষ একটি আকর্ষণীয় পদ, তবে ঐ পদের জন্য আমাকে প্রার্থী সাজিতে হয় নাই। আমার প্রাক্তন ছাত্রদের অনেকে গৌরনদী কলেজ প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত ছিল। তাহারাই আমাকে ভালো শিক্ষক মনে করিয়া গৌরনদী কলেজের অধ্যক্ষ পদে বরণ করিয়া নিয়াছিলেন। ভালো শিক্ষকের পুরস্কার পাইয়া জীবনটা প্রথম বারের মতো ধন্য হইয়া গেল।
নব প্রতিষ্ঠিত কলেজ। ছিল না অর্থ, ছিল না অবকাঠামো। ছিল না বেতন দিবার মতো পর্যাপ্ত তহবিল অধিকন্তু, পাশে প্রতিযোগিতামূলকভাবে আর একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করিলেন কিছু লোক। কলেজ যায় যায় অবস্থা। গৌরনদী কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হরলাল বাবুর জীবনপণ চেষ্টা সত্ত্বেও সমস্যার পর সমস্যা আসিয়া ভিড় করিতেছিল। অর্থের অভাবে বেতন না-পাইবার কারণে স্থানীয় দুইজন শিক্ষক অন্য কলেজে চলিয়া গিয়াছিলেন। পাকা দালান দূরে থাক বেড়া দিবার সামর্থ্যও কলেজ কর্তৃপক্ষের ছিল না। খোলা স্থানে শিক্ষার্থীদের পড়াইতে হইত। আজ জীবন সায়াহ্নে আফসোস করি, কেন যে সেই দিন একজন আবুল হোসেন পাই নাই। সেই দিন যদি একজন আবুল হোসেন পাইতাম তাহা হইলে সে চৌষট্টিতে গৌরনদী কলেজ কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সুদৃশ্য ভবন ও অলেপনীয় খ্যাতি অর্জন করিত। ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হইত।
১৯৬৬ সনের জুলাই মাসে কলা ও বাণিজ্য শাখা দিয়া গৌরনদী কলেজে ডিগ্রি ক্লাশ শুরু হইল। সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ, খোয়াজপুর-এর মহান প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন ডিগ্রি ক্লাশের ১৯৬৮ ব্যাচের বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৯ সনে অভ্যন্তরীণ কারণে আমি গৌরনদী কলেজ ছাড়িয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার সায়েদাবাদের আদর্শ মহাবিদ্যালয়ে যোগদান করি। নোংরা দ্বন্দ্বের জন্য সেখানেও বেশিদিন থাকিতে পারি নাই। শিক্ষাকে আমি নোংরা দ্বন্দ্ব ও রাজনীতি হইতে যত দূরে রাখিবার চেষ্টা করিতাম। সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে কিছু লোক তাহা আমার উপর আরও জোর করিয়া চাপাইয়া দিবার চেষ্টা করিত। আমি শিক্ষক, শিক্ষাদান ছাড়া আর কিছু বুঝিতাম না কিন্তু তাহারা আমাকে শিক্ষার বাহিরে লইয়া যাইবার চেষ্টা করিত। ব্যর্থ হইলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাইত।
১৯৭০ সনের জুন মাসে আমি রায়পুরা কলেজে যোগদান করি। আমার গ্রাম, আমার দেশ। সেইখানে দেখি ঝামেলা আরও বেশি, সেই পুরানো নোংরা দ্বন্দ্ব। ১৯৭১ সনের ৩ মার্চ আমি পিরোজপুর কলেজে অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদানের আমন্ত্রণ পাই। সকল দিক বিবেচনা করিয়া আমি উহা গ্রহণ করি এবং ঐ বৎসর পিরোজপুর কলেজে যোগদান করি। ১৯৮০ সনের ১ মার্চ কলেজ সরকারি হইল। অনেকের কপাল ফিরিল কিন্তু আমার কপাল পুড়িল। সরকারি সার্কুলারের মারপ্যাঁচের কারণে আমি অধ্যক্ষ হইতে রাতারাতি প্রভাষক হইয়া গেলাম। এই কলেজে আমার চাকুরি মাত্র তিনদিন বেশি হইলে অধ্যক্ষ পদ পাইতাম। তিন দিনের জন্য ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা নাই হইয়া গেল। ১৯৮৫ সনের ১ ফেব্রচ্ছারি আমি কলেজ হইতে বিদায় নিয়া নরসিংদী সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করিলাম। অধ্যক্ষ হতে প্রভাষক, কী করুণ পরিণতি। অবশেষে এর ১৮ মাস পর ১৯৮৬ সনের জুলাই মাসে সরকারি চাকুরির গ্লানির অবসান ঘটিল। সরকারি চাকুরির অবসান ঘটিবার পর ১৯৮৬ সনের জুলাই হইতে ১৯৮৯ সনের জুলাই পর্যন্ত আমি আরও দুইটি নতুন বেসরকারি কলেজে অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করি।

॥ দুই ॥

১৯৮৯ সনের আগস্ট মাসে সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব মাদারীপুরের খোয়াজপুরে কলেজ প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়া আমাকে ধরিয়া বসেন। শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা ও উহার বিস্তারে এবং সমাজসেবায় তাহার কোনো তুলনা এ কালে নাই। মেধা ও কর্মদক্ষতা গুণে সমাজে একটু প্রতিষ্ঠা লাভের সঙ্গে সঙ্গে তিনি শিক্ষা বিস্তারের বলিষ্ঠ মনোভাব লইয়া একটি আদর্শ উচ্চ বিদ্যাপীঠ গড়িয়া তুলিবার উদ্যোগ নিয়াছেন। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে তিনি তাঁহার নিজ থানা সদরে অবস্থিত কালকিনি কলেজকে একটি প্রথম শ্রেণির উন্নত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিতে চাহিলেন। কিন্তু তৎকালীন রাজনীতিক প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ তাঁহাকে রাজনীতির অঙ্গনে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী চিন্তা করিয়া এই কাজে অগ্রসর হইতে তীব্র বাধা প্রদান করিলেন। তিনি তাহাতে দমিবার পাত্র ছিলেন না। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি ১৯৮৯ সনে মাদারীপুর সদর থানার খোয়াজপুরে সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ প্রতিষ্ঠা করিলেন। মেধাবী ছাত্রদের থাকা খাওয়া ফ্রি ঘোষণাসহ কলেজে প্রথম দুই বৎসর বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ দানপূর্বক এই ব্যতিক্রমধর্মী কলেজটি গড়িয়া তুলিলেন। বিশাল সুদৃশ্য ভবন নিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা পাইল। এই কলেজ প্রতিষ্ঠার সংকল্প গ্রহণ করিয়াই তিনি আমাকে তাঁহার সন্তানপ্রতিম প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য এমনভাবে ধরিয়া বসিলেন যে, আমি আর না বলিতে পারি নাই। এই কলেজের তিনিই স্রষ্টা। বয়সের ভারে আমি প্রায় রোজই কলেজ ছাড়ি ছাড়ি করিয়াও সহজে ছাড়িতে পারি নাই।
যুব বয়সে সৈয়দ আবুল হোসেন আপন পরিশ্রমে বিপুল বিত্তের অধিকারী হইলেন। সেই টাকা সে অন্যান্য বাঙালির মতো আনন্দ-ফুর্তি করিয়া খরচ করিতে পারিতেন। আবুল হোসেন তাহা করিলেন না। তিনি দেশের কথা ভাবিলেন, শিক্ষার কথা ভাবিলেন। তাই আনন্দ-ফুর্তি নামক ক্ষণিকের মোহকে জলাঞ্জলি দিয়া প্রত্যন্ত গ্রামে গলা-জলে ডোবা বিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিলেন।
বহু গুণের অধিকারী সৈয়দ আবুল হোসেন গৈলা উচ্চবিদ্যালয় হইতে এসএসসি পাশ করিয়া গৌরনদী কলেজে ভর্তি হইয়াছিলেন। আমি তখন গৌরনদী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাড়িতে থাকিতাম। একদিন সৈয়দ আবুল হোসেন আমার কাছে আসিয়া খুব বিনয়ের সহিত বলিল: স্যার, আমি আপনার কাছে একটি আবেদন নিয়া আসিয়াছি। আমি বলিলাম: নির্ভয়ে নিবেদন কর। সে বলিল: আমি আপনার কাছাকছি থাকিতে চাই। আমি ভাড়া বাসায় থাকিতাম। আমার সহিত তাঁহাকে রাখিবার ইচ্ছা থাকিলেও সুযোগ ছিল না। আমার বাসার পাশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অর্ধ-নির্মিত একটি কমিউনিটি সেন্টার ছিল। ঐটি তখনও যে উদ্দেশ্যে নির্মিত হইয়াছিল সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহার হইতেছিল না। আমরা তাঁহাকে সেখানে থাকিবার ব্যবস্থা করিয়া দিলাম। কমিউনিটি সেন্টারটি ছিল আমার বাসা হইতে মাত্র ৫০ গজ দূরে। তিনি আমার কাছাকাছি থাকিবার জন্য অর্ধনির্মিত ভবনটিতে উঠিয়াছিলেন। অধ্যক্ষ হিসাবে আমার বাসায় প্রতিদিন নানা কারণে শিক্ষকগণ আসিতেন। পরিচালনা পরিষদের সদস্যগণও আসিতেন। তাঁহাদের সহিত আবুল হোসেনের প্রায় দেখা হইত। এইভাবে অল্পসময়ের মধ্যে কলেজের শিক্ষক এবং পরিচালনা কমিটির সকলের সাথে আবুল হোসেনের সুসম্পর্ক গড়িয়া উঠিল। আমি তখন বুঝিতে পারি নাই, আবুল হোসেন কেন আমার কাছাকাছি থাকিবার নিবেদন করিয়াছিলেন। এখন বুঝিতে পারি, সেইদিন আবুল হোসেন কেন আমার কাছকাছি থাকিবার আবেদন করিয়াছিলেন।
কমিউনিটি সেন্টারে সৈয়দ আবুল হোসেন একা থাকিতেন। নিজে পাক করিয়া খাইতেন এবং সময় বাঁচাইবার জন্য ভাতের সাথে আলু সিদ্ধ করিতেন। তারপর ভর্তা বানাইয়া খাইতেন। মাঝে মাঝে আমাকে দাওয়াত দিতেন। দুইজনে বসিয়া খাইতাম আলু ভর্তা আর গরম ভাত। আমাকে দাওয়াত করিলে ডিম সিদ্ধ করিতেন। খাইতে খাইতে একদিন সে আমাকে বলিল: স্যার, আপনার কাছে আর একটি নিবেদন আছে। আমি তাহা নিঃসঙ্কোচে প্রকাশ করিতে বলিলাম। সে বলিল: কলেজের শিক্ষকগণ যেন আমাকে স্নেহ করেন এই ব্যাপারে আপনাকে দায়িত্ব লইতে হইবে। আমি মনে মনে হাসিলাম। ইতোমধ্যে সকল শিক্ষক তাঁহার ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া আছেন। ছাত্র হিসেবেও আবুল হোসেন মনোযোগী ও মেধাবী ছিলেন। কোনো অবস্থাতে সময় নষ্ট করিতেন না। ব্যবস্থাপনার শিক্ষক ছিলেন মো. মাকসুদ আলী। তিনি সৈয়দ আবুল হোসেনের আগ্রহ দেখিয়া কমিউনিটি সেন্টারে গিয়া বিনা বেতনে পড়াইতেন। আবুল হোসেন ছিলেন অধ্যয়নমুখী সতত সচেতন একজন তুলনাহীন চরিত্রের অধিকারী আদর্শ ছাত্র। শিক্ষকগণ বলিতেন, সৈয়দ আবুল হোসেন অত্যন্ত মেধাবী, একাগ্র এবং ভদ্র। ইংরেজির শিক্ষক আবদুল খালেক ও হিসাব বিজ্ঞানের শিক্ষক জামিল আহমেদের সহিতও তাহার ভালো সম্পর্ক গড়িয়া উঠিয়াছিল। অন্যান্য শিক্ষকগণও সৈয়দ আবুল হোসেনের খোঁজ খবর নিতেন। ছাত্র হিসাবে গৌরনদী কলেজে তিনি এত ভালো গুণের অধিকারী ছিলেন যে, কেউ তাঁহাকে ভালো না-বাসিয়া পারিতেন না। ইংরেজি শিক্ষক আবদুল খালেক বলিতেন, সৈয়দ আবুল হোসেন ইংরেজির ডিপো। এমন কোনো ইংরেজি ওয়ার্ড নাই, যা সে জানে না।’ আমার শুনিয়া গর্ব হইত। হাজার হউক আমারই ছাত্র।
সেই সময় আবুল হোসেন ষোলো-সতেরো বয়সের কিশোর। রবীন্দ্রনাথ এই বয়সকে বালাই বলিয়াছেন। এই বয়স ছিল দুষ্টুমির বয়স। অন্য ছেলেরা কত দুষ্টুমি করিত, কোলাহল করিত, মিছিল করিত, ঝগড়া করিত। আবুল হোসেনকে আমি কোনোদিন এই সবের কাছাকাছিও যাইতে দেখি নাই। তিনি কলেজের নিয়মকানুন এবং শিক্ষকগণের উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলিতেন। শিক্ষকগণের উপদেশ-নির্দেশ তাঁহার কাছে ছিল অলঙ্ঘনীয়। ঐ বয়সে তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িতেন। ছাত্ররাজনীতির আড়ালে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি সৈয়দ আবুল হোসেন পছন্দ করিতেন না। তিনি বলিতেন, ‘ আগে লেখাপড়া, তারপর অন্য কিছু।’
তাঁহার খাতাপত্র, বই, জামাকাপড় ইত্যাদিতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ছাপ আমাকে মুগ্ধ করিয়া দিত। একা থকিলেও কক্ষটি সবসময় গুছানো থাকিত। জামাকাপড় দামি না-হইলেও, সৈয়দ আবুল হোসেনের শরীরে উঠিলে তাহা দামি হইয়া উঠিত। সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। পঁয়তাল্লিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে অনেক ছাত্রছাত্রী দেখিয়াছি, অনেক মানুষের সাথে পরিচয় ঘটিয়াছে, অনেকের সহিত ঘনিষ্ঠ হইয়াছি, কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো আদর্শ ছাত্র, আদর্শ মানুষ, আদর্শ শ্রোতা আমি আর দ্বিতীয় কাহাকেও পাই নাই। এত সুন্দর, এত মায়া একটি মুখে কীভাবে থাকিতে পারে, তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিতাম না। আল্লাহ তাহাকে দান করেন, যিনি ধারণ করিতে পারেন। সৈয়দ আবুল হোসেন আল্লহর দান ধারণ করিবার ক্ষমতা অর্জন করিয়াছিলেন বলিয়াই আল্লাহ তাঁহাকে দুই হাতে উজাড় করিয়া দিয়াছেন।
তিনি ছিলেন পা হইতে মাথা পর্যন্ত একজন আদর্শ ছাত্র। আবুল হোসেন মাথা নিচু করিয়া রাস্তায় চলাফেরা করিতেন। কলেজের ক্যাম্পাসে বড় গলায় কাহারও সহিত কথা বলিতেন না। কোনোদিন কোনো শিক্ষকের সহিত উঁচু গলায় কথা বলেন নাই। পরিচালনা পরিষদ তাঁহার ব্যবহারে অভিভূত ছিলেন, তাই পুরস্কারস্বরূপ তাঁহার সকল বেতন মওকুফ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। বর্তমানে আবুল হোসেন একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া চলিতেছেন। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি দিতেছেন, পড়াইতেছেন। ইহা দেখিয়া আমি মনে মনে পুলকিত হই এই ভাবিয়া যে, আমার হাত দিয়া তাঁহার বেতন মওকুফ করিয়াছিলাম।
কলেজের সকল ছাত্র-ছাত্রী তাহাকে ভালো জানিত। কলেজ ছাড়িয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইবার পরও তাহার সহিত আমার যোগাযোগ ছিল। ঢাকা হইতে গ্রামে গেলে আমাকে দেখিবার জন্য কলেজে আসিতেন। আমি ইতিহাসের শিক্ষক। আমার কাছে বসিয়া ইতিহাসের নিগূঢ় তথ্য জানিতে চাহিতেন। তখন কে জানিত বাণিজ্যের ছাত্রের ইতিহাসে আগ্রহ থাকিবার পিছনে ইতিহাস সৃষ্টির রহস্য লুকাইয়াছিল। সৈয়দ আবুল হোসেন স্ব-প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ। তাঁহাকে আমি নিজের চোখের সামনে যেভাবে ক্রমশ বড় হইয়া উঠিতে দেখিয়াছি তাহাতে ইহা ছাড়া আর কিছু বলিবার থাকে না।
গৌরনদী কলেজে পড়াকালীন সৈয়দ আবুল হোসেনকে আমি সবকিছুতে ব্যতিক্রম দেখিয়াছি। তিনি কোনোদিন বিড়ি-সিগারেট এমনকি পান পর্যন্ত খাননি। তাহার খাইবার ধরন ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়; দেখিবার মতো। হাতের আঙুলগুলি আস্তে আস্তে নাড়িয়া নাড়িয়া গ্রাস বানাইতেন এবং খুব সুন্দরভাবে মুখে তুলিয়া নিতেন। খাদ্যের কণা প্লেটর আশেপাশে পড়িত না। খাইবার সময় কোনো আওয়াজ হইত না। ধীরেসুস্থে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে খাদ্য গ্রহণ করিতেন। খাওয়া শেষ হইলে সুন্দরভাবে সাবান দিয়া হাতমুখ ধুইয়া আসিতেন। খাওয়া ইবাদতের মতোÑ এ প্রবাদটি আবুল হোসেন তার জীবনে অক্ষরে অক্ষরে প্রয়োগ করিয়াছেন।
॥ তিন ॥
যোগাযোগ মন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করিবার কিছুদিন পর আমি তাঁহাকে ফোন করিয়া বলিলাম: আমার স্বাস্থ্য খারাপ। তোমার সাথে আমি দেখা করিব, বড্ড দেখিতে ইচ্ছা করিতেছে। কখন আসিব? আমার কণ্ঠ পাইয়া তিনি আবেগপ্রবণ হইয়া পড়িলেন। বিনীত কণ্ঠে বলিলেন: ‘স্যার, আমাকে ক্ষমা করিয়া দিবেন। আমার উচিত ছিল শপথ গ্রহণ করিবার পরপরই আপনার পদধূলি লওয়া। আমি তাহা করি নাই। অজুহাতের কোনো সীমাপরিসীমা নাই তাই, কোনো অজুহাত দিব না। অনুগ্রহপূর্বক অনুমতি দিলে আগামী শুক্রবার সকাল দশ ঘটিকায় আপনাকে দেখিবার জন্য বাসায় যাইব।’ শুক্রবার কাঁটায় কাঁটায় ঠিক দশটায় তিনি আমার বাসায় আসিয়া পৌঁছিলেন। আমি সিঁড়ির গোড়ায় তাঁহাকে স্বাগত জানাইবার জন্য দাঁড়াইয়াছিলাম। আমাকে দেখিয়া তিনি এমন বেগে দৌড়াইয়া আসিলেন যেন, কোনো শিশু দীর্ঘ দিন পর তাহার পিতাকে দেখিল। দৌড়াইয়া আমার পায়ের উপর উবু হইয়া পড়িলেন। আমি তাহাকে টানিয়া তুলিলাম। আমার স্ত্রী আসিলেন, তাহাকেও পায়ে ধরিয়া সালাম করিলেন। আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রীর এমন ব্যবহার দেখিয়া শিক্ষক জীবন বাছিয়া লওয়াকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত ভাবিয়া গর্ব ও আনন্দে পুলকিত হইয়া উঠিলাম।
আবুল হোসেন আবেগঘন গলায় বলিলেন: ‘স্যার, আমাকে দোয়া করিবেন।’ আমি তাহার মাথায় হাত বুলাই দিলাম। মনে মনে বলিলাম: আমি তোমাকে দোয়া করি বা না-করি, বাংলাদেশের চৌদ্দ কোটি মানুষের দোয়া তোমার উপর অনবরত বর্ষিত হইতেছে। একালে তোমার মতো দাতা আর কে আছে! যেই লোক একটি মানুষকে শিক্ষিত করিল, তিনি যেন সারা পৃথিবীকে শিক্ষিত করিল। জ্ঞান আলোর মতো নিমিষে ছড়াইয়া পড়ে। একজন নিউটন, একজন আইনস্টাইন সারা বিশ্বের সম্পদ। পৃথিবীর একজন জ্ঞানী লোক তিনি যেইখানে অবস্থান করুক না কেন, তাহার জ্ঞানের আলো সূর্যের মতো গোটা পৃথিবীকে আলোকিত করিয়া রাখে। সৈয়দ আবুল হোসেন কালকিনির লোক কিন্তু সূর্যের মতো সে সারা বিশ্বকে জ্ঞান দিয়া আলোকিত করিবার সংকল্পে উল্কার বেগে ছুটিয়া চলিয়াছে।
ঘরে ঢুকিয়া তিনি আমার পাশে বসিলেন। আমি তাঁহার দিকে তাকাইলাম, সেই আগের ভঙ্গি। যেন এখনও গৌরনদী কলেজের ছাত্র আর আমি অধ্যক্ষ। আমার এক মূহূর্তের জন্যও মনে পড়িল না যে, সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব এখন মন্ত্রী। স্বভাবসুলভ অভিজাত গলায় বলিলেন: আপনি আসার পর হইতে খোয়াজপুর কলেজের অবস্থা ভালো নয়। আমার কলেজটি অভিভাবকহীন হইয়া আপনার জন্য কাঁদিতেছে। আপনি আবার খোয়াজপুর আসেন। আপনাকে কাজ করিতে হইবে না। শুধু অধ্যক্ষ হিসাবে আছেন এমনটি মানিয়া লইলেও আমি খুশি হইব। একজন অধ্যক্ষ যত বেতন পান তার দশগুণ বেশি দিব। আবুল হোসেনের কথা শুনিয়া অনেক দিন আগের একটি কথা মনে পড়িয়া গেল। আবুল হোসেন আমার সম্পর্কে মন্তব্য করিতে গিয়ে এক বৈঠকে বলিয়াছিলেন: তমিজ স্যারকে আমি কলেজে আনিয়াছি। কলেজের জন্য যদি আমি বিশ লক্ষ টাকা খরচ করি তাহা আমার তমিজ স্যারের কাছে তুচ্ছ। আমার তমিজ স্যারের ফেইস ভ্যালু বিশ কোটি টাকার অধিক।
আমার শরীর এখন বিছানা ছাড়িয়া উঠিবার শক্তি পায় না। কথা বলিতে কষ্ট হয়, আওয়াজ অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে রোগ আসিয়া বাসা করিয়াছে। যে কোনো মুহূর্তে মরিয়া যাইতে পারি। তাহার প্রস্তাব গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আবুল হোসেন খোয়াজপুর কলেজের প্রাঙ্গণে আমার কবর এর জায়গা নির্ধারণ করিবার অনুমতি চাহিলেন। আমি কিছু বলতে পারি নাই। তাঁহার শ্রদ্ধা দেখিয়া শুধু স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিলাম। আমার নীরবতা দেখিয়া আবুল হোসেন বলিয়াছিলেন, ‘আমি টাকা দিয়া অনেক প্রতিষ্ঠান বানাইতে পারিব, অনেক দালানকোঠা গড়িতে পারিব কিন্তু আপনার মতো একজন শিক্ষক পাইব না। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিগণিত করিবার জন্য আপনার নামই যথেষ্ট।’
শিক্ষকের মর্যাদা প্রদানে তাঁহার কোনো তুলনা ছিল না। খোয়াজপুরে আবুল হোসেন কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে আমি ঢাকায় যাইয়া তাঁহার কাছ হইতে টাকা নিয়া যাইতাম। একদিন অফিসে যাইয়া দেখি তিনি চলিয়া গিয়াছেন। আমার সাথে কালকিনি উপজেলার গোপালপুরের একজন লোক ছিলেন। তাঁহার নাম এখন মনে পড়িতেছে না। সৈয়দ আবুল হোসেনকে ফোন করা হইলে তিনি ক্যাশিয়ারকে নির্দেশ দিলেন, যেন আমাকে দশ হাজার টাকা দ্রুত দিয়া দেন। ইহা বলিবার পর তিনি ফোন কাটিয়া দিলেন। কিছুক্ষণ পর আবুল হোসেন আবার ফোন করিয়া ক্যাশিয়ারকে বলিয়া দিলেন টাকা প্রদান করিবার প্রমাণস্বরূপ যেন আমার নিকট হইতে কোনো রশিদ গ্রহণ না-করেন। আবুল হোসেন ভাবিয়াছিলেন, রশিদ চাহিলে শিক্ষক হিসাবে আমার প্রতি অসম্মান করা হইবে। কলেজ করিবার জন্য তিনি আমাকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়াছেন। আমি কলেজের বিভিন্ন কাজে তাহা খরচ করিয়াছি। আশ্চর্যের বিষয় তিনি কোনোদিন রশিদ চাহেন নাই। কোনোদিন হিসাবও চাহেন নাই। তিনি জানিতেন, আমি তাঁহার অর্থের তসরূপ কখনও করিব না। আমি আজ বড় আনন্দিত আমার মহান ছাত্র সৈয়দ আবুল হোসেনের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখিতে পারিয়াছি।
১৯৯৪ সালে সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ জাতীয় পুরস্কার লাভ করিল। কলেজের প্রথম ব্যাচে জাহিদ হোসেন (পনির) নামক একজন ছাত্র বোর্ডে ১ম স্থান এবং মনোয়ার হোসেন নামক একজন ছাত্র চতুর্থ স্থান লাভ করিল। কৃতিত্বের জন্য তাহাদিগকে বিশাল সংবর্ধনা দেওয়া হইয়াছিল। ঐ সংবর্ধনা সভায় সৈয়দ আবুল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁহার সন্তানপ্রতীম কলেজের এমন সাফল্য দেখিয়া আনন্দে আত্মহারা হইয়া পড়িয়াছিলেন। এত খুশি তিনি আর কখনও হইয়াছিলেন কি নাÑ আমার জানা নই। তিনি এত উদার যে, সাফল্যের কৃতিত্ব নিজে নিলেন না, বরং তা শিক্ষকদের পদপ্রান্তে তুলিয়া দিলেন। বক্তৃতায় তিনি প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য একটি করে বোনাস ঘোষণা করিলেন আর অধ্যক্ষ হিসেবে আমাকে দিলেন পাঁচটি বোনাস। টাকা বড় বিষয় ছিল না, কিন্তু সেদিন তিনি শিক্ষকদের সম্মানিত করিয়া আরেকবার প্রমাণ করিলেন: আল্লাহ তাহাকেই বড় করেন, যিনি বড় হইবার যোগ্য। বক্তৃতায় সেদিন তিনি আরও বলিয়াছিলেন: এ কৃতিত্ব আপনাদের, আমার নয়।
১৯৬৬ হতে ১৯৮৯ অনেক লম্বা সময়। ১৯৮৯ সন হতে আমি তাঁহার প্রতিষ্ঠিত সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ হই। প্রথম ভাবিয়াছিলাম আমার সেই ছোট্ট ছাত্রটি যদি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রাতারাতি বদলে যান! আমাকে আগের মতো সম্মান না-করেন! আমি বিস্মিত হইয়া দেখিলাম সৈয়দ আবুল হোসেন এখনও আমার ছাত্র যেন। চাকুরিদাতা হিসাবে তাহার কোনো অহংবোধ আমি দেখি নাই। বরং আমার প্রতি আগের চেয়েও বেশি শ্রদ্ধাশীল হইয়া উঠিয়াছেন। এত শ্রদ্ধাবোধ ও কৃতজ্ঞতাবোধ যাহার কাছে আছে, তিনি বড় না-হইলে কে বড় হইবে! আমি প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন তাহাকে আরও বড় করেন।

॥ চার ॥
২০০৩ সনে আমি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ ছাড়িয়া পূর্ণ অবসর গ্রহণ করি। ১৯৫২ হইতে ২০০৩, আমার শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘ পরিক্রমা। শরীর আর চলছিল না। তবু আবুল হোসেন আমাকে ছাড়িতে চাহিলেন না। রাখিয়া দেবেন, আমার লাশও তার কাছে অনেক বড়। তবু চলিয়া আসিলাম। আমি চলিয়া আসিবার পর, অধ্যক্ষের পদটা শূন্য পড়িয়া রহিল। আমার উপর অভিমান করিয়া হউক কিংবা রাজনীতিক বা অন্যবিধ সমস্যার কারণে হউক অধ্যক্ষ নিয়োগ দিবার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হইতেছিল না। ২০১০ সনে সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের শিক্ষকগণের মধ্য হইতে অধ্যক্ষ নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইল। প্রায় সবাই প্রার্থী হইলেন। সৈয়দ আবুল হোসেন ঘোষণা করিলেন: তমিজ স্যার যার নাম বলিবেন তাহাকেই আমি অধ্যক্ষ করিব।
এই ঘোষণার পর আমার বাসায় ভিড় লাগিয়া গেল। সবাই আসিয়া আবুল হোসেনের কাছে রিকমেন্ডশন করিবার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। বুড়ো বয়সে সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে এত বড় দায়িত্ব কেন দিলেন বুঝিতে পারিলাম না। মরিবার পরও তিনি বুঝি আমাকে ছাড়িবেন না। তাই আবুল হোসেন কলেজের সামনে আমাকে কবরস্থ করিতে চাহেন। অধ্যক্ষ নিয়োগের ব্যাপারে আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিবার সংকল্প করিয়া প্রকাশচন্দ্র নাগকে অধ্যক্ষ করিবার অনুরোধ করিলাম। সৈয়দ আবুল হোসেন তাহা করিলেন। দীর্ঘদিন পর কলেজ আবার অধ্যক্ষ পাইল। মরিবার আগে আমার এইটি আর একটি সান্ত্বনা।
সৈয়দ আবুল হোসেন এত বড় হইবার পেছনে অনেকগুলি কারণ আছে। তন্মধ্যে শিক্ষক ও পিতা-মাতার দোয়া অন্যতম বলিয়া আমি মনে করি। তিনি শিক্ষকদিগকে কত শ্রদ্ধা করেন, তাঁহার একটা উদাহরণ দিতেছি। আমার বোনঝি হাসিনা খাতুন ঝুমা একদিন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে দেখা করিতে গেল। মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন তখন গুরুত্বপূর্ণ একটি সভায় পৌরোহিত্য করিতেছিলেন। সচিবসহ অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সভায় ছিলেন। সভায় বসিয়া তিনি জানিতে পারিলেন আমার বোনঝি তাহার সহিত দেখা করিবার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। এই সংবাদ পাইয়া সৈয়দ আবুল হোসেন দেরি করিতে পারিলেন না। ঝুমাকে মিটিঙের ভিতর ডাকিয়া লইয়া গেলেন। সভায় উপস্থিত সদস্যরা হতবাক হইয়া গেলেন। এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহারা আর দেখেন নাই যে সভায় ডাকিয়া কথা বলেন। মন্ত্রী মহোদয় উপস্থিত ব্যক্তিদের মুখে প্রশ্ন দেখিতে পাইয়া আগ্রহ নিরসনকল্পে সবাইকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন: যে আসিয়াছেন সে গুরুত্বপূর্ণ কেউ নহে। তাহাকে আমি চিনি না, তবে সে যাহার নাম বলিয়াছে এবং সে যাহার বোনঝি হিসেবে পরিচয় দিয়াছে তিনি আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক তমিজ উদ্দিন। তাঁহার নাম শুনিলে আমার শরীরের পশম খাড়া হইয়া যায়।”
আবুল হোসেন যেইখানে হাত দিয়াছেন, সেইখানে সোনা ফলিয়াছে। তাহার পরশে খড়কুটোও সোনায় পরিণত হয়। ১৯৯১ সনের নির্বাচনে সে একবার মাত্র এলাকায় গিয়াছিলেন। তাহাতেও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হইয়া সবাইকে তাক লাগাইয়া দিয়াছিলেন। জানি না পৃথিবীতে এমন কোনো ঘটনা আর আছে কিনা। বুড়ো বয়সে খোয়াজপুরের প্রত্যন্ত এলাকার নতুন কলেজের অধ্যক্ষ হইয়াছিলাম। পরিশ্রমের অন্ত ছিল না। তবে সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে সাক্ষাৎ করিলে আমার সব রোগ এবং ক্লান্তি দূর হইয়া যাইত। আমি অনেকবার বিষয়টা লক্ষ্য করিয়াছি। সে যেন আমার মৃতসঞ্জিবনী, যাঁর পরশ পাইলে নিস্তেজ দেহমন উদ্দীপনার আমেজে উদ্বেলিত হইয়া ওঠে। এমন অলৌকিক মানুষ আমার জীবনে আর কোথাও কখনও পাই নাই।
অনেক কর্মপ্রাণ লোক আমি দেখিয়াছি। তাহারা কাজ করিতে করিতে রুক্ষ হইয়া যায়। কাজ করিতে করিতে নিজেরাই যন্ত্র হইয়া যায়। সৈয়দ আবুল হোসেন তেমন ছিলেন না। তিনি কাজ করিতে করিতে আরও প্রফুল্ল হইয়া উঠিতেন। কাজ ছিল তাঁহার প্রাণ। তবে সে প্রাণে ছিল স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, হাসি-কান্না, রস, কৌতুক, বিশ্রাম এবং সুকুমার চিত্ত। ছোট বেলা হইতে দেখিয়াছি জীবন তাঁহার কাছে কাজের সমষ্টি ছাড়া কিছু নয়। কর্মহীন জীবন তাঁহার কাম্য নয়, তাই তিনি কাজকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়া থাকেন। কাজের সাথে আর একটি জিনিসকে তিনি অবিচ্ছেদ্য রাখেন, সেইটি হইল নিষ্ঠা। কর্ম আর নিষ্ঠার মিশ্রণ ঘটাইয়া তিনি এমন এক সরবত তৈয়ার করিয়াছেন, যাহা কেহ পান করিলে সেই পরশপাথর হইয়া যায়। ঐ পরশপাথর যাহারা ধরেন, তাহারা আপন মহিমায় হইয়া ওঠেন সাফল্যের বর, সাধনার নির্ঘণ্ট।
সরকারি চাকুরি হইতে অবসর গ্রহণ করিবার পর আমি বাসায় অলস বসিয়া থাকিতাম। সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে ডাকিয়া নিয়া তাঁহার কলেজের দায়িত্ব দিয়াছিলেন। আমি দায়িত্ব নিলাম। তাঁহার দেওয়া দায়িত্ব আবার আমাকে পূর্ণ উদ্যমে জাগাইয়া তুলিল। আমি কাজ করিতে শুরু করিলাম। আমার কষ্ট হইবে ভাবিয়া ঢাকা হইতে আসা-যাওয়া করিবার জন্য তিনি আমাকে একটি নিশান পেট্রল জিপ দিয়াছিলেন। আমি শুধু দুইবার উহাতে চড়িয়া খোয়াজপুর গিয়াছিলাম। তৃতীয়বার যাইতে ইচ্ছা করে নাই। একবার খোয়াজপুর যাইতে অনেক টাকার তেল খরচ হইত। একজন লোকের জন্য এত টাকার তেল না- পুড়িয়া ঐ টাকা কলেজের উন্নয়নে ব্যয় করাকে আমি শ্রেয় মনে করিয়াছিলাম। তাই আবুল হোসেনের গাড়ি আবুল হোসেনকে ফেরত দিয়াছিলাম।
সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে আমি জাতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসেবে বিরল সম্মানে ভূষিত হইলাম। ইহা ছিল আমার কর্মজীবনের পরম প্রাপ্তি। একজন শিক্ষক এর চেয়ে আর বেশি কিছু চাহে না, চাহিবার থাকে না। সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে ডাকিয়া কলেজের অধ্যক্ষ না-করিলে এই সম্মান পাইতাম না। সংগতকারণে শিক্ষকের পরম প্রাতিষ্ঠানিক প্রাপ্তি হইতে বঞ্চিত থাকিতাম। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলিয়াছিলাম: আবুল হোসেন, তুমি আমার জন্য অনেক করিয়াছ। আবুল হোসেন আমার কথা শুনিয়া যাহা বলিয়ছিলেন তাহা শুনিয়া গর্বে আমার বুক সাফলের আনন্দে ভরিয়া উঠিয়াছিল। তিনি বলিয়াছেন:

গুরু যদি এক বর্ণ শিষ্যরে শিখায় কোনদিন,
পৃথিবীতে নেই দ্রব্য যা দিয়ে শোধ দিবে ঋণ।

কবি বলিয়াছেন, সেই ধন্য নরকুলে, মরণের পরেও যারে লোকে নাহি ভুলে। সৈয়দ আবুল হোসেন এমন একজন মানুষ যাহাকে ভুলিয়া যাইবার সকল পথ তিনি রুদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। বাংলাদেশ যতদিন থাকিবে ততদিন সৈয়দ আবুল হোসেন থাকিবে। তিনি বাঁচিয়া থাকিবেন, তাঁহার প্রতিষ্ঠানের মাঝে, তাঁহার লেখার মাঝে, তাঁহার কাজের মাঝে, তাঁহার বাণীর মাঝে, তাঁহার প্রতিষ্ঠান হইতে যাহারা জ্ঞান অর্জন করিয়াছেন এবং ভবিষ্যতে করিবেনÑ তাঁহাদের মাঝে।
তিনি প্রকৃতই ধন্য। আমার তাঁহার প্রতি ঈর্ষা হয়, কারণ তিনি গুরুর চেয়ে অনেক বড় হইয়াছেন। এই ঈর্ষাই আমার শিক্ষক জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব, সবচেয়ে বড় পাওয়া। জানি না, পৃথিবীর ইতিহাসে কয়জন শিক্ষক সক্রেটিস হইবার জন্য আলেকজান্ডার পাইয়াছেন, তবে আমি পাইয়াছি। আমি সক্রেটিস না হইতে পারি, আমার ছাত্র সৈয়দ আবুল হোসেন আমার জন্য বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার।

অধ্যক্ষ মো. তমিজ উদ্দিন : সৈয়দ আবুল হোসেনের কলেজ জীবনের শিক্ষক, ছয়টি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, ইতিহাসবেত্তা, শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসেবে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত, লেখক ও গবেষক

সৈয়দ আবুল হোসেন, পদ্মা সেতু ও বিশ্বব্যাংক
মোবেশ্বের হোসেন
সৈয়দ আবুল হোসেন ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন পাসপোর্ট সংক্রান্ত একটি অন্যায় বিতর্কের কারণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পদত্যাগ করেছিলেন। অন্যায্য বলছি এ জন্য, যে কারণে তাঁর পদত্যাগ সেজন্য তিনি মোটেও দায়ি ছিলেন না। তাঁর একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তার ভুলের কারণে পত্রপত্রিকায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রতিবেদন ছাপা হয়। তিনি পদত্যাগ না করে স্বপদে বহাল থাকতে পারতেন। অনেকে এর চেয়ে জঘন্য কাজ করেও নির্বিকার থাকেন। কিন্তু আত্মসম্মানে আঘাত লাগায় সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করে নিজের নির্লোভ দৃষ্টিভঙ্গী ও সৎ মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে এমন আর কেউ কী করেছেন? অনেকে প্রশ্ন করেন তাহলে, সেবারের মত এবারও তিনি পদত্যাগ করছেন না কেন? এবার তো পত্রপত্রিকায় আরও বেশি লেখা হচ্ছে। 
এর দু’টি কারণ উল্লেখ করা যায়। প্রথমটি, গতবার তিনি ভুল না করলেও তাঁর ব্যক্তিগত এক কর্মচারী ভুল করেছিলেন। ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে দায়টা বদান্যতাস্বরূপ নিজের উপর নিয়েছিলেন। সে সময় তিনি নিজের অসামান্য বিবেচনাপ্রসূত সৌকর্যকে সমুজ্জ্বল রাখার স্বার্থে ব্যক্তিত্ব ও সততার প্রতিভূ হিসেবে পদত্যাগ করেছিলেন। এবার ঘটনা অন্যরকম। এবার তিনি বা তাঁর কোন ব্যক্তিগত কর্মচারী কোন ভুল করেননি, অন্যায় করেননি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পদ্মা সেতু সংক্রান্ত কোন দুর্নীতির সাথে তিনি বা তার কর্মচারীরা কেউ জড়িত নন। সৎ বা স্বচ্ছতার অধিকারী কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেনি। বিশ্বব্যাংক, যেটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও মানবতাবিরোধি মুনাফাখোর হিসেবে কুখ্যাত সেরূপ একটি প্রতিষ্ঠান মিথ্যা অভিযোগ আনয়ন করেছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে যে প্রতিষ্ঠানটি আগাগোড়া দুর্নীতি দিয়ে মোড়া। এ বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা, ঋণপ্রদান, উদ্দেশ্য সব পাশবিক আচরণ এবং নিষ্ঠুর স্বার্থ দ্বারা চালিত। বিশ্বব্যাংক এ পর্যন্ত যতগুলো উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড উন্নয়নশীল বিশ্বে নিয়েছে তার কোনটি ফলপ্রসু হয়নি। পরবর্তীকালে সেগুলো ঐ দেশের বোঝা এবং ধ্বংসকারী প্রতিভাত হয়েছে। আফ্রিকার দিকে তাকালে, বাংলাদেশের পাটের দিকে তাকালে এটি সহজে অনুমেয়। বিশ্বব্যাংক কী কৌশলে বাংলাদেশের পাট শিল্পকে ধ্বংস করে পলিথিন সংস্কারের প্রবর্তন ঘটালো! 
অধিকন্তু গতবার সৈয়দ আবুল হোসেন স্বচ্ছতা, ঔদার্য্য, মহত্ত্ব, স্বকীয় মূল্যবোধ এবং উচ্চমার্গের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে পদত্যাগ করলেও সেটি যথাযথভাবে বিবেচিত হয়নি। পদত্যাগকে কেউ প্রশংসার চোখ দেখেনি। কিছু পত্রিকায় পদত্যাগের অন্তর্নিহিত মননশীলতাকে অবমূল্যায়ন করেছে। তার অনিমেষ অভিলাষকে প্রশংসার পরিবর্তে উপহাস করা হয়েছে। এবার ভুল বা দোষ না করে পদত্যাগ করলে আরও বেশি উপহাস করা হতো। বলা হতোÑ দোষ না করলে পদত্যাগ করলেন কেন? দোষ না করে শাস্তি মেনে নেয়া পক্ষান্তরে অপরাধকে স্বীকার করার নামান্তর। ক্রীতদাসের মত এমন আচরণ একজন ব্যক্তিত্বশীল মানুষের কাছে কাম্য নয়। সৈয়দ আবুল হোসেনের মত একজন দৃঢ়চিত্তের আদর্শ মানুষ এমন পলায়নপর মানসিকতা প্রকাশ করে জাতিকে ছোট করে দিতে পারেন না। পদত্যাগের মত সামান্য ঘটনাও তার পক্ষ থেকে ঘটলে তিনি অবশ্যই পদত্যাগ করতেন। এ ব্যাপারে তার অতীত অকাট্য প্রমাণের বাহক।
অনেকে বলেন, উন্নত দেশে এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কারণে ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করা হয়। পূর্বেই বলেছি, সৈয়দ আবুল হোসেনের এমন দায় মাথায় নেয়া উচিত নয়, যার জন্য তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবে দায়ি নন। অন্যদিকে যে সকল দেশে এমন পদত্যাগের ঘটনা ঘটে সে সকল দেশে পদত্যাগকে সপ্রংশস দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা হয়। সে দেশে বিশ্বব্যাংক প্রভু নয়, ভৃত্য। সে সকল দেশে বিশ্বব্যাংক বড় জোর একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কিংবা অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া কিছু নয়। সেখানে বিশ্বব্যাংক দেশের সার্বভৌম শক্তির প্রতি অসম্মান দেখানো দূরে থাক, অনুরূপ প্রয়াসের সাহসও রাখে না। সে সকল দেশে পদত্যাগকারীকে সাহস আর নির্লোভমানসিকতার জন্য বাহবা দেয়া হয়, অভিনন্দন জানানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটে উল্টো। ঘটনা যাই হোক, আত্মযাতনার কারণে পদত্যাগ করলেও উপহাসস্বরূপ দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে মর্মে আকাশ-বাতাস চিৎকারে চিৎকারে একাকার করে দেয়া হয়। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা যে দেশের সংস্কৃতি সে দেশে ভালো মানুষের ভালো দিকগুলো বিকশিত হবার জন্য বিপ্লবের গত্যন্তর নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মোবাইল আর মেইল নাম্বার জনসমক্ষে প্রচার করে যে সাহস ও মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা পৃথিবীতে বিরল। অথচ বিএনপি’র একজন নেতা এবং গুটি কয়েক ভাঁড়মার্কা বুদ্ধিজীবী এটাকে প্রতারণা এবং জনগণের সাথে উপহাস আখ্যায়িত করেছেন। যিনি এমন বলেছেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন, আবার পিএইচডি ডিগ্রিধারী ডক্টর। তার মত একজন লোকের ঠোট-জিহ্বা যদি এমন বেহায়া শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন তাহলে অন্যদের ক্ষেত্রে কী হতে পারে বলাই বাহুল্য। যে দেশে ক্ষমাকে দুর্বলতা, মহত্ত্বকে ভয়কাতুরে হিসেবে উপহাস করা হয় সে দেশে উদারতা আর মহত্ত্ব কীভাবে আলোড়িত হবে? বিস্তৃত হবে? এ মুহূর্তে যদি সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন তাহলে ড. নেতার মতো অনেক বুদ্ধিজীবী বলা শুরু করবেনÑ দুর্নীতি না করলে পদত্যাগ করলেন কেন? সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করবেন না। কারণ তিনি কোন অন্যায় করেননি। অন্তত বিশ্বব্যাংকের মত একটি নীতি বিবর্জিত প্রতিষ্ঠানের দাবিতে।
বিশ্বব্যাংক যে নীতি বিবর্জিত প্রতিষ্ঠান তা কমবেশি সবার জানা। কেউ স্বীকার করেন, কেউ করেন না। উন্নয়নশীল বিশ্বের যে সকল দেশ এক সময় খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল; বিশেষ করে আফ্রিকা অঞ্চলের অনেকগুলো দেশকে বিশ্বব্যাংক ফতুর করে দিয়েছে। এক হিসেবে দেখা যায়, বিশ্বব্যাংক যে ঋণ দেয় তার ১৫- ২০ ভাগ দুর্নীতির আড়ালে হারিয়ে যায়। বিশ্বব্যাংক এটি জানে তবু ঋণ দেয় এবং বাতিল করে না। যে কারণে পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল করা হল তা মোট প্রকল্প ব্যয়ের তিন শতাংশের দশ শতাংশ বলে বিশ্বব্যাংকের দাবি। তাও আবার দুর্নীতি হয়নি; হবার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। দাবির পক্ষেও কোন জোরালো যুক্তি নেই। এমন অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের চেয়ে আর জঘন্য দুর্নীতি কী হতে পারে! যার মধ্যে বিবেচনা বোধ নেই সে কখনও ভালো হতে পারে না। যে ভালো নয় সে কখনও যথার্থ বক্তব্য উপস্থাপন করার যোগ্যতা রাখে না।
সৈয়দ আবুল হোসেন তিন বছর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তার সময়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে যতগুলো প্রকল্প পাশ হয়েছে বিগত একশ বছরেও কিংবা আগামী পঞ্চাশ বছরেও প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে পরিমাণ ও গুণগত বিবেচনায় অনুরূপ সংখ্যক প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। এমনটি সম্ভব হয়েছে কেবল সৈয়দ আবুল হোসেনের কঠোর শ্রম, আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব, আন্তরিক নিষ্ঠা, অমানুষিক শ্রম, লৌহকঠিন সততা আর বিচক্ষণতার কারণে। তিনি বাংলাদেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেনÑ পারতেনও যদি তার চেতনায় আমরা ঋদ্ধ হতাম। তিনি সকাল আটটার মধ্যে অফিসে চলে যেতেন। এখনও যান। বাংলাদেশের অন্য কোন মন্ত্রী তাঁর আগে অফিসে যান না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীগণকে সকাল নয়টার আগে প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দেয়ার মাধ্যমে দিনের কাজ শুরু করেন। 
অনেক মন্ত্রী দিনের অধিকাংশ সময় কর্মসূচি নির্ধারণে ব্যস্ত থাকেন। তিনি কর্মসূচি নয়, কর্ম নিয়ে অধিক ব্যস্ত থাকতেন এবং এখনও আছেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে প্রতি বছর সহস্র কোটি টাকার কাজ হয় কিন্তু কোন ঠিকাদার বলতে পারবেন না সৈয়দ আবুল হোসেন কখনও এ সব প্রকল্প বাস্তবায়নে সামান্য নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেছেন, কোন অনৈতিক সুবিধা দাবি করেছেন। তিনি ব্যবসা করে বড় হয়েছেন, কখনও অনৈতিক কোন সুবিধা আদায় করেননি।
বিশ্বব্যাংকের মত দুনিয়া কাঁপানো একটি দৈত্য, বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বিরোধি দল, বুদ্ধিজীবী সবাই আবুল হোসেনের উপর খড়গহস্ত। তাদের সম্মিলিত দাবি পদ্মা সেতু নিয়ে কথিত দুর্নীতির সাথে সৈয়দ আবুল হোসেন জড়িত এবং এ জন্য তার শাস্তি দাবি করে আসছে। দাবিতে দাবিতে গলায় রক্ত এনে ফেললেও কোন প্রমাণ কেউ হাজির করতে পারছে না। প্রথম আলো তো পারলে সৈয়দ আবুল হোসেনকে খেয়ে ফেলে। এ পত্রিকার লেখা দেখে মনে হয় সৈয়দ আবুল হোসেন ছাড়া আর কোন কিছু তাদের নেই। এ পত্রিকার অপর নাম প্রথম আলু। পত্রিকাটি নিয়ে জনৈক লুৎফুর বলেছিলেন: আমার নাম লুৎফুর, এটি প্রথম আলো পত্রিকায় দেখার পর সন্দেহ হল, সত্যি আমার নাম লুৎফুর কিনা। এমন পত্রিকায় লেখা হলে জনগণ ভূতের গল্পের মত পড়ে কিন্তু বিশ্বাস করে না।
প্রকৃতপক্ষে সৈয়দ আবুল হোসেন যদি এ বিষয়ে সামান্য দুর্নীতি করতেন তাহলে এতগুলো অপ্রতিরোধ্য শক্তির কাছে তিনি কি টিকতে পারতেন? সবাই বলছে দুর্নীতি হয়েছে কিন্তু কেউ দেখাতে পারছে না। সবার টার্গেট সৈয়দ আবুল হোসেন। অযথা কেন একজন মানুষের উপর এমন দোষারোপ? এটি কী দুর্নীতি নয়? এত কিছুর পরও কেউ দুর্নীতির সামান্যতম প্রমাণও হাজির করতে পারছে না। এর অর্থ পদ্মা সেতু নিয়ে কোন দুর্নীতি হয়নি। হয়েছে মিথ্যাচার- যা করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক, পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে যেভাবে উঠে-পড়ে লেগেছে সামান্য দুর্নীতির আভাস পেলেও তাঁর অস্তিত্ব থাকত না। কিন্তু তার বিরুদ্ধে শুধু একটি অভিযোগÑ পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে। তাও আবার ভূয়া, কাল্পনিক। পাঠক, জন্মের পূর্বে জীবনধারণ কীভাবে সম্ভব? সৈয়দ আবুল হোসেন দুর্নীতি করলে সরকার অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত। ব্যক্তি বিশেষের জন্য সরকার দায় নিতে যাবে কেন? সৈয়দ আবুল হোসেন এমন প্রভাবশালীও নন যে, প্রধানমন্ত্রী তার দায় নেবেন। বস্তুত তিনি কোন অন্যায় করেননি, তার কোন দুর্নীতির প্রমাণ পাননি বলে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং সরকার সাহসী গলায় বলতে পারছেনÑ পদ্মা সেতু নির্মাণে কোন দুর্নীতি হয়নি।
তবু তার বিরুদ্ধে এত লেখালেখি কেন? এর বহুবিধ কারণ রয়েছে। অনেকে যোগাযোগ মন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে তার মন্ত্রীত্বে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হোক এটি অনেক রাঘব বোয়াল আন্তঃরাজনীতির কারণে মেনে নিতে পারেননি। তারা শুরু থেকে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেন, যাতে যুক্ত তাদের অনুসারী কিছু মিডিয়া। একটি প্রভাবশালী মিডিয়া কিছু জমি বরাদ্দের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। সৈয়দ সাহেব এক বাক্যে না করে দিয়েছিলেন। এমন আরও অনেক ঘটনা আছে। যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তার বিরুদ্ধে কোটি টাকা খরচ করে মন্ত্রীর কক্ষ নির্মাণের অভিযোগ আনা হয়। অথচ কক্ষটি নির্মাণ নয়, মেরামত করা হয়েছিল। সেটি যোগাযোগ মন্ত্রণালয় নয়; করেছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং খরচ হয়েছে মাত্র সাত লক্ষ টাকা। অভিযোগ করা হয়েছে তিনি কোটি টাকার গাড়ি কিনেছেন, অথচ কোন গাড়িই কেনা হয়নি। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র মন্ত্রী যিনি একদিনের জন্যও সরকারি গাড়িতে চড়েননি। তারপরও যদি এমন মিথ্যা খবর ছাপা হয় তো সংবাদপত্রের গ্রহণযোগ্যতা কীভাবে থাকে! ভূতের গল্প যেমন মানুষ পরম আগ্রহে পড়ে কিন্তু বিশ্বাস করে না তেমনি কিছু পত্রিকার অবস্থাও অনেকটা সেরূপ হয়ে পড়েছে। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র মন্ত্রী যিনি গত সাড়ে তিন বছরে মাত্র এক বার সরকারি খরচে বিদেশ গিয়েছেন। তাও ডেলিগেশনের নেতা হিসেবে।
সৈয়দ আবুল হোসেন নিজের রক্তক্ষয় করা অর্থ দিয়ে কেনা গাড়িতে চড়ে অফিস করেন। পত্রিকা প্রতিবেদন ছাপায়Ñ তিনি কোটি কোটি টাকা গাড়ি ক্রয়ে ব্যয় করেছেন। মন্ত্রীর কথা বাদ দিলাম, অনেক অফিসারও একাধিক গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ান; স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন। সৈয়দ আবুল হোসেন কিংবা তার পরিবারের কোন সদস্য কখনও একদিনের জন্যও সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেননি। বিদেশ ভ্রমণে অনেকে কাড়ি কাড়ি সরকারি অর্থ ব্যয় করেন। সৈয়দ আবুল হোসেন রাষ্ট্রীয় কাজেও নিজের অর্থ খরচ করে বিদেশ যান। গ্রামের বাড়িতে তিনি একটি রেস্ট হাউজ করেছেন। এটি নিয়েও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। কিন্তু কেন তিনি ঐ রেস্ট হাউজটি করেছেন সে বিষয়ে কেউ লিখেননি। লেখেননি তিনি এলাকার উন্নয়নের জন্য কত অবদান রেখেছেন, লেখেননি শিক্ষাবিস্তারে তাঁর অবদান কত অনবদ্য। যে এলাকায় তিনি রেস্ট হাউজটি করেছেন সেখানে শেখ হাসিনা একাডেমী এন্ড উইমেন্স কলেজ, সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এন্ড কলেজ ছাড়াও আরও অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তদন্ত কেন্দ্র তিনি করেছেন। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের বহু লোক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দেখার জন্য আসেন। খ্যাতিমান কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়াও আরও অনেক লোক এখানে এসেছেন, প্রতিদিন আসছেন। তাদের জন্য এমন একটি রেস্ট হাউজ প্রয়োজন। অধিকন্তু তিনি নিজের অর্থ ব্যয় করে এ রেস্ট হাউজ করেছেন। কোন সরকারি অর্থ ব্যয়ে নয়। প্রতিটি অর্থের বিপরীতে সরকারি কোষাগারে আয়কর দিয়েছেন। তাকে নিয়ে লেখালেখি যতই হোক- বিশ্বব্যাংকের কাল্পনিক অভিযোগ ছাড়া তার বিরুদ্ধে কেউ কখনও দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেননি। এমনকি তার শত্র“রাও। পুরো পৃথিবীর মানুষও যদি বলেন পৃথিবী চ্যাপ্টা তবু পৃথিবী গোল।
বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে কিন্তু একটা পয়সাও দেয়নি। অর্থ ছাড় করার আগে কীভাবে দুর্নীতি হয়! ধরে নিলাম পরবর্তীকালে প্রদেয় শর্তে দুর্নীতি করা হয়েছে। কিন্তু কখন এবং কার সাথে? এ বিষয়ে কোন তথ্য কিন্তু বিশ্বব্যাংক এত তোড়জোর হাঁকালেও বলতে পারেনি। যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। কিন্তু কেন দেখতে পারেন না সে বিষয়টি অনেকে বুঝেও বুঝতে চান না। বিরোধী দল এবং গুটিকয়েক মধ্যরাতের কথাজীবী সরকারের কাছে একটি দাবি তুলেছেন। সেটি হলÑ বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের যে তালিকা দিয়েছে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা। তাদের এ দাবি শুনে হাসি পায়। যে বিশ্বব্যাংক সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছে সে বিশ্বব্যাংক নিজেই তো দুর্নীতির তালিকা প্রকাশ করতে পারে। সরকারের কাছে দাবি করতে হবে কেন? বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির জন্য চুক্তি বাতিল করেছে, সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরে যাবার দাবি তুলেছে সে বিশ্বব্যাংকের হাতে যদি অমন কিছু থাকত সেটি কী প্রকাশ করতো না! আসলে বিশ্বব্যাংকের দাবি কাল্পনিক, মিথ্যা। বিশ্বব্যাংকের দাবি সরকার প্রকাশ না করলে তারা করতে পারে না। সার্বভৌম দেশের প্রতি সম্মানÑ আহ! কী হাস্যকর। তথাকথিত কয়েকজনের দুর্নীতির জন্য যে বিশ্বব্যাংক ষোল কোটি মানুষের স্বপ্ন গুড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেনি তার আবার বিবেচনা বোধ! এমন সাংঘর্ষিক বাণী আদিমকালের গুহাবাসীদের গ্রন্থেও দেখা যায় না!
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে কানাডাভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে অবৈধ অর্থ দাবি করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক প্রথমদিকে সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রাক্তন প্রতিষ্ঠান সাকোর কোন এক কর্মকর্তার জড়িত থাকার ধুয়া তুলে যথাসময়ে তার নাম প্রকাশের দাবিও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। এখন বলা হচ্ছে কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তার ডায়েরিতে কিছু সাংকেতিক নাম পাওয়া গিয়েছে। কারও খাতায় সাংকেতিক নাম পাওয়া যদি দুর্নীতি প্রমাণের বাহন হয় তাহলে যে-কেউ যে-কাউকে দুর্নীতিবাজ বানিয়ে নিতে পারে। তর্কের খাতিরে পরামর্শক নিয়োগে কোন দুর্নীতি কিংবা ঘুষ আদান-প্রদানের কথিত দাবি সত্য বলে ধরে নেয়া হলেও এর সাথে সৈয়দ আবুল হোসেনের জড়িত থাকার কোন হেতু নেই। 
কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি জানে, পরামর্শক নিয়োগে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই। পরামর্শক কমিটিতে সৈয়দ আবুল হোসেন প্রভাাবিত করতে পারেন এমন কোন ব্যক্তি ছিলেন না। বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনায় আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল (কমিটি) গঠন করা হয়। প্যানেলের দশজন বিশেষজ্ঞের মধ্যে তিনজন জাপানি, একজন হল্যান্ডের, একজন নরওয়ের এবং বাকি পাঁচজন ছিলেন বাংলাদেশি। ডিজাইন পরামর্শক সংস্থা যে প্রতিবেদনগুলো জমা দিয়েছিল তা পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞ প্যানেল তাঁদের মতামত দিয়েছিল। এ মতামতের ভিত্তিতে পদ্মা সেতুর ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয়। পরবর্তীকালে প্রাকযোগ্যতা নির্ধারণের জন্য সরকার আর একটি কমিটি করে। যার সুপারিশ বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা অনুমোদন করে। সুতরাং এখানে এটি নিশ্চিত যে, পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের ব্যাপারে যোগাযোগ মন্ত্রী কিংবা মন্ত্রণালয়ের প্রভাব বিস্তারের কোন সুযোগ ছিল না।
বিশ্বব্যাংক পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন করার পর হঠাৎ দুর্নীতির কথা তুলে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর প্রত্যাশাকে ধুলিস্যাৎ করে দেয়। এর কারণ হচ্ছেÑ বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে পরামর্শক কমিটির সুদৃঢ় অবস্থান। বিশ্বব্যাংক একটি ভুইফোঁড় চায়না কোম্পানিকে প্রাকযোগ্য ঘোষণার জন্য অবৈধ ও অনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করে আসছিল। চায়না কোম্পানিটি প্রাক-যোগ্য বিবেচিত না হওয়ায় বিশ্বব্যাংক ক্ষেপে যায়। কোম্পানিটিকে প্রাক-যোগ্য করার জন্য সরকারের উপর প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করে। বিশ্বব্যাংক সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথেও এ প্রসঙ্গে আলাপ করে। সৈয়দ আবুল হোসেন সাফ জানিয়ে দেন- এ বিষয়ে তার কোন কিছু করার নেই। কমিটিই সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্বব্যাংকের অনৈতিক দাবি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তারপরও বিশ্বব্যাংক অনৈতিকভাবে অযোগ্য বিবেচিত চায়না কোম্পানিটিকে প্রাকযোগ্য করার জন্য সরকার ও কমিটির উপর চাপ দিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু পরামর্শক নির্বাচন কমিটি বার বার যাচাই করেও চায়না কোম্পানিটিকে যোগ্য করার কোন হেতু খুঁজে পাননি। বরং প্রমাণিত হয় যে, কোম্পানিটি ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ ও জাল কাগজপত্র দিয়ে প্রাকযোগ্য হতে চাইছে। একটি ভুয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের ওকালতি এবং তা সরকার কর্তৃক দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যানের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের কথিত দুর্নীতির দাবি যে সারবত্তাহীন তা সহজে অনুমেয়। মূলত বিশ্বব্যাংক নিজে ঐ কোম্পানিটি দ্বারা লাভবান হবার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে। 
মূলত বিশ্বব্যাংক নিজেই প্রাক-অযোগ্য ঘোষিত অনভিজ্ঞ ও জাল সনদধারী চায়না প্রতিষ্ঠানটিকে অনৈতিকভাবে প্রাকযোগ্য ঘোষণার জন্য সরকার ও কমিটিকে চাপ প্রয়োগ করে নিজেই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে। সরকার বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির কাছে মাথা নত না করায়, সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্বব্যাংকের অনৈতিক দাবির অনুকূলে সাড়া দিতে অপরগতা প্রকাশ করায় তারা ক্ষেপে যায়। দরিদ্র দেশগুলোর উপর বিশ্বব্যাংকের এমন অনৈতিক চাপ কোন নতুন বিষয় নয়। গরিবের বৌ সবার ভাবী প্রবাদের ন্যায় সুযোগ পেলে ঠোকা মারে। ঠোকায় প্রভাবশালী বিশ্বব্যাংকের অনৈতিক কার্যকে আমলে না নিয়ে গরিবের বউটাকে সবাই দুষে। বিশ্বব্যাংক কত দুর্নীতিবাজ, এর অভ্যন্তরে কত দুর্নীতি হয় তা ফোর্বস ম্যাগাজিনে একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন একটি পত্রিকায় ‘ব্যক্তির দায় প্রজাতন্ত্র বইবে কেন’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন দেখলাম। তাতে কী আছে পড়িনি। শিরোনামেই লেখকের দূরদর্শিতার অভাব দেখে কষ্ট পেলাম। প্রজাতন্ত্রের প্রধান কর্তব্য প্রজাকে রক্ষা করে। কোন প্রজা যাতে অন্যায়-অবিচার কিংবা প্রভাবশালী কারও হেনস্তার শিকার না হন সে দায়িত্ব প্রজাতন্ত্রের। যে প্রজাতন্ত্র ব্যক্তিকে রক্ষা করতে পারবে না সে কীভাবে রাষ্ট্রকে রক্ষা করবে? অত্যন্ত গৌরবের সাথে বলতে পারি, বর্তমান সরকার বিশ্বব্যাংকের অন্যায় আব্দার আর আচরণের বিরুদ্ধে প্রবল সাহসে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছে। একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বব্যাংকের চেয়ে বড় শক্তিকে প্রতিহত করে এ দেশ স্বাধীন করেছে। সৈয়দ আবুল হোসেনের মত একজন নিরিহ, সৎ ও সজ্জন ব্যক্তিকে বিশ্বব্যাংক নামীয় প্রতিষ্ঠানের হিংস্র থাবা থেকে রক্ষা করতে না পারলে সার্বভৌমত্ব অর্থহীন হয়ে যায়। অনেকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের পদ্মাসেতু হতে সরে যাবার সিদ্ধান্ত একটি দুর্যোগ। তা বটে- কিন্তু দুর্যোগ ছাড়া সুযোগ সৃষ্টি হয় না। একাত্তরে পাকিস্তানিরা অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে দুর্যোগ সৃষ্টি করেছিল বলেই স্বাধীনতার সুযোগ এসেছে। আমরা ঐকবদ্ধ হবার প্রেরণা পেয়েছি। বিশ্বব্যাংকের জুলুম আমাদের আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাপানের মত, সিঙ্গাপুরের মত, মালয়েশিয়ার মত আর্থিকভাবে সার্বভৌম হবার প্রেরণা দেবে। সেদিন সৈয়দ আবুল হোসেনই হবেন বাংলাদেশের লি কুয়ান ইয়ো।
বিশ্বব্যাংক প্রথমে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরকারকে দুর্বল করে অযোগ্য প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাকযোগ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু সরকার তা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করায় বিশ্বব্যাংক সৈয়দ আবুল হোসেনের উপর প্রচণ্ড ক্ষেপে যায়। তারপরও বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতময় দাবির প্রতি অনুকূল সাড়া না দেয়ায় সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কাল্পনিক অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। বিশ্বব্যাংকের সাথে তাল মেলায় তাদের অনুগৃহীত কিছু পত্রিকা এবং সাথে যুক্ত হয় সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রী করার বিপক্ষে অবস্থানকারী কিছু রাঘব বোয়াল। পত্রিকায় বিভিন্নভাবে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও মনগড়া প্রতিবেদন ছাপানো হয়। বিশ্বব্যাংক জানায়, সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে থাকলে পদ্মা সেতুর ঋণ প্রদান করা হবে না। দেশের স্বার্থে সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরে গেলেন। তারপরও বিশ্বব্যাংক ঋণ দিল না। এতে কী বুঝা যায়? এতে বুঝা যায় বিশ্বব্যাংক সামন্তপ্রভু কিংবা সন্ত্রাসীর ন্যায় চাঁদা আদায় হতে বঞ্চিত হয়ে ক্ষেপে গেছে। চায়না কোম্পানির নিকট থেকে প্রতিশ্র“ত সুবিধা পেতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষুধার্ত কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ শুরু করে। চোরের মায়ের বড় গলার মত কাল্পনিক দুর্নীতির তদন্ত করার দাবি জোরদার করে। সরকার কোন দুর্নীতি হয়নি জানা সত্ত্বেও আর্থিক কারণে বিশ্বব্যাংকের অন্যায্য দাবির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। দুদক তদন্ত শুরু করে। তদন্ত করে কোন কিছু পাওয়া যায়নি। সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ায় আরও ক্ষেপে যায় বিশ্বব্যাংক। তারপরও সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতি হিংস্র থাবা বাড়িয়ে রাখে। বিভিন্নভাবে তাকে হয়রানি করার চেষ্টা করা হয়। দেশীয় কয়েকটি পত্রিকার মাধ্যমে এটি আরও বিকট করে তোলা হয়। অবশেষে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে তাদের প্রতিশ্র“ত অর্থ প্রদান সংক্রান্ত চুক্তি বাতিল করে দেয়।
বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল বিশ্বের দুর্বল অবস্থানের কথা জানলেও সৈয়দ আবুল হোসেনের নৈতিক উচ্চতর বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। নইলে কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠানের কাছে ঘুষ দাবির বিষয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের সংশ্লিষ্টতার কথা কখনও তুলতেন না। শিশির বিন্দুর কাছ থেকে যেমন সমুদ্র জল প্রত্যাশী নয় তেমনি কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকেও সৈয়দ আবুল হোসেন অর্থপ্রত্যাশী হতে পারে না। সৈয়দ আবুল হোসেনের নিকট কল্পিত দুর্নীতির বর্ণিত ১০ ভাগ অর্থ সমুদ্রের কাছে শিশির বিন্দুর ন্যায়। এটি সৈয়দ আবুল হোসেন এবং তার কর্মকাণ্ডের প্রতি যারা পরিচিত তারা সহজে অনুধাবন করতে পারবেন। তিল তিল করে তিনি সততার মাধ্যমে ব্যবসা করে নিজেকে এ অবস্থানে এনেছেন। মানুষ অর্জিত আয় আমোদ-ফূর্তি ও আয় বর্ধনের কাজে লাগায়। সৈয়দ আবুল হোসেন অর্জিত অর্থ জনগণের কল্যাণে, শিক্ষাবিস্তারে ব্যয় করেছেন। একজন সম্পদশালী লোকের যে বদভ্যাস সাধারণত দেখা যায় তার কোনটি সৈয়দ আবুল হোসেনের নেই। 
ব্যক্তিগত অর্থ ব্যয়ে তিনি ৫টি কলেজ, ৭টি উচ্চ বিদ্যালয়, ১৩৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। সহায়তা করেছেন অসংখ্য রাস্তা-ঘাট, ক্লাব, সমাজকল্যাণমূলক সংগঠন, মাদ্রাসা, মক্তব, মসজিদ ও মন্দির প্রতিষ্ঠায়। গ্রামাঞ্চলের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের নাম ‘কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’। প্রত্যন্ত এলাকায় নারীশিক্ষার জন্য তিনি গড়ে তুলেছেন শেখ হাসিনা একাডেমী এন্ড উইমেন্স কলেজ। আন্তর্জাতিক মানের এ কলেজটির অবকাঠামো এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি ঈর্ষণীয় মাত্রায় ব্যতিক্রম। খোয়াজপুর সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মানসম্মত শিক্ষা ও বোর্ডের পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান বিবেচনায় বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম কয়েকটি কলেজের অন্যতম হিসেবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে। সৈয়দ আবুল হোসেন এ পর্যন্ত ৭ হাজার অসহায় মেয়ের বিবাহ, ১০ হাজার দুঃস্থের চিকিৎসা, ৫ হাজার ভূমিহীনের ঘরবাড়ি বিনির্মাণে সহায়তা করেছেন। এক হিসেবে দেখা যায়, তিনি ১৯৮৫ থেকে যোগাযোগ মন্ত্রী হবার পূর্ব পর্যন্ত যে যে পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন শিক্ষালয়সহ জনকল্যাণে ব্যয় করেছেন তা বিনিয়োগ করলে এ রকম একটা পদ্মা সেতু সহজে একাই নির্মাণ করে দেয়া তার পক্ষে যথেষ্ট হত। এমন একজন দানবীর, নির্লোভ চরিত্রের আদর্শ মানুষ কানাডিয়ান একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে পরামর্শক নিয়োগের জন্য ঘুষ দাবি করবেনÑ এটা হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।

মোবেশ্বের হোসেন : লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ।

অবগুণ্ঠনে খুঁজে ফিরি
কে এম ইফতেখার হায়দার
আমি একজন পরিপূর্ণ মানুষের কথা বলছি। আমি শুধু কোনো মানুষরূপী মানুষের কথা বলছি না। শুধু মানুষের অবয়ব নিয়ে জন্ম নিলেই মানুষ হয় না। মানুষ হতে হলে অর্জন করতে হয় মনুষ্যত্ববোধ, লালন করতে হয় সর্বভূতে নিবিড় পরম সহানুভূতি। মানুুষ হয়ে যারা নিজেকে নিয়ে আত্মমগ্ন থাকেন, সহমর্মিতা থাকে না অপরের প্রতি, লক্ষ্য থাকে না পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রতি, তারা মানুষের ছদ্মবেশে পশু বই কিছু নয়। আমি তাদের কথা বলছি না। আমি মানুষ বলতে বুঝি মানবতার লালন, স্বজাতির বিকাশ আর পশুত্বের বিসর্জন। আমি তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ একজনের কথা বলছি। আমি এমন একজন মানুষের কথা বলছি, যিনি অযুত জনপদের আযুগ সাধনার একজন। আমি এমন মানুষের কথা বলছি, যিনি জন্মেছেন কল্যাণের মশাল নিয়ে অন্ধকারে আচ্ছন্ন মানুষের জীবনে দীপ জ্বালাতে প্রমিথিউসের মতো। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর মতো আমি কোনো কিংবদন্তির কথা বলছি না। রাজনীতি, সমাজ এমনকি ব্যক্তি জীবনেও তিনি একজন স্বার্থক পুরুষ, আমি তার কথা বলছি। আমি বলছি, একজন সত্যিকারের মানুষের কথা যাকে দেখে মনে আলোড়ন ওঠে আনন্দের, আকর্ষণের, অনুসরণের ও অনুভবের এবং স্বপ্নীল প্রত্যাশার।
আমি এমন একজন মানুষের কথা বলছি, যিনি সত্যিকার অর্থে মানুষ। মানুষ বলে যিনি কোনো মানুষকে নিজের কাছ হতে অবিচ্ছিন্ন ভাবেন না। নিজেকে যিনি সব মানুষের আত্মার সাথে সংযুক্ত দেখতে পান। যিনি রাজনীতি, ধর্ম ও জাতীয়তা নির্বিশেষে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মানবকল্যাণে রত। যিনি সবার কষ্ট নিজের করে নেন ব্যাকুল প্রবণতায়। আপ্লুত উদ্দীপনায় বিভোর হয়ে পড়েন জনকল্যাণে। আমি এমন একজন মানুষের কথা বলছি, যিনি দুর্গতকে সাহায্য, বস্ত্রহীনের বস্ত্র আর অন্নহীনে অন্ন দিতে অমিয় কোড়কে উজাড় করে দেন নিজস্ব মহানুভবতায়।
আমি এমন একজন মানুষের কথা বলছি, যিনি একদিকে ভুলোমন, অন্যদিকে প্রখর স্মরণশক্তির অধিকারী। যিনি ভুলে যান অন্যের ত্র“টি যত বড় হোক; আবার আজীবন মনে রাখেন অন্যের সকল গুণ। প্রশংসায় হয়ে ওঠেন বিহঙ্গমুখর। তিনি স্বচ্ছ কাচ; নিজের দোষগুলো দেখেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, আর অন্যের দোষগুলো ঢেকে রেখে স্বমহিমায় কাছে ডেকে নেন সবাইকে বিশ্বভ্রাতৃত্বের অনিমেষ সৌরভে। আমি এমন একজন মানুষের কথা বলছি, যিনি অন্যকে বড় করার মাঝে আনন্দ পান। আমি সেরূপ এক মনীষীর কথা বলছি, যিনি অন্যকে মহান করতে গিয়ে নিজ মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে ওঠেন।
জন্মের পর একদিন মানুষের মৃত্যু হয়। তখন তার শারীরিক উপস্থিতি থাকে না। সময়ের বিস্মৃতিতে সব হারিয়ে যায়, কেউ জানত না তিনি ছিলেন। তবে এমন কেউ আছেন, যারা নিজস্ব কীর্তিতে চির অম্লান। যার অশরীরী উপস্থিতি তার শরীরী উপস্থিতির চেয়ে বলবান হয়ে ওঠে। যেমনটি হয়েছিল সেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজার। আমি এমনই একজনের কথা বলছি, যার কাছে নীলাভ মৃত্যু আজ পরাভূত। যিনি জীবদ্দশায় মৃত্যুঞ্জয়ী।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার ১৪০০ সাল কবিতায় শতবর্ষ পরের পাঠকের কথা বলেছেন। আমি কবিগুরুর নস্যিসমান যোগ্যতা নিয়ে আজকের পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। পাঠক, এ মানুষটির পরিচয় না-দিয়ে আপনাকে অযথা একটি ব্যর্থ রহস্যের বেড়াজালে রাখছি। যে রহস্যের গভীরতা নেই, নেই কৌতূহল তৈরির সুচতুর বৈশিষ্ট্য। এ রহস্য কিসমিসের পাতলা পর্দার মতো। অনায়াসে সেখানে অভিস্রবন (ঙংসড়ংরং)সম্ভব। আমি জানি, আপনার বুদ্ধির তীক্ষèধারে আমি অনেক আগেই পরাভূত। যাকে অবগুণ্ঠনে রেখে এত কথামালা, তিনিও আপনাদের লোক। মায়ের কাছে মাসীর গল্পের মতোÑ এ বলে হয়ত ভ্রƒকুটি করছেন। তাতেও আমি ক্ষান্ত নই। আমাকে বলতে হয় আমার তাড়নায়। তার জন্য কি এক অবিনাশী শ্রদ্ধাবোধ আকণ্ঠ ভর করেছে আমায়। কিছু না-বললে নিজেকে অকৃতজ্ঞ মনে হয়। বুক ভরা শান্তির প্রত্যাশায় নিজেকে তাই কোলরিজের এনসিয়েন্ট ম্যারিনারের মতো কিছু বলে হালকা বোধ করতে চাই।
রতœগর্ভা আলহাজ্ব সুফিয়া খাতুনের জঠরে জন্ম নেয়া সে মানুষটির ডাসার গ্রাম আজ পুণ্যভূমি। কালকিনি উপজেলা আজ বিশাল বিদ্যাপীঠ। প্রতিটি পাঠশালার ইট আজ তাঁর কথা বলে। অজস্র লেখনীর পরেও হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘আমার অবিশ্বাস’ গ্রন্থে তীব্র আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে লিখেছেন- “একদিন নামবে অন্ধকার মহাজগতের থেকে বিপুল, মহাকালের থেকে অনন্ত; কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি আরো কিছুদূর যেতে চাই।” রবাট ফ্রস্টও তাঁর দঝঃড়ঢ়ঢ়রহম নু ড়িৎফং ড়হ ধ ংহড়ুি বাবহরহম’ কবিতায় এ আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন। আমার প্রবাদ পুরুষের রূপকল্প সেই চেতনার ফল্গুধারা।
মাদারীপুর জেলার উন্নয়নে যিনি কাণ্ডারির ভূমিকায়, পদ্মা সেতু আজ যার স্বপ্নের জানাডু। রাজধানী ঢাকার আশেপাশের সকল সড়ক ৪-লেনের চাদরে ঢেকে দেয়ার মহাপরিকল্পনা যাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আজ এক বাস্তবতা। সর্বোচ্চ বরাদ্দ সংগ্রহ করে রেলওয়ের পুনর্গঠনে যিনি আজ এক নিবেদিতপ্রাণ।
সকলের চিরচেনা মানুষটিকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে, তাঁকে অপরিচিত করে তুলতে চাই না। সতত সুন্দর এ মানুষটিকে সশ্রদ্ধচিত্তে অবগুণ্ঠনে রেখে খুঁজে ফিরতে চাই।

কে এম ইফতেখার হায়দার : অতিরিক্ত সচিব, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

আবুল হোসেনের সৌভাগ্য বনাম পদ্মা সেতুর দুর্ভাগ্য
গোলাম মাওলা রনি এমপি
সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম আমি প্রথম শুনি প্রয়াত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ ও নির্মল সেনের কাছে। ১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসের কোনো এক সন্ধ্যায় তোপখানা রোডের রাজনৈতিক অফিসে তারা আমাকে আবুল হোসেনের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ফরিদপুর দর্পণ নামে একটি পত্রিকা তখন আমি বের করতাম। বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার নামকরা লোক এবং একই সঙ্গে বিজ্ঞাপনের জন্য আমার চেষ্টা ছিল নিরন্তর। যদিও কখনো তার কাছে যাওয়া হয়নি কিন্তু দয়া-দাক্ষিণ্যের সুনাম এবং ব্যবসায়িক সফলতার জন্য তাকে আমি আদর্শ মনে করতাম। সংসদ সদস্য হওয়ার পর তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। প্রধানমন্ত্রী আমাকে অন্যান্য এমপির সঙ্গে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন। সত্যি বলতে কি, প্রথম সাক্ষাতেই তার অনাড়ম্বর ব্যবহার, আন্তরিকতাপূর্ণ আতিথেয়তা এবং সরল স্বীকারোক্তিতে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভাবছিলাম, মাদারীপুর জেলায় কালকিনি উপজেলার ডাসার গ্রামে জন্ম নেওয়া একজন মানুষ বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের সেরাল গ্রামে লেখাপড়া শুরুর মাধ্যমে কিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেনÑ তার উপাখ্যান নিয়ে। শত সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে স্বাধীনতার পর পরই তিনি ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতেন মুহসীন হলে। প্রথমদিকে সাইকেল চালাতেন। পরতেন সাদা রংয়ের পাজামা এবং সাদা হাফ শার্ট। সাইকেলটিকে হলের নিচে তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখতেন। কম-বেশি সবাই জানতেন এটা আবুল হোসেনের সাইকেল। ছাত্রাবস্থায় তিনি চাকরি ও ব্যবসা শুরু করেন। সফলতা এবং সৌভাগ্য তাকে ধরা দেয়। রাতারাতি মোটরসাইকেল কিনে ফেলেন এবং একই সঙ্গে রুমের জন্য একটি টিভিও। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। হলের ছেলেরা তার রুমে টিভি দেখতে আসত এবং অনেকে তার মোটরসাইকেলেও চড়ত। ফলে আবুল হোসেনকেন্দ্রিক একটি বন্ধুত্বের বলয় তখন গড়ে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মোহাম্মদ মুহসীন হলে।
আবুল হোসেনের প্রতি আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতা ও বিমুগ্ধতার কারণেই আমি চাইতাম তিনি যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে সফলতা লাভ করুন। ফলে প্রথমদিকে আমি যেসব বিষয়ে তার ত্র“টি দেখতাম যেসব বিষয়ে খোলামেলা বক্তব্য রাখতাম কমিটি মিটিংগুলোতে। সমালোচনা করতাম, উপদেশ দিতাম এবং ক্ষেত্রবিশেষে তর্কও হতো। আজ আফসোস হয়Ñ আহা তিনি যদি কথাগুলো শুনতেন! কিন্তু তিনি শোনেননি কিংবা আমলারা তাকে শুনতে দেননি। অথবা পৃথিবীর তাবৎ সব মানুষের মতো তিনি হয়ত তার সমালোচনা শুনতে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না।
আমি তাকে প্রায়ই বলতামÑ ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো ত্বরিত মেরামতের জন্য। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করে তাদের থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতাম। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে আমি একাধিকবারই বলেছিলাম, বিশ্বব্যাংক আমাদের টাকা দেবে না। পারলে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন করুন এবং প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বব্যাংকের বাস্তব মনোভাব অবহিত করুন; বড় বড় প্রকল্পের বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে দৈনন্দিন রুটিন ওয়ার্কগুলো শেষ করুন। তাকে সতর্ক করেছিলাম তার আশপাশে থাকা ঈর্ষাপরায়ণ সহকর্মীদের সম্পর্কে। এগুলো সবই বলেছিলাম আজ থেকে তিন বছর আগে, যখন সবাই আশা করত আবুল হোসেন অবশ্যই পারবেন। আমিও তার সফলতার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলাম। ছিলাম এ কারণে যে, তিনি নিয়মিত সবার আগে অফিসে আসতেন, বদলি বাণিজ্য করতেন না, সব কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি টিমওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন।
কর্মকর্তাদের সম্মান করতেন। প্রয়োজনে সব কর্মকর্তার রুমে যেতেন এবং সকাল-বিকাল ছোটাছুটি করতেন প্রয়োজনীয় সব দফতরে। বৃহত্তর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তথা রেল বিভাগ, বিআরটিএ, বিআরটিসি, সেতু বিভাগ, সড়ক ভবনের সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ফেরি বিভাগ এবং সর্বোপরি ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ডের যে বেইজ ওয়ার্ক তা কিন্তু আবুল হোসেনই করে গেছেন। এসব বিভাগ ও অনুবিভাগের বিশাল কর্মযজ্ঞের সমন্বয়, আগামী দিনের কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা এবং ক্ষেত্রবিশেষে মহাপরিকল্পনা তার নেতৃত্বেই করা হয়েছে। আগামী দিনের কোনো কৃতজ্ঞ যোগাযোগমন্ত্রী এগুলো অস্বীকার করতে পারবেন না। এর পরও আবুল হোসেনকে ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরে যেতে হয়েছে। এর কারণ কি? আমার মনে হয় তার কতিপয় অভিব্যক্তি, অতিরিক্ত অরাজনৈতিক সরলতা, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা, অর্থমন্ত্রীর অসহযোগিতা এবং দুর্নীতিবাজ আমলাদের খপ্পরে পড়া ইত্যাদি অন্যতম।
অভিব্যক্তির মধ্যে তার ঝসরষরহম ঋধপব বা হাস্যময় মুখচ্ছবি শেষের দিকে অনেকের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটা এমন একটি বিষয় যে, এ ব্যাপারে একান্ত আপনজন হয়েও কাউকে সতর্ক করা যায় না। এর পরও আমি একাধিকবার তাকে সতর্ক করেছিলাম। সতর্ক করেছিলাম নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে। আমার নিজের মুখেও সব সময় হাসি লেগে থাকে। আমি চেষ্টা করেও বেশিক্ষণ মুখ কালো করে থাকতে পারি না। এ কারণে আমি অনেক দুর্ভোগ ও বদনামের শিকার হয়েছি। বিশেষত আমার স্ত্রী যখন রেগে যায়, তখনো আমার হাসি পায়। একবার এক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। অনেকে আহত হলো, বাস খাদে পড়ে গেল কিন্তু আমার বড্ড হাসি পেল। দৌড়ে নিকটস্থ শস্য ক্ষেতে গিয়ে একপেট হাসলাম। নৌ দুর্ঘটনার মধ্যেও আমার একবার হাসি পেয়েছিল। বড় বড় ঢেউয়ের তাণ্ডব দেখে ছেলেমেয়ে, বুড়া-গুঁড়া সবাই কান্না শুরু করল। কাঁদলে একেকজন একেক রকম মুখভঙ্গি করেন। চিৎকারের শব্দও ভিন্ন। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে আবার দোয়া-দরুদ। আমি হাসি থামাতে পারলাম না। বিক্ষুব্ধ লোকজন সেদিন আমাকে লঞ্চ থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। আমার হাসির সবচেয়ে অসম্মানজনক প্রতিদান পেয়েছিলাম যখন আমি মাধ্যমিক স্তরে পড়তাম। আমি যে সব সময় মুচকি মুচকি হাসতাম তা মেয়েরা একদম দেখতে পারত না। তারা আমাকে একটি উপাধি দিয়েছিল, যা আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে শুনি। অথচ এই একই হাসি দিয়েই আমি অনেক কিছুই জয় করেছি। গত নির্বাচনে আমার হাসি হাসি মুখ অনেক ভোটারকে বিমুগ্ধ করেছিল এবং একই সঙ্গে আকৃষ্ট করেছিল। এখন হাসিটি আমার সম্পদ এ কারণে যে, আমি এটিকে স্থান, কাল ও পাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপন করি।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। আবুল হোসেনের সফলতা এবং পদ্মা সেতুর দুর্ভাগ্য। প্রধানমন্ত্রী একজন সফল ব্যক্তি, একজন সফল উদ্যোক্তা এবং একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় সংসদ সদস্যকে যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিলেন। প্রধানমন্ত্রী যেমনি আশ্বস্ত হয়েছিলেন তেমনি আমরাও মনে করেছিলাম আবুল হোসেন সফল হবেন। কিন্তু এই সফলতার পথে হাঁটতে গিয়ে তিনি বড্ড আবেগতাড়িত হয়ে তাড়াহুড়া করেছিলেন। প্রতিটি বিষয় যেহেতু তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে করতেন সেহেতু সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী। এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই তার কাল হয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তিনি অনেক কিছুতেই রুলস অব বিজনেস মানতেন না। যেমন দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তিনি সরাসরি যোগাযোগ করতেন। অর্থমন্ত্রীর প্রবল আপত্তি ছিল এতে। ফলে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিশ্বব্যাংকের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় ফাইল চালাচালি শুরু হয়। ফলে অনৈক্য, তিক্ততা এবং ভুল বোঝাবুঝি বাড়তে থাকে। আবুল হোসেন এ সময় পদ্মা সেতু, উড়াল সেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, পাতাল রেল ইত্যাদি প্রকল্প নিয়ে এতটাই গলদঘর্ম যে, কোন ফাঁকে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-বরিশাল এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে সেদিকে খেয়াল দিতে পারেননি। এরই মধ্যে সাংবাদিক মিশুক মুনীর ও চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে আবুল হোসেন তখন এক দুর্বিষহ অসহায় জীবন কাটাচ্ছিলেন। মাত্র পাঁচ-ছয়শ কোটি টাকার মেরামতের কাজের জন্য তিনি যে এত বিপদে পড়বেন তা ছিল কল্পনার অতীত। অর্থ মন্ত্রণালয়ে তার বিরুদ্ধবাদীরা অত্যন্ত সুকৌশলে অর্থ ছাড়ে অহেতুক দেরি করার জন্য তিনি অযাচিত বিপদে পড়েন। চারদিকে আবুল হটাও, আবুল হটাও রব উঠতে থাকে। ঠিক এ সময়েই আমিও নির্বোধের মতো টেলিভিশনের টকশোতে একটি দৌড়ের গল্প বলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে ফেলি। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক শেষ চালটি চালে। তারা আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে। সাড়ে তিন বছর এই মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটিতে কাজের অভিজ্ঞতায় বর্তমান সরকারের প্রতি বিশ্বব্যাংকের অসহযোগিতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অসৌজন্যমূলক আচরণ আমাকে আহত করেছে। আমি দেখেছি, সরকারের ভেতরে বিশেষ করে উচ্চ পদস্থ আমলাদের ভেতরে অনেকেই বিশ্বব্যাংকের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। তাদের এজেন্ট রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে, সুশীল সমাজে, সাংবাদিক মহলে এবং কূটনৈতিক মহলে। কেবল সরকারকে বিব্রত করার জন্য বিশ্বব্যাংক যে দুর্নীতির অভিযোগ আনল আমরা কেউ তার বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর উঁচু করতে পারলাম না। চক্রান্তকারীদের বিষময় সমস্বরে জাতীয় মানমর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল এবং এর কোরবানিতে কাটা পড়লেন আবুল হোসেন। এ লেখার মূল প্রতিপাদ্য পদ্মা সেতুর ইতিবৃত্ত ও ভবিষ্যৎ। আবুল হোসেন প্রসঙ্গক্রমে এসেছেন। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি পদ্মা সেতুর ফাঁদে ফেলে বিশ্বব্যাংক মহলবিশেষের ইন্ধনে সরকারের ইমেজ ক্ষুণœ করার অশুভ খেলায় মেতে উঠেছে। অক্টোপাসের মতো সরকারের সফল বৈদেশিক অর্থায়নমুক্ত কর্মকাণ্ড স্তব্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। তাদের এ কাজে সহযোগিতা করছে এদেশেরই কতিপয় কুলাঙ্গার। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ইস্যুটি ভৌতিক। এর কোনো অস্তিত্ব নেই। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে অর্থাৎ প্রায় ১২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ। ভূমি অধিগ্রহণ যথানিয়মে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য বিশ্বব্যাংক লিখিতভাবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানিয়েছে। এর পর যে কাজটি হয়েছে তা হলো সেতুর ডিজাইন বা নকশা চূড়ান্তকরণ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা এবং তাদের মনোনীত কনসালট্যান্টরা সেতু বিভাগের সঙ্গে সার্বক্ষণিক কাজ করে এর নকশা চূড়ান্ত করেছে। এখানে মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটি কিংবা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কিছুই করার ছিল না। এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র পরীক্ষা করার অধিকারও বিশ্বব্যাংক আমাদের দেয়নি। প্রকল্পের তৃতীয় ভাগে ছিল সেতুর তদারককারী কনসালট্যান্টদের একটি তালিকা করে তা বিশ্বব্যাংকের হেড অফিসে পাঠানো, যা কিনা গ্রহণ, পরিমার্জন ও বাতিল করার ক্ষমতা বিশ্বব্যাংকের। পরবর্তীতে সেই তালিকা অর্থাৎ কনসালট্যান্টদের প্রি-কোয়ালিফাইড তালিকার ভিত্তিতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় টেন্ডারের মাধ্যমে যে কোনো একজন বা একাধিককে নিয়োগ দিত। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় কেবলমাত্র বিশ্বব্যাংকের ফর্মুলা অনুযায়ী কতিপয় কনসালট্যান্টের নামের তালিকা পাঠিয়েছে মাত্র। আর এই তালিকার মধ্যে দুর্নীতি হয়েছে বলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত করে।
আসলে আমরা গরিব দেশ বলেই বিশ্বব্যাংক একটি বায়বীয়, ভিত্তিহীন অমূলক এবং বাস্তবতাবিবর্জিত বিষয়ে অভিযোগ তোলার সাহস পেয়েছে। অন্য কোনো মধ্যম আয়ের দেশ হলে তারা এতদিন বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে দিত। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ কোনো কিছু না বুঝেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছে। সরকারবিরোধীরা বড় গলায় সরকারের সমালোচনা করছে। অথচ এটা কোনো আবুল হোসেন কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের বিষয় নয়। এটা একটি জাতীয় মর্যাদার বিষয়। সরকারকে ছোট করতে গিয়ে আমরা মূলত জাতি হিসেবে নিজেদের ছোট করে ফেলছি এবং বিশ্বব্যাংক নামক সাম্রাজ্যবাদের মুখপাত্রের কাছে নিজেদের ভিক্ষুক হিসেবে উপস্থাপন করছি।
পাদটীকা : আমার মনে হচ্ছে পদ্মা সেতুর দুর্ভোগ সহজে কাটবে না। বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে না। মালয়েশিয়া বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গেও অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা এগুবে না। একমাত্র পথ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন। এ ক্ষেত্রে সেতু বিভাগের নেতৃত্বে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটের ম্যানেজারিয়ালে অতি সত্বর কাজ শুরু করা যেতে পারে। এ বছর বাজেটে তিন হাজার কোটি টাকা পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পিপিপির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থও সেতুর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ আমাদের নিজস্ব সক্ষমতায়ই সেতুর কাজ শুরু এবং শেষ করা সম্ভব। মূল সেতুর কন্ট্রাক্টর এবং কনসালট্যান্ট আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে গ্রহণ করলে এক্ষেত্রে অসুবিধা কি? কিন্তু আজ মালয়েশিয়া, কাল চীন, পরশু রাশিয়ার সঙ্গে কথা বললে পদ্মা সেতুর দুর্ভোগের ঘনঘটা বাড়তেই থাকবে।

গোলাম মাওলা রনি : সংসদ সদস্য।

পদ্মা সেতু উপাখ্যান : সত্য বনাম কল্পনা
ড. মোজাম্মেল খান
আমি কোন সাংবাদিক নই, অনুসন্ধানী তো অনেক দূরের কথা। তবুও আমি এ লেখাটি লিখছি কয়েকটি কারণে। প্রথমত, এটা এমন একটা ইস্যু যার সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং ভাবমূর্তি জড়িত, যে দেশের উন্নয়ন এবং গর্ব আমার হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। দ্বিতীয়ত, কানাডিয়ান যে প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানটি এ উপাখ্যানের মূল নায়ক সেটার সুদৃশ্য দুটো অফিস বলা যেতে পারে আমার বাড়ির পিছনের আঙিনায়, যেটা টরেন্টোর বিজিনেস ডিসিট্রিকে যাওয়ার পথে কোন ভিজিটরের চোখ এড়াবার কোন কারণ নেই। তৃতীয়ত, আমার অনেক প্রাক্তন ছাত্র কানাডার এ অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে গৌরবের সাথে কর্মরত আছে। চতুর্থত, যে দুই ব্যক্তি এ ব্যাপারে অভিযুক্ত হয়েছেন তাঁদের একজন আমাদের বুয়েট থেকে পাস করা এক মেধাবী প্রকৌশলী, যিনি আমাকে ২০০০ (যখন আমি অন্টারিওর বাংলাদেশ প্রকৌশল এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলাম) সাল থেকে চেনেন বলে জানালেন এবং ঘটনাক্রমে আমার বাড়ি থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে থাকেন। এবং পরিশেষে এবং সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেটা হলো : বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে এ উপাখ্যান নিয়ে এমন সব কাল্পনিক কাহিনী রচিত হয়েছে যার সাথে সত্যের খুব কমই সম্পর্ক রয়েছে এবং যার বেশিরভাগই শোনা কথা এবং গুজবের ওপর ভিত্তি করে রচিত, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার সাথে যার খুব কমই সম্পর্ক রয়েছে।
এমনকি বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদপত্র ঘুষের (যেটা কোনদিন দেয়া হয়নি) এমন সংখ্যা আবিষ্কার করেছে যেটা কিনা ঐ প্রজেক্টের কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের দাখিল করা দরপত্রের অর্থনৈতিক পরিমাণ থেকেও অনেক বেশি। গত মাসে বাংলাদেশের এক অতি পুরনো ইংরেজি সাপ্তাহিক, যেটা এখন কয়জন লোক পড়েন সেটা আমার জানা নেই, সেটাতে খোদ টরন্টো থেকে এক ব্যক্তি লিখেছেন এসএনসি-লাভালিনের দুই ব্যক্তি নাকি এখন টরন্টোর জেলে পচছেন। কানাডার বাইরে থেকে এ খবর যখন আমার এক বন্ধু আমাকে জানালেন তখন আমি ঘটনাচক্রে ঐ দুইজনের যিনি বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত তার সাথে এক কফি শপে বসে কফি পান করছিলাম। এমনকি গত ৬ সেপ্টেম্বর চ্যানেল আই তাদের রাতের সংবাদে একই ধরনের আজগুবি সংবাদ পরিবেশন করেছে। ডেইলি স্টার যেটাকে কানাডার সংবাদ মাধ্যমসমূহ প্রতিনিয়ত উদ্ধৃত করেন এবং সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গণ্য করেন তাদের ২৬ জুন সংখ্যায় লিখলেন, ‘কানাডার আরসিএমপি এসএনসি-লাভালিনের অফিস তল্লাশি চালিয়ে অনেক দলিল দস্তাবেজ জব্দ করার পাশাপাশি ঐ প্রতিষ্ঠানের সিইও পিয়ার ডুহেম, বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত মোহাম্মদ ইসমাইল এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত রমেশ শাহকে আটক করেছে। আসল ঘটনা হলো সিইও পিয়ার ডুহেম এ ঘটনায় কোনদিনও দৃশ্যপটে ছিলেন না। লিবিয়া এবং তিউনিসিয়াতে কয়েকটি প্রজেক্ট পাওয়ার ব্যাপারে এক এজেন্টকে ৫৬ মিলিয়ন ঘুষ দেয়ায় তাঁর অনুমোদন ছিলÑ এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি গত মার্চ মাসে কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করেন।
এ উপাখ্যানের সত্য বের করার প্রচেষ্টায় আমি একমাত্র বিশ্বব্যাংক ছাড়া বাংলাদেশের বাইরে আর সবাই, যাদের সাথে এ প্রজেক্টের বা অনুসন্ধানের সম্পর্ক রয়েছে তাদের সাথে কথা বলেছি বা যোগাযোগ করেছি। এদের মধ্যে কানাডিয়ান পুলিশ আরসিএমপি অফিসার লুছি শোরে এবং এসএনসি-লাভালিনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লেসলী কুইয়ন্টনও রয়েছেন। এসএনসি-লাভালিনের কর্মরত যে তিন ব্যক্তির নাম এ তদন্তে উল্লিখিত হয়েছে তাঁরা হলেন : কেভিন ওয়ালেছ, যিনি ঐ প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। তিনি ২০১১ সালের অক্টোবরে পদত্যাগ করে কানডু এনার্জি নামে একটা প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। রমেশ শাহ, যিনি ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, যাকে ২০১১ সালে পদত্যাগ করতে হয় এবং এরপর থেকে কানাডার সাসকাচুয়ান প্রদেশের রেজাইনা নামক শহরে ফিন্যান্সিয়াল কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। মোহাম্মদ ইসমাইল, যিনি ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ার হিসেব ২০০৪ সালে ঐ কোম্পানিতে যোগদান করেন এবং খুব তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ঐ কোম্পানির আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োজিত হন। ২০১১ সালের মে মাসে ইসমাইল ঐ কোম্পানি ছেড়ে মিসিসাগা শহরে এসসিও নামে একটি কনসালটিং কোম্পানি গঠন করেন এবং সে থেকে ঐ প্রতিষ্ঠানের সিইও হিসেবে কর্মরত আছেন।
২০১১ সালের প্রথমদিকে পদ্মা ব্রিজ প্রজেক্টের কনস্ট্রাকশন কন্ট্রাকটরদের সুপারভিশনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইসমাইল কেভিন ওয়ালেছকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে যান। ঐ সফরে তাঁরা ঢাকাতে যে সমস্ত ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলেন তাঁদের নাম এবং আলোচনার সারসংক্ষেপ ইসমাইল টেলিফোনে রমেশ শাহকে নিয়মিতভাবে অবহিত করতেন এবং রমেশ সেটা তাঁর ডায়েরিতে অনেকটা সাঙ্কেতিক ভাষায় লিখে রাখতেন। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক রমেশের ডায়েরি থেকে উদ্ধার করা নামগুলোই বাংলাদেশের দুদককে সরবরাহ করেছে, যে তথ্য দুদক চেয়ারম্যান গত জুলাই মাসের এক তারিখে সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন। আমি যখন এ ব্যাপারে আরসিএমপি অফিসারের সাথে কথা বলি তখন তিনি ‘ঘটনাটা নিয়ে এখনও অনুসন্ধান চলছে’ এ অজুহাতে এর বেশি কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
ইসমাইল এবং কেভিন ওয়ালেছের বাংলাদেশ সফরের পর তাদের ঐ প্রজেক্টটা পাওয়ার ব্যর্থতার পর ২০১১-এর ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সবকিছুই নীরব ছিল। আসলে ঐ প্রজেক্টটা কত ডলারের ছিল সেটা বাংলাদেশের কোন গণমাধ্যমে আমি দেখিনি। রয়টার সংবাদ সংস্থার ভাষ্য অনুযায়ী এটা ছিল ১০ মিলিয়ন ডলারের, প্রাক্তন মন্ত্রী আবুল হোসেন তার দুদককে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী ৩৭ মিলিয়ন ডলার, এসএনসি-লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্টের আমার কাছে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী ‘আমাদের অংশটা একেবারেই অল্প, যেহেতু আমরা বিড করেছিলাম শুধু মাত্র ক্লায়েন্টের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার জন্য’। আমার নিজস্ব নির্ভরযোগ্য সূত্র বলেছে এটা ছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের যেটা অবশ্য এসএনসি-লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। ২০১১ সালে ৩ সেপ্টেম্বরে সংবাদ মাধ্যমে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হলো যে বিশ্বব্যাংকের অনুরোধ পদ্মা ব্রিজের কথিত দুর্নীতি তদন্তে কানাডিয়ান পুলিশ এসএনসি-লাভালিনের অকভিল অফিসে অভিযান চালিয়েছে। ২০১১ এর ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসএনসি-লাভালিন এ অভিযানের সত্যতা স্বীকার করে। তদন্ত পরিক্রমায় এ বছরের ২৯ ফেব্রচ্ছারি তারিখে আরসিএমপি-এর দুর্নীতি দমন টিম রমেশ শাহ এবং মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেফতার করে। বাংলাদেশ সংবাদ মাধ্যমসমূহে গ্রেফতারকৃত দুই ব্যক্তির ভুল নাম (রমেশ সাহা এবং ইসমাইল হোসেন হিসেবে বাংলা সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করেছে) প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত (২৪ জুন, ২০১২) তাদের গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ আরসিএমপি প্রকাশ করেনি। যদিও কোন অর্থ হস্তান্তরিত হয়নি তবুও তাদের বিরুদ্ধে ১১ এপ্রিল করাপশন অব ফরেন পাবলিক অফিসিয়াল এ্যাক্ট-এর আওতায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।
১৯৯৯ সাল থেকে প্রবর্তিত এ আইনটি এমন সব ব্যবসায়ীকে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে তৈরি করা হয়েছে যারা “প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন বিদেশী সরকারী কর্মকর্তা বা ব্যক্তিকে কোন ধরনের সুযোগ সুবিধা বা পারিতোষিক দেয়ার প্রতিশ্র“তি দেন।” “বিদেশী কোন সরকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজের বা নিজেদের ক্ষমতা বলে যেন সে দেশের কোন সিদ্ধান্তকে প্রভান্বিত না করতে পারেন” সেটাকে বন্ধ করার জন্যই এ আইনটি প্রবর্তিত হয়েছে। ঘটনাক্রমে এ আইনের প্রথম শিকার হয়েছে নাইকো নামে একটি প্রতিষ্ঠান (বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই এ প্রতিষ্ঠানটিকে ভাল করেই জানেন) গত বছরের জুন মাসে যাকে বাংলাদেশেরই এক মন্ত্রীকে ঘুষ দেয়ার অপরাধে ৯.৫ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়েছে।
রমেশ শাহ এবং মোহাম্মদ ইসমাইলের বিরুদ্ধে গত ১১ এপ্রিল প্রাথমিক অভিযোগ দায়েরের পর থেকেই তারা জামিনে মুক্ত রয়েছেন এবং এর মাঝে কয়েকবার আদালতে হাজিরা দিয়েছেন যার সর্বশেষটি ঘটেছে গত ২৫ জুন তারিখে। ঐদিন আদালত আগামী বছরের (২০১৩) ৮ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যে তাদের বিরুদ্ধে বিচার করার মতন পর্যাপ্ত অভিযোগ রয়েছে কিনা।
গত এপ্রিলের ২ তারিখে এসএনসি-লাভালিনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লেসলী কুইয়ন্টন দাবি করলেন তাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দায়ের করা হয়নি এবং রমেশ এবং ইসমাইল ছাড়া অন্যকোন প্রাক্তন কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়েছেন কিনা বা বাংলাদেশ ইস্যুতে অন্য কোন কর্মকর্তা এসএনসি-লাভালিন ছেড়ে গেছেন কিনা সেটা তার জানা নেই। তিনি আরও স্বীকার করলেন যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে এ প্রজেক্টে তাদের প্রতিষ্ঠানতে ‘ঊধৎষু ঞবসঢ়ড়ৎধৎু ঝঁংঢ়বহংরড়হ’ ইস্যু করেছে যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা আপাতত বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক সম্পর্কিত কোন কনট্রাক্টে দরপত্র দাখিলের ক্ষমতা হারিয়েছেন। আমার নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য অনুযায়ী যদি প্রজেক্টটা ৪৫ মিলিয়ন ডলারের বলে ধরে নেয়া যায় তবে সেটা বিশ্বব্যাংকের বাতিল করা প্রতিশ্র“ত অর্থের মাত্র ৩.৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে আরসিএমপি মুখপাত্র আমাকে প্রজেক্টের আর্থিক পরিমাণ বা প্রতিশ্র“ত ঘুষের অঙ্ক কোনটাই জানাতে রাজি হননি যেহেতু ঘটনার এখনও তদন্ত চলছে। মোহাম্মদ ইসমাইল ছিলেন ঐ প্রতিষ্ঠানের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর যার সত্যিকার অর্থে কোন অর্থ প্রদানের ক্ষমতা ছিল না, আর রমেশ শাহ যদিও ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তারও এসএনসি-লাভালিনের সর্বোচ্চ ব্যক্তির অনুমোদন ছাড়া, যেমনভাবে অনুমোদিত হয়েছিল লিবিয়া এবং তিউনিসিয়াতে প্রজেক্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে, কোন বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কোন বেআইনী অর্থ প্রদানের প্রতিশ্র“তি দেয়ার কোন ক্ষমতাই ছিল না। অতএব স্বাভাবিক জ্ঞানতাড়িত হওয়া যে কোন ব্যক্তির মনেই মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন জাগবে : কে বা কারা কার স্বার্থ উদ্ধারের মানসে এই দুই ব্যক্তিকে বলির পাঁঠা বানিয়েছে?

লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক

সতত বিভাময়
মোহাম্মদ মোস্তফা
কিছুটা দ্বিধা আর দোদুল্যমানতাÑ কারণ যে ক্ষণজন্মা ব্যক্তির প্রভা ও বৈভব এবং হৃদয়ের ঐশ্বর্য আলোকপাতের জন্য লেখনীর এই ক্ষুদ্র প্রয়াস, তার সূচনা করবো কোথা হতে?
অঙ্কুরোদ্গম হতে বিশাল মহীরুহে রূপান্তরিত এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিটি হলেনÑ সৈয়দ আবুল হোসেন, যিনি বাংলাদেশের বিশাল জনপদের প্রায় সর্বত্র পরিচিত একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক এবং উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার একজন পথিকৃত হিসেবে। বিন্দু হতে বৃত্তে রূপান্তরিত এই দূরদর্শী প্রতিভাবান ব্যক্তির জীবনাচরণ উদ্যমী ও উচ্চাকাক্সক্ষীদের জন্য এক গভীর অনুপ্রেরণার উৎস।
দিবাবসানে লঘুচরণে ধরণীর বুকে নেমে আসে সন্ধ্যা। আর তখনই প্রয়োজন হয় সন্ধ্যাপ্রদীপ প্রজ্জ্বলনের। প্রদীপের কাচ স্বচ্ছকরণ, সলতে প্রস্তুতকরণ কিন্তু শুরু হয় মধ্যাহ্নে কখনো বা অপরাহ্ণে। আমার লেখনীর শুরুটাই হচ্ছে সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে প্রথম সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে। সময়টি ছিল ১৯৯৬ সালের মে মাসের মাঝামাঝি, যখন জাতীয় সংসদের নির্বাচন সন্নিকটে এবং টিএনও কালকিনি হিসেবে আমার উপর সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব অর্পিত। বৈশাখের শেষ নিশ্বাসে প্রচণ্ড দাবদাহে যখন সকলেই ঘর্মাক্ত, বিশেষ করে, টিএনও’র অফিস কক্ষে, যেখানে মনোনয়নপত্র জমা নেয়া হচ্ছে এবং একই সাথে শোরগোল তুঙ্গে, তখন জলতরঙ্গের মতো একটি ‘উচ্চারণ’ টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়া আমার মাথা উঁচু করে তোলে। ‘আমি সৈয়দ আবুল হোসেন’Ñ ধীর অথচ ঋজুভঙ্গিতে কক্ষে প্রবেশ করলেন তিনি। হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দনের জন্য, যেখানে উষ্ণতার তাৎক্ষণিক স্পর্শ এবং আচরণে বসন্তের মাদকতা। লক্ষণীয়, কক্ষের শোরগোল সাময়িকভাবে স্তিমিত হলো। পরক্ষণেই যথা পূর্বং তথা পরং। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমাদান এক সময় শেষ হলো। বাইরে কর্মী সমর্থকদের তুমুল কোলাহল। এরই মাঝে সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদেরকে এই মর্মে প্রস্তাব দিলেন, যেন বাইরের খোলা আঙিনায় একই মঞ্চে তাঁরা প্রত্যেকেই কালকিনির ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার রূপকল্প সবার সামনে তুলে ধরেন। প্রস্তাবটি কেউ গ্রহণ করলেন না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে চকিতে আমার মনে পড়লো, এ তো পাশ্চাত্যের সবচাইতে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রপতি প্রার্থীদের বিতর্ক প্রতিযোগিতার আদলেই প্রস্তাব। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি যে প্রস্তাবটি এসেছিল একজন ক্ষুরধার, তীক্ষè ও দূরদর্শী রাজনীতিকের পক্ষ হতে, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে। এখন মনে হয়, ঐ প্রস্তাবের চর্চা অন্তত শুরু হলেও পরবর্তীকালে তা ব্যাপকহারে প্রচারিত হলে গণতন্ত্রের চর্চার একটি ‘মডেল’ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো।
১২ জুন, ১৯৯৬ জাতীয় সংসদের নির্বাচনে ভোট প্রদান শুরু হলো। কন্ট্রোল রুমে বসে সংশ্লিষ্ট সকলকে দিকনির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি চোখ কান খোলা রেখেছি, যাতে প্রতিশ্রুত সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা যায়। খবর এলো কালকিনিতে এসেছেন সৈয়দ আবুল হোসেন এবং ভোট দেয়ার জন্য তাঁর নিজ এলাকা ‘ডাসার’ রওনা হয়েছেন। অশুভ চিন্তা আচ্ছন্ন করলো আমাকে। কারণ, দুর্বৃত্তরা ইতোপূর্বে কালকিনিতে পদার্পণ করলে তাঁর প্রাণ সংহারের হুমকি দিয়েছিল। পুলিশ প্রহরা ছাড়াই তাঁর এরূপ সফর দুশ্চিন্তাকে প্রকট করে তুললো। পরিদর্শনের এক পর্যায়ে ‘ডাসার’ ইউনিয়নে তাঁর সাথে দেখা হলো। আমার উদ্বেগের কথা জানাতেই তিনি তাঁর স্বভাবসূলভ হাসি দিয়ে বললেন, “টিএনও সাহেব, জন্মেছি যখন, মরতে তো একদিন হবেই। কিন্তু কাগুজে বাঘদের হুমকিতে যদি আমি পিছিয়ে যাই, তাহলে এলাকাবাসীর কাছে আমার অবস্থান কি হবে, চিন্তা করেন।” মৃত্যুভয়কে জয় করতে পেরেছেন বলেই সৈয়দ আবুল হোসেন সমস্ত চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে অমানিশার কালো চাদর ভেদ করে সাফল্যের এই স্বর্ণশিখরে আরোহণ করতে পেরেছেনÑ এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
সৈয়দ আবুল হোসেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্তির পর তাঁর প্রিয় কালকিনি উপজেলার সার্বিক উন্নয়নের প্রতি দৃকপাত করলেন। তাঁর প্রথম ধাপ ছিল কালকিনি এবং গোপালপুর ইউনিয়নের একাংশ নিয়ে কালকিনি পৌরসভা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ। প্রায় প্রতি রাতেই তিনি আমার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করে কাজের অগ্রগতি জানতে চাইতেন। সে সময়ের টেলিফোনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রারম্ভিক অবস্থার মতো ছিলো না। সেই পুরোনো ধাঁচের টেলিফোন হ্যান্ডেল কানে লাগিয়ে একটি হাতল কপিকলের মতো শুধু ঘোরাতেই হতো। তারপর যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতো টেলিফোন অফিস সেই কল রিসিভ করে ঢাকায় সংযোগ স্থাপন করতো। মাঝে মাঝে মাঝপথেই টেলিফোন হয়ে পড়তো নির্বাক, নিথর। যোগাযোগের এই প্রতিকূলতাকে বিন্দুমাত্র ভ্রƒক্ষেপ করতেন না সৈয়দ আবুল হোসেন। বলা যায়, তাঁর এই নিরলস প্রয়াসের কারণেই অবিশ্বাস্য স্বল্প সময়ের মধ্যেই কালকিনি ‘পৌরসভা’তে উন্নীত হলো।
কালকিনি ‘পৌরসভা’তে উন্নীত হওয়ার বেশ কয়েকমাস মাস পর এক অবসর মুহূর্তে আমি মন্ত্রী মহোদয় (সৈয়দ আবুল হোসেন)-এর কাছে কৌতূহলভরে জানতে চেয়েছিলাম, কেন তিনি কালকিনি পৌরসভার আওতায় বড় আকারের গ্রামীণ জনপদকে অন্তর্ভুক্ত করলেন। এর ফলে ঐ এলাকার মানুষের হোল্ডিং, ট্যাক্সের বিড়ম্বনা বৃদ্ধি পাবে কি না? প্রত্যুত্তরে তিনি যা বললেন, তার নির্যাস হলো দক্ষিণাঞ্চলের, বিশেষ করে, বৃহত্তর ফরিদপুর এলাকাতে উন্নয়নের ছোঁয়া একেবারেই কম। পৌরসভা গঠনের মধ্য দিয়ে নগরায়নের বিস্তৃতি এলাকার জনগণের সার্বিক উন্নয়নে এক বিরাট মাইফলক হয়ে থাকবে। উপরন্তু, একটি উদাহরণ টেনে বললেন, প্রচণ্ড দাবদাহে ঘর্মাক্ত মানুষ যখন স্নিগ্ধ সমীরণের প্রত্যাশায় দক্ষিণের বাতায়ন খুলে দেয়, তখন তার ক্লান্তি, শ্রান্তি মুহূর্তেই দূরীভূত হয়। যদিও দক্ষিণের বাতায়নের ফলে কিছু ধুলো ঘরে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু এই তুচ্ছ বিড়ম্বনাকে গুরুত্ব দেয়া হলে বড় অর্জন ‘অধরা’ই থেকে যাবে।
এর প্রমাণ পেলাম কিছুদিনের মধ্যেই। মোটামুটি দূরবর্তী একটি ইউনিয়নে আমার একটি সরকারি কর্মসূচি নির্ধারিত হলো। তার কয়েকদিন আগে থেকে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান দৌড়-ঝাঁপ করে সফরের খুঁটিনাটি প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। সহকর্মী এসিল্যান্ড, থানা শিক্ষা অফিসার, থানা সমাজসেবা অফিসারসহ আমার জিপ দুলুনি খেতে খেতে অগ্রসর হচ্ছিল। আন্দাজ করলাম কয়েক জায়গায় জিপ চলাচলের উপযোগী করার জন্য রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে। কখনও পুকুরের পাড়ের পাশ দিয়ে কখনও-বা বাঁশঝাড়ের অপ্রশস্ত পায়ে চলা পথ দিয়ে আমাদের জিপ স্বভাবসুলভ শব্দ করতে করতে পৌঁছলো। ফেরার সময় এক জায়াগায় কয়েকজন যুবক আমাদের গাড়ির গতিরোধ করলো। প্রচণ্ড অস্বস্তিতে পড়লাম। যুবকেরা বিনয়ের সঙ্গে জানালো, তাদের একটি আর্জি আছে। আর তা হলো জিপটাকে একটু থামাতে হবে। কারণ, তাদের ঠাকুরমা কখনও মোটর গাড়ি দেখেননি। একটু দেখার সুযোগ করে দিতে হবে। দূরে লক্ষ করলাম একটি জটলা। যাকে কেন্দ্র করে জটলা তিনি অশীতিপর একজন বৃদ্ধা, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। আলতো করে হাত ধরলাম। জিপের কাছে পৌঁছানোর পর ঐ বৃদ্ধার চোখে লক্ষ করলাম অপার বিস্ময়। বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা কাটার পর আমি প্রস্তাব দিলাম জিপে ওঠার জন্য। কিন্তু তার স্বজনেরা জানালেন যেহেতু তিনি কখনো মোটর গাড়ি দেখেননি সুতরাং মোটর গাড়িতে ওঠার এবং মোটর গাড়ির শব্দ তাঁর স্বাস্থ্যের অনুকূলে নাও হতে পারে। সারাটা পথ আমাকে এই চিন্তা আচ্ছন্ন করে রাখলো যে ঐ বৃদ্ধা দশ/বারো কিলোমিটার দূরে যদি কালকিনিতেও কখনও এসে পৌঁছোতেন তাহলে মোটর গাড়ি দর্শন কোনো না-কোনো এক সময় সম্ভব হতো। ৬৯’-এর ২২ জুলাই চন্দ্রপৃষ্ঠে মানুষের পদচিহ্ন আঁকার দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কালকিনির কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক বৃদ্ধা মোটর গাড়িই দর্শন করেননিÑ এই দুঃখবোধে বেদনায় নীল হয়ে গেলাম। আর তখনই মনে হলো সৈয়দ আবুল হোসেন নগরায়নের যে সোপান কালকিনি পৌরসভা গঠনের মাধ্যমে সৃষ্টি করলেন, তা দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, দুঃখ-বেদনা ও অভিমানকে অবশ্যই প্রশমিত করবে।
সরকারের সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ‘জ্যোতির্ময় মাদারীপুর’-এর উদ্যোগে কালকিনিতে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। যথারীতি বিভিন্ন বক্তা উদ্দীপনামূলক বক্তব্য দিচ্ছিলেন। অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক হিসেবে আমার উপর দায়িত্ব ছিল অনুষ্ঠান পরিচালনার। এক পর্যায়ে লক্ষ করলাম সৈয়দ আবুল হোসেন একজন স্বেচ্ছাসেবককে ইশারায় জনৈকা বৃদ্ধা দর্শককে কাছে ডেকে আনতে বলেন। জীবন সায়াহ্নে উপনীতা ঐ বৃদ্ধাকে লক্ষ করলাম জীবনের চাওয়া এবং পাওয়ার অনেক উপরে উঠে গেছেন। পরে জেনেছি ঐ বৃদ্ধা সৈয়দ আবুল হোসেনকে জানিয়েছিলেন তার উপস্থিতিতে যদি সাক্ষরতার বাইরের কারও চোখ খুলে যায়, সে কারণেই তার এখানে আসা। সহায় সম্বলহীন ঐ বৃদ্ধার চেতন জ্ঞানে সৈয়দ আবুল হোসেন অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন। ঐ বৃদ্ধাকে তিনি যে সম্মাননা দিয়েছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন-এর ‘দানবীর’ উপাধি তার যথার্থতাকে নতুন করে প্রমাণ করলো।
মনে পড়ে সহস্রাব্দের সূচনা বছরেই মন্ত্রী মহোদয় মাতৃহারা হলেন। আমি তখন মাদারীপুর জেলা পরিষদের সচিব। সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রশাসনের সবাইকে নিয়ে আমরা উপস্থিত হলাম ডাসার ইউনিয়নে মন্ত্রী মহোদয়ের বাসভবনে। মন্ত্রী মহোদয়কে দেখলাম প্রাণপ্রিয় জননীকে হারিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে আছেন। তাঁর মনের মধ্যে গুমরে ওঠা কান্না এবং অসংখ্য স্মৃতিকথা প্রকাশিত হলো জানাজা অনুষ্ঠানের প্রাকমুহূর্তে তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। এ এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হলো আমাদের সবার সামনে। এতদিন মন্ত্রী মহোদয়কে দেখে এসেছি কিছুটা কাছে থেকে, কখনও-বা দূর থেকে কখনও বা আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে। কিন্তু সেদিন মন্ত্রী মহোদয়ের কান্নাভেজা বাষ্পরুদ্ধ অথচ সুসংবদ্ধ বক্তব্যে আমার দৃঢ় প্রতীতি জন্মালো যে, একজন মহীয়সী সর্বগুণে গুণান্বিতা মায়ের গর্ভেই এমন একজন ক্ষণজন্মা প্রতিভা জন্মগ্রহণ করতে পারেন।
মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের সূত্র ধরে জানা গেল, তিনি বিবাহের পূর্বেই হজব্রত পালন করেছিলেন। সাথে ছিলেন প্রাণপ্রিয় জননী। মক্কা-মদীনার দীর্ঘপথে বাসে একজন যাত্রী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। পথিমধ্যে ঐ অসুস্থ যাত্রীকে হাসপাতালে নেয়ার বিড়ম্বনা/ঝামেলা কেউ গ্রহণ করতে আগ্রহ দেখালেন না। মায়ের নির্দেশে যুবক সৈয়দ আবুল হোসেন মাঝপথে নেমে ঐ অসুস্থ যাত্রীর চিকিৎসার দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। যতটা সহজে ঘটনার বিবরণ দেয়া হলো, বাস্তবে তা ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং অনিশ্চত। প্রথম হজযাত্রী হিসাবে অচেনা পথঘাট, হাসপাতালে ভর্তি করার হাজারো বিড়ম্বনা, কারণ, ইংরেজি ভাষায় দখল রয়েছে ঐ দেশে এমন সংখ্যা অত্যন্ত কম, সীমিত বৈদেশিক মুদ্রা এবং সর্বোপরি মা’-কে কাফেলার দায়িত্বে রেখে আসা এসবই দুশ্চিন্তাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেন জয় করেছেন এ সকল প্রতিবন্ধকতা। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছেন অকুতোভয়ে। সর্বোপরি, মাতৃআজ্ঞা পালন করেছেন অক্ষরে অক্ষরে। তিনি এ কালের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মাতৃভক্তির এই চরম পরাকাষ্ঠা এ সময় সত্যিই বিরল।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উপমা এসে যাওয়ায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষানুরাগের প্রসঙ্গ চলে আসে। উচ্চ শিক্ষাকে আক্ষরিক অর্থে নয়, একেবারে প্রায়োগিকভাবে শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার দুর্লভ কৃতিত্বের অধিকারী তিনি। কালকিনি উপজেলার কেন্দ্রতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজÑ যা ‘বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস’ পত্রিকায় কয়েক বছর ধরে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘খোয়াজপুর’ ইউনিয়নে আবুল হোসেন কলেজ ভবনটি বহু দূর হতে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘ডাসার’ ইউনিয়নে ডিকে আইডিয়াল আতাহার আলী একাডেমী এন্ড কলেজ ঐ এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্যের উৎস। সর্বশেষ ‘ডাসার’ এ তাঁর গ্রামের বাড়ির একান্ত সন্নিকটে শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজ শুধু স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণ কৌশলের দিক দিয়ে নয়, সংশ্লিষ্ট ত্রয়ী জেলা তথা মাদারীপুর গোপালগঞ্জ এবং বরিশালের মিলন মোহনায় প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠ রাঙা আলোর হাতছানি দিয়ে সকল শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের, মননের ও মনীষার জগতে নিয়ে এসেছে। মোস্তফাপুর থেকে শুরু করে আরও বহু এলাকায় স্থাপিত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার উল্লেখ করলে তালিকার কলেবর নিঃসন্দেহে আরও বৃদ্ধি পাবে। সৈয়দ আবুল হোসেন শুধু এ সকল বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠিত করেই ক্ষান্ত হননি, বরং শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের কল্যাণে অকৃপণভাবে সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করেছেন। তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত এই মহতী উদ্যোগে তিনি তাঁর সময়, সম্পদ ও স্বেদবিন্দু অকাতরে ব্যয় করে চলেছেন।
সৈয়দ আবুল হোসেনের উপর্যুক্ত প্রয়াস গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইতিহাসের একটি ঘটনা আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। গ্রিক ধনকুবের ওনাসিস তার ধনৈশ্বর্যের শক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের ফার্স্ট লেডি জ্যাকুলিন কেনেডিকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর পর গ্রিসের একটি গোটা দ্বীপ ক্রয় করেছিলেন পুত্রের সমাধির জন্য। অবশেষে ওনাসিস নিজেও মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ ভোগ করলেন। তার মরদেহ গ্রিসে এসে পৌঁছোলো। কিন্তু গ্রিসবাসীর চোখে ছিল না কোনো অশ্রুবিন্দু। পাশাপাশি গ্রিসেরই আর এক চিত্র। বহু শতক পূর্বে গ্রিসে জন্ম নেয়া সক্রেটিস, তাঁর শিষ্য প্লেটো, তাঁরও শিষ্য এ্যারিস্টটলÑ তাঁদের ছিল না কোনো প্রাসাদ, বিপুল রতœসম্ভার, বিশাল সম্পত্তিÑ কিন্তু যা ছিল তা হলো হৃদয়ের ঐশ্বর্য, জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার এবং সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার দুর্দমনীয় অভিপ্রায়। তাঁরা গড়েছেন বিদ্যাপীঠ, সৃষ্টি করেছেন একঝাঁক আলোকিত মানুষ, ব্যাপ্তি ঘটিয়েছেন মানবতার। আজও তাঁদের নাম আমরা স্মরণ করি শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে এবং নিবেদন করি আমাদের হৃদয় নিঙড়ানো কৃতজ্ঞতা। তাঁরা বেঁচে আছেন আমাদের চিন্তায়, চেতনায়, মননে। পক্ষান্তরে, ওনাসিস বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে গেছেন। তাঁর ধনৈশ্বর্য তাঁকে নান্দিপাঠের যোগ্য করে তোলেনি। এ ঘটনার পাদটীকা হিসাবে উল্লেখ করা যায় যে, সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর হাতেগড়া বিদ্যাপীঠের মধ্য দিয়ে প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
মাঝখানে প্রায় একটি দশক অতিক্রান্তের পর আবারও সুযোগ হলো সৈয়দ আবুল হোসেনের সান্নিধ্য লাভের। এবার তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় মন্ত্রী। আমি যুগ্ম-সচিব। অনেক শিক্ষণীয় ঘটনা আমার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে সঞ্চিত হতে থাকলো। একটি ঘটনার উল্লেখ করেই এই লেখনির যবনিকাপাত ঘটাবো। ২০০৯-এর সেপ্টেম্বর/অক্টোবর-এর দিকে মন্ত্রী মহোদয় সরকারি সফরে দক্ষিণ কোরিয়া হতে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করলেন। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে হতে রাত প্রায় তিনটা। বিমানবন্দরে আমাদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। আমরা অনেকেই ধরে নিয়েছিলাম যে, হয়ত তাঁর পরের দিন নিত্যকার অভ্যাসমতো সকাল নয়টার মধ্যে সকল কর্মকর্তাদের সাথে মন্ত্রী মহোদয়ের যে দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা হওয়ার কথা, তা হবে না। ফলে আমার মতো বেশ কয়েকজন রাতের ক্লান্তি-শ্রান্তির কারণে সকাল নয়টার বেশ পরে মন্ত্রী মহোদয়ের কক্ষে উপস্থিত হই। আর তখনই বিস্ময়ের ধাক্কা। জানলাম মন্ত্রী মহোদয় নিত্যকার অভ্যাসের কোনো ব্যত্যয় ঘটাননি। অর্থাৎ তিনি সকাল নয়টার পূর্বেই অফিসে উপস্থিত হয়েছেন। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যিনি সর্বদাই কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে চলে এসেছেন, সাফল্যের সোনালি সবুজ হরিণ তো তাঁরই করায়ত্ত্বে থাকবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বহুমাত্রিক কাজের মধ্যে নিমগ্ন সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর প্রচণ্ড ধীশক্তির প্রমাণ রাখবেন, দেশবাসীর মনের আশা আকাক্সক্ষার সফল বাস্তবায়ন ঘটাবেন, সেই অনাগত দিনের প্রতীক্ষায় আমরা সবাই। এক সময়ে যিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ শেরপা, তাঁর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছেন হাজারো দৃঢ় চিত্তের অভিযাত্রী। এই অনন্য সাধারণ ব্যক্তির প্রতিভা ও কর্মযজ্ঞ সূর্যালোকের ন্যায় চতুর্দিকে বিস্তৃত হবে, সতত বিভাময় হয়ে থাকবেন, এই শুভ কামনায়।

মোহাম্মদ মোস্তফা : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম-সচিব

বহুমাত্রিক প্রজ্ঞা
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ
বহুগুণের অধিকারী আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। তিনি একাধারে একজন প্রজ্ঞামণ্ডিত সংসদ সদস্য, দেশের একজন অগ্রণী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, খ্যাতিমান শিক্ষানুরাগী, সুলেখক, সুবক্তা এবং রাজনৈতিক গবেষক ও বিশ্লেষক। সৈয়দ আবুল হোসেন ১৯৫১ সালে মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আতাহার আলী এবং মাতার নাম সৈয়দা সুফিয়া আলী। তিনি হযরত শাহ আলী বাগদাদী (রঃ), যাঁর মাজার ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত, তাঁর অধস্তন বংশধর। তাঁর পিতা মরহুম হযরত আলহাজ্ব সৈয়দ আতাহার আলী একজন পরোপকারী ধর্মপ্রাণ সুফি সাধক হিসেবে এলাকার আপামর মানুষের গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র ছিলেন। আবুল হোসেন বরাবরই কৃতী ছাত্র ছিলেন। তিনি ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে পঞ্চম শ্রেণি, গৈলা হাই স্কুল হতে মেট্রিক এবং গৌর নদী কলেজ হতে বিএ পাশ করেন।
১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে তিনি বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। গতানুগতিক সরকারি চাকুরির দিকে না-ঝুঁকে তিনি ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তোলেন সাকো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। যা আজ দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশে ও বিদেশে পরিচিত।
আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন চীনের হাইনান প্রদেশের বোয়াওতে জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, বাংলাদেশসহ এশিয়ার ২৬টি দেশ নিয়ে গঠিত অর্থনৈতিক সহযোগিতা ফোরাম ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ২০০৫ সালে তিনি এ ফোরামের স্পোকস পারসন নির্বাচিত হন।
ঢাকা বাণিজ্য ও শিল্প অনুষদ এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাথে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা বিভাগ এলামনি এসোসিশনের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। সাকো ডেভেলপমেন্ট সেন্টার নামে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সাহায্য সংস্থার তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মানবদরদি মহানুভব সমাজসেবী হিসেবে তার রয়েছে দেশজোড়া খ্যাতি। মধ্য আশির দশকে উড়িরচর ও মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়ায় এবং ১৯৮৮ সালের মহাপ্লাবনের সময়ে মাদারীপুরে তিনি দুস্থ মানবতার সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছিলেন স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে। ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় এবং সেই সময়ে ময়মনসিংহের সাইক্লোন দুর্গতদেরও তিনি উদার হস্তে সাহায্য করেছিলেন। সৈয়দ আবুল হোসেন স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন দেশে শিক্ষাবিস্তার ও নিরক্ষরতা দূরীকরণে তাঁর মহতী উদ্যোগের জন্য। অগণিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিনি দাতা ও প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৮৯ সালে মাদারীপুর জেলার খোয়াজপুরে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থানুকূল্যে স্থাপিত হয় সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ; যা শিক্ষার মান, পরিবেশ ও ফলাফলের দিক দিয়ে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় ভূষিত। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তির জন্য সেখানে তারই অর্থে ছাত্রবৃত্তি তহবিল চালু রয়েছে। তাঁর আরেকটি সুকীর্তি কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ। তাঁর অক্লান্ত প্রয়াসে দেশের থানা পর্যায়ের বেসরকারি কলেজগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীত হয়েছে। তাঁর নিজস্ব গ্রামে ডাসারের মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে সেখানে অবস্থিত ডি কে আইডিয়াল একাডেমিকে তিনি কলেজে উন্নীত করেন সম্পূর্ণ নিজ অর্থায়নে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এখন তাঁর মরহুম পিতার স্মৃতিবাহী ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজে রূপান্তরিত। মাদারীপুর জেলার মধ্যে একমাত্র এখানেই বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক শাখা ছাড়াও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা কোর্স চালু রয়েছে।
তাঁর এলাকায় তিনি শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছেন। এসব বিদ্যালয়ের কমিউনিটি পার্টিসিপশনের অংশ হিসেবে প্রতিটি বিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত সমুদয় অর্থ এলাকার জনগণের পক্ষ থেকে তিনি নিজ তহবিল থেকে দান করেছেন। পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজটির ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের বাসস্থানও নিজ অর্থে প্রতিষ্ঠা করেছেন। শিক্ষক সমাজকে তিনি সবসময়েই অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকেন। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ১৯৯৪ সালের ঢাকার রাজপথে অবস্থান ধর্মঘটের সময় তিনি তাদের জন্য তাঁবু ও খাবার-দাবারের আয়োজন করেন। একজন শিক্ষক ইন্তেকাল করলে তিনি তাঁর সন্তান-সন্ততির শিক্ষা ও পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে অর্থায়নের ব্যবস্থা করেন। যা দেশবাসীর সামনে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। তিনি ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে মাদারীপুর-৩ নির্বাচনী এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের প্রাথী হিসেবে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এলাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা কিংবদন্তির মতো। তাঁর মহানুভবতা, দানশীলতা, শিক্ষানুরাগিতা ও মানবদরদি সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডের স্বাক্ষর ছড়িয়ে রয়েছে কালকিনি-মাদারীপুরের সর্বত্র। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যে শিখা তিনি প্রজ্বলিত করেছেন তার আলোয় তাঁর নির্বাচনী এলাকা আজ আলোকিত।
আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন পঞ্চম জাতীয় সংসদে অর্থ ও বাণিজ্য বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দয়িত্বও পালন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু তথ্য কেন্দ্রের কোষাধ্যক্ষ। সংসদে তিনি একজন প্রতিভাবান ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। ছাত্রজীবনে তিনি কিছুদিন ‘দি পলিটিশিয়ান’ নামে রাজনীতিক বিশ্লেষণধর্মী একটি মাসিকের সম্পাদনা করেন। দেশের প্রথম শ্রেণির জাতীয় দৈনিকসমূহে ইংরেজি ও বাংলায় তাঁর রচিত রাজনৈতিক অর্থনৈতিক গবেষণাধর্মী নিবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে থাকে।
আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন একজন মননশীল গ্রন্থকার হিসেবে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত। লেখক ছাড়াও তিনি সাহিত্যানুরাগী হিসেবে অনেক কবি-সাহিত্যিককে গ্রন্থ প্রকাশে সহায়তা করেছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সমাজ চিন্তামূলক অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে :
১. স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
২. শেখ হাসিনা সংগ্রামী জননেত্রীর প্রতিকৃতি
৩. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন
৪. গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট
৫. আওয়ামী লীগের নীতি ও কৌশল- শিল্পায়ন ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশ
৬. শেখ হাসিনার অক্ষয় কীর্তি- পার্বত্য শান্তিচুক্তি
৭. বঙ্গ জননী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব
৮. শেখ হাসিনার অসামান্য সাফল্য এবং
৯. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুবর্ণ জয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ
১৯৯৬ সালের ২৩ জুন গণতন্ত্রের মানসকন্যা সাবেক প্রধানমনত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রীসভায় আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। মন্ত্রণালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি সর্বপ্রথম কর্পোরেট কালচার প্রবর্তনের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত গতিশীলতা আনয়ন করে সকল মহলের অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করেন। আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন সপ্তম সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিরও একজন সদস্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
তাঁর সহধর্মিণী বেগম খাজা নার্গিস হোসেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সুফি সাধক হযরত খাজা এনায়েতপুরী (রঃ)-এর পৌত্রী ও এনায়েতপুর দরবার শরীফের বর্তমান গদিনশিন পির হযরত খাজা কামাল উদ্দিন সাহেবের কন্যা। সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন ও সৈয়দা ইফফাত হোসেন নামে তাঁদের দুটি কনা সন্তান রয়েছে। তারা উভয়ে অত্যন্ত মেধাবী এবং আমেরিকার খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চ ডিগ্রিধারী।
সৈয়দ আবুল হোসেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছেন। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বাসে অনুষ্ঠিত বিশ্ববাণিজ্য সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্ব করেন। একই বছর জাপানে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সোস্যাল ডেমোক্র্যাট সম্মেলনে তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে তাঁর মিডিয়া কভারেজের সার্বিক দায়িত্ব পালন করে দেশব্যাপী বিপুল সাড়া জাগান। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে আয়োজিত শিশু সংক্রান্ত সেমিনারের তিনি সফল উদ্যোক্তা। তিনি সমাজসেবা ও শিক্ষানুরাগিতার স্বীকৃতিস্বরূপ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। অমায়িক, ভদ্র, সজ্জন, পরোপকারী, দয়ালু ও দানশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাদৃত।

সিরাজ উদ্দীন আহমেদ : বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, প্রাক্তন সদস্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ইতিহাসবেত্তা, গবেষক, কলামিস্ট। লেখাটি মাদারীপুরের ইতিহাস গ্রন্থ হতে সংগৃহীত।

সময়ের বরপুত্র
ড. হাসমত আলী
রবিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১০ দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার পঞ্চম পৃষ্ঠার প্রথম কলামে ‘যানজটে পড়ে যোগাযোগ মন্ত্রীর পদযাত্রা’ হেডিং দিয়ে প্রকাশিত ষাট শব্দের ছোট কিন্তু আকর্ষণীয় খবরটি এক নিশ্বাসে পড়ে নিলাম-
‘শনিবার বেলা একটা সার্ক ফোয়ারার প্রতিবিম্বিত সূর্যরশ্মি ঝিলিক দিয়ে ফিরছে চোখ থেকে চোখে। রোদ-গরমে বিপর্যস্ত পথচারীরা যখন আপন
গন্তব্যমুখী তখন পান্থপথ মোড়ের চারটি রাস্তা জুড়েই গতিহীন গাড়ির বহর। শাহবাগের দিক থেকে আসা যোগাযোগ মন্ত্রীর গাড়িটিও সামিল সে স্তব্ধ মিছিলে। সময়-সচেতন মন্ত্রী হাঁটতে শুরু করলেন গাড়ি থেকে নেমে। কৌতূহলী দৃষ্টি আর অম্ল-মধুর পথিকবাণী ছাপিয়ে তিনি পৌঁছে গেলেন ইউটিসি ভবনের গন্তব্যে।’
খবরটি আমাকে আমার দিকে নজর দেয়ার ফুরসত এনে দিল। ঘড়ির দিকে তাকালাম, বাসা হতে আমার চেম্বার এক কিলোমিটার, গাড়িতে বসে আছি বাইশ মিনিট আরও কতক্ষণ লাগবে জানি না। মানুষের জীবনে সময়ের বড় অভাব। এ সময় বাঁচানোর জন্যই আবুল হোসেন গাড়ি হতে নেমে পায়ে হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওয়ানা দিয়েছেন। বন্ধুরা অনেকে খবরটি পড়ে অবাক হয়েছেন। বাংলাদেশে এমন ঘটনা ইতোপূর্বে ঘটেনি।
বন্ধুরা অবাক হলেও আমি অবাক হইনি, কারণ লোকটি সৈয়দ আবুল হোসেন। সময়নিষ্ঠ আবুল হোসেন সময়ের জন্য, সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছার জন্য গাড়ি কেন সব কিছু ছেড়ে দিতে পারেন। যে দূরত্ব হেঁটে গেলে লাগে দশ মিনিট; সে দূরত্ব গাড়িতে গেলে কত সময় লাগবে তা কেউ বলতে পারে নাÑ এ ঢাকা শহরে। লাগতে পারে পাঁচ মিনিট আবার এক ঘণ্টা কিংবা দেড় ঘণ্টা অথবা আরও বেশি। তারপরও আমরা গাড়ি ছাড়তে নারাজ। সবাই গন্তব্যে পৌঁছোতে চায় কিন্তু সময়ের দিকে খেয়াল রাখে না। যাত্রাপথে সময় শেষ করে গন্তব্যে পৌঁছা যে অর্থহীন, সেটি আমরা অনেকে বুঝি না এবং তাই আমাদের সময় খেয়ে ফেলে অসময় নামক দৈত্য।
সৈয়দ আবুল হোসেন শুধু গন্তব্যে পৌঁছোতে চান না, আবশ্যিকভাবে যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছোতে চান। তাঁর কাছে উপায়টা মুখ্য নয়, যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোটায় মুখ্য। এজন্য তিনি মন্ত্রী হয়েও গাড়ি হতে নেমে সানন্দে পায়ে হেঁটে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পারার মতো অনবদ্য মানসিকতার অধিকারী। ঐ দিন গাড়ি চড়ে আরাম করে শীতাতপ যন্ত্রের হাওয়া খেয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বসে থাকলে গন্তব্যে পৌঁছোতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগত।

জীবন থেকে অযথা চলে যেত একটি ঘণ্টা। ঐ সময়টা তিনি কীভাবে ফেরত পেতেন? যাদেরকে সময় দিয়েছেনÑ তাদের কাছে কী জবাব দিতেন তিনি?
পত্রিকা বলেছে- কৌতূহলী দৃষ্টি আর অম্লমধুর পথিকবাণী নিয়ে আবুল হোসেন গন্তব্যে পৌঁছেছেন। পথিকরা কী বাণী দিয়েছিলেন সেদিন? হয়ত বলেছেন- আপনি যোগাযোগ মন্ত্রী, যানজটের জন্য আপনিই দায়ী, এবার বোঝেন মানুষ কত কষ্টে আছে। কেউ-বা বলেছেন- চমৎকার মাননীয় মন্ত্রী, আপনি সময়নিষ্ঠতার যে উদাহরণ দেখালেন, তা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকল।
যানজটের জন্য কী যোগাযোগ মন্ত্রীকে একা দায়ী করা উচিত? বর্তমান বিশ্বে কারও পক্ষে এককভাবে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কথাটি আরও অনেক বেশি প্রযোজ্য। ঢাকা শহরে মানুষ বাড়ছে, মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে উঠছে ভবন- এক তলা হতে ঊনিশ তলা, তারও বেশি কিন্তু রাস্তা তো আর ঊনিশ তলা করা যাচ্ছে না। তাহলে যানজট কমবে কীভাবে? রাস্তার দু’পাশের ফুটপাথ হকারদের দখলে। ট্রাফিক আইন মানে না অনেকে। আগে যাবার জন্য তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যানজট পরিণত হচ্ছে মহা যানজটে। প্রতিদিন নামছে হাজার হাজার গাড়ি। সরকার কোনো কঠিন কার্যক্রম গ্রহণ করলে বিরোধী দল তা পুঁজি করে আন্দোলন পাকানোর তালে থাকে। এ অবস্থায় যোগাযোগ মন্ত্রী একা কীভাবে যানজট নিরসন করবেন?
যোগাযোগ মন্ত্রী গাড়ি হতে নেমে হেঁটে চললেন দেখে যানজটের লম্বা স্থিরতায় স্তব্ধ অন্য গাড়ির যাত্রীরাও গাড়ি হতে নেমে হাঁটতে শুরু করলেন- খবরটিতে যদি এমন তথ্য থাকত তাহলে কেমন হতো? কিছু হতো না; বাংলাদেশ এমন ঘটনা কখনও ঘটবে না কারণ, এ দেশে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো সময়নিষ্ঠ ও কর্মনিষ্ঠ মানুষ খুব একটা বেশি নেই। নইলে এ রকম হেঁটে যাবার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটত ফলে খবর হতো না। সৈয়দ আবুল হোসেন ব্যতিক্রমী মানুষ, তাই ব্যতিক্রমী কাজ করতে পেরেছেন। তিনি আমাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, নিষ্ঠাবানদের লক্ষ্য ও যাত্রাপথে কোন কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক যে, আবুল হোসেন কিন্তু এর আগেও বহুবার এমন করেছেন, যা সাংবাদিকদের চোখ এড়িয়ে গেছে।
প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন খুব প্রত্যন্ত একটি গ্রামের সাধারণ অথচ সম্ভ্রান্ত একটি পরিবারে সৈয়দ আবুল হোসেনের জন্ম। তিনি এখন বড় ব্যবসায়ী এবং একজন মন্ত্রী। এতদূর ওঠার পেছনে কেবল সময়নিষ্ঠতা ও অবিরাম কর্মাগ্রহতা তাকে সাহায্য করেছে। তিনি সময়কে মূল্য দিয়েছেন, বিনিময়ে সময় তাকে দিয়েছে সমৃদ্ধি। সমৃদ্ধি মানুষকে যেমন সমৃদ্ধ করে তেমনি আবার করে দিতে পারে নিঃস্ব। সমৃদ্ধি যদি মালিকের মনিব হয়ে যায়, তাহলে সে ব্যক্তি ভৃত্যের মতো নিঃস্ব হয়ে যায়। সৈয়দ আবুল হোসেন প্রচুর অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার মালিক, তবে এগুলোকে তিনি নিজের মনিব হতে দেননি বরং তিনি নিজে এগুলোর একচ্ছত্র মনিব হয়ে থাকতে পেরেছেন। ফলে সমৃদ্ধি তাঁকে করেছে সমৃদ্ধতর। যারা অর্থ আর ক্ষমতার মালিক হয়ে এগুলোর গোলাম হয়ে গেছেন, তারা দাসানুদাস নিঃস্ব।
সৈয়দ আবুল হোসেন দারুণ অমায়িক মানুষ। দেখামাত্র প্রাণখোলা হাসিতে মুখটা সকালের আলোর মতো উদ্ভাসিত করে এগিয়ে আসেন উজাড় করা শ্রদ্ধায়। বিনয়ের সাথে সালাম দিয়ে আন্তরিক কণ্ঠে বলে ওঠেন: কেমন আছেন… ভাই? বুকটা ভরে ওঠে মমতায়। সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যবহার যেমন আভিজাত্যপূর্ণ, তেমনি ব্যক্তিত্বময়। আভিজাত্য আর ব্যক্তিত্বের সাথে যুক্ত ছিল বিনয় মিশ্রিত সৌজন্যবোধ আর ভদ্রতা। ফলে, পুরো আবুল হোসেন পরিণত হয়েছিল একজন চমৎকার মানুষে।
জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই, আর সময় হচ্ছে জীবনের অণু-পরমাণু। যে ব্যক্তি সময়কে অবহেলা করল সে জীবনকে অবহেলা করল, সমাজকে অবহেলা করল। আত্মহত্যা করা আর সময়কে নষ্ট করা এক কথা। সবকিছু ফিরে আসে কিন্তু জীবন আর সময় কখনও ফিরে আসে না। সময়কে ঘিরে সবকিছু আবর্তিত। সময়কে অবহেলা করা মানে সবকিছুকে অবহেলা করে। সৈয়দ আবুল হোসেন সময়কে অবহেলা করতে পারেন না বলে কোনো কিছুকে অবহেলা করতে পারেন না। আমরা যদি সবাই সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো সময়কে মূল্য দিতে পারতাম তাহলে কতই-না ভালো হতো। কেমন হতো যদি গাড়ি ছেড়ে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যাবার অভ্যাস করি, যেখানে প্রতিবন্ধকতা সেখানে থেমে না-থেকে অন্য উপায় খুঁজে বের করি। কেমন হবে বড় বড় আলিশান দামি গাড়ি ছেড়ে পদব্রজে কিংবা সাইকেল নিয়ে রওয়ানা দেই!!

ড. হাসমত আলী: এমবিবিএস, পিএইচডি, নিউরোসার্জন এবং সহকারী অধ্যাপক, উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হাসপাতাল, গবেষক ও ইতিহাসবেত্তা। যানজটের দিন সৈয়দ আবুল হোসেনের পায়ে হেঁটে যাওয়ার একজন প্রত্যক্ষদর্শী।

ম্যাগনেটিক ব্যক্তিত্ব
ফরহাদ রহমান
আমার বন্ধু ও সহকর্মী উপ-সচিব মজিবুর রহমান ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেনের সহপাঠী। তিনি ১৯৯৭ সালের প্রথম দিকে একদিন আমাকে মতিঝিলের আমিন কোর্টে সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালে নিয়ে যান। আধুনিক ও রুচিশীল আসবাবে চমৎকারভাবে সজ্জিত বড়সড় একটি কক্ষে সৈয়দ আবুল হোসেন প্রধান নির্বাহীর নির্দিষ্ট চেয়ারে উপবিষ্ট। মজিবুর রহমান আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। নবাগত হলেও আমার প্রতি তাঁর আগ্রহ ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার আমার জড়তাকে স্বতঃস্ফূর্ততায় পরিণত করল। অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং নিখুঁত দেহাবয়ব আমাকে প্রথম দর্শনে মুগ্ধ করে দিল। তাঁর অফিসে অনেক লোকের ভিড়। এলাকার মানুষ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এসেছেন। এক-একজন করে দেখা করছেন এবং সৈয়দ আবুল হোসেন প্রত্যেককে ধৈর্য সহকারে শুনে সমাধান দিয়ে যাচ্ছেন। আধ ঘণ্টা যাবৎ বসে বসে তাঁর কাজকর্ম দেখছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। কত সমস্যা, কত অভিযোগ, কত লোকের কথা শুনতে হচ্ছে- তবু কোনো বিরক্তি নেই, বরং চোখেমুখে দীপ্তি। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলামÑ মানুষকে ভালোবাসতে হলে কত ধৈর্য থাকতে হয়।
সংসদ সদস্যগণ সাধারণত ত্রাণ, কাবিখা, গম-চালের বণ্টন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল ইত্যাদি নিয়ে অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকেন, এমন একটি অভিযোগ প্রায়শ শোনা যায়। এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। এখানে দেখলাম ভিন্ন পরিবেশ, যে জনগণের ভোটে সৈয়দ আবুল হোসেন সংসদ সদস্য, সে জনগণের প্রতি তাঁর ভালোবাসাময় দায়বদ্ধতা আব্রাহাম লিংকনের সে বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতার বিখ্যাত উক্তিটার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ধহফ ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব.’, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এলাকার উন্নয়ন ছাড়া আর কোনো বিষয়ই তার কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে উন্নত করা যায়, কীভাবে নিশ্চিত করা যায় কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা, কোন কৌশল অবলম্বন করলে এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নতি হবে, কীভাবে জনকল্যাণ আরও পরিব্যাপ্ত করা যায়Ñএগুলোই ছিল আলোচনার বিষয়। দু’একজন লোক গম-চালের বরাদ্দ নিয়ে আলাপ উত্থাপন করতে গিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের নিরুৎসাহ দেখে থেমে যেতে বাধ্য হচ্ছিলেন। আমার খুব ভালো লাগলÑ একজন দূরদর্শী ও শিক্ষানুরাগী এমপি দেখে, যিনি জাতির সার্বিক উন্নয়নকল্পে শিক্ষাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে দেশকে প্রকৃত অর্থে এগিয়ে নেবার মহান তপস্যায় রত।
১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসে জেলাপ্রশাসক হিসেবে আমার মাদারীপুর বদলি হয়। সৈয়দ আবুল হোসেন সংসদ সদস্য, কিছু দিন আগেও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। মতিঝিল আমিন কোর্টে তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করতে যাই। ‘জেলাপ্রশাসক হিসেবে মাদারীপুর জেলায় বদলি হয়েছে শুনে তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন। বললাম, ‘আমি যাচ্ছি, আপনার দোয়া নিতে এসেছি।’ তিনি বললেন, ‘আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনার প্রতি আমার একটা অনুরোধ আছে। আপনাকে আমার এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব নিতে হবে।’ উল্লেখ্য, তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নীতিমালা অনুযায়ী স্থানীয় সংসদ সদস্য কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের চেয়ারম্যান হতেন। বললাম, ‘আপনি চেয়ারম্যান, আপনার নেতৃত্বে আমি কাজ করে যাব।’ তিনি বললেন, ‘কর্তৃত্ব না-দিলে কর্তব্যপরায়ণতায় মন উজ্জীবিত হয় না। ব্যবসা, রাজনীতি, সংসদ সদস্য ইত্যাদি নানাবিধ কাজে আমাকে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভালোভাবে দেখভাল করা সম্ভব হচ্ছে না। এগুলোর আরও নিবিড় পরিচর্যা প্রয়োজন। আপনাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে, আপনি পারবেন। আমি আপনাকে সর্বোতভাবে সাহায্য করব। যখন প্রয়োজন তখনই যোগাযোগ করবেন। আমি বরং খুশি হব।’
এখানে আর একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, আমার যখন বদলি হয় তার কিছুদিন পূর্ব হতে রাজনৈতিক কারণে মাদারীপুরের আইন-শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছিল। ডিসি-এসপি অবরুদ্ধ। এ অবস্থায় মাদারীপুর গিয়ে কতটুক সফল হতে পারব তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম। তবে আমার মনোবল ছিল- আমি একটা রূপকল্প নিয়ে মাদারীপুর যাচ্ছি। যে কোনো পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণভাবে মোকাবেলা করার দৃঢ়তা আমাকে সফল হবার প্রত্যয়ে সাহসী করে তোলে। সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছ হতে বিদায় নিয়ে আমি মাদারীপুর চলে যাই।
প্রথমে আমার উপর মাদারীপুরের অশান্ত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার দায়িত্ব বর্তায়। এ সময় মাননীয় সংসদ সদস্য সৈয়দ আবুল হোসেনের নিকট হতে যে নির্দেশনা পেয়েছি, তা আমাকে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত অনুকূল পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। তিনি একজন রাজনৈতিক নেতা, জেলার রাজনৈতিক কোন্দলে তাঁর পক্ষ-বিপক্ষ থাকাই ছিল স্বাভাবিক। আমি অবাক হয়ে দেখলাম তিনি, রাজনৈতিক কোন্দাল ও হানাহানিতে কিংবা পক্ষ-বিপক্ষে অংশ না নিয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে অশান্ত পরিস্থিতি নিরসনে আমাকে উপদেশ দিয়েছেন। অনেক সংসদ সদস্য স্বীয় সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষার্থে কিংবা রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য প্রতিপক্ষকে ঘায়েল, মিথ্যা মামলা, কোন্দল, হানাহানি, প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার ইত্যাদি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকেন। সৈয়দ আবুল হোসেনকে এরূপ কর্মকাণ্ড করা দূরে থাক, কখনও এসব বিষয়ে চিন্তা করতেও দেখিনি। এমন উদারমনা রাজনীতিবিদ আমি আর দেখিনি।
জেলাপ্রশাসক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করার অল্প কিছুদিন পর শিক্ষা অধিদপ্তর হতে একটি আদেশ আসে। ঐ আদেশে আমাকে কালকিনির কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। সৈয়দ আবুল হোসেন এমপি-এর বিশেষ অনুরোধে অধিদপ্তর এ আদেশ জারি করেছে। যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হবার জন্য সংসদ সদস্যগণ অস্থির হয়ে থাকেন, সেখানে নিজের অর্থ-শ্রমে গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সভাপতির পদ জেলাপ্রশাসকের হাতে তুলে দেয়ার মতো মানসিকতা কত বড় মহানুভবতার পরিচায়ক, তা সহজে অনুমেয়।
বাংলাদেশে একমাত্র সৈয়দ আবুল হোসেনের উপজেলা কালকিনিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরিদ্র কৃষক ও মেহনতি মানুষের সন্তানেরা লুঙ্গি পরে পাকা রাস্তার উপর দিয়ে হেঁটে প্রথম শ্রেণি হতে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নামমাত্র খরচে অর্জন করতে পারে। মেধাবী ছাত্রছাত্রী হলে কোনো কথা নেই। তারা অনেকে শুধু ফ্রি পড়ে না, বরং সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যক্তিগত শিক্ষা তহবিল হতে গোপনে আর্থিক সাহায্য পেয়ে থাকেন। শিক্ষার উন্নয়নে এর মাধ্যমে তাঁর এলাকার যোগাযোগ ও শিক্ষার অবস্থা সহজে অনুমেয়। কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ; ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এন্ড কলেজ; শেখ হাসিনা উইমেন্স কলেজ এন্ড একাডেমি; খাসের হাট বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ; ডাসার সৈয়দ আতাহার আলী এবতেদায়ি মাদ্রাসা এবং মাদারীপুর জেলার প্রত্যন্ত খোয়াজপুরে প্রতিষ্ঠিত কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে সৈয়দ আবুল হোসেনের নিজ অর্থে গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে অন্যতম। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের আরও ৩৮ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার আর্থিক অনুদানে ফিরে পেয়েছে নব জীবন। কালকিনির প্রাথমিক শিক্ষার ভিতকে মজবুত ও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি পার্টিশিপশনের ভিত্তিতে শতাধিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন।
শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সৈয়দ আবুল হোসেনের অবদান মাদারীপুরবাসী কখনও ভুলতে পারবে না। মাদারীপুর মহিলা হ্যান্ডবল দলের একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হবার পেছনে সৈয়দ আবুল হোসেনের সাহায্য-সহযোগিতার আমি প্রত্যক্ষ সাক্ষি। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি হিসেবে তাঁর কাছ হতে আমি যা পেয়েছি সেটি বিস্ময়কর। দাতার মর্যাদা রক্ষার্থে নাই বা বললাম। তিনি কতভাবে কত ক্ষেত্রে কত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দান করেছেন তারও কোনো হিসাব নেই। যথাসম্ভব সব দান তিনি গোপন রাখার চেষ্টা করেন, তবু কিছু কিছু প্রকাশ পেয়ে যায়। যেমন প্রকাশ পেয়ে যায় গভীর অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে ফুটে ওঠা ফুলের সুভাস। শকুনি লেক-এর পাশে সার্কিট হাউজের সামনে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে মাদারীপুর শহিদ মিনার। এ শহিদ মিনার প্রতিষ্ঠায় অনেকের অবদান রয়েছে। তবে এককভাবে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন সৈয়দ আবুল হোসেন। এ কথা অনেকে জানেন না। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে আমি এ শহিদ মিনার উদ্বোধন করি।
অনেক রাজনৈতিক নেতার আক্ষেপ, সরকারি কর্মকর্তাগণ কাজ করেন না, কথা শোনেন না। যারা এমন বলেন তাদের কাছে বিনম্র অনুরোধ- সৈয়দ আবুল হোসেনের দিকে দৃকপাত করুন। দেখবেন কাজ কীভাবে হয়ে যায়। সৈয়দ আবুল হোসেনের মাধুর্যময় ব্যবহারের কারণে কর্মকর্তাগণ শুধু কাজ নয়, জীবন দিতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। আমি জেলপ্রশাসক, তিনি সংসদ সদস্য। পদমর্যাদার আকাশ-পাতাল তফাৎ। তবু তাঁর আচরণে আমি কোনোদিন সামান্য অহমিকা অনুভব করতে পারিনি। মনে হতো একজন শুভাকাক্সক্ষী বন্ধু। সুললিত গলায় কখনও ‘ডিসি সাহেব’ আবার কখনও ‘ফরহাদ ভাই’ সম্বোধন করে মনের মধ্যে এমন একটি ঝড় তুলে দিতেন যে, সব কিছু ছেড়ে ইচ্ছে করত তাঁর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো উৎসাহ উদ্দীপনা আর স্নেহের পরশ পেলে কুম্ভকর্ণের মতো অলস আমলাও পিঁপড়ের মতো অবিরাম শ্রমে নিজেকে উৎসর্গীত করার প্রতিযোগিতায় নামবেন।
মাদারীপুর জেলাপ্রশাসক হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনের পরশ আমাকে এতই মুগ্ধ করেছিল যে, আমি স্বীয় দায়িত্বে এমন আত্মমগ্ন হয়ে পড়েছিলাম যে, নিজের কথা পর্যন্ত ভুলে যাই। কালকিনি উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব আমার কর্তব্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠি, যেভাবে হোক সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তার মর্যাদা রাখতে হবে। আমি যখন তাঁর এলাকায় কর্মে নিয়োজিত তখন আমার বড় ছেলে সিজার ঢাকায় বিবিএ পড়ছে। এ অবস্থায় প্রায় সময় সৈয়দ আবুল হোসেন আমার ছেলেকে ফোন করতেন। বলতেন, তোমার বাবা আমার এলাকার স্কুল কলেজ নিয়ে রাতদিন পরিশ্রম করছেন। আমার উচিত তোমাদের খোজ খবর নেয়া, তোমার লেখাপড়া কেমন হচ্ছে বাবা? ছেলের কাছে যখন এমন মহানুভবতার কথা শুনতাম, আমি আরও বিগলিত হয়ে যেতাম তাঁর প্রতি। চোখের কোণ ডুবে যেত জলে। নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আরও নিষ্ঠাবান হবার প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠতাম।
সবচেয়ে আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করেছি তাঁর উদারতা। এমন উদার মানুষ বাংলাদেশে আর কয়জন আছে আমার জানা নেই। কেউ তাঁর কাছ হতে খালি হাতে ফিরে গেছেন, এমন কোনো ঘটনা কেউ বলতে পারবেন না। অনেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাঁর এ উদারতার সুযোগ নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একটি বহুল শ্র“ত ঘটনা উল্লেখ করছি। জনৈক ব্যক্তির লাশ পরিবহন ও দাফন-কাফনের জন্য কয়েকজন লোক সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে সাহায্য চাইতে আসেন। সৈয়দ আবুল হোসেন স্বভাবসুলভ সরলতায় তাদেরকে কাক্সিক্ষত অর্থ প্রদান করে বিদায় করেন। কয়েক বছর পর এক অনুষ্ঠানে সৈয়দ আবুল হোসেন দেখলেন- সেদিন যে লোকটির লাশ পরিবহন ও দাফন-কাফনের জন্য তাঁর কাছ হতে টাকা নেয়া হয়েছিল, সে লোকটি দিব্যি আরামে হাঁটছেন। তিনি এ বিষয়ে সাহায্যপ্রার্থীদের কিছু বলেননি। শুধু মুচকি হেসেছিলেন।
কার্য, কৌশল, অবস্থান ও প্রশাসনিক কারণে জেলাপ্রশাসক হিসেবে একজন সংসদ সদস্যকে জানার যে সুযোগ, তা আর কারও পক্ষে সম্ভব হয় না। জেলাপ্রশাসক হিসেবে আমি প্রায় তিন বছর সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রত্যক্ষ করেছি। এ তিন বছরে একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে, একজন সংসদ সদস্য হিসেবে, সর্বোপরি, একজন মানুষ হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনের যে মহানুভবতা প্রত্যক্ষ করেছি তা প্রতিনিয়ত আমাকে শিহরিত করে, বিনীত করে দেয় তাঁর প্রতি অবনত সম্মানে।
সৈয়দ আবুল হোসেন এমন একজন মানুষ, যাঁকে বিভিন্ন কৌশলে শত চেষ্টা করেও রাগানো যায় না। অনেক বার চেষ্টা করেও তাঁকে কেউ রাগাতে পারেননি। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার অদ্ভুত ক্ষমতা তাঁর চরিত্রে মহামানবের স্নিগ্ধতা এনে দিয়েছে। কালকিনিতে সৈয়দ আবুল হোসেন একটা সভায় যোগদান করতে এসেছেন। সভার পূর্বে একটি কক্ষে বসে কলেজের উন্নয়ন সম্পর্কে আমার সাথে আলোচনা করছেন। সে সময় কয়েকজন লোক এসে তাঁর কাছে অভিযোগ করলেন যে, একজন লোক সৈয়দ আবুল হোসেনের নিন্দা করছেন। তারা এমনভাবে কথাগুলো বলেছিলেন যেন, সৈয়দ আবুল হোসেন উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তিনি উত্তেজিত হলেন না, কোনো পরিবর্তনও তাঁর চোখেমুখে দেখা গেল না। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, তোমরা যাও। বিষয়টা আমি দেখব। বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি অভিযোগকারী আর নিন্দুকদের জবাব দিলেন: আমাকে যারা ভালোবাসেন, তার শুনে রাখেন, যারা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেন, তারা আমার গায়ের ময়লা তাদের নিজের শরীরে মেখে নিয়ে আমাকে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। এতে আপনাদের খুশি হবার কথা, মন খারাপ করার প্রশ্নই আসে না। মনে রাখবেন- নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো; যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো।
তিনি একজন ম্যাগনেটিক ব্যক্তিত্ব। একবার তাঁর কাছাকাছি গেলে আর দূরে যাওয়া যায় না। তার ম্যাগনেটিক ব্যক্তিত্বের কাছে আকৃষ্ট না-হয়ে থাকতে পারেন এমন কোনো লোক আমি দেখিনি। ভালোবাসার শক্তি যে কত প্রবল, কত স্থায়ী তা আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছেই শিখেছি।
তিনি এমনটি আশা করতেন না যে, কেউ তাঁর কাছে এসে বিনয়ে বিগলিত হোক, তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য আনুগত্যে উদ্বেল হোক। তদপরিবর্তে পদমর্যাদার তথাকথিত সংস্কার ভেঙে তিনি নিজেই কাছে চলে যেতেন, অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা অনুসারী ও ছোটবড় সবার কাছে। তিনি প্রত্যেক মানুষকে যোগ্যতা ও মানবিক গুণাবলীর ভিত্তিতে যথার্থ আসনে আসীন করার বিশাল মনের অধিকারী। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন তাঁর হায়াত দারাজ করেন, সুস্থ ও সবল রাখেন তাঁকে।

ফরহাদ হোসেন: সাবেক অতিরিক্ত সচিব, জেলাপ্রশাসক, মাদারীপুর (১৯৯৭-২০০০)।

পঞ্চমণি
ড. মো. আবদুল জলিল
সাধারণ্যে সৈয়দ আবুল হোসেন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও উদার রাজনীতিক। তবে তিনি যে লেখালেখিও করেন, এটি আমি জানতাম না। অবশ্য এটা আমার ব্যর্থতা। অকাজে আমাদের এত বেশি সময় ব্যয় হয় যে, অধ্যয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজেও পর্যাপ্ত সময় দেয়ার সুযোগ এবং ইচ্ছা কোনোটা পাই না। ব্যক্তি হিসেবে এটি আমার কাছে খুব লজ্জার মনে হয়। আমার ছাত্র মোহাম্মদ আমীনের কাছেই প্রথম শুনতে পেলামÑ সৈয়দ আবুল হোসেন একজন লেখকও বটে।
ব্যবসা ও রাজনীতির বাইরেও সৈয়দ আবুল হোসেনের অন্য একটি জগতে স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ রয়েছে। সেটি হচ্ছে লেখালেখি ও গবেষণা। ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘দি পলিটিশিয়ান’ নামক একটি ইংরেজি সাময়িকী সে সময় সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন কলাম লেখা ছাড়াও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক তিনি। এ পর্যন্ত তার ৯টি গ্রন্থের নাম পাওয়া গেছে। তবে আমি হাতে পেয়েছি মাত্র পাঁচটি। যে বইগুলো পাইনি, সেগুলো হচ্ছে: শেখ হাসিনার অক্ষয় কীর্তি- পার্বত্য শান্তি চুক্তি, বঙ্গজননী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ হাসিনার অসামান্য সাফল্য এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুবর্ণ জয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ। সৈয়দ আবুল হোসেন রচিত যে পাঁচটি গ্রন্থ আমি হাতে পেয়েছি সেগুলো হলো:
শেখ হাসিনা: সংগ্রামী জননেত্রীর প্রতিকৃতি;
গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন;
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট;
আওয়ামী লীগের নীতি ও কৌশল: শিল্পায়ন ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশ 
এবং
স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 
একটি সজ্জিত মোড়কে আবৃত বইগুলোর সামগ্রিক মূল্য ৫০০ টাকা। প্রতিটি গ্রন্থ ভিন্ন স্বাদ ও ব্যতিক্রমী যোজনায় পরিসজ্জিত। লেখক গ্রন্থগুলোকে রাজনীতিক বিশ্লেষণধর্মী আলেখ্য উল্লেখ করেছেন। আমি মনে করি, এ দাবি যথার্থ। রাজনীতি, স্বাধীনতা, আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড, পররাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত জীবন পরম্পরায় মানবিক মূল্যবোধ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে জীবনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত কণিকা সৈয়দ আবুল হোসেনের লেখায় অপূর্ব ব্যঞ্জনায় দ্যোতিত। আমি গ্রন্থ পাঁচটিকে এ জন্য এক কথায় ‘পঞ্চমণি’ নাম দিলাম। তবে সবগুলো মৌলিক গ্রন্থ নয়। লেখক তেমন দাবিও করেন না। মৌলিক না-হলেও উপস্থাপনা যথেষ্ট আকর্ষণীয় এবং মুন্সিয়ানাময়। এখন কাজের চাপে সময়ের অভাবে লেখালেখিতে সময় দিতে পারেন না। আমি অনুরোধ করব শত কাজ থাকলেও লেখার জন্য যেন কিছুটা সময় বের করে নেন।
আবেশিত লেখা বাস্তবতার কোড়কে পরিশুদ্ধ করা গেলে তা কী পরিমাণ কার্যকর হয়, তা পাঠকমাত্রই অনুধাবন করতে পারেন। সৈয়দ আবুল হোসেনের ‘পঞ্চমণি’ও এর ব্যতিক্রম নয়। মনের মাধুরী মিশিয়ে অনেক বড় বড় গ্রন্থ লেখা যায়, কিন্তু বাস্তবতার লেশমাত্র পাওয়া যায় না। সে বিবেচনায় সৈয়দ আবুল হোসেন ব্যতিক্রমী। গ্রন্থগুলোক লেখক তথ্য, ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্র, গ্রহণযোগ্য উদ্ধৃতি দিয়ে সত্যিকার অর্থে মণির মতো আকর্ষণীয় আলেখ্যে উদ্ভাসিত করেছেন। সত্যি এগুলো পঞ্চমণি। চোখ বুলালে বোঝা যায়, প্রতিটি বই লিখতে সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রচুর পড়তে হয়েছে। কিছু কিছু বিষয় আরও চমৎকার, যা পড়ে অর্জন করা যায় না। এগুলো জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার মধুর প্রাপ্তির প্রগাঢ় অনুভব ছাড়া হয় না। পরিসরে ছোট হলেও তথ্য-তত্ত্ব ও বিষয়াবলীতে বেশ সুস্বাদু ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ প্রতিটি বই। যদিও পঞ্চমণিতে অনেকের বক্তব্য এবং বিভিন্ন কর্মশালার বিরবণ দেয়া হয়েছে। সেগুলো বাদ দিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের যে মতামত গ্রন্থগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে, তা পাঠকের মনে দাগ কাটতে বাধ্য।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তবে সৈয়দ আবুল হোসেনের লেখা “স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান” ব্যতিক্রমী ও সযতœ পরিবেশনা বলে আমার মনে হয়েছে। বড় নয়, আবার ছোটও নয়; যেমন প্রয়োজন তেমন; মেদহীন নিখাদ। প্রতিটি বাক্য ও ঘটনা যুক্তির সাথে তথ্য এবং তথ্যের সাথে বাস্তবতা দিয়ে দারুণ সতর্কতায় গ্রথিত। লেখক যা বলেছেন তা দৃঢ়ভাবে বলেছেন, অকাট্য যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন। অস্বীকারের বিন্দুমাত্র ফাঁক অবশিষ্ট রাখেননি। এটি লেখকের একটি বড় কৃতিত্ব। দাবির স্বপক্ষে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ ও অকাট্য ঐতিহাসিক পারিপার্শ্বিকতা “স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান” গ্রন্থটিকে গুরুত্বপূর্ণ দলিলের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। কোনো রাজনীতিক গ্রন্থ যখন অনিবার্য দলিলের মর্যাদা লাভ করে, তখন এটি স্বতই ইতিহাসের অলংঘনীয় অংশ হয়ে যায়। এটি তেমন একটি গ্রন্থ। তবে গ্রন্থটির নাম স্বাধীনতার জনক না-বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জনক হলে ভাষাগত দ্যোতনা আরও জোরালো হতো বলে আমি মনে করি।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও অসম্পূর্ণ দ্বিতীয় বিপ্লবের বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যায় বাংলাদেশকে সার্বিক উন্নয়ন ও প্রগতির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবার যে পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর ছিল তা বিশদ বিবরণে পরিস্ফুট করা হয়েছে। ইসলামি মূল্যবোধ, বেসামরিক প্রশাসন, পররাষ্ট্রনীতি, সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশি ভারতের সম্পর্ক স্থাপনে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী ভূমিকার কার্যকর স্বরূপ এখানে বিমূর্ত হয়ে উঠেছে। সার্ক ও যমুনা সেতুর স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্য সৈয়দ আবুল হোসেন প্রাঞ্জল ভাষায় পর্যাপ্ত উদাহরণসহ তুলে ধরেছেন। এটি কৌতূহলী পাঠকের অনেক সংশয় মেটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। কৌশলগত চয়ন যৌক্তিক হওয়ায় উদাহরণগুলো চমৎকারভাবে প্রবন্ধের সাথে খাপ খেয়ে রয়েছে। এখানে লেখকের কিছুটা পেশাদারিত্বও দেখা যায়। এ পেশাদারিত্ব লেখার মানকে উন্নত করেছে।
সৈয়দ আবুল হোসেনের মতে, স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা, ব্যাপক জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস, দীর্ঘ সংগ্রাম, সীমাহীন আত্মত্যাগ আর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। যা কেবল রাজনীতিক সংগঠনই দিতে পারে, কোন ব্যক্তি নয়। কেউ ভুইঁফোঁড়ের মতো গলা উঁচিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার দাবি করতে পারেন, তবে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কারণ পৃথিবীতে কোথাও এমন নজির নেই। অবশ্য পাগলের কথা ভিন্ন। তা যদি হত তো পৃথিবীতে স্বাধীনতার জন্য এত রক্তপাত, এত সংগ্রাম আবশ্যক হতো না। শৈশব হতে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ মাস স্বাধীনতা ঘোষণা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তথ্যপ্রমাণসহ উদ্ধৃত করে লেখক দেখিয়েছেন- শৈশব থেকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন হৃদয়ে সযতেœ লালন করতেন। লেখকের মতে, এটি তাৎক্ষণিক উত্তেজনার কোনো ফসল নয়। স্বাধীনতার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনীতি, সংগ্রাম ও জীবনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন প্রতিক্ষণ। যার প্রকাশ্য স্ফুরণ ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ। ঐ বছর বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার দাবি তুলেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে যাদের সংশয় আছে; এ গ্রন্থটি পড়লে সৈয়দ আবুল হোসেনের তথ্য প্রমাণের কাছে তাদের সংশয় নিমিষে দূরীভূত হয়ে যাবে। শেখ মুজিবুর রহমান, কেবল শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক, আর কেউ নয়- লেখক এখানে সেটি মৌলিক যুক্তিসহ প্রমাণ করার প্রয়াস নিয়েছেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বিদ্যোৎসাহী, সমাজ সংস্কারক, দানবীর ও রাজনীতিক হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও তাঁর লেখা গ্রন্থগুলো পড়লে লেখক সত্তা ছাড়া বাকিগুলো ক্ষণিকের জন্য হলেও ঢাকা পড়ে যায়। তিনি বিশ্লেষণমূলক প্রতিভার সাহায্যে তাঁর আর্থ-রাজনীতিক প্রবন্ধগুলো সত্যিকার অর্থে মানসম্পন্ন করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। ‘গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন’ গ্রন্থটি পড়লে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি একটি বহুমুখী বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ চেতনায় মণ্ডিত অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গ্রন্থ। এখানে লেখক সংক্ষেপে অথচ স্বয়ংসম্পূর্ণ তথ্যে আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দিক প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন। লেখক ভূমিকাতে তাঁর উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করেছেন। এটি তাঁর আদর্শেরও প্রতিফলন। ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনায়ক ও প্রশাসকদের নিকট এটি একটি মূল্যবান সংগ্রহ হিসেবে প্রতিভাত হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ ও সামগ্রিক উন্নয়নে প্রতিটি নির্দেশনা যেমন কার্যকর তেমন সুদূরপ্রসারী লালিত্যে আপ্লুত। গতিশীল অর্থনীতির সাথে সম্পদের সুষম বণ্টন, স্থিতিশীলতার সাথে উন্নয়নের বহুধারূপ; সর্বোপরি, মানব কল্যাণে সৈয়দ আবুল হোসেনের উপস্থাপনা ও যৌক্তিক পরামর্শ তাঁর আর্থ-দার্শনিক প্রাঞ্জলতার বিমল ফিরিস্তি। বাংলাদেশের রাজনীতির স্বরূপ বিশ্লেষণে সৈয়দ আবুল হোসেন মানবিক মূল্যবোধের সাথে আর্থসামাজিক উত্তরণের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে স্থিতিশীল উন্নয়নের যে সূত্র দিয়েছেন তা অনিবার্য বাস্তবতা। এমন লেখা শুধু পুঁথিগত জ্ঞান দিয়ে হয় না; অভিজ্ঞতার তিক্ততা দিয়ে তিলে তিলে অর্জন করতে হয়। তাই করেছেন আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন। অনেক পরামর্শ আছে গ্রন্থে, তবে কোনোটি অবাস্তব নয়; অনেক ব্যাখ্যা, তবে কোনোটি আবেগতাড়িত নয়; অনেক বিষয়, তবে কোনোটি অতিরঞ্জিত নয়। সবকিছু মার্জিত, ঠিক তাঁর দৈনন্দিন কথার মতো, প্রাত্যহিক কাজের মতো। প্রতিটি উপদেশ গ্রহণযোগ্য ঠিক তাঁর সরলতার মতো, প্রতিটি সমাধান প্রয়োগযোগ্য ঠিক তার সফলতার মতো। তবে এগুলো প্রয়োগ করতে হলে যে, মানুষকে শিক্ষিত করতে হবে, ঋদ্ধ করতে হবে- এ সব বিষয়ও তাঁর চোখ এড়ায়নি। হয়ত এর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি শিক্ষা বিস্তারে এত আগ্রহী।
তিনি দেশকে নিজ হতে বিচ্ছিন্ন করে দেখেন না। দেশ বাঁচলে নিজে এমন অনুভূতির সাথে মানুষকে একাত্ম করার প্রেরণা সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিবেদিত হতে সহায়তা করে। শিল্পায়নে অর্থনীতির বিকাশ, রাজনীতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ভোটার তালিকা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক, তারুণ্য ও শিক্ষা, দারিদ্র্য নিরসন সর্বোপরি রাজনীতিক দর্শনের সাথে প্রগতি ও উন্নয়নকে সমন্বিত করে বাংলাদেশকে কীভাবে সার্বিক কল্যাণে অভিষিক্ত করা যায়, গ্রন্থটিতে সে নির্দেশনা রয়েছে। সুশাসনের জন্য তাঁর আকুতি ও পরামর্শ দুটোই অনিন্দ্য। সৎ ও প্রত্যয়দীপ্ত নেতৃত্বের জন্য তাঁর আকুলতা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মুগ্ধকর। তিনি মনে করেন, নেতা অন্ধকারে আলোর মতো। নেতাহীন জাতি আলোহীন পথিকের মত বিপদগ্রস্ত। তার আশা শুধু নিরাশায় ঢেকে থাকে। তবে শুধু নেতা হলে হবে না। নেতার কী ধরনের গুণাবলী অপরিহার্য, তাও তিনি বিধৃত করেছেন।
‘গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট’ সৈয়দ আবুল হোসেনের অনিমেষ ভাবনার গভীর অন্তর্দৃষ্টির অভিজ্ঞতাজাত আলেখ্য। নিবিড় পর্যবেক্ষণের সাথে বাস্তবতা, বিশ্লেষণের সাথে প্রায়োগিক পূর্ণতা গ্রন্থটিকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। সমস্যার উৎপত্তি ও বিবরণই কেবল নয়; সেইসাথে সমাধানও বর্ণিত। সমাধান কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। সংগত কারণে এটি একটি দিকনির্দেশনামূলক গ্রন্থ। এ গ্রন্থে সংকলিত প্রবন্ধসমূহ যেমন সমৃদ্ধ তেমন অনুভবনীয়। পেশা নির্বিশেষে শিক্ষিত মাত্রই বইটি সংরক্ষণে রাখা উচিত।
ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ হোসেন কথা বলেন কম, তবে যা বলেন তা নিপাট, কার্যকর। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের ন্যায় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট গ্রন্থেও এর মনোহর চরিত্রের প্রতিফলন ঘটেছে। লেখকের ভাষায়, ‘… কেবল সমস্যাই তুলে ধরা হয়নি, সমাধানের বিকল্প পথেরও সন্ধান দেয়া হয়েছে। সমস্যার কথা অনেকে বলেন কিন্তু সমাধানের রূপরেখা দানের ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব করে থাকেন। আমার লেখাগুলোতে আমার সীমিত জ্ঞানে আমি দেখিয়েছি বিরাজমান সমস্যাগুলোর সুষ্ঠু ও বাস্তবভিত্তিক সমাধান কীভাবে সম্ভব।’ তিনি শুধু সমস্যা দেখেননি, সম্ভাবনাও দেখেছেন। তাঁর ভাষায, ‘ঘোর কৃষ্ণ মেঘের মধ্যে আবিষ্কার করেছি সোনালি সূর্যের প্রত্যয় ও প্রতিভাস।’
লেখকের বিশ্বাসÑ গণতন্ত্রের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলে চিরায়তভাবে বৃত্তবন্দি থাকার প্রয়োজন হবে না। এ জন্য প্রথমত জনগণকে ক্ষমতায়ন করতে হবে। এর পূর্ব শর্ত হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন। নিয়মিত ব্যবধানে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনমতের যথার্থ, স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ ও পক্ষপাতহীন প্রতিফলন; সার্বভৌম সংসদ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন, সামাজিক শক্তিসমূহের সমন্বিত সমাবেশ, জাতিগত ঐক্য ও আত্মশক্তি জাগ্রত করে গণতন্ত্রের সংকট হতে উত্তরণ হওয়া যায়। লেখক মনে করেন, দেশপ্রেমই আত্মশক্তি জাগ্রত করতে পারে। একটি জাতির অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির চাকিকাঠি হচ্ছে আত্মশক্তি। এ শক্তিতে আত্মস্থ হয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ থেকে জার্মানি ও জাপানের বিস্ময়কর উত্থান সম্ভব হয়েছে। আত্মশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা পেয়েছে। বস্তুত সত্যিকার গণতন্ত্রই আত্মশক্তি জাগ্রত করতে পারে- লেখকের এ উক্তি কত নিষ্ঠুর সত্য, তা আমার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি। তাই গণতন্ত্রের সংকট উত্তরণে সৈয়দ সাহেবের আকুতি যেমন অকৃত্রিম তেমনি কার্যকর। এটি আমার কাছে ভাল লেগেছে। খুব ভালো লেগেছে। আমি এর প্রশংসা না-করে পারছি না।
‘শেখ হাসিনা: সংগ্রামী জননেত্রীর প্রতিকৃতি’ সৈয়দ আবুল হোসেনের সৃজনশীল মন ও দূরদর্শী মননের চমৎকার শৈলী। তিনি রাজনীতিক ও আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণে দূরদর্শী তা ইতোপূর্বেকার আলোচনায় প্রতিভাত। কিন্তু জীবনীগ্রন্থ রচনাতেও সৈয়দ সাহেব বেশ অভিজ্ঞ- আমার এমন মনে হয়েছে। তবে এটি শুধু জীবনীগ্রন্থ নয়; রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় জীবন হতে শুরু করে পুরো জীবনের বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের প্রতিফলন। জীবনকেও কত কার্যকর গ্রহণযোগ্যতায় উপস্থাপন করা যায়, তার প্রমাণ এ গ্রন্থ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধূ শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ব্যক্তি শেখ হাসিনাকে লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন খুব নিবিড় মমতায় পরম শ্রদ্ধার সাথে উপস্থাপন করেছেন। নামায়ন হতে লেখকের বহুমাত্রিক বিচরণ পরিদৃষ্ট। নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও গভীর মমতা অথচ আবেগহীন প্রফুল্লতায় লেখাগুলো চয়িত। শ্রদ্ধার সাথে ভালোবাসা আর ভালোবাসার সাথে হৃদয়ের অভিযোজন না-থাকলে কারও কলম হতে, মন হতে এমন উষ্ণ মমতার প্রকাশ ঘটে না। তিনি নেত্রীকে দেখেছেন কাছ হতে, অনুভব করেছেন অন্তর দিয়ে, প্রকাশ করেছেন চিন্তার স্রোত ধরে ধেয়ে আসা কলমের কালিতে। এখানে শ্রদ্ধা আছে অতিরঞ্জন নেই, ভালোবাসা আছে আবেগ নেই। প্রতিটি কথা ইতিহাস- সত্যের রশ্মিতে উজ্জ্বল। ইতিহাসের একজন ছাত্র ও আইনের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি বলতে পারি, শিক্ষকতা পেশাতেও তিনি ব্যবসা আর রাজনীতির মতো সফল হতে পারতেন। বেগম সুফিয়া কামালের ভূমিকা গ্রন্থটিকে সমৃদ্ধ করেছে।
আওয়ামী লীগের নীতি ও কৌশল: শিল্পায়ন ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশ সৈয়দ আবুল হোসেন-এর একটি সংকলন। গ্রন্থটিতে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ও ২৫মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের শিল্প উন্নয়নের প্রেক্ষিত এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশ ও বিনিয়োগ শীষর্ক সেমিনারের উপর ভিত্তি করে চয়িত। গ্রন্থটিতে আওয়ামী লীগের নীতি-কৌশল সম্পর্কে বিভিন্ন লোকের বক্তব্য ও মন্তব্য পরিবেশিত।
শিল্পায়নের জন্য রাজনীতিক সদিচ্ছার বিকল্প নেই। তাই সফল শিল্পায়নে রাজনীতিকে শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করার পরামর্শ দিয়েছেন সৈয়দ সাহেব। তিনি মনে করেন, শিল্পায়ন ও অভ্যন্তরীণ সম্পদের সমাবেশের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো দেশ একটি সমৃদ্ধÑজাতিতে পরিণত হতে পারে। পৃথিবীর যে কোনো দিকে দৃকপাত করা হোক না; মূলত সৈয়দ আবুল হোসেনের এ সূত্রই প্রতিফলিত।
সৈয়দ আবুল হোসেন মনে করেন, শিল্পায়ন সহজ কাজ নয়। কেবল যন্ত্রপাতি আমদানি করলে শিল্পোন্নয়ন হয় না। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নির্দেশনা। শুধু থিউরি ও তত্ত্ব দিয়ে এটি হয় না। এর জন্য আবশ্যক রাজনীতিক ও অর্থনীতিক নির্দেশনা। তার সাথে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি এবং জনমুখী প্রকল্প। সবার জন্য পঞ্চমণি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আমি মনে করি।

ড. মো: আবদুল জলিল-সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামি ইউনিভার্সিটি, মালেশিয়া; সাবেক চেয়ারম্যান, আইন বিভাগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, লেখক ও গবেষক।

পদ্মা সেতু প্রকল্প বৃত্তান্ত
জামিলুর রেজা চৌধুরী
পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের আকস্মিক সরে যাওয়া নিয়ে ইতোমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের তরফের কম কথাবার্তা হয়নি। আমি আর সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। কোনো বিচার বিশ্লেষণও নয়। কারিগরি পর্যায়ে যুক্ত থাকার সুবাদে প্রকল্পটিকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে সে ব্যাপারেই দু’চারটি কথা বলব। 
২০০৭ সালে প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের জন্য এডিবি (্এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) বাংলাদেশ সরকারকে কারিগরি সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ এবং এ লক্ষ্যে পরামর্শকদের কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করে। এতে বিভিন্ন দেশের ছয়টি খ্যাতনামা প্রকৌশলী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দাখিল করে এবং ফিলিপাইনের ম্যানিলায় অবস্থিত সদর দফতরে বসে এডিবি নিজেই এ প্রস্তাবগুলো মূল্যায়ন করে। একই সময় বাংলাদেশ সরকার একটি বিশেষজ্ঞ দল নিয়োগ এবং সমান্তরালভাবে ওইসব প্রস্তাব এডিবির গাইডলাইন অনুসারে মূল্যায়ন করতে থাকে। আমাদের মূল্যায়নে এডিবির মূল্যায়ন সমীক্ষায় কিছু ভুলত্র“টি ধরা পড়ে এবং তা চিহ্নিত করায় এডিবি তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন সংশোধন করে। এরই ভিত্তিতে নিউজিল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠান মনসেল, কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান নর্থ-ওয়েস্ট হাইড্রোলিক ও অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠান স্মাক পরামর্শক নির্বাচিত হয়। 
বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই পরামর্শক সম্পর্কিত মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি অনুমোদন করে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এ ধরনের একটি জটিল ও বৃহৎ প্রকল্পে ডিজাইনের আগে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং তা বিশ্লেষণ করে ডিজাইন প্রণয়ন করতে হয়। এই প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন করে ২০১০ সালের মাঝামাঝি সেতুর ড্রইং প্রণয়ন শুরু করা হয়। একই সঙ্গে প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজের জন্য ঠিকাদারদের প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এই বিভিন্ন প্যাকেজের প্রাক-যোগ্যতার ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণের সময় বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সঙ্গে অনেক আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হয়। 
এদিকে ২০০৯ সালের মাঝামাঝি এই প্রকল্পে বিভিন্ন কারিগরি দিক নিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল নিয়োগ করা হয়। এর অন্তর্ভুক্ত ১০ বিশেষজ্ঞের মধ্যে তিনজন জাপানি বিশেষজ্ঞ, একজন নরওয়েজিয়ান বিশেষজ্ঞ এবং বাকি পাঁচজন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ।
ডিজাইন পরামর্শক সংস্থা যে প্রতিবেদনগুলো বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে জমা দেয়, তা পর্যালোচনা করে এই বিশেষজ্ঞ প্যানেল তাদের মতামত দেয়। এই মতামতের ভিত্তিতে ২০১১ সালের মাঝামাঝির দিকে ডিজাইনটি প্রায় চুড়ান্ত করা হয়। প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণের জন্য সরকার আরেকটি কমিটি করে, যাদের সুপারিশমালা বিশ্বব্যাংক , এডিবি ও জাইকা অনুমোদন করে।
এদিকে এই প্রকল্পের পরিবেশগত সমীক্ষা এবং অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন করা হয়। মূল সেতুর ঠিকাদারের প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ডিজাইন কনসালট্যান্ট ও বাংলাদেশের প্রাক-যোগ্যতা মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশে মতভেদ দেখা দেয়। মূলত একটি চীনা কোম্পানিকে কেন প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা হয়নি, সে বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বারবার জানতে চায় এবং তাদের প্রাক-যোগ্য ঘোষণার জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ কমিটি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়, তারা যে অভিজ্ঞতা সনদ প্রস্তাবের সঙ্গে জমা দিয়েছে তা ভুয়া।
তারা বলেছিল যে, চীনের একটি সেতুতে তারা ইস্পাতের পাইল ব্যবহার করেছে। এর সমর্থনে তারা একটি আলোকচিত্রও জমা দেয়। পরে দেখা যায়, আলোকচিত্রের সেতুটি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত। এ ধরনের জালিয়াতি ধরা পড়ার পরদিন আমরা কিছু জানানোর আগেই তারা চিঠি দিয়ে প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়। এরপরই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কমিটির সুপারিশকৃত প্রাক-যোগ্য ঠিকাদারদের তালিকা লিখিতভাবে অনুমোদন করে।
একইভাবে নদী শাসনের ঠিকাদারদের প্রাক-যোগ্যতা তালিকায় ডিজাইন কনসালট্যান্ট ও বাংলাদেশ সরকারের কমিটির সুপারিশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক দ্বিমত পোষণ করে। বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের তিনজন বিশেষজ্ঞ চীনের প্রকল্পগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে কোম্পানিগুলোর প্রদত্ত তথ্য যাচাই বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দেয়। এই তালিকাপত্র প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পথে। ২০১০ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্মাণ তদারকি পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য সরকার পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করে। এই প্রস্তাব কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে তারও খুঁটিনাটি বিশ্বব্যাংক নির্দিষ্ট করে দেয়। এই মূল্যায়নের কাজ করার জন্য সরকার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগ করে এবং ২০১১ সালের শুরুতে কারিগরি প্রস্তাবের ওপরে তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে। এই কমিটিতে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ অনুসারে তাদের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কমিটির মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক লিখিতভাবে অনুমোদন করে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, এখানে কোয়ালিটি অ্যান্ড কস্ট বেইজড সিলেকশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারেই। ওইখানে কারিগরি মূল্যায়নের ওপর শতকার ৯০ ভাগ ওয়েইটেজ এবং ভিন্ন একটি খামে জমা দেওয়া আর্থিক প্রস্তাবের মূল্যায়নের ওপর শতকার ১০ ভাগ ওয়েইটেজের মূল্যায়ন করা হয়। যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব জমা দিয়েছিল তাদের উপস্থিতিতেই কারিগরি মূল্যায়ন প্রদত্ত নম্বর ঘোষণা করা হয় এবং আর্থিক প্রস্তাব ও খামগুলো খুলে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
এছাড়া বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কমিটিকে প্রতিটি পরামর্শক দলের যে ২৭ জন কি পারসোনালের নাম অভিজ্ঞতা উল্লেখ আছে তা সঠিক কি-না তা যাচাই করার জন্য দিকনির্দেশনা দেয়। সেই অনুসারে কমিটি এসব বিশেষজ্ঞের অভিজ্ঞতা সনদ যাচাই করে দেখে। তাতে দেখা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞের যে অভিজ্ঞতা কারিগরি প্রস্তাবে উল্লেখ আছে তা প্রমাণ করার জন্য যথাযথ সনদ তারা উপস্থাপন করতে পারেননি। কেউ কাজ করেছেন এক ক্ষেত্রে, সনদ জমা দিয়েছেন আরেক ক্ষেত্রের। এ ধরনের একটি ঘটনার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে তাদের অসাবধানতার জন্য ভুল স্বীকার করে। সব মিলিয়ে তিনজন এমন ব্যক্তি পাওয়া যায়। তবে এরই ভিত্তিতে কারিগরি প্রস্তাব পুনর্মূল্যায়ন এবং আর্থিক প্রস্তাবের অসঙ্গতিগুলো দূর করা হয়। নির্ধারিত ওয়েইটেজ ব্যবহার করে সরকার গঠিত কমিটি তাদের চূড়ান্ত মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করে। এই প্রতিবেদন অনুমোদনের পর সরকার যখন অপেক্ষা করছিল, তখনই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ উপস্থাপন করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের কার্যক্রম স্থগিত করে।
আগেই যেমনটি বলেছি, পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যকার দ্বিমত ও দ্বৈরথ নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারিগরি বিভিন্ন দিক কীভাবে মূল্যায়িত হয়েছে, সেটাই জানালাম। বিচার-বিবেচনার ভার পাঠকের।

অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী। পদ্মা সেতু প্রকল্প বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রকৌশল-বিশেষজ্ঞ চেয়ারম্যান।

শতাব্দীর স্মৃতি
আব্দুল কাদের
সৈয়দ আবুল হোসেন আমার বন্ধু। আমার নিয়োগ-দাতা। তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয় গৈলা উচ্চ বিদ্যালয়ে। তিনি গৈলা উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। ষষ্ঠ হতে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত এবং সপ্তম শ্রেণি পাশ করে অষ্টম শ্রেণিতে মাস দু’য়েক মেধারকুল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন। এরপর তৎকালীন গৌরনদী, বর্তমান আগৈলঝারার গৈলা হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে আমাদের ক্লাশে ভর্তি হন। এটি ১৯৬৪ সালের কথা। আমি তখন গৈলা হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। নতুন ছাত্রকে সাধারণত সবাই আগন্তুক হিসেবে দেখেন। আমরা কিন্তু তাঁকে ভালোভাবে গ্রহণ করলাম। নবাগত হিসেবে আমি তাকে আপনি বলে সম্বোধন করতে শুরু করি। সেই শুরু আপনি। তারপর এ সম্বোধন স্কুল ছড়িয়ে কলেজ, কর্মজীবন, অদ্যাবধি পরিবর্তন হয়নি। এখনও আমরা পরস্পরকে আপনি সম্বোধন করি।
গৈলা উচ্চ বিদ্যালয় ছিল তৎকালে পূর্ব-পাকিস্তানের একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। এ বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবিস্মরণীয় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ প্রত্যেকে ছিলেন দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ। এ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করা মানে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অধিকারী হওয়া এমন একটা বিশ্বাস সারা বরিশালে প্রচলিত ছিল। সৈয়দ আবুল হোসেনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে পিতা-মাতা তাঁকে মেধারকুল উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। আগৈলঝারার সেরেলে সৈয়দ আবুল হোসেনের মামা বাড়ি। তিনি মামা বাড়ি থেকে পড়তে পারবেন। এ সুবিধাও সৈয়দ আবুল হোসেনের পিতা-মাতাকে গৈলা স্কুলের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছে- এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়।
আমাদের সাথে একই ক্লাশে অন্য যারা পড়তেন তাদের মধ্যে প্রখ্যাত সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, পূবালী ব্যাংকের ডিজিএম মুন্সি নুরুল ইসলাম, অগ্রণী ব্যাংকের ডিজিএম সোহরাব শিকদার এবং মেজর শাহ আলমের নাম এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আরও অনেকে ছিলেন। তাদের নাম স্মরণ করতে পারছি না। সময় আর স্মৃতির অতলে কে কোথায় হারিয়ে গেছেন। জানি না তারা কে কোথায় আছেন। আমিও হয়ত তাদের অনেকের স্মৃতির তলায়। এভাবে একদিন পৃথিবী হতে হারিয়ে যাব। জানতেও পারবেন না গৈলার সে পুরোনো দিনের প্রিয় বন্ধুরা। এভাবে পুরাতন ঝরে পড়ে। নতুন এসে দখল করে শূন্য স্থান।
আবুল ভাই মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতেন। হাঁটার ভঙ্গি ছিল চমৎকার, মার্জিত এবং ব্যক্তিত্বময়। চলাফেরায় গতি ছিল। তবে কোন চঞ্চলতা বা অস্থিরতা ছিল না। ছোটবড় সবার সাথে তিনি ভালো ব্যবহার করতেন। প্রতিটা কথা হতো সাজানো, পরিমিত এবং সুরুচির পরিচায়ক। আধুনিক সাহিত্যের মতো ছোট ছোট সহজ বাক্যে তিনি কথা বলতেন। এটি ছিল তাঁর অভ্যাস। কণ্ঠ ছিল মোলায়েম। বাক্যের প্রতিটা শব্দ স্পষ্টভাবে শোনা যেত। চড়া গলায় কখনও কথা বলতেন না। বিনয় মিশ্রিত ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর কথাবার্তার অলঙ্কার।
লেখাপড়া ছাড়া অন্য কিছুতে তেমন আগ্রহ ছিল না, তবে বিকেলে মাঝে মাঝে হাঁটতেন। বিল-ঝিল, নদীনালা, পাখি ইত্যাদি আনন্দের সাথে উপভোগ করতেন। প্রকৃতি হতে তিনি আহরণ করেছেন সৌন্দর্যবোধ এবং পরিপাটিত্য এবং অধ্যয়ন হতে অর্জন করেছেন পরিমিত বোধ ও সহনশীলতা।
আবুল ভাইয়ের স্মরণশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। হাই স্কুল জীবনেই ইংলিশ-টু বেঙ্গলি অভিধানের প্রায় পুরোটাই তিনি মুখস্থ করে নিয়েছিলেন। হাইস্কুল জীবনে তাঁর এত বেশি ইংরেজি ওয়ার্ড মুখস্থ ছিল যে, প্রধান শিক্ষক শ্রীযুক্ত জর্জ অশ্র“ বাবু তাঁকে চলন্ত অভিধান ডাকতেন। কোনো শব্দের অর্থ নিয়ে সংশয় দেখা দিলে প্রধান শিক্ষক আবুল ভাইকে ডাকতেন। বলতেন, ‘হ্যালো মিস্টার ডিকশনারি, হোয়াট ইজ দ্যা মিনিং অব দিজ ওয়ার্ড?’ অন্যান্য ছাত্রছাত্রী ঈর্ষার চোখে আবুল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আবুল ভাই দাঁড়িয়ে সহজ ভঙ্গিতে শব্দের অর্থ বলে দিতেন। শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রীরা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতেন। এখন যেমন মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকেন হাজার হাজার লোক, সারা দেশ।
গৈলা উচ্চ বিদ্যালয় হতে আমাদের বাড়ি বেশি দূরে ছিল না। মাঝে মাঝে আবুল ভাইকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতাম। খুব মজা হতো। তাঁর মজার মধ্যেও ছিল আভিজাত্য, শালীনতাবোধ। তিনি আমার মা-বাবা ও মুরুব্বিদের সম্মান করতেন। ছোটদের প্রতি ছিল অনাবিল স্নেহ। আমার মা-বাবা তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। বেড়াতে গেলেও পড়তেন। তিনি বলতেন, ‘অধ্যয়ন নিশ্বাসের মতো, তাই এটি বন্ধ করা মানে মানসিকভাবে মৃত্যু ঘটা।’
১৯৬৬ সালে গৈলা উচ্চ বিদ্যালয় হতে আবুল ভাই ও আমি এসএসসি পাশ করি। একই বছর আমরা সদ্যপ্রতিষ্ঠিত গৌরনদী কলেজে ভর্তি হই। সৈয়দ আবুল হোসেন ও আমি উভয়ের বিভাগ ছিল বাণিজ্য। কলেজে আসার পর দুই জনের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় ও নিবিড় হয়ে ওঠে। সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলেজ, ছাত্রাবাস দূরে থাক, কলেজ ভবনও ছিল জরাজীর্ণ। প্রত্যন্ত গ্রাম, ছাত্রছাত্রীদের থাকার মতো বাসা-বাড়ি ছিল না। আবুল ভাই কলেজের অনতিদূরে স্বাস্থ্য বিভাগের অর্ধনির্মিত একটি কমিউনিটি সেন্টারে ওঠেন। কমিউনিটি সেন্টারের পাশে কলেজের অধ্যক্ষ মো. তমিজ উদ্দিন স্যারের বাসা। তিনি গৌরনদী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাসায় ভাড়া থাকতেন। অধ্যক্ষের কাছাকাছি থাকার কারণে আবুল ভাইয়ের সাথে অধ্যক্ষ এবং অন্যান্য শিক্ষকগণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আবুল ভাই একা থাকতেন। আমি মাঝে মাঝে তাঁর কক্ষে যেতাম। ভদ্র, বিনয়ী, মেধাবী ও সৎ চরিত্রের অধিকারী হিসেবে পরিচিত ছাত্রদের সাথে তিনি বেশি মিশতেন। তবে কলেজের কারও সাথে তাঁর খারাপ সম্পর্ক ছিল না। তিনি বলতেন, ‘সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। কলেজের সবাই তাঁকে ভালো জানত। তিনিও সবাইকে ভালো জানতেন। কমিউনিটি সেন্টারে তিনি নিজ হাতে রান্না করে খেতেন। ভাত, আলু আর ডিম এক সাথে সিদ্ধ করতেন। ডালও পাক করতেন, তবে সবসময় নয়। মাঝে মধ্যে আমিও তাঁর রান্না খাবারে ভাগ বসাতাম। বন্ধের দিন মাঝে মাঝে প্রিন্সিপাল স্যারকে দাওয়াত করতেন। স্যার দাওয়াত গ্রহণ করতেন। সে দিনগুলো ছিল নির্মল আনন্দে ভরা, মনে পড়লে আবেশে চোখ বুজে আসে। মনে পড়ে মান্না দে-এর বিখ্যাত গান: কোথায় হারিয়ে গেল, সোনালি বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই…।
আবুল ভাইয়ের থাকার রুম, মেঝে, বিছানা, বইপত্র এবং পড়ার টেবিল সবসময় সাজানো গোছানো থাকত। যতবার গেছি কখনও এলোমেলো দেখিনি। মনে হতো এ মাত্র পরিষ্কার করেছেন। আহার ছিল পরিমিত। আজেবাজে জিনিস খেতেন না। কথাবার্তার ন্যায় খাওয়াদাওয়াতেও ছিলেন হিসেবি। জীবনযাপনে এত সুশৃঙ্খল এবং পরিচ্ছন্ন ছিলেন যে, কোন রোগবালাই তাঁর কাছে ঘেঁষতে পারত না। তাঁর অনুধাবনের ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। ইংরেজি হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর। বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে ভালো দখল ছিল তাঁর। পরীক্ষার সকল প্রশ্নের উত্তর ইংরেজিতে লিখতেন। গৈলা উচ্চ বিদ্যালয়ের চলন্ত অভিধান গৌরনদী কলেজে এসে ইংলিশ ডিকশনারি হয়ে ওঠেন। আমরা পুরো বই পড়তাম না, শুধু বিশেষ কয়েকটি অংশ পড়তাম। তিনি পুরো বই পড়তেন এবং খুঁটিনাটিসহ।
একদিনের ঘটনা, কলেজে সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছিল। মিটিংমিছিলে ক্যাম্পাস উত্তপ্ত। তখন আমাদের পরীক্ষা। আন্দোলনকারী ছাত্ররা পরীক্ষা বর্জন করে। কিন্তু আমি, মুন্সি নুরুল ইসলাম ও আবুল ভাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। আমরা পরীক্ষার হলে প্রবেশ করলে আকন্দ মোবারক ও ভিপি নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে আন্দোলনরত ছাত্ররা আমাদের মেরে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেন। এ ঘটনায় প্রিন্সিপাল স্যার খুব মর্মাহত হয়েছিলেন। আবুল ভাই এটাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আন্দোলন গণতন্ত্রের অংশ। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতা। জোর করে সমর্থন আদায় গণতন্ত্র নয়, স্বৈরাচারের নামান্তর।’ তিনি ছাত্রজীবনেই রাজনীতিক স্বৈরাচার ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবসানের সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন। এ ঘটনার পর তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিকে সহনশীল রাজনীতিতে পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকেন। আমাদের বলতেন, ‘রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য। কল্যাণ তখনই নিশ্চিত হবে যখন আমরা পরস্পর সহনশীল অবস্থানে থাকতে পারব।’
১৯৬৮ সালে আবুল ভাই আর আমি এইচএসসি পাশ করি। আমাদের ভাগ্য ভালো যে, এর দু’বছর আগে ১৯৬৬ সালে গৌরনদী কলেজে কলা ও বাণিজ্য বিভাগ অনুমোদন লাভ করে। পূর্বের ন্যায় উভয়ে বাণিজ্য বিভাগে ডিগ্রি ক্লাশে ভর্তি হই। আমাদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। তবু আমরা পরস্পরকে আপনি হিসেবে সম্বোধন করে চলি। বন্ধুত্বের মধ্যে এত শ্রদ্ধাবোধ আর আমি দেখি না।
আমাদের ছাত্রকালীন এখনকার মতো অত ছাত্রী পড়তেন না। মুসলমান ছাত্রী ছিল না বললেই চলে। এইচএসসি ক্লাশে ছাত্রীর সংখ্যা যতদূর মনে পড়ে ছয়-সাত জনের বেশি ছিল না। দু’জনের নাম এখনও মনে আছে। একজন সুনীতি আর একজন সতী। উভয়ে পরস্পর সহোদরা। সাত মাইল হেঁটে সুদূর আগৈলঝারা হতে ক্লাশ করতে আসতেন। মেয়েদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল একদিকে শ্রদ্ধার অন্যদিকে সৌহার্দ্যরে। ঠিক ভাইবোনের মতো। মেয়েরা ক্লাশে সামনের বেঞ্চে বসতেন। শিক্ষকের সাথে আসতেন আবার শিক্ষকের সাথে ছাত্রীদের কমনরুমে চলে যেতেন।
ডিগ্রি ক্লাশে ওঠার পর মার্চের দিকে সৈয়দ আবুল হোসেন পুরোনো আবাসস্থল ছেড়ে গৌরনদী থানার নিকটবর্তী ভ্যাটেরনারি বিভাগের একটি কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে ওঠেন। তাঁর সাথে ওঠেন পিঙ্গুলাকাটির নুরু। তাঁরা একত্রে নিজেরা রান্নাবান্না করতেন। একই রুমে থাকলে অনেক সময় রান্নাবান্না বা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আবুল ভাই ছিলেন অন্য রকম। তাঁর সাথে নুরুর কোনোদিন কোনো মনোমালিন্য হয়নি। নুরু বলতেন, ‘আবুল ভাইয়ের মেনে নেয়ার ক্ষমতা এবং বন্ধুবাৎসল্য সব কিছুর ঊর্ধ্বে। তাঁর মতো রুমমেট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’
সময়ের পরিধিতে আবুল ভাইয়ের সাথে শিক্ষকমণ্ডলীর ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়তে থাকে। মাকসুদ স্যার তাঁকে এত ভালোবাসতেন যে, তিনি সৈয়দ আবুল হোসেনকে বিনা বেতনে রুমে গিয়ে পড়িয়ে আসতেন। আবুল ভাই ছিলেন ভালোবাসার মতো ছাত্র। তার কোনো ঘাটতি ছিল না। আল্লাহ তাঁকে পরিপূর্ণভাবে সৃষ্টি করেছেন।
১৯৭০ সালে ডিগ্রি পাশ করার পর আবুল ভাই এবং আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। প্রিলিমিনারি সমাপ্ত করার পর আর্থিক সংকটের কারণে আমি লেখাপড়া ত্যাগ করতে বাধ্য হই। আবুল ভাই ছিলেন সচ্ছল পরিবারের ছেলে। তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি মুহসীন হলের ছাত্র ছিলেন। দানবীর হাজি মুহসীনের নামানুসারে মুহসীন হল। আবুল ভাইয়ের উদার-দাতা হবার পেছনে বংশগত ঐতিহ্য ছাড়াও হাজি মুহসীনের অনুপ্রেরণা থাকা অসম্ভব কিছু নয়। পাঠ্য বইয়ের ফাঁকে তিনি বিখ্যাত মনীষীদের জীবনী পাঠ করতেন। হাজি মুহসীন ছিলেন তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্বদের অন্যতম। এখনও বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি হাজি মুহসীনকে স্মরণ করে থাকেন। আমি লেখাপড়া বন্ধ করে দিলেও মাঝে মাঝে মুহসীন হলে তাঁর রুমে যেতাম। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে আবুল ভাই ব্যবস্থাপনা বিভাগ হতে কৃতিত্বের সাথে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
মাস্টার্স পাশ করার পর আবুল ভাই কিছুদিন টিসিবি-তে চাকুরি করেন। কিছু দিন পর চাকুরি ছেড়ে দেন। তখন সুতো ও সুতো-সম্পর্কিত রাসায়নিক দ্রব্যাদি টিসিবি-এর মাধ্যমে আমদানি করে বিসিক কর্তৃক তাঁতিদের মধ্যে বণ্টন করা হতো। ঢাকায় সুতোর গুদাম ছিল মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছনে নলগোলা নামক স্থানে। ১৯৭৪ সালের বন্যায় গুদামে পানি ঢুকে সুতো নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থায় ‘বঙ্গবন্ধু সরকার’ সুতো আমদানি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। অন্যদিকে নলগোলা গুদামের সুতো টেন্ডারে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সৈয়দ আবুল হোসেন, পাবনার আবদুল মান্নান ও আলহাজ্ব টেক্সটাইলের মালিক আবদুল হাই; সম্মিলিতভাবে নলগোলা গুদামের সুতো ক্রয়ের টেন্ডার দেন। ভাগ্য ভালো তাঁরা টেন্ডার পেয়ে যান। এ প্রাপ্তি আবুল ভাইয়ের জীবনের একটি মাইলফলক। সুতো বিক্রি করে তিনি প্রচুর লাভ করেন। কিছু নগদ অর্থ হাতে আসে এবং এ অর্থ দিয়ে তিনি ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে সাকো ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলেন। সুতোর টেন্ডার ও ক্রয়-বিক্রয় কাজে আমি প্রথম হতে আবুল ভাইয়ের সাথে ছিলাম। সাকো প্রতিষ্ঠার পর তিনি আমাকে তাঁর প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেন। আমাদের আরেক সহকর্মী শহীদুল হকও সাকো ইন্টারন্যাশনাল-এর কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। জন্মলগ্ন হতে আমি সাকোর কর্মকর্তা। ছাত্রজীবনের সহপাঠী কর্মজীবনে এসে নিয়োগদাতায় পরিণত হন।
১৯৭৫ সালে আমি আবুল ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করি। বন্ধু হতে মালিক, বন্ধু হতে বস। কি রকম ব্যবহার পাব এ নিয়ে শঙ্কা ছিল। আমাদের শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে আবুল ভাই প্রমাণ করলেন, সত্যি তিনি অসাধারণ। বন্ধু এবং পরবর্তীকালে অধস্তন কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর ব্যবহারে আমি বিন্দু পরিমাণ পার্থক্য খুঁজে পাইনি। কর্ম জীবনে এসে আমাদের আর্থিক ব্যবধান ও বৈষয়িক সম্পর্কের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু আত্মিক সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হয়নি, বরং আমার প্রতি তাঁর স্নেহ, সহানুভূতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি আমার প্রিয় বন্ধু আবুল ভাইয়ের গুণাবলীর মধ্যে অনন্য একটি বলে আমি মনে করি।
১৯৭৮ সালে আবুল ভাইয়ের সাথে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধক খাজা বাবা এনায়েতপুরী (রঃ)-এর সেজো ছেলে গদিনশিন সেজো হুজুর খাজা কামালউদ্দিন (রঃ)-এর সেজো কন্যা খাজা নার্গিসের শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়। সৈয়দ আবুল হোসেনের ছোটবোন সৈয়দা মনোয়ারা বেগম ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তিনি এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ড হতে মেয়েদের মধ্যে ফার্স্ট স্ট্যান্ড করেছিলেন। এসএসসি পাশ করে তিনি ইডেন কলেজে ভর্তি হন। খাজা নার্গিস ছিলেন তার ক্লাশমেট। উভয়ের মধ্যে অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল। সে সম্পর্কের সূত্র ধরে বিবাহের প্রস্তাব পাঠানো হয়। আবুল ভাইয়ের বংশ পরিচয়, শারীরিক ও মানসিক সৌন্দর্য প্রস্তাবকে সফল করে তোলে। ইডেন কলেজের পাশে অবস্থিত আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারে পূর্ণ ইসলামি শরিয়াহমতে উভয়ের শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হয়।
আবুল ভাই ও খাজা নার্গিসের দাম্পত্য জীবন পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক আদর্শ উদাহরণ। সৈয়দ আবুল হোসেনের দিনরাত শ্রম সাকোর উত্থানের পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। আবুল ভাই দিনরাত নিরলস সময় দিয়েছেন সাকো- এর জন্য। টেন্ডার ও জরুরি কাজের সময় বাসায় না-গিয়ে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন অফিসে কাটিয়েছেন। সাকো ইন্টারন্যাশনাল-কে গড়ে তোলার জন্য কত দিন বাড়ি যাননি তার ইয়ত্তা নেই। আমার অদ্ভুত লাগে মহীয়সী খাজা নার্গিস কখনও এ বিষয়ে কৈফিয়ত চাননি, প্রশ্নও তোলেননি। একজন স্বামীর প্রতি একজন স্ত্রীর এর চেয়ে বড় ভালোবাসা, বড় ত্যাগ, বড় বিশ্বাস কী হতে পারে তা আমার জানা নেই। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধই সৈয়দ আবুল হোসেনকে পরিবারের বাইরে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এত বেশি সময় দেয়ার সুযোগ দিয়েছে। এত সময় দিতে পেরেছেন বলেই আজ সাকো ইন্টারন্যাশনাল এত বিশাল। সুতরাং আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সৈয়দ আবুল হোসেনের বড় হবার পেছনে খাজা নার্গিস হোসেনের অবদান অসামান্য।
সৈয়দ আবুল হোসেনের রাজনীতি করার কিংবা রাজনীতিবিদ হবার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। কোনোদিন তা প্রকাশও পায়নি। কালকিনির লোকজনকে তিনি উদারহস্তে দান করতেন। মেয়ের বিয়ে, চিকিৎসা, ভর্তি, দারিদ্র্য বিমোচন, পারিবারিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি সমস্যা নিয়ে হাজার হাজার লোক আমিন কোর্টের সাকো অফিসে ভিড় জমাত। তিনি কাউকে খালি হাতে ফেরাতেন না। সাটুরিয়ায় টর্নোডো আক্রান্ত অসহায় ও বিধ্বস্ত লোকজন তাঁর সাহায্যে নবজীবন লাভ করেছে। ১৯৮৮ সালের বন্যায় মাদারীপুর তলিয়ে গিয়েছিল। সংবাদ পেয়ে ভগ্নিপতি সৈয়দ টুনু মিয়া, ভাগ্নে শাখাওয়াত ও আমাকে নিয়ে কালকিনির দুর্গত লোকদের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। কাড়ি কাড়ি টাকা ও বস্ত্র বিতরণ করেছেন। তাঁর আগমন সংবাদ জনমানুষের মনে ব্যাপক সাড়া তুলেছিল। জাতীয় পার্টির লোকজন তাঁকে সাহায্য করতে বাধা দেয়ার জন্য চলে আসে। তিনি তাদের ব্যবহারে মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনিও কম না, সাহায্য করবেন এবং করবেনই। এ প্রত্যয়ে আবুল ভাই অনড় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এলাকাবাসীর সহায়তায় দুর্গতদের মাঝে অর্থ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। লোকজন তাঁর নিঃস্বার্থ দানকে সানন্দে বরণ করে নিয়েছিলেন।
শিক্ষার প্রসার ছিল তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য। ছাত্রজীবনে তিনি যে সকল বিঘেœর সম্মুখীন হয়েছেন পরবর্তী প্রজন্ম যেন তা হতে মুক্ত থাকেন, এটিই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নয়ন অসম্ভব। তিনি বলতেন, ‘জাতির সার্বিক উন্নতির জন্য প্রত্যন্ত এলাকার নিরক্ষর লোকজনকে শিক্ষিত করে তোলা প্রয়োজন।’ তাই তিনি গ্রামাঞ্চলে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। খোয়াজপুরে যেখানে বর্তমানে সুদৃশ্য সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ দাঁড়িয়ে ১৯৮৯ সালের আগেও সেটি ছিল সাত-আট হাত গভীর পানির বিল। মাটির পর মাটি নয়, রীতিমত টাকার উপর টাকা দিয়ে বিলের উপর প্রাসাদ তুলেছেন। সৃষ্টি করেছেন শিক্ষার অনবদ্য পরিবেশ। এ কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি আমাকে জমি ক্রয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগিয়েছেন। সম্মান প্রদর্শন করে তাঁর কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও কলেজ গভর্নিং বডির সদস্য করেছেন। এটি শুধু উদারতা নয়, তারও বেশি। আমি কখনও সে কথা ভুলব না।
২০০৫ সালে আমি সাকো ইন্টারন্যাশনাল-এর চাকুরি হতে অবসর নিই। ১৯৭৫ হতে ২০০৫ দীর্ঘ ত্রিশ বছর আমি তাঁর প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেছি। এ ত্রিশ বছরে তাঁকে আমি কারও প্রতি অভদ্র, নিষ্ঠুর কিংবা অবিচার করতে দেখিনি। অত্যন্ত কষ্ট পেলে নিজের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করতেন। অনেক বড় ক্ষতি করলেও ক্ষমা করে দিয়েছেন। অন্যের কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারেন না। আমি ১৯৬৪ হতে ২০১০ পর্যন্ত সৈয়দ আবুল হোসেনের বন্ধু। সাকো ইন্টারন্যাশনালে ত্রিশ বছর কাজ করেছি। সাকো ইন্টারন্যাশনালকে কি দিয়েছি, এটা কখনও ভাবিনি। সাকো এবং সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে কি দিয়েছেন, তার হিসেব মেলাতে গেলে আমার হিসাব বার বার গোলমাল হয়ে যায়। খেই হারিয়ে ফেলি। আমি এখনও আমাকে ও আমার পরিবারকে সাকো ইন্টারন্যাশনাল হতে বিচ্ছিন্ন দেখতে পাই না। আমার জীবনের মূল্যবান ত্রিশ বছর যে প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয় করেছি তাকে ভুলে যাওয়া কখনও সম্ভব নয়। সাকো আমার নিঃশ্বাসে অবিরত সমুজ্জ্বল।
আমার বড় ছেলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাঙ্কে আছেন। এ চাকুরি পাওয়ার পেছনে আমার বন্ধু ও নিয়োগ কর্তা আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের বদান্যতা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনসহ প্রায় অর্ধশতক আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে কাটিয়েছি। যে কোনো সমস্যায় উদারহস্তে এগিয়ে এসেছেন পিতৃমমতায়। এ দীর্ঘ সময়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনে সামান্য খুঁতও খুঁজে পাইনি। ভেবে পাই না, তিনি মানুষ না দেবতা, নাকি তারও বড়!

আব্দুল কাদের: সৈয়দ আবুল হোসেনের ছাত্রজীবনের বন্ধু এবং সাকো ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রাক্তন কর্মকর্তা, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক।

বিশাল মনের মাটির মানুষ
মজিবর রহমান
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় মন্ত্রী আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন একজন অসাধারণ মানুষ। তাঁর জীবনধারা, কর্মপরিসর ও ব্যক্তিত্বের দিকে খেয়াল করলে বোঝা যায় তিনি একজন বিশ্বমানের ও বিশাল মনের মানুষ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে আসছেন। শুধু দায়িত্ব পালন নয়, বলা যায় অসাধারণ সফলতার সাথে, তুলনাহীন দক্ষতায় তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার যুগোপযোগী নির্দেশনার যথার্থ বাস্তবায়নের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তিকে বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল করার প্রতিটি পদক্ষেপে চমৎকার সফলতা অর্জন করেছেন।
নির্ভেজাল কর্মঠ মানুষ সৈয়দ আবুল হোসেন। মন্ত্রণালয় এবং বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দু’টিকে এমনভাবে পরিচালনা করছেন, যাতে কোনোটির সাবলীলতা ব্যাহত না-হয়। বিভিন্ন মত ও পথের মানুষের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং সহমর্মিতা প্রদর্শনে তিনি সীমাহীন উদারতা প্রদর্শন করতে পারেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতার অন্যতম উৎস উপদল সৃষ্টি ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সৈয়দ আবুল হোসেনের এলাকায় কোনো উপদল নেই। তাঁর সাম্যচেতনায় সবাই অভিন্ন একাত্মতায় একাকার হয়ে যায়। তাই সব দলের লোক তাঁকে শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন এবং বিশ্বাস করেন। আওয়ামী লীগ এর নেতা হলেও সব দলের কাছে তিনি সমভাবে গ্রহণযোগ্য।
তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে দলের হলেও দেশ ও জাতির উন্নয়নের প্রশ্নে সর্বোতভাবে রাষ্ট্রের হয়ে যান; হয়ে যান কল্যাণের, উন্নতির এবং প্রগতির। তাই সরকারি দল ও বিরোধী দল সবার কাছে রয়েছে তাঁর প্রশ্নাতীত গ্রহণযোগ্যতা। তিনি বাংলাদেশকে বোঝেন, বোঝেন মানুষকে। মানুষের প্রতি রয়েছে তাঁর অপরিসীম দরদ, জাতির প্রতি রয়েছে একনিষ্ঠ অঙ্গীকার। এজন্য তিনি দেশের সবাইকে, সবকিছুকে যথার্থ দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতে পারেন। তিনি কাউকে অবহেলা করেন না। শত্র“মিত্র সবাইকে কাছে টেনে নেন। ফলে কোন্দল ও দলমত তাঁর উদার ভালোবাসায় স্নাত, নির্মোহ পরশে ঐক্যের মহিমায় বিলীন হয়ে যায়।
যে কোনো অবস্থান হতে, যে কোনো অবস্থায় থেকে সর্বপর্যায়ের মানুষের মঙ্গল সাধন তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য। বস্তুত প্রচলিত আর্থ-রাজনীতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে জনমুখী ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা মেটানো কিংবা উদ্ভূত সমস্যা দ্রুত সমাধানের মাধ্যমে তিনি কাক্সিক্ষত লক্ষ্য স্পর্শ করতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মূলত এটিই তাঁর জীবনের ব্রত। সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবন ও কর্ম লক্ষ করলে এটি ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁর কাছে বামপন্থী, ডানপন্থী, মধ্যপন্থী কিংবা ধর্ম নির্বিশেষে সবাই সমান পান অভিন্ন ব্যবহার। তাই নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সবার কাছ হতে তিনি অনুরূপ ব্যবহার পান।
সুযোগ ও ক্ষমতা সাধারণত ব্যক্তিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলার উৎস হিসেবে কাজ করে। বহু সুযোগ ও প্রচণ্ড ক্ষমতা সৈয়দ আবুল হোসেন পেয়েছেন কিন্তু সবসময় থেকেছেন দুর্নীতির ঊর্ধ্বে। ক্ষমতা ও সুযোগ তাঁকে জনকল্যাণে আত্মোৎসর্গ করতে উৎসাহ দিয়েছে। ফলে তিনি থেকে যেতে পেরেছেন দুর্নীতিমুক্ত। প্রতিদ্বন্দ্বী এমনকি শত্র“রাও তাঁর সততার বিষয়ে কোন প্রশ্ন তুলতে পারেন না। মানুষ চারিত্রিকভাবে লোভী তাই নির্লোভ মানুষের সংখ্যা খুবই কম। যারা নির্লোভ তারা অসাধারণ, মহামানব। মানব চরিত্রের সবচেয়ে মহান অথচ দুর্লভ দিক হচ্ছে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের সহজ সুুযোগ ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সৎ থাকা এবং থাকতে পারা। সৈয়দ আবুল হোসেন এমন একজন বিরল ও মহান মানুষ, যিনি এ দুর্লভ গুণটির অধিকারী। তাই তাঁর পক্ষে নিজের অর্জিত অর্থ দিয়ে এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং সমাজকল্যাণমূলক কাজে কোটি কোটি টাকা আনন্দের সাথে খরচ করা সম্ভব হচ্ছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজে যাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তখন কলেজটি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত হয়নি। অধিভুক্ত না-হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘদিন তিনি কলেজের সকল শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন নিজের ব্যক্তিগত তহবিল হতে প্রদান করেছেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশপ্রেমিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী উদারমনা ব্যক্তি হিসেবে ছাত্রজীবন হতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। তবে সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় হবার ইচ্ছা তাঁর কোনোদিন ছিল না। জনগণের অনুরোধের মূল্য দিতে গিয়েই তিনি ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি হয়েছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর অভিমত হলো- ‘রাজনীতি না-করেও দেশের সেবা করা যায়।’ সক্রিয় রাজনীতিতে আসার পূর্বে তিনি শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক যে সকল কাজ করেছেন সেগুলো তাঁর এহেন দৃষ্টিভঙ্গির সাক্ষ্য বহন করে।
সৌজন্য প্রকাশে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো বড় মন বাংলাদেশে আর কারও আছে বলে মনে হয় না। তাঁকে আগেভাগে সৌজন্য প্রদর্শন করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়; তিনি নিজেই আগেভাগে সৌজন্য প্রদর্শন করে ফেলেন। সড়ক ও রেলপথ বিভাগে বদলির সুবাদে প্রতিদিন মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে দেখা করার, তাঁর কক্ষে যাবার এবং খুব কাছ হতে দেখার সৌভাগ্য ঘটে। এ সুযোগে তাঁর আচার-আচরণ ও সৌজন্য প্রকাশের যে উদারতা প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করি, তা প্রতিনিয়ত আমাকে হতবাক করে দেয়। পদমর্যাদায় তাঁর চেয়ে অধস্তন দর্শনার্থীকেও তিনি সিঁড়ি ও লিফটের গোড়া পর্যন্ত এগিয়ে দেন।
বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম হতে উঠে এসেছেন তিনি। মাটির মানুষের মাঝ হতে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা স্বপ্রতিষ্ঠিত মানুষ সৈয়দ আবুল হোসেন যতই উপরে উঠেছেন, মাটির সোদা গন্ধ তাঁকে ততই নিবিড় করেছে। শহরে জৌলুসময় পরিবেশে থেকেও ভোলেননি মাটির কথা। তাই তাঁর সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অবদান গ্রামকে ঘিরে, গ্রামের সাধারণ মানুষের কল্যাণে। তিনি একজন বিশাল মনের মাটির মানুষ।

মজিবর রহমান: অতিরিক্ত সচিব, সড়ক ও রেলপথ বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

মহান এক মানুষ
ওসমান গণি
মানব আর মহামানবের আকৃতি অভিন্ন। তারা মানবিক দুর্বলতা মুক্তও নয়, তবু পার্থক্য ব্যাপক। এ পার্থক্য ধর্মে নয় কর্মে; বর্ণে নয় মর্মে। কর্ম ও মর্মের অভিনন্দিত সমন্বয় ঘটিয়ে যে কোনো মানুষ মহামানব হয়ে উঠতে পারেন। মানুষ মাত্রই সাধারণ হয়ে জন্মায়। জ্ঞান-ধ্যান, আচার-আচরণ, প্রেম-ভালোবাসা, নির্লোভ-কর্ম, স্বর্গীয়-অনুভূতি, অহিংস-মমত্ব, প্রগাঢ়-অনুভব, সৎ-চিন্তা ও কল্যাণময়-কর্ম ইত্যাদির অনবদ্য সমন্বয়ে একজন মানুষ যখন আলোকিত হয়ে ওঠেন, তখনই তিনি মহামানবে পরিণত হন। সুতরাং জন্ম নয়, কর্মই মানুষকে মহান করে, ক্ষুদ্র করে।
সাধারণ মানুষ হতে মহামানবে উত্তরণ। যে কোনো মানুষের মধ্যে এরূপ এক বা একাধিক গুণাবলীর পরিস্ফুটন দেখা যেতে পারে এবং তা ঘটতে পারে। তবে আকস্মিক বলে তা কারও দৃষ্টি কাড়ে না। উল্কার মতো জ্বলে আবার নিভে যায়। সতত প্রকাশমান নয় বলে দাগ কাটে না স্মৃতিতে। তাই ক্ষণিকের জন্য অসাধারণ কিছুর প্রকাশ ঘটলেও ক্ষণস্থায়ীত্বের জন্য অগোচরে থেকে যায়। যাদের কর্মে ও মর্মে আলোকিত গুণাবলীর প্রকাশ সতত প্রজ্জ্বল, যাদের আলো অন্ধকারকে বিদূরিত করে, জনারণ্যে প্রগতির স্রোত ডাকে, জাতির অমানিশায় সূর্যের মতো অফুরন্ত শক্তির উৎস সৃষ্টি করে, তমসাচ্ছন্ন মনে আলোর দ্যুতি আনে, মূলত তারাই মহামানব। এ-সব গুণাবলী অর্জন অত্যন্ত কঠিন। চিত্তের সাথে বিত্তের সমন্বয় ঘটিয়ে মর্মকে নির্লোভ করতে না-পারলে তা কারও পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। অসাধারণ ধীচিত্ত, অবিশ্বাস্য কল্যাণপরায়ণতা এবং নির্লোভ অভিজ্ঞান না-থাকলে কেউ মহামানব হতে পারেন না। আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন গ্রামের মধ্যবিত্ত সাধারণ পরিবারে জন্ম নিয়েও কর্ম, চিন্তা ও চেতনার সাথে নির্লোভ কর্মনিষ্ঠার সমন্বয়ে পরিপূর্ণ মানুষের এক মহান অবয়ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
আজকের সভ্যতা মহামানবগণের অবদান, তাঁদের শ্রম-চেতনার ফসল। পৃথিবীতে যে সকল মহামানব জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁদের জীবন-কর্ম অধ্যয়ন করলে যে সকল ঘটনা মনে দাগ কাটে, হৃদয়ে শ্রদ্ধা আনে, অনুভবে চেতনার উন্মেষ ঘটায়; সে রকম ঘটনা মহামানবের চারিত্রিক নিদর্শন। যাদের জীবনে এমন ঘটনা দেখা যায়, তাঁরাই মহামানব। তিনিই মহামানব, যিনি নিজের জন্য যেমন ভাবেন, ঠিক তেমনি ভাবেন অন্যের জন্য, দেশের জন্য, সমাজের জন্য। তিনিই মহামানব, যিনি নিজের সুখের জন্য অন্যের সুখ ব্যাহত করেন না, তিনিই মহামানব যিনি অন্যকেও নিজের মতো মহান করে তোলার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যান।
সৈয়দ আবুল হোসেন নিজের জন্য ভাবেন, তবে তার চেয়ে বেশি ভাবেন দেশের জন্য, সমাজের জন্য। ধনী, গরিব, ছোট, বুড়ো, রাজনীতি-ধর্মমত নির্বিশেষে সবার কাছে আবুল হোসেন অবিসংবাদিত শিক্ষানুরাগী। রাজনীতিকে তিনি সহিংস ধারা হতে বের করে নিয়ে আসার জন্য উদ্গ্রীব। দানে তিনি অতুলনীয়, প্রাণে তিনি মোহনীয়। জাতীয়তাবোধে তিনি প্রবল, তবে তা সহিংস নয়, উগ্র নয়। তাঁর মনোভাব ও আদর্শ বৃষ্টির মতো স্নাত আর সকালের রোদের মতো মিষ্টি। নিজে যেটি বিশ্বাস করেন, সেটি কাজে পরিণত করার চেষ্টা করেন। ধর্মে তিনি অন্ত, তবে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক, চিন্তনে তিনি স্বাধীন, তবে নির্ভেজাল। এগুলো একজন মহামানবের জীবনের নিদর্শন।
প্রত্যন্ত এলাকার সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে সৈয়দ আবুল হোসেনের জন্ম। প্রতি মুহূর্তে এ রকম অসংখ্য শিশু জন্মায়। কিন্তু তাদের কেউ সৈয়দ আবুল হোসেন হয় না, হতে পারে না। গাছপালা সহজে গাছপালা, তরুলতা সহজে তরুলতা কিন্তু মানুষ হতে হলে অনেক সাধনা প্রয়োজন। সৈয়দ আবুল হোসেন স্বনামধন্য নেতা ও সফল শিল্পপতি, খ্যাতিমান ব্যাংকার, বোদ্ধা লেখক, দূরদর্শী বিশ্লেষক। তবে কারও অনুগ্রহে তিনি এগুলো লাভ করেননি, বরং প্রতিনিয়ত কর্ম ও মর্মের ঐশ্বর্যময় মহিমার নির্লোভ স্ফুরণের মাধ্যমে এ ভূষণ অর্জন করেছেন। স্বকীয়তার স্মারক সৈয়দ আবুল হোসেন বিন্দু বিন্দু মহিমা হতে সিন্ধু মহিমায় বিশাল হয়ে উঠেছেন। কালকিনির ছোট্ট একটা পরিবার হতে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে কোনোরূপ সংশয় ব্যতিরেকে সূর্যালোকের মতো নিদাঘ সৌকর্যে অনন্যসাধারণ স্থায়িত্বে প্রতিনিয়ত আলোকিত করছে সমাজকে।
পনেরো বছর আগেও কালকিনি ছিল একটি পশ্চাদপদ এলাকা। নিম্নাঞ্চলের এ ভূখণ্ডটিতে ছিল না রাস্তা, বিদ্যুৎ, শিক্ষালয় এবং আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া। এখন কালকিনি বাংলাদেশের যে কোনো উন্নত উপজেলার সাথে পাল্লা দিতে পারে। সৈয়দ আবুল হোসেনের অবদান। শিক্ষার দিক হতে গ্রামীণ উপজেলা হিসেবে প্রাকৃতিক অবস্থান বিবেচনায় কালকিনি এখন প্রথম স্থানে চলে গেছে। । পনেরো বছরে যেন পনেরোশ বছর এগিয়ে গেছে কালকিনি। কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজ, ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ, সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ, খোয়াজপুর, শত শত প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কালের মাঝে শিক্ষার স্তম্ভ হয়ে আলো ছড়াচ্ছে, ছড়িয়ে যাবে আরও অনেক কাল। পরিপাটি রাস্তাঘাট, সেতু, পুল, কালভার্টÑ পুরো উপজেলাকে আদর্শ উপশহরে পরিণত করেছেন। এমন উন্নয়নের পেছনে যে ব্যক্তির অবদান রয়েছে, তিনি হচ্ছেন সৈয়দ আবুল হোসেন। পনেরো বছর আগে যারা কালকিনি গিয়েছেন তাদের বর্তমান কালকিনিকে চিনতে সত্যি কষ্ট হবে। কোনো যাদু কালকিনিকে এমন পরিবর্তন করল? কোন্ আলাদীন? আলাদীন নয়, সৈয়দ আবুল হোসেন।
আবুল হোসেনকে বাদ দিলে কালকিনি কী হতো? সোজা মধ্যযুগ। পৃথিবীর এত উন্নয়ন, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য হাতেগোনা কয়েকজন মানুষকে বাদ দিলে তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকে না। বাংলা সাহিত্যের বিকাশে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মধুসূদন, শরৎচন্দ্র এরূপ হাতেগোনা কয়েকজন জন্ম না-নিলে বাংলা সাহিত্য সেই কয়েকটি পুঁথির সংকীর্ণ গলি। আর্কিমিডিস, নিউটন, আইনস্টাইন, এডামস, ব্যাভেজের মতো বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে না-এলে পৃথিবী এখনও গুহাময় থাকত। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় জন্ম না-নিলে মানুষ এখনও আকাশে ওড়ার যোগ্যতা অর্জন করত কিনা সন্দেহ আছে। জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, মাওসেতুং, মহাত্মাগান্ধী, মাদার তেরেসা, বঙ্গবন্ধুর মতো কয়েকজন রাজনীতিবিদ না-জন্মালে পৃথিবী এখনও থেকে যেত দাসত্বের নৃশংস আদিমে। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিলে বাংলাদেশ পরাধীন, বাঙালি জাতি নির্জীব। তেমনি সৈয়দ আবুল হোসেনকে বাদ দিলে কালকিনি মধ্যযুগের গহ্বর। যেখানে হাঁটু কাদায় রাস্তা, কলেজে পড়ার জন্য বরিশাল। আবুল হোসেনের বদান্যতায় কালকিনির বুকে বিশ্ববিদ্যালয় শোভা পাচ্ছে। এ এক অপূর্ব ইতিহাস। কালকিনির ছেলে-মেয়েদের কষ্টের দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন বরিশাল হতে লেখাপড়ার জন্য ছেলে-মেয়েরা কালকিনি আসে। কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বরিশালসহ বাংলাদেশের অনেক জেলার ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছে।
শিক্ষা সভ্যতার ভিত্তি। শিক্ষায় যে জাতি যত আগে অগ্রসর হয়েছেন, সে জাতির সভ্যতা তত আগে বিকশিত হয়েছে। যে জাতি যত আগে বিকশিত হয়েছে সে জাতি তত অধিক সম্মানিত ও ঐতিহ্যমণ্ডিত হয়েছে। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। এ স্বতঃসিদ্ধ কথাটি সৈয়দ আবুল হোসেনের মনে গভীর রেখাপাত করে। শিক্ষা ছাড়া জ্ঞান অর্জনের কোনো উপায় নেই। আর জ্ঞানী না-হলে শক্তি অর্জন সম্ভব নয়। তার ভাষায়Ñ
“শিক্ষাই জ্ঞান, জ্ঞানই শক্তিÑ এ মহান বাণীকে সামনে রেখে মাদারীপুর ও শরিয়তপুর জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার পথ প্রসারের লক্ষ্যে আমি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে আমার ক্ষুদ্র শক্তি ও সামর্থ্য নিয়োজিত করার অঙ্গীকারে উজ্জীবিত হই। আমি শিক্ষিত কিন্তু আমার চারিপাশে যদি অশিক্ষিত থেকে যায় তাহলে আমার শিক্ষার কোনো দাম থাকে না। অশিক্ষিতদের ভিড়ে আমার শিক্ষা কুশিক্ষার জঞ্জালে চাপা পড়ে যাবে। জাতিকে যদি আমি শিক্ষিত করতে না-পারি, তাহলে দেশ কখনও প্রকৃত উন্নয়নের স্বাদ পাবে না। মানুষ পরলোক গমন করে, কিন্তু তার কীর্তি থেকে যায় অবিনশ্বর। আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য হতে শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে জ্ঞানের আলোকে বিকশিত করে জাতিকে সভ্যতায় প্রস্ফুটিত করা এবং এর মাধ্যমে তাদের মনের মুকুরে স্থান করে নেবার কামনা নিয়ে আমি নিজেকে উৎসর্গ করেছি।”১
তিনি কোনো সাধারণ উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, দেশ জাতির বৃহৎ কল্যাণের লক্ষ্য নিয়ে নিজেকে, নিজের অর্জিত সম্পদকে উৎসর্গ করে যাচ্ছেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন আজ শুধু ব্যক্তিমাত্র নন, ব্যক্তির অধিক। ব্যক্তির অধিক বলতে সমষ্টিকে বোঝায়। সৈয়দ আবুল হোসেন গণনায় একজন কিন্তু কার্যকরণে অগণিত। যার পরতে পরতে মেধা, অন্তরে অন্তরে আলোকিত মানুষ গড়ার স্বপ্ন, কর্মে কর্মে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করার ব্যাকুলতা। যারা শুধু নিজের জন্য না-হয়ে, আমজনতায় নিজেদের বিলিয়ে দেয়ার প্রেরণায় উদ্গ্রীব থাকেন তারাই মহামানব। আবুল হোসেন এরূপ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। অন্যভাবে বলা যায়, যিনি মহান তিনি মহামানব, যিনি মহান কাজ করেন তিনি মহান। আর মহান কাজ বলতে বোঝায় আত্মস্বার্থের সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে অভিন্ন করে তোলা। সৈয়দ আবুল হোসেন চিন্তা, চেতনা, মনন ও কার্যে এমন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তাই তিনি মহামানব।
ওসমান গনি: প্রকাশক, আগামী প্রকাশনী।
১. সৈয়দ আবুল হোসেন খোয়াজপুর-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ।

সৈয়দ আবুল হোসেনকে যেমন দেখেছি
তরুন তপন দেওয়ান
আমার জীবনটাই গেল প্রয়োজন না-হলে ক্ষমতাবানদের এড়িয়ে চলো- এ দর্শনে। নিজের বাল্যবন্ধু ঢাকা কলেজের রুমমেট পরপর দুই বার এমপি হওয়ার পরও ‘হ্যালো’ বলিনি; পাছে সে বলে বসে, ‘এতদিন খবর রাখেনি, এখন খবর নিচ্ছে’- এই ভয়ে। অবশ্য তিন বার এমপি হওয়ার পর যখন সে প্রতিমন্ত্রী; তখন মাঝে মধ্যে ‘হ্যালো’ বলি। আমার এই দর্শন নিতান্তই মফস্বল কেন্দ্রিক বলে আমার ধারণা। যেহেতু চাকরি জীবনের অধিকাংশ সময়ই মফস্বলে কেটেছে। হয়ত-বা ক্ষমতাবানদের অহেতুক দাম্ভিক রূঢ় আচরণ বা অহঙ্কার প্রকাশকে ভালো লাগে না বলেই বা ক্ষমতাবানদের কুনজরে পড়ে গেলে লেজে-গোবরে অবস্থা হতে পারে ভেবে, ক্ষমতাবানদের ছায়া সহজে মাড়াতে চাইতাম না। এ যেন অনেকটা প্রলয়ের আশঙ্কা করে চোখ বুঁজে থাকার মতো, আর কি। অনেকে মনে করছেন, ‘কি কইতে কি, পান্তা ভাতে ঘি; বলতে এসেছে সৈয়দ আবুল হোসেনের কথা, আর বলছে নিজের কথা।’ আসলে মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের কথা বলতে গিয়েই নিজের মানসিকতার অবতারণা। না-হলে পাক শুদ্ধ হলেও পানসে হবার সম্ভাবনা।
মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের যে বৈশিষ্ট্যটি প্রথম দর্শনেই আমার ভালো লেগেছে, তা হলো তাঁর ইঁংরহবংং ঊীবপঁঃরাব খড়ড়শ। প্রায়শই কালো স্যুট, সাথে সুন্দর মানানসই টাই। অনেকের মতো পায়জামা পাঞ্জাবি পরে জননেতা সাজার প্রাণান্তকর চেষ্টা তাঁর মধ্যে নেই। তাঁর ব্যবসায়ী কর্মজীবনই হয়ত তাঁকে এ ঘধঃঁৎধষ খড়ড়শ টি দিয়েছে। এরপরে যেটি ভালো লাগে সেটি হলো তাঁর অমায়িক ব্যবহার: একেবারেই ঊষবমধহঃ ঃড়ঁপয । হাসিটি শিশুর মতোই নিখাদ বলে মনে হয়। সুন্দর ব্যবহার দিয়ে কীভাবে মানুষের মন জয় করা যায়, এই বিষয়ে তিনি এক অনুপম দৃষ্টান্ত হতে পারেন। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করি, “স্যার, ডেল কার্নেগির ‘ঐড়ি ঃড় নব চড়ঢ়ঁষধৎ’ বইটি কতবার পড়েছেন?”
আবার নিপাট ভদ্রলোক বলেই যে, রাগটাগ করেন না তা নয়, অবশ্যই রাগেন, মানুষ তো! মাঝে মধ্যে আমাদের মতো অধীনস্থদের কর্মকাণ্ডে কিংবা কেউ অতিরঞ্জিত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রকাশ করলে। অনেককে দেখেছি রাগলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। রাগের মুহূর্তে ঐ ভদ্রর লোকদের ভদ্রলোকি মুখোশ খসে পড়ে আর বস্তির অশিক্ষিত লোকের অশ্রাব্য খিস্তিখেউড় তাদের মুখ থেকে আগুনের গোলার মতো বের হতে থাকে। এক্ষেত্রেও আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর শিক্ষিত মনের সেই পরিশীলিত ও মার্জিত রূপে আলোকিত। সৈয়দ আবুল হোসেনের মুখ দিয়ে অন্যকে সামান্য আহত করতে পারে, এমন একটি উক্তিও বের হয় না। মুখের কাঠিন্য, চোখের ভাষা দেখে আমরা বুঝে নিই স্যার রাগ করেছেন। কোনো গালিগালাজ নেই, অথচ এতেই আমরা অধীনস্থরা থরথর কম্পমান।
এবার তাঁর কর্মক্ষমতা ও দক্ষতার দিকে একটু নজর দেই। কর্মক্ষমতার ক্ষেত্রে মনে হয় তিনি যেন একটি বহমান সময়। কোনো ক্লান্তি নেই। কাজে তাঁর সাথে তাল মিলিয়ে চলা কষ্টকর। একেবারেই ঝঁঢ়বৎ ভধংঃ। তিনি হাঁটছেন আর আমরা সবাই দৌড়াচ্ছি তাঁর পেছনে। যেখানে এক পদ্মা সেতুই যে কোনো লোকের ঘুম হারাম করে দিতে পারে, সেখানে পদ্মা সেতুর বাড়তি চাপ নিয়ে এত বড় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বহুমাত্রিক কাজের মনিটরিং করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। অথচ তিনি তা খুবই চমৎকারভাবে করে যাচ্ছেন। এত কর্মযজ্ঞের মাঝেও মুখের হাসির মলিনতা নেই।
একদিনের কথা বলি। সকাল থেকে মন্ত্রণালয়ের লোকদের সাথে কাজ করছি। কাজটি হলো: ঈধনরহবঃ ঈড়সসরঃঃবব ড়হ ঊপড়হড়সরপ অভভধরৎং-এর সভায় উপস্থাপনের জন্য চঁনষরপ-চৎরাধঃব চধৎঃহবৎংযরঢ় (চচচ) প্রয়োগে ২য় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণের উদ্দেশ্যে একটি সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করা। মন্ত্রী মহোদয় দুই-তিন বার সারসংক্ষেপটি সংশোধন করলেন। দুপুর দুটোর দিকে পিএস আমিন ভাইসহ কম্পিউটারে বসে সারসংক্ষেপ চূড়ান্ত করতে বসেছি। এমন সময় হুড়মুড় করে সেতু বিভাগের সচিব তাঁর পিডি এবং যুগ্মসচিবসহ পিএস সাহেবের কামরায় ঢুকে পড়েন। সচিব মহোদয় পিএস আমিন ভাইকে অনুরোধ করলেন, তাদের দু’তিনটে কাজ করে দেয়ার জন্য। বললেন, ‘খুবই জরুরি, মন্ত্রী মহোদয় সই করবেন।’ আমারটাও জরুরি; কিন্তু সচিবের তুলনায় আমি ছোট মানুষ বলে আমিন ভাই সচিব মহোদয়ের কাজ করা শুরু করলেন। আমি চুপচাপ সাইড লাইনে বসে থাকলাম, যতক্ষণ না সচিব মহোদয়ের কাজ শেষ হয়। সচিব মহোদয় ড্রাফটা নিয়ে একবার মাননীয় মন্ত্রীর কামরায় যান আর আসেন, ড্রাফটা সংশোধন করেন। সন্ধ্যে ছটার দিকে সচিব মহোদয়ের কাজ শেষ হলে আমি ক্লান্ত আমিন ভাইকে নিয়ে আমার কাজে বসে পড়লাম। মন্ত্রী মহোদয় কিন্তু তখনও তাঁর কামরায় বসা আমাদের ড্রাফটা দেখবেন বলে। আমিন ভাইকে হাসতে হাসতে বললাম “আপনার সমস্যা আপনি শিক্ষিত আর আমাদের সমস্যা মন্ত্রী শিক্ষিত।” মন্ত্রী মহোদয় তাঁর কাজে পারফেক্ট হতে চান বলে আমাদের এই সন্ধ্যে পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে। দায়সারা কাজ তিনি করেন না, প্রত্যেক কাজেই তাঁর কমিটমেন্ট লক্ষ করার মতো। কাজের মধ্যে সৌন্দর্য আর পরিপাটি থাকা চায়। আর দক্ষতার কথাই যদি বলি, তাহলে পদ্মা সেতুর কথা বলাটাই উত্তম। পদ্মা সেতুর কাজ ২০১০ সালের শেষের দিকে শুরু করবেন বলে ২০০৯ সালে দেয়া মন্ত্রী মহোদয়ের ঘোষণা নিয়ে আড়ালে-আবডালে অনেকে ঠাট্টা মশকারা করেছেন। আমরাও বিশেষ অজ্ঞের মতো সন্দেহ পোষণ করেছি। দাতা সংস্থার লোকজন বলেছেন উচ্চাভিলাষী। এখন কিন্তু আর ঠাট্টা করার, সন্দেহ পোষণ করার এবং উচ্চাভিলাষী বলার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মন্ত্রী মহোদয়ের কর্মক্ষমতা, কমিটমেন্ট, দক্ষতার সফল রসায়নের ফল হচ্ছে পদ্মা সেতুর বর্তমান কার্যক্রম।
সৈয়দ আবুল হোসেনের আর একটা গুণ চোখে পড়ার মতো, অন্তত এই বাংলাদেশে, যেখানে দেরি করে কর্মস্থলে যাওয়াটাই হচ্ছে বাঙালির ধর্ম, সেখানে প্রতিদিন সাড়ে আটটায় অফিসে হাজির হওয়া-কর্তব্যপরায়ণতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উপদেশ দিয়ে নয়, ফরমান জারি করে নয়, ‘আপনি আচরি ধর্ম, এ নীতিতে ব্রতী হয়ে সবাইকে নয়টার মধ্যে অফিসে উপস্থিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সময়ানুবর্তিতায় এক মিনিট এদিক-ওদিক হতে কোনো দিন দেখিনি। বিদেশিরাও হার মেনেছেন সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে। গত বারের শীতের ঘটনা। মন্ত্রী মহোদয় ভোর ছ‘টায় বাসা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। সফরসঙ্গী চীনের রাষ্ট্রদূত। আমরা জানতাম ছ‘টা ছ‘টাই, একটু হেরফের হবে না। মাঘের কনকনে শীতের আধো অন্ধকারে ভোর সোয়া পাঁচটায় বেইলী রোডের বাসা থেকে বেরোলাম। সাড়ে পাঁচটায় মন্ত্রী মহোদয়ের বাসায় হাজির হলাম। চীনা রাষ্ট্রদূত পৌনে ছ‘টায় এসে উপস্থিত হলেন। তার মাঝেই মাননীয় মন্ত্রী ড্রয়িংরুমে এসে পড়লেন। ঠিক ছ‘টায় যাত্রা হলো শুরু। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সার্থক আদর্শ তার চেয়ে আর কে হতে পারেন।
এবার আমার নিজের কথা দিয়েই শেষ করি। এ সরকারের শুরুর দিকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, ঢাকা জোন হিসেবে আমার বদলি হয়। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে এ পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমার ছোট ভাই মনিস্বপন দেওয়ান গত বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী ছিলেন। অনেকেই এ সময় মন্ত্রী মহোদয়ের কান ভারি করেছেন এই বলে যে, বিএনপি উপমন্ত্রীর ভাই কি করে আওয়ামী লীগের সময় ঢাকা জোনে বদলি হয়। ২০০৯ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি মন্ত্রী মহোদয় এবং তৎকালীন সচিব মহোদয় উভয়ে একসাথে ডেকে আমাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ৪-লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের ‘প্রকল্প পরিচালক’ পদে বদলি করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন; উদ্দেশ্য মরা প্রকল্পকে সচল করা।
চাকুরি জীবনে কোনোদিন দলবাজি করিনি, কোনো দলের হয়ে কাজ করিনি। শুধু কর্মে বিশ্বাস করেছি। কাজ করেছি। অর্পিত দায়িত্ব দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত থেকে সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছি। বিএনপি উপমন্ত্রীর ভাই এ কথায় কান ভারি না-করে মন্ত্রী মহোদয় আমার কর্মে বিশ্বাস করেছেন, আস্থা স্থাপন করেছেন। এ জন্য আমি তাঁর প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ এবং সমভাবে গর্বিতও। আমি আজীবন তাঁর এ বিশ্বাস ও আস্থার মর্যাদা রাখার প্রত্যয়ে অনড় থাকব। যেখানেই থাকি, যেভাবেই থাকি সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে যে শিক্ষা পেয়েছি, তা ভুলব না। যতটুক সম্ভব এ বোধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য অন্যকে অনুপ্রাণিত করব।
যাই হোক এবার উপসংহার টানব। এই লেখার শুরুতে বলা আমার জীবন দর্শনের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে। অবসর জীবনে খুঁজে নেওয়া চাকরির তাগিদে মাঝে মধ্যে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে যেতে হয়, গেলেই ইচ্ছে হয় সৈয়দ আবুল হোসেনকে একটি সালাম দিয়ে আসি, অন্তত পক্ষে একটা স্নিগ্ধ হাসি পাব বলে, একটি সুন্দর মানুষ দেখব বলে।
তরুন তপন দেওয়ান : সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, সওজ, এডিবি কনসালটেন্ট।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক অনন্য ব্যক্তিত্ব
অধ্যক্ষ হযরত মৌলানা মো. ইউনুস আলী
সৈয়দ আবুল হোসেন উদার চেতনা ও প্রগতিশীল মনের একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি। তিনি ইসলামের অনুসারী, পরহেজগার এবং অসাম্প্রদায়িক, তবে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক ঘোষণায় তাঁর কোনো দ্বিধা নেই। এ বিষয়ে তিনি যেমন দৃঢ় তেমনি সুস্পষ্টÑ
‘চূড়ান্ত বিশ্লেষণে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলেই একই স্রষ্টার সৃষ্টি। মানবতার চেয়ে বড় ধর্ম আর নেই। আমি সে মানবতায় বিশ্বাসী। চিন্তা ও চেতনায়, কাজে ও কর্মে একজন মানবতাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে আমার অবস্থান। সে-ভাবেই আমি শিক্ষা পেয়েছি। সেভাবেই জীবন গড়েছি। মনুষ্যত্বের পরিচয়েই আমি মানুষকে বিচার করে থাকি। আমার কাছে সবসময় মানুষই বড়। আমার ব্যবহারিক জীবনেও এ আদর্শই আমি সবসময়ই অনুসরণ করে আসছি।’১
মানবতার বিকাশে অসাম্প্রদায়িকতার কোনো বিকল্প নেই। তাই ইসলাম ধর্মে সাম্প্রদায়িকতা নিষিদ্ধ। শান্তির ও মানবতার ধর্ম ইসলামে সাম্প্রদায়িকতা বিষতুল্য। এ জন্য আল্লাহপাক মুসলমানদের সর্বোচ্চমাত্রায় সহনশীল ও নিরপেক্ষ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাাহপাক এরশাদ করেছেন, “এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছিÑ যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমণ্ডলীর জন্য এবং যাতে রসুল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য।”২ যারা আল্লাহ্পাকের এত øিগ্ধ প্রত্যাশাকে সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে বিনষ্ট করে দেয়, তারা কোনো অবস্থাতেই ঈমানদার হতে পারে না। সুতরাং আল কোরআনের নির্দেশনা মতে সাম্প্রদায়িকতা পুরোপুরি হারাম, এ বিষয়ে সন্দেহপোষণকারী ব্যক্তিকে পাক কালামের প্রতি সন্দেহপোষণকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
সৈয়দ আবুল হোসেন শিক্ষাদীক্ষা ও চিন্তা চেতনায় মনেপ্রাণে একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি সবার কাছে সম্মানিত। আদর্শবান মানুষ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থাকেন। একজন আদর্শ মানুষকে সাম্প্রদায়িকতা কখনও স্পর্শ করতে পারে না। যেমন পুণ্যকে স্পর্শ করতে পারে না পাপ। সৈয়দ আবুল হোসেন শুধু তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে নয়, বাস্তব ও প্রায়োগিক জীবনেও পরিপূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িক। তার অসাম্প্রদায়িকতা বোঝানোর জন্য একটি ঘটনা তুলে ধরছিÑ
সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর গ্রামের বাড়ি ডাসারের মূল বসত ঘরের যে কক্ষটিতে জন্ম নিয়েছিলেন সে কক্ষে তাঁর মা সুফিয়া খাতুন বসবাস করতেন। নব প্রতিষ্ঠিত সৈয়দ আতাহার আলী ডি কে আইডিয়াল কলেজের দুইজন মহিলা শিক্ষক আবাসনের অভাবে অসুবিধায় পড়েন। উভয়ে ছিলেন হিন্দু। সৈয়দ আবুল হোসেন তাদের দু’জনকে তাঁর মায়ের সাথে রাখার মনস্থ করেন। মায়ের মতামত চাওয়া হলে মা আলহাজ্ব সুফিয়া আলী বলেছিলেন, ‘ওরা আমার কন্যার মতো আমার সাথে থাকবে, খাবে।’ সৈয়দ আবুল হোসেনের মা তাদের পরম আদরে আপন কন্যার মতো নিজ কক্ষে থাকতে দিয়েছিলেন। কত বড় মাপের অসাম্প্রদায়িক হলে এটি সম্ভব, তা সহজে অনুমেয়। সৈয়দ আবুল হোসেন অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। তাদের পূর্বপুরুষগণও যুগযুগ ধরে ছিলেন ধর্মপ্রাণ কিন্তু অসাম্প্রদায়িক। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল হোসেনের দৃষ্টিভঙ্গি আরও শানিতÑ
‘একটি অসাম্প্রদায়িক খাঁটি বাঙালি পরিবেশে আমি মানুষ হয়েছি এবং সেই শিক্ষাই ধারণ করে চলেছি। সেই শিক্ষাই ধারণ করে চলব আমৃত্যু। সেই শিক্ষাই আমাকে প্রণোদিত করেছিল, উদ্বুদ্ধ করেছিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে।’৩
ধর্ম ব্যক্তির, রাষ্ট্র নাগরিকের। এটি অনেক নাগরিকের স্ব স্ব ধর্মের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের ক্ষেত্র। তিনি ধর্মকে রাষ্ট্রের সাথে গুলিয়ে ফেলার ঘোর বিরোধী। তিনি ধর্মনির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিককে সমমর্যাদায় অভিষিক্ত করার পক্ষপাতি। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার শশীরকর ইউনিয়নে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান কীর্তন উৎসবে এক লিখিত বক্তৃতায় সৈয়দ আবুল হোসেনের এ দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ মেলেÑ
‘হাজার বছর ধরে বাংলার হিন্দু মুসলমান পরস্পর পাশাপাশি ভাইয়ের মতো বসবাস করছে। মসজিদের আযান আর মন্দিরের শঙ্খধ্বনি কিংবা ঈদ আর পুজোয় স্ব স্ব সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের মধ্যে দিয়ে উদ্যাপন করছে। সেভাবেই তা তাদের মনে রেখাপাত করেছে। বাংলার স্বাধীনতার জন্য নবাব সিরাজউদদৌলার সাথে সাথে তার সেনাপতি মোহনলাল ও মীরমদন অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। আমিও অনুরূপভাবে নিজের অস্তিত্বে অসাম্প্রদায়িকতার ঐতিহ্য অনুভব করি। আমার কাছে মানবতার চেয়ে বড় কিছু নেই।’
সত্যি, সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে মানবতার চেয়ে বড় কিছু নেই। এ কারণে তিনি নিজের অর্জন, নিজের ইচ্ছা, আনন্দ, সুখ ইত্যাদি জাতি-ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণের কল্যাণে বিলিয়ে দেয়াকে পরম প্রাপ্তি মনে করেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন ধর্মান্ধ নন, ধর্মভীরুও নন, তিনি ধর্মপ্রাণ। তাই সে শিশুবেলা হতে ইসলামি শরিয়া অনুসারে জীবনযাপন করলেও কোনো ধর্মের প্রতি তার অশ্রদ্ধা নেই। ধর্মপ্রাণ বলে তিনি নিজের ধর্মকে প্রাণের মতো ভালবাসেন। নিজের ধর্মকে যিনি প্রাণের মতো ভালবাসেন, তিনি অন্যের ধর্মপালনেও প্রাণের মতো মমতা দেখান। কালকিনির নবগ্রাম ও শশীকরের নব্বই ভাগ অধিবাসী হিন্দু। সংখ্যালঘুরা তাকে দেবতার মতো ভক্তি করেন। সৈয়দ আবুল হোসেনের নির্বাচনী এলাকায় কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতন দূরে থাক, তাদের সামান্য অসম্মান দেখানোর সাহস পর্যন্ত কেউ পায় না। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য পরিষ্কার, ‘আমার নির্বাচনী এলাকার কোনো সংখ্যালঘু যেন কোনো অবস্থাতে মুসলমানদের কাছ হতে কোনো অবহেলা, অসম্মান না-পান। তারা সংখ্যালঘু। তাদের দেখভালের দায়িত্ব আমাদের। এটিই ইসলামের নির্দেশ।”৪
সুরা আল ইমরানে আল্লাহ্পাক এরশাদ করছেন, “তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত। মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজে নির্দেশ দান করবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দেবে।”৫ উম্মত সৃষ্টির উদ্দেশ্য এখানে পরিষ্কার। যারা মানব জাতির কল্যাণের পরিবর্তে সাম্প্রদায়িকতার নামে মানবজাতির অকল্যাণ ঘটায়, ধর্মের নামে অধর্মের বেসাতি করে মানুষকে কষ্ট দেয়, গলা কাটে, অসৎ কাজে প্রবৃত্ত করে তারা নিকৃষ্ট। ধর্ম ব্যক্তির কিন্তু রাষ্ট্র সবার সৈয়দ আবুল হোসেন এটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রকে সবার সানন্দ কল্যাণ নিশ্চিত এবং উপভোগ্য করে তুলতে হলে ধর্মনিরপেক্ষতার মর্ম অনুসারে পরিচালনা করতে হবে।
মানুষ আল্লাহ্র প্রতিনিধি এবং নেতা জনগণের সার্বিক কল্যাণের প্রতিভূ। নেতার কাজ তার অধিক্ষেত্রভুক্ত এলাকার সকল মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা, স¤পদের সুষমবণ্টনের মাধ্যমে অর্থনীতিক শোষণ হতে মানুষকে মুক্ত করা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক বিকাশকে অবারিত রাখা। আইনের বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের নিরাপত্তা বিধান নেতার কাজ। কেউ ধর্ম বা অন্য কোনো অজুহাতে জনগণকে এ সকল অধিকার হতে বঞ্চিত করলে, সে সৃষ্টিকর্তার কাছে জুলুমবাজ। পাক কোরআনে তাদেরকে আল্লাহ্ চরম পাপী, অবিশ্বাসী ও মুনাফেক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে সমাজে অন্যায়-অবিচার ও সাম্প্রদায়িক কলহ টিকিয়ে রাখে, তারা আল্লাহ্র অদেশ অমান্যকারী। তারা কীভাবে ইসলামের নামে রাজনীতি করে? তাই সৈয়দ আবুল হোসেন নিজেকে একজন পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তিনি মনে করেন, অসাম্প্রদায়িক হওয়া একটি কৃষ্টি। কৃষ্টি কখনও আপনা-আপনি গড়ে ওঠে না। সযতœ চর্চার বিষয়।৬ মনের গভীরে এ বোধ উৎসারিত না-হলে কেউ অসাম্প্রদায়িক হতে পারে না।
যারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সৃষ্টিকর্তাকে সংকীর্ণ স্বার্থ চিন্তায় আবদ্ধ রাখে, তাদের পক্ষে সৃষ্টি হতে কল্যাণকর ফল অর্জন করা সম্ভব হয় না। যারা স্বাধীনতাবিরোধী, প্রখ্যাত মুফাচ্ছেরে কোরআন বা আল্লামা উপাধি নিয়ে কোরআনের বাণী বিক্রি করে স্ত্রী-পুত্রদের আহার যোগান, নির্বাচনী খরচ সংগ্রহ করেন, তারা কখনও খাঁটি ঈমানদার হতে পারেন না। ধর্ম আত্মার শান্তি, পণ্য নয়। ধর্ম কল্যাণের, অকল্যাণের ছোঁয়া এতে থাকতে পারে না। যদি থাকে তো বলতে হবে এটি ধর্ম নয়; অধর্ম।
ধর্ম ব্যবসায়ীদের স্বরূপ ও অবস্থান বর্ণনায় আল্লাহপাক বলেছেন, “মুশরিকরা আল্লাহ্র আয়াতসমূহ অতি নগণ্য মূল্যে বিক্রয় করে, অতঃপর লোকদের নিবৃত রাখে তার পথ হতে, তারা যা করে চলছে তা অতি নিকৃষ্ট। ধর্মের নাম দিয়ে তারা সৃষ্টি করে বিবাদ।৭ পবিত্র কোরআনের সুরা আল-আনফাল-এর ৪৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্তায়ালা বিবাদে লিপ্ত না-হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং কোরআন-হাদিস ও ইসলামি আদর্শে ধর্মের নামে রাজনীতি তথা সাম্প্রদায়িক হানাহানি হারাম। পৃথিবীতে মানবতাবিরোধী সকল কাজই নিকৃষ্ট। যা মানুষকে কষ্ট দেয় তা পাপ। তাই সৈয়দ আবুল হোসেন সর্বদা মানবতার পক্ষে অবস্থান করেন। আর মানবতার পক্ষে অবস্থান করতে গিয়ে তাঁকে সর্বাগ্রে ত্যাগ করতে হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। বস্তুত সাম্প্রদায়িকতা সর্বনিকৃষ্ট পাশবিকতা বৈ কিছই নয়।
পবিত্র কোরআনে সুরা বাক্বারার ১১৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করছেন, “ইহুদিরা বলে খ্রিস্টানেরা কোনো ভিত্তির উপরেই নয় এবং খ্রিস্টানেরা বলে ইহুদিরা কোনো ভিত্তির উপরই নয় অথচ ওরা সবাই কিতাব পাঠ করে। এমনিভাবে যারা মূর্খ তারাও ওদের মতো উক্তি করে ….।” ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ভণ্ডামিপূর্ণ রাজনীতিক দলগুলোতে এ ধরনের পরস্পর আক্রমণাত্মক ও উস্কানিমূলক বাহাস অহরহ দেখা যায়। আল্লাহ্তায়ালা এদেরকে মূর্খ বলে ভর্ৎসনা করেছেন।
দুর্বল ও অত্যাচারিতের প্রতি অবহেলা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচার জুলুমের নামান্তর। সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ ছাড়া কেউ এমন কাজ করতে পারে না। যারা অত্যাচারী এবং অন্যের অত্যাচার দেখে প্রতিরোধ করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও নিশ্চুপ থাকে, ইসলাম তাদের পছন্দ করে না। তারা আশরাফুল মখলুকাতের অবয়বে জন্ম নিলেও প্রকৃতপক্ষে পশু। অত্যাচার সহ্যকারী কিংবা অত্যাচারিতের করুণ আর্তনাদে নির্লিপ্তকারী প্রত্যেকে অত্যাচারীর মতো সমান অপরাধী। অসহায় ও শোষিত জনগণের জন্য সংগ্রাম করে অত্যাচারিতদেরকে নির্যাতন হতে মুক্ত করা প্রত্যেক মুমিনের পবিত্র দায়িত্ব। এ কাজ করে গেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। সৈয়দ আবুল হোসেন বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও জীবন হতে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের অধিকারী হবার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, “আল্লাহ্র পথে নিপীড়িতদের জন্য তোমরা কেন সংগ্রাম করবে না? দুর্বল, অত্যাচারিত নরনারী আত্মক্রন্দন করছে। হে আল্লাহ্ জালিমদের এই ভয়ঙ্কর দেশ হতে আপনি আমাদের রক্ষা করুন।৮ অত্যাচারীর অত্যাচার সৈয়দ আবুল হোসেনকে ব্যথিত করে, মানুষের অসহায়ত্ব তাকে ব্যাকুল করে দেয়। অসাম্প্রদায়িক ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে মানুষের অসহায়ত্ব তিনি মেনে নিতে পারেন না। ঝাঁপিয়ে পড়েন মানুষের সেবায়, সমাজের প্রয়োজনে। এগিয়ে যান বন্যায়, শিক্ষায় আর ক্ষুধায়।
অত্যাচারিত মুসলমান আর নির্যাতিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো প্রত্যেক বিশ্বাসী মানুষের কর্তব্য। যে মানুষের অন্তরে বিন্দুবৎ ধর্মপ্রীতি ও মানবতা অবশিষ্ট থাকে, সে কখনও কোনো মানুষকে অত্যাচার করতে পারে না। শধু তাই নয়, যদি কেউ অত্যাচারীর কার্যকলাপ প্রতিহত করার চেষ্টা না-করে, তাহলে সে নিজেও অত্যাচারী। আল্লাহ্পাক বলেছেন, “আমি কী এমন কোন বিধান দিয়েছি বা এমন কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেছি, যা মানুষের অকল্যাণ বয়ে আনবে, মানুষকে যাতনায় নিপতিত করবে? অবশ্যই না, তবু মানুষের এত কষ্ট কেন? এ দিকে লক্ষ্য রেখে সৈয়দ আবুল হোসেন যাতে কোনো সংখ্যালঘুর উপর কোনো অত্যাচার না-হয়, তা সবসময় খেয়াল রাখতেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ধর্ম নিরপেক্ষতার উৎস ইসলামের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর ঐতিহাসিক মদীনা সনদ।”৯
“সকল মানুষ একই জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ্তায়ালা পয়গম্বর পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে। আর তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করলেন সত্য কিতাব, যাতে মানুষের মাঝে বিতর্কমূলক বিষয়ে মীমাংসা করতে পারেন। বস্তুত কিতাবের ব্যাপারে অন্য কেউ মতভেদ করে নি; কিন্তু পরিষ্কার নির্দেশ এসে যাবার পর নিজেদের পারস্পরিক জেদবশত তারাই করেছে, যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ্ ঈমানদারদেরকে হেদায়েত করেছেন সেই সত্য বিষয়ে, যে ব্যাপারে তারা মতভেদে লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা সরল পথ বাতলে দেন।”১০ পাক কোরআনের এ আয়াতে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, প্রেরিত কিতাবের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দ্বারা মানুষ অহেতুক অন্যায়ভাবে নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে। এভাবে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। যারা সীমিত জ্ঞানের অধিকারী এবং অজ্ঞ তারাই পবিত্র কোরআনের প্রকৃত অর্থের বিপরীতে গিয়ে অন্ধের হস্তি দর্শনের ন্যায় বিভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করায় কেতাব অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও অগণিত মতাবলম্বী সৃষ্টি করেছে। এ আয়াতটির মাধ্যমে আল্লাহ্তায়ালা সকল মানুষকে একই জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত ঘোষণা করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ধর্মান্ধতাকে হারাম করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের শতাধিক রাজনীতিক দল তথাকথিত ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে রাজনীতিতে সক্রিয়। তথ্যগতভাবে তাদের সবার উদ্দেশ্য ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম দাবি করলেও একদল অন্যদলকে সহ্য করতে পারে না, মুরতাদ ডাকে; কখনও কখনও আরও বেশি কিছু। কিন্তু ইসলাম অভিন্ন একটি ধর্ম, ইসলামি শাসনতন্ত্রও অভিন্ন একটি প্রত্যয়। তাহলে শতাধিক রাজনীতিক দল কেন? কারণ, তাদের উদ্দেশ্য ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, ইসলামে বিভেদ সৃষ্টি করে ইসলামের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করা, ফেতনা সৃষ্টির মাধ্যমে মানবতাকে বিপর্যস্ত করা। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে জাতিকে সংকটে নিপতিত করা। এ বিষয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের ভাষ্য অত্যন্ত চমৎকারÑ
“একাত্তরের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণতন্ত্রসম্মত অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ে তোলা। যেখানে সকল ধর্মের, সকল সম্প্রদায়ের লোকজন সুখ ও শান্তিতে বসবাস করবে। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আদর্শ।”১১
আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, “সমগ্র মানবমণ্ডলী এক জাতি”১২ তাহলে কেন রাষ্ট্রের অজুহাতে, সরকারের নামে, রাজনীতির আড়ালে একদল অন্যদলকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখে শোষণ করবে? কেন চলবে সাম্প্রদায়িক নৃশংসতা? কোরআনে জাতি স¤পর্কে বিধৃত বিশ্বসাম্যের বাণীকে সৈয়দ আবুল হোসেন নিজ অন্তরে সযতেœ লালন করেন। শুধু তিনি নন, জন্মজন্মান্তর হতে করে আসছেন। এ মহান বাণীর স্বর্গীয় কিরণ সৈয়দ আবুল হোসেনকে, সৈয়দ আবুল হোসেনের সত্তাকে বিশ্ব সাম্যের মহীয়ান মহিমায় মহিমান্বিত করে তুলেছিল বলেই তাঁর পক্ষে মানবতার কল্যাণে সম্পূর্ণ সার্বজনীন হয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।
যারা শাসনের নামে জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখে তারা আল্লাহ্র নির্দেশ ভঙ্গকারী। আর কে না জানে, যারা আল্লাহ্র নির্দেশ ভঙ্গ করে, তারা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী। খোদাদ্রোহীরা আল্লাহ্র সবচেয়ে বড় দুশমন। অনন্য সাধারণ ধীশক্তির অধিকারী ও অবিশ্বাস্য ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর ধনস¤পদ, মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে প্রমাণ করে গেছেন, তিনি শধু ত্যাগী মাত্র নন, নিজেই ত্যাগের অনন্য মহিমা। আল্লাহ্র রাহে এত বড় ত্যাগ স্বীকারকারী ব্যক্তি ও পরিবার সারা বিশ্বে বিরল। এলাকার সংখ্যালঘুরা সৈয়দ আবুল হোসেনকে পরম নির্ভরতায় বিশ্বাস করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাকে ভালোবাসেন, অনুসারীরা শ্রদ্ধা করেন; নিরপেক্ষরা বন্ধু ভাবেন। কারণ তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আযুগ বিকশিত মহাসাগর।

অধ্যক্ষ মো. ইউনুস আলী: অধ্যক্ষ, কালনা আমিনিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, খুলনা, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক।

১. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ১১৬।
২. আল কোরআন, সুরা বাক্বারা, আয়াত- ১৪৩।
৩. মাদারীপুরের কালকিনি থানার শশীকরে অনুষ্ঠিত হিন্দু সম্প্রদায়ের কীর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতা, ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৯৫ ( গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন গ্রন্থের ১১৮-১১৯ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।
৪. ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে এলাকার রাজনীতিকদের উদ্দেশে দেয়া এক বক্তৃতায়।
৫. আল কোরআন, সুরা আল ইমরান, আয়াত- ১১০।
৬. গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট, সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রকাশক মো. আব্দুল কাদের।
৭. আল কোরআন, সুরা তাওবা।
৮. আল কোরআন (৪ ঃ ৭৫)।
৯. গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট, সৈয়দ আবুল হোসেন, অধ্যায় ইসলাম ও আওয়ামী লীগ, পৃষ্ঠা ১৩৫; প্রকাশক মো. আব্দুল কাদের।
১০. আল কোরআন, সুরা বাক্বারা, আয়াত- ২১৩।
১১. নেতৃত্ব উন্নয়ন ও গণতন্ত্র, সৈয়দ আবুল হোসেন।
১২. আল কোরআন- (২ ঃ ২১৩)।

এক আদর্শ সংসদ সদস্যের কথা
অধ্যাপক মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হই। সৈয়দ আবুল হোসেনও সেবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদে আমরা পাশাপাশি বসতাম। বয়সে আমি তাঁর চেয়ে সিনিয়র, তবে সংসদ সদস্য হিসেবে একই সময়ে সংসদে আগমন। প্রথম দিনের কথা এখনও মনে আছে। সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন: আমার নাম সৈয়দ আবুল হোসেন। তাঁকে আমি চিনতাম। তাঁর দানশীলতা আর বদান্যতার কথা হাতিয়া দ্বীপেও ছড়িয়ে পড়েছিল। হ্যান্ডস্যাক করতে করতে মুখের দিকে তাকালাম। চমৎকার হাসি। দাঁত নয় যেন মুক্তো। বলেছিলাম: আমি অধ্যাপক মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ, হাতিয়া বাড়ি। আপনি খুব বিখ্যাত লোক। আমার কথা শুনে তিনি আবার হাসলেন, অনুপম হাসি। মনে হলো লজ্জা পেয়েছেন, আসলে লজ্জা নয়, নম্রতা। বললেন: আপনিও কম বিখ্যাত নন। আপনার আর আমার মিল আছে। আপনার মতো আমিও নদী ভাঙন এলাকার লোক।
তারপর হতে পরিচয় নিবিড় হতে শুরু করে। তিনি সংসদে যে কোনো বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতেন। প্রথমে তাঁকে আমি রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়, ব্যবসায়ী হিসেবে বেশি সফল মনে করতাম। কিছুদিন পর দেখলাম তিনি উভয় অঙ্গনে সফল। কোনটায় বেশি, কোনটায় কম, এমন ভাবনা কেউ করলেও স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি সারা বাংলাদেশে খ্যাত। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের মহাপ্লাবনে তাঁর উদার সহায়তার কথা কে না জানে। সংসদ সদস্যের অনেকে এ কারণে তাঁকে ঈর্ষা করত। আমি মনে করি, ঈর্ষা নীরব স্বীকৃতি।
হাজি মুহম্মদ মহসীন উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের দাতা শিরোমণি। তাঁর দানে অনেক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান হয়েছে। নিঃসন্দেহে তিনি আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। হাজি মুহাম্মদ মহসীনের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে আমি বলতে চাই, দাতা হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেন হাজি মহসীনের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। হাজি মহসীন দাতা শিরোমণি হলে সৈয়দ আবুল হোসেন দাতা মহা-শিরোমণি। আমার মন্তব্য অতিরঞ্জিত ভাবার কোনো অবকাশ নেই। আমি কেন সৈয়দ আবুল হোসেনকে হাজি মুহাম্মদ মহসীনের চেয়েও শ্রেষ্ঠ দাতা বললাম তার যুক্তি দিচ্ছি।
হাজি মহসীন তার বোন মুন্নজানের সম্পত্তি পেয়ে ধনী হয়েছেন। মুন্নজান পেয়েছেন তার স্বামী হতে। হাজি মহসীনের পেশা ছিল ভ্রমণ করা। বোনের দেয়া সম্পত্তি হতে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি ইচ্ছেমতো ঘুরতেন। হাজি মুহসীন ছিলেন অবিবাহিত, চিরকুমার। স্ত্রী-পুত্র-দারা-পরিবার কিছু ছিল না। কোনো নিকটাত্মীয়ও তেমন ছিল না। যারা ছিলেন তাদের কাউকে তিনি বঞ্চিত করেননি। বোনের নিকট হতে প্রাপ্ত সম্পত্তি দান করার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো পিছুটান ছিল না। তিনি নিজের অর্জিত সম্পত্তি দান করেননি। বোনের নিকট হতে প্রাপ্ত সম্পত্তি দান করেছেন।
সৈয়দ আবুল হোসেনের বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রত্যন্ত কালকিনি উপজেলার ডাসার গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে সৈয়দ আবুল হোসেনের জন্ম। তিনি নিজ গ্রামে অবস্থিত ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে পঞ্চম শ্রেণি এবং গৈলা উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি পাশ করেন। অতপর, গৌরনদী কলেজ। গৌরনদী কলেজ হতে কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন। ওখান থেকে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স ডিগ্রি পাশ করেন। সাদামাটা মনের সাধারণ মানুষ তিনি। ভেবেছিলেন মাস্টার্স-এর সার্টিফিকেট নিয়ে চাকুরি করে সংসার-ধর্মে আত্মনিয়োগ করবেন। ভালো চাকুরি পেতেন, চাকুরিতে গেলেন না, বরং দেশের সেবা করার লক্ষ্যে ব্যবসায় নামলেন। কঠোর পরিশ্রম, সততা আর একাগ্রতায় আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে লাগলেন। ব্যবসায়ী হতে হলেন দানবীর, দানবীর হতে জনগণের ব্যাকুল অনুরোধে হলেন সংসদ সদস্য, তারপর রাজনীতিবিদ। সব নিজের চেষ্টায়। তিনি আপন ভুবনে একজন সেল্ফ মেইড ম্যান। হাজি মহসীনের মতো কারও সম্পত্তি তিনি পাননি। নিজের শ্রম আর ঘামে অর্জন করেছেন সব। কারও দয়ায় নয়, কর্মের বিনিময়ে। তিনি নিজের রক্তস্নাত শ্রমে অর্জিত সম্পত্তি দান করেছেন।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের সংসদে এমপি হিসেবে তিনি আর আমি দু’জনে ছিলাম নতুন। তদুপরি বিরোধী দলের সংসদ সদস্য। স্বাভাবিক কারণে বেশি ফ্লোর পেতাম না, নিতেও চাইতাম না। সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন মিতভাষী। তিনিও বেশি ফ্লোর নিতেন না, তবে ফ্লোর নিলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম তাঁর দিকে। ছোট ছোট বাক্যে চমৎকারভাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বক্তব্য শেষ করে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে কথা থাকত কম, অর্থ থাকত বেশি। তাই স্পিকার যে সময় বরাদ্দ করতেন, সে সময়ের মধ্যে বক্তব্য শেষ করতেন। বলতেন, ‘আমি যদি বেশি সময় নিই তাহলে বাকিরা বলবেন কীভাবে?’ তাঁর এমন সচেতনতা আমাকে মুগ্ধ করত। আমাদের অনেকের এ বোধ ছিল না। ফ্লোর নিয়ে বলে যেতাম, সময়ের দিকে খেয়াল করতাম না। সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন অত্যন্ত সময়-সচেতন। যে কোনো বিষয়ের উপর তিনি সাবলীলভাবে বলে যেতে পারতেন। অসংখ্য উদ্ধৃতি আর পরিসংখ্যান তাঁর মুখস্থ ছিল।
অনেক সংসদ সদস্যকে দেখেছি সংসদ ভবনে মন্ত্রী-এমপি-দের কাছে ধরণা দিতে; ব্যবসার তদ্বির করতে। আমি সৈয়দ আবুল হোসেনকে কখনও সংসদ ভবনে নিজ ব্যবসার তদ্বির করতে দেখিনি। তাঁর কাছে ব্যবসা আর রাজনীতি, প্রতিষ্ঠান এবং সংসদ ভবন সম্পূর্ণ আলাদা সত্তা। ব্যবসার তদ্বির না-করলেও এলাকার উন্নয়নের জন্য তিনি সর্বক্ষণ সচেষ্ট থাকতেন। তিনি ফ্লোর নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে কখনও ব্যর্থ হতে দেখিনি। তাঁর সময়জ্ঞান এবং যৌক্তিক কথার জন্য স্পিকার তাঁকে ফ্লোর দিতে উৎসাহ বোধ করতেন। সংসদে তাঁর এলাকার অভাব অভিযোগ চমৎকারভাবে তুলে ধরতে পারতেন। তাঁর কথায় থাকত যুক্তি আর সহানুভূতি আদায়ের মতো তথ্য। কখন কোন কথা বললে কার্যকর হবে, সময়োপযোগী হবে, তা তিনি সহজে বুঝতে পারতেন এবং ঠিক সেভাবেই বলতেন।
মানুষকে অভিভূত করার মতো এত পারঙ্গম সংসদ সদস্য আমি সৈয়দ আবুল হোসেন ছাড়া আর কারও মাঝে তেমন দেখিনি। তাঁর নম্রÑভদ্র কথা সবার কাছে অলঙ্ঘনীয় হয়ে উঠত। হৃদযোগীর ন্যায় অসাধারণ একটি আকর্ষণ তাঁকে ঘিরে থাকে। মানুষের মন জয় করার অসাধারণ ক্ষমতা সৈয়দ আবুল হোসেনের মজ্জাগত। আমরা যে কাজ অসাধ্য মনে করতাম, তিনি তা সহজে করে নিয়ে আসতেন। এ গুণ তাঁর অর্জন, নাকি জন্মগত তা ভেবে ঠিক করতে পারতাম না।
সৈয়দ আবুল হোসেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। বিএনপি ক্ষমতাসীন দল। রাজনীতিক কারণে আমাদের সাথে সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের ভালো সম্পর্ক ছিল না। অনেকের সাথে কথা বলাবলি পর্যন্ত বন্ধ ছিল। সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁকে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরাও ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর হাসির কাছে সবাই নত হয়ে যেত। অনেক সিনিয়র সংসদ সদস্যও সৈয়দ আবুল হোসেনকে আবুল ভাই ডাকতেন। তাঁর কথায় ছিল আন্তরিকতা। মুখের হাসিটা এত প্রাণবন্ত ছিল, মনে হতো সকালের রোদ। জ্যোৎস্নার মতো এক প্রবল আকর্ষণ তাঁকে সারাক্ষণ ঘিরে থাকত। অপ্রয়োজনীয় একটা কথাও তিনি বলতেন না। আচরণ ছিল সবসময় অনুপম। সৌজন্যবোধ তাঁকে সবার প্রিয়পাত্র করে তুলেছিল।
এলাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল কিংবদন্তির মতো। তবে তাঁর সম্পর্কে একটা কথা অনেকে বলে থাকেন। সেটি হচ্ছে, তিনি নাকি এলাকায় কম যান। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের সংসদ নির্বাচনে তিনি শুধু একবার এলাকায় গিয়েছিলেন। অথচ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। সাধারণত নির্বাচনের সময় ভোট চাওয়ার জন্য আমরা এলাকায় মানুষের ঘরে ঘরে যাই। হাতে ধরি, জড়িয়ে ধরি। জয়ের পর আর খবর রাখি না। নির্বাচনের পর মাঝে মাঝে এলাকায় গিয়ে পার্টির নেতা-কর্মীদের সাথে মিটিং মিছিল করি। ভিলেজ পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়ি। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিগণের সাথে বিভিন্ন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে না-পড়ে উপায় থাকে না। অনেক সংসদ সদস্য উপজেলার অনুকূলে বরাদ্দ টিআর-কাবিখা নিয়ে টানা-হেঁচড়া শুরু করেন। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিগণকে তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেন। উপজেলার কোনো কর্মে হস্তক্ষেপ করতেন না, এখনও করেন না। তিনি বলতেন, ‘আমি অন্যের দায়িত্বে অযথা হস্তক্ষেপ করতে যাব কেন? আমি কারও পক্ষে গেলে অন্যজন আমার বিপক্ষে অবস্থান করবেন। সবাইকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে আমি সবার ভালোবাসা পাব।’ তাঁর এ কৌশলটা আমার কাছে সর্বোত্তম মনে হতো। আমিও অনুরূপ চেষ্টা করতাম। পারতাম না। তাঁর মতো হতে হলে যে ধৈর্য ও কৌশলের প্রয়োজন, তা অর্জন করা সহজ নয়।
আমি গ্রামে নিজের সংসদীয় এলাকায় থাকি। গ্রামে থেকে এমপি হয়েছি। তবে আমার জনপ্রিয়তা সত্য বলতে কি, সৈয়দ আবুল হোসেনের তুলনায় বলার মতো কিছু নয়। আমি একবার এমপি হয়েছি। সৈয়দ আবুল হোসেন ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এমপি হয়েছেন। তারপর আর কেউ তাঁকে হারাতে পারেননি। পরপর চার বার এমপি হয়েছেন। এলাকায় কম গেলেও তাঁর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েছে। আর আমরা অনেকে এলাকায় থেকেও কিংবা এলাকায় ঘন ঘন গিয়েও জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারিনি। এর কারণ কাজ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা। এটি নৈকট্য বা দূরত্বের বিষয় নয়, আন্তরিকতার বিষয়। সৈয়দ আবুল হোসেন এমপি পরিমাণগত দূরত্বকে হৃদয়ের নিবিড়তা দিয়ে মুছে দিতে পেরেছেন। আমরা অনেকে তা পারিনি। সুতরাং তাঁর এলাকায় কম যাওয়া বা বেশি যাওয়ায় কিছু যায় আসে না। তাঁর মন সবসময় পড়ে থাকে গ্রামে। নইলে প্রত্যন্ত গ্রামের উন্নয়নের জন্য এত স্কুল, কলেজ, মাদরাসা গড়ে তুলতে পারতেন না।
নেতাকে জনগণের সাথে সম্পর্ক রাখতে হয়, নির্বাচনে জিততে হলে এর বিকল্প নেই। এর মানে এলাকায় গিয়ে কিছু লোকের সাথে কোলাকুলি করা এবং কিছু লোককে ঘায়েল করার জন্য প্রশাসনকে ব্যবহার করা নয়। এরূপ করতে গিয়ে অনেক প্রতিভাবান সংসদ সদস্যকে উল্কার মতো হঠাৎ জ্বলে উঠে চিরতরে হারিয়ে যেতে হয়েছে। নেতার সাথে ভোটার ও জনগণের সম্পর্ক হতে হয় আত্মিক, হৃদ্যিক এবং নান্দনিক। সৈয়দ আবুল হোসেন জনগণের সাথে এ ত্রয়ী সম্পর্কে শুরু হতে অবিচ্ছেদ্য হয়ে যেতে পেরেছিলেন। তিনি এলাকায় না-গিয়েও প্রতিটি ভোটারের খবর রাখেন। বিপদে-আপদে প্রয়োজনীয় সাহায্য পৌঁছে দেন। তাঁর কাছে আগত লোকদের কাউকে খালি হাতে ফেরত দেন না। তিনি আওয়ামী লীগের এমপি হলেও দল নির্বিশেষে সবাইকে সমান চোখে দেখেন। প্রতিদ্বন্দ্বী-প্রবল এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আগে হাত দেন। সংসদে তিনি আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। কালকিনিতে তিনি শুধুই এমপি। নির্বাচনে জয়ের পরপর সব দলের লোকদের কাছে টেনে নেন। কারও প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন না। শত্র“দের প্রতিও অমায়িক ব্যবহার দেখান। সব দলের লোকের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কারণ তিনি গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের মতো কাজ করেন।
১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের বন্যায় যখন তিনি দুর্গতদের পাশে সাহায্যের অবারিত হাত প্রসারিত করেছিলেন, তখন তাঁর কোনো রাজনীতিক উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি জনগণের সেবার জন্য নিঃস্বার্থ মনোভাবে এলাকায় গিয়েছিলেন। সে সময় তাঁর প্রসারিত হাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন আপামর জনতা, দুর্গত মানুষ, গরিব ছাত্র, কন্যাদ্বায়গ্রস্ত অসহায় পিতা। অনবরত তিনি তাদের ছায়া দিয়ে গিয়েছেন। একজন লোক কোলাকুলির চেয়ে তার প্রয়োজন মেটানোকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। তিনি যেমন করেছেন কোলাকুলি তেমন মিটিয়েছেন প্রয়োজন। সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর নির্বাচনী এলাকায় যেভাবে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির ও রাস্তাঘাট করেছেন তা অভাবনীয়, অলৌকিক এবং অবিশ্বাস্য। তাঁর বদান্যতায় কালকিনির ছেলেরা পান্তাভাত খেয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এলাকার সব মানুষের মনে তিনি সূর্যালোকের মতো বিদ্যমান। তাঁর সশরীরে এলাকায় যাবার প্রয়োজনীয়তা এখানে গৌণ বিষয়। তিনি আন্তরিকতা দিয়ে সকল দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছেন।
আমাদের চাঁদ প্রয়োজন। তবে চাঁদকে কোলে নিয়ে বসে থাকার জন্য নয়; জ্যোৎস্নার জন্য। সূর্য নয় সূর্যের আলো সবার কাম্য। সূর্য দূরে না কাছে এটি বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য হচ্ছে আলো। তেমনি সৈয়দ আবুল হোসেন এলাকায় কম যান নাকি বেশি যান সেটি আলোচ্য হতে পারে না। আলোচ্য বিষয় তিনি এলাকার জন্য কী করেছেন এবং করছেন। তিনি তাঁর অবস্থান থেকে অর্জিত উর্বরতা কালকিনিতে প্রতিনিয়ত সরবরাহ করছেন। সূর্যের মতো তাঁর আলো সতত বিস্তৃত সর্বত্র।
সংসদ জাতির বিবেক, সংসদকে জনগণ যাতে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন, সেভাবে সংসদ সদস্যগণকে চলতে হবে, এ হচ্ছে তাঁর অভিমত। তিনি কোনোদিন সংসদে কারও বিরুদ্ধে একটি অশোভন উক্তিও করেননি। সবসময় সতর্ক থাকতেন যাতে তাঁর কথায় কেউ আহত না-হন, বিক্ষুব্ধ না-হন। কেউ তাঁর প্রতি ক্ষোভ দেখালেও তিনি তা এমন সহজে গ্রহণ করেন যে, যিনি ক্ষোভ দেখান, তিনি লজ্জায় মুষড়ে পড়েন।
তিনি এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। এত বড় দায়িত্ব, তবু কোনো অহমিকা দেখিনি। আগের মতো রয়ে গেছেন। চলনে-বলনে এমনকি অবয়বেও। বয়স আমার অনেক বেড়েছে। তাঁকে দেখে মনে হয় বয়স বাড়েনি। আসলে বয়স মনের বিষয়, সময়ের নয়। মন্ত্রণালয়ে গেলে এখনও আগের মতো সদাহাস্যে উঠে দাঁড়ান। সালাম ও হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার।
অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন নামের জন্য। প্রতিষ্ঠার পর আর খবর রাখেন না। সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজ সন্তানের মতো অবিরাম পরিচর্যায় নিবেদিত। তাঁর দান একদিকে যেমন বিশাল অন্যদিকে তেমন নীরব ও গোপন। ডান হাতে দান করেন কিন্তু বাম হাত জানে না। তিনি কি দিলেন সেটি মনে রাখেন না, মনে রাখেন কে তাঁকে দিয়েছেন। কেউ তাঁর জন্য সামান্য করলেও তিনি তা সহস্রগুণ প্রবল কৃতজ্ঞতায় ফেরত দেয়ার চেষ্টা করেন।
সংসদ সদস্য হিসেবে আমি তাঁকে পাঁচ বছর খুব কাছ হতে এবং বাকিটুকু অনতিদূর থেকে অবলোকন করেছি। সংসদীয় কার্যবিধি, সংসদ পরিচালনা সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন, বিধি ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর পরিপূর্ণ ধারণা আছে। সংসদে তিনি যা বলতেন তা প্রতিটি যুক্তি, আইন, বিধি ও নজিরসহ উল্লেখ করতেন। যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে এখন তাঁকে আরও সতর্ক, আরও বিচক্ষণ মনে হয়। কোনো বেফাঁস কথা বলেন না। এমন আচরণ করেন না, যাতে সরকার বা প্রশাসন বিব্রত অবস্থার মুখোমুখি হয়। এমন কাজ করেন না, যাতে সংসদের ভাবমূর্তি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। শুধু সংসদে নয়, একজন সংসদ সদস্যকে সবসময় সংসদ সদস্যের মতো আচরণ করতে হবে। এটিই তাঁর দর্শন। তিনি সবসময় শালীন, ভদ্র ও মার্জিত; কোনো সাধারণ লোক যেন কোনোভাবে তাঁর আচরণ হতে কষ্ট না-পায় সে বিষয়ে সদা সতর্ক থাকেন। জনস্বার্থ রক্ষা সংসদ সদস্যগণের অন্যতম দায়িত্ব। এটি তিনি কোনো কিছুর বিনিময়ে ক্ষুণœ হতে দেন না। আর একটা বিষয় যেটি আমাকে মুগ্ধ করত, সেটি হচ্ছে ক্ষমতার ব্যবহার। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার কখনও করেননি। রাজনীতি করলেও সৈয়দ আবুল হোসেন ব্যবসায়িক স্বার্থে রাজনীতিকে ব্যবহার করেননি। অন্তত আমি কোনোদিন এমন দেখিনি।
জাতীয় সংসদের অন্যতম কাজ আইন প্রণয়ন। এ বিষয়ে আইনের একজন ছাত্র হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সবসময় আন্তরিক দেখা গেছে। খসড়া আইনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো তিনি গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতেন। কোনো সংশয় থাকলে সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করে পরিষ্কার হয়ে নিতেন। যে আইন জনস্বার্থ বিরোধী বলে বিবেচিত হতো কিংবা অপব্যবহারের শঙ্কা থেকে যেত, সেটি মেনে নিতে পারতেন না। এ রকম কোনো আইন পাশ হয়ে গেলে তিনি কষ্ট পেতেন। বলতেন, ‘আমি নিজের কাছে পরিষ্কার, আমার সামর্থ্য থাকলে আমি এমন হতে দিতাম না। যা আমার সামর্থ্যরে বাইরে, সাধ্যের আওতাবহির্ভূত তার জন্য আমি দায়ী নই। তবে এর প্রতিক্রিয়া আমাকেও বিদ্ধ করবে, নিরীহ জনগণকে আহত করবে, এটিই আমার কষ্ট।’
সংসদ সদস্যগণের দায়িত্ব, কর্তব্য এবং তাদের প্রতি সরকারের দায়িত্ব সম্পর্কে তাঁর মতো ঋদ্ধ ও সচেতন খুব কমই দেখা যায়। এ ব্যাপারে তাঁর অভিমত হচ্ছেÑ
‘গণতন্ত্র যেখানে দৃঢ় ভিত্তি লাভ করেছে এবং সংসদের প্রাতিষ্ঠানিককরণ সম্ভব হয়েছে, সেখানে একজন সংসদ সদস্যকে প্রতিনিয়ত তাঁর নির্বাচনী এলাকার জনগণের সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলতে হয়। তাদের অভাব অভিযোগ শুনতে হয়। তাঁদের দাবি দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে দেন দরবার করতে হয়ে। সংসদে তাদের কথা বলতে হয়। এটা একজন সংসদ সদস্যের তাঁর নির্বাচনী এলাকার জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতারই একটি অপরিহার্য অংশ।’১
সংসদে বিতর্কে অংশ নেয়াই সংসদ সদস্যদের একমাত্র কাজ নয়। সংসদ যদি জাতীয় সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়, তাহলে সংসদ সদস্যরা হচ্ছেন সে সব কর্মকাণ্ডের পরিচালক। সে অনুযায়ী তাদের স্বীকৃতি হবে বাঞ্ছনীয় ও কাজ করার আইনগত ভিত্তি ও বর্ধিত আর্থিক সুবিধাদান।২ সংসদে যে কোনো বিষয়ে তিনি অনর্গল বলে যেতে পারেন। তাঁর এ বছরের (২০১০) বাজেট বক্তৃতা শুনে আমি অভিভূত হয়েছি। এমন প্রাঞ্জল ও সহজ অনুধাবনযোগ্য অথচ সংক্ষিপ্ত বিবরণে পুরো বাজেটের বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ অসাধারণ মনে হয়েছে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ: প্রাক্তন সংসদ সদস্য, শিক্ষাবিদ, হাতিয়া ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা, গবেষক, রাজনীতিবিদ, বর্তমানে হাতিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।

১. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ৭৪।
২. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ৭৫।

মহাকালের যাত্রী
দুলাল সরকার
পথে যেতে যেতে প্রমাদ গুনি- কোথাও বড় কোনো ভুল হলো কিনা। সর্বোতভাবে নিজেকেই দায়ী করি। ভাবি, নিঃসংশয়ে যদি শুধু অপরের ভালোটুকুও দেখতে অভ্যস্ত হতাম, তাও পারিনি। এই যে আমাকে, আমাদের মতো সাধারণ কাউকে মনে রাখা, মনে পড়া- এ শুধু মনে পড়া নয়, শ্রদ্ধা জানানো। এটি যিনি পারেন তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আবুল হোসেন। যার চরিত্রগত শৈলীই এ রকম। তাঁর প্রতি আমি শ্রদ্ধাবনত।
তাঁর প্রতি আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা এই কারণেও যে, তাঁর স্মিত মুখের নান্দনিক মুখাবয়বে লেগে থাকে শরতের প্রসন্নতা। এ পোড়া দেশে তিনি তাঁর শালীন, শৈল্পিক ও সহিষ্ণু হৃদয়শীল প্রসন্নতা দিয়ে কেবলই নিজেকে পাঁপড়ির মতো মেলে ধরছেন। প্রশংসা-কৃপণ এ দেশ; সত্যি বলছি, এ আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি। এ কথা আর কারও ভালো লাগবে কিনা জানি না, কিন্তু আমি যখন ক্লাশে যাবার পূর্বে আমার কলেজের বকুল তলায় বসে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ পড়াবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হঠাৎ মুঠোফোনটি বেজে উঠল। অপরিচিত কণ্ঠস্বর। পরিচয় দিলেন মোহাম্মদ আমীন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও রেলপথ বিভাগে আছেন তিনি। শুনলাম উনার কিছু বিস্মিত কথা। তারপর সাগ্রহে জানালেন, ‘মন্ত্রী (সৈয়দ আবুল হোসেন) মহোদয়ের উপর একটি সম্মাননা গ্রন্থ করতে যাচ্ছি। আপনার লেখা চাই।’
সত্যি বলছি, আমি আমার মতো করে লিখি, আমি স্বাধীন। বললাম, ‘আমার লেখা কি পছন্দ হবে? তবু আমার বিস্ময় এবং সশ্রদ্ধ ভালোলাগা যে, একটি দেশের অনেক উপরে ওঠা একজন স্মিত মানুষকে নিয়ে আমার মতো একজন সাধারণ মানুষ কি লিখব? কিভাবে লিখব, কোথা হতে শুরু করব, কোথায় শেষ করব। ইত্যাদি আমার মনে একটি কাঁপন ধরিয়ে দিল। তখনি ব্যাকুল আগ্রহে বাড়ি ফিরে সেই মানুষটিকে নিয়ে আমার মতো করে সাজিয়ে কিছু লিখতে বসতে পেরে কুণ্ঠিত চিত্তে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছি। আর মনে মনে গভীর আবেগে পুলকিত হয়ে উঠি, এ কারণে যে, যাকে আমি সবচেয়ে বেশি বেশি শ্রদ্ধা করি, আমার মনে, ধ্যানে অনুক্ষণ যার কীর্তি মহিয়ান হয়ে থাকে, তাঁকে নিয়ে লেখার সুযোগ পেয়েছি।
লিখতে বসেই আমার মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর ‘সোনার তরী’কে। যে রবীন্দ্রনাথ, সোনার তরী ও শান্তি নিকেতন আমার বাল্য, কৈশোর ও যৌবনের বারানশী। আজও তাই তাঁর রচিত কবিতাটিই যেন বেশি বেশি প্রযোজ্য বলে এক্ষেত্রে ‘সোনার তরী’র কাছেই আমাকে ফিরে যেতে হচ্ছে। অমর সে উক্তিই আমাকে ভাবিয়ে তুলছেÑ

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি… ।

কবিতাটি পড়াতে পড়াতে এখানে এসে কোনো কোনো দিন গলা ধরে আসে। মুহূর্ত থেমে পুনরায় পড়ানোতে মন দেই। তারপর কিছুক্ষণ এক ধরনের ঘোর আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আজও রেখেছিল। তারপর ঐ পঙক্তিদ্বয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ এ লেখাটির একটি সূক্ষ্ম সূত্র খুঁজে পেলাম। মনে হল, ব্যক্তি সৈয়দ আবুল হোসেন, মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনও কি রবীন্দ্র বর্ণিত একজন কৃষক? রূপকের আশ্রয়, আড়ালে ঐ কৃষকই কি ব্যক্তির জীবন? মহাজীবনের এক পাড়ে ক্ষণকালের অস্তিত্ববান কোনো দেহজ সত্তা? যে সত্তা একদিন কাল প্রবাহের অনন্ত ধারায় নিঃশেষিত হয়ে যাবে। জড় প্রকৃতির এই অনিবার্য কঠিন সত্যকে কেউ খণ্ডন করতে পারেনি, পারবেও না। মহাকবি তা জানতেন, জেনেছিলেন।
তাই সীমা ও অসীমের নিত্য প্রবাহের বেদীমূলে যে সত্যকে তিনি আবিষ্কার করলেন, তা হলো সমস্ত কিছু একদিন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। নিরুদ্দেশ প্রবাহমান মহাকাল সবই গ্রাস করে নেবে। কিন্তু সবই কি নেবে? ‘সোনার তরী’তে কবি বললেন, ‘নেবে কিন্তু সব নয়।’ বয়ে যেতে যেতে একদিন কৃষকরূপী সকল মানুষের শারীরিক অস্তিত্ব কোনো এক নিঃসীম অন্ধকারে হারিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবেন ব্যক্তি সৈয়দ আবুল হোসেন, যেমনটি হারিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। যেমনটি আর নেই সেই সোনার ফসল নিয়ে অধীর অপেক্ষমান ভূমিপুত্র- কৃষক মানুষটি।

কৃষকরূপী রবীন্দ্রনাথ নিজে উপলব্ধি করলেন যে, তিনিও থাকবেন না। মহাকালরূপ বহমান কল্পিত ‘সোনার তরী’র মাঝি নির্বিকার চিত্তে একে একে কৃষকের আঁটি আঁটি সোনার ফসল নৌকোতে তুললেন, স্তূপ স্তূপ সাজিয়ে এক সময়ে কোনোদিকে না-তাকিয়ে কৃষকের দিকে ভ্রƒক্ষেপ না-করে কৃষককে রেখে শুধু তাঁর কল্পিত ফসল নিয়ে সেই অচেনা মাঝি তার সোনার তরীটি বেয়ে নিরুদ্দেশে কোনো অচেনা দিগন্তের অভিমুখে এগিয়ে যাবে। আর কৃষক? নৌকায় উঠতে চাইলেও মাঝির নৌকোতে তাঁর ঠাঁই হবে না, ঠাঁই হবে শুধু তাঁর কর্মের, সৃজনের, তাঁর সব সোনার ফসল তুলে সোনার তরী নিয়ে এগিয়ে চলবেন মাঝি। শূন্য ক্ষেত্রে শূন্য জীবনে, কৃষক পড়ে থাকবেন এক বুক বেদনা নিয়ে, অসহায়ত্বের পাথর হয়ে।
আজ ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ নেই, নেই তাঁর শারীরিক অস্তিত্ব কিন্তু ‘মহাকাল’ কাল থেকে কালান্তর কবির সোনার ফসল আজও বহন করে চলেছে। আমরা তাঁর সোনার ফসল উপভোগ করছি, সমৃদ্ধ হচ্ছি। তাঁর সোনার ফসলের মৌ মৌ ঘ্রাণে মনুষ্যজীবনকে পুষ্ট করছি।
আমার আজ এভাবেই কথাগুলো কেন যেন মনে হতে হতে, মনে হলো, কোনো না-কোনোভাবে রবীন্দ্র বর্ণিত কৃষক আর সোনার ফসলের সম্পর্কে ব্যক্তি আবুল হোসেন, মর্ত্যবাসী আবুল হোসেন তাঁর শারীরিক অস্তিত্ব নিয়ে সময়ের কালো গহ্বরে একদিন হারিয়ে যাবেন কিন্তু তাঁর ফলিত সোনার ফসল কি হারাবে, নিশ্চিহ্ন হবে? অথবা তাঁর কি এমন কিছু আছে যা শ্রদ্ধাস্পদ আবুল হোসেনের দেহান্তরের পরও কাল থেকে কালান্তরে, ‘সোনার তরী’রূপ মহাকাল বয়ে বেড়াবে?
হ্যাঁ, বয়ে বেড়াবে। ঐ স্মিত মুখের সজ্জন মানুষটিকে নয়। তাঁর কর্মকে, তাঁর সৃষ্টিকে, তাঁর স্বপ্নময়তাকে। বয়ে বেড়াবে মমত্ব ও মানুষকে জ্ঞানালোকে আলোকিত করার প্রজ্জ্বল বাসনাকে। রবীন্দ্র কথিত সোনার ফসলের মতো, তাঁরও কর্ম মহাকালরূপ নৌকোতে ঠাঁই পাবে। ব্যক্তি আবুল হোসেন অনিবার্য মৃত্যুতে হারিয়ে যাবার পরও তিনি জীবিত থাকতে এমন কিছু ফসল ফলালেন, এমন কিছু সোনালি শস্যের চাষে ক্ষেত ভরিয়ে তুললেন যে, অনন্তে প্রবাহমান ‘সোনার তরী’ তা সব বহন করতে বাধ্য হবে। কল্পিত এক মাঝি মহাকালের বুকে তাঁর সব কর্মকে চির স্থায়িত্ব দেবেন। এভাবেই তিনি একদিন অনিবার্য মৃত্যুকে জয় করবেন।
তাই অকুণ্ঠ চিত্তে এটুকু আমি বলি, শ্রদ্ধেয় আবুল হোসেন তাঁর জীবনকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে, তিল তিল করে শ্রমের সাধনায় তাঁর নিজ ভূমি কালকিনি-মাদারীপুর এবং ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়া সমগ্র বাংলাদেশকে যে শিক্ষার আলো জ্বেলে জমে থাকা স্তূপ স্তূপ অন্ধকারকে অপসৃত করার আকুল প্রয়াসে কীর্তিমান হলেন, তার অমিয় সৌরভটুকু শরতের নীলিম আকাশের মতো মহাকালের বুকে চিরস্থায়িত্ব লাভ করবে- এ আমি জানি। এ আমার বিশ্বাস। যদিও আমি জানি না এতে কেউ সন্দেহ পোষণ করবেন কিনা? কিন্তু কি এসে যায় তাতে? নিন্দুককে, প্রশংসা-বিমুখতাকে তিনি তো জয় করেছেন হৃদয়ের ঔদার্যে। তাই মননে পরিশীলিত এই মানুষটির কাছে বৈষয়িক দাবি কারও যখন মন ভরে না, সহজ নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে তখন আমি এক নৈর্ব্যক্তিক দূরত্বে তাঁর কর্মপ্রয়াসকে, তাঁর কর্মযজ্ঞকে অনুভব করার চেষ্টা করি- ভাবি, এভাবেই বুঝি প্রসন্নচিত্তে এই সসীম জীবনকে অসীমতার ফল্গুধারায় ভরিয়ে তুলতে হয়। এও তো আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। কিন্তু সেখানেও আমাদের ক্ষীণ বুদ্ধি সীমাবদ্ধতার গণ্ডি পেরুতে ব্যর্থ হয়।
তবু আপাত ব্যর্থতার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে আমার ও আমাদের চারপাশে ঘিরে যে আলোর প্রদীপ জ্বেলে শিক্ষা বঞ্চিত অজপাড়াগাঁয়ে উচ্চশিক্ষা প্রসারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, নিজ গাঁয়ে নারীশিক্ষা প্রসারে শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজ, পিতৃস্মৃতি রক্ষা ও শ্রদ্ধা নিবেদনার্থে নিবেদিত ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ, খোয়াজপুরের নিভৃত গ্রামে জননন্দিত সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ নামের শিক্ষা নিকেতন। তাঁর দানের উদার মহিমায় ঋদ্ধ হয়েছে শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়, শশিকর চলবল উচ্চ বিদ্যালয়, শশিকর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, নবগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়সহ তাঁর সংসদীয় এলাকার আরও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে সৈয়দ আবুল হোসেনের উদারতার ফসল, তা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না!
আর এ সবই তাঁর কর্ম, তাঁর সোনার ফসল। মহাকালের বুকে যা অক্ষয়ের দাবিদার। আমার নিজ গ্রাম শশিকরের পাশেই তাঁর জন্ম-ভিটে ডাসার। এক অভিজাত ধর্মপরায়ণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন তিনি। যদিও অর্থের বৈভব ছিল না সেদিন কিন্তু কি এসে যায় তাতে? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেমন রুদ্ধ হন নি বিত্তহীনতার প্রতিবন্ধকতায়, বরং বিদ্যায়, মননে, তেজে, সংস্কারমুক্তিতে তিনি বাঙালির নিত্য স্মরণীয়; তেমনি আবুল হোসেন সকল প্রতিবন্ধকতার ঊর্ধ্বে উঠে বিদ্যায়, মননে, কর্মে ও প্রগতিশীল ভাবনায় এ দেশে আজ সর্ববরেণ্য অসীম মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠেছেন। বিদ্যালয় জীবন তাঁর বরিশালের অন্তর্গত গৈলা উচ্চ বিদ্যালয়। কি করে এটা হলো আমি জানি না। নিশ্চয়ই পিতা শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আতাহার আলীর দূরদর্শিতা। গৈলা শব্দটি আমার মনে এক বিশেষ আবেগ সৃষ্টি করে। আমার বাবা কানাইলাল সরকার শশিকর উচ্চবিদ্যালয়ের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং দাদা শশিকর উচ্চ বিদ্যালয়ের সুদীর্ঘকালীন প্রধান শিক্ষক সর্বজন শ্রদ্ধেয় তরণীকান্ত সরকার। ছোটবেলায় বাবা ও দাদা উভয়ের কাছে শুনেছি ঐ গৈলা গ্রামের কথা।
ওখানেই মধ্যযুগের মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা কবি বিজয় গুপ্তের জন্ম। বাবা ও দাদা ছোটবেলায় ঐ ঐতিহাসিক গ্রামটি আমাকে দেখাতে নিয়ে বলেছিলেন, ঐ গ্রামের কোন বাড়িতে কত জন এম এ; কতজন ডাক্তার, ব্যারিস্টার রয়েছে। ঐ গ্রামে এবং ঐ বিদ্যালয়ে এসেছিলেন অবিভক্ত ভারত বর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবের পথিকৃত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর আগমনহেতু স্মৃতিফলকটি আমি দেখে, স্পর্শ করে শিহরিত হয়েছি। আমাদের প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আবুল হোসেন কি তবে অদৃশ্য নেতাজীর আশীর্বাদ পেলেন? যেন মনে হয় তাঁর জীবন জাগরণের পশ্চাতে নেতাজীর স্পর্শধন্য ঐ বিদ্যালয়ের পুরো আশীষধন্য সৈয়দ আবুল হোসেন। আমি তাঁকে এই অবকাশে আভূমি শ্রদ্ধা জানাই।
সময় বয়ে চলেছে নিরন্তর কবিগুরুর সোনার ফসল বহন করে। আর কে কে সাথী হবে? কার কার ফসলের জায়গা হবে ঐ সোনার তরীতে, ঐ মহাকালের অনন্ত যাত্রাতে? বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আদর্শে পরিপুষ্ট, তার কন্যা সর্বমান্য শেখ হাসিনার প্রেরণাধন্য শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর অনন্য জ্ঞানপ্রীতি ও শিক্ষামানসে যে বিরল ধারা সৃষ্টি করেছেন মহাকালরূপ ‘সোনার তরী’ তা শ্রেষ্ঠ ফসল রূপে যুগ থেকে যুগান্তরে বহন করবে, বয়ে বেড়াবে ঘাটে ঘাটে, জীবনে জীবনেÑ এই তো তাঁর জীবনের বড় প্রাপ্তি, শ্রেষ্ঠ অর্জন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা নক্ষত্রের মতো স্বমহিমায় আলো ছড়াবে। নিভে যাবে না কোনো দিন। যেসব দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রী অর্থের যোগান দিয়ে ঢাকা বা অন্যত্র গিয়ে অনার্স পড়ার সুযোগ পেত না, পড়তে পারত না, তারা পান্তাভাত খেয়ে বহু বিষয়ে অনার্স এবং এমএ ডিগ্রি অর্জন করার অবাধ সুযোগ পাচ্ছে কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে। আবুল হোসেন না-জন্মালে এবং তাঁর আলোকিত ইচ্ছাসমূহ যদি শিক্ষামুখী না-হতো তবে এ অঞ্চলের মানুষের ঘরে ঘরে আজ যে উচ্চশিক্ষিত অসংখ্য ছেলেমেয়ে নবজীবনের উচ্ছ্বাসে অভিভূত হচ্ছে, তা সম্ভব হতো না। আলোর সমুদ্রে থেকে মানুষ যেমন বোঝে না নিভে যাওয়া প্রদীপের অভাব তেমনি সত্যি সত্যি একদিন এ অঞ্চলের মানুষ বুঝবে তাঁর সৃজনের অবদান।
পুনরায় রবীন্দ্রনাথ আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। তাই গভীর বিনয়ের সাথে আমি বলছি। জীবনের একটি সময়ে, দূর অতীতে আমি কবিগুরু প্রতিষ্ঠিত তার স্বপ্নের, তাঁর প্রাচীন তপোবনিক শিক্ষাশ্রম শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার বিরল সুযোগ পেয়ে বুঝতে পেরেছিলাম স্বপ্নচারী, রোমান্টিক, কল্পনাপ্রবণ ঐ মহাকবি কত দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে ভাষণ ও শেখানোর বিনিময়ে অর্থ, স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর গহনা বিক্রি করে যে সর্ব ভারতীয় ও বৈশ্বিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন তার আলো বিশ্ববাসীকে আলোকিত করে তুলছে ও তুলবে। সেখানে একদিকে মানস গঠনে কলা বিভাগ, মানবিক বিভাগ, বিজ্ঞান, সঙ্গীত, চিত্রচর্চার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসারে চলছে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। আমি ক্ষুদ্র, আমার অর্থ নেই, বিত্ত নেই। শুধু যে অমল ইচ্ছেটুকু পোষণ করি, তা দিয়ে বলি অর্থ বিত্ত তো কত মানুষেরই থাকে, সৈয়দ আবুল হোসেনেরও আছে। সে অর্থের যেমন যথাযথ ব্যবহারে ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তেমনি ভবিষ্যতে এর পাশাপাশি আরও সেবামূলক ও কারিগরি পাঠাগার বিষয়ক প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়তে তিনি এগিয়ে আসবেনÑ যাতে মানুষের প্রায়োগিক জীবন আরও সমৃদ্ধ হবে।
বাস্তবতার কারণে আমার লেখার রাশ টানতে বাধ্য হচ্ছি। যদিও ক্লান্তিহীন লাগছে, ভালো লাগছে লিখতে, তবুও সমাপ্তির দিকে এগুতে হবে। শেষাংশে শুধু প্রকাশ করছি, শ্রদ্ধাস্পদ সৈয়দ আবুল হোসেন স্ব-প্রতিভায় নিজেকে নিরন্তর রচনা করে চলেছেন। কারও মুখাপেক্ষী নন, এটাই তাঁর চরিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য। অনেক গুণের মধ্যে দরিদ্র মানুষের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ দরদ আজ প্রবাদতুল্য। মনে পড়ে, অনেক আগে শশিকরের এক গরিব মহিলাকে পাঠিয়েছিলাম একটি ঘর চেয়ে। আমাকে অবহেলা না-করে ঐ গরিব মহিলাকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কি খুশি ঐ মহিলা! তাঁর দানশীলতা, শিক্ষানুরাগ ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় একদিন এই বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে আলাদা মর্যাদা পাবেÑ এ আমার, আমাদের স্বপ্ন। তিনি সে রকম যোগ্য হয়ে উঠবেন, ঈশ্বরের কাছে এ আমার প্রার্থনা।
পাছে ব্যক্তিগত দুর্বলতা কাজ করে তাই আমার সীমাবদ্ধতার কথা মনে করে আমার পেশাগত কারণে শুধু তাঁর বিদ্যানুরাগকেই অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে আলোচ্য লেখায় তাঁকে প্রকাশ করার প্রয়াস নিলাম। এ প্রকাশ তাঁর প্রকৃত বিস্তারের কাছে সমুদ্রের নিকট এক বিন্দু জল ছাড়া আর কিছু নয়। তবে সমুদ্রের কাছে আমার একবিন্দু জল নগণ্য হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে ঐ একবিন্দু জল পরিমাণগত দিক হতে না হোক, ধারণগত দিক হতে সমুদ্রের জলরাশির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সৈয়দ আবুল হোসেন শিক্ষার দিশারী, মহাকালের কাছে চিরঞ্জীব চরিত্র। আর সেভাবেই কবিগুরুর সোনার তরীতে তাঁকে, সৈয়দ আবুল হোসেনকে তুলে দিলাম। ঈশ্বর তাঁকে সর্বমঙ্গলে বিধৌত করুক। ঘিরে রাখুক শুভবোধে। নিষ্কলঙ্ক, নিষ্পাপ চিন্তায়, সর্বমানব হয়ে উঠুন তিনি। এ আমার গভীর, গভীর আকাক্সক্ষা। জয় হোক তাঁর।
দুলাল সরকার : কবি, অধ্যাপক, শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়, শশিকর, কালকিনি, মাদারীপুর।

মনের মুকুরে
আবদুল আজিজ হাওলাদার
এই পৃথিবীর পাতায় পাতায়
শিখছি দিবা রাত্র
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর
সবার আমি ছাত্র।
অতি শৈশবকালে পাঠ্যপুস্তকে পঠিত “সবার আমি ছাত্র” কবিতাখানা আমার অনুভূতিতে দারুণভাবে রেখাপাত করেছিল। তাই আমি প্রকৃতিকে সাধ্যমতো অবলোকন করি। বিশ্বের ভূতলে পদচারণাকারী মানুষকে আমি বিশ্লেষণের প্রয়াস পাই। আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন একজন মানুষ। তিনি যখন গৌরনদী কলেজের ছাত্র, আমি তখন কালকিনি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বয়সের পার্থক্য খুব একটা বেশি না, হলেও তাঁর এলাকার একমাত্র পাইলট স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কালকিনির অধিকাংশ লোকই আমাকে স্যার ডাকতেন। সে হিসেবে তিনিও আমাকে প্রথম হতে স্যার সম্বোধন করতেন। তবে মাঝে মাঝে একান্তে আলাপে মাস্টার সাহেবও ডাকতেন। আমি প্রথম কালকিনি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীকালে সভাপতির দায়িত্ব পাই। যদিও আমার বাড়ি বরিশাল। সৈয়দ আবুল হোসেনকে স্বচক্ষে দেখার পূর্বে তাঁর জনকল্যাণমূলক মহান কর্মকাণ্ড আমাকে দিয়েছিল বিস্তর আনন্দ।
১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের মহাপ্লাবন তলিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের জনপথ। সাকো ইন্টারন্যাশনাল নামক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিক সৈয়দ আবুল হোসেন নিজ তহবিল হতে মহাপ্লাবনক্রান্ত দুস্থ মানবের সেবায় অকাতরে দান করলেন অর্থ আর বস্ত্র। যার ফলে পথে, প্রান্তরে হাট বাজার এবং রেস্তোরাঁয় সৈয়দ আবুল হোসেন হয়ে উঠলেন আপামর জনতার হৃদয়মণি। সত্য কথা বলতে কি, আমার সাথে তখন পর্যন্ত তার সাক্ষাৎ হয়নি, সুযোগ ঘটেনি সাক্ষাতের।
চেতনার প্রতিচ্ছবি
অভিজ্ঞতার আলোকে এবং বাস্তবতার নিরিখে সচরাচর দেখে আসছি যে, বিত্তবানের থাকে না চিত্ত এবং চিত্তবানের থাকে না বিত্ত। তার ব্যতিক্রম এ পর্যন্ত আমি একজনকে পেয়েছি। সে একজন হচ্ছেন কালকিনির সূর্যসন্তান আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন। যার বিত্ত আর চিত্ত দুটোই আছে। তাইতো দেশবাসীর আশা-ভরসার উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে আছেন আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন। তাঁর বিত্তের সাথে চিত্ত না থাকলে কালকিনির এতটা উন্নয়ন সম্ভব হত না।

বিচক্ষণতা
আমার সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ হবার কিছুকাল যেতে-না-যেতে তাঁর বিচক্ষণতা আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম। আমিন কোর্টে সৈয়দ আবুল হোসেনের অফিস কক্ষে নিরিবিল পরিবেশে আলাপ করছিলাম। আমি বলেছিলাম, আপনি দরিদ্র জনসাধারণের মাঝে গেঞ্জি বিতরণ করেছেন; খুব ভালো কথা। তবে গেঞ্জিগুলোতে আপনার ছবি ছেপে দেয়াটা আমার চোখে খারাপ লাগছে। ছবি দেয়ার পেছনে আপনার দানশীলতার সুনাম প্রকাশের অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে।
আমার কথা শুনে তিনি বিচলিত হলেন না। বলেছিলেন, ‘জি না স্যার। সুনাম প্রচারের আদৌ উদ্দেশ্য আমার নেই। প্রথমে আমি গরিব দুঃখী মানুষের জন্য কিছু পরিমাণ অর্থ প্রেরণ করেছিলোম। থানা পর্যায়, গ্রাম পর্যায় এমন কি বাড়ি পর্যায় পর্যন্ত প্রতিনিধি নিয়োগ করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল প্রতিনিধির মাধ্যমে যথাযথভাবে অর্থ বিতরণ করা। প্রতিটা পর্যায়ে শক্ত করে আটকানো খামের মধ্যে টাকার সাথে একখানা ছাপানো চিঠি প্রেরণ করেছিলাম। তাতে লেখা ছিল, “এই টাকা যেন প্রান্তিক গরিবের হাতে সঠিকভাবে পৌঁছে। কেউ আত্মসাৎ করবেন না, যদি কেউ আত্মসাৎ করেন, রোজ কিয়ামতে তাকে যেন নবীজি সাফায়াত না-করেন। দুনিয়াতে যেন তার উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হয়।” তারপরও টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছিল। তাই গেঞ্জিতে আমার ছবি দিয়েছি। আপনি আজিজ স্যার, মান সম্মানের তাগিদে ঐ ছবিযুক্ত গেঞ্জি পরিধান করবেন না। এমন কি বিক্রি করতে চাইলে ধরা পড়ে যাবেন। বাধ্য হয়ে যিনি গরিব; প্রকৃতই বস্ত্রাভাবি, গেঞ্জি পাওয়াকে পরম প্রাপ্তি মনে করবে, তার হাতেই আমার দেয়া গেঞ্জি পৌঁছবে। গরিবের হক লুণ্ঠনকারীরা যাতে আমার দেয়া বস্ত্র পরার সুযোগ না-পায়, সে জন্য গেঞ্জিতে আমি আমার ছবি দিয়েছি।’

দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব
ধর্মে ধীর, কর্মে বীর
চির উন্নত তাঁর শির।
তিনি সৈয়দ আবুল হোসেন। তাঁর ঘটনাবহুল জীবন নিঃসন্দেহে বর্ণীল, পুণ্যরশ্মিতে আলোকিত। তাঁর নিজের থানা সদর কালকিনিতে ছিল কালকিনি কলেজ। কলেজটা ছিল ভাঙাচুরা। ছিল না ভালো শিক্ষক, ভালো অবকাঠামো। শিক্ষা সরঞ্জাম ও আনুষঙ্গিকের অভাবে এটি মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিল। আবুল হোসেন কলেজটি নবধারায় সজ্জিত করার প্রস্তাব দেন। স্বার্থান্বেষী একটি মহল পরশ্রীকাতর চেতনার বশে তাঁর ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করে। তিনি চেয়েছিলেন থানা এলাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটার সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে কালকিনির কার্যকর উন্নয়ন প্রতিষ্ঠা করতে। প্রত্যাখ্যাত হয়ে মনেপ্রাণে ক্ষুণœ হলেও বাইরে প্রকাশ করলেন না। তিনি অত্যন্ত ধীর। সহজে নিজের কষ্ট প্রকাশ করেন না। আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীলদের পছন্দ করেন। তিনি ধৈর্যধারণ করলেন। সুপণ্ডিত হুমায়ুন কবিরের ভাষায়:
দুঃখ দিয়ে ব্যথা দিয়ে, হিয়ারে আমার
আঘাতে আঘাতে কর মহানুদার।

এ ঘটনার কিছুদিন পর তিনি আমাকে বলছিলেন: “স্যার, খোয়াজপুর থেকে আচমত আলি নামের এক যুবক আমার অফিসে এসেছিল। সে খোয়াজপুরে একটা কলেজ স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং এ কাজে আমার সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করেছে। পূর্ব তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে আমি বলেছিলাম: দেখুন আচমত সাহেব, এ কাজ অনেক দুঃসাধ্য। চাঁদা তুলে কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে আমি পারব না। আমার এগুলো ভালো লাগে না। তার চেয়ে আমি একটা প্রস্তাব রাখছি- কলেজ প্রতিষ্ঠার সমস্ত খরচ আমি আপনাদের দিয়ে দেবো। দশ লাখ, বিশ লাখ যত লাগে। আমার প্রস্তাব পেয়ে খুশিমনে আচমত চলে যায়। যাবার সময় গ্রামের মুরব্বিদের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত আমাকে জানানোর জন্য যত তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন বলে জানায়। 
কিছুদিন পর দেড় শতাধিক লোক এসে আমাকে বলল: “আপনি কলেজের সব খরচ দেবেন শুনে আমরা অত্যন্ত খুশি হয়েছি। কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। কলেজটা আপনার নামে করার প্রস্তাব রাখছি। এর মাধ্যমে হয়ত আপনার প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে।”
সৈয়দ আবুল হোসেন তা মেনে নিলেন। এর কয়েকদিনের মধ্যে তিনি নিজের অর্থে জমি ক্রয় করে কলেজের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করেন। প্রথমে সূচনাস্বরূপ খোয়াজপুর হাইস্কুলের একটি বড় কক্ষে শিক্ষাদান কার্যক্রম শুরু হলো। এ কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি আমাকে সহায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এটি আমি এখনও গর্বভরে স্মরণ করি। সৈয়দ আবুল হোসেনের অনুরোধে আমি ছাত্রছাত্রী সংগ্রহে নেমে গেলাম। অভূতপূর্ব সুযোগ সুবিধার কথা ব্যক্ত করে ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ করার কাজ চালিয়ে যেতে থাকলাম। অবশ্য সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব আরও অনেককে এ কাজের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তারা কে কতদূর কাজ করেছিলেন, আমার জানা নেই। তবে আমি এ কাজে যতটা সফল হয়েছিলাম আর কেউ অতটা সফলতা অর্জন করতে পারেনি। যার ফলে আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের আরও কাছের হয়ে গেলাম। আমার প্রতি তাঁর প্রীতি ও শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল।
এরপর আসে সে মাহেন্দ্রক্ষণ। যেদিন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাশ শুরু হবে সেদিন খোয়াজপুরে চলছিল উৎসবমুখর কর্মকাণ্ডের অপূর্ব কোলাহল। সমগ্র জনপথ লোক-সমাগমে ভর্তি। প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করা ডলি নামের আমার এক ছাত্রীকে ঐ দিন আমি কলেজে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। বড় একটা হলঘরে উৎসবমুখর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমি অভিভাবকদের জন্য নির্ধারিত চেয়ারের সারির মধ্যে একখানা চেয়ারে আসন গ্রহণ করলাম। চলতে থাকল সুধীজনের বক্তব্য পরিবেশন করার পালা। এক সময় অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে বক্তব্য প্রদানের আহবান আসে। আমি হতবিহ্বল। ভাবতেও পারিনি যে, আমাকে বক্তব্য রাখার জন্য আহবান জানানো হবে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের একটা কথা আমার হৃদয় সরোবরে বুদ্বুদের মতো ফেনিয়ে উঠল- “ভাব যেখানে গভীর ভাষা সেখানে স্তব্ধ।” আমার চেতনায় একটা ভাবনার উচ্ছ্বাস দোল খেতে লাগল। সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো অমন অনন্যসাধারণ গুণসম্পন্ন ব্যক্তি সম্পর্কে আমি কিইবা বলতে পারব। হৃদপিণ্ডের নাচন এবং জানুদ্বয়ের কাঁপন নিয়ে বক্তৃতা মঞ্চে উঠলাম। বক্তব্য রাখার নিয়মকানুন রক্ষা করতে পারলাম না। সভাপতি এং সুধীজনকে সম্বোধন করতে বেমালুম ভুলে গেলাম। আমার কণ্ঠ থেকে যে কথাটা প্রথম বেরিয়ে এসেছিল তা ছিল নিম্নরূপ:
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। কবির আক্ষেপ পূরণ হয়েছিল কিনা জানি না। তবে আমাদের কালকিনিতে সে ছেলের জন্ম হয়েছে।” তারপর কি বলেছিলাম আমার এখন স্মরণে নেই। তবে ঐ অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন উচ্চমানের শিক্ষকদের সামনে সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব আমার বক্তব্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে আমাকে কয়েক দফা অপ্রস্তুত করেছিলেন।
দু’বছরের চেয়ে বেশি সময় পার হয়ে গেল। নিজের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত খোয়াজপুরের কলেজ স্বচক্ষে দেখতেও গেলেন না। কলেজ থেকে প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা উচ্চ মাধ্যমিক চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম বারের মতো অংশগ্রহণ করেছিল। তার ফলাফল প্রকাশিত হলো। সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ থেকে একজন ছাত্র প্রথম স্থান, অন্য একজন চতুর্থ স্থান অধিকার করল। তাদেরকে সংবর্ধনা দেয়া উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে সৈয়দ আবুল হোসেন যোগদান করেছিলেন। প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি সেখানে এক নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন। আমি সে ভাষণ শ্রবণ করে অবাক হয়েছিলাম। কী সুন্দর ও চমৎকার বক্তব্য! কিছু কথা আমার আজও মনে পড়ে, কানে বাজে। সঠিকভাবে বলতে না-পারলেও মূলকথা প্রকাশ করতে প্রয়াস পাব:
“সম্রাট শাহজাহান তাজমহল স্থাপন করে বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে আছেন। হাজি মুহাম্মদ মহসীন শিক্ষা বিস্তারের জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করে অমর কীর্তি চলমান রেখে গেছেন। উভয় ব্যক্তিত্ব আমার অনুপ্রেরণার উৎস। তবে সম্রাট শাহজাহানের চেয়ে হাজি মুহাম্মদ মহসীন আমার কাছে অনেক বেশি অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই এখানে এ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে অগ্রসর হয়েছিলাম।”
কলেজ স্থাপন করতে যারা অবদান রেখেছিলেন, তাদের প্রতি যথার্থ কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে তিনি একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন। তাঁর কথা শুনে সেদিন সবাই আনন্দে ও বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। আমি এত চমৎকার কথা খুব একটা শুনিনি। সে কথাটি হলোঃ
“জোনাকির আলোতে পথ চলা যায় না। উহা ক্ষণিক জ্বলে ওঠে, আবার দ্রুত নিভে যায়। পথ চলতে প্রয়োজন দেদীপ্যমান পূর্ণ শশীর আলো। যা অনবরত জ্বলতে থাকে, আলো দিতে থাকে। সেইরূপ এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্জিত কীর্তির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। উহা যেন জোনাকির আলোবৎ না-হয়। আবহমান কাল যেন অর্জিত কীর্তি দেদীপ্যমান শশীর আলো হয়ে বিরাজ করে। আযুগ যেন শিক্ষার আলো ছড়ায় সারা দেশের প্রান্তরে, প্রান্তরে। উত্তর হতে দক্ষিণে আর দক্ষিণ হতে পশ্চিমে।”

তাজে শাহি তলবি, গওহরে জাতি বুনামা
পণ্ডিতপ্রবর ড. মুহম্মদ শহীদল্লাহ সাহেব ফার্সি ভাষায় এক সুধি সমাজে শিরোনামে বর্ণিত উক্তিটা ব্যক্ত করেছিলেন। বাংলা পরিভাষায় এর অর্থ- রাজমুকুট পেতে হলে নিজের গুণাবলী কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। সৈয়দ আবুল হোসেনের কর্মকাণ্ডে তার গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশ প্রণিধানযোগ্য। খোয়াজপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। চারদিক থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা দলে দলে ঐ কলেজে ভর্তি হবার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এ অবস্থায় কালকিনি কলেজ হতেও অনেক ছাত্র-ছাত্রী খোয়াজপুর আবুল হোসেন কলেজে চলে আসে। তখন কালকিনি কলেজে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমতে কমতে মাত্র তেইশে গিয়ে দাঁড়ায়।
এবার টনক নড়ে তাদের। কালকিনি কলেজ পরিচালনা কমিটি এলাকাবাসীর চাপে ঢাকার মতিঝিলের আমিন কোর্টে অবস্থিত সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালে চলে আসেন। এবার তারা নিজেরাই সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, ‘আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আপনি কালকিনি কলেজের দায়িত্বভার গ্রহণ করুন। আমরা আপনাকে কালকিনি কলেজের দায়িত্ব তুলে দিলাম।’ সৈয়দ আবুল হোসেন অভিমান রাখতে পারলেন না। তাদের আহবানে সাড়া দিলেন। হাজার হোক, নিজের উপজেলা। প্রথম কিস্তিতে দিলেন পঁচিশ লক্ষ টাকা। তার অর্থায়নে কালকিনি কলেজকে নতুনভাবে সাজানো হলো। সেদিনের সে ভাঙাচুরা মৃতপ্রায় কালকিনি কলেজ আজ কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। এর ইমারত ও গঠনশৈলী দেখে যে কেউ অভিভূত না-হয়ে পারবেন না। রাস্তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে পথচারীগণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আধুনিক যুগের নব তাজমহল কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের দিকে।

শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজের ইতিকথা
কালকিনি উপজেলার ডাসার ইউনিয়নের ডাসার গ্রামে সৈয়দ আবুল হোসেনের পৈত্রিক বাড়ি। ঐ বাড়ির অদূরে শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজ অবস্থিত। ঐ কলেজটিরও প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল হোসেন। প্রতিষ্ঠাকালে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। তিনি তাঁর নিজ এলাকায় নারীশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে একটি গার্লস কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নিলেন। কলেজের স্বীকৃতি পেতে প্রথম অন্তরায় হলো ভবন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলল: “স্বীকৃতি পেতে হলে কলেজের নিজস্ব ভবন থাকতে হবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে সৈয়দ আবুল হোসেন নিজের অর্থায়নে গড়ে তুললেন সুদৃশ্য বিশাল ভবন। তারপরও স্বীকৃতি পাওয়া গেল না। কারণ বোধ করি নিম্নরূপ: তিনি প্রতিমন্ত্রী; হয়ত-বা শিক্ষা বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ নিবেদন করেছিলেন, স্যার এটা নিয়ম বহির্ভূত। তারপরও আপনি অনিয়ম করতে চাইলে করতে পারেন।” সরকারের অন্যতম প্রতিমন্ত্রী হয়ে নিয়ম বহির্ভূত কাজ করতে তিনি চাইলেন না। পরবর্তীকালে যখন বিএনপি সরকার গঠন করলেন, তখন সৈয়দ আবুল হোসেন বিরোধী দলের এমপি। আওয়ামী লীগ দলের সংসদ সদস্য হয়েও বিএনপি সরকারের আমলে ডাসারের শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজের স্বীকৃতি আদায় করলেন। এটি ছিল একটি নজিরবিহীন সফলতা। সৈয়দ আবুল হোসেন ব্যতীত আর কারও পক্ষে সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সৈয়দ আবুল হোসেন শেখ রেহেনার স্বামী ড. সফিক আহমদ সিদ্দিকীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ছিলেন। উভয়ের মাঝে ছিল নিবিড় আন্তরিকতা। তারা দু’জন পরস্পর একে অন্যকে দোস্ত বলে সম্বোধন করে থাকেন। সেই সুবাদে সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে শেখ পরিবারের মধুর সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধে শেখ কামালের সহযোদ্ধা হিসেবেও সৈয়দ আবুল হোসেন শেখ হাসিনার অতি স্নেহভাজন। শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজ-এর স্বীকৃতি প্রাপ্তির পর সৈয়দ আবুল হোসেন শেখ হাসিনাকে তা অবগত করালেন। এ সংবাদ পেয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন: আমাকে আগে জানালেন না কেন? সৈয়দ আবুল হোসেন সবিনয় শ্রদ্ধায় বলেছিলেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে যাতে পক্ষপাতিত্বের বা স্বজনপ্রীতির অভিযোগ না-হয়, সেজন্য আপনাকে জানাইনি। আপনাকে বললে তো হয়ে যেত। সেটি উচিত হতো না। আপনার নামে কলেজ, আরও অনেকে আপনার কাছে অনুরূপ সুবিধা নিতে আসতেন। যা একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারত। এখন আপনাকে কেউ পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ দিতে পারবে না।’

স্বচ্ছ ধারণার ধারক ও বাহক
আমি যখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কালকিনি উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক, তখন আমার সাথে সৈয়দ আবুল হোসেনের সুসম্পর্কের সেতুবন্ধন রচিত হয়েছিল। সৈয়দ আবুল হোসেন তখন রাজনীতি করতেন না, রাজনীতিতে আসার চিন্তা ভাবনাও তাঁর মাথায় ছিল না। তবে তাঁর অবারিত সাহায্য-সহযোগিতা এবং অনুদান পেয়ে কালকিনির আপামর জনতা ধন্য। সাধারণ মানুষ তখনও তাঁকে স্বচক্ষে দেখতে পায়নি। ভাবতেও অবাক লাগতো, তাঁর দানে সিক্ত আপামর জনতা, তাকে দুর্দিনের বন্ধু এবং নয়নমণিরূপে গ্রহণ করেছিল। একদিন তাঁর অফিস কক্ষে নিরিবিল পরিবেশে আলাপ করছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে তাঁকে প্রশ্ন করলাম: আপনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন্ দলটাকে সমর্থন করেন?
তিনি বললেন, আমি রাজনীতি করি না, বুঝিও না। তবে একটা সত্য কথা না-বললে, নিজের কাছে অপরাধী বলে মনে হবে। এ দেশের মাটিতে শেখ মুজিবের মতো মহান সন্তানের জন্ম হয়েছিল বিধায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাঁর ডাকে আমি যুদ্ধ করেছি। বংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বলে আজ আমার মতো বাঙালি সন্তান স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারছি। এ আসনে বসতে পেরেছি। দেশ স্বাধীন না-হলে বসতো পাঞ্জাবি কিংবা বিহারি কিংবা তথাকথিত বাইশ পরিবারের স্বজন এবং তাদের এজেন্টরা। বঙ্গবন্ধু জাতির জনক। তিনি আমার প্রিয় নেতা। বাংলার জনগণ লক্ষ বছরেও বঙ্গবন্ধুর ও তাঁর পরিবার-পরিজনের রক্তের ঋণ শোধ করতে পারবে না। কোনো দিন পার্টি করলে ঐ রক্তের ঋণ শোধ করার জন্য পার্টি করব। আমি বলেছিলাম, ‘কিভাবে রক্তের ঋণ শোধ করবেন: তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিজেকে একাত্ম করে জনগণের সেবায় নিজেকে বিলীন করে দিলে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে। পিতার ঋণ আসলে কেউ শোধ করতে পারে না।’

মনের মুকুরে স্মৃতির প্রতিবিম্ব
আজও মনে পড়ে, পশ্চাতে ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিকথা। সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে বললেন, “স্যার, আপনি আমার একটা উপকার করবেন। কালকিনির মানুষ অহরহ আমার অফিসের সামনে ভিড় করে। সবাই সাহায্য চায়, অসুবিধায় আছে, টাকা দিতে হবে, টাকার প্রয়োজন। যাদের দরকার না, তারাও আসে। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। কি করে বুঝব- কার দরকার, কার দরকার নেই। কেউ কেউ আবার চেয়ারম্যানের সুপারিশ নিয়ে আসে। সেখানেও দেখা যায় স্বজনপ্রীতি এবং রাজনীতি। আমার দৃষ্টিতে আপনি নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব। রাজনীতি করলেও দুস্থ মানুষের প্রতি আপনার প্রচুর দয়া। কারণ আপনি শিক্ষক। তাই আমার কাছে যে যখন আসবে, আমি তাকে আপনার কাছে পাঠাব। আপনি বিবেচনা করবেন। প্রকৃতই সে অভাবি কিনা। অভাবি হলে আপনি পত্র দিয়ে পাঠাবেন এবং তাকে কি পরিমাণ অর্থ দিতে হবে তাও লিখে পাঠাবেন।”
আর যাবো কোথায়? আমার কাছে শুরু হলো আসা। জনতার ভিড়। দিন নেই, রাত নেইÑ মহা ঝামেলা। আমার উপর বর্তাল এক বাড়তি খাটুনি। তবে এটি আমার উপকারও হয়েছিল। ঐ কাজের মাধ্যমে আমার সাথে দুঃখী জনতার সেতুবন্ধন স্থাপিত হয়েছিল। অনেক সময় সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব কিছু সংখ্যক সাহায্যপ্রার্র্থীকে পত্র দিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। তাদের বলে দিতেন। মাস্টার সাহেবকে নিয়ে আসবে। আমি উচিত মনে করলে যেতাম। সৈয়দ আবুল হোসেন সে প্রার্থীর কাছে আমার যাওয়া আসার খরচও গোপনে দিয়ে দিতেন।

পরের ধনে পোদ্দারি
অনেক সময় এমন কিছু লোক দেখতাম, যাদের অভাব থাকলেও আত্মসম্মান রক্ষার জন্য মুখ ফুটে কিছু বলতে পারত না। এ ধরনের দু’চারজন লোককে আমি উপযাজক হয়ে পত্র লিখে সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে প্রেরণ করতাম। সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব তাদেরকে অতি গোপনে অর্থ সাহায্য প্রদান করতেন এবং মধুর ব্যবহারে তাদের খুশি করতেন। এরূপ একজন লোক সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছ হতে গিয়ে আমাকে সালাম দিয়ে বলেছিলেন: স্যার, আপনি যার কাছে পাঠিয়েছিলেন, তিনি কি মানুষ, না-ফেরেশতা। আমি বলেছিলাম, ‘কী হয়েছে?’ তিনি আমাকে আশাতীত সাহায্য করেছেন এবং আসার সময় সাহায্যের কথা কাউকে বলতে নিষেধ করেছেন। সে লোকটির নাম আমি এখানে লিখতে পারতাম। লিখলাম না, লিখলে এটি তার প্রতি প্রতারণা করার সামিল হতো। সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেবের গোপন দানের মর্যাদা রক্ষা আমার নৈতিক দায়িত্ব।

চিঠি হলো মুখপত্র
এক সময় মতিঝিলের ‘সাকো ইন্টারন্যাশনাল’ অফিস হয়ে গেল কালকিনির জনতার তীর্থস্থান। সারাক্ষণ জনতার ভিড়। সৈয়দ আবুল হোসেন সকলের সাথে অফিস কক্ষে কিংবা বারান্দায় কিংবা নির্ধারিত অন্য কক্ষে বিরতিহীনভাবে আলাপ করে যেতেন। আমি পড়লাম মহাবিপদে। একান্তে আলাপ করার সুযোগ পেতাম না। গত্যন্তর না-দেখে সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে বলতেন, ‘স্যার, আপনি নিচে গিয়ে আমার গাড়িতে বসেন।’ আমি তাই করতাম। তিনি এক সময় গাড়িতে এসে বসে তাঁর গন্তব্যে যাত্রা করতেন। তাঁর পাশে আমি বসতাম। চলার পথে চলন্ত গাড়িতে বসে আলাপ করতাম। গন্তব্যে পৌঁছে আমাকে নামিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘স্যার, বেবি টেক্সি ভাড়া করে চলে যান।’ এ কথা বলার পূর্বেই আমার পকেটে ভাড়ার পর্যাপ্ত টাকা পুরে দিতেন। তাতেও কি সব কথা বলা সম্ভব হতো? না, হতো না। তখন আমি বেছে নিলাম চিঠি লেখার কাজ। প্রতি মাসে একাধিক চিঠি লিখে আমার মনের কথা ব্যক্ত করতে থাকি। আমার চিঠিতে বার বার যে কথা ফলাও করে লিখতাম, তা ছিল- সৈয়দ আবুল হোসেনকে কালকিনি এলাকা থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া সম্পর্র্কে। তিনি কিছুতেই রাজি হতেন না। বার বার যুক্তি দিয়ে বলতেন, ‘একজন সংসদ সদস্য হয়ে এলাকার জন্য যা করব আমার নিজের অর্থ দিয়ে তার চেয়ে বেশি কাজ করব। তবু আমাকে রাজনীতিতে টানবেন না।’ তিনি বার বার অনিচ্ছা প্রকাশ করতেন। আমি ছিলাম নাছোড়বান্দা। আমি প্রত্যেকটা চিটিতে একই অনুরোধ করে যেতাম। তবু তাঁকে কিছুতে রাজি করাতে পারছিলাম না। এমপি নির্বাচিত হবার পর একবার এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি আমার চিঠি সম্পর্কে অকপটে বলেছিলেন, ‘আজিজ মাস্টার সাহেবের চিঠিগুলো আমার জ্ঞানের উৎস হয়ে আছে। তার প্রত্যেকটা চিঠিতে আমি জ্ঞানের কথা খুঁজে পেতাম। জনসভায় বক্তব্য রাখার জন্য সুন্দর সুন্দর পয়েন্ট পেতাম। চিঠির সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, বড় আকারের চারটা ট্রাংক ভর্তি হয়ে যায়। আমার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পশ্চাতে তার চিঠিগুলো আমাকে প্রস্তুতি নেয়ার উপকরণরূপে কাজ করে যেত।’

একান্ত আপন জন
আমার নিজের অন্তরে এ বিশ্বাস স্থাপিত হয়েছিল যে, কালকিনিতে সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকেই সবচেয়ে আপন জানেন এবং আমাকেই সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করেন। কালকিনির আপামর জনতাও এটি বিশ্বাস করতেন। তাদের এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, আজিজ স্যার যাই দাবি করেন সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব তাই মেনে নেন, তাই করেন। আমি তার কাছে লেখা চিঠিতে তাকে সম্বোধন করতাম সুপ্রিয় ভ্রাতা।

পালোর্দি নদীর উপর সেতু সম্পর্কে
একদিনের ঘটনা। কালকিনি উপজেলার ডজন দুই নেতাকর্মী আমিন কোর্টে অবস্থিত সৈয়দ আবুল হোসেনের সাকো অফিস উপস্থিত হন। জাতীয় পার্টি তখন ক্ষমতায়। আলাপের এক পর্যায়ে কালকিনি এবং শিকারমঙ্গলের মাঝখানে বহমান পালোর্দি নদীর উপর সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্বের কথা উঠল। সৈয়দ আবুল হোসেন এক নেতার কথা উল্লেখ করে যা বলেছিলেন, তা নিম্নরূপ:
‘আমি তাকে বলেছিলাম, আপনি মেম্বার। চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে কিছু টাকা সংগ্রহ করুন। যদি তারা টাকা না-দেয়, টাকা আমি দেবো। তাই দিয়ে একটা অবকাঠামো প্রস্তুত করে নদীর উপর বসিয়ে দিন। তারপর সেতু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাঠামোটি দেখিয়ে সরকারের কাছে দাবি উপস্থাপন করা হোক। এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে নিশ্চয় সরকার সেতু নির্মাণ করে দেবেন। কিন্তু উক্ত নেতা আমার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে দিলেন। উপস্থিত জাতীয় পার্টির নেতা কর্মীরা উক্ত নেতার প্রতি ক্রোধ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে উচ্চবাচ্যের মাধ্যমে মনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিল।’
দিন অতিবাহিত হতে থাকে। জাতীয় পার্টির পতন ঘটে। সাধারণ নির্বাচনে কালকিনি আসন থেকে সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব এমপি নির্বাচিত হলেন, তবে সরকার গঠন করলেন বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলেন। সৈয়দ আবুল হোসেন আওয়ামী লীগের এমপি হয়েও পালোর্দি নদীর উপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন। নিজের প্রভাব এবং প্রতিপত্তি প্রয়োগ করে এবং প্রবল প্রচেষ্টা ও কৌশল খাটিয়ে সেতুর জন্য সরকারের নিকট হতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ আদায় করে নিলেন। বিএনপি সরকারের অন্যতম মন্ত্রী ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদার এসে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন। 
মাননীয় মন্ত্রী ক্ষুদ্র এক জনসমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বললেন, ‘ভাবতে অবাক লাগে, আমরা এবং আমাদের বিএনপি সরকার আপনাদের সুবিধার জন্য ব্রিজ নির্মাণ করে দিলাম। অথচ তিনি (সৈয়দ আবুল হোসেন) দাবি করছেন যে, উনি নাকি ব্রিজ নির্মাণ করেছেন।’ যাই হোক মন্ত্রী মহোদয় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে কালকিনি ত্যাগ করলেন।
পরদিন নদীর পাশে প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে দেখি, যথাস্থানে ভিত্তিপ্রস্তরখানা নেই। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম, রাতের বেলা উত্তেজিত জনতা সে ভিত্তিপ্রস্তর উপড়ে ফেলেছেন। জনগণের দাবিÑ যিনি ব্রিজ এনেছেন, যার ব্রিজ, তিনি এসে ভিত্তিপ্রস্তর বসাবেন। মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পর্কে ব্যঙ্গোক্তি করেছেন। যিনি আমাদের নেতার নামে ব্যঙ্গোক্তি করেছেন, তার নামচিহ্ন এখানে থাকবে না। পুরো ঘটনাটি কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনের অগোচরে হয়েছিল। তিনি জানলে কাজটি করতে দিতেন না।

প্রথম নির্বাচন
চার বছর যাবৎ চিঠির মাধ্যমে ইনিয়ে-বিনিয়ে কতবার যে সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেবকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলেছিলাম, তার ইয়ত্তা নেই। তিনি আমার সকল কথা রাখলেও এ ব্যাপারে অটল এবং অনড়। তার একই কথা, ‘নির্বাচন মানে দল সমর্থন। আমি আছি এবং থাকবো দলমত নির্বিশেষে সকলের হয়ে, সকল মানুষের জন্য।’ এইচ এম এরশাদের পতনের পর কালকিনির আমজনতা তাঁকে ঘিরে ধরল। তাদের আবেদন একটাই, ‘আপনাকে নির্বাচন করতেই হবে।’ তিনি আগের ন্যায় একইভাবে না-সূচক উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। এদিকে আমি নিজের প্রচেষ্টায় জাতীয় পার্টির শক্তিশালী গ্র“পটাকে তাঁর অনুকূলে নিয়ে আসি। সে সঙ্গে যখন নির্বাচনী হাওয়া বইতে থাকে, সর্বস্তরের নেতাকর্মী দিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেবের উপর চাপ দিতে থাকি। যাতে তিনি নির্বাচনে আসতে রাজি হন। কালকিনির জনতা সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেবকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার দাবিতে তাঁর অফিসের বারান্দায় অনশন ধর্মঘট পালন করে। তবু তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি হচ্ছিলেন না। মনোয়নপত্র সংগ্রহ করার শেষ তারিখের একদিন পূর্বে আমি তাঁর বাসভবনে গেলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন, ‘স্যার, অনেক মানুষ এসেছিল, সকলকেই না-বলে দিয়েছি। আপনাকেও না-বলব কিন্তু কিভাবে বলব! ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি জানি ‘না’ বললে আপনি ভীষণ কষ্ট পাবেন। কিন্তু উপায় নেই।’ আমি বললাম, এখানে শেষ নয়। খবঃ ঁং ঢ়ৎড়পববফ ধযবধফ.’
পরদিন তাঁর অফিস লোকারণ্য। সকলের একই কথা, নির্বাচন করতে হবে। উনি বললেন, ‘আমাকে মাপ করবেন।’ আমি তাঁর নিকটতম এবং নির্ভরযোগ্য দু’একজনকে ডেকে বললাম, ‘আজ মনোনয়নপত্র ক্রয়ের শেষ তারিখ। আমি চললাম, আগে ওনার নামে মনোনয়নপত্র কিনে নিই। তারপর দেখা যাবে।’ রিক্সা ভাড়া করে ছুটলাম। অনেক লোকের ভিড় ঠেলে সৈয়দ আবুল হোসেনের নামে মনোনয়নপত্র ক্রয় করে তাঁর অফিস কক্ষে ফিরে আসলাম। অফিসে তখন জনতার ভিড় ছিল না। উনিও অফিসে ছিলেন না। আমি ওনার নিজ কক্ষে প্রবেশ করে মনোনয়পত্রখানা একটা বড় আকারের খামে পুরে দিলাম। সে সঙ্গে পুরে দিলাম আমার হাতে লেখা একখানা ক্ষুদ্র চিঠি। তারপর আমি চলে গেলাম আমার নিজস্ব অন্য কাজে। অপরাহ্ণে আবার ফিরে এলাম। সৈয়দ আবুল হোসেনকে তাঁর কক্ষে পাওয়া গেল। তিনি আমাকে বললেন: ‘স্যার, আপনি কেন এ পাগলামি করলেন, বিশ্বাস করুন স্যার, আমি প্রস্তুত নই। ওদিকে কিছুতে আমার মন টানে না। রাজনীতি করলে আমি দলে সীমাবদ্ধ হয়ে যাব। আমি সার্বজনীন থাকতে চাই।’
আমি বললাম, ‘আমার কাজ আমি করলাম, এখন যা করণীয়, আপনি করবেন। তবে মনে রাখবেন দল করলেও সার্বজনীন থাকা যায়। দল আপনাকে শক্তি দেবে।’ এ বলে আমি চলে গেলাম। পরের দিন সকাল নয় ঘটিকায় ওনার অফিস কক্ষে গেলাম। দেখলাম তিনি চিন্তাক্লিষ্ট মনে বসে আছেন। আমার দিকে তাকিয়ে একটু শুকনো হাসি হাসলেন। আমাকে বসার অনুরোধ জানালে আমি বসলাম। উনি বললেন, ‘স্যার, আমাকে মাফ করবেন, আমি রাজনীতিতে যেতে আগ্রহী নয়। রাজনীতির পরিবেশ ভালো না। তবে আপনাদের কষ্ট দিয়েও আমি শান্তিতে থাকতে পারব না। এখন আমি কি করব কিছু বুঝতে পারছি না।’
ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা টেলিফোন করে তাঁকে মনোনয়ন দেয়ার ঘোষণা দিলেন। তাঁর আদেশ অমান্য করার সাহস কার আছে। আমি বললাম, তাহলে আমরা এখন নিশ্চিত। সৈয়দ আবুল হোসেন বললেন, যে জনগণের জন্য আমি নিজেকে উৎসর্গ করার প্রত্যয় নিয়েছি, তাদের জন্য নিজেকে আবার উৎসর্গ করলাম। তবে একটা কথা বলতে চাই, আমি জনসভা করতে কোথাও যাব না। কারও কাছে ভোট চাইতে পারব না। তাতে কি আমি এমপি হতে পারব?’ 
আমি বললাম, ‘অবশ্যই পারবেন। আপনার কোথাও যেতে হবে না। আপনি গত পাঁচ বছর আমাদের উজাড় করে দিয়েছেন। বিপদে কাছে ছিলেন কোনো প্রতিদানের প্রত্যাশা কখনও করেননি। জনগণ অকৃতজ্ঞ নয়। তারা আপনাকে ভালোবাসে। আমরা আপনার জন্য জনসভা করব। আপনি কালকিনি সদরে একটি মাত্র জনসভা করবেন, একদিনের জন্য যাবেন।’ 
উনি বললেন, ‘তাহলে সেদিনই আমি যাব, যেদিন সভানেত্রী যাবেন।’
আমি বললাম, তাই হোক।’
সৈয়দ আবুল হোসেন ঠিকই গেলেন না। আমরা ঘুরে ঘুরে জনসভা করতে থাকলাম। একদিন এসে গেল সে শুভদিন। কালকিনি কলেজ মাঠে জনসভা। প্রধান অতিথি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং বিশেষ অতিথি সৈয়দ আবুল হোসেন। লোকে লোকে মাঠভর্তি। আচমত আলী খান সাহেব সভাপতিত্ব করবেন। সত্য বলতে কি, সেদিন এত লোক সমাগম হয়েছিল যে, অনড় বৃদ্ধ আর অতি শিশু ছাড়া ঘরে মনে হয় আর কেউ ছিল না। সেদিন সভানেত্রীর জন্য নয়, বরং সৈয়দ আবুল হোসেনকে স্বচক্ষে দেখার জন্যই এত লোকের সমাগম হয়েছিল।

দানশীল সৈয়দ আবুল হোসেন
সত্য কথা অনেকে লুকিয়ে রাখেন। এর বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে সৈয়দ আবুল হোসেন অন্যান্য বিষয়ের মতো এ বিষয়েও ব্যতিক্রম চরিত্রের অধিকারী। আমি সৈয়দ আবুল হোসেনকে কখনও সত্য কথা গোপন রাখতে দেখিনি। তিনি অপ্রিয় হলেও সত্য কথা বলতে দ্বিধা করেন না। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন দানশীল, গরিবের বন্ধু। তাঁর দানের কর্মকাণ্ড আমি সচক্ষে দেখিনি। তবে সৈয়দ আবুল হোসেনের দানশলীতা এ কে ফজলুল হকের চেয়ে অনেক বড়, অনেক ব্যাপক। সত্য কথা গোপন না-রাখলেও, তিনি তাঁর দানের কথা কখনও প্রকাশ করতেন না। তবে ঢোলের শব্দ যেমন কাপড়ের নিচে লুকিয়ে রাখা যায় না, তেমনি দানের খোশবুও লুকিয়ে রাখা যায় না। তাই কিছু কিছু প্রকাশ হয়ে যায়। এতে তিনি লজ্জা পেতেন। তবে সৈয়দ আবুল হোসেন যা দান করেছেন তার সিংহভাগ পরম যতেœ গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এখানেই সৈয়দ আবুল হোসেন ও এ কে ফজলুল হকের পার্থক্য।

ধার্মিকতা
ধর্মভীরু এবং ধার্মিক এক কথা নয়। ধর্মভীরুরা দোযখের ভয়ে এবং বেহেস্তের লোভে ধর্মকর্ম করে থাকেন। ধার্মিকগণের কথা আলাদা। তাদের চিন্তা-চেতনা সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। তারা পবিত্র কোরআনের একটি বিশেষ মর্মবাণীকে জীবনের কর্মকাণ্ডে আমল করে থাকেন। সেই মর্মবাণীটা হচ্ছে- আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হওয়া। আল্লাহতায়ালা দানশীল, দয়াবান, ক্ষমাশীল ও ধৈর্যশীল। এ সকল গুণাবলী সৈয়দ আবুল হোসেনের মাঝে পরিপূর্ণভাবে রয়েছে। আল্লাহতায়ালার ভালোবাসা এবং প্রেমরসে সিক্ত। আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হওয়ার কথা বলে আল্লাহতায়ালা ঐ সমস্ত গুণাবালীর ধারক-বাহক হওয়ার কথা বলেছেন। সৈয়দ আবুল হোসেনের কর্মকাণ্ড যদি কেউ দিব্যদৃষ্টিতে অবলোকন করেন, তাহলে তিনি অবশ্যই স্বীকার করবেন যে, সৈয়দ আবুল হোসেন আল্লাহর রঙে রঞ্জিত একজন মহান মানুষ। আমি মনে করি আবুল হোসেনের ধার্মিক হবার পশ্চাতে দুটো কারণ ক্রিয়াশীল। প্রথমত, তাঁর পিতামাতা উভয়ে ধার্মিক ছিলেন। অন্যদিকে তাঁর শ্বশুর পরিবার নামকরা পির বংশ। আটরশির পির সাহেবের মুর্শিদ এনায়েতপুরের পির সাহেব সৈয়দ আবুল হোসেনের দাদা শ্বশুর।
অনেক বিত্তবান লোক দেখেছি যে, পিতামাতা জীবিত আছেন। তারা পিতামাতাকে হজ না-করিয়ে নিজে হজ করে আলহাজ্ব হয়েছেন। সৈয়দ আবুল হোসেন তা করেননি। তিনি নিজ পিতামাতাকে সাথে নিয়ে জলপথে মক্কা মদীনায় গিয়ে হজব্রত পালন করেছেন। ইসলাম ধর্মের এটাই বিধান। পিতামাতা জীবিত থাকলে তাঁদের হজ না করিয়ে, নিজে হজ করতে পারবে না। সৈয়দ আবুল হোসেন পিতামাতাকে সাথে নিয়েই প্রথম বার হজব্রত পালন করেছিলেন।

মহানুভবতার প্রতীক
কালকিনি পাইলট হাই স্কুলে আমি বাংলা ও ইংরেজি পড়াতাম। বাংলায় শিক্ষকতা আমার সাহিত্য মননশীলতা ও রসবোধের অনেক উন্নতি ঘটিয়েছে। মাঝে মাঝে কবিতা লিখতাম, গান লিখতাম। সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিয়ে আমি একটা জারিগান লিখেছিলম। এর প্রথম কলি:
যার কারণে সারা দেশে পরিচিত কালকিনি
আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন জনতার নয়ন মণি।
এটি একদল ছাত্র সৈয়দ আবুল হোসেনকে গেয়ে শোনালেন। শুনে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে গাইয়েদের পাঁচ হাজার এবং রচয়িতাকে পাঁচ হাজার; মোট দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেন। গায়কদেরকে ঘোষিত পাঁচ হাজার টাকা নগদ প্রদান করেছিলেন। রচয়িতাকে পরে দেবেন বলেছিলেন। অনেক দিন যায়, আামার মনে থাকলেও না-থাকার ভান করি। চাইনি। একদিন উনি আমার ব্যাগে একটা এনভেলাপ ভরে দিয়ে বললেন, ‘বাসায় গিয়ে খুলবেন।’ বাসায় গিয়ে খুললাম। দেখলাম দশটা পাঁচশ টাকার নোট। তার উপর একটি চিঠি। চিঠিতে লেখা আছে- ‘ক্ষুদ্র দানে মানের অপমান করব না বিধায় গোপনে দিলাম।’ এমন মহানুভবতা কয়জনই-বা দেখাতে পারেন।

তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ
আল্লাহতায়ালা ‘খালেক’ অর্থাৎ স্রষ্টা। তিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। তাই সবকিছুকে বলা হয় মাখলুক। খালেকের চেয়ে মাখলুক কখনও বড় হতে পারে না। দাতার চেয়ে দান বড় হতে পারে না। তাই আমার কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের মূল্যায়ন: দান বড় ঠিক আছে কিন্তু দাতা আরও বড়। সকল মানুষের কাছে তাই হওয়া উচিত বলে মনে করি। কারণ দাতা না-জন্মালে দানের জন্ম হতো না। তেমনি আবুল হোসেন না-জন্মালে আবুল হোসেনের অবারিত দান হতে আপামর জনতা বঞ্চিত হতো। তাই আবুল হোসেনের কীর্তির চেয়ে আবুল হোসেন মহৎ।

উপসংহার
মানুষ মরণশীল। একদিন আমরা কেউ থাকব না। আমাদের স্থান আবার নতুন প্রজন্ম দখল করে নেবে। তাদের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের কীর্তি অমর হয়ে থাকবে। সেদিন এ মহান দাতার কথা স্মরণ করে নতুন প্রজন্ম শ্রদ্ধায় অবনত হবে। কল্পনায় সে দৃশ্য অবলোকন করে আমি আজ কবির ভাষায় বলে যেতে চাই:

যায় যদি মুছে যায়, যাক
শুধু থাক,
এক বিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে
শুভ্র সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল।
আবদুল আজিজ হাওলাদার: প্রাক্তন সিনিয়র শিক্ষক, কালকিনি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।

নেতার মতো নেতা
আলহাজ্ব উপাধ্যক্ষ মুহাঃ জালাল উদ্দিন
এভেরিট ডার্কসেন (ঊাবৎবঃঃ উরৎশংবহ)-এর একটা উদ্ধৃতি এ মুহূর্তে মনে পড়ে গেল, ‘ ও ধস ধ সধহ ড়ভ ভরীবফ ধহফ ঁহনবহফরহম ঢ়ৎরহপরঢ়ষবং, ঃযব ভরৎংঃ ড়ভ যিরপয রং ঃড় নব ভষবীরনষব ধঃ ধষষ ঃরসবং. মনে হচ্ছিল মচকাবেন, তবু ভাঙবেন না। এত বড় রাজনীতিক এত বড় ব্যবসায়ী, এত বড় সংগঠক- এমনই তো হবার কথা। অবশেষে দেখলাম এভেরিট ডার্কসেন ঠিকই বলেছেন: সৈয়দ আবুল হোসেন শুধু রাজনীতিক নন, লিডারও বটে। তাঁর অনড় দৃঢ়তার পেছনে রয়েছে সংস্কারের আহবান, নতুনত্বের ডাক, পরিবর্তনের জয়গান। এটিই নেতার বৈশিষ্ট্য, এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তির চিত্তে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে, উদ্দেশ্য খুঁজে পায় সার্থকতা। এমন মানুষের হাত ধরে সমাজ এগিয়ে যায়, এমন ব্যক্তির ডাকের জন্য সমাজ উদ্গ্রীব হয়ে থাকে। তবে তারা ঈগল, ঝাঁকে ঝাঁকে আসে না। নেতা ঈগলের ন্যায় একটিই আসে। তাই নেতার জন্য এত প্রতীক্ষা।
নারীর সার্থকতা মাতৃত্বে, ব্যক্তির সার্থকতা প্রশান্তিতে আর নেতার সার্থকতা অবিসংবাদিত আকর্ষণ সৃষ্টিতে। একজন নেতার প্রতি তার জনগণের থাকবে ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধা। তিনি হবেন প্রেরণাদাতা, সংকটে-বিপদে আশ্রয়। যে জাতির নেতা থাকেন, যে জনগোষ্ঠীর নেতা থাকেন সে জনগোষ্ঠীর ভয় থাকে না। নেতা অন্ধকারে আলোর মতো পথ দেখায়, লাঠির মতো শত্র“র হাত থেকে রক্ষা করে। নেতাকে ঘিরে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা আবর্তিত হয়। জনগণ মনে করেন যত ভয় আসুক নেতা তাদের রক্ষা করবেন। প্রত্যেকের জন্য ঞযব ড়হষু ংধভব ংযরঢ় রহ ধ ংঃড়ৎস রং ষবধফবৎংযরঢ়. কালকিনির জনগণ যে লোকটাকে অনুরূপভাবে ভালোবাসার প্রীতি দিয়ে আঁকড়ে ধরেছেন এবং যে লোকটিও তাঁর জনগণকে ঝড়ের জাহাজের মতো বিক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝা হতে রক্ষা করার জন্য সদা ব্যস্ত থাকেন, তিনি সৈয়দ আবুল হোসেন।
নেতা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন, পরিচালিত করতে পারেন। এ দু’টি গুণ যার নেই, তিনি যত বড় রাজনীতিবিদ হোন না কেন, নেতা হতে পারেন না। সকল নেতাই রাজনীতিবিদ কিন্তু সকল রাজনীতিবিদ নেতা নয়। পৃথিবীতে এত আবিষ্কারের পেছনে রাজনীতিবিদদের চেয়ে বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিকদের অবদান বেশি। কিন্তু কালের ইতিহাসে তাদের চেয়ে নেতারাই বেশি উজ্জ্বল হয়ে টিকে আছে। কারণ পৃথিবীর সমস্ত প্রগতি, সকল আবিষ্কার, সকল শিল্পকলা রাজনীতিবিদগণের মাধ্যমে জনগণ প্রত্যক্ষ করেন। ওহাবহঃড়ৎরবং পধহ নব সধহধমবফ, নঁঃ ঢ়বড়ঢ়ষব সঁংঃ নব ষবফ. তাই জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে নেতাকে চোখে পড়ে। কারণ তিনি ঈগল। ঝাঁকের কেউ নয়।
জনগণ আর নেতার মধ্যে মিল আছে, সূত্র আছে, যোগাযোগ আছে। তবে দু’জনের মধ্যে তফাৎও আছে। নেতা জনগণকে দেখে দুই চোখে কিন্তু নেতাকে জনগণ দেখে অসংখ্য চোখে। দুই চোখ দিয়ে নেতা কোটি চোখকে প্রত্যক্ষ করেন, নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই নেতার দু’চোখ জনগণের অসংখ্য চোখের চেয়ে প্রখর হতে হয়। এরূপ প্রখরতা যার নেই তিনি নেতা নন। নেতা তা দু’চোখ দিয়ে জনগণের প্রাণের ছোট স্পন্দন পর্যন্ত অনুভব করতে পারেন। তাই জনগণের চেয়ে যদি তার দূরদৃষ্টি অধিক না-থাকে, জনগণের চেয়ে যদি তার চেতনা অধিক কার্যকর না-হয় তাহলে জনগণ তাকে নেতা হিসেবে মানে না। নেতাকে শুধু জনগণের উপদেশ অনুসারে কাজ করলে চলবে না। তাকে জনগণের উপদেশের বিপরীতেও কাজ করার সাহস রাখতে হয়। এ রকম প্রখরতা ও সাহস আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের চোখেমুখে প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি তাঁর দু’চোখ দিয়ে লক্ষ লক্ষ চোখের অধিকারী জনগণের প্রাণের ক্ষুদ্র স্পন্দনটিও অনুভব করতে পারেন। তাঁর ভালোবাসা আছে, সাহস আছে। তাই তিনি শুধু জনগণের উপদেশ অনুসারে কাজ করেন, তাই না। প্রগতির লক্ষ্যে, বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যে জনগণের বিপরীতেও কাজ করার সাহস তিনি রাখেন, তাই তাঁর সমর্থকগণ যখন বলেন, বিরোধীদের রুখতে তখন তিনি বলেন, তাদের ভালোবাসতে। প্রগতিকে তিনি গতিময়তায় বিয়োজন করার পক্ষপাতি। প্রগতিকে ‘ণড়ঁ পধহ’ঃ ংধু পরারষরুধঃরড়হ ফড়হ’ঃ ধফাধহপব — ভড়ৎ রহ বাবৎু ধিৎ, ঃযবু শরষষ ুড়ঁ রহ ধ হবি ধিু’ এ প্রবাদ মাথায় রেখে বিস্তার করতে হবে। এটি কেবল তারাই পারেন যারা মেনে নেয়ার মতো মনের অধিকারী।
রাজনীতিবিদরা সবাইকে সন্তুষ্ট করতে চায় কিন্তু পারে না, এটি সম্ভবও নয়। একজন মানুষের পক্ষে সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। নেতার জন্য এটি আরও বেশি কঠিন। মানুষের কল্যাণে তারা যত বিস্তৃত হন, যত পরিব্যাপ্ত হন, যত এগিয়ে যান, যত বিলিয়ে দেন না কেন তারপরও অনুসারীদের অনেকে বঞ্চিত মনে করেন। সন্তুষ্টি পেতে হলে দাতা ও গ্রাহক উভয়কে মহান হতে হয়। এটি সম্ভব নয়। যার জন্য মহাত্মা গান্ধী, আব্রাহাম লিংকন, কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং, বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরাগান্ধী, অং সান-এর মতো মহাত্যাগী নেতাদেরও খুন হতে হয়েছে। হার্বাট বি সুয়োপ ঠিকই বলেছেন, ও পধহহড়ঃ মরাব ুড়ঁ ঃযব ভড়ৎসঁষধ ভড়ৎ ংঁপপবংং, নঁঃ ও পধহ মরাব ুড়ঁ ঃযব ভড়ৎসঁষধ ভড়ৎ ভধরষঁৎব: যিরপয রং: ঞৎু ঃড় ঢ়ষবধংব বাবৎুনড়ফু. নেতার এ সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পূর্ণ সচেতন। তিনি জানেন যারা সবাইকে সন্তুষ্ট করতে চান, তারা পক্ষান্তরে সবার অসন্তুষ্টি পায়। তাই তিনি সবাইকে নয়, অধিকাংশকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। কাজটি তিনি এত আন্তরিকভাবে করেন যে, তার কাজে প্রায় সবাই সন্তুষ্টি অর্জন করেন। তাই তিনি নির্বাচনী এলাকায় একবার গিয়েও বিপুল ভোটে জয়ী হন।
সৈয়দ আবুল হোসেনের কথায় আগ্রহ আছে, মমত্ববোধ আছে, আছে নিদাঘ অনুপ্রেরণা। তিনি কোনো সহকর্মীর উপর জোর খাটান না। সমর্থকদের বাধ্য করেন না। অধস্তনদের এমনভাবে আদেশ দেন, যা তারা ভালোবাসার আহবান মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সহকর্মীরা তাকে ভাবেন নেতা, ভাবেন মন্ত্রী কিন্তু দেখেন সহকর্মী হিসেবে। তারা তাঁকে দেখেন অত্যন্ত প্রভাবশালী হিসেবে কিন্তু অনুভব করেন বন্ধু হিসেবে। তাই তিনি সহজে পারেন মানুষকে কাছে টেনে নিতে। এমনভাবে কথা বলেন যেন সাধারণ একজন। তিনি বিশ্বাস করেন, ঞযব শবু ঃড় ংঁপপবংংভঁষ ষবধফবৎংযরঢ় ঃড়ফধু রং রহভষঁবহপব, হড়ঃ ধঁঃযড়ৎরঃু. তিনি আরও বিশ্বাস করেন নেতা হতে হলে আগে আনুগত্য শিখতে হয়। এ আনুগত্য যেমন ঊর্ধ্বমুখী তেমনি নিম্নমুখী। তাই নেতাকে তাঁর অনুগত সমর্থকদের চেয়েও ছোট ভাবার মানসিকতা থাকতে হয়। এমন বোধ সৈয়দ আবুল হোসেনের আছে। তাই তিনি কালজয়ী নেতৃত্বের দিকে ছুটে চলেছেন।
তিনিই নেতা, যিনি জনগণকে স্বপ্ন দেখান, জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য নিজেও স্বপ্নের সাথে একাকার হয়ে যান। যার অনুপ্রেরণায় জনগণ তাড়িত হয়ে প্রত্যেকে এক একজন একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে ওঠেন। সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর সংসদীয় এলাকার প্রত্যেক ব্যক্তির মনে কোনো না কোনোভাবে স্থায়ী রেখাপাত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তাঁর প্রত্যেক সমর্থক এক একজন সৈয়দ আবুল হোসেন। নেতার স্বরূপ বলতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন কুইন্সি এডামস বলেছিলেন, ওভ ুড়ঁৎ ধপঃরড়হং রহংঢ়রৎব ড়ঃযবৎং ঃড় ফৎবধস সড়ৎব, ষবধৎহ সড়ৎব, ফড় সড়ৎব ধহফ নবপড়সব সড়ৎব, ুড়ঁ ধৎব ধ ষবধফবৎ. সৈয়দ আবুল হোসেন রাজনীতিবিদ হিসেবে জন কুইন্সি এডামসের কথাটি সচেতনভাবে মনে রাখেন।
অনেকে মনে করেন, লিডারশিপ ক্ষমতার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। সন্ত্রাস আর ভয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় কিন্তু তা ঠিক নয়। এ বিষয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন অনেকটা মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী। সৈয়দ আবুল হোসেন মনে করেন, ও ংঁঢ়ঢ়ড়ংব ষবধফবৎংযরঢ় ধঃ ড়হব ঃরসব সবধহঃ সঁংপষবং; নঁঃ ঃড়ফধু রঃ সবধহং মবঃঃরহম ধষড়হম রিঃয ঢ়বড়ঢ়ষব. তাই তিনি যা করেন জনগণকে নিয়ে করেন, যা করেন জনগণের জন্য করেন। নইলে নিজের অর্থ ব্যয়ে কালকিনির মতো একটি প্রত্যন্ত এলাকাকে শহরের মতো সজ্জিত করা সম্ভব হতো না। মানুষ যেখানে এক টাকা খরচ করতে পাঁচ বার পেছনে তাকায় সেখানে তিনি কোটি কোটি টাকা জনগণের জন্য খরচ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেন না। এ উদারতা নেতৃত্বের সার। যার মধ্যে এ উদারতা নেই তিনি নেতা নন, ঝাঁকের কৈ।
সবকিছু জনগণের জন্য। বিধি মানার প্রয়োজন অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। জনকল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য বিধি। বিভিন্ন কারণে বিধি কাক্সিক্ষত লক্ষ্য হতে দূরে সরে আসতে পারে। পুনরায় বিধি করতে হয়। তাই তিনি বিধির জন্য জনস্বার্থ বা জনকল্যাণ ব্যাহত করার পক্ষপাতি নন। বিধি যখন জনকল্যাণ ব্যাহত করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তিনি বিধির বাইরে এসে শুধু জনস্বার্থটাই প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ওয়্যারেন বেন্যিস-এর কথা মনে করিয়ে দেয়: ঞযব সধহধমবৎ ধপপবঢ়ঃং ঃযব ংঃধঃঁং য়ঁড়; ঃযব ষবধফবৎ পযধষষবহমবং রঃ. তিনি ম্যানেজার নন, লিডার। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এটি প্রমাণ করার সাহস ও দক্ষতা দুটোই সৈয়দ আবুল হোসেনের আছে। প্রশাসক আইনকে অনুসরণ করে কিন্তু আইন অনুসরণ করে নেতাকে। কারণ নেতা জনগণের, জনগণের জন্যই সব।
সৈয়দ আবুল হোসেন অত্যন্ত নরম মনের মানুষ। তিনি সবকিছু সহ্য করতে পারেন, কিন্তু কারও কষ্ট সহ্য করতে পারেন না। নেতার মন সবসময় নরম থাকে। শুধু মানুষ নয়, কোনো জীবের কষ্টই তিনি সহ্য করতে পারেন না। শত্র“কেও তিনি তাই বিপদগ্রস্ত করতে নারাজ। ডাসারের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের একটি ছেলের শুধু নিজ চেষ্টায় এত উপরে ওঠার পেছনে যে সূত্রটি কাজ করেছে সেটি হচ্ছে: খড়াব ষরভব ধহফ ষরভব রিষষ ষড়াব ুড়ঁ নধপশ. খড়াব ঢ়বড়ঢ়ষব ধহফ ঃযবু রিষষ ষড়াব ুড়ঁ নধপশ. এটি সবার জন্য সত্য। কেউ যদি এ সূত্র অবলম্বন করে, তাহলেও সেও আবুল হোসেনের মতো বড় হবেন। তবে দুর্ভাগ্য, এটি প্রায় অসাধ্য। ভালোবাসার মত কঠিন জিনিস আর নেই। এটি দেয়া অনেক বেশি কষ্টের। সৈয়দ আবুল হোসেন এ কাজটি খুব ভালোভাবে পারেন।
কথামালা দিয়ে উপন্যাস রচনা করা যায়, গল্প-কাহিনী সৃষ্টি করা যায় কিন্তু নেতৃত্ব অনেক কঠিন জিনিস। নেতাকে কথা ও কাজে একাত্ম থাকতে হয়। তাকে প্রতিটি কথা বলতে হয় মেপে। মাঠ, সংসদ ভবন, অফিস সবখানে সৈয়দ আবুল হোসেন কথা বলেন খুব মেপে, চিন্তা করে। তার প্রতিটি বাক্যে দূরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন ঘটে। মনে হয় যেন অনেক ভেবে বলছেন। আব্রাহাম লিংকনও কথাবার্তায় অনুরূপ ছিলেন। তিনি বলতেন: ডযবহ ও মবঃ ৎবধফু ঃড় ঃধষশ ঃড় ঢ়বড়ঢ়ষব, ও ংঢ়বহফ ঃড়ি ঃযরৎফং ড়ভ ঃযব ঃরসব ঃযরহশরহম যিধঃ ঃযবু ধিহঃ ঃড় যবধৎ ধহফ ড়হব ঃযরৎফ ঃযরহশরহম ধনড়ঁঃ যিধঃ ও ধিহঃ ঃড় ংধু. এ বিবেচনায় সৈয়দ আবুল হোসেন আব্রাহাম লিংকনের অনুসারী। তিনি বলেন:
‘একজন নেতা বা নেত্রীকে কথায় ও কাজে কেবল পারফেক্ট হলেই চলবে না, তাকে অনুকরণীয় গুণাবলীর অধিকারীও হতে হবে। তার কাছ থেকে মানুষ প্রেরণা পাবে। তিনি হবেন আদর্শ স্থানীয়। মানুষ তাকে অনুসরণ করবে। তাকে দেখে শিখবে, উজ্জীবিত হবে। সে জন্যে একজন নেতা বা নেত্রীকে মেপে মেপে কথা বলতে হয়। তিনি যা বলছেন তার তাৎপর্য, মর্ম এবং জনগণের মনে কি সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে সম্পর্কে তার সঠিক ধারণা থাকতে হবে। কারণ রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তার প্রতিটি কথারই গুরুত্ব রয়েছে। তাই দৃষ্টিনন্দনের চেয়ে তাকে হতে হবে বেশি মাত্রায় উক্তি নন্দন। তাকে সবসময় স্মরণ রাখতে হবে তার অসংলগ্ন বা বল্গাহীন উক্তি তার ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে পারে।১
তাই সৈয়দ আবুল হোসেন কথাবার্তায় চালচলনের মতোই সাবধান। কেউ কষ্ট পাবে, কারও অনুভূতিকে আহত করতে পারে এমন কথা তিনি বলেন না। তাই বলে তিনি নিশ্চুপও থাকেন না। তিনি বলেন তবে তা মার্জিত, শালীন। তিনি সমালোচনাও করেন, তবে তা গঠনমূলক। যার বিরুদ্ধে সমালোচনা করেন তাকে ক্ষুব্ধ করে না, সচেতন করে। এখানেই তার নেতৃত্বের স্বকীয় বারতার অবগাহন। তিনি প্রতিদিন কমপক্ষে একটি হলেও ভালো কাজ করার চেষ্টা করেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন- ঘবরঃযবৎ ভরৎব হড়ৎ রিহফ, নরৎঃয হড়ৎ ফবধঃয পধহ বৎধংব ড়ঁৎ মড়ড়ফ ফববফং.
নেতা কোনো পেশা নয়, কার্যকরণ। তাই পৃথিবীর অধিকাংশ নেতা উদ্দেশ্যগত নয়, কার্যকরণগত ঘটনায় আকস্মিক নেতার পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। সৈয়দ আবুল হোসেনেরও নেতা হবার ইচ্ছা কখনও ছিল না। ঘটনা তাকে নেতা করে দেয়। প্রকৃতি এভাবে তার অনিবার্যতাকে সামনে নিয়ে আসে। সৈয়দ আবুল হোসেন ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের বন্যায় যখন দুর্গত লোকদের সাহায্য করতে গিয়েছিলেন তখন সেখানকার কিছু লোক তাকে বাধা দিয়েছিলেন। তারা মনে করেছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন আসলে বিদ্যমান নেতৃত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এ বাধা হয়ত সৈয়দ আবুল হোসেনের মনে একটা জেদ সৃষ্টি করেছিল। তিনি সবসময় চ্যালেঞ্জকে সাহসের সাথে বরণ করেন। তিনি সেদিন সাহায্য দিয়ে এসেছিলেন। পরাজয় বরণ করে আসেননি। যারা ঐদিন তাঁকে বাধা দিয়েছিলেন এখন তারা সৈয়দ আবুল হোসেনের সামান্য দর্শনের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। এটাই নেতৃত্ব, এটাই জনকল্যাণ। এটা মহাজীবনের বৈশিষ্ট্য। ঝধুবফ অনঁষ ঐড়ংংরহ, যব রং হড়ঃ নড়ৎহ ধং ধ ষবধফবৎ. অহফ যব রং সধফব লঁংঃ ষরশব ধহুঃযরহম বষংব, ঃযৎড়ঁময যধৎফ ড়িৎশ. অহফ ঃযধঃ রং ঃযব ঢ়ৎরপব যব যধং ঃড় ঢ়ধু ঃড় ধপযরবাব ঃযধঃ মড়ধষ, ড়ৎ ধহু মড়ধষ.
পৃথিবীতে অনেক নেতা ছিলেন এখনও আছেন। তারা কেউ নেতা হয়ে জন্মায়নি। তিল তিল শ্রমে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। সৈয়দ আবুল হোসেন এটি বিশ্বাস করেন। কারণ তিনি নিজে সাধনায় সাধনায় এ পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন।
প্রগতিকে তিনি শিক্ষার অনুকল্প হিসেবে চিন্তা করেন। আমি তার লেখা, কর্ম আর ভাষণে এর প্রতিফলন পেয়েছি। তিনি মনে করেন, ঈযধহমব ফড়বং হড়ঃ হবপবংংধৎরষু ধংংঁৎব ঢ়ৎড়মৎবংং, নঁঃ ঢ়ৎড়মৎবংং রসঢ়ষধপধনষু ৎবয়ঁরৎবং পযধহমব. ঊফঁপধঃরড়হ রং বংংবহঃরধষ ঃড় পযধহমব, ভড়ৎ বফঁপধঃরড়হ পৎবধঃবং নড়ঃয হবি ধিহঃং ধহফ ঃযব ধনরষরঃু ঃড় ংধঃরংভু ঃযবস. তাই তিনি শিক্ষা বিস্তারে আপোষহীন। নেতার মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের মনোভাব অনাগত প্রজন্মের কাছে আলোর ডাক। সৈয়দ আবুল হোসেনের ভাষায়-
‘ফসলের জন্য যেমন জমিকর্ষণ করতে হয়, বীজ রোপন করতে হয়, পরিচর্যা করতে হয়, তেমনি নেতৃত্বের যোগ্যতাও অর্জন করতে হয়। নেতৃত্ব আপনা আপনি আসে না। আকাশ থেকে পড়ে না। মাটি ফুঁড়ে গজায় না। তার জন্যে পরিশ্রম করতে হয়। সাধনা করতে হয়। অধ্যবসায়ী হতে হয়। ইসলামের মহান দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) যথার্থই বলেছেন, নেতা ও দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য বিদ্যা অর্জন অপরিহার্য।’২
একজন নেতার যে সকল গুণাবলী থাকা প্রয়োজন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নেতার যে সকল গুণাবলীকে অনিবার্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার সবটাই সৈয়দ আবুল হোসেনে বিদ্যমান। তিনি কৃতজ্ঞতায় আকাশ। যাদের ভালোবাসায় সিক্ত তাদের জন্য রিক্ত হতে প্রস্তুত। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তার অনাবিল চরিত্রের নিখাদ অলঙ্কার। তিনি মনে করেন, এৎধঃরঃঁফব রং ৎরপযবং. ঈড়সঢ়ষধরহঃ রং ঢ়ড়াবৎঃু. কারও প্রতি অভিযোগ নয়, বরং কারও প্রতি বিরক্ত হলে তিনি কৃতজ্ঞতায় সিক্ত হয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন।
তাঁর সাথে আমার পরিচয় তেমন ঘনিষ্ঠ নয়। দূর হতে জেনেছি। আমার একটা ইতিহাস গ্রন্থ প্রকাশে সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। এ পর্যন্তই। তবে রাজনীতির গবেষক হিসেবে প্রত্যেক নেতাকে আমার পাঠ করতে হয়। এটি আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। বাংলাদেশের অধিকাংশ নেতাকে নিয়ে আমি এ শখ নিজে নিজে মেটাই। সেই ভাবে আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের রচনা, বক্তৃতা, সমাজসেবা ও দর্শনের সাথে পরিচিত হয়েছি। আমি দেখেছি তাঁর ভালোবাসা জনগণকে প্লাবিত করে, জনগণের ভালোবাসা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাই তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয় কৃতজ্ঞতার সুর:
‘আমি সিক্ত আমার এলাকার মানুষের ভালোবাসায়। তাদের কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। সেটা আমি শোধ করতে পারি শিক্ষার আলো জ্বেলে বা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ব্যক্তিকে সাহায্য দানের আবেদন সব সময়ই সাময়িক। প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আবেদন কালজয়ী।’৩
ডন মারকুইস বলেছেন, ওভ ুড়ঁ সধশব ঢ়বড়ঢ়ষব ঃযরহশ ঃযবু’ৎব ঃযরহশরহম, ঃযবু’ষষ ষড়াব ুড়ঁ. ওভ ুড়ঁ ৎবধষষু সধশব ঃযবস ঃযরহশ, ঃযবু রিষষ যধঃব ুড়ঁ. সৈয়দ আবুল হোসেনের রাজনীতি ও নেতৃত্বে এ কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আমি ইতিহাসের শিক্ষক এবং ইতিহাস রাজনীতির নাটক। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিশ্লেষণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি, কারণ, তিনি শ্রদ্ধার সকল উপাদানে ভূষিত।
আলহাজ্ব উপাধ্যক্ষ মুহাঃ জালাল উদ্দিন: ডাঃ আফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ, ইতিহাসবেত্তা, সাহিত্যিক ও গবেষক।

১. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন গ্রন্থের প্রবন্ধ, লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা- ৪১।
২. তারুণ্য ও শিক্ষা, সৈয়দ আবুল হোসেনের গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন গ্রন্থের একটি প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ৯৫।
৩ . নির্বাচনী এলাকা কালকিনির ছাত্রছাত্রীদের আয়োজিত নবীনবরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ, জানুয়ারি, ১৯৯৩

আধুনিক কালকিনির বিনির্মাতা
অধ্যক্ষ মো. খালেকুজ্জামান
পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, পলারদি বিধৌত ফরায়েজি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হাজি শরিয়তুল্লাহর স্মৃতি বিজড়িত ও উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি শাহ মাদারের পুণ্যভূমি মাদারীপুর জেলার একটি প্রত্যন্ত উপজেলা-জনপদ কালকিনি। এটি সমুদ্র উপকূলবর্তী উপজেলা। নদীমাতৃক হওয়ায় বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল হতে অপেক্ষাকৃত নিচু। ভৌগোলিক কারণেই এলাকাটি ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক অভিশাপে অভিশপ্ত। তাছাড়া, রাজনৈতিক কারণেই এলাকাটি দীর্ঘ দিন জাতীয় উন্নয়নের সার্বিক অবস্থা থেকে অনেক অনুন্নত এবং পিছিয়ে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বা পরবর্তীকালে সৈয়দ আবুল হোসেনের পূর্বে কালকিনি উপজেলার কোনো অধিবাসী সংসদ সদস্য ছিল না। অন্য এলাকার লোক সংসদ সদস্য ছিলেন। ফলে প্রত্যন্ত এ জনপদটির উন্নয়নের লক্ষ্যে আন্তরিকভাবে কাজ করার, এলাকার সমস্যা সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে কথা বলার মতো কেউ ছিল না। সংগত কারণে কালকিনি দেশের অন্যান্য এলাকা এমনকি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের চেয়েও শিক্ষা-দীক্ষা, যোগাযোগ, অবকাঠামো এবং আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। কালকিনির এ ক্রান্তিকালে প্রচণ্ড প্রতাপের সাথে আবির্ভূত হলেন চিরভাস্বর একটি নক্ষত্র। যার নাম আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন।
১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাস। কালকিনি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জনাব জালাল উদ্দিন সাহেবের সাথে কলেজের কাজে ঢাকা গেছি। ঢাকা বোর্ডের কর্মচারী জনাব সৈয়দ আবুল হান্নান সাহেবের সাথে চা খেতে বসে কলেজের উন্নয়নের কথা আলোচনা করছি। অধ্যক্ষ স্যার কলেজের আর্থিক অসচ্ছলতা, ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি, ক্যাম্পাসের প্রতিকূল পরিবেশ প্রভৃতি ব্যাপারে আলোচনা করছেন। আলোচনার এক পর্যায়ে হান্নান সাহেব বললেন, ‘আমার একজন আত্মীয় আছেন ধনাঢ্য এবং শিক্ষানুরাগী। চলেন তার কাছে যাই- দেখি তিনি কোনো সাহায্য করতে পারেন কিনা।’ আমরা গেলাম মতিঝিলের আমিন কোর্টে। সুউচ্চ ভবনের ত্রিতলে সাকো অফিস। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হান্নান সাহেবের আত্মীয়। হান্নান সাহেব আমাদেরকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহেবের কক্ষে নিয়ে গেলেন। পরিচয় হলো আজকের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে। প্রথম দৃষ্টিতে মুগ্ধ হলাম। নজরকাড়া-তরুন, স্মার্ট। যেমন সুন্দর চেহারা, তেমন অমায়িক ব্যবহার। কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি তাঁর আচরণ দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করে দিলেন। কালকিনি কলেজের দৈন্যতার কথা আলোচনা করলাম। উনি বললেন, ‘আজিজ ভাই (প্রয়াত আজিজ চেয়ারম্যান সাহেব) আমাকে বলেছিলেন, কলেজটির উন্নয়নে এগিয়ে আসতে কিন্তু নানা ব্যস্ততার কারণে হয়ে ওঠেনি। আপনারা এখন এসেছেন আমি চিন্তা করে দেখব কি করা যায়।’ তার কথার মধ্যে ছিল আন্তরিকতা এবং দৃঢ়তা। আমরা আশ্বস্ত হয়ে ফিরে আসলাম। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় পরবর্তীকালে কলেজের পক্ষ হতে তাঁর সাথে আর যোগাযোগ করা হয়নি। যথাসময়ে যোগাযোগ করা হলে হয়ত কলেজের অবয়বসহ সার্বিক উন্নয়ন অনেক আগেই সম্পাদিত হয়ে যেত।
জালাল স্যার চলে গেলেন অন্য কলেজে। দায়িত্বে আসলেন জনাব হাতেম আলী মিঞা। ১৯৮৫ সালের শেষে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিলাম আমি। অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে বুঝলাম কলেজের অবস্থা কত মারাত্মক ও কত সঙ্গীন। এ অবস্থা কয়েক বছর থাকলে কলেজটি বন্ধ হয়ে যাবে। বারবার মন চাইছিল কলেজটির উন্নয়নের জন্য সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে ছুটে যাই। তাঁকে গিয়ে বলি কিন্তু বিভিন্ন কারণে কলেজের উন্নয়নের অনুরোধ নিয়ে তাঁর সাথে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে সরকারি হওয়ার আশায় সংশ্লিষ্টদের যোগাযোগের উৎসাহে আরও ভাটা পড়ে। গুটি কয়েক লোক সৈয়দ আবুল হোসেনকে দিয়ে কলেজের উন্নয়ন হোক, এটি চাইছিলেন না। এর কারণ ছিল মূলত রাজনৈতিক।
১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় এলাকায় প্রচুর ত্রাণ বিতরণ করলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন খোয়াজপুর সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ। কলেজটির অবকাঠামো নির্মাণ, ছাত্র শিক্ষকের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে চারিদিকে আলোড়ন ফেলে দেন। সৈয়দ আবুল হোসেনের উদ্যোগ ম্যাজিকের মতো কাজ করল। খোয়াজপুরের মতো একটি অজপাড়াগাঁ অল্প সময়ের মধ্যে রূপান্তরিত হলো একটি ছোটখাটো শহরে। প্রতিক্রিয়া হলো কালকিনিতে। জনগণ, শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ হতে প্রশ্ন উঠল, কালকিনির ছেলের টাকা আমরা কেন আনতে পারলাম না। এলাকাবাসীর অনেকেই তখনও প্রত্যাশা করছেন কালকিনি কলেজ সরকারি হবে। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন কালকিনি সদরের ৩টি প্রতিষ্ঠান কালকিনি কলেজ, কালকিনি পাইলট হাইস্কুল ও কালকিনি গার্লস হাইস্কুল সরকারি হবে কিন্তু তা হয়নি। এলাকার কলেজের উন্নয়নে সৈয়দ আবুল হোসেনের সহায়তা প্রার্থনার দাবি ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠে। শিক্ষানুরাগী হিসেবে ততদিনে তাঁর নাম সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
১৯৯০ সালে এরশাদের পদত্যাগের মাধ্যমে জাতীয় পার্টির সরকারের অবসান ঘটে। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ঐকান্তিক অনুরোধে প্রবল অনীহা সত্ত্বেও সৈয়দ আবুল হোসেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এলাকায় মাত্র একদিন এসে তিনি বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হন। এলাকার মানুষ, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী সবাই একযোগে কলেজটির উন্নয়নের লক্ষ্যে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনকে সম্পৃক্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলেন। তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান, ভারপ্রাপ্ত উপজেলা চেয়ারম্যান, রাজনৈতি, নেতৃবৃন্দসহ অনেকেই এগিয়ে আসলেন। কলেজটিকে রক্ষা করতে হবে। কলেজটি রক্ষা করতে হলে অর্থের প্রয়োজন, প্রয়োজন উদ্যোগী ও উদ্যোমী উদার মনের মানুষ। এগিয়ে এলেন কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্যরা। জনাব অ্যাডভোকেট এমএ কাদের সাহেবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হলো সভা। সবার একই কথা কলেজটিকে রক্ষা করতে হলে, উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করতে হলে সৈয়দ আবুল হোসেন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কলেজটির উন্নয়নে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের সহায়তা চাওয়ার এবং সার্বিক উন্নয়নে তাঁকে সম্পৃক্ত করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
জনগণের নেতা সৈয়দ আবুল হোসেন। এলাকার উন্নয়ন তাঁর প্রাণ এবং শিক্ষাবিস্তার তাঁর হৃদপি। জনগণের অনুরোধ তিনি ফেলতে পারলেন না। কলেজের উন্নয়নের জন্য এককালীন দান করলেন পঁচিশ লক্ষ টাকা। তাঁর এহেন বদান্যতায় জনগণ মুগ্ধ হয়ে কলেজটির নাম কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ রাখার দাবি তোলেন। নাম পরিবর্তনে সরকারি শর্ত ছিল পনেরো লক্ষ টাকা অনুদান। অথচ তিনি একবারেই দান করলেন পঁচিশ লক্ষ টাকা। জন-দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুন ক্ষীণপ্রভা ‘কালকিনি কলেজ’ ‘কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ’ নাম ধারণ করে নব উদ্যমে যাত্রা শুরু করল মহা প্রত্যাশার পথে। নিভু নিভু কালকিনি কলেজের শুরু হলো আলোঝলমল অগ্রযাত্রা। সৈয়দ আবুল হোসেন নামক মহাদাতার মহাপরশে সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল কলেজের নিভু নিভু শিখা। শুধু পঁচিশ লক্ষ টাকা দিয়ে তিনি থেমে থাকেননি। কলেজের উন্নয়নে আরও অনেক টাকা দিয়েছেন। নিজের মনের মতো করে সজ্জিত করেছেন কলেজ, ক্যাম্পাস ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা। এগিয়ে চলল কলেজের উন্নয়ন কাজ। বৃদ্ধি পেল ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কলেজে চালু হলো অনার্স কোর্স, মাস্টার্স কোর্স, বিএসসি কোর্স, নির্মিত হলো নতুন নতুন ভবন। বর্তমানে কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজে দশ বিষয়ে অনার্স ও দুই বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু হয়েছে। অধ্যয়ন করছে তিন সহস্রাধিক ছাত্রছাত্রী। প্রতি বছর পান্তাভাত খেয়ে এলাকার বহু ছাত্রছাত্রী অর্জন করছে সর্বোচ্চ ডিগ্রি। এছাড়া পরিকল্পনায় রয়েছে বিবিএ এবং এমবিএ-সহ কম্পিউটার বিজ্ঞানে অনার্স কোর্স চালুর। সবই সম্ভব হবে এবং অচিরে। কারণ কলেজের প্রাণপুরুষ সৈয়দ আবুল হোসেন।
আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন দানে হাজি মহসিন, শিক্ষানুরাগে অনন্য। আগের দিনে হিন্দু শিক্ষানুরাগীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতেন। বিশেষ করে হিন্দু জমিদারদের অনেকে নিজ নিজ অধিকারভুক্ত জমিদারিতে একটি-দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতেন। সৈয়দ আবুল হোসেন তার চেয়ে বেশি। তিনি জমিদার নন, তবু নিজের শ্রমে অর্জিত অর্থ ব্যয় করে গড়ে তুলেছেন একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একটি নয়, দুটি নয়- অসংখ্য, অগণিত। শিক্ষা বিস্তারে সৈয়দ আবুল হোসেন যে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন তা বাংলাদেশে বিরল। অল্প বয়সে তিনি ব্যবসা করে ধনবান হয়েছেন। তিনি শুধু ধনবান নন, মনবান এবং চরিত্রবানও বটে। তাঁর চরিত্র মহামানবের মতো মহীয়ান। সাবেক জেলাপ্রশাসক জনাব আঃ সাত্তার সাহেবের ভাষায়, ‘যে বয়সে বাঙালি মুসলমান অর্থ সম্পদের মালিক হলে নষ্ট হয়, সে বয়সে সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব নষ্ট হননি; বরং হয়েছেন উজ্জ্বল, করেছেন দেশের উন্নয়ন, দানে দানে হয়েছেন মহীয়ান।’ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি জেলাপ্রশাসক মহোদয়ের কথা।
আসলেই সৈয়দ আবুল হোসেন এককভাবে কালকিনির উন্নয়নের জন্য যে অবদান রেখেছেন তা আবুল হোসেনকে বাদ দিয়ে কালকিনির সকল জনগণের পক্ষেও সম্ভব হতো না। এলাকার উন্নয়নে তাঁর ইচ্ছা, প্রয়াস ও গতি যেমন অবিরাম তেমন নিবিড় ও নিরলস। এ ব্যাপারে কোনো আপোষ নেই। কালকিনিকে তিনি দিয়েছেন অনেক; দিয়ে যাচ্ছেন অবিরল। বিনিময়ে পেয়েছেন এলাকার মানুষের প্রাণঢালা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। এ কারণে তাঁর কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ছাড়াই লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়। তাঁকে একনজর দেখার জন্য জনগণের ঢল নামে। আবালবৃদ্ধবণিতা বেরিয়ে আসে ঘর ছেড়ে, তাদের নমস্য ব্যক্তিটিকে এক নজর দেখবেন বলে।
সৈয়দ আবুল হোসেন অসম্ভব পরিশ্রমী, নিয়মানুবর্তী ও সুশৃঙ্খল জীবনের অধিকারী। মানুষের জীবনের সব ভালো দিকগুলো তার চরিত্রে সমভাবে দেদীপ্যমান। তিনি নিরহঙ্কারী এবং অমায়িক। সত্যি, সৈয়দ আবুল হোসেন প্রকৃতই শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিত্ব।
সৈয়দ আবুল হোসেন অপরিসীম মেধা, মনন আর উদ্যম নিয়ে কালকিনির উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে সম্মানজনক ও শক্তিশালী অবস্থান করে নিয়েছেন অল্প সময়ের মধ্যে। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আর তাঁকে পিছনে তাকাতে হয়নি। পরপর চার বার এমপি পদে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছেন। এ বিজয় তাঁর প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতি।
১৯৯৬ সালে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হলেন। অল্প দিনের মধ্যে এলাকার যোগাযোগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন কালকিনি পৌরসভা। ২০০৯ সালে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় দেশের বৃহত্তম নদী পদ্মায় সেতু নির্মাণের বড় চ্যালেঞ্জের মোকাবেলাসহ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি কালকিনির সার্বিক উন্নয়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
কালকিনির এই রতœ আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের সবচেয়ে বড় সাফল্য কালকিনি অঞ্চলের শিক্ষা প্রসারে সীমাহীন অবদান। তিনি বিশ্বাস করেন যে জাতি বা অঞ্চল যত বেশি শিক্ষিত সে অঞ্চল তত বেশি উন্নত। তাই সামর্থ্য অর্জনের সাথে সাথে তিনি শিক্ষার প্রসারে নিজেকে নিবেদিত করে দিয়েছেন। একক প্রচেষ্টায় ১৯৮৯ সালে মাদারীপুর থানাধীন অনুন্নত অঞ্চল খোয়াজপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের অন্যতম খ্যাতি সম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ। অতঃপর কালকিনি উপজেলা সদরে তৎকালীন ক্ষীণপ্রভার কালকিনি কলেজ তাঁর সার্বিক তত্ত্বাবধানে আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর সুরম্য ভবনের খ্যাতি দেশ জোড়া। কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ এখন কোনো সাধারণ কলেজ নয়; দক্ষিণ বঙ্গের অন্যতম খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এছাড়া উপজেলাধীন ডাসার গ্রামে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ, শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজ প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যেকটিকে খ্যাতি, অবয়ব ও শিক্ষার মান ও মননে শীর্ষে তুলে দিয়েছেন।
তাঁর উদারতার ছোঁয়ায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে শশীকর শহিদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়, সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম কলেজ প্রভৃতির সার্বিক উন্নয়ন। এ বছরেই আড়িয়ালখাঁর অপর পাড়ের প্রত্যন্ত জনপদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন খাসেরহাট সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ। কলেজ ছাড়াও উপজেলার সব মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয় তাঁরই তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া তিনি শতাধিক স্বল্পব্যয়ী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাদরাসা শিক্ষার প্রসারেও তাঁর ভূমিকা অনন্য। তাঁর একক প্রচেষ্টা সমগ্র অঞ্চলকে নিরক্ষরতা মুক্ত আলোকপ্রাপ্ত অঞ্চলে পরিণত করেছে।
আজকের কালকিনি আগের সে প্রত্যন্ত কালকিনি নয়। আজকের কালকিনি আবুল হোসেনের কালকিনি, শিক্ষা, যোগাযোগ, উন্নয়ন, অবকাঠামো আর সমৃদ্ধির কালকিনি। সারা দেশের মধ্যে একটি অন্যতম উন্নত ও খ্যাতনামা উপজেলা। আর আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন নিষ্কলুষ গগনের মতো চির উন্নত শিরে অনির্বাণ দিনমণি। তার প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।
মো. খালেকুজ্জামান: অধ্যক্ষ, কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, কালকিনি, মাদারীপুর।

আমার ভাই আমার আদর্শ
ড. সৈয়দ এ হাসান
আমার বাবার নাম আলহাজ্ব সৈয়দ আতাহার আলী, মা আলহাজ্ব সুফিয়া আলী। বাবা লেখাপড়া শেষ করে দেশ বিভাগের পূর্বে বর্ধমানের সেটেলমেন্ট অফিসে চাকুরিতে যোগ দিয়েছিলেন। দেশ বিভাগের পর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে পাট ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। তখন পাট ব্যবসা ছিল সম্মানজনক পেশা। মোটামুটি সচ্ছল হবার পর তিনি কিছু জমিজমা কেনেন। এরপর পাট ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে গৃহস্থালি কাজে মনোনিবেশ করেন। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আমি সর্বকনিষ্ঠ। অন্যান্য ভাইবোনগণ হচ্ছেন যথাক্রমে সৈয়দা শামসুন নাহার, সৈয়দ আবুল কাশেম, সৈয়দ আবুল হোসেন, সৈয়দা জাহানারা এবং সৈয়দা মনোয়ারা বেগম। মেজো বোন সৈয়দা জাহানারা বিশ বছর বয়সে মারা যান। তাই অনেকে মনে করেন আমরা দুই বোন। সৈয়দ আবুল হোসেন আমার মেজো ভাই। তাঁকে আমরা ছোট ভাই-বোনেরা দাদা ডাকতাম। বড় ভাই আবুল কাশেমকে ডাকতাম নানা। মা ছোটবেলায় আমাদের এভাবে ডাকতে শিখিয়েছেন।
কালকিনি উপজেলার ডাসার গ্রামে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। ভালো করে কথা বলতে শেখার আগে আরবি আলিফ বা শিখতে শুরু করি। বাড়ির পাশের মক্তবে হুজুরের কাছে আরবি শিখতাম। সন্ধ্যায় বড়দের কাছে শিখতাম বাংলা ও ইংরেজি।
আব্বা ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটাহাঁটি করতে বের হতেন। এ ফাঁকে জমি-জমা ও ফসলাদিরও তদারকিটা সেরে নিতেন। বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে নয়/দশ টা বেজে যেত। আমরা ততক্ষণে সকালের নাস্তা খেয়ে নিতাম। আব্বার জন্য মা পৃথকভাবে নাস্তা রেখে দিতেন। তখন গ্রামে ভিক্ষুকের অভাব ছিল না। বাবা খেতে বসলে প্রায় সময় ভিক্ষুক আসত। তিনি ভিক্ষুক দেখলে ডেকে নিয়ে একত্রে খেতে বসতেন। এভাবে প্রায় প্রতিদিন বাবা ভিক্ষুকের সাথে খেতেন। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন হয়েছিল যে, ভিক্ষুক না-আসলে বাবা আর খেতে পারতেন না।
১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে আমি ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। দাদা সৈয়দ আবুল হোসেনসহ আমার সব ভাইবোন ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেছিলেন। এটি ছিল আমাদের বাড়ি হতে এক কিলোমিটার উত্তরে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে আমি ডি কে আইডিয়াল একাডেমিতে ভর্তি হই। এটি তখন ছিল ভাঙাচুরা ভবনের সাধারণ মানের একটি স্কুল। আমার দাদা সৈয়দ আবুল হোসেনের বদান্যতায় ডি কে আইডিয়াল একাডেমি ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এবং পরবর্তীকালে ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজে উন্নীত হয়। মনু আপার স্বামী জামান ভাই অক্লান্ত শ্রম দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে দেশের শ্রেষ্ঠ কলেজে পরিণত করেছিলেন। অবশ্য এগুলো অনেক পরের কথা। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে আমি এসএসসি পাশ করি। এরপর গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসে ভর্তি হই নটরডেম কলেজে। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে নটরডেম কলেজ হতে এসএসসি পাশ করে সিলেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই এবং ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে এমবিবিএস পাশ করি।
১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট আমার দাদা সৈয়দ আবুল হোসেন কালকিনি উপজেলার ডাসার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দাদা এখন বিখ্যাত ব্যক্তি। শুধু মন্ত্রী নন; একাধারে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, লেখক, সুবক্তা, দানবীর পার্লামেন্টারিয়ান এবং শিক্ষানুরাগী হিসেবে সারাদেশে সুপরিচিত। একদিনে তিনি এ অবস্থানে উন্নীত হননি। তিলে তিলে কঠোর সাধনার মাধ্যমে নিজেকে বড় করে তুলেছেন। আমার ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অধ্যবসায়ী ছিলেন দাদা, মেধাবী ছিলেন মনু আপা। দাদার অধ্যয়ন পদ্ধতি সাধারণ শিক্ষার্থীর ন্যায় গতানুগতিক ছিল না। সাধারণ ছাত্ররা ভালো পাশ করার জন্য পড়তেন কিন্তু দাদা পড়তেন জ্ঞান অর্জনের জন্য। নোট করে পরীক্ষা পাশের চিন্তা তাঁর মাথায় কোনোদিন ছিল না। তিনি পুরো বই আগাগোড়া এমন ভালোভাবে পড়তেন যে, যেখান থেকে প্রশ্ন আসুক উত্তর দিতে পারতেন। জীবনী গ্রন্থ ছিল তাঁর প্রিয়। তাছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত লেখকদের বই পড়ার প্রবল আগ্রহ ছিল। শত শত উদ্ধৃতি দাদার মুখস্থ ছিল। ইংরেজিতে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। স্কুল জীবন হতে তিনি অনর্গল ইংরেজি বলা রপ্ত করেছিলেন।
আমার মামার বাড়ি বরিশাল জেলার গৈলার সেরেল গ্রামে। মামারা দুই ভাই, বড় জন আরজ আলী মল্লিক, তার ছোট রাজ্জাক মল্লিক। উভয়ে ছিলেন অনেক বড় মনের মানুষ। দাদা ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে মেধারকুল হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখানে দুই বছর পড়েন। তারপর গৈলা হাই স্কুল। দাদা মামা বাড়ি থেকে গৈলা হাইস্কুলে পড়তেন। মামা বাড়ির সবাই তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। গৈলা স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাশ করেন। দাদা ছিলেন যেমন পড়–য়া তেমন সময়নিষ্ঠ ও অধ্যবসায়ী। মেধাকে তিনি শ্রমের সন্তান মনে করতেন। বড় মামা আরজ আলী মল্লিকের ছেলে মান্নান ভাই ছিলেন দুষ্টের শিরোমণি। লেখাপড়ায় মোটেও মনোযোগী ছিলেন না। দাদা মামাবাড়ি থেকে লেখাপড়া করবেন জানতে পেরে মামা-মামি খুব খুশি হন। দাদা ছিলেন ভালো ছাত্র। তাঁর দেখাদেখি মান্নান ভাইও ভালোভাবে পড়তে শুরু করবেন- এটি ছিল তাদের আনন্দের বিষয়।
মামাবাড়িতে সারাক্ষণ লোকজন আর শোরগোল লেগে থাকত। ছুটির দিন দাদা আমাদের বাড়িতে যখন ইচ্ছা তখন পড়তে পারতেন। কেউ ডিস্টার্ব করত না। মামা বাড়িতে দিনের বেলা পড়া যেত না, কারণ সারাদিন লোক গমগম করত। শোরগোলের জন্য লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারতেন না। এক বন্ধের দিন দাদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। মামা-মামি অস্থির হয়ে পড়েন; আবুল হোসেন কোথায়! দুপুর গড়িয়ে গেল; তবু দেখা নেই। অনেক্ষণ খুঁজাখুঁজির পর মামাবাড়ির পাশের শন ক্ষেতে দাদাকে পাওয়া গেল। শন ক্ষেতের মাঝখানে এক টুকরো জমি পরিষ্কার করে পাটি বিছিয়ে দাদা একাগ্র মনে পড়ছেন। ছুটির দিন বৃষ্টি না-হলে দাদা অধ্যয়ন করার জন্য পাটি নিয়ে শন খেতে চলে যেতেন। প্রকৃতির একান্ত নিভৃতে এভাবে সাধনায় সাধনায় বড় হয়ে উঠেছেন আমাদের মেজো ভাই সৈয়দ আবুল হোসেন।
তখন আমি ডি কে আইডিয়্যাল একাডেমির নবম শ্রেণির ছাত্র। ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত মনোয়ারা আপাকে দেখার জন্য ঢাকা আসি। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাধিক মেধাবী। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে এসএসসি পাশ করেছিলেন। তাকে আমি মনু আপা ডাকতাম। মনু আপার রুমমেট ছিলেন খাজা নার্গিস, ডাক নাম কুন্তি। তাকে ডাকতাম কুন্তি আপা। তিনি এনায়েতপুরের পির সাহেব খাজা ইউনুছ (র:)-এর ছেলে বর্তমান গদিনশিন সেজো হুজুর হযরত কামাল উদ্দিন সাহেবের সেজো কন্যা। মনু আপার ছোট ভাই এসেছে শুনে কুন্তি আপা খুব আগ্রহ প্রকাশ করলেন। দৌড়ে এসে আমাকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর সাথে ঐ দিন প্রথম দেখা হলেও মনু আপাকে যে চিঠি দিতাম তাতে কুন্তি আপার প্রতিও আমার শ্রদ্ধা আর অনেক কথা লেখা থাকত। সর্বোপরি, রুমমেট ও প্রিয় বান্ধবীর ছোট ভাই হিসেবে আমার প্রতি তাঁর আগ্রহ এবং স্নেহ ছিল অপরিসীম। এরপর কুন্তি আপার সাথে আমার সম্পর্ক বন্ধু ও ভাই-বোনের সংমিশ্রণে এক অনুপম হৃদ্যতায় অভিষিক্ত হয়। ডাসার হতে মনু আপাকে চিঠি লিখলে কুন্তি আপাও বাদ যেতেন না। দুই বান্ধবীর একমাত্র ছোট ভাই হিসেবে আমি সৈয়দ আবুল হাসান উভয়ের বন্ধুরূপে হরিহর আত্মায় মিশে যাই।
মনু আপার মাধ্যমে দাদার সাথে কুন্তি আপার বিয়ের প্রস্তাব। পাত্রপক্ষ আমাদের বংশ পরিচয় ও দাদা সম্পর্ক জ্ঞাত হয়ে প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে দাদা সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে কুন্তি আপার শুভ বিবাহ আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারে সুসম্পন্ন হয়। বিয়ের দিনের একটি কথা আমার এখনও মনে পড়ে। ঐ দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বিয়ের আগে দাদা হজ করে এসেছিলেন। ছোট বেলা হতে তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন। হজ আদায় করে আসার পর নামাজ-রোজা ও ধর্মকর্মের প্রতি আন্তরিকতা আরও বেড়ে যায়। বরবাহী গাড়ি কমিউনিটি সেন্টারে ঢোকার পথে একদল ছেলেমেয়ে বরণ ডালা নিয়ে হাজির। বরণ করবেন তবে কিছু প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতা আছে। মাগরিবের ওয়াক্ত আসন্ন। দুলাভাই গেইট পাশ নিয়ে বরণকারী ছেলেমেয়েদের সাথে আলোচনা করছেন। মাগরিবের সময় বয়ে যাচ্ছে দেখে দাদা গাড়িতে বসে নামাজটা সেরে নেন। তিনি বলতেন, ‘আগে নামাজ তারপর অন্য কিছু।’
বিয়ের পর কুন্তি আপা নার্গিস ভাবীতে পরিণত হন। বন্ধুত্ব আর ভাইয়ের সম্পর্কের সাথে যুক্ত হয় মায়ের সম্পর্ক। এ ত্রয়ী সম্পর্কের মিলন এক মধুর আবহ সৃষ্টি করে। আমি বাড়ির সবার ছোট। সব আদর আমার উপর উপচে পড়ে। ভাবী আমাকে এমন আদর করতেন যেন আমি তার সন্তান। নিজ হাতে খাইয়ে দিতেন, চুল আঁচড়ে দিতেন। ইন্টারমেডিয়েট পাশ করার পরও ভাবী আমাকে নিজ হাতে খাইয়েছেন। কোনো প্রয়োজন আমার অনুভূত হবার পূর্বে ভাবীর কাছে অনুভূত হয়েছে। ভাবীর মাতৃআদর আর দাদার পিতৃহৃদ্যতায় প্রতিটি অভাব মুছিয়ে দিয়েছেন পরম যতেœ। এগুলো মনে পড়লে এখনও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মনপ্রাণ আনত হয়ে ওঠে।
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে দাদা সাকো ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন অফিস। অনেক কষ্টে কর্মচারীদের বেতন দিতে হতো। এরূপ অনেক প্রতিষ্ঠান ছিল, যাদের মালিক মাসের পর মাস কর্মচারীদের বেতন দিতেন না। দাদা কিন্তু কখনও এমন করেননি। নিজের যতই কষ্ট হোক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখের হাসিতে প্রশান্তি খুঁজে পেতেন। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা পাবার ক্ষেত্রে ভাবী দাদাকে আন্তরিকভাবে সাহায্য করেছেন। দাদার যে কোনো বিপদে আপদে ভাবী বন্ধু হয়ে পাশে এসে দাঁড়াতেন। অনুপম মমতায় উৎসাহ দিতেন দাদাকে।
দাদা আর ভাবীর পারস্পরিক বিশ্বাস ও হৃদ্যতা ছিল পাহাড়ের চেয়ে অটল, সমুদ্রের চেয়ে বিশাল। ব্যবসায়ী দাদা আর মন্ত্রী দাদা দুটোই ভীষণ ব্যস্ত পেশা। সারাদিন মেজো ভাইকে অফিস আর রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবু তিনি সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার এবং রাতের আহার ভাবী-বাচ্চাদের নিয়ে একসাথে খান। অনিবার্য না-হলে এর ব্যতিক্রম ঘটতে আমরা দেখিনি। ভাবীর বিশ্বাস আর মেজো ভাইয়ের বিশ্বস্ততা তাদের দাম্পত্য জীবনকে করে তুলেছিল নিখাদ শান্তির অমিয় ভুবনে।
আমি তখন ইন্টারমেডিয়েট ক্লাশে। বাসা ছিল এলিফ্যান্ট রোড। মেজো ভাই, মনু আপা আর আমি এক সাথে থাকতাম। বড় দুলা ভাই টুন্নু মিয়াও আমাদের সাথে থাকতেন। দুলা ভাই বয়সে বড় হলেও অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ছিলেন। তিনি আমাদের স্নেহ করতেন। আমরা তাকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম এবং তিনি আমাদের ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। একদিন বারান্দায় সিমেন্টের বেঞ্চে বসে গল্প করছিলাম। দাদা তখনও আসেননি। বেঞ্চে মনু আপা আর দুলাভাই পাশপাশি বসে। আমি বেঞ্চের কোণায় বাম পা তুলে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলাম। দরজা খোলা ছিল। হঠাৎ দাদা ঘরে ঢুকলেন। আমি কিছু ভাবার আগে আমাকে প্রচণ্ড জোরে এক চড় মারেন। সারা শরীর ব্যথায় ঝিমঝিম করে ওঠে। রাগতস্বরে বললেন, ‘এভাবে বড়দের সাথে বেয়াদবি করতে নেই। দুলাভাই আর মনু দু’জনে বয়সে তোমার বড়। কোন আক্কেলে এভাবে পা তুলে রাখলে!’ দাদাকে ইতোপূর্বে এ রকম রাগতে দেখিনি। তিনি সব সহ্য করতে পারেন কিন্তু বেয়াদবি সহ্য করতে পারেন না। ঐ শাসন আমার জীবনের পাথেয় হয়ে আছে। আর কোনোদিন অমন ভুল করিনি। এখনও ঐ শাসনের কথা মনে পড়লে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়। তিনি আমাকে বিনয়ী হতে শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন মানুষকে মর্যাদা দিতে, বড়দের শ্রদ্ধা করতে এবং ছোটদের স্নেহ করতে।
আর একদিনের ঘটনা মনে পড়ে। নটরডেম কলেজ হতে বাসে সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে নামতাম। তারপর হেঁটে বাসায়। সেদিন গাড়ি হতে নামার পর মনে পড়ল আমার প্র্যাকটিক্যাল শিট নেই। পরদিন জমা দিতে হবে। এখন উপায়! আমার এক বন্ধু, নাম তৌফিক এলাহি, বর্তমানে এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার; তার বাসায় প্র্যাকটিক্যাল শিট আনতে যাই। সাধারণত মাগরিবের পূর্বে আমি বাসায় ফিরতাম। ঐ দিন দেরি হয়ে গেল। দাদা বাসায় এসে আমাকে না-পেয়ে অস্থির হয়ে পড়েন। চারিদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। পুলিশেও খবর দেয়া হল। আমি বাসায় ঢুকে দেখি মনু আপা মনমরা হয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখে খুশি মনে এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘দাদা কিন্তু রেগে আছেন খুব।’ এ কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বর্তমান অবস্থার মতো মোবাইল থাকলে এ সমস্যা হতো না। দাদা সেদিন আমাকে খুব মার দিয়েছিলেন। জীবনে এ দুইবার দাদার মার খেয়েছি। দুটোই আমার জীবনের মাইল ফলক হয়ে আছে। তিনি আমাদের দাদার মতো আদর আর পিতার মতো শাসন দিয়ে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন, যাতে চলার পথে কোনো অসুবিধা না-হয়।
দাদা ছিলেন প্রচারবিমুখ। ডান হাতে দান করলে বাম হাত জানবে না- এ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। নীরবে নিভৃতে কত জনকে কতভাবে সাহায্য করেছেন, দান করেছেন তা লেখাজোখা নেই। আমরাও জানতাম না তিনি কখন এত বিখ্যাত হয়ে গেছেন। একদিন তাঁর বাসায় যাই। বারান্দায় দেখি দাদার একটা বড় ছবি পড়ে আছে। ছবিটা এনে আমার চেম্বারের দেয়ালে লটকিয়ে দেই। চেম্বারে অনেক লোক আসতেন। দাদার ছবির দিকে তাকানোমাত্র চিনে ফেলতেন। খুব সমীহের সাথে বলতেন সৈয়দ আবুল হোসেনের ছবি; এখানে কেন? যত লোক আসতেন সবাই তাকে চিনতেন এবং প্রশ্ন করতেন। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম দাদা কিভাবে কখন এত বিখ্যাত হয়ে গেলেন! আমার মেজো ভাই পরিচয় পেলে সবাই ঈর্ষার চোখে তাকাতেন। আবার অনেকে বিশ্বাসই করতে চাইতেন না যে, আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো খ্যাতিমান একজন মহান ব্যক্তির ছোট ভাই। তাদের কাছে জানতে পারি আমার দাদার উদারতার ইতিহাস। সবাই আমার দাদা দ্বারা কোনো-না-কোনোভাবে এমন উপকার পেয়েছেন মর্মে স্বীকার করতেন, যা অন্য কারও দ্বারা প্রদান করা সম্ভব হতো না। অনেক দলের লোক আমার কাছে আসতেন। সবাই তাকে সম্মান করতেন, শ্রদ্ধা করতেন। তখন আমি বুঝতে পারি দল নির্বিশেষে আমার দাদা একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। আমি বিস্ময়ে অভিভূত হতাম। আমাদের অজান্তে তিনি যে কখন এত বড় হয়ে গেছেন জানতাম না। যখন জানলাম তখন দেখলাম তিনি শুধু আমাদের সে মেজো ভাই মাত্র নন; কর্ম, ব্যবহার আর আচরণের মাধ্যমে তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের মনের গভীরে স্থায়ী আসন গেঁড়ে নিয়েছেন।
আমার মায়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি ছিল না। তবে প্রকৃতিগতভাবে তিনি ছিলেন অনেক জ্ঞানী। তাঁর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও রূপকল্প ছিল অনেক শীর্ষে। সাধারণ মানুষ যা কল্পনা করতে পারতেন না, আমার মা তা সহজে বাস্তবে পরিণত করতে পারতেন। সবকিছু ধীর মস্তিষ্কে পরিকল্পনা মাফিক করতেন। তাঁর রূপকল্প কত উঁচু ছিল তা আমরা ছোটবেলায় বুঝতে পারিনি। এখন বুঝতে পারি। আমার বড় ভাই চেয়ারম্যান ছিলেন, আমি ডাক্তার হয়েছি। মেজো ভাই মন্ত্রী, মনু আপা ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে গ্রামের স্কুল হতে এসএসসি পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছেন। কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছেন। আমাদের অবস্থান দেখে মা খুশি হতেন কিন্তু অবাক হতেন না। তিনি বলতেন, “এতে অবাক হবার কিছু নেই। আমি আমার ছেলেদের ওভাবে গড়ে তুলেছি। যোগ্যতা আছে বলেই তারা এমন হয়েছে।” ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে দাদা এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। তার উত্তরণ দেখে মা অসম্ভব খুশি হয়েছেন কিন্তু অবাক হননি। বলেছিলেন, ‘এটা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত কিছু নয়. আমার মেজো ছেলে অনেক বড় হবে। সে যা হয়েছে এর চেয়ে ঢের বড় হবার যোগ্যতা আমার আবুল হোসেনের আছে।’ বড় ভাই এখন আরও বড় হয়েছেন। মা আজ নেই। বড় মনে পড়ে তাঁর কথা। মায়ের কথা সত্য হয়েছে দেখতে পেলে আরও খুশি হতেন।
আমার মা ছিলেন অসাধারণ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। জোর করে তাঁর কিছু বলতে হতো না। কারও চোখের দিকে তাকালে সে যে হোক, আনত হয়ে যেত। মা অনুচ্চস্বরে মায়াভরা কণ্ঠে কথা বলতেন। তাঁর উচ্চকণ্ঠ আমি কোনোদিন শুনিনি। তাঁর কথার মধ্যে এমন একটি অলৌকিক গাম্ভীর্য ছিল যা কার্যকর করা ছাড়া শ্রোতার অন্য কোনো উপায় থাকত না। মা জীবনে কোনোদিন নামাজ কাজা করেননি। বুদ্ধি হবার পর হতে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে আদায় করেছেন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগের ঘটনা। এশার নামাজ আদায়ের পর মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমার কোলে মায়ের মাথা। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। ফজরের নামাজের সময় হলে মা চোখ খুলে নামাজ আদায়ের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। নামাজ আদায় করার পর মা-কে আবার বিছানায় শুইয়ে দেয়া হয়। ভোরের দিকে মায়ের অসুস্থতা বেড়ে যায়। সকাল দশটায় শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার স্যালাইন দিলেন। জোহরের সময় হলে মা সজাগ হয়ে নামাজ পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। স্যালাইন খুলে নেয়া হলো। মা নামাজ আদায় করলেন। এভাবে আছরের নামাজও আদায় করলেন। এর কিছুক্ষণ পর মা অজ্ঞান হয়ে যান। মায়ের জ্ঞান আর ফেরেনি। এভাবে কয়েকদিন অজ্ঞান থাকার পর ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর শুক্রবার ইন্তেকাল করেন।
বাবা লেখাপড়ার জন্য আমাদের শাসন করতেন না। এ বিষয়টা মা দেখতেন। তবে নিয়মানুবর্তিতার জন্য প্রচণ্ড শাসন করতেন বাবা। নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি না-ফিরলে রাগারাগি করতেন। রাতে বন্ধু-বান্ধব বা অন্য কারও বাড়িতে থাকা বাবা মোটেও পছন্দ করতেন না। এমন কোনো বন্ধুর সাথে মিশতে দিতেন না, যারা সাধারণত খারাপ ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিল। আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে মা অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। ঠিক সময়ে খাইয়ে-দাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিতেন। স্কুল হতে ফিরলে খাতাপত্র গুছিয়ে রাখতেন। স্কুলের পড়া ঠিকমতো করেছি কিনা সর্বদা খেয়াল রাখতেন। নারীশিক্ষার প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত আগ্রহী। বলতেন, ‘নারীপুরুষ সবার জন্য বিদ্যা অর্জন ফরজ।’ তবে লেখাপড়ার জন্য আমাদের কাউকে তেমন বকা খেতে হয়নি। আমরা সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে নিজেদের লেখাপড়া যথাসময়ে সেরে নিতাম।
দাদার মতো সৎ মানুষ জগতে খুব বিরল। দাদা কত সৎ ছিলেন, তা একটি ঘটনা দ্বারা উপলব্ধি করা যাবে। তখন ঢাকা হতে গ্রামে যাবার সহজ উপায় ছিল লঞ্চ। ঢাকার লঞ্চ বরিশাল হয়ে মাদারীপুর যেত, অনেক লম্বা পথ। একদিন দাদা লঞ্চে চড়ে ঢাকা হতে বাড়ি ফেরেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অসাবধানতা বশত লঞ্চ ভাড়া দিতে ভুলে যান। বাড়িতে ঢোকার পর এটি মনে পড়ার সাথে সাথে কাপড় চোপড় না-খুলে আবার লঞ্চঘাট চলে যান। যে লঞ্চে এসেছিলেন সেটি ততক্ষণে চলে গেছে। আর একটি লঞ্চে করে দাদা ঢাকা যান। ঢাকায় এসে ঐ লঞ্চটি খুজে নিয়ে প্রাপ্য ভাড়া মিটিয়ে পরের লঞ্চে আবার গ্রামে ফেরেন। ছাত্রজীবনের এ নিষ্ঠা ও সততা পরবর্তীকালে আরও গভীর হয়েছিল। এ রকম ফেরেশতার মতো একজন লোককে ওয়ান ইলেভেনের হোতারা দুর্নীতিবাজ বানাতে চেয়েছিল। থ্যাংকস গড, পারেননি। আল্লাহ তার খাঁটি বান্দাদের এভাবে রক্ষা করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পরের ঘটনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। চারিদিকে অভাব। পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারে হিন্দুদের অবস্থা শোচনীয়। আমাদের গ্রামের হিন্দুদের অবস্থাও এর বাইরে নয়। এক হতদরিদ্র হিন্দু ভদ্রলোক আমাদের বাড়ির পাশে বর্ষার জলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতেন। সন্ধ্যায় বড়শি দিয়ে যেতেন এবং সকালবেলা এসে মাছ তুলতেন। একদিন সকালে মাছ তুলতে এসে হাজি চাচার ভিটির পেঁপে চুরি করতে যান। আওয়াজ পেয়ে লোকজন বেরিয়ে এসে তাকে বেঁধে রাখে। অনেক লোক জড়ো হয়। খবর পেয়ে আমিও যাই, চোর দেখার আগ্রহই ছিল আলাদা। শুনতাম চোর ধরলে মাথার চুল কেটে দেয়া হয়। আমি আরও কয়েকজন বন্ধু মিলে চোরের মাথার চুল কেটে দেই। ঐদিন দাদা ঢাকা হতে বাড়ি এসেছিলেন। আমাকে বাড়ি না পেয়ে জানতে চান আমি কোথায়। খবর পেয়ে বাড়ি যাই। আমার কাছে ঘটনা শুনে দাদা আঁতকে ওঠেন। তাড়াতাড়ি হাজি চাচার উঠোনে এসে চোরের বাঁধন খুলে দিয়ে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসেন। আমাকে দিয়ে চোরের পা ধরিয়ে ক্ষমা চাওয়ান। হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করে চোরকে পেট পুরে খাইয়ে দেন। অতঃপর হাতে টাকা দিয়ে নাপিতের দোকান হতে চুল কাটানোর ব্যবস্থা করেন। এ ছিল আমার দাদাÑ মানবতার আলো, দয়ার সাগর, বিনয়ের অবতার।
আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টের স্মৃতি ওয়ান ইলিভেন। আর্মিরা দাদাকে গ্রেফতার করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তাকে আটক করে নির্যাতন ও ব্ল্যাকমেইলিং করা। আমি জানি আমার দাদা কত সৎ, কত দেশপ্রেম তাঁর মনে, কত দরদি জনগণের জন্য; কত বড় দাতা। তিনি অর্জিত সম্পদের ৭০ ভাগ দেশ, জাতি ও জনকল্যাণে ব্যয় করেন। মানুষ যেমন বাতাস ছাড়া বাঁচতে পারেন না তেমনি আমার দাদাও দান ছাড়া বাঁচতে পারেন না। জীবনে এক পয়সা অবৈধভাবে উপার্জন করেননি। তারপরও তাঁকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। কষ্ট আর অপমানে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। দাদা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, এখান থেকে ওখানে। সামরিক শাসনের আদলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য এখান থেকে ওখানে ছুটে বেড়িয়েছেন। দিনের পর দিন এক কক্ষে কাটিয়েছেন। শঙ্কা ও ভয়ে ক্ষুধা তৃষ্ণার কথাও ভুলে গিয়েছিলেন। বাতাসে পর্দা নড়ার শব্দে শিউরে উঠেছেন। চুল ও দাড়িমোচ কাটার জন্য সেলুনে পর্যন্ত যেতে পারেননি। আমার দাদার মতো মহান একজন মহৎ ব্যক্তিকে প্রতিনিয়ত আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়েছে। ভাইয়ের সাথে দেখা করতে পর্যন্ত যেতে পারতাম না। যদি কেউ দেখে ফেলে। দীর্ঘ দেড় বছরের অধিক তাঁকে দেখিনি। সারা রাত ঘুমোতে পারতাম না, বসে বসে কাঁদতাম। যদি ভাই ধরা পড়েন, তাহলে কষ্টে মারা যাবেন। জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করে বানোয়াট বিবৃতিতে স্বাক্ষর নেবে। শুধু দাদা কেন, আমার নানা (বড় ভাই আবুল কাশেম), ভাগ্নে এবং অন্যান্য অনেক আত্মীয়স্বজন ওয়ান ইলিভেনের সময় নরক যন্ত্রণার মতো কষ্টে দিনাতিপাত করেছে। অনেককে দাদার সন্ধান দেয়ার জন্য ধরে নিয়ে গেছে। আমার জীবনে এটি বড় দুঃসহ ঘটনা। কোনোদিন ভুলব না।
দাদা যখন ব্যবসায়ী ছিলেন তখন তার বাসায় ঘন ঘন যেতাম। এখন তিনি যোগাযোগ মন্ত্রী, আগের মতো ঘন ঘন আর যাই না। এর কারণ মনোগত নয় সম্পূর্ণ কৌশলগত। তিনি আগে আমাদের প্রতি যেরূপ আন্তরিক ছিলেন এখনও সেরূপ আন্তরিক তবে ব্যস্ততার জন্য সময় দিতে পারেন না। এটি সম্ভবও নয়। কুন্তি ভাবী সাকো ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান, তিনিও সময় দিতে পারেন না। আমরাও প্রত্যেকে নিজের পেশা ও পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তারপরও সময় পেলে ছুটে যাই। অধিকন্তু তদ্বির এড়ানোর লক্ষ্যে দাদার কাছে কম যাওয়াকে আমি কৌশল হিসেবে নিয়েছি। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব তদ্বির নিয়ে আসেন। বলেন, ‘তোমার ভাই এত বড় প্রভাবশালী মন্ত্রী, আমাদের এ কাজটা করে দাও।’ বদলি, ব্যবসায়, টেন্ডার কত রকম তদ্বির। আমি সবিনয়ে এড়িয়ে যাই। আমি চাই না আমার জন্য আমর ভাইয়ের আকাশচুম্বী সততায় সামান্যটুকু চিড় লাগুক। আমরা মন্ত্রী ভাইকে ব্যবহার করে সামান্য সুবিধাও পেতে চাই না। কারণ সৈয়দ আবুল হোসেন আমাদের মন্ত্রী নন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী। আমার কাছে তিনি মন্ত্রী নন, মেজো ভাই মাত্র। আমি গ্রামের সে দাদা হিসেবে তাঁর কাছ হতে স্নেহ প্রত্যাশা করি, মন্ত্রী হিসেবে চাইবে দেশ এবং জনগণ। তাই দাদার কাছে কোনো তদ্বির করি না। এজন্য অনেকে আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের আপন ভাই কিনা সন্দেহ পোষণ করেন। ভাই হিসেবে ব্যবসায়ী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের মনোগত হৃদ্যতা সেই ছোটবেলার মতোই অনুপম রয়ে গেছে। এখনও আগের মতো স্নেহরাশি, নিপাট হাসি, অনবদ্য পিতৃ-শাসন কোনোটির কমতি নেই; কোনোটির ব্যত্যয় নেই।
লোকজন মনে করেন সৈয়দ আবুল হোসেন অনেক টাকার মালিক। তাঁর মতো অত বড় ধনী লোক নাকি বাংলাদেশে খুব একটা বেশি নেইÑ এ রকমও অনেকে বলে থাকেন। মেজো ভাই তাঁর আয়ের ৭০ ভাগ দান করেন। পকেটে ১০০ টাকা থাকলে ৭০ টাকা বিলিয়ে দেন। এ জন্য লোকে মনে করেন, তিনি অনেক পয়সার মালিক, বিশাল ধনী। দানে দাদা এত উদার যে, দান করতে গেলে নিজের কথা চিন্তা করেন না। দান করার জন্য উদগ্রীব থাকেন সবসময়।
ইলিশ ছিল দাদার প্রিয় মাছ । বাড়ি যাবার পথে ফেরিঘাটে ইলিশ ভাজা দিয়ে খেতেন। তিনি ছিলেন যেমন ধর্মপ্রাণ, তেমনি সংস্কৃতিমনা। পুরোনো দিনের প্রায় সবগুলো গান তার ক্যাসেটে বন্দি ছিল। রবীন্দ্র সংগীত তাঁর খুব প্রিয়। নজরুল গীতিও শুনতেন। এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় থাকার সময় মেজো ভাই আর মনু আপা অবসর সময়ে অনেক্ষণ গান শুনতেন। ছাত্রাবস্থায় দাদা সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। তবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁর প্রিয় নেতা এবং আদর্শ। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিজেকে বিলিয়ে দেয়াই তাঁর অঙ্গীকার।
তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির প্রতি রয়েছে তাঁর বিশেষ সম্মান ও মর্যাদাবোধ। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের বাড়িতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আসতেন। তাদের অনেকে ছিলেন দাদার বন্ধু। যেভাবে হোক তাদের সাহায্য করতাম। দাদার নির্দেশ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাঙ্গীন সাহায্য করা। আমরা সবাই দাদার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। এখনও দাদা মুক্তিযোদ্ধাদের উদার হস্তে দান করেন।
আমার দাদা সৈয়দ আবুল হোসেন আমার আদর্শ। বর্তমানে তিনি যেরূপ মহান, ছোটবেলায় তার চেয়েও মহান ছিলেন। তার মহত্ব একদিনের নয়। এটি তাঁর রক্তের অংশ এবং জীবনের মতোই অবিচ্ছেদ্য। মা-বাবাকে তিনি প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন। পিতামাতার প্রতি তাঁর ব্যবহার ছিল অবিশ্বাস্য পবিত্রতার আলো। মা-বাবার প্রতি তাঁর ব্যবহার আমাদের গ্রামের অনেক ছেলের ব্যবহারই পাল্টে দিয়েছিল। প্রতিবেশিরা বলতেন, আবুল হোসেনের মতো ছেলের মা-বাবা হতে পারা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি বলি, তার মতো ভাই পাওয়াও সৌভাগ্যের ব্যাপার। তিনি আমার আদর্শ, আমার গর্ব। যুগ যুগ ধরে এমন মানুষ আসুক মানুষের কল্যাণের জন্য।
ড. সৈয়দ এ হাসান : বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ, সৈয়দ আবুল হোসেনের ছোট ভাই।

সার্বজনীন রাজনীতিবিদ
ড. একেএম আখতারুল কবীর
আমার বাড়ি যশোর। সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় নেই, অমন সৌভাগ্যও আমার হয়নি। কিন্তু সারাদেশের মানুষের মতো আমিও তাঁকে চিনি। অধিকন্তু, সৈয়দ আবুল হোসেনের ন্যায় আমিও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্য সৈয়দ আবুল হোসেনের ত্যাগ ও আন্তরিকতার কথা সর্বজনবাদী স্বীকৃত। আওয়ামী লীগের প্রতি তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আন্তরিকতার কথা আমিও জানি, এবং সেজন্য তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের কথা, আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতা হতে সদ্য বেরিয়ে এসেছে। এ সময় আওয়ামী লীগ অফিসে ৬০ লক্ষ টাকা দেনা। ক্ষমতায় থাকার সময় যারা পার্টির উপকার নিয়েছেন, তারা অনেকে দূরে। বসন্তের কোকিলদের বসন্তকাল ছাড়া সহজে পাওয়া যায় না। পার্টি ক্ষমতায় নেই, তাই কেউ আসেন না। এ অবস্থায় এগিয়ে আসেন সৈয়দ আবুল হোসেন। পার্টি অফিসের দেনা মেটানোর জন্য নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হতে ২০ লক্ষ টাকা তাৎক্ষণিক দান করে সবাইকে হতবাক করে দেন।
চার বছর যাবৎ কালকিনির জনগণ তাঁকে সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণে রাজি করানোর চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। তাঁর যুক্তি ছিলÑ সংসদ সদস্য না-হয়েও জনকল্যাণ করা যায়, রাজনীতি না-করেও এলাকার উন্নয়নে সচেষ্ট থাকা যায়। রাজনীতি করলে ব্যক্তি বহুলাংশে দলের হয়ে যায় এবং তিনি সার্বজনীন থাকতে চাইছিলেন। অন্যদিকে, এইচ এম এরশাদের পতনের পর কালকিনির হাজার হাজার জনতা তাঁকে সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য আকুল আবেদনের সাথে সাথে প্রচণ্ড চাপ দিতে শুরু করে, তবু তিনি নিজ সিদ্ধান্তে অনড় ও অটল থাকেন। অবশেষে, একদিন কালকিনির আপামর জনতা শুরু করে অনশন। তারপরও তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি হননি। এরপরের ঘটনা তৎকালীন কালকিনি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল আজিজ হাওলাদারের জবানিতে শোনা যাকÑ
পরদিন তাঁর অফিস লোকারণ্য। সকলের একই কথা: নির্বাচন করতে হবে। উনি বললেন, ‘আমাকে মাফ করবেন।’ আমি তাঁর নিকটতম এবং নির্ভরযোগ্য দু’একজনকে ডেকে বললাম, ‘আজ মনোনয়নপত্র ক্রয়ের শেষ তারিখ। আমি চললাম, আগে ওনার নামে মনোনয়নপত্র কিনে নিই। তারপর দেখা যাবে।’ রিক্সা ভাড়া করে ছুটলাম। অনেক লোকের ভিড় ঠেলে সৈয়দ আবুল হোসেনের নামে মনোনয়নপত্র ক্রয় করে তাঁর অফিস কক্ষে ফিরে আসলাম। অফিসে তখন জনতার ভিড় ছিল না। উনিও অফিসে ছিলেন না। আমি ওনার নিজকক্ষে প্রবেশ করে মনোনয়নপত্রখানা একটা বড় আকারের খামে পুরে দিলাম। সে সঙ্গে পুরে দিলাম আমার হাতে লেখা একখানা ক্ষুদ্র চিঠি। তারপর আমি চলে গেলাম আমার নিজস্ব অন্য কাজে। অপরাহ্ণে আবার ফিরে এলাম। সৈয়দ আবুল হোসেনকে তাঁর কক্ষে পাওয়া গেল। তিনি আমাকে বললেন: ‘স্যার, আপনি কেন এ পাগলামি করলেন? বিশ্বাস করুন স্যার, আমি প্রস্তুত নই। ওদিকে কিছুতে আমার মন টানে না। রাজনীতি করলে আমি দলে সীমাবদ্ধ হয়ে যাব।’
এত কিছুর পরও তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হননি। ইতোমধ্যে জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার ঘোষণা দেন, ফলে সৈয়দ আবুল হোসেন নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হন। যে দেশে বড় দলের রাজনীতিক টিকেট পাবার জন্য মানুষ পাগলের মতো হয়ে যান, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে দ্বিধা করেন না, সেখানে যদি কোনো ব্যক্তি তা অবলীলায় অবহেলা করার মতো মানসিকতার অধিকারী হন, তাহলে তিনি কত মহানুভব, কত উদার, কত ত্যাগী এবং কত নির্লোভ তা সহজে অনুমেয়।
শুধু বাংলাদেশে কেন, পৃথিবীর অনেক দেশে নির্বাচনে জেতার জন্য অনেকে ন্যায়-অন্যায়ের তোয়াক্কা না-করে এহেন কোনো কাজ নেই যা করেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও নির্বাচনে জেতার লক্ষ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেআইনিভাবে ঘায়েল করার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কথা উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশ এবং অনুরূপ তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে এ অবস্থা আরও ভয়াবহ, যেনতেন উপায়ে নির্বাচনে জিততে হবে- এটাই হয়ে দাঁড়ায় সবার একমাত্র লক্ষ্য। জিয়া-এরশাদের হ্যাঁ-না ভোটসহ তাদের শাসনামলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন ও ১৯৯৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারচুপি ও অপকৌশলের কথা ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে আছে। বিশেষ করে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগণ জীবন বাজি রেখে অনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়তেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। পাকিস্তানি শাসনামল হতে শুরু হয়েছে সামরিক আইন, মৌলিক গণতন্ত্র, সংবিধান সংশোধন, হত্যা, গুম, মামলা, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ, কোন্দল ইত্যাদির মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণের পথ সুগম করার অপকৌশল।
বঙ্গবন্ধু পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অবস্থার কথা সবার জানা। গণতন্ত্রের নামে মোশতাক, জিয়া এবং এরশাদ স্বৈরশাসনের নাম দিয়ে মানুষের ভোটাধিকার কী ঘৃণ্য ও নৃশংসভাবে ডাকাতি করে নিয়েছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে আযুগ কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। শুধু তাই নয়, জাতীয় হোক কিংবা স্থানীয় হোক বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামগঞ্জের ছোটখাটো ক্লাবের নির্বাচনেও খুনোখুনি হতে দেখা যায়। আইনজীবী, নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গবেষক হিসেবে আমি এগুলোর স্বরূপ ও বিস্তার নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। আমার ভাবতে অবাক লাগে, যে ব্যক্তি অবৈধ উপায়ে, ভোট চুরি করে নির্বাচনে জেতেন তিনি বা তারা কীভাবে দেশের কল্যাণ করবেন? অসততার বীজ হতে যে গাছ অঙ্কুরিত হয় তার পাতা, ডালপালা, শেকড় ও ছায়া কখনও শান্তির ও সততার হতে পারে না।
এ সবের মধ্যে আমি যে কয়টি ব্যতিক্রম দেখেছি তন্মধ্যে সৈয়দ আবুল হোসেন সর্বশ্রেষ্ঠ। ১৯৯১- ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আমি লিগ্যাল এইড এসোসিয়েশন, মাদারীপুরে ট্রেনিং এন্ড রিসার্চ এর কাজ করেছি। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে ঐ সংস্থার পক্ষে কালকিনির নির্বাচন পরিদর্শক ছিলাম। সে সময় আমি সৈয়দ আবুল হোসেনকে নির্বাচন বিধিসমূহের ব্যতয় না-ঘটিয়ে এবং সমর্থকদেরকেও অনুরূপ নির্দেশনা প্রদান করে নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনায় আন্তরিক থাকতে দেখেছি। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনটি ছিল বিভিন্ন কারণে অত্যন্ত জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ। আমি সৈয়দ আবুল হোসেনকে নির্বাচন প্রচারণায় অংশ নিতে দেখিনি। এলাকার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর হয়ে নির্বাচন প্রচারণা চালিয়ে গেছেন। এটি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাসে একমাত্র ব্যতিক্রমী ঘটনা বলে আমি মনে করি। কালকিনির নির্বাচন বিষয়ে আমি একটা গবেষণাপত্রও প্রস্তুত করেছিলাম। মাদারীপুর লিগ্যাল এইড আমার গবেষণার ভিত্তিতে একটি বই প্রকাশ করে। এ গ্রন্থে কালকিনির ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের সার্বিক আচরণের প্রশংসা প্রতিফলিত হয়েছে।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে তিনি শুধু একবার নির্বাচনী এলাকায় গিয়েছিলেন। তাও জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার জন্য। ঐ সভায় আমি নিজে উপস্থিত থেকে তাঁর বক্তৃতা শুনেছি। অনেকে অবাক হয়ে যান কীভাবে একবার মাত্র নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে রাজনীতিতে সদ্যাগত একজন যুবকের পক্ষে এ রকম বিজয় অর্জন করা সম্ভব হলো? আমি কিন্তু অবাক হইনি, কারণ নির্বাচন ও নির্বাচনোত্তর অবস্থা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করেছি। জাতীয় রাজনীতিতে আসার অনেক পূর্ব হতে তিনি এলাকার জনগণের সাথে, তাদের দুঃখ-বেদনা ও প্রয়োজনের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না-করার দৃঢ় প্রত্যয়ে অটল থেকেও শেষ পর্যন্ত জনগণের অনুরোধে অটলতা ভাঙতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমার মনে হয়, সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনের একটাই পরাজয়, সেটি হচ্ছেÑ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না-করার প্রবল ইচ্ছা জনগণের অনুরোধের কাছে ভেসে গিয়েছিল।
নতুন এমপি হলে অনেকে দম্ভ দেখায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, এলাকায় অন্তত কোন্দল সৃষ্টি ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে রাজনীতিক ফায়দা নিতে চায়Ñ কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন এ সব হতে যোজন মাইল দূরের একজন মানুষ। এমপি হবার পর তাঁর আচার-ব্যবহার ও সৌজন্যবোধ এবং সাধারণ মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মনোভাব পূর্বের তুলনায় আরও বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। ফলে তিনি অল্পসময়ের মধ্যে জনগণের হৃদয়ের গভীরে স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। যার প্রমাণ পরবর্তী নির্বাচনসমূহ। এরপরও আরও তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রতিটি নির্বাচনে সৈয়দ আবুল হোসেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিপুল ভোটে হারিয়ে বিজয় অর্জন করেন। তিনি চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রত্যেকটিতে বিজয়ী হন, তবে কোনো নির্বাচনে প্রচলিত বিধির লঙ্ঘন করার কোনো নজির নেই। নির্বাচনে এমন কোনো কাজ করেননি। যাতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তাঁর বিরুদ্ধে সামান্যতম অভিযোগ করতে পারেন।
প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে তিনি এমন উদারতায় নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন, যার উদাহরণ দেশে বিরল। জনগণের স্বাধীন ইচ্ছা যাতে সাবললীভাবে প্রবাহিত হতে পারে, সে জন্য তিনি নির্বাচন প্রচারণায়ও বেশি সময় দিতেন না। তিনি বলতেনÑ জনগণ যাকে ভালো মনে করেন, তাকেই ভোট দেবেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা তৎকালীন সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুগ্মসচিব মো. মোস্তফার জবানিতে শোনা যাক :
সময়টি ছিল ১৯৯৬ সালের মে মাসের মাঝামাঝি, যখন জাতীয় সংসদের নির্বাচন সন্নিকটে এবং টিএনও কালকিনি হিসেবে আমার উপর সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ের একটি ঘটনা। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমাদান এক সময়ে শেষ হলো। বাইরে কর্মী সমর্থকদের তুমুল কোলাহল। এরই মাঝে সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদেরকে এই মর্মে প্রস্তাব দিলেন যেন বাইরের খোলা আঙিনায় একই মঞ্চে তাঁরা প্রত্যেকেই কালকিনির ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার রূপকল্প সবার সামনে তুলে ধরেন। প্রস্তাবটি কেউ গ্রহণ করলেন না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে চকিতে আমার মনে পড়লো, এ তো পাশ্চাত্যের সবচাইতে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রপতি প্রার্থীদের বিতর্ক প্রতিযোগিতার আদলেই প্রস্তাব। বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি যে প্রস্তাবটি এসেছিল একজন ক্ষুরধার, তীক্ষè ও দূরদর্শী রাজনীতিকের পক্ষ হতে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে পদাপর্ণ করেও মনে হয় ঐ প্রস্তাবের চর্চা অন্তত শুরু হলেও বা পরবর্তীকালে ব্যাপকহারে প্রচারিত হলে গণতন্ত্রচর্চার একটি ‘মডেল’ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো।
দেশ স্বাধীন হবার পর অনেকে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণের অথবা প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হবার সকল সুযোগ ও প্রস্তাবকে অবলীলায় তুচ্ছ করে সৈয়দ আবুল হোসেন বেছে নিয়েছেন অধ্যবসায়স্নাত পরিশ্রমী জীবন। তিনি নিজ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত ছিলেন, তাই কোনো প্রশ্নকে তার জীবনের মাঝে রাখতে চাননি। ঘামে ঘামে অর্জন করেছেন প্রতিটি মুদ্রা। এমন মানুষ শ্রদ্ধার বরপুত্র ছাড়া আর কী?
তিনি সকলের সাথে সমভাবে মিশতে পারঙ্গম। অভূতপূর্ব বিমূর্ততায় অভিষিক্ত একজন মানুষ। প্রত্যন্ত কালকিনি হতে যাত্রা শুরু করে দীর্ঘ পরিক্রমার মাধ্যমে স্বীয় চেষ্টায় মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন। এ দীর্ঘ পরিক্রমায় অতি সাধারণ হতে সর্বোচ্চ পর্যন্ত সকলের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা অবিচল। আওয়ামী রাজনীতির একনিষ্ঠ সমর্থক ও লালনকারীদের অন্যতম হয়েও তিনি শুধু রাজনীতিক মতবাদকে এক গ্রন্থমুখীদের ন্যায় আঁকড়ে ধরে রাখতে চাননি। তিনি কখনও নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভেবে আপ্লুত হননি, বরং সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাবার দৃপ্ত শপথে উদ্দীপ্ত থেকে সবাইকে নিয়ে কাজ করার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছেন।
কর্ম তাঁর জীবনের একটি বিশাল স্থান দখল করে আছে। কাজ ছাড়া তিনি জীবনকে অর্থহীন মনে করেন। তাই কাজকে তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। তাঁর দর্শন ব্যাপ্তি পায় কাজে। তিনি মনে করেন, অপঃরড়হ সধু হড়ঃ ধষধিুং নৎরহম যধঢ়ঢ়রহবংং, নঁঃ ঃযবৎব রং হড় যধঢ়ঢ়রহবংং রিঃযড়ঁঃ ধপঃরড়হ.ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যময় মূল্যবোধ ও যুক্তিবাদী রাজনীতির প্রতিষ্ঠাতা, সময়ের সন্তান জনাব আবুল হোসেন বাংলাদেশের ইতিহাসে দীপ্তসৌরভে মণ্ডিত। মাদারীপুর চাকুরিকালীন আমি তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও অনুদানকৃত সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েছি। স্কুল-কলেজ পরিচালনায় তাঁর নিরপেক্ষ নির্দেশনা, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং মানবিক উদারতা লোকেমুখে রূপকথার গল্পের মতো ছড়িয়ে থাকত।
সৈয়দ আবুল হোসেন দলীয় জগতে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবেনÑ এ জন্য রাজনীতিতে আসতে চাননি; সার্বজনীন থাকতে পারবেন না এ জন্য দলের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হতে চাননি। তারপরও জনগণের অনুরোধ অবহেলা করতে না-পেরে, আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হয়েছেন। তিনি এখন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত এমপি এবং মন্ত্রী। তারপও তিনি দলীয় জগতে সীমাবদ্ধ নন। বাতাসের মতো, আলোর মতো ধর্ম-জাতি ও বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি সমভাবে সমর্পিত একজন সার্বজনীন মানুষ, সার্বজনীন রাজনীতিবিদ।
ড. একেএম আখতারুল কবীর: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আইন গবেষক, লেখক ও রাজনীতিবিদ। সাবেক ট্রেনিং এন্ড রিচার্স কো-অর্ডিনেটর, লিগ্যাল এইড এসোশিয়েশন, মাদারীপুর।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু
অধ্যাপক ইবনে হাসান আলম
সংসদের ১৩-তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থায়ন, সময়সীমা ও পরিকল্পনাসহ সার্বিক রূপরেখা সংসদে তুলে ধরেন। তার এ রূপরেখা জাতির মনে একটি অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি কালবিলম্ব না করে দৃঢ়তার সাথে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরুর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের ঘোষণার পর সৃষ্ট অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর সাহসী বক্তব্য পদ্মা সেতুর ব্যাপারে সরকারের অবস্থান ও ভাবনা স্পষ্ট করে। নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণে সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে আস্থার অনিবার্য দৃঢ়তায় আবারও একাত্তরের মত উত্তাল করে তুলেছেন। একেই বলে বাপকা-বেটি।
পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ এনে ২০১১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে তাদের অর্থায়ন স্থগিত করার পর থেকেই সেতু নির্মাণের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুরু হয়। তখন থেকে সরকারের বিভিন্ন মহলে এ বিষয়ে নানারকম আলোচনা-প্রত্যালোচনা চলে আসছে। তখন যদি সরকার বিশ্বব্যাংকের মতলব সম্পর্কে ধারণা করতে পারত তাহলে কতই না ভালো হতো!
সম্প্রতি অর্থঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংকের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দানের পর পদ্মা-সেতু, বিশ্বব্যাংক ও সৈয়দ আবুল হোসেন সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। মিডিয়া, টকশো, চায়ের কাপ, সভা-সমিতি, রাজনীতিক মঞ্চ প্রভৃতি পদ্মাসেতু আর দুর্নীতি নিয়ে নানা কথাবার্তায় ছেয়ে যায়। মূলত যার অনেকটাই বাগাড়ম্বর ও পরস্পর বৈপরীত্যপূর্ণ তথ্যাদিতে ভরপুর। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির কথা বলছে কিন্তু প্রমাণ দেখাতে পারছে না। বিশ্বব্যাংকের কথার সাথে কার্যের, কার্যের সাথে পূর্বাপর আচরণের কোন মিল খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও কথা থেমে নেই। বাঙালিা হুজুগে জাতি- কথা চলতেই থাকে। 
এসব কথাবার্তা পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা দূর করার ভূমিকা তো রাখেইনি বরং সাধারণ নাগরিককে আরও অধিকমাত্রায় বিভ্রান্ত ও উদ্বিগ্ন করেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকে থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে তার সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রত্যয়দীপ্ত অবস্থান থেকে এক ইঞ্চিও সরেননি। বরং দিন দিন তা আরও জোরালো করেছেন। বিভিন্ন সময় সাহসী বক্তব্য ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দিয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ফয়সালায় দীর্ঘসূত্রতার প্রেক্ষাপটে ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের জন্য আর অপেক্ষা নয়, প্রয়োজনে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। দুর্নীতি প্রমাণ করতে না পারলে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের টাকা নেবে না- কাছাকাছি সময়ে এমন ঘোষণাও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সংসদেও পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে দেরি করিয়ে দিয়ে বিশ্বব্যাংক যে ক্ষতি করেছে সেজন্য তিনি বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্য তার প্রবল দেশপ্রেম ও আত্মমর্যাদাবোধেরই প্রকাশ।
মূলত প্রথম থেকে বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্য ছিল ঋণচুক্তি বাতিল করা। তবে দীর্ঘসূত্রতার মাধ্যমে বিলম্ব করার কারণ হচ্ছে সরকার যাতে কম সময় পায় তা নিশ্চিত করা। কিন্তু শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা এটি মনে হয় বিশ্বব্যাংক ভাবেনি। শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংককে অবহেলা করার যে সাহস দেখিয়েছেন তা তাকে তৃতীয় বিশ্বের কণ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থঋণের মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণই আমাদের জন্য যে কোনো বিচারে সাশ্রয়ী হতো এবং সেটাই প্রথম অগ্রাধিকারে ছিল। কিন্তু এটাও সত্য যে, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণচুক্তি বাতিল করার জন্য ঋণচুক্তি করেছিল। যাতে আওয়ামী সরকার অন্য কোন উপায়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে কৃতিত্ব নিয়ে না যায়। অনিশ্চিত অবস্থায় বিকল্প অর্থায়নের ব্যাপারে মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি আগ্রহী দেশের সঙ্গেও আলোচনা চালানো হলেও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ইতিবাচক ফয়সালার একটা আশাবাদ ছিল। শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতুর অর্থঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি প্রকাশের পর সরকার অনেকটা নিশ্চিত হয়েই বিকল্প ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হবার প্রেরণা পায়। এরূপ প্রেরণা পাবার জন্য এমন আঘাত প্রয়োজন ছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের রূপরেখা বর্ণনা করে বলেছেন, চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরেই নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হবে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে। পর্যায়ক্রমে সেতুর নির্মাণকাজ চালিয়ে যাওয়া হবে। পদ্মা সেতুর অর্থায়নের খাত হিসেবে উন্নয়ন বাজেট থেকে টাকা সাশ্রয়, দেশীয় বন্ড থেকেও অর্থ সংগ্রহ, আমদানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সারচার্জ প্রয়োগ এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের যে সুযোগ ও সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা যেমন বাস্তবসম্মত তেমনি আত্মমর্যাদাকর। 
গোলামের মত পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে না হেঁটে বীরের মত সাঁতরে পার হবার গৌরব শেখ হাসিনার বক্তৃতায় সুস্পষ্ট। এর মধ্যে দুর্নীতির কোন গন্ধ থাকলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এত আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বলতে পারতেন না যে, পদ্মা সেতু নির্মাণে কোন দুর্নীতি হয়নি। মূলত মার্কিন স্বার্থ রক্ষা, তৃতীয় বিশ্বের বিশ্বব্যাংকের নীতি, ড. ইউনুসের দেশদ্রোহীমূলক ভূমিকা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং তাদের রক্ষায় কিছু ইসলামি দেশের ভূমিকা বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলকে প্রভাবিত করেছে। আমি মনে করি এতে সাধারণ দৃষ্টিতে সমস্যা মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদি মহাকল্যাণের বীজ নিহিত। বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি আমাদের মুষড়ে দেয়নি, উজ্জীবিত করেছে। বিশ্বব্যাংক ভেবেছিল বাংলাদেশ মুষড়ে পড়বে। তাদের কাছে মান-সম্মান বিকিয়ে ছুটে যাবে ভিক্ষার থলে নিয়ে। শেখ হাসিনা তেমন নেত্রী নন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। 
পদ্মাসেতুর স্বপ্নপূরণে জাতি ত্যাগস্বীকারে ও সহায়তার হাত বাড়াতে প্রস্তুত। আমরা যদি দাতাদের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের শক্তিতে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারি সেটা হবে আমাদের জন্য বড় কৃতিত্ব; আমাদের সক্ষমতা ও আত্মমর্যাদার অনবদ্যস্মারক। এর জন্য যে দৃঢ় অঙ্গীকার ও সদিচ্ছা প্রধানমন্ত্রী ব্যক্ত করেছেন, গোটা সরকারকেই ধারণ করতে হবে। জাতিধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের উচিত পদ্মা সেতুর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর আত্মমর্যাদাশীল সাহসী উক্তির সমর্থনে এগিয়ে আসে। যারা এ বিষয়ে বিরোধিতা করবে তারা আবারও একাত্তরের রাজাকারদের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। পাকিস্তানের মত হিংস্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যদি নিরস্ত্র বাঙালি শুধু সাহস, ঐক্য আর দৃঢ়তা দিয়ে জয় ছিনিয়ে আনতে পারে তাহলে পদ্মা সেতুর মত একটি অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারবে না- এমনটি যে ভাবেন তিনি মূর্খ বই কিছু নন।
অধ্যাপক ইবনে হাসান আলম: আর্থনীতিক বিশ্লেষকক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।

আমার বাল্যবন্ধু
মো. লাল মিয়া
সৈয়দ আবুল হোসেন আর আমি সমবয়সী। আমার বাড়ি আর সৈয়দ আবুল হোসেনের বাড়ির ফারাক মাত্র তিন’শ গজ। পুরো তল্লাটে একটিমাত্র প্রাইমারি স্কুল ছিল। নাম ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমাদের বাড়ি হতে এক কিলোমিটার দূরে। সৈয়দ আবুল হোসেন, পুলিন সরকার, মল্লিক, সৈয়দ মোস্তফা, ডালিম, শাহীন, রসময় এবং আমি সবাই ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একই ক্লাশে পড়তাম। সেই অনেক আগে ১৯৫৬ সালের কথা। আমাদের গ্রামে ভালো রাস্তা ছিল না। বর্ষায় নৌকায় চড়ে স্কুলে যেতাম। এখন যে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলে, সে সময় ঐটা ছিল আইলের মতো ছোট। তবে সৈয়দ আবুল হোসেন ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। প্রথম দুই ক্লাশ পড়েছিল নবগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তবে একই গ্রামের অধিবাসী হবার সুবাদে তার সাথে খেলতাম, ঘুরতাম।
স্কুলে যাবার পথে আমরা অনেক দুষ্টামি করতাম। প্রতিবেশীর গাব গাছে ঢিল, সুযোগ পেলে আম, জাম ইত্যাদি চুরি করে খেতে সংকোচ করতাম না, বরং চুরি করে খেতে পারলে গর্ব হতো। তবে আমাদের বন্ধু সৈয়দ আবুল হোসেন চুরি বা অন্য কোনো রকম দুষ্টামি সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলত। সে কোনোদিন কারও গাবগাছে ঢিল ছোড়েনি, আম পাড়েনি। আমরা ভাবতাম আবুল হোসেন বোকা। সে বলত, ‘চুরি করা পাপ, চুরির জিনিস খেলে কেউ বড় হয় না।’ আবুল হোসেন সত্য বলেছে। আমরা চুরির জিনিস খেতাম বলে বড় হইনি। ইস্, তখন যদি তার কথা শুনতাম তাহলে আমরাও তার মতো বড় হতে পারতাম!
চঞ্চলতা ছিল প্রাইমারি স্কুলের শিশুদের সহজাত অভ্যাস। এমন কোনো দুষ্টামি নেই যা করতাম না। শিশু হলেও সৈয়দ আবুল হোসেন ছিল অন্য রকম। মাথা নিচু করে বইগুলো সযতেœ আঁকড়ে ধরে গুটি গুটি পায়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করত। মুরুব্বিদের দিকে মুখ তুলে তাকাত না এবং কোনো অশালীন উক্তি করত না। তার মধ্যে একটা সম্মোহন ছিল। সে ছিল স্কুলের সবচেয়ে সুন্দর। ছোট বড় সবাই তাকে স্নেহ করত। তার ব্যক্তিত্ব আমাদের মোহিত করত। তার সাথে কথা বলার সময় সাবধানে বলতাম। ব্যক্তিত্বের জন্য কেউ তার সাথে দুষ্টামি করার সাহস করত না। মুরুব্বিরা আমাদেরকে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো হতে উপদেশ দিতেন। আমি তার মতো হতে চাইতাম, কিন্তু পারতাম না।
রমজান মাসের কথা। আমরা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। শুকনো ছোলা কিনে খাচ্ছিলাম, আবুল হোসেনকেও খেতে বললাম। সে নিল না। বলেছিল, আমি রোজা রেখেছি। ছোটবেলা হতে সে রোজা রাখত। মা-বাবার মতো নিয়মিত নামাজ পড়ত। তার মা-বাবা দু’জনে ছিলেন বুজুর্গ। এলাকায় তারা আউলিয়া-পরিবার হিসেবে পরিচিত ছিল। দশ গ্রামের সবাই তাদের পরিবারকে সম্মান করত। সৈয়দ আবুল হোসেন তার মা-বাবাকে খুব সম্মান করত। শিশু বেলার সেই মাতৃভক্তির কথা মনে পড়লে এখন খুব কষ্ট পাই, লজ্জা হয়। তার মতো ভক্তি থাকলে হয়ত আমিও বড় হতে পারতাম। তার মা সুফিয়া খাতুন অত্যন্ত পর্দানশীন মহিলা ছিলেন।
সে সময় এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা খুব খারাপ ছিল, স্কুলটাও ছিল ভাঙাচোরা। এগুলো দেখে সে আক্ষেপ করত। বড় হয়ে সব রাস্তাঘাট পাকা করে দেবার সংকল্প ব্যক্ত করত। বড় বড় স্কুল আর বড় বড় কলেজ বানানোর কথা বলত। আমরা হাসতাম এবং মাঝে মাঝে উপহাস করতাম। তবে সে কিছু বলত না। একদিন সে তার মাকে গিয়ে আমাদের উপহাসের কথা বলে দেয়। তার মা বলেছিলেন, ‘আমি দোয়া করি, তোমার সব ইচ্ছা পূরণ হবে। তারা তখন হাসবে না, বরং অবাক হয়ে তোমাকে দেখবে, আর দেখবে।’ সৈয়দ আবুল হোসেনের মায়ের দোয়া পূরণ হয়েছে।
এলাকায় সৈয়দ আবুল হোসেনের পরিবার ছিল তুলনামূলকভাবে সচ্ছল। খরচার জন্য টাকা দিলে সে নিজে খরচ করত না। গরিবদের দিয়ে দিত। যাদের বই নেই তাদের বই কেনার জন্য সাহায্য করত। বড় হয়ে সে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সকল জমি শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজে দান করে দিয়েছে। আমার ছোট ভাই মফিজ মেম্বার সৈয়দ আবুল হোসেনের টাকা দিয়ে ৭০০-এর মতো অসহায় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। আমিও তার টাকা দিয়ে অনেক গরিব-অসহায়কে সাহায্য করেছি। আমার মনে হয় এ জীবনে কমপক্ষে দুই হাজার গরিব মেয়ের তার টাকায় বিয়ে হয়েছে। আমার ভাই মফিজ মেম্বার প্রায় সময় অসহায় ও গরিব পরিবারের মেয়ের বিয়ের সাহায্য চাইতে ঢাকায় সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে নিয়ে যেত। মফিজকে সে মজা করে হেসে হেসে মেয়ের দালাল ডাকত। আবুল হোসেনের সহায়তা ছাড়া হয়ত তাদের বিয়ে হতো না। তার গ্রামে এবং উপজেলায় এমন কোনো ছাত্রছাত্রী নেই যে, টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারছে না। কোনো ছাত্রছাত্রী টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারছে না শোনার সাথে সাথে সে তার লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেয়।
সে ছিল একজন আদর্শ শিশু। কেউ তার সাথে রাগ করলেও সে রাগ করত না। হাসি দিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করত। বলত, রাগ করা ভালো নয়। কেউ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে সে কষ্ট পেত, কিন্তু অভিশাপ দিত না। প্রতিশোধপরায়ণতা তার মাঝে ছিল না। আজ পর্যন্ত তাকে আমি কারও সাথে ঝগড়া করতে দেখিনি। ছোটবেলার সে অভ্যাস এখন আরও পরিব্যাপ্ত হয়েছে।
স্কুলে আমরা হিন্দু ছেলেদের ভালো চোখে দেখতাম না। হিন্দু ছেলেরাও আমাদের ভালো চোখে দেখত না। তবে সৈয়দ আবুল হোসেনকে হিন্দু ছেলেরাও ভালো জানত, মুসলমান ছেলেরাও ভালো জানত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের অনেক হিন্দু বন্ধু ছিলো তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। আমরা তাদের সাথে ভালোভাবে মিশতাম না। তারাও আমাদের সাথে মিশত না কিন্তু আবুল হোসেনকে তারাও খুব ভালো জানত। হিন্দু ছেলেরা বলত, মুসলমান হলেও আবুল হোসেন ভালো। তার কাছে কোনো সাম্প্রদায়িকতা ছিল না এবং হিন্দু-মুসলমান সবাইকে সমান চোখে দেখত। আল্লাহর সৃষ্টি কারও প্রতি সে খারাপ ব্যবহার করত না। এখনও তার মনে সে ধারণা রয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তাকে দেবতার মতো শ্রদ্ধা করে।
আমরা তাকে আবুল নামে ডাকতাম। এখন আমাদের আবুল অনেক বড়। ১৯৯১ থেকে আমাদের এমপি, আমাদের মন্ত্রী। অনেক বড় ব্যবসায়ী, অনেক বড় রাজনীতিবিদ। অনেক কলেজ করেছে, অনেক স্কুল করেছে। অজপাড়া গ্রাম ডাসার-এর আবুল হোসেন এখন সারা পৃথিবীতে পরিচিত নাম। তার এমন অনেক বন্ধু আছে যারা এখনও কৃষক, মজুর, শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা। তাদের দেখলে সৈয়দ আবুল হোসেন ছোটবেলার মতো সহাস্যে জড়িয়ে ধরে কুশল জিজ্ঞাসা করে। তার মধ্যে কোনো অহঙ্কার ছোটবেলায়ও ছিল না, এখনও নেই। এখনও সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোট শিশুটির মতো নিষ্পাপ।
তৎকালে মনোরঞ্জনের একমাত্র মাধ্যম ছিল যাত্রাগান, পালা, থিয়েটার। সুযোগ পেলে এমন কি লেখাপড়া ফাঁকি দিয়ে হলেও আমরা সেগুলো দেখতাম। সৈয়দ আবুল হোসেন যেত না। তাকে ডাকলে বলত, লেখাপড়া শিখে আগে বড় হয়ে নিই। তারপর অন্য কিছু। সে বড় হয়েছে, আমরা হইনি। যে সহে সে রহে।
স্কুলে ছাত্রদের মধ্যে ঝগড়া হলে আমরা তাকে সালিশি মানতাম। সে ন্যায়ভিত্তিতে সমাধান দিত। এ গুণটা তার এখন আরও বেশি দেখতে পাই। সন্ত্রাসী সে যেই হোক না কেন, নিজের ভাই হলেও ছাড় দিয়ে কথা বলে না। এ জন্য কালকিনি উপজেলায় কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। এ উপজেলা সকল প্রকার টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি হতে মুক্ত। এখানে সব দলের লোক শান্তিতে বসবাস করে। কারও প্রতি তার বিদ্বেষ নেই, তাই তার প্রতিও কারও বিদ্বেষ নেই। বিচারকের আত্মীয় নেই। এ শিক্ষা আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে দেখেছি। এ জন্য সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে।
সে কোনো জিনিস ক্রয়ে ছোটবেলায় দর কষাকষি করত না। মনটা এত বড় ছিল যে, আমরা তার বোকামি দেখে হাসতাম। একদিন আমরা ঝড়ে আম কুঁড়োচ্ছিলাম। সে তিনটা আম পেয়ে বাড়ির দিকে চলে আসছে। এ সময় একটা ছেলে আম পায়নি বলে কাঁদছিল। আবুল হোসেন তা দেখে সবগুলো আম ছেলেটিকে দিয়ে দিয়েছিল। ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে। তখন আবুল হোসেন ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির পরীক্ষা দিয়েছে। এক জেলের কাছ হতে মাছ কিনল। জেলে দাম বলল, দশ টাকা। জেলের কথামতো আবুল হোসেন জেলের হাতে দশ টাকা দিয়ে বলল, আপনার আর কোনো পাওনা আছে? জেলে অবাক হয়ে আবুল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তুমি একদিন অনেক বড় হবে।’ জেলের আশীর্বাদ ফলেছে।
হাডুডু ছিল সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রিয় খেলা। আমরা মার্বেল, গোল্লাছুট, দাড়িবান্দা ইত্যাদিও খেলতাম। আবুল হোসেনও আমাদের সাথে খেলত। তবে পড়ার সময় হলে খেলা বন্ধ করে দিয়ে বাড়ি চলে যেত কিন্তু আমরা খেলতে থাকতাম। তাকে আরও খেলার জন্য বললে সে বলত, ‘পড়ার সময় হয়ে গেছে, আর খেলব না।’ সামুদ্রিক মাছের মধ্যে তার প্রিয় ছিল ইলিশ। দেশীয় মাছের মধ্যে শোল, কৈ, মাগুর, শিং পছন্দ করত। ডিম ভাজাও পছন্দ করত। সে বাইরের কিছু তেমন একটা খেতো না। আমরা যা পেতাম তা খেতাম।
ঢাকায় পড়তে যাবার পূর্ব পর্যন্ত তার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। গৌরনদীতে পড়ার সময় গ্রামে বেড়াতে এলে আমার সাথে দেখা হতো, কথা হতো। কোনোদিন তাকে আমি কারও প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে দেখিনি। কোনো মেয়ের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কটাক্ষ করতেও দেখিনি। সে এগুলো প্রচণ্ড ঘৃণা করত। নারীর প্রতি এত মর্যাদা দিতে আর কোনো মানুষকে আমি দেখিনি। নারী শিক্ষার জন্য তার আগ্রহ নারীর প্রতি মর্যাদা ও তাদেরকে আর্থসামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তার আগ্রহের প্রমাণ বহন করে। সে এখন নারী শিক্ষার জন্য অনেক স্কুল কলেজ ও কর্মমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। আমাদের গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছে দেশখ্যাত নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: শেখ হাসিনা একাডেমী এন্ড উইমেন কলেজ।
ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে চতুর্থ শ্রেণি পাশ করে সৈয়দ আবুল হোসেন মেধাকুল হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। মেধাকুল হাই স্কুল থেকে সপ্তম শ্রেণি পাশ করে সৈয়দ আবুল হোসেন গৈলা হাইস্কুলে ভর্তি হবার জন্য মামার বাড়ি চলে যায়। গৈলার সেরেলে স্কুলের অদূরে তার মামার বাড়ি। সে মামা বাড়ি থেকে গৈলা হাইস্কুল হতে সে এসএসসি পাশ করে গৌরনদী কলেজে ভর্তি হয়। আই কম পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়েছিল। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়। কিন্তু গৌরনদী কলেজের অধ্যক্ষ তমিজ স্যার তাকে ঢাকা গিয়ে গৌরনদী কলেজে ভর্তির জন্য নিয়ে এসেছিলেন। 
গ্রামে কেউ অসুস্থ হলে সৈয়দ আবুল হোসেন তাকে দেখতে যেত। বাড়ি হতে দুধ, ফল ইত্যাদি নিয়ে খাওয়াত। চিকিৎসার জন্য টাকা দিয়ে আসত। একবার তাদের প্রতিবেশী সৈয়দ চাঁন অসুস্থ হয়ে পড়লে আবুল হোসেন নিজে গিয়ে চিকিৎসার জন্য ২০ হাজার টাকা দিয়ে এসেছিল। এরূপ কত শত শত লোককে কত টাকা দিয়েছে তা তার নিজেরও মনে নেই। আকাশ হতে বৃষ্টি পড়ে। আকাশ জানে না কয় ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। আবুল হোসেনও আকাশের মতো বৃষ্টি দিয়ে রুক্ষ্ম কালকিনিকে শ্যামল করে রেখেছে, কিন্তু সে জানে না কত সাহায্য সে করেছে।
সৈয়দ আবুল হোসেন চায় সবাই ভালো থাকুক। তাই কেউ অসুস্থ হলে সে ছুটে না-গিয়ে পারত না। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে সে খেতে পারত না। তার বাবাও এ রকম ছিলেন। গ্রামের কিছু কিছু লোক চাইত, আবুল হোসেন যেন শুধু তাদের সাহায্য করে আর কাউকে নয় কিন্তু সে এ মনোভাব পোষণ করত না। সে গ্রামের সবাইকে একই পরিবারের সদস্য মনে করত। ১৯৮৮ সালের বন্যায় কালকিনি উপজেলার সব দুর্গত লোককে সে সাহায্য করেছে। কে তার শত্র“ ছিল কে মিত্র ছিল এটা ভাবেনি। তখন মনে হয়েছে, উপজেলার সব লোক তার পরিবারের সদস্য। 
একবার তার ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের সাথে এক লোকের ঝগড়া হয়। আত্মীয় সৈয়দ আবুল হোসেনকে ফোন করে অভিযোগ করে এবং এর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য থানাকে নির্দেশ দেয়ার দাবি করে। সৈয়দ আবুল হোসেন থানায় ফোন করলে ওসি বলল, ‘স্যার, আপনার আত্মীয়ের সাথে দুর্ব্যবহার মানে আমার সাথে দুর্ব্যবহার। আমি কড়া অ্যাকশন নেব।’ সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছিল, ‘না। আপনাকে আমার আত্মীয় হিসেবে কাউকে বিচার করতে হবে না, সহানুভূতি দেখাতে হবে না। আপনি আইনের দৃষ্টিতে দেখবেন। যে দোষি, সে আমার আত্মীয় হোক, রেহাই দেবেন না। আইন সবার জন্য সমান।’
ছোটবেলায় আমরা খেতাম রাক্ষসের মতো। অনেকের আবার খাবার সময় জিহ্বার শব্দ হতো। কোনো দাওয়াতে গেলে খাওয়ার জন্য পাগলের মতো দাপাদাপি করতাম, ঝাঁপিয়ে পড়তাম। সৈয়দ আবুল হোসেন চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকত। সে আস্তে আস্তে খুব সুন্দর করে খেতো। খাবার জন্য কোনো দাওয়াতে লাফালাফি-দাপাদাপি করত না। যখন তাকে ডাকত তখনই যেত। না-ডাকা পর্যন্ত নির্দিষ্ট স্থানে ভদ্রভাবে বসে থাকত। হুড়োহুড়ি করতে হবে বলে সে অনেক দাওয়াত হতে না-খেয়ে চলে এসেছে।
একবার স্কুল হতে আসছিলাম। আমি আর সৈয়দ আবুল হোসেন তৃতীয় শ্রেণি পাশ করে সবেমাত্র চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। অশীতিপর এক বুড়ো, নাম মবিন হাওলাদার। লাঠিতে ভর করে পথ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায়। আমরা হেসে উঠি, সে হাসল না, বরং তার চোখ জলে ছল ছল করে উঠল। বইগুলো আমার হাতে দিয়ে লোকটাকে তুলে ধরল। বুড়ো লোকটি আবুল হোসেনকে দোয়া করল, কিন্তু আমাদের দিকে ঘৃণার চোখে তাকাল। আবুল হোসেন পেল দোয়া, আমরা পেলাম বদদোয়া। সে অনেক বড় হলো, পৃথিবী বিখ্যাত; আমরা হতে পারলাম না। মবিন হাওলাদার যে রাস্তায় আছাড় খেয়েছিল সে রাস্তা এখন কাদাময় নয়, পাকা। গাড়ি চলে, বড় গাড়ি। আগে সে রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি দু’জন লোক হেঁটে যেতেও কষ্ট হতো। রাস্তাগুলো সৈয়দ আবুল হোসেনের বদৌলতে বড় হয়েছে।
সৈয়দ আবুল হোসেনের পিতার নাম হযরত সৈয়দ আতাহার আলী। তিনি ছিলেন একজন বুজুর্গ। অনেকের বিশ্বাস ছিল তিনি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুনও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন। লোকজন অসুখে-বিসুখে পড়লে সৈয়দ আতাহার আলীর কাছে পানি পড়া নিয়ে আসতেন। তার ফুঁ দেয়া পানি খেলে সব রোগ সেরে যেতÑ এটিই ছিল সর্বসাধারণের বিশ্বাস। তবে তিনি এটি সবিনয়ে না-করার জন্য উপদেশ দিতেন। লোকজন শুনতেন না। তিনিও আর লোকজনকে কষ্ট দিতে চাইতেন না। ফুঁ দিয়ে দিতেন। বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।
সৈয়দ আবুল হোসেন এখন বিখ্যাত লোক। বাংলাদেশের সব লোক তাকে চেনে। তিনি কালকিনির এমপি; বাংলাদেশের মন্ত্রী। আমি তার গ্রামের অতি সাধারণ একজন নাগরিক মাত্র। তবু সে আমাকে ভোলেনি। দেখা করতে গেলে শত কাজের মাঝেও সময় দেয়। প্রায় সময় কথা বলার সুযোগ হয় না, দিতে পারে না, তবে এমন খুব কমই ঘটে। কালকিনি হতে ঢাকা গিয়ে আমাদের আবুল হোসেনের সাথে দেখা করতে না-পারলে মনে কষ্ট পাই কিন্তু পরক্ষণে পরিস্থিতি অনুধাবন করার চেষ্টা করি। সে আমার অবস্থানে এবং আমি তার অবস্থানে থাকলে আমিও তাকে অত সময় দিতে পারতাম না।
সৈয়দ আবুল হোসেন আমার ছোটবেলার বন্ধু। একই গ্রামে এক সাথে বড় হয়েছি। মানুষের কোনো-না-কোনো বদঅভ্যাস থাকে, তবে সৈয়দ আবুল হোসেনের কোনো বদঅভ্যাস দেখিনি। চলন, কথা, ব্যবহার, উদারতা, সত্যবাদিতা, দেশপ্রেম, মানবতা ইত্যাদি বিবেচনায় সে একজন ফেরেশতার মতো মানুষ। আল্লাহ তাকে আরও বড় করবেন। আমাদের কালকিনির একমাত্র গার্ডিয়ান সে।

মো. লাল মিয়া : ডাসার গ্রামের অধিবাসী, সৈয়দ আবুল হোসেনের বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী।
অনুবর্ণন : মো. মফিজুল হক

প্রেরণাদাত্রী সহধর্মিনী খাজা নার্গিস
আহমদ হোসেন বীরপ্রতীক
সৈয়দ আবুল হোসেনের বংশ ও রক্তধারা সুদূর ইসলামের উৎসভূমি আরব। তাঁর সহধর্মিণী খাজা নার্গিস উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফিসাধক হযরত খাজাবাবা এনায়েতপুরী (রঃ)-এর সেজো ছেলে গদিনশিন সেজো হুজুর পিরজাদা হযরত খাজা কামালউদ্দিনের সেজো কন্যা। জন্ম, মৃত্যু বিয়ে এগুলো আল্লাহর হাতে। সৃষ্টির সময় আল্লাহপাক যুগল ঠিক করে রাখেন। কেউ এর বাইরে যেতে পারেন না। নইলে কালকিনির সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে এনায়েতপুরীর পৌত্রী খাজা নার্গিসের বিয়ে হবে কেন? আল্লাহ যেভাবে জোড়া নির্ধারণ করে দিয়েছেন সেটিই চূড়ান্ত। আর আল্লাহপাক বিচক্ষণতার সাথে সমমান এবং সমমর্যাদা দেখে জোড়া নির্ধারণ করেন। কথায় বলে- রাজার জন্য রানী, মানের জন্য মানি।
সৈয়দ আবুল হোসেনের স্ত্রী খাজা নার্গিস উচ্চশিক্ষিত এবং ছাত্রী হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষার মতো দীনি এলেমেও ছিলেন ঋদ্ধ। এনায়েতপুরী (রঃ)-এর মতো প্রখ্যাত পিরের পৌত্রী হওয়ার কারণে খাজা নার্গিসের চালচলন, আচার-ব্যবহার প্রভৃতি ছিল পিরের মতোই আকর্ষণীয়, ধর্মের মতোই পবিত্র। খাজা নার্গিস প্রচণ্ড আত্মসচেতন এবং নিখুঁত চেতনার অধিকারী একজন বিনয়ী মহিলা। সারল্যে শ্যামল, বাৎসল্যে কমল আর ব্যক্তিত্বে পাহাড়। ধর্মীয় শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক আবহের সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় তাঁকে মহিয়ান করে তুলেছে।
সৈয়দ আবুল হোসেনের বহুমুখী সফলতার পেছনে তাঁর মহিয়ষী সহধর্মিনী খাজা নার্গিসের ভূমিকা অসাধারণ। তিনি তাঁর চারিত্রিক মাধুরিমা দিয়ে পরিপূর্ণ মানবতায় ভাস্বর সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রকৃতির লাস্যে বিকশিত হওয়ার পথকে সাবলীল করে দিয়েছেন। তাঁর ত্যাগে মহিমান্বিত হয়েছেন স্বামী এবং তিনি হয়েছেন পুণ্যবান। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় :
জগতে সৃষ্টির যাহা কিছু কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
বিয়ের পর হতে সৈয়দ আবুল হোসেন ও খাজা নার্গিস একাত্মার মতো অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছেন। একজন অপরজনকে উপলব্ধি করার যে মনমানসিকতা সংসার জীবনকে মধুময় করার জন্য অপরিহার্য, তা উভয়ের মধ্যে আছে। বাপের বাড়িতে খাজা নার্গিস অলৌকিক বেহেশতি পরিবেশে উম্মে জননী ফাতেমার আদর্শ ও শিক্ষায় বড় হয়েছেন। মাতৃগর্ভ হতে দুনিয়াতে আসার পর পরই তিনি আল্লাহ ও আল্লাহ রাসুলের শিক্ষা, বাণী ও পির মাশায়েখ পরিবেশিত হয়ে বেড়ে উঠেছেন। তাই তিনি পরশে পরশে খাঁটি সোনা। অন্যদিকে, তাঁর মহান স্বামী সৈয়দ আবুল হোসেন আমাদের প্রিয় নবি হযরত মোহাম্মদের পিতৃব্য হযরত আবুতালিবের পুত্র হযরত আলীর সন্তান ইমাম হোসেনের রক্তাধিকারী। উভয়ের পবিত্র রক্তের বন্ধন মহা পবিত্রতারই জয়গান রচনা করেছে। হয়ত তাই সৈয়দ আবুল হোসেন নিজের আয়ের সত্তর ভাগ বিলিয়ে দিয়েও সন্তুষ্ট হতে পারেন না। আরও বিলিয়ে দেয়ার প্রত্যয়ে উন্মুখ হয়ে থাকেন। তাঁর এ দানে উৎসাহ যোগান প্রিয় জীবনসঙ্গিনী খাজা নার্গিস।
স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর বিশ্বাস ও মমত্ববোধ দাম্পত্য জীবনের মধুর অনুভব। মানবিক মূল্যবোধ খাজা নার্গিসকে সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল ও কর্র্তব্যপরায়ণ হতে উৎসাহিত করে। শিক্ষা তাঁকে মার্জিত করেছে, বড় করেছে, বিনয়ী করেছে; বংশ তাঁকে পুণ্যবতী করেছে, অহঙ্কারী করেনি। এখানেই সাধারণ মহিলা আর মহীয়সী খাজা নার্গিসের পার্থক্য। সৈয়দ আবুল হোসেন স্বল্পভাষী, অধিকন্তু মৃদুভাষী। তার স্ত্রীও অনুরূপ স্বল্প ও মৃদুভাষী। খাজা নার্গিসের কণ্ঠ যেমন মধুময় তেমন মার্জিত ও ব্যক্তিত্বময়। তার দিকে দৃষ্টি পড়লে জেগে ওঠে গভীর শ্রদ্ধা। এটি এমন একটি গুণ, যা কোনো সাধারণ রমণীতে দেখা যায় না। তার সাধারণ কথাও শ্রোতাদের কাছে অনিবার্য হয়ে ওঠে। এটি শুধু অর্জন নয়, জন্মগতও বটে।
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আবুল হোসেন সাকো ইন্টারন্যাশনালের গোড়াপত্তন করেন। জন্মকালে এটি এত বিশাল ছিল না। অল্পপরিসরে কয়েকজন কর্মচারী নিয়ে কোনো রকমে চলত। বেশি পুঁজি ছিল না। দিনরাত বিরামহীন শ্রম দিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন তার সন্তান-প্রতীম সাকো ইন্টারন্যাশনালের ভালে জয়টীকা পরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। দেহ, মন, সংসার, শরীর­Ñকোনো দিকে না-তাকিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন সাকো ইন্টারন্যাশনালকে অনুক্ষণ সময় দিয়েছেন। এটিই সাকো ইন্টারন্যাশনালের উত্থানের পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। সবাই জানেন, সৈয়দ আবুল হোসেন সাকো-এর জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। যে সময় সাধারণ মানুষ পরিবার পরিজনকে দেন, সে সময়ের অধিকাংশ তিনি সাকো-কে দিয়েছেন। টেন্ডার ও জরুরি কাজের অনেক সময় বাসায় না-গিয়ে রাতের পর রাত অফিসে কাটিয়েছেন। অন্য কোনো স্ত্রী হলে এটি মেনে নিতেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু মহীয়সী খাজা নার্গিস হোসেন কখনও সৈয়দ আবুল হোসেনের সময়ের ব্যাপারে কৈফিয়ত চাননি। একজন স্বামীর প্রতি একজন স্ত্রীর এর চেয়ে বড় ভালোবাসা আর কী হতে পারে! আমাদের সমাজে এমন নারী যার স্ত্রী হন, তিনি সততই সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো বিখ্যাত না হয়ে পারেন না।
সৈয়দ আবুল হোসেন ও খাজা নার্গিসের দাম্পত্য জীবন পারস্পরিক বোঝা-পড়ার অনাবিল উপন্যাস। এখানে শুধু হৃদয় নয়, আছে পরস্পর নৈকট্য লাভের আকুলতা, যা সবুজাভ অরণ্যের মতো অধরা-মাধুরী আর বিহ্বল ঐশ্বর্য্যে কাণায় কাণায় ভর্তি। শত ব্যস্ততার মাঝেও সৈয়দ আবুল হোসেন সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার আর রাতের ডিনার বাসায় স্ত্রী-কন্যাদের সাথে সারেন। এটি কাজের সাথে সংসারের প্রতিও সৈয়দ আবুল হোসেনের ঐকান্তিক আকর্ষণের একটি প্রমাণ। স্ত্রী কন্যা, যাদের সময় নিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন এত বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, এত বিখ্যাত হয়েছেন, তাদের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার সীমা নেই, ভালোবাসার অন্ত নেই। এখানেই সার্থক খাজা নার্গিস। এটি অনুধাবন করতে পারেন বলেই খাজা নার্গিস তাঁর স্বামীর প্রতি এত ঐকান্তিক। এখানেই সৈয়দ আবুল হোসেনের সার্থকতা।
খাজা নার্গিস স্বামী সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিজের অস্তিত্বের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করেন। যারা বিশ্বাস করেন তারা বিশ্বাসের জন্য ত্যাগ করতে পারেন, যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে ভালোবাসাও নেই। খাজা নার্গিস যেমনি স্বামীকে শ্রদ্ধা করেন, তেমনি আবুল হোসেন সমর্পিত তার স্ত্রীর প্রতি। তাই সাকো ইন্টারন্যাশনালকে প্রতিষ্ঠার জন্য সৈয়দ আবুল হোসেন রাতের পর রাত অফিসে অবস্থান করলেও খাজা নার্গিস তা নিয়ে কোন মন্তব্য করতেন না, বরং উৎসাহ দিতেন এবং পরম লালিত্যে পরিবারকে আগলে রাখতেন। আবার সৈয়দ আবুল হোসেন ‘সাকো’র জন্য এত পরিশ্রম করার পরও দুপুরে বাসায় চলে যেতেন খেতে। খাজা নার্গিস পিরের মেয়ে। পিরের পবিত্র রক্ত তাঁর শরীরে। তিনি উচ্চ শিক্ষিত, স্বামীকে দেবতার মতো শ্রদ্ধা করেন। এ শ্রদ্ধাবোধই সৈয়দ আবুল হোসেনকে পরিবারের বাইরে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এত সময় দেয়ার সুযোগ দিয়েছে। এত সময় দিতে পেরেছেন বলেই আজ সাকো এত বিশাল। সাকো এত বিশাল হয়েছে বলেই সৈয়দ আবুল হোসেন এত বড় দাতা। সুতরাং সৈয়দ আবুল হোসেনের বড় হবার পেছনে খাজা নার্গিস হোসেনের অবদান অসামান্য। স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক ত্যাগের মাধ্যমে একাত্ম হতে পারলে বিশ্ব জয় করাও অসম্ভব নয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ সৈয়দ আবুল হোসেন এবং খাজা নার্গিস।
এ কথা সর্বজনবাদি স্বীকৃত যে, সৈয়দ আবুল হোসেন একজন পরিপূর্ণ আদর্শ মানুষ। ছাত্রজীবন হতে এ পর্যন্ত কেউ তার সামান্য খুঁতও ধরতে পারেনি। তার চরিত্রে কোনো কালিমার স্পর্শ নেই। সৈয়দ আবুল হোসেনের স্কুল, কলেজ ও কর্মজীবনের বন্ধু আব্দুল কাদিরের ভাষায় বলা যায়:
স্কুল ও কর্মজীবনে আমার চেয়ে ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধু তার আছে, এমন আমার জানা নেই। এত অর্থবিত্তের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তার চরিত্রে এক বিন্দু কালিমা নেই। মদ-শরাব দূরে থাক, কোনোদিন একটা সিগারেট পর্যন্ত টানেননি। স্ত্রী জানতেন সৈয়দ আবুল হোসেনকে, সৈয়দ আবুল হোসেনও জানতেন স্ত্রীকে। সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতি স্ত্রীর এমন অকুণ্ঠ বিশ্বাসই তাদের দাম্পত্য জীবনের এমন নান্দনিক মনোরমতার নিয়ামক।
সাকো ইন্টারন্যাশনালকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সৈয়দ আবুল হোসেনকে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। এ সময় খাজা নার্গিস প্রিয়তম স্বামীকে সেবা, ভালোবাসা আর উৎসাহ দিয়ে শ্রমকে বিশ্রামের আড়ালে ঢেকে দিতেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে ছিলেন পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা উভয়ে একজন অপরজনের প্রতি এতই আন্তরিক যে, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব আন্তরিকতায় হারিয়ে যায়। উভয়ে উভয়কে এতই ভালবাসেন যে, একে অন্যের কাছে পরাজয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। ফলে দু’জনেই জয়ী হয়ে যান। মজবুত হয় বন্ধন। সংসার হয়ে ওঠে স্বর্গের মতো মোহনীয়।
যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সারাক্ষণ ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। অন্যদিকে খাজা নার্গিস সাকো ইন্টারন্যাশনালের মতো
আন্তর্জাতিকমানের বিশাল এক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। এত ব্যস্ততার মাঝেও তাঁদের দাম্পত্য জীবনের কোনো ছন্দপতন নেই। কাজ শেষ হওয়া মাত্র উভয়ে বাড়ি ফেরেন। সৈয়দ আবুল হোসেন মন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ হলে বাসায় চলে যান। বাসায় গিয়ে স্ত্রী-কন্যাকে পর্যাপ্ত সময় দেন। ভোরে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করেন। স্ত্রী তাঁকে অনুসরণ করেন।
সাকো ইন্টারন্যাশনালে অনেক কর্মচারী এক সাথে কাজ করছেন। সবার প্রতি ছিল সৈয়দ আবুল হোসেনের সমান নজর, সমান দৃষ্টি। তাদের প্রতি দৃষ্টি দিতে গিয়ে পরিবার হয়ত তার সময় হতে কিছুটা বঞ্চিত হয়েছে। খাজা নার্গিস ভাবতেন, যে সময় তিনি অফিসে দিচ্ছেন, সে সময় তিনি আমাদেরও দিতে পারতেন। অফিসে দিচ্ছেন বলেই সাকো এত বড়। হাজার হাজার লোক সাকোয় চাকুরি করে সংসার নির্বাহ করছে। তাঁর সামান্য ত্যাগের বিনিময়ে যদি হাজার হাজার পরিবার চলার সহায়ক হয়, তাহলে তিনি আরও বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি। সৈয়দ আবুল হোসেনের মহীয়সী সহধর্মিণীর ধৈর্যগুণ রাবেয়া বাসরির সাথে তুল্য। স্বামীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য তিনি নিজে একাই পরিবার সামলিয়েছেন।
দাম্পত্য জীবনে তারা পরস্পর ভালোবাসার প্রতিভু, বিশ্বাসের স্তম্ভ আর বাৎসল্যের বর্ষণ। এত অর্থবিত্তের মালিক হওয়া সত্ত্¡েও সৈয়দ আবুল হোসেনের চরিত্রে এক বিন্দু কালিমা নেই। মদ-শরাব দূরে থাক, কোনোদিন একটা সিগারেট পর্যন্ত টানেননি। স্ত্রী জানতেন সৈয়দ আবুল হোসেনকে, সৈয়দ আবুল হোসেনও জানতেন স্ত্রীকে। সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতি স্ত্রীর এমন অকুণ্ঠ বিশ্বাসই তাদের দাম্পত্য জীবনের নান্দনিক পবিত্রতার অবিচ্ছেদ্য নিয়ামক। সৈয়দ আবুল হোসেনের ছোট ভাই ড. এ হাসানের ভাষায় :
‘মেজো ভাই আর ভাবীর পারস্পরিক বিশ্বাস ও হৃদ্যতা ছিল পাহাড়ের চেয়ে অটল, সমুদ্রের চেয়ে বিশাল। ব্যবসায়ী মেজো ভাই আর মন্ত্রী মেজো ভাই দুটি ভীষণ ব্যস্ত পেশা। সারাদিন তাকে রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবু তিনি সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার এবং ডিনার ভাবী-বাচ্চাদের নিয়ে একসাথে খেতেন। অনিবার্য না-হলে এর ব্যতিক্রম ঘটতে আমরা দেখিনি।’১
সংসার জীবনে সৈয়দ আবুল হোসেন একজন সার্থক পুরুষ। কারণ, তার স্ত্রী খাজা নার্গিস একজন আদর্শ স্ত্রী। অনেক স্ত্রী স্বামীর বদনাম করেন। খাজা নার্গিস তা কল্পনাতেও আনতে পারেন না। খাজা নার্গিসের ভাষায়, তিনি (সৈয়দ আবুল হোসেন) শুধু স্বামী নন, বন্ধু, উপদেষ্টা। সৈয়দ আবুল হোসেনও স্ত্রীকে অনুরূপভাবে আখ্যায়িত করেন: তিনি শুধু আমার স্ত্রী নন, বন্ধু, উপদেষ্টা। উভয়ের প্রতি উভয়ের সরল স্বীকৃতির বর্ণীল প্রকাশ কতই না মধুর। স্বামী হিসেবে খাজা নার্গিসের ভাষায়, তিনি একজন বিশ্বস্ত মানুষ। কোনো মলিনতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি, তিনি একজন উদার মানুষ, কোনো সীমায় তাকে আবদ্ধ করা যায় না। হি ইজ এন ওশ্যান, রিফিউজেস নো রিভার। সৈয়দ আবুল হোসেন তার স্ত্রীকে মনে করেন প্রেরণাদাতা। তিনি তার সফলতার পেছনে স্ত্রীর ভূমিকাকে শ্রদ্ধাময় কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করেন।
পরিবারকে খাজা নার্গিস খুব ভালোবাসেন। পরিবারের শান্তি সবচেয়ে বড় শান্তি। একজন মানুষ যতই ধনী হোক না কেন, অসুস্থ হলে কোনো শান্তি উপভোগ করতে পারে না। তেমনি একজন লোক যতই ধনী, যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, পারিবারিক শান্তি না-থাকলে তার সবকিছু ব্যর্থ হতে বাধ্য। সৈয়দ আবুল হোসেনে ভাষায়, ‘আমি পারিবারিক জীবনে একজন সুখী মানুষ। আমার সুখের বিনির্মাতা আমি, আমার স্ত্রী, আমার দুই কন্যা। আমি তাদের পর্যাপ্ত সময় দেই, ভালবাসা দেই। তারাও দেয়। এটি বিনিময় নয়, মর্যাদার আদান প্রদান। যেখানে মর্যাদা নেই সেখানে ভালোবাসা নেই। আমি আমার স্ত্রীর প্রতি সর্বদা বিশ্বস্ত এবং মর্যাদাশীল আচরণে অভ্যস্ত। সন্তানদের প্রতি আমি সবসময় সুন্দর ব্যবহার করি। আমি জানি, আমার মৃত্যুর পর, তারাই আমার শেষ ঠিকানা স্থির করবে। আমার স্ত্রী কন্যা আমার আনন্দ, বেঁচে থাকার প্রেরণা।’২
খাজা নার্গিসের শুধু স্বামীর প্রতি নয়, স্বামীর পরিবারের সবার প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। খাজা নার্গিস ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেনের ছোট বোন ইডেন কলেজের তৎকালীন ছাত্রী সৈয়দা মনোয়ারার রুমমেট ও বান্ধবী। তাই সৈয়দ আবুল হোসেনের ছোট ভাই ড. এ হাসানের সাথে তাঁর ভাবীর পরিচয় ছিল। খাজা নার্গিস-এর ডাক নাম কুন্তি। কুন্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ড. হাসান বলেছিলেন:

বিয়ের পর কুন্তি আপা নার্গিস ভাবীতে পরিণত হন। বন্ধুত্ব আর ভাইয়ের সম্পর্কের সাথে যুক্ত হয় মায়ের সম্পর্ক। এ ত্রয়ী সম্পর্কের মিলন এক মধুর আবহ সৃষ্টি করে। আমি বাড়ির সবার ছোট ভাই। সব আদর আমার উপর উপচে পড়ে। ভাবী আমাকে এমন আদর করতেন যেন আমি তার সন্তান। নিজ হাতে খাইয়ে দিতেন। চুল আঁচড়ে দিতেন। ইন্টারমেডিয়েট পাশ করার পরও ভাবী আমাকে নিজ হাতে খাইয়েছেন। সকল প্রয়োজন আমার অনুভূত হবার পূর্বে মেজো ভাবীর কাছে অনুভূত হয়েছে। ভাবীর মাতৃ আদর আর দাদার পিতৃ হৃদ্যতা প্রতিটি অভাব মুছিয়ে দিয়েছেন পরম যতেœ। এগুলো মনে পড়লে এখনও তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মনপ্রাণ আনত হয়ে ওঠে।

খাজা নার্গিস সৈয়দ আবুল হোসেনকে বন্ধুর মতো আশ্রয়, ধাত্রীর মতো সেবা, প্রেমিকার মতো ভালোবাসা, সহকর্মীর মতো সহায়তা, উপদেষ্টার মতো উপদেশ, গার্ডিয়ানের মতো সতর্কবাণী, জয়ের মতো প্রেরণা আর উৎসবের মতো প্রফুল্লতা দিয়ে উদ্ভাসিত হবার পাথেয় হিসেবে অবিরাম অবিচল।
আহমদ হোসেন বীরপ্রতীক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত। তিনি এনায়েতপুরের গদিনশিন পির হযরত খাজা কামালউদ্দিনের অসংখ্য ভক্ত-শিষ্যদের একজন।

১. ড. এ হাসানের সাথে সাক্ষাৎকার।
২. কমিউটর ট্রেইন উদ্বোধনের লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জ যাবার পথে ট্রেইনে কথাপ্রসঙ্গে আলাপক্রমে।

ছাত্রনং অধ্যয়নং তপোঃ
মো. শামশুল আলম মিয়া
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আমি গৌরনদী কলেজে আইএসসি ক্লাশে ভর্তি হই। সত্তরের রাজনীতিক আবহে দেশের অন্যান্য কলেজের ন্যায় গৌরনদীও ছিল উত্তপ্ত। চারিদিকে স্বাধীনতার হাতছানি, রক্তে নতুন দিনের আহ্বান। পাকিস্তান বিরোধী শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত। আবালবৃদ্ধবনিতা মুজিব নামের যাদুতে বিমোহিত। আমাদের কলেজ এগুলো হতে দূরে ছিল না। কিন্তু অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন স্যারের সার্বক্ষণিক নজর এড়িয়ে কেউ পড়া ফাঁকি দেয়ার সামান্য সুযোগও পেত না। সেকালে আমাদের গৌরনদী কলেজ ছিল একটি আদর্শ বিদ্যাপীঠ। শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী এবং পরিচালনা কমিটির সদস্যগণ সবাই ছিলেন স্ব স্ব দায়িত্ব ও কর্তব্যে যেমন আন্তরিক তেমন সচেতন।
কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথম দিন যে নামটি আমার মনে দাগ কাটে, তিনি আমার তিন বছরের সিনিয়র আবুল হোসেন ভাই। এত ছাত্রছাত্রীর মাঝে তাঁর নাম দাগ কাটার অনেক কারণ আছে। জুনিয়রদের কাছে তিনি শুধু সিনিয়র সতীর্থই ছিলেন না। ছিলেন একাধারে গুরু, বড় ভাই এবং অনুকরণীয় ব্যক্তি। আমি যখন আইএসসি ফাস্ট ইয়ারে, আবুল হোসেন ভাই তখন গৌরনদী কলেজে বি কম থার্ড ইয়ারে পড়ছেন। সহপাঠীদের সাথে আলাপ করতে গেলে সৈয়দ আবুল হোসেন ভাইয়ের কথা চলে আসত। সবাই তাকে চিনতেন অথচ তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী একজন নিভৃতচারী। আমাদের কলেজে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো মেধাবী অনেক ছাত্র ছিলেন, কিন্তু তাঁর মতো আদর্শবাদী আর কাউকে আমার চোখে পড়েনি।
সৈয়দ আবুল হোসেন ভাই শুধু মেধাবী ছিলেন না। ছিলেন সদালাপী, অমায়িক, সহানুভূতিশীল, ভদ্র এবং বুদ্ধিমান। তাঁর ছিল মহাসাগরের মতো বিশাল একটা মন এবং আকাশের মতো উদার একটা চেতনা। কারও স্বকীয়তাতে তাঁর বিরক্তি ছিল না, বরং ছিল আগ্রহ আর মুগ্ধতা। আমরা মুগ্ধ হয়ে তাঁকে অবলোকন করতাম, অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম। সবাই তাঁর কথা বলতেন, আমি শুনতাম এবং শুনতে শুনতে অবাক বিস্ময়ে পুলকিত হয়ে উঠতাম। মনে মনে একটি আশা লালায়িত হয়ে উঠত, যদি আমি তাঁর মতো হতে পারতাম! পরে বুঝতে পেরেছি, তাঁর মতো হবার চেষ্টা করা যায় কিন্তু হওয়া যায় না। জন্মই তাঁকে ধন্য করে পাঠিয়েছে দুনিয়াতে।
আমাদের কলেজ জীবনে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত চমৎকার। সিনিয়র ভাইদের প্রতি আমাদের অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল। ভয়ও করতাম। তারা আমাদের স্নেহ করতেন। আবার অসৌজন্যমূলক আচরণ করলে শাসন করতেও ছাড়তেন না। তাই সবসময় সিনিয়রদের কাছ হতে একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতাম। এ দূরত্ব অবহেলার নয়, এড়িয়ে যাবার নয়; শ্রদ্ধার। সৈয়দ আবুল হোসেন ভাইয়ের প্রতি অল্প কয়েক দিনে আমি এত অনুরক্ত হয়ে পড়ি যে, তাঁকে দেখার জন্য, তাঁর কাছে যাবার জন্য আমার হৃদয় উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এর অনেক কারণ আছে। প্রথমত, তিনি ছোটদের স্নেহ করতেন, দ্বিতীয়ত, উদাহরণসহ উপদেশ দিতেন। এ´ামপল ইজ বেটার দ্যান প্রিসেপ্ট। দুটোই আমার ভালো লাগত। তৃতীয়ত, তার মতো সুন্দর কোনো লোক কলেজে ছিল না।
ভর্তির দুই-একদিন পর আবুল হোসেন ভাইকে দেখার সৌভাগ্য হয়। আমার এক বন্ধু ইশারায় তাঁকে দেখিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ঐ আমাদের আবুল হোসেন ভাই। আমি তাকালাম। তাকানো নয়, যেন অবাক অবোধ্যতা। ধবধবে ফর্সা অবয়বে নির্ঝর আকর্ষণ। মুক্তোর মতো সাদা দাঁতগুলোয় হাসির তুফান। যেন মরুদেশের বরফ। এক ফোঁটা কৃত্রিমতা নেই। চোখ দুটো অদ্ভুদ মাদকতায় ঢাকা। মোহনীয় ভঙ্গিতে কয়েকজন বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। কথা নয়, যেন এক পশলা প্রশান্তি। না তীব্র না ধীর, এত সুন্দর মানুষ আমি আর দেখিনি। এত মার্জিত কথা আর শুনিনি। নিজের অজান্তে এক অজানা আকর্ষণ আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যায়। সামনে গিয়ে বিনয়ের সাথে সালাম দিলাম।
ভেবেছিলাম তিনি আমার সালাম শুনতে পাবেন না। শুনলেও না-শোনার ভানে এড়িয়ে যাবেন। কলেজে যার এত সুনাম, তিনি আমাকে পাত্তা দেবেন কেন? আমাকে অবাক এবং আমার বন্ধুদের মন্তব্যকে সত্য প্রমাণ করে শ্রদ্ধেয় আবুল হোসেন ভাই একরাশ হাসি দিয়ে বললেন: ওয়ালাইকুম সালাম। তোমার নাম কি ভাই? এত মোলায়েম কণ্ঠ আমাকে শিহরিত করে দেয়। বিনয়ের সাথে বললাম: শাহ আলম মিয়া, নতুন ভর্তি হয়েছি। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে বলেছিলাম গৌরনদী থানার বারতি ইউনিয়নে। আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন: স্কুল আর কলেজ ভিন্ন। এখানে তুমিই তরী, তুমিই মাঝি। প্রতিটি পা হিসেব করে ফেলবে। মা-বাবা কেউ তোমাকে দেখছে না, দেখার নেই। তোমাকে তুমিই দেখছ, আর কেউ নয়। খুব সাবধান কিন্তু; একটু ভুল হলে আর শোধরাতে পারবে না। মনে রাখবে ছাত্রনং অধ্যয়নং তপোঃ।
কয়েক মাসের মতো তাকে আমি কাছ হতে দেখেছি। কোনোদিন রাগ করতে দেখিনি। কারও সাথে রাগ করেছেন এমন শুনিনি। কলেজে তিনি ছিলেন অজাতশত্র“। দীর্ঘ চার বছর তিনি গৌরনদী কলেজে অধ্যয়ন করেছেন। এ চার বছরে কেউ তার মুখ হতে একটি অশালীন কথাও বের হতে দেখেনি। তিনি মাটির দিকে তাকিয়ে সটান হয়ে হাঁটতেন, ঠিক রাজপুত্রের মতো। শিক্ষকগণ ক্লাশে আমাদেরকে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো হবার উপদেশ দিতেন। তিনি ছিলেন আমাদের আদর্শ এবং অনুসরণীয়। সৈয়দ আবুল হোসেন ভাই ছিলেন সর্বজন প্রিয় একটি নাম। পুরো কলেজের মধ্যমণি। তাঁর আচার-ব্যবহার ছিল যেমন মার্জিত তেমন হৃদয়গ্রাহী। সিনিয়র-জুনিয়র সবাই তাঁর ব্যবহারে মুগ্ধ ছিলেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কোনো সমস্যায় শিক্ষকগণ তাঁর উপদেশকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতেন। তাঁর সুচিন্তিত মন্তব্য, মোহনীয় ভঙ্গি সবাইকে অভিভূত করে দিত। ছাত্রজীবন পেরিয়ে আমি কর্মজীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে। এ দীর্ঘ জীবনে তাঁর মতো সদালাপী, অমায়িক এবং বন্ধুবৎসল লোক আমি পাইনি।
আমার বড় বোনের শ্বশুর বাড়ি সৈয়দ আবুল হোসেনের গ্রামের বাড়ির নিকটে। ভগ্নিপতির কাছে সৈয়দ আবুল হোসেন ও তাঁর পূর্বপুরুষদের অনেক কথা শুনেছি। সৈয়দ আবুল হোসেন কালকিনির ডাসার ইউনিয়নের বিখ্যাত সৈয়দ বাড়ির সন্তান। তাঁর পিতা, পিতামহ প্রত্যেকে ছিলেন বুজুর্গ। বাংলাদেশে তাঁর পূর্বপুরুষ হযরত শাহ আলী বোগদাদী। তিনি হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর চাচা হযরত আবু তালেবের বংশধর। হযরত শাহ আলী বোগদাদীর স্ত্রী আয়েশা বেগমের স্ত্রী ছিলেন সুলতান শাহ আলাউদ্দিন আলমের কন্যা। সৈয়দ আবুল হোসেনের শরীরে এত পবিত্র ও অভিজাত রক্ত প্রবাহিত বলেই তিনি এমন সমাজে বাস করেও এত বিনয়ী, এত চরিত্রবান।
আইএসসি পাশ করে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। পাঁচ বছর পর ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে মাস্টার্স শেষ করে রাজশাহী ত্যাগ করি। এ পাঁচ বছরে কোনো দিন আমার গৌরনদী কলেজের প্রিয় বড় ভাই সৈয়দ আবুল হোসেনের উপদেশ এক মুহূর্তের জন্যও মন হতে তাড়াতে পারিনি। তাড়াতে পারিনি তার উপদেশ: ছাত্রনং অধ্যয়নং তপোঃ। এলএলবি পাশ করার পর আইন পেশায় নিয়োজিত হই। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে বিসিএস পাশ করে জুডিশিয়াল সার্ভিসে যোগ দেই। এখন ২০১০, অনেকদিন গড়িয়ে গেছে। অনেক স্মৃতি আমার বিস্মৃতির কালো গহ্বরে হারিয়ে গেছে। একান্তে যখন আত্মচয়নে মগ্ন হই, তখন সব কিছু ছাড়িয়ে ভেসে আসে আমার প্রিয় মুখ-সৈয়দ আবুল হোসেন। যার হাসির মাঝে অকৃত্রিম স্নেহের বারতা, কথায় ভালোবাসার মাধুর্য, অন্তরে অকপট ছন্দ। ছাত্রনং অধ্যয়নং তপোঃ। প্রিয় গৌরনদী কলেজের মুগ্ধ অঙ্গন এখনও আমাকে টানে। একটা জায়গায় এসে থেমে যাই। সেটি হচ্ছে গৌরনদী থানার পাশে অবস্থিত পশুস্বাস্থ্য বিভাগের একটি কমিউনিটি সেন্টার। সৈয়দ আবুল হোসেন অনেক দিন এখানে থেকেছেন।
গৌরনদী কলেজের সে সৈয়দ আবুল হোসেন এখন বিশ্বপরিচিত মুখ। বড় শিল্পপতি, বড় রাজনীতিবিদ, খ্যাতিমান শিক্ষানুরাগী। অন্যান্য স্থানের মত গৌরনদী কলেজ এলাকাও সৈয়দ আবুল হোসেনের অবারিত দানের উদারতা হতে বঞ্চিত হয়নি। যে সমস্ত রাস্তা দিয়ে আমরা চলতে পারতাম না, এখন সে সকল রাস্তা দিয়ে যান্ত্রিক গাড়ি চলছে। তাঁর মতো একজন মহান লোকের সাথে একই কলেজে পড়েছি, এটি আমি এখনও গর্ব ভরে স্মরণ করি।
এখন তিনি যোগাযোগ মন্ত্রী। মাঝে মাঝে আমি তার কাছে যাই। ঠিক আগের মতো স্নেহার্দ্র কণ্ঠে কুশল জিজ্ঞাসা করেন। এতটুকু অহংবোধ নেই। তিনি আমার অন্তরের মানুষ। তার কর্ম, দয়া, মানবীয় গুণাবলী ও ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে সম্মান করি, বড় ভাইয়ের মতো। আমি তার দীর্ঘায়ু কামনা করি। আল্লাহ যেন তাকে আরও বড় করেন। কারণ, তিনি যত বড় হবেন দেশ তত সমৃদ্ধ হবে। তার নিজের জন্য তার বড় হওয়ার প্রয়োজন নেই। তার বড় হওয়া প্রয়োজন আমাদের জন্য। তার জন্য তার বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই। তার বেঁচে থাকা প্রয়োজন দেশের জন্য, সমাজের জন্য এবং সর্বোপরি, একটি শিক্ষিত জাতির জন্য।

মো. শামসুল আলম মিয়া : জেলা ও দায়রা জজ, ময়মনসিংহ।
আমার দেখা সৈয়দ আবুল হোসেন
অধ্যক্ষ মো. জসিম উদ্দিন

নাই চিন্তা, নাই ধ্যান, নাই জ্ঞান, নাই অনুভবের শক্তি,
নাই পূজনীয় দেবতারে পূজিবারে যোগ্য ভক্তি।
ভয়ে লজ্জায় নিজেকে করি ঘৃণা
প্রভু, এমন ব্যর্থ জীবন দিয়েছ কি না।
কি করব হায় কি দিয়ে লিখব কিছু
একেবারে অসহায়; সামান্য এগিয়ে অনেকটা হাঁটি পিছু।

তারপরও এমন এক জীবন নিয়ে এমন এক ব্যক্তি এবং ব্যক্তিত্ব নিয়ে ভাবতে বসেছি যে, জীবন বিত্তের সাথে চিত্তের উদারতা মিশে করেছে যাকে মহীয়ান সহজ সরল মহৎ প্রাণ।

পরের দুঃখে কাঁদে যিনি, নিজের দুঃখে হাসে
শত যন্ত্রণা সহ্য করেও পরের বেদনা নাশে।

হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক, আজকে এমনই একজনকে নিয়ে ভাবছি, যাকে ব্যক্ত করার ভাষা, চিন্তা-চেতনা সত্যিই আমার খুব দুর্বল এবং আমার সাহস হচ্ছে না, না জানি আমার বর্ণনায় এতবড় এবং মহৎ ব্যক্তিত্বের কোনো অমর্যাদা হয়ে যায়। তবে আমার আন্তরিকতার দিকে তাকিয়ে, আমার সাধের দিকে বিবেচনা করে এবং আমার সাধ্যের দিকে না-তাকিয়ে আমাকে ক্ষমা করবেন। এই প্রার্থনা জানিয়ে এমন এক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে লিখছি :

‘যিনি জাতি, ধর্ম, গরিব-দুঃখী নির্বিশেষে সকলকে ভালোবাসেন
সেই আমার মহান নেতা সৈয়দ আবুল হোসেন।’
এই মহান নেতার সাথে আমার পরিচয় ১৯৯২ সনে। আমার চাকুরির বয়স সবেমাত্র আট পেরিয়েছে। অধ্যক্ষ পদে সাক্ষাৎকার দিতে হবে, স্থান সাকো ইন্টারন্যাশনাল, আমিন কোর্ট, ঢাকা। নানা চিন্তা, এক ধরনের শিহরণ, অনিশ্চয়তা, কৌতূহল এবং প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়ার অন্য সকলের মতো ভয় ইত্যাদি নিয়ে এক ধরনের একেবারেই নতুন অনুভবসহ সাক্ষাৎকার গ্রহণ সভায় ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম। কারণ হচ্ছে একটি মাত্র ব্যক্তি যেন জলহংসের শ্বেত-শুভ্র পৃষ্ঠপালক আসনে বসে অনিন্দ্য সুন্দর এক সৌম্যকান্তি, অত্যন্ত সহজ-সরল হাসির অবয়বে আমাকে গ্রহণ করে নিলেন। কথা হলো সেক্সপিয়রের উপর, ছাত্রছাত্রী বৃদ্ধির উপর এবং লেখাপড়ার মানোন্নয়নের উপর। ভালোই হলো। উপস্থিত সদস্যবৃন্দের হাসি মুখ দেখেই বোর্ড থেকে বিদায় নিলাম। চাকুরি হবে কি, হবে না, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। না হওয়ার প্রধান কারণ ছিল আমার কম বয়স ও চাকুরির অভিজ্ঞতার স্বল্পতা। অধিকন্তু, ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষসহ বেশ কিছু প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন। সাক্ষাৎকার শেষে হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমাকে গাড়িতে নিয়ে গেলেন এবং উৎসাহব্যাঞ্জক, উদ্দীপনামূলক অনেক কথা বললেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম এবং ভুবন-ভরা বিস্ময় চোখে নিয়ে পলকহীন নেত্রে তাকিয়েছিলাম আর ভাবছিলাম এত সহজ-সরল, উদার এবং আন্তরিক মানুষ হয়! মনে মনে শত কোটি সশ্রদ্ধ সালামের মাল্য অর্ঘ্য দিয়ে বিদায় নিলাম।
সাথে নিয়ে গেলাম পূত-পবিত্র এক দীপ্তিময় কান্তি/ যে কান্তি স্মরণে, যে কান্তি দরশনে দূর হয় ভ্রান্তি/ যাহার লাগিয়া অহর্নিশি জেগে করি তপস্যা/ পূর্ণচাঁদের তিথি কিংবা ঘোর অমাবস্যা। ইহলোক পরলোক সে গোলাপের আভায়/ অন্য লোকের ভাব জাগায় সুদূর মনের সূক্ষ্ম বীণায়/ বিহগ-বিহগী এক হয়ে যায় শত সহস্র বেদনা হননে/ আক্ষেপ হতাশা নাশি পরম তৃপ্তি আনে মরণে।
কিছুদিন পর নিয়োগ পত্র হাতে নিয়ে সভাপতি হিসেবে আমিন কোর্টের সাকো অফিসে সাক্ষাৎ করতে এলে সে ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে আমাকে কাছে বসালেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর তাঁর প্রতিষ্ঠানের একজন ডাইরেক্টর জনাব আব্দুল কাদেরকে দিয়ে আমাকে পাঠালেন দুটি শার্ট কিনে দেয়ার জন্য। আমার পছন্দমতো শার্ট কেনা হলো। ফিরে আসলাম সাকো অফিসে। শার্ট দুটি তাঁকে দেখানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। উনি বললেন, ‘আমার দেখা লাগবে না। আপনার পছন্দ হলেই চলবে।’ অফিসে কর্মরত ওহাব আলী নামের একজনকে ডেকে আমাকে নিয়ে সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে মাদারীপুর যাবার জন্য বললেন এবং আমার বিনীত অনুরোধ আমলে না-নিয়ে দুই হাজার টাকা আমাকে দিলেন নতুন জায়গায় যাচ্ছি বিবেচনায়। এলাকার গণ্যমান্য কয়েকজন ব্যক্তি যেমন আলহাজ্ব আতাহার উদ্দিন আহমেদ (৪৭ বছর যাবৎ সাহেবরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক), জনাব আসাদুজ্জামান, পরিচালক নায়েম, কলেজ প্রতিষ্ঠাতা এবং জনাব আবদুর রাজ্জাক মোল্লা, প্রধান শিক্ষক আন্ডারচর উচ্চ বিদ্যালয়, জনাব আওলাদ হোসেন, প্রধান শিক্ষক হাকিমুননেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়- সকলেই তৎকালীন দায়িত্ব পালনরত ছিলেন। এই সকল শ্রদ্ধেয় মুরব্বিদের সাথে পরামর্শ করে কলেজ পরিচালনার ব্যাপারে তিনি আমাকে দিক-নির্দেশনা দিলেন। মহোদয়-এর প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি দিক-নির্দেশনা আমাকে বিস্ময়াভিভূত করতে লাগল এবং আমার চিন্তা ও চেতনার জগতে বিপ্লবের ডাক দিতে শুরু করল। বিশেষ করে, লেখাপড়ার মানোন্নয়নের ব্যাপারে, আদর্শ সমাজ গড়ার ব্যাপারে, ছাত্রছাত্রীদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে, তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতার ভাব জাগিয়ে পরনিন্দা, পরচর্চা থেকে বিরত থাকা, মঙ্গলের ডাকে, কল্যাণের চিন্তায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়া- এ সমস্ত বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য এবং দৃঢ় অবস্থান আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।
সাহেবরামপুর কলেজে চাকুরি জীবনের পাঁচ বছরে অসংখ্য বার সাকো অফিসে কলেজের প্রয়োজেনে গিয়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন আমার প্রিয় নেতার সামনে বসে থেকেছি। অত্যন্ত আন্তরিকতা এবং শ্রদ্ধার সাথে প্রতিটি লোকের সাথে তাঁর ব্যবহার ও আচরণ, প্রতিটি মানুষকে সরলভাবে, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতার সাথে গ্রহণ করার তাঁর আশ্চর্য ক্ষমতা, প্রতিটি মানুষের কথা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে শোনা এবং সাধ্যমতো তাদের উপকার করাÑ এই বিষয়গুলো লক্ষ্য করেছি আর অপার বিস্ময়ের সাগরে অবগাহন করেছি। আমার দেখা প্রায় কর্মদিবসে পঞ্চাশ হতে একশ সাহায্যপ্রার্থীকে তিনি হাসিমুখে বিদায় করেছেন এবং কাউকে খালি হাতে ফেরাননি। তাঁর সাধ্যের সর্বোচ্চ সামর্থ্য উজাড় করে দিয়েছেন। সারাদেশের, বিশেষ করে, কালকিনি উপজেলা ও মাদারীপুর জেলার গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার খরচ, গরিব দুঃখী এবং বিজ্ঞ জনদের মারাত্মক রোগ এবং দুর্ঘটনাজনিত চিকিৎসার ব্যয়ভার তিনি হাসিমুখে বহন করছেন। অসহায় মেয়েদের বিয়ের খরচ এবং সংসার টিকে থাকার ব্যয়ভার তিনি অকাতরে বহন করেছেন এবং করছেন।
প্রতিদিন এত মানুষের এত অভাব অভিযোগ, বঞ্চনা, প্রতারণার কথা, হতাশার ব্যথা, বিশ্বাসভঙ্গের কথা, নিপীড়ন, নির্যাতনের কথা, মারামারি হানাহানির কথা, সামাজিক, রাজনৈতিক কোন্দল এবং ধর্মীয় সমস্যার কথা অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে এবং আন্তরিকতার সাথে শুনেছেন এবং প্রতিটি বিষয়ের গঠনমূলক ও বাস্তব সমাধান দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন, ভাবতে সত্যিই বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে অসীমের দিকে টেনে নিয়ে যায়। একটা মানুষের পক্ষে একটা জীবনের পক্ষে এও কি সম্ভব! এতো শুধু মানুষ নয়, মহামানবের জীবনাদর্শ এবং দৃষ্টান্তকেও হার মানায়। এলাকায় মারামারি হয়েছে, জখম হয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে খুন হয়ে গেছে এবং মামলা হয়ে গেছে, তিনি তাদের ডেকে এনে সহজ সরল কথা দিয়ে উভয় পক্ষকে বুঝিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দিয়ে, মামলা উঠানোর খরচের টাকা দিয়ে এমনকি উভয়পক্ষের সমস্ত লোকের ঢাকায় আসা-যাওয়ার ভাড়ার টাকা দিয়ে, বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছেন।
মারামারি, হানাহানি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সুদৃঢ়, তাঁর কণ্ঠ স্পষ্ট, সোচ্চার এবং অত্যন্ত বলিষ্ঠ। অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নন। এ ব্যাপারে তিনি একেবারেই আপোষহীন। স্বজনপ্রীতি শব্দটি তাঁর জীবনের অভিধানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। শোষণের হাত থেকে শোষিতকে রক্ষা করা, অত্যাচারীর হাত থেকে অত্যাচারিতকে বাঁচানো, বঞ্চনার হাত থেকে বঞ্চিতকে রক্ষা করা, গরিব ও দুর্বলকে অকাতরে উদার মনে সহায়তা দেয়া তাঁর জীবনের ব্রত।
অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর আপোষহীন মনোভাব, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, স্বজনপ্রীতিহীন আপাদমস্তক নির্ভেজাল চিন্তা-চেতনা এবং সমাজে এর সঠিক বাস্তবায়ন- কালকিনি এলাকায় প্রশংসনীয় শান্তি বিরাজ করছে। অথচ এই এলাকা একদিন ছিল সন্ত্রাসীদের চারণভূমি, সর্বহারাদের শক্ত ঘাঁটি। তাঁর এই নিরপেক্ষতার কারণে, পূত-পবিত্র স্বচ্ছ চিন্তাধারার ফলে এলাকার মানুষ দলাদলি, হানাহানি ভুলে এক দলে পরিণত হয়েছে, এক ব্যানারে সমবেত হয়েছে। আর সে ব্যানার হচ্ছেÑ শান্তির ব্যানার, উন্নতির ব্যানার, প্রগতির ব্যানার, ভ্রাতৃত্বের ব্যানার এবং অহিংসার ব্যানার। সহনশীলতা, নিরপেক্ষতা, উদারতা, দানশীলতা, পরোপকারে নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, মূল্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, নিরহঙ্কার মনোভাব, ধর্মীয় চেতনায় সমৃদ্ধ নির্ভেজাল সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতাÑ এ সমস্ত দুর্লভ ও প্রশংসনীয় চিন্তা-চেতনা আমাকে মহোদয়-এর প্রতি এক অদৃশ্য শক্তি দারুণভাবে টানতে থাকে। আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি এবং একনিষ্ঠভাবে তাঁর ভক্ত হয়ে যাই। মনের সিংহাসনে, চিন্তা ও চেতনা রাজ্যের রাজার আসনে বসিয়ে তাঁকে দিবানিশি দেবতাজ্ঞানে স্মৃতির মহাকাশে ধ্রুব তারার মতো ভাসমান রাখতে থাকলাম। তখন আমি সাহেবরামপুর কবি নজরুল কলেজের অধ্যক্ষ। এ মহান নেতার আচরণ আমার অন্তরে এমন দাগ কাটল যে, প্রায় সবসময় তাঁর ছবি, তাঁর দীপ্তিময় কান্তি আমার মনের আয়নায় উজ্জ্বল হয়ে আলো দিতে থাকল। সাহেবরামপুর থেকে কালকিনি দীর্ঘপথ। ভ্যানে চড়ে সেই দীপ্তিময় ছবিটির সাথে মনে মনে কথা বলতে বলতে উপজেলায় হঠাৎ উপস্থিত। আর এ হেন চিন্তা-চেতনার কারণে আমি আমার নেতাকে নিয়ে কিছু গান লিখে ফেললাম। সামনে নির্বাচন, নির্বাচনী গান। গানের বোদ্ধাদের বিচারে এগুলো গান হবে না আমি জানি। কারণ আমি গীতিকার নই আর কবিত্বের ছিটেফোঁটাও আমার নেই। সে ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত। এগুলো ছিল আমার নেতার প্রতি আমার সহজ সরল সমর্থনমূলক সম্মান।
বেশ কিছুদিন পর, কালকিনি উপজেলার সাহেবরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিরাট জনসভা। আমার জানা মতে, এই প্রথম আমার নেতা সাহেবরামপুরে যাচ্ছেন। পাশেই সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম কলেজ। হাইস্কুল মাঠটি সর্ব বিবেচনায় তুলনামূলকভাবে ভালো বিধায় সেখানেই মিটিং করার সিদ্ধান্ত হলো। চারদিক থেকে হাজার হাজার লোক মিছিল সহকারে মিটিঙে এসে হাজির হচ্ছে, তাদের প্রিয় নেতাকে এক নজর দেখার জন্য। শিশু-কিশোর, যুব-যুবা, পরিণত বয়স্ক, বিধবা, বৃদ্ধ নর-নারী শত কষ্ট-যন্ত্রণা উপেক্ষা করে বন্যার স্রোতের মতো তাদের প্রিয় মানুষ, তাদের স্বপ্নের মুখ দর্শন করবেন বলে। যথানিয়মে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সভার কার্য শুরু হল। এত বড় সভায় পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। দেখে অভিভূত হলাম, বিস্মিত হলাম। সভার মূল পর্ব শুরু হলো ‘জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে কণ্ঠদানে দু’জন ছাত্রী এবং নেতৃত্বে আমি। সভায় আরও একটি সঙ্গীত পরিবেশিত হলো। মুহুর্মুহু করতালি যেন থামতে জানে না। আমার প্রিয় নেতা খুশিতে উঠে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং মেয়েদের আশীর্বাদ করলেন। পরে নেতার বক্তৃতার গানের জন্য ষোলো হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেন। তৎকালীন আমার দুই মাসের বেতন। সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম কলেজ উন্নয়নকল্পে পাঁচ লক্ষ টাকা ঘোষণা করেন, যা দিয়ে একটি ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হলো। পরবর্তীকালে উন্নয়ন প্রকল্প দেখে নেতা মন্তব্য করেছিলেনÑ আপনি পাঁচ লক্ষ টাকায় যে কাজ করেছেন, আমি লোক দিয়ে দশ লক্ষ টাকায়ও সে কাজ পাই না।’ সে সভায় পার্শ্ববর্তী বেশ কিছু মসজিদ, মাদ্রাসা এবং হাইস্কুলে প্রতিটিতে পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা করে দান করেছিলেন। সাহেবরামপুর কলেজে এ প্রথম এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রস্থাপনের জন্য বোর্ডের অনুমতি পত্রটিও সভায় আমার হাতে হস্তান্তর করেছিলেন। বিরাট করতালির মাধ্যমে সভা শেষ হলো, এক বিরল অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতিতে জমা হলো।
প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে বা যে কোনো ব্যাপারে মহোদয়ের সাথে যোগাযোগ করেছি, শত ব্যস্ততার মাঝেও কোনোদিন বিরক্তির ভাব লক্ষ করিনি। হাসিমুখে সাহস দিয়েছেন, উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। এখানে একটি কথা কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতিস্বরূপ আমাকে অকপটে স্বীকার করতে হয় যে, সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম কলেজটি ছিল আর্থিক দিক থেকে বেশ দুর্বল। সেখানে আমার সংসার পরিচালনার খরচের একটা অংশ আসত মহোদয়ের ব্যক্তিগত খাত থেকে। আরও বছর তিনেক পরের কথা, পদ্মা কলেজ, দোহার, ঢাকা এর অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়ে সাহেবরামপুর কলেজের অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা পত্র মহোদয়ের হাতে দিলাম। পত্রটি পড়ে দলামোছা করে তিনি আমার হাতে দিলেন আর পকেট থেকে কয়েকটি পাঁচশত টাকার নোট বের করে আমার পকেটে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘যান, ছেলে-মেয়েদের জন্য ফল কিনে নিয়ে বাসায় চলে যান।’ বুঝলাম এখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। পরের বার বুঝিয়ে বললাম, ‘স্যার, আমার বিভিন্ন দিক থেকে সুবিধে হয়।’ তখন তিনি অনুমতি দিলেন এবং বললেন, ‘আপনার যদি একান্তই ভালো হয়, তবে যান।’
সাত বছর দোহারে ছিলাম। দুটি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছি। পদ্মা কলেজ এবং মালিকান্দা মেঘুলা স্কুল এন্ড কলেজ। সর্বজনশ্রদ্ধেয় মেজর জেনারেল (অবঃ) ডাঃ এ আর খান, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, সালমান এফ রহমান, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ মোঃ জালাল উদ্দিন প্রমুখ খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলেজ। কলেজের মান ভালো এবং ভালোই চলছিল জীবন-যাপন। এরই মাঝে ডাক এলো। মালিকান্দা কলেজের অফিসে বসে ফোন পেলাম, অপর পাড়ে আমার প্রিয় নেতা। সেই মনভোলানো মধুর হাসিসহ আমাকে তাঁর বাসায় আমন্ত্রণ জানালেন। গেলাম বাসায়। আমাকে সাদরে গ্রহণ করে একটি রুমে বসালেন। অন্য কেউ নেই, আমরা দু’জন। রুমে ঢুকেই বোঝা গেল এখানে তিনি লেখাপড়া করেন। ইতোপূর্বে অবগত হয়েছি যে, তিনি একজন উচ্চমানের লেখকও বটে। মহোদয়ের নিজের লেখা অনেকগুলো বই দেখলাম। তিনি আমাকে আরও কাছে গিয়ে বসার ইঙ্গিত করলেন। দু’জন সামনা-সামনি। কলেজ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা, লেখাপড়ার মানোন্নয়নের ব্যাপারে তাঁর ধারণা, সমাজ ও মানুষের মুক্তি, উন্নতি ও প্রগতির ব্যাপারে তাঁর চিন্তা চেতনা- এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল। গভীর মনোযোগ দিয়ে তাঁকে শুনছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। এতশত কাজের মাঝেও তিনি কীভাবে এসব ব্যাপারে এত সূক্ষ্ম, স্বচ্ছ, বাস্তব ও গঠনমূলক ধারণা পোষণ করেন, তা ভাবতেও অবাক লাগে।
ইতোমধ্যে একটি সুদর্শন ছেলে নাস্তা নিয়ে এল। বিভিন্ন আইটেমে ভরা ট্রে। আমার সবচেয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করল সৌদি আরবের এক ধরনের খেজুর, বাউকুলের মতো বড় ও মোটা, পাকা তালপৃষ্ঠসদৃশ ঝিকঝিকে কালো। এর আগে এ রকম খেজুর আমি দেখিনি। মহোদয় বললেন, “আপনি নিন, আমি একটু ভেতর থেকে আসি।” কিছুক্ষণ পর হাসিমুখে তিনি ঢুকলেন। হাতে তাঁর দুটি স্যুটের কাপড়, দুটি শার্ট এবং কয়েকটি টাই। এগুলো আমার হাতে দিলেন। যে কলেজে আমার যাওয়ার কথা হচ্ছে আর্থিক দিক থেকে কলেজটি তেমন সচ্ছল ছিল না বিধায় প্রতি মাসে তিনি আমাকে ৬০০০ টাকা সম্মানি হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত খাত থেকে দেয়ার কথা বললেন। মালিকান্দা কলেজের সুযোগ সুবিধা থেকে প্রস্তাবিত সুযোগ-সুবিধা যদিও অনেক কম, তবু আমি বিন্দুমাত্র অসন্তোষ প্রকাশ করিনি। স্বেচ্ছায় তিনি যে অফার দিয়েছেন, তাতেই নিজেকে ধন্য মনে করেছি, গৌরবান্বিত হয়েছি। যে সম্মান দেখিয়েছেন, কোনোভাবেই আমি এর যোগ্য নই। প্রায়শই মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে কায়মনো বাক্যে এ প্রার্থনা করতাম- গায়ের রক্ত দিয়ে যদি এ উপকারের প্রতিদান দিতে পারতাম, তবে নিজেকে সফল, স্বার্থক ও ধন্য মনে করতাম। আর সে কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল কলেজটিতে বিনা দ্বিধায় চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বিদায় নেয়ার সময় হলো। উঠে দাঁড়ালাম। তিনি আমার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিলেন মাদারীপুর আসা যাওয়ার যাতায়াত খরচ বাবদ এবং হাসতে হাসতে বললেন“ মাদারীপুরের খিরপুরী নিয়ে বাসায় যাবেন”। মহোদয় আমাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেইট পর্যন্ত আসলেন। আমার কাঁধের উপর আলতোভাবে হাত রেখে বললেন, “আমি যে সম্মানির কথা বলেছি, যতদিন আপনি আমার কলেজে দায়িত্ব পালন করবেন ততদিন পাবেন।” ড্রাইভারকে ডেকে গাড়িতে করে আমাকে গুলিস্তানে পৌঁছে দিতে বললেন। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। তাঁর সহজ-সরল শিশুর মতো আন্তরিকতাময় কথাবার্তা জীবনে ভুলব না এবং তা আমার অন্তরাকাশে ধ্র“বতারার মতো উড্ডীয়মান থাকবে চিরদিন। কৃতজ্ঞতায় আমার অন্তর ভরে গেল। ভাবতে লাগলাম, এত আন্তরিক মানুষ হতে পারে! এত দূরের মানুষ- কোথায় ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ঝুনারচর গ্রামের এক অখ্যাত মানুষকে এত সহজে কাছে টেনে নেয়া, সত্যি এটি কেবল মহোদয়ের মতো অনন্যসাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব।
আমার নেতার আচার-আচরণ, চিন্তা চেতনা, সহানুভূতি মানবতাবোধ, উন্নতি ও প্রগতির ভাবনা, তাঁর সার্বিক ব্যক্তিত্ব আমার অন্তরে এত গভীর রেখাপাত করেছে যে, প্রায় সবসময় তিনি আমার চেতনায় জাগরূক থাকেন। আমার হৃদয়ের ভালোবাসার শ্রদ্ধার আসনের স্বর্ণশিখরে তিনি অবস্থান করেন। এ রকমটি খোদার দুনিয়ায় আর দশটির বেশি মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলে আমার বিশ্বাস। এটি আমার একেবারেই ব্যক্তিগত ধারণা। প্রায়ই এ চিন্তাটি আমার মনে আসে কিন্তু কোনোদিন প্রকাশ করতে পারিনি।
জ্ঞান বিস্তারে, লেখাপড়ার মানোন্নয়নে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার ব্যাপারে সারা দেশে তাঁর জুড়ি নেই। সুপ্রতিষ্ঠিত পাঁচটি কলেজের তিনি সফল প্রতিষ্ঠাতা। (১) ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এন্ড কলেজ- মহোদয় এর স্বর্গীয় পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত। (২) শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজ- উপজেলার একমাত্র মহিলা কলেজ, জাতির জনকের কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনার নামে প্রতিষ্ঠিত। (৩) কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, কালকিনি; (৪) সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ খোয়াজপুর, টেকেরহাট এবং (৫) খাসেরহাট সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ। এছাড়া অনেকগুলো প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল এবং মাদ্রাসার তিনি প্রতিষ্ঠাতা। এতগুলো প্রতিষ্ঠানের একক প্রতিষ্ঠাতা আমার জানামতে বাংলাদেশে আর দ্বিতীয় জন নেই।
প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেই তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজখবর রাখা, লেখাপড়ার মান উন্নয়ন, পাবলিক সকল পরীক্ষায় প্রশংসনীয় ফলাফল, প্রয়োজনীয় অর্থ যোগান, শিক্ষক-কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা বিধান, সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, আধুনিক শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে শিক্ষা দান, ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা, গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ানো, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ও পোশাক সরবরাহ করা, লেখাপড়া শেষ করার পর তাদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে সাহায্য করাÑ এ সমস্ত বহুবিধ কাজ তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে করে থাকেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত পাঁচটি কলেজে প্রায় সাড়ে তিনশ শিক্ষক-কর্মচারীর প্রত্যেককে তিনি দুই সেট করে সাফারি স্যুট উপহার দিয়েছেন। ডি.কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ ও শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজর প্রায় সাড়ে আটশ ছাত্রছাত্রীর প্রত্যেককে দুই সেট করে কলেজ-ড্রেস উপহার দেন। গ্রামাঞ্চলের গরিব-দুঃখী মানুষের আর্থিক দীনতার কথা বিবেচনায় এনে এবং নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের লক্ষ্যে শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজের প্রায় সাড়ে পাঁচশত ছাত্রীর ভর্তি ফ্রি, পাঠ্যপুস্তক ফ্রি, বেতন ফ্রি, এ (প্লাস) এবং এ গ্রেড ছাত্রীদের খাওয়া ফ্রি, সমস্ত ছাত্রীহোস্টেলে থাকার জন্য প্রত্যেকের খাট, মেট্রেস, লেপ, তোষক, বালিশ, টেবিল, চেয়ার সমস্ত কিছু মহোদয় ব্যক্তিগতভাবে ব্যবস্থা করেছেন। বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এক মিনিটের জন্য মেয়েদের অন্ধকারে থাকতে হয় না এবং তাদের লেখাপড়ার কোনো ক্ষতি হয় না। ডাসার-এর মতো একটি প্রত্যন্ত গ্রামে এটি কল্পনা করাও অসম্ভব।
মহোদয়গৃহীত এ সমস্ত যুগান্তকারী পদক্ষেপের কারণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরীক্ষার ফলাফল অত্যন্ত ভালো এবং প্রশংসনীয়। শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাবলিক পরীক্ষায় পাশের হার শতকরা ৮০ ভাগের বেশি এবং বর্তমান বছরে পাশের হার ৯৩ ভাগ। একেবারেই প্রত্যন্ত গ্রামে প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজÑ যার ছাত্রী গার্ডিয়ানদের ৮০ ভাগের অধিক দরিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে, যাদের নুন আনতে পান্তা পুরোয় সে সমস্ত মেয়েদের পাশের হার বরাবরই এ পর্যায়ে বজায় রাখা আমার মতে সত্যি আশ্চর্যজনক এবং অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এটি কেবল সৈয়দ আবুল হোসেনের নিবিড় পরিচর্যার কারণে সম্ভব হয়েছে।
পাশাপাশি আর একটি কলেজ ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ; এ কলেজটিও প্রতিষ্ঠালগ্ন (১৯৯৪) থেকে অত্যন্ত ভালো ফলাফল করে আসছে। পাশের হার প্রশংসনীয় পর্যায়ে বজায় রাখাসহ প্রতি বছরই বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান দখল অব্যাহত রেখে চলেছে। এ কলেজের ছাত্র ছাত্রছাত্রীগণ প্রথম এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১৯৯৬ সনে। এইচএসসি পরীক্ষায় বিভিন্ন বছর কলেজটির ছাত্রছাত্রীদের মেধা তালিকায় অধিকৃত স্থানের বিষয়ে একটি তালিকা নিচে দেয়া হলো :

পরীক্ষার সন মেধা তালিকায় স্থান
মানবিক কারিগরি 
১৯৯৬ ১৬-তম
১৯৯৭ ৩য় ও ৯ম ৫ম
১৯৯৮ ১৩-তম
১৯৯৯ ১ম, ২য়, ৩য়, ৫ম ৮ম
৮ম, ১৫-তম 
২০০০ ১৭-তম
২০০২ ৮ম
মহোদয় প্রতিষ্ঠিত সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ খোয়াজপুর, টেকেরহাট এবং কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজও লেখাপড়ার ব্যাপারে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছে। কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বেশ কিছু সাবজেক্ট-এর উপর অনার্সসহ এমএ পাশ করার সুযোগ রয়েছে। গ্রামে থেকে নিতান্তই গরিব মানুষের ছেলেটি বা মেয়েটি ঘরের পান্তা খেয়ে অনার্সসহ এমএ পাশ করার সুযোগ পাচ্ছে-এ তো কল্পনার অতীত। উপজেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ সত্যি বিরল। এলাকার গরিব মানুষ যে কত উপকৃত হচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মহোদয় বলেছিলেন, “আমি চাই আমার এলাকায় বিএ/ এমএ পাশ ছাড়া কোনো ছেলে মেয়ে থাকবে না”। সে লক্ষ্যেই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন এবং নিজের কষ্টার্জিত সম্পদ দু‘হাত দিয়ে অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছেন। লেখাপড়ার সাথে সাথে ছেলে-মেয়েদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড- কবিতা আবৃতি, গান, অভিনয়, ধর্মীয় প্রতিযোগিতা এবং খেলাধুলায় মহোদয় আর্থিক যোগানসহ ব্যাপক উৎসাহ যুগিয়ে থাকেন।
ব্যক্তিগত জীবনে বড় ধরনের কোনো অপ্রাপ্তির জন্যও তাঁকে কোনোদিন আক্ষেপ বা আফসোস করতে দেখিনি। ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে যে, এ কি করে সম্ভব! খুব বড় ধরণের অপ্রাপ্তির ব্যাপারেও তাঁকে টু শব্দটি উচ্চারণ করতে এমনকি তাঁর চেহারায় কোনোভাবে অসন্তোষ বা হতাশার চিহ্ন লক্ষ করিনি। প্রায়ই একটা বিষয় আমার চিন্তায় আসে যে, বর্তমান সময়ে একজন মানুষ কিভাবে একসাথে অতগুলো দুর্লভ গুণের অধিকারী হতে পারে। অনেক ভেবেচিন্তে একটা উত্তর আমি খুঁজে পেয়েছি- সেটি হচ্ছে মহোদয় এর মাতা-পিতা ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ। বিশেষ করে তাঁর জান্নাতবাসিনী মা-এর নাকি তুলনাই হয় না, এলাকার অনেক মুরুব্বির মুখ থেকে আমি তা শুনেছি। মহোদয় তাঁর মাতা-পিতার আন্তরিক দোয়া পেয়েছিলেন।
সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো এত বিশাল ব্যক্তি এবং ব্যক্তিত্বের বিন্দু বিসর্গও আমার পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই আমি আমার অজ্ঞতা স্বীকার করে করজোড়ে মহোদয় এবং পাঠক সমাজের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কারণ, যে ব্যক্তিত্বের মূল্যায়নে সেক্সপিয়রের মতো বিষয়বস্তুর সার্বজনীনতা প্রয়োজন, মিল্টনের মতো অকাট্য যুক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা আবশ্যক, রবীন্দ্রনাথের মতো বাণী ও সুরের অমিয় ধারায় অবগাহন করে কল্পনার বিষয়কে চরম এবং পরম বাস্তবে রূপায়নের প্রতিভা প্রয়োজন, পছন্দ-অপছন্দ কিংবা ঘৃণা প্রকাশে নজরুলের মতো বিদ্রোহের আগুনে জ্বলে ওঠা প্রয়োজন, সুকান্তের মত সমাজ সচেতনতা এবং অন্তর্দহন প্রয়োজন, বিভূতিভূষণের মতো বর্ণনার শক্তি থাকা বাঞ্ছনীয়, জীবনানন্দ দাশের মতো নির্ভেজাল প্রকাশ আর জসিম উদ্দীনের মতো সহজ-সরল বর্ণনা ও বাক্য চয়ন প্রয়োজন, সেখানে আমার মতো সাধারণ একজন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষকের দ্বারা মহোদয়কে প্রকাশ করার চেষ্টা নিতান্তই বালখিল্যতা। তবে আমি চেষ্টা করেছি, মনপ্রাণ এবং হৃদয়ের সকল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা উজাড় করা আন্তরিকতা দিয়ে। পুকুরের জল দ্বারা মহাসমুদ্রের জলরাশি ধারণ করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় আমার মতো সাধারণ একজন ব্যক্তির দ্বারা মহোদয়ের মতো বিশাল একজন ব্যক্তিকে কোটি ভাগের একভাগও প্রকাশ করা।
মহোদয়কে প্রকাশ করা প্রয়োজন, প্রয়োজন মহোদয়ের জীবনধারা এবং প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড জনসমক্ষে তুলে ধরা। তাহলে আমাদের মধ্যে এবং পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হবে। তাঁকে অনুসরণ করে অনেকে তাঁর মতো হতে চেষ্টা করবেন যারা আমাদের দেশকে মহোদয়ের মতো ভালোবাসবেন, শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে আসবেন, এগিয়ে আসবেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণে। আমার প্রত্যাশাÑ নবপ্রজন্ম সৈয়দ আবুল হোসেনের বিষয়ে আরও গবেষণা করবেন।
মো. জসিম উদ্দিন : অধ্যক্ষ, ডি.কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ, কালকিনি, মাদারীপুর।

খুঁজে বেড়াই তারে
অধ্যাপক মনোরঞ্জন দাশ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শনে সদ্য মাস্টার্স করে চাকুরি খোঁজার মানসে ঢাকায় বসবাস করছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে যখন যার সাথে সুযোগ পেতাম তার কক্ষে রাত কাটাতাম। সারাদিন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ঘুরতাম আর আড্ডায় আড্ডায় দেশ উদ্ধার করতাম। একদিন আমাদের আলোচনায় একটি ছাত্র যোগ দেয়। নতুন ভর্তি হয়েছে। শিবচরের কানু দা, যার পুরো নাম আমার মনে নেই ছেলেটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, সৈয়দ আবুল হোসেন, ব্যবস্থাপনা বিভাগে প্রিলিমিনারির ছাত্র।
সৌম্যকান্ত চেহারা, অনেকটা আমাদের সবচেয়ে সুদর্শন দেবতা কার্তিকের মতো। গোলাকার মুখে হাসি পুরো লেপটে। চোখে নিষ্পাপ যোজনায় সারল্যের মুখরতা। সালাম দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। হয়ত সে তখনও জানত না আমি হিন্দু। টিএসসি-এর বারান্দায় ততক্ষণে অনেক ছাত্র জমে গেছে। সৈয়দ আবুল হোসেন মন দিয়ে আমাদের কথা শুনছিলেন। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে আমি তার দিকে খেয়াল রাখছিলাম। নতুনের প্রতি সবার মতো আমারও আকর্ষণ। একটি কথাও বলছে না। একটু অস্থিরতাও নজরে পড়েনি। এ বয়সে তার স্থিরতা দেখে অবাক নাÑ হয়ে পারলাম না। এমন ধীরস্থিরগণই শেষ পর্যন্ত সাফল্যের বরমাল্যে ভূষিত হন। এটি ব্যক্তিত্বের লক্ষণ। ঐ বয়সে আমার সাথে তাকে তুলনা করলাম। আকাশ পাতাল তফাৎ। প্রথম দর্শনে সে আমাকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হলো। আমি বুঝলাম একটি কথা না-বলেও মানুষ মানুষকে আকর্ষণের জালে জড়িয়ে নিতে পারে। এ জন্য বলা হয় ফেইস ইজ দ্যা ইনডেক্স অব মাইন্ড।
আমি তাকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলাম। প্রথমে রাজি নাÑহলেও সবার অনুরোধে রাজি হলেন। সেদিন তিনি কি বলেছিলেন তা হুবুহু বলতে পারবÑ এমন বলাটা মিথ্যা হবে। তবে যা বলেছিলেন, তা আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। গ্রাম হতে সদ্য ঢাকায় আসা একটি ছেলে আমাদের মতো পোড়খাওয়া সিনিয়রদের অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সহাবস্থান ও সহনশীলতাই গণতন্ত্রের মূল কেন্দ্র। এ দুটোর সমন্বয় ঘটাতে নাÑপারলে গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেম। তবে জাতীয়তাবোধ যেন উগ্রতায় পর্যবসিত নাÑহয়। শিক্ষা তখনই প্রকৃত অর্থে আমাদের ঋদ্ধ করতে সক্ষম হয় যখন আমরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিনয়ী ও শ্রদ্ধাশীল হই। গণতন্ত্র কোনো একক বিষয় নয়, অনেকগুলো বিষয় এর সাথে জড়িত। গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয় যখন প্রত্যেক মানুষের স্বকীয় চিন্তা আপন আলয়ে স্বাধীনভাবে উচ্চকিত হওয়ার পরিবেশ পায়। সহাবস্থান, সহনশীলতা ও শিক্ষার মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করা যায়। তাই ছাত্রদের উচিত আগে জ্ঞান অর্জন করা। জ্ঞান তখনই অর্জিত হবে বলে ধরে নেয়া যাবে, যখন ব্যক্তি নিজের সুখের জন্য অন্যের সুখ হরণকে অত্যন্ত গর্হিত মনে করবে। পক্ষান্তরে, সবার সুখ নিশ্চিত করার জন্য আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হবে। রাজনীতি বড় কঠিন পথ। ছাত্রদের বেলায় কথাটি আরও বড় সত্য। রাজনীতিকে ভালোভাবে অনুধাবনের মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জিত নাÑ হওয়া পর্যন্ত তাতে জড়িয়ে পড়া উচিত নয়। পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জিত হলে রাজনীতি আপনাকে, আমাকে নিজেই খুঁজে নেবে।’
আমরা অবাক হয়ে তার কথা শুনেছিলাম। বক্তব্য শেষে প্রচণ্ড তালিতে তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। আমি জানি না, সে কথা তার এখন মনে আছে কিনা। এরপর তার সাথে আরও কয়েক বার দেখা হয়েছে। তবে কেমন আছেন- ছাড়া তেমন কথা হয়নি। তিনি খুব বেশি একটা আড্ডায় আসতেন না, তবে কোনো প্রস্তুতি ছাড়া যে কোনো বিষয়ে ইংরেজি ও বাংলায় সমান অনর্গলভাবে বলে যেতে পারতেন। এ ঘটনার অল্প কয়েক মাস পর দর্শন বিদ্যার প্রভাষক হিসেবে আমার চাকুরি হয়ে যায়। অনেক মুখের ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যান সৈয়দ আবুল হোসেন তবে সে হারিয়ে যাওয়া ছিল ক্ষণিকের।
১৯৮০-এর দশকের কথা। বন্যায় ত্রাণ দিতে শরীয়তপুর গেলাম। দেখি অনেক দুর্গত লোকের গায়ে মানুষের ছবিওয়ালা একটি গেঞ্জি। ছবিটা দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে পড়ে গেল। ছাত্র রাজনীতির উপর বক্তব্য দিয়ে এ ছেলেটিই আমাদের সহনশীল রাজনীতির দীক্ষা দিয়েছিলেন। সৈয়দ আবুল হোসেন নামটি ত্রাণকর্তার সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাজার হাজার বন্যাক্রান্ত লোক সৈয়দ আবুল হোসেনের দানে আবার উঠে দাঁড়ানোর উপযোগ খুঁজে পেয়েছে। আমার বুক গর্বে উদ্বেল হয়ে উঠল। সৈয়দ আবুল হোসেন, যার উদারতায় হাজার হাজার দুর্গত লোক অন্নবস্ত্র পাচ্ছে, তিনি আমার পরিচিত। সহকর্মীদের খুব গর্বের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ঘটনাটা শুনিয়ে দিলাম।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে আমরা একটা কলেজ করার উদ্যোগ নিই। আমার সাথে সৈয়দ আবুল হোসেনের পরোক্ষ পরিচয় আছে শুনে প্রতিষ্ঠাতা আমাকে তার কাছে যেতে বললেন, সময়টা সম্ভবত ১৯৯২, তখন তিনি বিরোধী দলীয় এমপি। ঢাকার মতিঝিলের আমিনকোর্টে তার অফিসে গেলাম। জামান নামের এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হলো। কি জন্য এসেছি জানতে চাইলে উদ্দেশ্যের কথা বললাম। জামান সাহেব জানালেন তিনি নেই। কয়েক দিন পর আবার গেলাম, কিন্তু সেবারও তার সাক্ষাৎ পাইনি। তমিজ উদ্দিন নামের এক লোকের সাথে আলাপ হলো। তিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ। শিক্ষক জানতে পেরে আমাকে সম্মান দেখালেন এবং আশ্বস্ত করে বললেন, ‘সৈয়দ আবুল হোসেনকে কথাটা বলতে পারলে আপনার উদ্দেশ্য সফল হবে’। কয়েকদিন পর আবার যেতে বললেন তিনি কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। কলেজ আমরা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, তবে এখনও ভাঙাচুরা। সৈয়দ সাহেবের দেখা পেলে হয়ত আমাদের কলেজটা তখন একটি পাকা ভবন পেয়ে যেত।
আমার এক আত্মীয় সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজে প্রভাষক পদের জন্য দরখাস্ত করে, মাদারীপুরের ছেলে। গ্রামের বাড়িতে থেকে কলেজে শিক্ষকতা করার খুব শখ। চাকুরিটা পেতে সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রভাবিত করার জন্য আমাকে ধরে বসেন। আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে দেখা করে এ বিষয়ে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিই। ইন্টারভিউর কয়েকদিন আগে আমি আমিন কোর্টে অবস্থিত সাকো অফিসে যাই। সেখানে অনেকের মধ্যে আজিজ মাস্টার নামক একজন লোকের সাথে আমার কথা হয়। তিনি জানালেন, অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন ও কাদের সাহেব কলেজের বিষয় দেখভাল করছেন।
সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে আমার পূর্বাপর পরিচয়ের কথা বিধৃত করলাম। আমার উদ্দেশ্যের কথা শুনে কাদের সাহেব আঁতকে উঠলে বললেন, ‘অমন কাজ করবেন না। ইন্টারভিউতেও ডাকবে না। তিনি নিজের রক্তের চেয়েও শিক্ষাকে বড় জানেন। সৈয়দ আবুল হোসেন মনে করেন, ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো শিক্ষার্থী গড়া যায় না। আপনার আত্মীয় যোগ্য হলে এমনিতেই চাকুরি পেয়ে যাবেন। তাকে প্রভাবিত করতে এসেছেন জানলে লজ্জা পাবেন।’ লজ্জা পাবেন কেন? আমার প্রশ্নের উত্তরে কাদের সাহেব বলেছিলেন, ‘কারণ তিনি আপনাকে না-ও করতে পারবেন না, আবার হ্যাঁ-ও বলতে পারবেন না। এসব ক্ষেত্রে তিনি পাহাড়ের মতো অনড়। নিয়োগে এক বিন্দু দুর্নীতি কিংবা স্বজনপ্রীতি করেন না।’ কাদের সাহেবের কথা শুনে মনে কষ্ট পেলেও বাংলাদেশে এমন সৎ এবং বাস্তব আদর্শের মানুষ আছেন জেনে পুলকিত হয়ে উঠলাম। আমি তার সাথে দেখা নাÑকরা উত্তম মনে করে চলে আসি। দুঃখের কথা, আমার সে আত্মীয় ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন কিন্তু চাকুরি হয়নি। ইন্টারভিউ এবং নিয়োগ সম্পর্কে আমার সে আত্মীয় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘নিয়োগে বিন্দুমাত্র কারচুপি হয়নি। যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং যারা চাকুরি পেয়েছেন তারা সত্যিকার অর্থে যাদের হয়নি তাদের চেয়ে মেধাবী।’
১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের কথা। আমি একটা জরুরি কাজে ঢাকা যাচ্ছিলাম। দেখি মাদারীপুর এসে গাড়ি থেমে আছে। বিরক্ত হয়ে গাড়ি হতে নামলাম। চারিদিকে লোক, লোক আর লোক। কারও হাতে ফেস্টুন, কারও হাতে ব্যানার। ভুরঘাটায় তিল রাখার জায়গা নেই। জানতে পারলাম, সৈয়দ আবুল হোসেন আসবেন। তাকে এক নজর দেখবেন, স্বাগত জানাবেন এ জন্য এত সমাগম। আমাদের গাড়ি ঐ দিন দেড় ঘণ্টা মতো দাঁড়িয়ে ছিল।
সৈয়দ আবুল হোসেনের এত জনপ্রিয়তা দেখে আমি ভাবপ্রবণ হয়ে পড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যক্ত তার কথাগুলো মনে পড়ে যায়: রাজনীতিকে ভালোভাবে অনুধাবনের মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জিত নাÑহওয়া পর্যন্ত তাতে জড়িয়ে পড়া উচিত নয়। পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জিত হলে রাজনীতি আপনাকে, আমাকে নিজেই খুঁজে নেবে।’ তিনি রাজনীতিতে আসতে চাননি, জনগণ এক প্রকার জোর করেই রাজনীতিতে টেনে এনেছেন। রাজনীতিক জ্ঞানে ঋদ্ধ হয়েছেন বলেই রাজনীতি সৈয়দ আবুল হোসেনকে খুঁজে নিয়েছে।
মনোরঞ্জন দাশ : সাবেক অধ্যাপক, লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক।

মহানুভব এক মহানায়ক
অধ্যক্ষ প্রকাশ চন্দ্র নাগ
“আসিলে ধরায় তব বিজয় তিলক পরে কপালে,
আপন মহিমায় জ্ঞানের আলোয় ভূলোক ভরিলে।”
ঠরহর, ারপর, ারফর, এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। অষবীধহফবৎ ঃযব এৎবধঃ সম্পর্কে এমনটি শুনেছিলাম সেই কৈশোরে, যিনি জন্মেছিলেন যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও ৩৬৫ বছর পূর্বে। আর এ যুগে যার ক্ষেত্রে উল্লিখিত মন্তব্যটি আমার নিকট সত্য বলে প্রতিভাত হয়, তিনি হলেন আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন। ভেবে পাই না, তার জন্ম মুহূর্তে অবনী কেমন সাজে সেজেছিল? হয়ত-

সেদিন ঊষায় নব রক্তরূপে
দীপ্ত তেজে উঠেছিল জেগে
বিভাবসু। জানাতে তার অরুণিমায়
এ মহাবিশ্বে এসেছে এক জ্যোতির্ময়।
লতা-গুল্ম-বৃক্ষ মিলে সবে
সেজেছিল নব পুষ্প পল্লবে।
ভোরের নির্মল বাতাস
ভরে দিয়েছিল কুসুম সুবাস।
পাখিরা মধুর কণ্ঠে ধরেছিল কলতান,
শোনাতে তারই আগমনী গান।

যার সম্পর্কে কিছু লিখব বলে কলম নিয়ে বসেছি, তার কাছে তো আমি সমুদ্রের কাছে গষ্পোদসম। তবুও কিছু লেখার চেষ্টা করছি। তাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম যে, তার ভেতরে অন্তর্নিহিত রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। সেদিন আমার মেজো-মামা আমাকে নিয়ে তার কাছে গিয়ে বলেছিলেন ও আমার ভাগ্নে। শুনে তিনি বলেছিলেন, অর্জুন তোমার ভাগ্নে তো আমারও ভাগ্নে। এ হলো সেই ১৯৮৯ সালের কথা। সে কথাটি আজও আমার কানে বাজে।
১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯, আমরা সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ-এ নিয়োগপ্রাপ্ত এক ঝাঁক তরতাজা যুবক, শিক্ষকতার ইচ্ছায় মতিঝিলে “সাকো” (তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান)-তে সাক্ষাৎ করি দুপুরের দিকে। তিনি আমাদেরকে কিছুটা সময় দিলেন। আমাদের সাথে খানিকটা আলাপ-আলোচনাও করলেন, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল শিক্ষক হিসেবে আমাদের করণীয় বিষয়সমূহ এবং পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভালো ফল অর্জন। আমাদেরকে কিছু সুযোগ সুবিধা দেয়ার কথাও বললেন। সকলের জন্য দুপুরে লাঞ্চের ব্যবস্থা করলেন ওখানেই। ঐদিনই সবাইকে কয়েকটি গাড়িতে করে মাদারীপুর পেঁৗঁছানোর ব্যবস্থা করলেন। সাথে কলেজের জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও পাঠিয়ে দিলেন। সকল শিক্ষকের জন্য ড্রেসও দিয়েছিলেন সাথে। (পুরুষ শিক্ষকদের জন্য নেভি ব্লুু কালারের হাফ সাফারি, ঐ রঙের হাফ সাফারি পরিহিত অবস্থায়ই তাকে প্রথম দেখেছিলাম। মহিলা শিক্ষকদের জন্য ছিল ক্রিম কালারের ওপর হাল্কা ছাপার শাড়ি। অধ্যক্ষ মহোদয়কে দিয়েছিলেন শেরওয়ানি। ) অধ্যক্ষ মো. তমিজউদ্দিন মহোদয়কে মাদারীপুর থেকে কলেজে যাতায়াতের জন্য একটি লাল রঙের জিপের ব্যবস্থাও করেছিলেন, যেটিতে লেখা ছিল কলেজের নাম। যে পর্যন্ত কলেজ ক্যাম্পাসে অধ্যক্ষ শিক্ষকবৃন্দের থাকার ব্যবস্থা নাÑহয়েছিল সে পর্যন্ত সবাইকে মাদারীপুরে থাকার ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন।
প্রথম ব্যাচে ভর্তিকৃত সকল ছাত্র-ছাত্রীকে বিনা খরচে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ করে তাদের থাকা খাওয়াসহ যাবতীয় খরচ তিনিই বহন করেন। এর সুফলও তিনি পেয়েছিলেন তাদের অর্জিত ফলাফলের মাধ্যমে। কলেজটি এমপিও ভুক্ত না-হওয়া পর্যন্ত অধ্যক্ষসহ শিক্ষক কর্মচারীদের বেতনের ব্যবস্থাও তিনি নিজেই করেছেন। অধ্যক্ষ মহোদয়কে তিনি পিতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন। কারণ গৌরনদী কলেজে ছাত্র থাকাকালীন অধ্যক্ষ মহোদয় গৌরনদী কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অধ্যক্ষ মহোদয়ও তাকে অত্যন্ত স্নেহের পাত্র হিসেবে গণ্য করতেন, যে কথা তিনি একাধিকবার আমাদের বলেছেন। 
অধ্যক্ষ মহোদয় সরকারি কলেজ থেকে অবসরপ্রাপ্ত হওয়ায় এমপিও ভুক্তির আওতায় আসবেন না বিধায় শুরু থেকে তিনি যে পর্যন্ত ছিলেন সে পর্যন্ত আলাদাভাবে তার জন্য উচ্চতর বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করেছেন। অধ্যক্ষ মহোদয়ের প্রতি তার এ শ্রদ্ধাবোধ থেকেই শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, যা তার আচরণেও বিভিন্ন সময়ে ফুটে উঠেছে।
১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯ ঢাকা থেকে কলেজে আসার পর দু-চারবার তার সাথে দেখা করার সুযোগ হয়েছে। যদিও খুব কাছ থেকে আলাপের সুযোগ কখনও হয়নি। যতবারই দেখা হয়েছে আমরা শিক্ষকরা সবাই একত্রিত হয়ে গিয়েছি কলেজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী কিংবা কলেজ সংক্রান্ত কোনো দাবি পূরণের ক্ষেত্রে তাকে কখনও না, বলতে শুনিনি। তাকে যতই দেখেছি ততই অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি। মনে মনে ভেবেছি এমন মানুষও পৃথিবীতে হয় নাকি! চোখে মুখে দেখি নি কখনও কোনো বিরক্তির ছাপ। সদা হাসিমাখা মুখখানি, যেখান থেকে দৃষ্টি ফেরানো ভার। বিধাতা তাকে কি উপাদানে গড়েছেন সেটা একমাত্র তিনিই জানেন।

জানি না সেদিন কোন খেয়ালের বশে
বিধাতা সৃজিলে তোমায় সবটুকু ভালোবেসে।
যা কিছু দেওয়ার সবই যে তোমায় দিলে
একে একে যে সবই জয় করে তুমি নিলে।

মানবকল্যাণ ও মানবসেবায় এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তার পদচারণা নেই। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, কিংবা করালগ্রাসী বন্যায় যখন এ দেশের মানুষ দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখনই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান তিনি। অর্থের অভাবে যখন কেউ মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না, চিকিৎসা করাতে পারছেন না কিংবা ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে পারছেন না সেক্ষেত্রেও তিনি উদার হস্তে দান করে যাচ্ছেন। অসহায় মানুষের জন্য তিনি সবসময় সাহায্য সহযোগিতার দরজা খুলে রাখেন। এমন একজন মানবপ্রেমী, মানবদরদি মানুুুুুুুুুষ সত্যিই এ যুগে বিরল।

চিত্ত তার উদার গগন সম,
হৃদয়ের ভাষা নিপুণ অনুপম।
পরহিতে সদা কাঁদে যার মন,
অসহায় মানুষের বড় যে আপন।

শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এ দেশে তার সমতুল্য অন্য কেউ আছেন কি না আমার জানা নেই। শিক্ষা বিস্তারের মহান ব্রতকে সামনে রেখে প্রথমেই তিনি গড়ে তোলেন ১৯৮৯ সালে মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলাধীন খোয়াজপুর গ্রামে সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ। সেখানকার শিক্ষায় অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার আলো বিস্তারের লক্ষ্যে। এই কলেজটিই অর্জিত ফলাফলের মাধ্যমে সমস্ত দেশব্যাপী তাকে সর্বপ্রথম শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিত করে তোলে। আর সেই সুনাম সুখ্যাতির মানসেই বোধ হয় তিনি শিক্ষাবিস্তারে আরও অধিকতর ব্রতী হয়ে ওঠেন। এরপর আর থেমে থাকেননি তিনি। তার মহান ছোঁয়ায় ১৯৯২ সালে তৎকালীন “কালকিনি কলেজ” নবরূপে নবজীবন লাভ করে ‘কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ’ নামে, যেখানে এ দেশে প্রথম বেসরকারি পর্যায়ে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। ১৯৯৪ সালে তিনি তার নিজ জন্মস্থান কালকিনি উপজেলার ডাসারে অবস্থিত ডি.কে. আইডিয়াল স্কুলকে তার পিতার নামানুসারে ডি.কে. আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এ্যান্ড কলেজ-এ রূপান্তরিত করেন। সবকিছুই করেছেন তিনি নিজস্ব অর্থায়নে। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে সম্পূর্ণ নতুনরূপে ডাসারেই গড়ে তোলেন বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশরতœ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার নামে “শেখ হাসিনা একাডেমী এ্যান্ড উইমেন্স কলেজ”। এখানে তিনি গড়ে তুলেছেন আধুনিক নান্দনিক সুরম্য অট্টালিকা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় ব্যয়ভার তিনিই বহন করে আসছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান অর্থ বছরে এমপিওভুক্ত হয়েছে। এখনও ছাত্রীদের থাকা-খাওয়াসহ যাবতীয় ব্যয়ভার তিনিই বহন করছেন। বর্তমানে তিনি মাদারীপুর সদর উপজেলাধীন উত্তর কলাগাছিয়ায় অবস্থিত এবিসিকে কলেজটিও নিজের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুনভাবে গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা করছেন। এছাড়াও তার সংসদীয় এলাকায় এমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে তিনি কম-বেশি আর্থিক সহায়তা প্রদান করেননি। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠানেও তিনি বরাবরই সাহায্য সহযোগিতা করে আসছেন। মানুষ তো নন তিনি, যেন এক “মহামানব” এক “পরশপাথর”।
সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর এলাকাবাসী ও শিক্ষকদের তিনি বলেছিলেন, ‘কলেজে আমি সেদিনই আসব, যেদিন এ কলেজটি সারাদেশে পরিচিতি লাভ করবেÑ পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের মাধ্যমে।’ হলোও তাই, ১৯৯১ সালে প্রথম এইচএসসি পরীক্ষায় বাণিজ্য শাখায় ঢাকা বোর্ডের মেধা তালিকায় ১ম ও ৪র্থ স্থান অধিকার করে যথাক্রমে জাহিদ হোসেন পনির ও মনোয়ার হোসেন লাভলু। এরপর প্রায় প্রতি বছরই এ কলেজ থেকে বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। ১৯৯৩ সালে ৩টি, ১৯৯৪ সালে ৭টি, ১৯৯৫ সালে ৩টি, ১৯৯৬ সালে ৪টি, ১৯৯৭ সালে ১টি এবং ১৯৯৯ সালে ১টিসহ মোট ২১ জন শিক্ষার্থী বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান দখল করে। এ-সব কিছুই সম্ভব হয়েছে তার প্রচষ্টায়। কেননা তিনিই সবসময় মেধাবী শিক্ষার্থীদের যাবতীয় খরচ বহন করতেন। ১৯৯২ সালে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেনে বিভিন্ন বোর্ডে মেধাতালিকায় স্থান দখলকারীসহ স্টার মার্কস প্রাপ্তদের থাকা খাওয়াসহ পড়াশুনার যাবতীয খরচ তিনি বহন করবেন। সে বছর এ দেশের সব প্রান্ত থেকে প্রচুর ছেলেমেয়ে এসে ভর্তি হয়েছিল। যার ফলে ১৯৯৪ সালে মেধাতালিকায় সর্বাধিক সংখ্যক (৭টি) স্থান দখল করেছিল এ কলেজের শিক্ষার্থীরা। সমগ্র দেশবাসীর দৃষ্টি কেড়েছিল কলেজটি তার অর্জিত ফলাফলের মাধ্যমে।
তিনি তার কথা রক্ষা করেছিলেন। প্রথম বছর ফল প্রকাশের পর ১৯৯২ সালে তিনি প্রথম কলেজে পদধূলি দিয়েছিলেন। এলাকাবাসী তার উদ্দেশে আয়োজন করেছিল বিশাল সংবর্ধনার। সে কি বিশাল আয়োজন! প্রায় মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল সাজসাজ রব। বেশ কিছুদিন আগেই ঢাকা থেকে পাঠিয়েছিলেন তার ছোট ভগ্নিপতি কাজী এমএ জামান সাহেব-কে (বর্তমানে মরহুম, তখন ছিলেন সাকোর কর্মকর্তা । পরবর্তীকালে ডিকে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত।) যারে থাকার জন্য আমার বিছানাটি ছেড়ে দিয়েছিলাম। তিনি এসেছিলেন অনুষ্ঠানটিকে সর্বাঙ্গীণ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্য নিয়ে, অনুষ্ঠানটিকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সার্থক করার জন্য। অনুষ্ঠানটির যাবতীয় ব্যয় ভার তিনি বহন করেছিলেন। প্যান্ডেল ও মঞ্চসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় উপকরণ এসেছিল ঢাকা থেকে। তখন মনে হয়েছিল কলেজ চত্বরটিকে যেন নববধূরূপে সাজানো হয়েছিল। এক অনাবিল সৌন্দর্য ফুটে উঠেছিল সর্বত্র। যেন নব বসন্তের সাজে সেজেছিল প্রকৃতি। প্রকৃতি যেন বরণডালা সাজিয়ে অধীর আগ্রহে ব্যাকুলচিত্তে অপলক দৃষ্টিতে পথপানে চেয়ে ছিল, কখন আসবে সে মহানায়ক। এলাকাবাসীর মনেও সৃষ্টি হয়েছিল এক ব্যাকুল প্রত্যাশা তাকে এক পলক নয়ন ভরে দেখার জন্য। তাদের হয়ত কেবলই মনে হয়েছিল যিনি এ সুন্দরের স্রষ্টা তিনি না জানি কত সুন্দর। অবশেষে এল সেই বহু প্রতীক্ষিত শুভ দিন বরণের পালা। হতদরিদ্র এলাকাবাসীর হয়ত কবিগুরুর মতোই মনে হয়েছিল-
ওহে সুন্দর, মরি মরি,
তোমায় কী দিয়ে বরণ করি!

সকাল থেকেই শুরু হয়েছিল মানুষের আনাগোনা। দুপুর নাÑগড়াতেই কলেজের মাঠ কানায় কানায় ভরে গেল। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই রইল না। মহানায়ক এলেন। ছাত্রীরা বাসন্তি রঙের শাড়ি পরে বরণকুলায় স্বাগতম লিখে কলেজ চত্বরে ঢোকার মুখেই তাকে সাদরে বরণ করে নিলেন। যেতে যেতে তার উপর পুষ্প বর্ষিত হলো। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। কুলবধূদের মনের গভীরে আন্দোলিত হলো কবিগুরুর সেই অতিথি বরণের সংগীত :

তোমার আনন্দ ওই এল দ্বারে এল এল এল গো।
বুকের আঁচলখানি ধূলায় পেতে আঙিনাতে মেলো গো।

অনেক কষ্টে আমরা শিক্ষকবৃন্দ, এলাকাসী এবং তার সাথে ঢাকা থেকে আগত অনেকে মিলে ব্যারিকেড দিয়ে জনস্রোত সামলে তাকে নিয়ে বসালাম অধ্যক্ষ মহোদয়ের কক্ষে। সামান্য নাস্তার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল কিন্তু তিনি তেমন কিছুই মুখে দিলেন না। একটু পরেই সোজা গিয়ে উঠলেন মঞ্চে। উপস্থিত সকলের উদ্দেশে হাত নেড়ে অভিবাদন জানালেন। অজস্র নেত্র তার দিকে তাকিয়ে রইল অপলক দৃষ্টিতে। যেমন করে কবিগুরু বলেছিলেন-

এই অনিমেষ তৃষাতুর আঁখি চাহিয়া দেখিছে তোরে।
এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল কলেজকে কিছু জায়গা দানের দলিল ও একটি মনোরম ক্রেস্ট। কলেজের পক্ষ থেকেও তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন কলেজের মনোগ্রাম সম্বলিত একটি ক্রেস্ট তৎকালীন অধ্যক্ষ মো. তমিজউদ্দিন। তিনি তার মূল্যবান বক্তৃতা শেষে ১৯৯১ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় উন্নত ফলাফল অর্জন ও বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান দখল করার পিছনে অধ্যক্ষ মহোদয় ও শিক্ষকবৃন্দের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অধ্যক্ষ মহোদয়কে ৫টি ও শিক্ষকবৃন্দকে ১টি বোনাস প্রদানের ঘোষণা দেন। পরবর্তীকালে অবশ্য কর্মচারীদেরও একটি বোনাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। একটি ছাত্রাবাস নির্মাণের জন্য ৫ লক্ষ টাকা প্রদানের ঘোষণাও দিয়েছিলেন। মেধা তালিকায় স্থান দখলকারী জাহিদ হোসেন পনির ও মনোয়ার হোসেন লাভলুর হাতে তুলে দেন মূল্যবান ক্রেস্ট। ঘোষণা দেন তাদেরকে সার্কভুক্ত দেশসমূহ ভ্রমণের ব্যবস্থা করার। মঞ্চ থেকে নেমে স্বল্প সময়ের জন্য গেলেন নদীর ওপারে যেখানে শিক্ষকবৃন্দের আবাসন ব্যবস্থা করেছিলেন। পৌঁছানোর পর হাঁটতে হাঁটতে আমাদের মহিলা শিক্ষকরা তার উপর পুষ্প বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গ থেকে পুষ্প বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছিল। নাস্তার ব্যবস্থা থাকলেও তিনি কিছুই খেলেন না। সেখান থেকেই তিনি সেবারের মতো বিদায় নিলেন।
তার বিদায়ের পর শুরু হলো মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তিনিই ঢাকা থেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এ দেশের সংগীত জগতের দুই মহারথী রথীন্দ্রনাথ রায় ও সুবীর নন্দীকে। অনেক রাত পর্যন্ত চলেছিল সে অনুষ্ঠান। মনের আনন্দে অনেক গান শুনিয়ে অগণিত শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেনÑ দুই প্রথিতযশা শিল্পী। শিক্ষক, এলাকাবাসী, তৎকালীন ছাত্র-ছাত্রী ও আশপাশের এলাকার মানুষের নিকট দিনটি আজও স্মরণীয় হয়ে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এমন দিনের কথা কি ভোলা যায়!

হেথায় প্রতিটি তৃণ, গুল্ম, বৃক্ষ-লতা
অনাগত প্রজন্ম, আবালবৃদ্ধবণিতা,
স্মরিবে তোমায় চিরকাল শ্রদ্ধাভরে,
অকুণ্ঠ চিত্তে বাসিবে ভালো নতশিরে।

দ্বিতীয় বার এলেন ২০১০ সালের ২৪ মার্চ। সেবার এসেছিলেন এই কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া যেসব ছাত্র-ছাত্রী প্রথম বারের মতো ২০-তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয়েছিল তাদেরকেসহ বিভিন্ন সময়ে বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান দখলকারীদেরকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য। ২০-তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল মো. জাহিদ হোসেন পনির, মো. মনোয়ার হোসেন লাভলু, মো. লোকমান হোসেন এবং মো. ইলিয়াছ হোসেন। এদের মধ্যে মো. লোকমান হোসেন ৫ম স্থান অধিকার করেছিল। সৈয়দ আবুল হোসেন এসেছিলেন হেলিকপ্টারে চড়ে। যা ছিল ছাত্র-ছাত্রী ও এলাকাবাসীর জন্য এক বিশাল বিস্ময়। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন অনেক মহারথীকে। তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. একে আজাদ চৌধুরী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. দুর্গাদাস ভট্টাচার্য এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এটিএম শরীফ উল্লাহ। উপস্থিত হয়েছিলেন তৎকালীন মাদারীপুরের জেলাপ্রশাসক জনাব মো. মোখলেছুর রহমান ও জেলা পুলিশ সুপার জনাব শফিকুর রহমান। এ দিনটিই ছিল কলেজটির জন্য একটি বড় ঐতিহাসিক অর্জন। এতসব বড় বড় মহারথীর পদধূলিতে ধন্য হয়েছিল শিক্ষাঙ্গনটিসহ এলাকার মাটি ও মানুষ। হেলিকপ্টার থেকে নামার পর আমরা শিক্ষকগণই তাকেসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলাম। হেলিপ্যাড থেকে শুরু করে মূল মঞ্চ পর্যন্ত বিছানো হয়েছিল লালসালু, যার ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে অতিথিদেরসহ সরাসরি মঞ্চে গিয়ে উঠেছিলেন। প্রফেসর ড. একে আজাদ চৌধুরী, ড. দুর্গাদাস ভট্টাচার্য ও প্রফেসর ড. এটিএম শরীফ উল্লাহ প্রত্যেকেই তাদের মূল্যবান বক্তব্যে এমন একটি অজপাড়াগাঁয়ে একাধিক বহুতলবিশিষ্ট ভবন নিয়ে এমন একটি সুন্দর প্রতিষ্ঠান দেখে বিস্ময় প্রকাশ করলেন এবং সেই সাথে ভূয়সী প্রশংসা করলেন এর প্রতিষ্ঠাতার। সবাই প্রতিষ্ঠানটির অর্জিত ফলাফলেরও প্রশংসা করলেন। এলাকাবাসী কলেজটিকে ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীতকরণের আবেদন জানালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি. সি. প্রফেসর ড. দুর্গাদাস ভট্টাচার্য বলেছিলেন আইনগত কোনো জটিলতা নাÑথাকলে তার আপত্তি থাকবে না। সবার বক্তব্য শেষ হলে প্রতিষ্ঠাতা তার মহামূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। বক্তব্য শেষে তিনি ২০-তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং বিভিন্ন সময়ে মেধা তালিকায় স্থান দখলকারীদের হাতে তুলে দিলেন মূল্যবান ক্রেস্ট। এরপর আর একটুও দেরি করেন নি তিনি। মঞ্চ থেকে নেমে সোজা গিয়ে উঠলেন হেলিকপ্টারে, রওনা হলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। রেখে গেলেন একরাশ অবিস্মরণীয় স্মৃতি, যা সকলকে আজও আন্দোলিত করে। কবি গুরুর ভাষায় :
নয়ন ছেড়ে গেলে চলে, এলে সকল মাঝেÑ
তোমায় আমি হারাই যদি তুমি হারাও না যে।

তিনি চলে যাবার পর শুরু হলো মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ঢাকা থেকে এসেছিলেন সংগীত পরিবেশনের জন্য তৎকালীন সাড়া জাগানো সংগীত শিল্পী ডলি সায়ন্তনী ও মনির খান। তাদের পরিবেশিত সংগীত মুগ্ধ করেছিল উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক শ্রোতাকে। কৌতুক অভিনেতা অমল বোস ও তার নাতি (কথিত) এবং কাজলও তাদের পরিবেশিত কৌতুকের মাধ্যমে মুগ্ধ করেছিলেন সকলকে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করার জন্য এসেছিলেন টিভি উপস্থাপক আনজাম মাসুদ। অনেক রাত পর্যন্ত চলেছিলো অনুষ্ঠান। সমগ্র এলাকা ছিল লোকে লোকারণ্য।
প্রতিবারের অনুষ্ঠানের যাবতীয় খরচ তিনি নিজেই বহন করেছেন। প্রতিবার অনুষ্ঠানের পূর্বে কলেজের প্রতিটি ভবনের প্রয়োজনীয় মেরামতসহ ঘষে মেজে রঙ করে ঝকঝকে করে তুলেছেন নিজের প্রচেষ্টায়, নিজস্ব অর্থায়নে। চলতি সময়েও তিনি কলেজের সমস্ত ভবনের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও রঙের কাজ করাচ্ছেন নিজস্ব খরচে। কলেজটি শুরু হওয়ার কিছুদিন পরেও সকল শিক্ষক ও কর্মচারীকে দিয়েছিলেন এক সেট ফুল-সাফারি। ১৯৯১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর খুশি হয়ে মেধা তালিকায় স্থান দখলকারী দুই ছাত্রসহ শিক্ষকদের দিয়েছেন কমপ্লিট স্যুট। চলতি বছরও সকল শিক্ষক-কর্মচারীকে দিয়েছেন দুই সেট করে ফুল-সাফারি। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য করেছেন দুই সেট করে ইউনিফর্ম ড্রেস-এর ব্যবস্থা। ছাত্র-ছাত্রীদের ড্রেস-এর ব্যবস্থা করেছেন মাদারীপুর জেলার মাননীয় জেলাপ্রশাসক জনাব শশীকুমার সিংহ-এর তত্ত্বাবধানেÑ যাকে তিনি অত্যন্ত কাছের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেন। শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজের ছাত্রীদের এবং ডিকে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজের ছাত্রদের ড্রেসের ব্যবস্থাও করেছেন তার তত্ত্বাবধানে। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই পরিচালনা পরিষদের সভাপতির আসন অলংকৃত করে আছেন জেলাপ্রশাসক মহোদয়। কত বড় উদার মনের মানুষ হলে এত কিছু করা সম্ভব, তা ভেবে আজও কোনো কূল কিনারা পাইনি। তাই পরম করুণাময় স্রষ্টার উদ্দেশে বলছি :

হে বিধাতা, দাও, তাকে আরও দাও
আমৃত্যু মানবসেবার তরে।
ক’জনই বা আসে বলো এ ধরায়
অকৃপণ পরহিত করে।

তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ২০০৩ সালে পদরেণু রেখে কলেজটিকে মহিমান্বিত করে গেছেন দুই বাংলার প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। উদ্বোধন করে গেছেন অধ্যক্ষ ভবনটি তার সুনিপুণ হস্তস্পর্শে।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ডÑএ কথাটি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে। তাই তিনি শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে উৎসর্গ করে চলেছেন সমস্ত মন-প্রাণ, উজার করে দিচ্ছেন সমস্ত বিত্ত-বৈভব। বিবিসি-এর জরিপে “শেখ মুজিবুর রহমান” নির্বাচিত হয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি -শতাব্দীর মহানায়ক রূপে। আর আমার বিবেচনায় শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে ‘আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন’-এ উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। দানবীর ও বাংলার হাতেমতাই নামে পরিচিত হাজী মুহম্মদ মহসীন; বাংলার ‘সৈয়দ আহম্মদ’ নামে খ্যাত নওয়াব আবদুল লতিফ; সৈয়দ আমীর আলী; দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা; মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত প্রমুখ ব্যক্তিগণ শিক্ষাবিস্তার ও দানশীলতার জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন, শিক্ষাবিস্তারে ও দানশীলতায় আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের অবদান তাদের থেকে কোনো অংশে কম নয়, বরং অনেক অনেক বেশি। তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই তাকে অমর করে রাখবে পৃথিবীর বুকে।

কে, কি বলে, কিবা আসে যায়!
তোমার কীর্তি অমর করবে তোমায়।
হবে প্রসিদ্ধ ইতিহাস তুমি অনাগত মহাকালের,
শিক্ষাপ্রেমী মহানায়ক এ বাংলার প্রতিটি প্রাণের।
১৯৯৪ সালে যে ঐতিহাসিক শিক্ষক আন্দোলন হয়েছিল, সেখানেও ছিল তার উপস্থিতি। সমগ্র দেশ থেকে আগত শিক্ষকবৃন্দ সমবেত হয়েছিল ঢাকা প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায়। একটানা সাত দিন চলেছিল সমাবেশ। সে আন্দোলনের মঞ্চে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি। করেছিলেন অনাহারী শিক্ষকদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা। শেষের দিকে শিক্ষকেরা যখন অনশন করেছিলেন বৃষ্টিতে ভিজে, খবর পেয়ে তখন তিনি শিক্ষকদের বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পাঠিয়েছিলেন পলিথিন। আন্দোলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশে বরিশাল থেকে আসার পথে মৃত্যুবরণ করেছিলেন একজন শিক্ষক। সে শিক্ষকের পরিবারকে দান করেছিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা। তার এসব কর্মকাণ্ড শিক্ষা এবং শিক্ষকদের প্রতি আন্তরিক মমত্ববোধেরই বহিঃপ্রকাশ।
কলেজটির প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নাÑথাকলেও পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর-৩ (কালকিনি-মাদারীপুর) আসনে ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে পর পর চারবার বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এবং বর্তমান সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও তিনি তার প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতির ছোঁয়া লাগতে দেননি। এটিও তার মহৎ চরিত্রেরই পরিচয় বহন করে।
পাঠক, এতক্ষণ যাকে আমি আপনাদের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি লেখনির মাধ্যমে, আমি জানি তার সম্পর্কে আমি যতটুকু তুলে ধরতে পেরেছি তা তার কীর্তিময় জীবনের তুলনায় অতীব নগণ্য। কবিগুরুর ভাষায় :
পরম আত্মীয় বলে যারে মনে মানি
তারে আমি কতদিন কতটুকু জানি।
তথাপি সকলের কাছে আমার আকুল আবেদন, আপনারা সবাই তার জন্য দোয়া করবেন। পরম করুণাময় স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা জানাবেন, তিনি যেন তাকে দীর্ঘায়ু দান করেন। কেননা, তার মতো একজন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষানুরাগী, দানশীল, জনহিতৈষী, মানবদরদি মানুষ পৃথিবীর বুকে যত বেশি দিন বেঁচে থাকবেন ততই মানুষের মঙ্গল, সমাজের মঙ্গল, দেশের মঙ্গল, মঙ্গল সারা বিশ্বের। অধ্যক্ষ হিসেবে আমার চাকুরি জীবনের প্রথম একাদশ শ্রেণির ওরিয়েন্টশন ক্লাশে আমার ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশেও আমি এমন কথাই বলেছিলাম। কলেজটির জন্মলগ্ন থেকেই আমারও কর্মজীবনের শুরু। আর তাই প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এমন একটি স্বনামধন্য কলেজে কর্মরত আছি বলে আমি নিজেও গর্ববোধ করি। গর্ববোধ করি আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো একজন মহৎ ব্যক্তির জন্মস্থানের পার্শ্ববর্তী গ্রামে জন্মগ্রহণ করার জন্যও। সর্বোপরি বলি:
হে সুন্দর, প্রণমি তোমায় শতবার,
যুগে যুগে ফিরে ফিরে এসো বার বার।

প্রকাশ চন্দ্র নাগ: অধ্যক্ষ, সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ, খোয়াজপুর, মাদারীপুর; কবি ও গবেষক।

মননশীল ভাষাবিজ্ঞানী
নির্মল চন্দ্র পাল
বিখ্যাত প্রাবন্ধিক, উদার রাজনীতিক, প্রগতিশীল চেতনা ও কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোক্তা সফল শিল্পপতি, সৈয়দ আবুল হোসেন স্কুলজীবন হতে অত্যন্ত মেধাবী এবং আদর্শ ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা, রাজনীতিক চেতনা ও লেখালিখির বিকাশ ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি ‘দি পলিটিসিয়ান’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করে সম্পাদক হিসেবে পরিচিতি পান। দেশের বহুল প্রচারিত বিভিন্ন ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকায় বিশ্লেষণধর্মী কলাম লিখে কলাম লেখক হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি ও প্রশংসা পান।
রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বিদ্যোৎসাহী, দানবীর প্রত্যয়গুলো অনেকটা পেশাগত। সবগুলো প্রত্যয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনকে ভূষিত করা যায়। তিনি আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থ রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট। সংগত কারণে অনুসৃত দলের প্রতি বহুমাত্রিকতায় আচ্ছন্ন থাকাই হতো প্রচলিত রাজনীতিক কৃষ্টি বিবেচনায় তাঁর জন্য স্বাভাবিক। অদ্ভুত হলেও তিনি তা হতে নিজেকে সযতেœ দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা সৈয়দ আবুল হোসেন দলের ভেতরে থেকেও একজন পেশাদার গবেষকের ন্যায় নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছেন। দলীয় সীমাবদ্ধতা তাঁকে সংকীর্ণ করতে পারেনি। এখানেই তাঁর মহত্ব, এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। আওয়ামী রাজনীতির সাথে গভীর সম্পৃক্ততায় সম্পৃক্ত থেকেও তিনি যখন অর্থনীতির কথা বলেন তখন পরিপূর্ণ মাত্রায় অর্থনীতিবিদ হয়ে ওঠেন।১
মূলত গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী রাজনীতিক লেখক হিসেবে তাঁর লেখা বোদ্ধাদের দৃষ্টি কাড়ে। স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা- সংগ্রামী জননেত্রীর প্রতিকৃতি, গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট, আওয়ামী লীগের নীতি ও কৌশল, শিল্পায়ন ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশ, শেখ হাসিনার অক্ষয় কীর্তি : পার্বত্য শান্তি চুক্তি, শেখ হাসিনার অসামান্য সাফল্য, বঙ্গজননী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুবর্ণজয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ ইত্যাদি সৈয়দ আবুল হোসেনের কয়েকটি গ্রন্থ। সৈয়দ আবুল হোসেনের ভাষার গাঁথুনি যেমন চমৎকার তেমনি পরিষ্কার উপস্থাপনার ক্ষেত্র ও বিস্তৃতি। এ প্রবন্ধে উদাহরণস্বরূপ তার কয়েকটি লেখা উপস্থাপন করা হলো। তার লেখায় ভাষার শৈল্পিক সজ্জা পাঠককে সহজে আকৃষ্ট করে, চমৎকৃত করে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক বছরের কর্মকাণ্ডের বিবরণ সম্বলিত একটি পুস্তিকায় সৈয়দ আবুল হোসেনের একটি বাণী পড়ে আমি এত পুলকিত হই যে, তার সম্পর্কে লেখার জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে উঠি। পাঠকের সুবিধার জন্য তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো২
ঈ ভড়ৎ উ; অর্থাৎ ‘ঈড়সসঁহরপধঃরড়হ ভড়ৎ উবাবষড়ঢ়সবহঃ’ আধুনিক উন্নয়ন ধারণার মূল প্রতিপাদ্য। উন্নয়ন বলতে মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নকে বোঝায়। তাই যোগাযোগ এবং উন্নয়ন পরস্পর সমার্থক। যোগাযোগের রথ বেয়ে আদিম মানুষ সভ্যতার জগতে উৎসারিত হয়েছে। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইয়ো জাতির উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এরাব সব ধ মড়ড়ফ ৎড়ধফ হবঃড়িৎশ ড়হষু, হড়ঃযরহম বষংব, ও রিষষ মরাব ুড়ঁ ধ পড়সঢ়ষবঃব হধঃরড়হ.’ জনগণ ও লি উভয়ে প্রতিশ্র“তি রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা সিঙ্গাপুরকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতিতে উন্নীত করে। শুধু সিঙ্গাপুর নয়, পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের জন্য এটি প্রযোজ্য। যোগাযোগহীন উন্নয়ন তৈলহীন প্রদীপÑ প্রবাদটি স্মর্তব্য। সংগতকারণে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সুষম পরিব্যাপ্তির নিবিড় বন্ধনে যুক্ত করার নিরলস প্রয়াসে নিবেদিত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের আধুনিক, সুষম ও নিবিড় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোক্তা। নবযুগের স্বপ্নদ্রষ্টা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনকের এ উদ্যোগে পরিপূর্ণ প্রাণ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর।
যোগাযোগ একটি বহুমুখী অভিধা। অনেকগুলো নিয়ামকের সমন্বয়। আমরা সবগুলো প্রত্যয়ের সমন্বয় সাধনে সচেতন। এক বছর মহাকালের নিকট নিতান্তই সামান্য কিন্তু সরকারের জন্য যেমন ব্যাপক তেমন গুরুত্বপূর্ণ। একটা মুহূর্তকেও অবহেলার অবকাশ নেই। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা এ চেতনার বহিঃপ্রকাশ। সড়ক ও রেলপথের সার্বিক উন্নয়ন, যানজটমুক্ত ঢাকা, গুরুত্বপূর্ণ সকল খাল ও নদীতে সেতু নির্মাণ; সর্বোপরি দেশব্যাপী নিরবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে জাতিকে সার্বিক উন্নয়নে বিদুষিত করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিগত এক বছরে অনেকগুলো প্রকল্প গ্রহণ করেছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক বছরের কার্যক্রম এ প্রতিবেদনটির বিষয়বস্তু। এর উদ্দেশ্য প্রচার নয়, বরং সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্বচ্ছতার সাথে উপস্থাপন। প্রতিবেদনটি জনগণের প্রতি আমাদের আরও দায়বদ্ধ করে তুলতে অনুপ্রাণিত করবে। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের কর্মকাণ্ডে জনগণের উপদেশ, নির্দেশনা ও সহায়তা প্রত্যাশা করি। আমাদের লক্ষ্য স্থির, তবে অসীম ও দুর্বার। প্রাপ্তির লক্ষ্যে আমাদের প্রত্যাশা মহাপ্রাপ্তির প্রেরণায় উজ্জীবিত। ক্লান্তিহীন চেষ্টা ও সময়ানুবর্তিতার মাধ্যমে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আব্রাহাম লিংকনের ভাষায়, “ও হবাবৎ যধফ সবৎবষু ধ ঢ়ড়ষরপু; ও যধাব লঁংঃ ঃৎরবফ ঃড় ফড় সু াবৎু নবংঃ বধপয ধহফ বাবৎু ফধু.”
মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক জাতীয় কৃষি দিবস/২০০৯ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় সৈয়দ আবুল হোসেনের আর একটি লেখার কিছু অংশ উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। “… নবান্ন নব প্রত্যাশার স্বপ্নীল মাধুর্যে আগামীর প্রমুগ্ধতা। অগ্রহায়ণে নতুন ধানের বিমুগ্ধ ঘ্রাণ ও বিহব্বল স্বাদের বৈচিত্র্যময় পিঠাপুলি কৃষাণ-কৃষাণীর নিপুণ ছোঁয়ায় উৎসব হয়ে ওঠে অনির্বাণ লাস্যে। নবান্ন বাঙ্গালি সংস্কৃতির প্রাচীনতম ঐতিহ্য। এটি ধর্ম নিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমতার লালিত্য প্রেরণায় আকীর্ণ চেতনার মধুময় নির্যাস। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ত্রয়ী প্রেরণার সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন, ও বাঙালি জাতিকে নব জীবন দান করেছেন। মহীয়সী জননেত্রী শেখ হাসিনা স¤পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণ, বিশেষ করে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নের মহান ব্রতে এগিয়ে। নবান্নের মতো নিজস্ব সংস্কৃতির উদার মৃণ¥য়তা জননেত্রীর মহান ব্রত ও জাতির জনকের স্বপ্নের সারথীতে নতুন গতি সঞ্চারক। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠী পক্ষান্তরে আবাদি জমির মতো অনিবার্য প্রত্যয়ের ক্রমহ্রাসমান সংকটের মাঝে সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করা বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। এর উত্তরণে নবান্নের আনন্দে উৎসারিত জাতীয় কৃষি দিবস/২০০৯ অনুপ্রেরণার অঙ্গীকার হয়ে থাক প্রকৃতির মতো সবুজ লাস্যে।”
এরূপ অসংখ্য উদাহরণ উপস্থাপন করা যায়। তবে পরিসরের কথা চিন্তা করে মাত্র দু’টি উপস্থাপন করা হলো। তার ভাষাজ্ঞান নিখুঁত এবং মার্জিত। অল্প বাক্যে তিনি অনেক বেশি প্রকাশ করতে পারঙ্গম। এটি অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। অনেক সাধনার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। কথার মতো লেখাতেও তিনি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন, যা তার লেখার গ্রহণযোগ্যতাকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করে। রাজনীতি, অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের উপরই তিনি বেশি লিখে থাকেন। এ ধরনের লেখা সাধারণত রসকসহীন হয়। পাঠক কয়েক লাইন পড়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তবে সৈয়দ আবুল হোসেনের লেখা রসকসহীন নয়। বাক্যের মাঝে উদ্ধৃতি ও শালীনতাময় হিউমার কঠিন বিষয়কেও পাঠকের কাছে উপন্যাসের মতো আকর্ষণীয় করে তোলে।
সৈয়দ আবুল হোসেন শধু বাংলা ভালো জানেন তাই নয়, তিনি ইংরেজিতেও বেশ দক্ষ। তার ছোট ছোট বাক্যে বিন্যস্ত ইংরেজি কথা যেমন প্রাঞ্জল তেমন সহজবোধ্য। কথার মাঝে মাঝে বিরতি এ সৌন্দর্যকে উপভোগের সময় দেয় শ্রোতাদের। যে কোনো সময় কোনো বিষয়ের উপর পূর্ব-প্রস্তুতি ছাড়াই তিনি অনর্গল ইংরেজি বলে যেতে পারেন। তার ইংরেজি ভাষার দক্ষতা সর্বজনবিদিত। ইসকাপ (ঊঝঈঅচ)-এর সভায় বাংলাদেশের পক্ষে তিনি একটি বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। এটা বিশ্বমহলে একটি অসাধারণ বক্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
ভাষা মনের আয়না, কর্মের প্রতিফলক, মাধুর্যের বারতা। মানব সভ্যতার সাথে ভাষার বিকাশ অবিচ্ছেদ্য। যোগাযোগের রথ বেয়ে মানুষ সভ্যতার শিখরে উঠেছে। যোগাযোগের অন্যতম উপায় ভাষা। কথা আর লেখা মানুষের সাথে শুধু সেতু বন্ধন রচনা করে না, রচিত সেতু ধ্বংসও করে দেয়। প্রাত্যহিক জীবনের শতকরা নিরানব্বই ভাগ সংঘর্ষ স্বর ও কথার কারণে সংঘটিত হয়। তাই লেখা ও কথাবার্তায় সৈয়দ আবুল হোসেন খুবই সাবধানতা অবলম্বন করেন। তার কথায় মমতার প্রতিবিম্ব। যা অন্যের মনে ছন্দের মতো আনন্দ সৃষ্টি করে। শত্র“কে কাছে টানে, বন্ধুত্বকে করে নিবিড়।
নির্মল চন্দ্র পাল: অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজিনেস এন্ড টেকনলজি।

১. আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের গ্রন্থ সমালোচনা, লেখক মোহাম্মদ আীমন।
২. যোগাযোগ মন্ত্রণালয় হতে প্রকাশিত পুস্তিকায় প্রকাশিত বাণী।

পরিশ্রমী এবং করিৎকর্মা একজন ব্যক্তির প্রতিকৃতি
ফোরকান বেগম
সৈয়দ আবুল হোসেন একজন সফল মানুষ। প্রত্যয়ী চেতনায় নিবেদিত পরিশ্রমী এ মানুষটি জনদরদি রাজনীতিবিদ ও দয়ালু ব্যক্তি হিসেবেও সর্বমহলে পরিচিত ও প্রশংসিত। সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থাÑ এ প্রবাদের প্রতিফলন ঘটিয়ে তিনি ব্যবসা ক্ষেত্রে অসাধারণ সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। দেশের অন্যান্য ব্যবসায়ীরা তাঁর এ সফলতার সূত্রটি অনুসরণ করলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ একটু হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ব্যবস্থাপনায় এম.কম ডিগ্রি শিরে ধারণ করে সে ডিগ্রির সফল প্রয়োগ করেছেন ব্যক্তিজীবনে, বাস্তবক্ষেত্রে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ইয়ারম্যাট তিনি। তখন অবশ্য সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেবের সাথে আলাপ পরিচয় ছিল না আমার। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়া হল থেকে ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, সামসুন্নাহার হল প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, হলের ধাই-পিয়নদের বয়স্ক শিক্ষাদান, ডঃ কুদরত-ই খুদা শিক্ষা কমিশনের সেমিনারে আলোচক, হলের ডাইনিং ব্যবস্থার উন্নয়ন, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীদের কমনরুম প্রতিষ্ঠাসহ সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি অনার্স কোর্স চালু ইত্যাদি নানা বিষয়ে কাজ করতাম। ফলে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একটা পরিচিতি ছিল। আমার ইয়ারম্যাট হিসেবে আবুল হোসেন সাহেবও অন্যান্যদের ন্যায় আমাকে চিনতেন।
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের পরের কথা, সম্ভবত ১৯৭৬। সৈয়দ আবুল হোসেন হঠাৎ আমাকে সচিবালয়ে একদিন দেখে- আসসালামু আলাইকুম আপা, কেমন আছেন বলে হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার ভালো লাগল পরিচিত জনকে অনেকদিন পর দেখলাম। কুশলাদি বিনিময় করলাম। যাবার সময় তিনি ‘সাকো ইন্টারন্যাশনাল’-এর একটি কার্ড আমার হাতে দিলেন। দেখলাম তিনি এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। দাওয়াতও দিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠানটি একদিন ভিজিট করে আসার। আমার সাথে পরিচিতি কার্ড নাÑথাকায় তাঁকে দিতে পারিনি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ও দপ্তরে শাখা অফিসার হতে শুরু করে সচিব পর্যন্ত যেখানে গেছি সেখানেই ‘সাকো ইন্টারন্যাশনাল’-এর ডেস্ক ক্যালেন্ডার এবং পেন হোল্ডার শোভা পাচ্ছিল, দেখতে পেয়েছি। গোটা সচিবালয়ই আবুল হোসেনময় হয়ে উঠেছিল। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন, হাত মেলাচ্ছেন। সচিব, মন্ত্রীদের সাথেও ছিল তাঁর সুন্দর সম্পর্ক। চমৎকার হাসি, অমায়িক আচরণ, মাধুর্যময় কথা ছিল তাঁর জীবনের নিত্যসঙ্গী। সে সময় তিনি ব্যবসায়ী হিসেবে তেমন বিখ্যাত ছিলেন না। ভদ্র, নম্র ও বিনয়ী সৈয়দ আবুল হোসেন তার মার্জিত আচরণ, যথার্থ শ্রদ্ধা, পরিপূর্ণ ভালোবাসা আর অপূর্ব সাহচর্য দিয়ে জয় করে নিয়েছিলেন পুরো সচিবালয় এবং মন্ত্রী, কর্মকর্তা, কর্মচারী, সাধারণ জনগণসহ সবার অন্তর। তাইতো তিনি প্রতি পদে পদে সাফল্য অর্জন করেছেন। বাংলাদেশের ভাগ্য ভালো যে, আবুল হোসেন সফল হয়েছেন। নইলে অন্তত কালকিনির মতো পশ্চাদপদ এলাকাটি এখনও সে পশ্চাদপদ থেকে যেত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নেতৃত্ব ও কর্মের কথা আবুল হোসেন সাহেব ভালোভাবে স্মরণে রেখেছেন। শ্রদ্ধার সাথে মনে করে থাকেন আমাকে। আর সবসময় সাক্ষাতে নম্র সুরে আপা কেমন আছেন বলে একটা সালাম দেন। এ ধরনের শ্রদ্ধা ও বিনয় কয়জন করে থাকেন বর্তমান সময়ে? বিশেষ করে, যেখানে তিনি সম্পদ, নাম, যশ, ক্ষমতা, খ্যাতি ও প্রতিপত্তির অধিকারী। যদিও সহপাঠীদের ও ইয়ারম্যাটদের সাথে দেখা হলে অনেকেই নেত্রী কেমন আছেন, কুশলাদি জানতে চানÑ এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু লক্ষ করেছি সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব মার্জিত এবং বিনয়ী হিসেবে সকলের থেকে আলাদা। সদাহাসি মুখ ও বিনয়ী হওয়া একটি স্বর্গীয় গুণ বটে। আমার ইয়ারম্যাটকে নিয়ে আমি সত্যি গর্বিত ও আনন্দিত সে কারণেই। সদা ব্যস্ত, কর্মঠ ও পরিশ্রমী আবুল হোসেন সাহেব সময়ের যথার্থ সদ্ব্যবহার করেন বলেই তিনি নিজেকে সার্থকভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। চারবার তিনি মাননীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। দু’বার মন্ত্রী হয়েছেন।
পরিশ্রম, বুদ্ধি, মেধা, শক্তি, সাহস, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা তাঁকে জীবনে সফলতা এনে দিয়েছে। এত বড় হবার পেছনে তিনি নিজের ছাড়া আর কারও সাহায্য প্রত্যাশী ছিলেন না। তিনি ধনী ও বিত্তবান হয়ে রূপকথার যজ্ঞ বা কারুনের মত সে ধন নিজের সিন্দুকে আগলে রেখে বসে থাকেননি। অর্জিত অর্থ-বিত্তকে জোয়ারের মতো উত্তাল তরঙ্গে হেসে হেসে আনন্দে আনন্দে জনগণের কল্যাণে ব্যয় করেছেন। তিনি নিয়মিত দান করেন, গরিব-দুঃখী, অসহায়, এতিম কেউ কখনও তাঁর কাছ হতে খালি হাতে ফিরে যায়নি। বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর দান রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। তাই সৈয়দ আবুল হোসেনকে অনেকে হাজি মহসীনের চেয়েও মহান দাতা বলে থাকেন।
তিনি একজন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় এমন কোনো স্থান বাকি নেই, অর্থাৎ পাড়া, মহল্লা, গ্রাম, ইউনিয়ন যেটি তাঁর উদারতায় ধন্য হয়নি। তিনি অসংখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনেক মাদ্রাসা, হাইস্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনেকে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ সেবামূলক। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সহায়সম্বলহীন গরিব পরিবারের সন্তান সন্ততিদের জন্য নিবেদিত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এলাকার জনগণের জন্য এক অনন্যসাধারণ শিক্ষা অবকাঠামো ও পরিবেশ গড়ে তুলেছে। কালকিনি উপজেলার ছেলে মেয়েদের শিশুপাঠ হতে শুরু করে সর্বোচ্চ ডিগ্রি মাস্টার্স অর্জনের জন্য আর উপজেলার বাইরে যেতে হয় না। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজনীতি মুক্ত। তাই শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সবসময় বজায় থাকে। অনেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। সৈয়দ আবুল হোসেন কিন্তু এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর।
তিনি অনেক বছর যাবৎ প্রতি বছরই বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক অনুদান দিয়ে আসছেন। এর মধ্যে ১৫টির অধিক স্কুল, একাডেমি, বালক-বালিকা বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দান করে থাকেন। তার দান জাতি ধর্ম বর্ণ ও রাজনীতি নির্বিশেষে সকলের জন্য অবারিত। সবার প্রতি তার সমান দৃষ্টি। তিনি তাঁর এলাকায় হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই যার যার ধর্ম স্বাধীন ও নিরাপত্তার সাথে পালনের অবারিত সুযোগ করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তিনি রাজনীতি ও ধর্ম নির্বিশেষ সবার প্রতি গণতান্ত্রিক আচরণ করে থাকেন। রাজনৈতিক হানাহানি ও গণতান্ত্রিক সংকটের যুগে কয়জন মানুষের মধ্যে দেখা যায়!
জনগণের চলাচল ও যাতায়াতের সুবিধার্থে সৈয়দ আবুল হোসেন কালকিনি উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের সড়ক উন্নয়ন, রাস্তাঘাট ও ব্রিজ-কালভার্টসহ বহুবিধ উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। জনকল্যাণ ও জনস্বার্থে তিনি উদার হস্তে দান করতে পিছপা হন না। তাঁর এ মানবিক গুণ কেবল প্রশংসারই দাবিদার নয়, বরং আমাদের দেশের বহু কৃপণ কোটিপতির অনুসরণীয় হতে পারে। বাংলাদেশে এমন অসংখ্য লোক আছে, যারা সৈয়দ আবুল হোসেনের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ-বিত্তের মালিক। আমি আশা করব তাঁরা যেন সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছ হতে কিছু শিক্ষা নেন। তাহলে বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলা কালকিনির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।
সৈয়দ আবুল হোসেন একজন বিশিষ্ট লেখকও বটে। ইতোমধ্যে তিনি ৯টির অধিক বই লিখেছেন। তাঁর বইগুলো গবেষণামূলক এবং সমৃদ্ধ। শুধু মেধা থাকলে চলে না। মেধার সাথে পরিশ্রম, রুচি এবং সাধনার অপূর্ব সমন্বয় ঘটাতে না পারলে সমস্ত কিছু মৃত বাঘের ন্যায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। সৈয়দ আবুল হোসেন মেধা, শ্রম, সাধনা ও রুচির সমন্বয় ঘটিয়ে সর্বক্ষেত্রে একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের সামনে আলোক বর্তিকার মতো আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও বটে।
নিরহঙ্কার ও অমায়িক ব্যক্তি সৈয়দ আবুল হোসেন। ধনী-দরিদ্র সকল স্তরের মানুষের সাথেই সহজ সরলভাবে মেশেন, কথা বলেন। মন্ত্রণালয়ে গেলে দেখা যায় জরুরি কাজে ফাইল ওয়ার্কে নিজের অফিস কক্ষে মন্ত্রীর চেয়ারে অনড় বসে থাকেন না। দর্শনার্থীদের সময় দিচ্ছেন, সভা করছেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন, সহকর্মীদের সাথে মত বিনিময় করছেন, মন্ত্রণালয়ের কাজের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা কর্মকর্তাদের পদক্ষেপ গ্রহণে অনুরোধ করছেন। তদসাথে ফাইলের কাজও করছেন। জরুরি ফাইলের তাৎক্ষণিক সমাধান আবশ্যক মনে হলে অতিথিবৃন্দের কক্ষ ছেড়ে সচিবের কক্ষে চলে যান আলাপ আলোচনার জন্য। ভিড়ের মধ্যে তাঁর কক্ষে সচিবকে ডেকে পাঠান না। এতে সচিবের শ্রমঘণ্টা নষ্ট হতে পারে ভেবে। বাংলাদেশে আর কয়জন মন্ত্রী এমনটা করে থাকেন?
অফিস শুরু হয় নয়টায়। মন্ত্রী হিসেবে তিনি যখন অফিসে আসেন, কারও কিছু বলার থাকে না। তবে তিনি অফিসে আসতে কখনও দেরি করেন না। নয়টায় অফিস শুরু হলেও অফিসে এসে হাজির হন আধ ঘণ্টা আগে। কোনো কোনো দিন আটটার আগে চলে আসেন। তিনি সরকারি কাজের প্রতি কতটা নিষ্ঠ, তা এই একটি ঘটনা হতে অনুধাবন করা যায়। নিয়মনীতি মেনে চলার যে স্বভাব তিনি গড়ে তুলেছেন, তা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের অনুসরণ করা উচিত। তাহলে বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের দুঃখ দারিদ্র্য জয় করে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে নিঃসন্দেহে। আমি মনে করি কাজে কর্মে সৈয়দ আবুল হোসেনের নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, আচার-আচরণ, নিরহঙ্কার, অমায়িক চলাফেরা, অফিস, সংসার ব্যবস্থা, বাণিজ্যেক কার্যক্রম, দ্রুততা, একাগ্রতা ইত্যাদি বিষয়গুলো ডকুমেন্টারি করে জনগণের সামনে তুলে ধরলে নবপ্রজন্ম ও অলস ব্যক্তিবর্গ উপকৃত হবে।
সৈয়দ আবুল হোসেনকে কেবল বাংলাদেশের সমাজে আবদ্ধ ভাবলে চলবে না। তিনি তাঁর ব্যবসাবাণিজ্যের কাজ করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, চিন ও বাংলাদেশসহ এশিয়ার ২৬টি দেশ নিয়ে চিনের হাইনান প্রদেশের বোয়াওতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ফোরাম ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’ গঠনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এ ফোরাম তাঁর মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বিশ্ব অঙ্গনে উজ্জ্বল করতে সক্ষম হয়েছে।
সৈয়দ আবুল হোসেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ। তিনি তাঁর জীবন, কর্ম, অর্জন ও চিন্তাকে সকলের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। দেশ ও জাতির প্রতি রয়েছে তার অকুণ্ঠ ভালোবাসা, মানুষের প্রতি রয়েছে অপরিসীম শ্রদ্ধা। তাঁর বেলায় কবির সে অমর পঙক্তিগুলো উচ্চারণ করা যায় :

আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবণী পরে
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।

দয়ালু, দাতা, পরপোকারী সৈয়দ আবুল হোসেন দীর্ঘজীবী হোন। সুখী সুন্দর জীবনযাপন করুন, কায়মনে এটিই কামনা করছি। তাঁর সুকর্মে তিনি আদর্শ হয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে এবং বহিঃবিশ্বে চির জাগরূক থাকুন। পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁকে সে তৌফিক দান করুন, যাতে তিনি সুস্থ সবল থেকে দেশ ও জাতির সেবা করে যেতে পারেন।
ফোরকান বেগম: কলামিস্ট, কথাশিল্পী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও মহিলা স্কোয়াড প্রধান, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

সৈয়দ আবুল হোসেন : কাছ থেকে দেখা
সমীর রঞ্জন দাস
সৈয়দ আবুল হোসেন বঙ্গবন্ধু’র আদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী এবং বর্তমান সরকারের মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী। মাদারীপুর-৩ আসন থেকে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে পর পর চারবার বিপুল ভোটে জয় লাভ করা মাননীয় সংসদ সদস্য। ব্যক্তিগত জীবনে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। লব্ধ প্রতিষ্ঠিত সাকো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড-এর স্বত্বাধিকারী এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং ১৯৭৪ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন একজন মেধাবী ও আদর্শ ছাত্র। তার শিক্ষক, সহপাঠী ও আত্মীয়স্বজন সবাই তাকে আদর্শ ছাত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ব্যবহার দ্বারা তিনি এ স্বীকৃতি অর্জন করেছেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষ। খুবই ভালো মানুষ। শিক্ষিত, মার্জিত, বিনয়ী, ভদ্র ও হাসি-খুশি মানুষ। সদালাপী ও নতুন সম্পর্ক সৃষ্টিতে উদ্যোগী মানুষ। সুন্দর মন, সত্যের সন্ধানী মানুষ। জনকল্যাণ ও ভালোকাজে উদার মানুষ। তিনি একজন লোভ-লালসামুক্ত মানুষ। সংস্কৃতিবান মানুষ। একজন পরোপকারী ও দেশপ্রেমিক মানুষ। তিনি একজন শিক্ষানুরাগী ও সমাজহিতৈষী মানুষ। একজন সাদাসিদে সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষ। যাঁর তুলনা বিরল। তার মধ্যে কোনো কুসংস্কার নেই। তিনি জ্ঞান দ্বারা অর্জিত বিষয়কে বাস্তবতা দ্বারা বিশ্লেষণ করতে পারঙ্গম একজন মানুষ।
আমি তাঁর অধীনস্থ একজন কর্মকর্তা। দীর্ঘ প্রায় ২২ বছর তাঁর সাথে কাজ করছি, তাঁর কোম্পানিতে চাকুরির সুবাদে। তাই ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে তাঁকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁকে যত দেখেছি তত মুগ্ধ হয়েছি। আমাদের মতো অধস্তন চাকুরেদের প্রতি তাঁর স্নেহ মমতা একালে আর কারও কাছে দেখা যায় না। আমি তাঁর চাকুরে এটা আমাকে গর্বিত করে। তবে যতক্ষণ তাঁর কাছাকাছি থাকি ততক্ষণ মনে হয় আমি তাঁর চাকুরে নয়- সহকর্মী, ভাই, বন্ধু।
তাঁর প্রতিষ্ঠানে চাকুরিতে যোগ দেয়ার আগে স্যার আমার মৌখিক পরীক্ষা নেন। বলেনÑ সমীর, তোমাকে সকাল আটটায় অফিসে আসতে হবে এবং বিকাল ছয়টায় যেতে হবেÑ পারবে তো? সাথে সাথে সে কথায় আমি ‘হ্যাঁ’ বলেছি। সে কথাটি মনে রেখে কর্মজীবনে যোগ দেই এবং আজও নিয়মিত অফিস করছি। একটি কথা নাÑ বললেই নয়, আমার প্রথম চাকুরি জীবনের একটি কথা মনে পড়ে- সেটা হলো এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলাম। ছুটি কাটিয়ে ছিলাম প্রায় বিশ/একুশ দিন। ছুটি শেষে অফিসে কাজে যোগ দেয়ার পর একদিন আমাকে ডেকে স্যার হাসতে হাসতে বললেন- “সমীর, এতোদিন ছুটি কাটালে কি চাকুরি থাকে?” কথাটি ছিল তাঁর আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ। সেই সাথে আরেকটি কথা উল্লেখ করতে চাই- আমি যখন কাজ-কর্মে কোনো ভুল করি বা ভুল-ত্র“টি হয় তখন তিনি বলে থাকেন- গাধাটা কিছু বোঝে না। সেটাও তাঁর আন্তরিকতা ও ভালোবাসার আরেকটি উদাহরণ। কথাটা এমনভাবে বলেন যে, পরবর্তীকালে কোনো কাজ ধরলে একাগ্রতা আপনা-আপনি জেগে ওঠে।
আমি দেখেছি, স্যার কঠোর পরিশ্রমী এবং নিয়ম-নীতি মেনে চলার মানুষ। শৃঙ্খলাবোধই তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ক্লান্তিবোধ বলতে একটা কথা আছে, কিন্তু দীর্ঘ চাকুরি জীবনে তাঁর মধ্যে আমি ক্লান্তিবোধ দেখিনি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় আঠারো-বিশ ঘণ্টাই পরিশ্রম করে থাকেন। অবসর সময়ে প্রচুর লেখাপড়া করেন। কোনো রাজনৈতিক সভা বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পূর্বে বই-পত্র এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট নিয়ে স্টাডি করেন। পার্লামেন্টে কথা বলার আগে প্রস্তুতিমূলক নোট করেন ও লেখাপড়া করেন। ফলে সংসদে একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেছেন। তিনি সব বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ফলে যে কোনো বিষয়ে যে কোনো সভায় কোনো প্রস্তুতি ছাড়া মুগ্ধকর বক্তব্য রাখতে পারেন।
স্যারের সবচেয়ে বড় গুণ হল, তিনি শত্র“কে শত্র“ হিসেবে দেখেন না। মিত্র হিসেবে কাছে টেনে নেন। ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেন। সন্ত্রাসী এবং সহিংসতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন তিনি। তিনি শান্তিতে বিশ্বাসী। কারও উপকার ছাড়া অপকার কামনা করেন না। কেউ তাঁর ব্যবহারে অহেতুক কষ্ট পেয়েছেন এমন ঘটনা নেই। কোনো লোক স্যারের কাছে সাহায্যের জন্য আসলে, তাদের বিমুখ হতে কখনও দেখিনি। তিনি নিজের অর্জনকে সবার দয়ার ফসল মনে করেন। ফলে তাঁর কাছে কেউ কোনো বিষয়ে বিমুখ হন না। কোনো কিছু নাÑপারলে এমনভাবে বুঝিয়ে দেন যে, সবাই খুশি হয়ে যান।
তিনি একজন বড় মাপের, উদার মানুষ। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। নিয়মিত নামাজ পড়েন। জাতি-ধর্ম দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে তিনি সমান দৃষ্টিতে দেখেন এবং কাছে টেনে নেন। বড়-ছোট বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীÑএভাবে তিনি কাউকে দেখেন না। ছোট-বড় সবাইকে সমান চোখে দেখেন। শ্রেণিভেদে তিনি সবাইকে যথাযথভাবে সম্মান করেন। আমি হিন্দু, স্যার মুসলমান। আমি কোনোদিন তাঁর কাছ হতে এ বিষয়ে সামান্য বৈষম্যও পাইনি। মানবধর্মের এমন অনুসারী বাংলাদেশে বিরল।
তিনি দেশের উন্নয়ন, এলাকার উন্নয়ন নিয়ে ভাবেন। নির্বাচনী এলাকার দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কি করা যেতে পারে, কি করলে তাদের ভালো হবে, কর্মসংস্থান হবেÑ দু’মুঠো ভাত পেট ভরে খেতে পারবে, সে চিন্তা তিনি করেন। এলাকার অনুন্নত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে সব সময় চিন্তিত থাকেন। সেই চিন্তা ও চেতনা থেকে তিনি এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী মানুষের কথা চিন্তা করে, এলাকায় অসংখ্য স্কুল, কলেজ- মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন। মানুষের কল্যাণ করেই তিনি আনন্দ পান। মানবকল্যাণই তাঁর ধর্ম।
স্যার সব সময় সাধারণ খাবার পছন্দ করেন। তাঁর পছন্দের খাবার তালিকার মধ্যে অন্যতম ডিমভাজি। সেই সাথে উল্লেখ করতে হয়, কোনো অনুষ্ঠানে বা কোথাও বেড়াতে গেলে যারা তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে থাকেন, তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তিনি খুবই সচেতন থাকেন। খোঁজ-খবর রাখেনÑখেয়েছে কিনা, কোনো সমস্যা আছে কিনা। তাঁর সহকর্মী এবং অধস্তনদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি সবসময় থাকে।
তাঁর পারিবারিক জীবন নিয়ে বলার সাহস আমার নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি : তিনি একজন সুখী মানুষ, তিনি সমাদৃত ব্যক্তি, উঁচুমানের মানুষ। তাঁর স্ত্রী খাজা নার্গিসও একজন উঁচু বংশীয় পরিবারের বিদুষী রমণী। স্যারের মতো স্যারের বেগম সাহেবার মনও উদার। তিনি আমাদের সন্তানের মতো স্নেহ করেন।
আরেকটি গুণ স্যারের যেটি আমার মতো সবাইকে মোহিত করে, সেটি হচ্ছে তাঁর সহজ সরল মন এবং নিরহঙ্কার ব্যবহার। সবার সাথে তিনি অমায়িক ব্যবহার করেন। পরিচিত কাউকে দেখলে সে ছোট হোক বড় হোক, সবার আগে হাসি দিয়ে স্বাগত জানান, কুশলাদি জানতে চান। আমাদের মতো অধস্তনদের প্রতিও তাঁর ব্যবহার অবিশ্বাস্য সৌজন্যে ভরপুর থাকে। বেসরকারি অফিসে চাকুরি করেন এমন অনেককে নিয়োগকর্তার ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে কাঁদতে দেখেছি। আমার স্যার এমন আচরণ কল্পনাও করতে পারেন না। তিনি সাকোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ পরিবারের সদস্য মনে করেন। তাদের আপদে বিপদে এগিয়ে আসেন।
পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্ম হয়, সমাজকে কিছু দেয়ার জন্য। সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতির অঙ্গনে তাঁরা বিভিন্ন সময়ে তাঁদের মেধা, প্রজ্ঞা এবং সৃষ্টিশীল কর্মের দ্বারা দেশ, সমাজ ও জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেন। সৈয়দ আবুল হোসেন তাদেরই একজন। এলাকার জনগণ, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সহকর্মীÑ সবার কাছে তিনি ভালো, অমায়িক ব্যক্তিত্ব। উত্তম বন্ধু, ভালো সহকর্মী, ভালো নেতা। আমি তাঁর সুস্বাস্থ্য ও সুদীর্ঘ জীবন কামনা করি।
সমীর রঞ্জন দাশ: সাকো ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা।

Man of dynamism, prudence and assiduous

Ahmudul Hasan

Alhaj Syed Abul Hossain, scion of holy and illustrious family of Bangladesh was born in 1951. After attaining the post-graduate degree in Management from the prestigious Dhaka University, the entrepreneur in him chose business as career. In 1975, he founded SAHCO International Limited to act as a conduit between the Government of Bangladesh and international organizations in the area of development assistance.

As the Managing Director of SAHCO Syed Abul Hossain has, by virtue of dynamism, prudence, inventive skill, assiduous efforts, fortitude and unparalleled organizational acumen, helped it become one of the leading business houses in Bangladesh as well as abroad. He is also a Director of a leading commercial bank of Bangladesh, Mutual Trust Bank Ltd.

As a patron of learning, Syed Abul Hossain has set up many schools, madrasahs and colleges. He is the Founder President of SAHCO Development Center, (SDC), an NGO carrying out human resources development and socio-economic strengthen activities in Bangladesh. Author of a dozen books on socio-economic and political issues, he is also a regular contributor of articles to leading print media. He was founder editor of an exceptional magazine named `Poltician’. Then he was a student of Dhaka University.

Syed Abul Hossain has been elected as member to Bangladesh National Parliament in four successive general elections in 1991, 1996, 2001 and 2008. He was a State Minister for Local Government, Rural Development and Cooperatives of the previous Government from 25.6.1996. He acted as a member of Parliamentary Standing Committee of the Ministry of Finance and also the International Affairs Secretary of Bangladesh Awami League, the largest Political Party of the country. Now, he is the Minister of Communications Ministry. Syed Abul Hossain is married to Khwaja Nagis Hossain and the couple is blessed with two daughters, both are highly educated from USA. An initial Member of the Boao Forum for Asia Alhaj Syed Abul Hossain MP is the Chief Representative of Bangladesh to the Forum. In this sense he is one of the most prominent International person of Bangladesh.

SAHCO International Ltd. was founded in 1975 with a vision to work as a trustworthy mouthpiece between the Government of Bangladesh and the international organizations and donors as development partners. With two decades of committed service, SAHCO has proved its appeal in nation building inventiveness. Now SHACO is the name of the company, stands as a symbol of confidence, self-assurance and reliability.

According to Syed Abul Hossoin, “SAHCO was conceived in 1975 with a vision to help the new country, our dear motherland in its march towards economic development through the promotion of democracy and democratic values in the country. Our commitment was to play a major role as an associate of foreign companies for the development of the country’s economy. I am happy to note that in this short period of time, our assiduous efforts and determination helped SAHCO to become one of the leading business house in Bangladesh.”1

The SAHCO scope of services in line with its commitment includes Feasibility Study, Consulting, Design Engineering, Fabrication, Erection, Procurement, and inspection, Construction, and Construction supervision, Commissioning, Start-up, Operation and Maintenance. Among other services of SAHCO are Inventory, Analysis and Forecasting, Detailed Design, Cost Estimation, Preparation and Checking of Bid Document. SAHCO also acts as the Sales Window/Local Associates of foreign companies for procurement of various development projects implemented under different agencies of government.

SAHCO can also provide services in respect of all types of consultancy including site selection, viability checking, engineering study, land use analysis, plan preparation, economic study, field supervision, socio-economic survey, data processing, reporting and judicious liberalization of trade and investment etc. The company provides services on its own merits and does not make unfair and misleading statements on services of its competitors. SAHCO has the capability to participate in all kinds of transportation planning and engineering. In this area its aim is to achieve the highest economic benefit and safety for the clients with optimum quality, fineness and durability.

SAHCO has successfully completed a large number of projects in the power sector of Bangladesh during last three decades. It is currently involved in several power projects in the country under different categories of financing including Suppliers’ Credit, Asian Development Bank (ADB) loan and International Development Agency (IDA) credit.

With the accelerated pace of inter-regional economic and cultural exchanges, the construction of transportation network is vital. SAHCO has rich technical human resources, engineering and scientific management to work in the infrastructure development projects. Highway, Bridge and Tunnel Subway, Railroad, Airfield Harbour and Technical Coastal Engineering and Offshore Facilities are among the areas where SAHCO has the capability to participate in any kind of transportation planning and engineering ventures. Construction of highway is the need of the hour. SAHCO is able to implement highway project.

The 1786 meter-long Paksey Bridge, the second largest bridge, consisting of 15 spans (each 109.5 meter long) plus two shorter end spans (each 71.75 meter long) across the river Padma in western part of Bangladesh is of strategic importance to the road and bridge infrastructure improvement programe of Bangladesh. Communication with the South West of Bangladesh and Mongla Port facilities, through to the North West, India and Nepal and via Bangabandhu Multipurpose Jamuna Bridge to Dhaka depends on crossing the river Padma at Paksey.

Carried out by highly experienced specialists using world-class systems, SAHCO’s precise design engineering works are divided into concept design, reserve design, basic design, detailed design and production design.From feasibility to technological and economic analysis and evaluation, SAHCO confidently addresses the minutest details for flawless construction. For customers who are planning new business, SAHCO presents opportunities to obtain optimum results.The Company carefully gathers, analyse and evaluates data on the proposed project and related materials, and then provides expert consulting services. Maximum customer benefits are ensured by meticulous analysis of the financing and feasibility of any project.

From the early days of its foundation, SAHCO has contributed to the national economic development by implementing the projects like Meghnaghat site preparation work under BPDB, Bera and Koitala Pumping Stations, Dholaikhal Pump Station Project under Dhaka City Corporation on IDA Credit, Construction of Twin-Culvert (Contract No. 3) under Syedabad Water Treatment Plant on IDA Credit, Construction of Water Supply Pipeline in Dhaka City (Contract No. 6) under Syedabad Water Treatment Plant on IDA Credit.

SAHCO also deals in Water Resources Development, Water Supply & Sewerage, Environmental Planning , Waste Treatment, Irrigation & Drainage, Reclamation, it also carries out Design and construction of University, College & School building, Urban & Regional Planning , Tourism Development , Industrial Development Planning , Architectural Design, The latest scientific design techniques to facilitate office work, Design and construction of office & commercial building SAHCO is also working in the fields of: Trading, Development, Export, Import and Local Supply. SAHCO has developed a group of experts for working in the field of telecommunication. It now extends its business in the Bangladesh’s booming IT sector with a view to render its contribution to the country’s efforts to cope with the competitive present day world.

IT is the country’s fastest growing sector but yet it needs more attention for the development and expansion of the existing telecommunication facilities to usher the country into Information Superhighway connectivity. Only an insignificant section of society mainly based in urban areas have the access to the telecommunication sector, which prompted SAHCO to contribute to the development of the sector.

Telecommunication is both an industry and an infrastructure, which helps other infrastructures to grow. The telephone density in Bangladesh is far below the world average of 10 telephones per 100 people. In order to enhance the investment in the telecommunication sector, the government has been pursuing the policy of raising the public sector allocation on the one hand, and attracting private sector investment by privatizing certain services, e.g. rural telecommunication, cellular mobile service, paging and radio trunking services etc. on the other.

SAHCO has the expertise to work in the projects under this sector including installation of digital telephone exchanges with high frequency switching power supply and tamdem switching exchange.

SAHCO is quite capable for undertaking the responsibilities of implementation of all projects in the energy and power sectors encompassing all aspects of projects development and execution from the initial feasibility study to commissioning. In association with Hyundai Corporation, Korea SAHCO has successfully completed a number of gas projects including the turnkey installation of Kailashtila LPG Plant Project of Rupantarita Gas Company Limited, a subsidiary of the state-owned organization named Petrobangla of Bangladesh.

SAHCO is dealing with various subsidiary companies of Petrobangla. They are Bangladesh Gas Exploration Company Limited, Bakhrabad Gas Systems Limited, Sylhet Gas Field Company Limited, Jalalabad Gas Transmission and Distribution Systems Limited, Rupantarita Prakritik Gas Company Limited, Gas Transmission Company Limited, Pashchimanchal Gas Transmission Company Limited, Bangladesh Petroleum Corporation and Eastern Refinery Limited.

SAHCO’s area of work in the sector ranges from Gas exploration to offshore development. It has cooperated with many leading gas companies and offshore contractors in the successful realization of projects. Through its activities, it has established close relationships with these energy giants.

SAHCO’s area of work also covers coal-mining projects of Bangladesh. Bangladesh has so far discovered huge quantity of coal in five coalfields—Khalashpir of Rangpur, Barapukuria, Dighipara and Fulbari of Dinajpur and Jamalganj of Joypurhat. SAHCO is able to conduct geological survey on mineral resources and implement coal mining development project in association with foreign companies.

SAHCO serves as consultant in designing of all types of development plans including urban and regional plans, master plans. It also acts as a consultant in designing of different types of building structures, utilizing various materials of construction and the extensive experience SAHCO has gained in the field of structural analysis and design, particularly with regard to the development of advanced structural systems and the effect of wind and temperature.

SAHCO is ready to stretch its hands of cooperation to its valued clients for export, import and supply of all types of commodities such as different kinds of automobiles, cotton, yarn, electrical equipment, cables, chemicals, medical equipment, food grains, etc.

SAHCO is not only a business organization, it also works to build enlightend society. It established a number of schools and colleges for the sake of human resource development passing on the light of education to the future generation. SAHCO always give emphasis on the quality of its services extended to its sophisticated clients who are gradually becoming more demanding. The obligation and competence have already gained enormous reputation from home and abroad.

All the staff of SAHCO are highly competent and experienced whose services have demonstrated satisfactory and trustworthy. SAHCO believes in team spirit coupled with honesty and integrity, openness and trust and looks forward to every growing opportunity to serve its clients, business associates and the Nation at large. SAHCO as well as Syed Abul Hossin is dedicated to direct all its actions to smooth the advancement of the economic development of the nation and is not, in any way, engaged in any activity compromising this commitment. It never undertakes any project detrimental to the interest of the nation or having adverse impact on the social and cultural ethos of the citizens.

Md. Hasan : Chittagong University, Department of English.

1. From the brochure of SHACO .

সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ খোয়াজপুর
মো. রফিকুল ইসলাম কোতোয়াল
১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় বছর। ঐ বছর মাদারীপুর জেলার সবচেয়ে অবহেলিত এলাকা খোয়াজপুরে সৈয়দ আবুল হোসেন তার জীবনের প্রথম কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা এলাকার জন্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা হতে পারে কিন্তু গোটা দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা হতে পারে না; প্রতি বছর অনেক কলেজ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। কিন্তু যে কলেজটির কথা বলা হচ্ছে এটি সাধারণ কোনো কলেজ নয়, এরূপ কলেজ শত বর্ষেও একটি প্রতিষ্ঠা পায় না। এ বিষয়ে বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেন, “১৯৮৯ সালে মাদারীপুর জেলার খোয়াজপুরে সৈয়দ আবুল হোসেন একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজ অনেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। তাই প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গটি তেমন গুরুত্বের দাবি রাখে না কিন্তু এ কলেজটি গুরুত্বের দাবি রাখে। এর কারণ প্রতিষ্ঠাগত নয়, প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী ফলগত। ১৯৯১ সালে কলেজের ছাত্রছাত্রীরা প্রথম বারের মতো বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নেয়। প্রথম বারেই এ কলেজের কয়েকজন ছাত্র বোর্ডের মেধা তালিকার দু’টি শীর্ষ স্থান দখল করে সারা দেশে আলোড়ন তুলে দিয়েছিল। এর পরের বছর আরও ভালো রেজাল্ট করেছে কলেজটি, পরের বছর আরও। সংগত কারণে ১৯৯১ সাল হতে সৈয়দ আবুল হোসেন তার কলেজের সাথে সাথে দেশব্যাপী পরিচিত ও বিখ্যাত হয়ে ওঠে।’১
খোয়াজপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার কারণ বলতে গিয়ে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন বলেন, ১৯৮৯ সালের আগস্ট মাসে সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব মাদারীপুরের খোয়াজপুরে কলেজ প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়া আমাকে ধরিয়া বসেন। শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা ও উহার বিস্তারে এবং সমাজ সেবায় তাহার কোনো তুলনা এ কালে নাই। মেধা ও কর্মদক্ষতা গুণে সমাজে একটু প্রতিষ্ঠা লাভের সঙ্গে সঙ্গে তিনি শিক্ষা বিস্তারের বলিষ্ঠ মনোভাাব লইয়া একটি আদর্শ উচ্চ বিদ্যাপীঠ গড়িয়া তুলিবার উদ্যোগ নিয়াছেন। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে তিনি তাঁহার নিজ থানা সদরে অবস্থিত কালকিনি কলেজকে একটি প্রথম শ্রেণির উন্নত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিতে চাহিলেন। কিন্তু তৎকালীন রাজনীতিক প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ তাঁহাকে রাজনীতির অঙ্গনে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী চিন্তা করিয়া এই কাজে অগ্রসর হইতে তীব্র বাধা প্রদান করিলেন। তিনি তাহাতে দমিবার পাত্র ছিলেন না। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি ১৯৮৯ সনে মাদারীপুর সদর থানার খোয়াজপুরে সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ প্রতিষ্ঠা করিলেন। মেধাবী ছাত্রদের থাকা খাওয়া ফ্রি ঘোষণাসহ কলেজে প্রথম দুই বছর বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ দানপূর্বক এই ব্যতিক্রমধর্মী কলেজটি গড়িয়া তুলিলেন। বিশাল সুদৃশ্য ভবন নিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা পাইল। এই কলেজ প্রতিষ্ঠার সংকল্প গ্রহণ করিয়াই তিনি আমাকে তাঁহার সন্তান প্রতিম প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য এমনভাবে ধরিয়া বসিলেন যে, আমি আর না বলিতে পারি নাই। এই কলেজের তিনিই স্রষ্টা। বয়সের ভারে আমি প্রায় রোজই কলেজ ছাড়ি ছাড়ি করিয়াও সহজে ছাড়িতে পারি নাই। যুবা বয়সে সৈয়দ আবুল হোসেন আপন পরিশ্রমে বিপুল বিত্তের অধিকারী হইলেন। সেই টাকা সে অন্যান্য বাঙালির মতো আনন্দ ফুর্তি করিয়া খরচ করিতে পারিতেন। আবুল হোসেন তাহা করিলেন না। তিনি দেশের কথা ভাবিলেন, শিক্ষার কথা ভাবিলেন। তাই আনন্দ ফুর্তি নামক ক্ষণিকের মোহকে জলাঞ্জলি দিয়া প্রত্যন্ত গ্রামে গলা-জলে ডোবা বিলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিলেন।’২
শিক্ষা বিস্তারের মহান ব্রতকে সামনে রেখে তিনি ১৯৮৯ সালে মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলাধীন খোয়াজপুর গ্রামে এ অনন্যসাধারণ কলেজটি গড়ে তোলেন। সেখানকার শিক্ষায় অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার আলো বিস্তারই ছিল তার মূল লক্ষ্য। এই কলেজটির সাফল্যের মাধ্যমে তিনি দেশব্যাপী শিক্ষানুরাগী হিসেবে খ্যাতি পান। এ সুনাম ও কৃতিত্ব তাকে শিক্ষাবিস্তারে আরও প্রত্যয়ী এবং আগ্রহী করে তোলে। ফলে খোয়াজপুর কলেজকে বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে একটি মাইল ফলক বলা যায়। এ প্রসঙ্গে খোয়াজপুর সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ প্রকাশ চন্দ্র নাগ বলেন, ‘এরপর আর থেমে থাকেন নি জনাব সৈয়দ আবুল হোসেন। তার মহান ছোঁয়ায় ১৯৯২ সালে তৎকালীন “কালকিনি কলেজ” নবরূপে নবজীবন লাভ করে ‘কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ’ নামেÑ যেখানে এ দেশে প্রথম বেসরকারি পর্যায়ে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। ১৯৯৪ সালে তিনি তার নিজ জন্মস্থান কালকিনি উপজেলার ডাসারে অবস্থিত ডি.কে. আইডিয়াল স্কুলকে তার পিতার নামানুসারে ডি.কে. আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এ্যান্ড কলেজ-এ রূপান্তরিত করেন। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে সম্পূর্ণ নতুন রূপে ডাসারেই গড়ে তোলেন বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশরতœ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার নামে “শেখ হাসিনা একাডেমী এ্যান্ড উইমেন্স কলেজ”।৩
তবে খোয়াজপুরে কলেজ প্রতিষ্ঠা এত সহজসাধ্য ছিল না। এলাকাটি ছিল অত্যন্ত অনগ্রসর এবং নিচু। কলেজ স্থাপনের মতো কোনো উঁচু জমি ছিল না। এ প্রসঙ্গে প্রাক্তন সচিব ও প্রাক্তন প্রধান তথ্য কমিশনার এবং যাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও কবি এম আজিজুর রহমান বলেন, ‘খোয়াজপুর ছিল মাদারীপুর জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। ছিল না বিদ্যুৎ, ছিল না রাস্তা-শিক্ষা-দীক্ষা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ছিটেফোঁটা চিহ্ন। চারিদিকে জলে-বিলে ডোবা গ্রামটির অধিবাসীগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত নাজুক। কোনো কলেজ দূরে থাক, কলেজ প্রতিষ্ঠার মতো ভূমিও তল্লাটে ছিল নাÑ দিগন্তব্যাপী বিল আর বিল, জল আর জল। এরূপ একটি পশ্চাৎপদ এলাকায় সৈয়দ আবুল হোসেন গলা জলের উপর গড়ে তোলেন সুরম্য অট্টালিকা সমৃদ্ধ অপূর্ব অবকাঠামোয় দৃষ্টিনন্দন ও উন্নত মানের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানÑ যার নাম সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ।’৪ খোয়াজপুরে যেখানে বর্তমানে সুদৃশ্য সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ দাঁড়িয়ে, ১৯৮৯ সালের আগে সেটি ছিল সাত-আট হাত গভীর পানির বিল। মাটির পর মাটি নয়, রীতিমতো টাকার উপর টাকা দিয়ে বিলের উপর প্রাসাদ তুলেছেন। সৃষ্টি করেছেন শিক্ষার অনবদ্য পরিবেশ। ৫
প্রতিষ্ঠার পর হতে কলেজটির শিক্ষাগত মান ও বোর্ড পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফল দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রতিষ্ঠাতার সুনাম। বিভিন্ন এলাকা হতে দলে দলে ছুটে এসেছিল মেধাবী শিক্ষার্থীরা। সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজে সন্তান-সন্ততির ভর্তি করানো অভিভাবক ও শিক্ষার্থীগণের কাছে মর্যাদা এবং সফলতার প্রতীক হয়ে ওঠে। সারা বাংলাদেশ সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ এবং প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল হোসেনের সাফল্য দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। কারণ সদ্য প্রতিষ্ঠিত এমন অজপাড়াগাঁয়ের একটি কলেজের পক্ষে স্বল্প সময়ে এমন কৃতিত্ব অর্জন সত্যি অবিশ্বাস্য ছিল।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রথম বারের মতো এইচএসসি বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। সৈয়দ আবুল হোসেন খোয়াজপুর ১৯৯১ সালে প্রথম এইচএসসি পরীক্ষায় বাণিজ্য শাখায় ঢাকা বোর্ডের মেধা তালিকায় ১ম ও ৪র্থ স্থান অধিকার করে যথাক্রমে জাহিদ হোসেন পনির ও মনোয়ার হোসেন লাভলু। এরপর প্রায় প্রতি বছরই এ কলেজ থেকে বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। ১৯৯৩ সালে ৩টি, ১৯৯৪ সালে ৭টি, ১৯৯৫ সালে ৩টি, ১৯৯৬ সালে ৪টি, ১৯৯৭ সালে ১টি এবং ১৯৯৯ সালে ১টিসহ মোট ২১ জন শিক্ষার্থী বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান দখল করে। এ সাফল্য অর্জনের মূল নিয়ামক ছিল সৈয়দ আবুল হোসেন। কেননা তিনি সবসময় মেধাবী শিক্ষার্থীদের যাবতীয় খরচ বহন করতেন। ১৯৯২ সালে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেনে বিভিন্ন বোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান দখলকারীসহ স্টার মার্কস প্রাপ্তদের থাকা খাওয়াসহ পড়াশুনার যাবতীয় খরচ তিনি বহন করবেন। সে বছর এ দেশের সব প্রান্ত থেকে প্রচুর ছেলে মেয়ে এসে ভর্তি হয়েছিল। ফলে ১৯৯৪ সালে মেধা তালিকায় সর্বাধিক সংখ্যক (৭টি) স্থান দখল করেছিল এ কলেজের শিক্ষার্থীরা। সমগ্র দেশবাসীর দৃষ্টি কেড়েছিল কলেজটি তার অর্জিত ফলাফলের মাধ্যমে। কারণ এরূপ কৃতিত্ব খোয়াজপুরের মতো অজপাড়াগায়ে অবস্থিত নতুন কোনো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব হয়নি।৬
সাফল্য সবাই চায় কিন্তু পায় না। কারণ সাফল্য পেতে হলে সাফল্যকে কাছে আনার যোগ্যতা থাকতে হয়, কাজ করতে হয়। খোয়াজপুর কলেজের এরূপ সাফল্যের কারণ কলেজের অধ্যক্ষ প্রকাশ চন্দ্র নাগ-এর কাছে শোনা যাক-“ সৈয়দ আবুল হোসেন প্রথম ব্যাচে ভর্তিকৃত সকল ছাত্র-ছাত্রীকে বিনা খরচে অধ্যয়নের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ করে তাদের থাকা-খাওয়াসহ যাবতীয় খরচ তিনি নিজেই বহন করেন। কলেজটি এমপিও ভুক্ত না-হওয়া পর্যন্ত অধ্যক্ষসহ শিক্ষক-কর্মচারীদের যাবতীয় বেতন-ভাতার ব্যবস্থাও তিনি নিজে করেছেন। কোনো শিক্ষক-কর্মচারী বুঝতেই পারতেন না যে, কলেজটি এমপিও-ভুক্ত হয়নি। নিয়োগ দেয়া হয়েছিল দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক। গৌরনদী কলেজে প্রাক্তন অধ্যক্ষ মো. তমিজ উদ্দিনকে কলেজের অধ্যক্ষ করা হয়েছিল। অধ্যক্ষ মহোদয় সরকারি কলেজ থেকে অবসরপ্রাপ্ত হওয়ায় এমপিও ভুক্তির আওতায় আসবেন না বিধায় শুরু থেকে তিনি যে পর্যন্ত ছিলেন সে পর্যন্ত আলাদাভাবে তার জন্য উচ্চতর বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করেছেন। অধ্যক্ষ মো. তমিজউদ্দিন মহোদয়কে মাদারীপুর থেকে কলেজে যাতায়াতের জন্য একটি লাল রঙের জিপের ব্যবস্থাও করেছিলেন, যেটিতে লেখা ছিল কলেজের নাম।
নব প্রতিষ্ঠিত কোনো কলেজ এমপিও-ভুক্ত না-হওয়া পর্যন্ত শিক্ষক-কর্মচারীগণ বেতন-ভাতার সরকারি অংশ পান না। ভবন, আসবাবপত্র ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণও সরকার হতে দেয়া হয় না। এ অবস্থায় সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের যাবতীয় ব্যয়ভার একাই বহন করেছেন। এক্ষেত্রে তার দান এত বেশি ছিল যে, তা সরকারি অনুদানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। যার ফলে শিক্ষকগণ অন্যচিন্তা মুক্ত হয়ে ছাত্রছাত্রীদের উজাড় করে দিতে পেরেছেন নিজেদের। ফলে সাফল্য ধরা দিয়েছে সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের।

মো. রফিকুল ইসলাম কোতেয়াল : রাজনীতিবিদ।

১ আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ আবুল হোসেন: আমার ভাল লাগা একজন।
২ আমার আলেকজান্ডার, অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মো. তমিজ উদ্দিন।
৩ মহানুভব এক মহানায়ক, অধ্যক্ষ প্রকাশ চন্দ্র নাগ।
৪ মননে উদ্ভাসিত অনুজপ্রতীম সৈয়দ আবুল হোসেন এম আজিজুর রহমান।
৫ শতাব্দীর স্মৃতি, আবদুল কাদের।
৬ তথ্যসূত্রঃ অধ্যক্ষ প্রকাশ চন্দ্র নাগ, সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ, খোয়াজপুর।

কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
জিয়াউল হাসান
স্বাধীনতাপূর্ব বা পরবর্তীকালে সৈয়দ আবুল হোসেনের পূর্বে কালকিনি উপজেলার কোনো অধিবাসী সংসদ সদস্য ছিলেন না। অন্য এলাকার লোক এসে এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতেন। ফলে, প্রত্যন্ত এ জনপদটির উন্নয়নে আন্তরিকভাবে কাজ করার, এলাকার সমস্যা সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে কথা বলার, জনগণের অভাব-অভিযোগ শোনার মতো কেউ ছিল না। সংগত কারণে কালকিনি দেশের অন্যান্য এলাকা, এমন কি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের চেয়ে শিক্ষা-দীক্ষা, যোগাযোগ, অবকাঠামো এবং আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে পড়েছিল। কালকিনির এ ক্রান্তিলগ্নে প্রচণ্ড প্রতাপ ও অনিমেষ প্রত্যাশা নিয়ে আবির্ভূত হন চির ভাস্বর একটি নক্ষত্র, যার নাম সৈয়দ আবুল হোসেন। 
এ নক্ষত্রের অসংখ্য অমর কীর্তি আজ কালকিনিসহ সারা দেশে বাতাসের মতো অনবদ্য প্রশান্তিতে ছড়িয়ে। তন্মধ্যে কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ একটি। সৈয়দ আবুল হোসেনের অবদান ছাড়া এ কলেজটির বর্তমান উত্তরণ, উন্নয়ন, বিকাশ ও প্রকাশ কখনও সম্ভব ছিল না। তবে এ উত্তরণের ইতিহাস কুসুমাকীর্ণ ছিল না, ছিল বরং কণ্টকাকীর্ণ। সৈয়দ আবুল হোসেনের পবিত্র ছোঁয়ায় কণ্টক কুসুমে কুসুমে হয়ে উঠেছিল কাননময়। এ কলেজের নবজন্মের ইতিহাস অধ্যক্ষ মো. খালেকুজ্জামানের জবানিতে শোনা যেতে পারে :
“১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাস। কালকিনি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জনাব জালাল উদ্দিন সাহেবের সাথে কলেজের কাজে ঢাকা গেছি। ঢাকা বোর্ডের কর্মচারী জনাব সৈয়দ আবুল হান্নান সাহেবের সাথে চা খেতে বসে কলেজের উন্নয়নের কথা আলোচনা করছি। অধ্যক্ষ স্যার কলেজের আর্থিক অসচ্ছলতা, ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি, ক্যাম্পাসের প্রতিকূল পরিবেশ প্রভৃতি ব্যাপারে আলোচনা করছেন। আলোচনার এক পর্যায়ে হান্নান সাহেব বললেন, ‘আমার একজন আত্মীয় আছেন ধনাঢ্য এবং শিক্ষানুরাগী। চলেন তার কাছে যাই, দেখি তিনি কোনো সাহায্য করতে পারেন কিনা।’ আমরা গেলাম মতিঝিলের আমিন কোর্টে। সুউচ্চ ভবনের ত্রিতলে সাকো অফিস। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হান্নান সাহেবের আত্মীয়। হান্নান সাহেব আমাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহেবের কক্ষে নিয়ে গেলেন। 
পরিচয় হলো আজকের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে। প্রথম দৃষ্টিতে মুগ্ধ হলাম। যেমন সুন্দর চেহারা তেমন অমায়িক ব্যবহার। কালকিনি কলেজের দীনতার কথা আলোচনা করলাম। উনি বললেন, ‘আজিজ ভাই (প্রয়াত আজিজ চেয়ারম্যান সাহেব) আমাকে বলেছিলেন কলেজটির উন্নয়নে এগিয়ে আসতে কিন্তু নানা ব্যস্ততার কারণে হয়ে ওঠেনি। আপনারা এখন এসেছেন, আমি চিন্তা করে দেখব কি করা যায়।’ 
আমরা আশ্বস্ত হয়ে ফিরে আসলাম। জালাল স্যার চলে গেলেন অন্য কলেজে। দায়িত্বে আসলেন জনাব হাতেম আলী মিঞা। ১৯৮৫ সালের শেষে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিলাম আমি। অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে বুঝলাম কলেজের অবস্থা কত মারাত্মক ও কত সঙ্গীন। এ অবস্থা কয়েক বছর থাকলে কলেজটি বন্ধ হয়ে যাবে। বারবার মন চাইছিল কলেজটির উন্নয়নের জন্য সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে ছুটে যাই। তাঁকে গিয়ে বলি কিন্তু বিভিন্ন কারণে কলেজের উন্নয়নের অনুরোধ নিয়ে তাঁর সাথে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে সরকারি হওয়ার আশায় সংশ্লিষ্টদের যোগাযোগের উৎসাহে আরও ভাটা পড়ে। গুটি কয়েক লোক সৈয়দ আবুল হোসেনকে দিয়ে কলেজের উন্নয়ন হোক এটি চাইছিলেন না। এর কারণ ছিল মূলত রাজনৈতিক।”১
তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের কালকিনির নেতাদের মনে এমন একটা ধারণা ছিল যে, সৈয়দ আবুল হোসেনকে কালকিনি কলেজ প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেয়া হলে এলাকায় তার নাম ও প্রভাব-প্রতিপত্তি আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। সূর্যের কাছে কেরোসিনের প্রদীপের মতো তার নি®প্রভ হয়ে পড়বে এবং তাদের রাজনীতি মাঠে মারা যাবে। তাই তারা সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরোধিতা করা শুরু করেন।
কিন্তু তারা সৈয়দ আবুল হোসেনকে থামিয়ে রাখতে পারলেন না। ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা পেল খোয়াজপুর সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ। কলেজটির অবকাঠামো, ছাত্র শিক্ষকের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ চারিদিকে আলোড়ন সৃষ্টি করে। খোয়াজপুরের মতো একটি অজপাড়া গাঁ অল্প সময়ে রূপান্তরিত হয় একটি ছোটখাটো শহরে। প্রতিক্রিয়া হল কালকিনিতে। জনগণ, শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ হতে প্রশ্ন উঠল, কালকিনির ছেলের টাকা আমরা কেন আনতে পারলাম না। এলাকাবাসীর অনেকেই তখনও প্রত্যাশা করছেন কালকিনি কলেজ সরকারি হবে। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন কালকিনি সদরের ৩টি প্রতিষ্ঠান কালকিনি কলেজ, কালকিনি পাইলট হাইস্কুল ও কালকিনি গার্লস হাইস্কুল সরকারি হবে, কিন্তু তা হয়নি। এলাকার কলেজের উন্নয়নে সৈয়দ আবুল হোসেনের সহায়তা প্রার্থনার দাবি ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠে। শিক্ষানুরাগী হিসেবে ততদিনে তাঁর নাম সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে আবদুল আজিজ হাওলাদার : বলেন-
“খোয়াজপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার (১৯৮৯) কৃতিত্ব দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। চারদিক থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা দলে দলে ঐ কলেজে ভর্তি হবার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এ অবস্থায় কালকিনি কলেজে হতেও অনেক ছাত্র-ছাত্রী খোয়াজপুর আবুল হোসেন কলেজে চলে আসে। তখন কালকিনি কলেজে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমতে কমতে মাত্র তেইশে গিয়ে দাঁড়ায়। 
এবার টনক নড়ে কালকিনিবাসীর। কলেজ পরিচালনা কমিটি এলাকাবাসীর চাপে ঢাকার মতিঝিলের আমিন কোর্টে অবস্থিত সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালে চলে আসেন। তারা নিজেরাই সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, ‘আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আপনি কালকিনি কলেজের দায়িত্বভার গ্রহণ করুন। আমরা আপনাকে কালকিনি কলেজের দায়িত্ব তুলে দিলাম।’ 
সৈয়দ আবুল হোসেন অভিমান রাখতে পারলেন না। তাদের আহবানে সাড়া দিলেন। প্রথম কিস্তিতে দিলেন পঁচিশ লক্ষ টাকা। তার অর্থায়নে কালকিনি কলেজকে নতুনভাবে সাজানো হলো। সেদিনের সে ভাঙাচুরা মৃতপ্রায় কালকিনি কলেজ আজ কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। এর ইমারত ও গঠনশৈলী দেখে যে কেউ অভিভূত নাÑহয়ে পারবেন না। রাস্তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে পথচারীগণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আধুনিক যুগের নব তাজমহল কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের দিকে।”২
১৯৯০ সালে এরশাদের পদ ত্যাগের মাধ্যমে জাতীয় পার্টির সরকারের অবসান ঘটে। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ঐকান্তিক অনুরোধে প্রবল অনীহা সত্ত্বেও সৈয়দ আবুল হোসেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এলাকায় মাত্র একদিন এসে তিনি বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হন। এলাকার মানুষ, শিক্ষক ছাত্রছাত্রী সবাই একযোগে কলেজটির উন্নয়নের লক্ষ্যে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনকে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস নেন। 
তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান, ভারপ্রাপ্ত উপজেলা চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ অনেকে এ প্রয়াসে এগিয়ে আসেন। কলেজটিকে রক্ষা করতে হবে। কলেজটিকে রক্ষা করতে হলে অর্থের প্রয়োজন, প্রয়োজন উদ্যোগী ও উদ্যোমী উদার মনের মানুষ। এগিয়ে এলেন কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্যরা। জনাব অ্যাডভোকেট এম এ কাদের সাহেবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হলো সভা। সবার একই কথা কলেজটিকে রক্ষা করতে হলে, উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করতে হলে সৈয়দ আবুল হোসেন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কলেজটির উন্নয়নে আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের সহায়তা চাওয়ার এবং সার্বিক উন্নয়নে তাঁকে সম্পৃক্ত করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।৩
কলেজের উন্নয়নে সৈয়দ আবুল হোসেনের উন্নয়ন সম্পর্কে অধ্যক্ষ মো. খালেকুজ্জামান বলেন, ‘জনগণের নেতা সৈয়দ আবুল হোসেন। এলাকার উন্নয়ন তাঁর প্রাণ এবং শিক্ষাবিস্তার তাঁর হৃদপিণ্ড। জনগণের অনুরোধ তিনি ফেলতে পারলেন না। কলেজের উন্নয়নের জন্য এককালীন দান করলেন পঁচিশ লক্ষ টাকা। তাঁর এহেন বদান্যতায় জনগণ মুগ্ধ হয়ে কলেজটির নাম কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ রাখার দাবি তোলেন। নাম পরিবর্তনে সরকারি শর্ত ছিল পনেরো লক্ষ টাকা অনুদান। অথচ তিনি একবারেই দান করে দিলেন পঁচিশ লক্ষ টাকা। জন-দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুন ক্ষীণপ্রভা ‘কালকিনি কলেজ’ ‘কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ’ নাম ধারণ করে নব উদ্যমে যাত্রা শুরু করল। 
নিভু নিভু কালকিনি কলেজের শুরু হলো আলোঝলমল অগ্রযাত্রা। সৈয়দ আবুল হোসেন নামক মহাদাতার নির্মল পরশে সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল কলেজের নিভু নিভু শিখা। শুধু পঁচিশ লক্ষ টাকা দিয়ে তিনি থেমে থাকেননি। কলেজের উন্নয়নে আরও অনেক টাকা দিয়েছেন। নিজের মনের মতো করে সজ্জিত করেছেন কলেজ, ক্যাম্পাস ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা। এগিয়ে চলল কলেজের উন্নয়ন কাজ। বৃদ্ধি পেল ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা। 
তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কলেজে চালু হলো অনার্স কোর্স, মাস্টার্স কোর্স, বিএসসি কোর্স, নির্মিত হলো নতুন নতুন ভবন। বর্তমানে কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজে দশ বিষয়ে অনার্স ও দুই বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু হয়েছে। অধ্যয়ন করছে তিন সহস্রাধিক ছাত্রছাত্রী। প্রতি বছর পান্তাভাত খেয়ে এলাকার বহু ছাত্রছাত্রী অর্জন করছে সর্বোচ্চ ডিগ্রি। এছাড়া পরিকল্পনায় রয়েছে বিবিএ এবং এমবিএ-সহ কম্পিউটার বিজ্ঞানে অনার্স কোর্স চালুর। সবই সম্ভব হবে এবং অচিরে। কারণ কলেজের প্রাণপুরুষ সৈয়দ আবুল হোসেন।’
সৈয়দ আবুল হোসেন এককভাবে কালকিনির উন্নয়নের জন্য যে অবদান রেখেছেন, তা তাকে বাদ দিয়ে কালকিনির সকল জনগণের পক্ষেও সম্ভব হতো না। এলাকার উন্নয়নে তাঁর ইচ্ছা, প্রয়াস ও গতি যেমন অবিরাম, তেমন নিবিড় ও নিরলস। এ ব্যাপারে কোনো আপোষ নেই। কালকিনিকে তিনি দিয়েছেন অনেক; দিয়ে যাচ্ছেন অবিরল। বিনিময়ে পেয়েছেন এলাকার মানুষের প্রাণঢালা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। এ কারণে তাঁর কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ছাড়াই লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়। তাঁকে একনজর দেখার জন্য জনগণের ঢল নামে। আবালবৃদ্ধবণিতা বেরিয়ে আসে ঘর ছেড়ে, তাদের নমস্য ব্যক্তিটিকে এক নজর দেখবেন বলে।
কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ এখন কোনো সাধারণ কলেজ নয়; দক্ষিণ বঙ্গের অন্যতম খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ ছাড়া উপজেলাধীন ডাসার গ্রামে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ, শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজ প্রতিষ্ঠিত করে প্রত্যেকটিকে খ্যাতি অবয়ব ও শিক্ষার মান ও মননে শীর্ষে তুলে দিয়েছেন। তাঁর উদারতার ছোঁয়ায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে শশীকর শহিদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়, সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম কলেজ প্রভৃতির সার্বিক উন্নয়ন। 
এ বছরেই আড়িয়ালখাঁর অপর পাড়ের প্রত্যন্ত জনপদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন খাসেরহাট সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ। কলেজ ছাড়াও উপজেলার সব মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয় তাঁরই তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া তিনি শতাধিক স্বল্পব্যয়ী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাদরাসা শিক্ষার প্রসারেও তাঁর ভূমিকা অনন্য। তাঁর একক প্রচেষ্টা সমগ্র অঞ্চলকে নিরক্ষরতা মুক্ত আলোকপ্রাপ্ত অঞ্চলে পরিণত করেছে।
আজকের কালকিনি আগের সে প্রত্যন্ত কালকিনি নয়। আজকের কালকিনি আবুল হোসেনের কালকিনি, শিক্ষা, যোগাযোগ, উন্নয়ন, অবকাঠামো আর সমৃদ্ধির সোনালি আভায় উদ্ভাসিত কালকিনি। সারা দেশের মধ্যে একটি অন্যতম উন্নত ও খ্যাতনামা উপজেলা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য যার নাম আজ সারা দেশে ছড়িয়ে। আর আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন নিষ্কলুষ গগনের মতো চির উন্নত শিরে অনির্বাণ দিনমণি হয়ে আলোকিত করে রেখেছেন বর্তমান, আলোকিত করে যাবেন অনাগত ভবিষ্যৎ।
জিয়াউল হাসান : কবি, গীতিকার ও গবেষক।

১. অধ্যক্ষ মো. খালেকুজ্জামান, সৈয়দ আবুল হোসেন: আধুনিক কালকিনির বিনির্মাতা।
২. মনের মুকুরে সৈয়দ আবুল হোসেন, আবদুল আজিজ হাওলাদার।
৩. আধুনিক কালকিনির বিনির্মাতা, অধ্যক্ষ মো. কামরুজ্জামান।

ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ
মো. শফিউল আজম
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। এ জন্য মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী। শিক্ষার মাধ্যমে একটি গ্রাম, সমাজ তথা জাতিকে যত দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, অন্য কোনো কিছু দিয়ে তা সম্ভব নয়। সংখ্যায় অল্প হলেও শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখর লক্ষ্যে কিছু শিক্ষানুরাগী মহাপ্রাণ ব্যক্তি নিরলস ও আত্মনিবেদিতভাবে কাজ করেন। মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন এমপি তেমনই একজন। যিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং করছেন। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাঙ্গনগুলোতে নিবিড় তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। যা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক প্রেক্ষাপটে অসম্ভব বলে মনে করা হতো। ফলে, প্রায় বছরই বোর্ড পরীক্ষায় তঁাঁর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মেধা তালিকার শীর্ষস্থানসূহের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্থান লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত এরূপ একটি কলেজ। এটি তিনি তাঁর পিতার স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করেছেন। ডাসারের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি আজ প্রত্যন্ত নয়। স্বীয় সাফল্যে শিক্ষার নির্বাণ আলো ছড়িয়ে সারা দেশে বিখ্যাত হয়ে আছেন।
ডাসার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। এটি মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলায় অবস্থিত। এ জেলায় জনবসতির আগমন সম্পর্কে জানা গেছে, সুদূর অতীতে প্রখ্যাাত আউলিয়া হযরত শাহ আলী বোগদাদী (র)-এর জ্যেষ্ঠ সন্তান শাহ ওসমান (র) বাঘের পিঠে চড়ে ডাসার এলাকায় শুভাগমন করে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন। এই মহান আউলিয়ার বংশধর ও অনুসারীগণ ক্রমান্বয়ে তাদের ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এলাকাটিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি চর্চা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণ কেন্দ্রে পরিণত করেন। সময়ের স্রোতে এ গ্রামে বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের জন্ম হতে থাকে, যারা দেশ-বিদেশে মেধা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে খ্যাতিমান হয়েছেন। তবে শিক্ষার দিক হতে এলাকাটি পশ্চাতে পড়ে থাকে। যারা বড় হয়েছেন তাদের সিংহভাগ আর গ্রামের কথা মনে রাখেননি। উৎসমূলকে অবহেলায় রেখে চলে গেছেন শহরে। এটিই দেখা যায় বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে। তবে সৈয়দ আবুল হোসেন এর ব্যতিক্রম। শিক্ষিত হয়েও অন্যান্যদের মতো গ্রামকে তিনি ভোলেননি। যে গ্রামের আলো-হাওয়া তার অস্তিত্ব সে গ্রামকে কোনো মহৎপ্রাণ ব্যক্তি কখনও ভুলতে পারেন না। মূলত এখানেই সৈয়দ আবুল হোসেনের অসাধারণত্ব। ডাসার গ্রামটির অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর উন্নয়নের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পূর্ণ নিজ অর্থায়নে ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এন্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ যেখানে অবস্থিত, সেখানে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ডাসার সরকারি প্রাইমারি স্কুল, তথা বোর্ড স্কুল নামে একটি বিদ্যালয় গৃহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটিই বর্তমান প্রসিদ্ধ ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এন্ড কলেজের ভ্রƒণ। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে এটি ডাসার মাইনর স্কুলে পরিণত হয়। স্থানীয় জনগণ বিশেষ করে সৈয়দ আবুল হোসেনের পিতা সৈয়দ আতাহার আলীর নেতৃত্বে এলাকাবাসীর চেষ্টায় ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ডাসার জুনিয়র হাইস্কুলে পরিণত হয়। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে মরহুম আব্দুল মান্নান ঠাকুরের প্রচেষ্টায় হাইস্কুল শাখা প্রতিষ্ঠা পায়।১ এ অবস্থায় শিক্ষালয়টির নাম পরিবর্তন করে ডি কে আইডিয়াল একাডেমি রাখা হয়। সৈয়দ আবুল হোসেনের স্নেহÑস্পর্শ পাবার পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। সৈয়দ আবুল হোসেনের স্পর্শ পাবার পর কলেজটির শিক্ষার মান ও অবকাঠামোগত অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে এর নামকরণ করা হয় ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি। সৈয়দ আবুল হোসেনের একক প্রচেষ্টায় এর পরের বছর খোলা হয় কলেজ শাখা। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ। ক্ষুদ্র মাইনর স্কুল হতে প্রত্যন্ত গ্রামের এ শিক্ষালয়টি বিশাল ভবন সমৃদ্ধ কলেজে উন্নীত হবার পেছনে শিক্ষালয়টি যে ব্যক্তির কাছে ঋণী, তিনি হচ্ছেন আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন। প্রয়াত পিতা আলহাজ্ব সৈয়দ আতাহার আলীর নামে কলেজটির নামকরণ পিতার প্রতি সৈয়দ আবুল হোসেনের শ্রদ্ধা আর মহাঋণের প্রতি সুবিমল প্রণতির বহিঃপ্রকাশ। উল্লেখ্য, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর আলহাজ্ব হযরত সৈয়দ আতাহার আলী মৃত্যুবরণ করেন।
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ক্ষুদ্র প্রাইমারি স্কুলটির কলেজে রূপান্তরিত হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন মাদারীপুর জেলার কৃতিসন্তান, সফল ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব, দানবীর আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন, এমপি। বিদ্যালয়টি প্রাথমিক স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর হতে হাইস্কুলে রূপান্তরিত হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘদিন প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের অভাবে বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত ছিল। এলাকায় বিত্তশালী ও প্রভাবশালী বহু লোক ছিলেন। তারা কেউ প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নের জন্য কিছু করেননি। ফলে এলাকার শিক্ষা উন্নয়ন সাংঘাতিকভাবে বিঘিœত হচ্ছিল। সমস্যা জর্জরিত বিদ্যালয়টির বিরাজিত সমস্যা দূরীভূত করে এলাকার গরিব ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম করার মহান লক্ষ্যে এলাকার আপামর জনগণের আহবানে সাড়া দিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন ১৫ লক্ষ টাকা প্রদান করে তাঁর পিতার নামে ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজটি নতুন কলেবরে প্রতিষ্ঠা করেন।
মাদারীপুর জেলাধীন কালকিনি থানার অন্তর্গত ডাসার গ্রামের অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে ৭ হাজার বর্গগজ এলাকা জুড়ে ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ অবস্থিত। কলেজের সন্নিকটে রয়েছে ডাসার হাফেজিয়া মাদ্রাসা, লিল্লাহ বোর্ডিং, মাদ্রাসা, মসজিদ ও বাজার। কলেজ হতে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ফজলগঞ্জ হাট, যা এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। মাদারীপুর জেলা শহর থেকে সড়ক পথে কলেজের দূরত্ব ২৫ কিমি এবং কালকিনি থানা সদর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার।
কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উত্তম বাসস্থান, সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তা বিধানে সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। কলেজের ছাত্রদের জন্য চারটি ছাত্রাবাস ও ছাত্রীদের জন্য একটি ছাত্রীনিবাস গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলো প্রতিষ্ঠার পুরো কৃতিত্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রাপ্য। আবাসিক সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়ে থাকে। কলেজ শিক্ষকদের জন্যও আবাসিক সুবিধা রয়েছে। সৈয়দ আবুল হোসেনের পুরোনো বাড়ি; যেখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে সুরম্য শিক্ষকনিবাস।
মাসিক টার্ম পরীক্ষায় ৮০%, ৭০% ও ৬০% নম্বর অর্জনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের যথাক্রমে মাসিক দুইশত, দেড়শত ও একশত টাকা বৃত্তি প্রদান করা হয়। ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কঠোর নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। সৈয়দ আবুল হোসেনের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে কলেজ প্রশাসন এমনভাবে সজ্জিত, যাতে কোনো ছাত্রছাত্রী অনৈতিক বা অশোভনীয় কোনো কার্যকলাপে লিপ্ত হতে নাÑপারে। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর আচরণ ভদ্র, শালীন ও আদর্শ ছাত্রসুলভ হওয়া বাঞ্ছনীয়। ক্লাশে যথাসময়ে উপস্থিত, পাঠাগার ও গবেষণাগার, নীরবতা ও শৃঙ্খলা পালন করতে হয়। কলেজটি সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত। কলেজ ক্যাম্পাসে কোনো ছাত্রছাত্রী রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা ও ক্রিয়াকলাপে অংশ নিতে পারে না। কলেজের সার্বিক ব্যবস্থাপনা এমনভাবে বিন্যস্ত, যা শিক্ষার একটি আদর্শ পরিবেশ স্থাপনে সহায়ক হয়েছে। শুধু ডি কে আইডিয়াল একাডেমি এন্ড কলেজ নয়, সৈয়দ আবুল হোসেন প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেকটি কলেজ এমন সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণকর নিয়মকানুনের আওতায় পরিচালিত হয়।
কলেজ পর্যায়ে তিনটি গ্রুপে যুগের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে প্রায় সকল বিষয়ই খোলা হয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি সাধারণ বিষয় ছাড়া বিজ্ঞান বিভাগে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং ও ওয়ার্কশপ প্র্যাক্টিস, গণিত, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, ভূগোল, বাণিজ্যনীতি, অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক ভূগোল, হিসাবরক্ষণ ও হিসাব বিজ্ঞান এবং মানবিক বিভাগে যুক্তিবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, অর্থনীতি, অতিরিক্ত বাংলা, সংস্কৃত ও ভূগোল ইত্যাদি বিষয় রয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর হতে ১৯৯৬-২০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাত্র ৫ বছরে এ কলেজের ১৩ জন ছাত্রছাত্রী বোর্ড পরীক্ষায় মেধাস্থান প্রাপ্ত হন।২ প্রত্যন্ত এলাকার নব প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজের জন্য এটি একটি অসাধ্য সাধনের মতো ঘটনা। কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে অসাধ্য বলে কিছু নেই। তিনি তার মেধা ও দূরদর্শী পরিকল্পনা দিয়ে যে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করে নিতে পারেন।
জন্মলগ্ন হতে বোর্ডের পরীক্ষায় চমৎকার ও ঈর্ষণীয় ফলাফল প্রদর্শন করে ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এন্ড কলেজ সারাদেশে আলোচনার শীর্ষে চলে আসে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বোর্ডের অধীন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানসহ মেধা তালিকায় কলেজের পরীক্ষার্থীরা সাতটি স্থান দখল করে এবং কলেজটি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি, গৌরব ও মর্যাদা অর্জন করে।৩ শুধু এ কলেজটি নয়, সৈয়দ আবুল হোসেন প্রতিষ্ঠিত খোয়াজপুরে অবস্থিত সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজও অনুরূপ সাফল্য অর্জন করে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ প্রতিষ্ঠালগ্ন (১৯৯৪) থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় বিভিন্ন বছর ছাত্রছাত্রীদের মেধা তালিকায় অধিকৃত স্থানের বিষয়ে একটি তালিকা নিচে দেয়া হলোঃ
পরীক্ষার সন মেধা তালিকায় স্থান 
মানবিক কারিগরি 
১৯৯৬ ১৬-তম 
১৯৯৭ ৩য় ও ৯ম ৫ম 
১৯৯৮ ১৩-তম 
১৯৯৯ ১ম, ২য়, ৩য়, ৫ম ৮ম
৮ম, ১৫-তম 
২০০০ ১৭-তম 
২০০২ ৮ম

সৈয়দ আবুল হোসেন প্রতিষ্ঠিত সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ খোয়াজপুর, টেকেরহাট এবং কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজও লেখাপড়ার ব্যাপারে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছে। কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বেশ কিছু সাবজেক্ট-এর উপর অনার্সসহ এমএ পাশ করার সুযোগ রয়েছে। গ্রামে থেকে নিতান্তই গরিব মানুষের ছেলেটি বা মেয়েটি ঘরের পান্তা খেয়ে অনার্সসহ এমএ পাশ করার সুযোগ পাচ্ছেÑ এ তো কল্পনার অতীত। উপজেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ সত্যি বিরল। লেখাপড়ার সাথে সাথে ছেলে-মেয়েদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড কবিতা আবৃতি, গান, অভিনয়, ধর্মীয় প্রতিযোগিতা এবং খেলাধুলায় মহোদয় আর্থিক যোগানসহ ব্যাপক উৎসাহ যুগিয়ে থাকেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক। বাংলাদেশের কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার অবদান রয়েছে, এ প্রশ্ন যদি কেউ তাকে করেন তো, মনে হয় না তিনি তার জবাব দিতে পারবেন। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার সন্তানতুল্য স্নেহের অমিয় আলোকে লালিত। শিক্ষা বিস্তারে তার আন্তরিকতা সব পার্থিব প্রাপ্তির ঊর্ধ্বে।
সৈয়দ আবুল হোসেনের ভাষায়, “শিক্ষার প্রসার আমার জীবনের ব্রত বা মিশন। এ লক্ষ্যে আমি আমার এলাকায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। এর অন্যতম হচ্ছে ডাসারে আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন মরহুম পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এন্ড কলেজ। আমি এই কলেজটিকে কেবল কালকিনি বা মাদারীপুরের নয়, সমগ্র দেশের মধ্যে একটি অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করি।”৪
সৈয়দ আবুল হোসেনকে স্মরণ করার অসংখ্য কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে যেটি সূর্যের মতো অবিরাম আলোয় আমাদের স্মৃতিকে আলোকিত করে রাখবে, সেটি হচ্ছে তার শিক্ষানুরাগিতা। আমি এ মহান মানুষটির দীর্ঘায়ু কামনা করি।

মো. শফিউল আজম : গবেষক, সেন্টার অন ইন্টিগ্রেডেট রুর‌্যাল ডেভলাপমেন্ট ফর এশিয়া এন্ড ফ্যাসিফিক (ঈওজউঅচ)।

১. বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বর্ষ ১৯, সংখ্যা ৫, জুন ২০০১(২)।
২. বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বর্ষ ১৯, সংখ্যা ৫, জুন- ২০০১(২), পৃষ্ঠা ২১, ফিচার: ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ, তছলিম উদ্দিন।
৩. বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বর্ষ ১৯, সংখ্যা ৫, জুন- ২০০১(২), পৃষ্ঠা ২৩, অধ্যক্ষ জামানের মহাপ্রয়াণে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল হোসেন এম পি-এর প্রতিক্রিয়া।
৪. বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বর্ষ ১৯, সংখ্যা ৫, জুন- ২০০১(২)।

দার্শনিক নান্দনিকতা
শফিকুল ইসলাম ইউনুস
এ অধ্যায়ে বর্ণিত ঘটনা ও বক্তব্যগুলো মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রী আলাপচারিতার বিভিন্ন প্রসঙ্গে যে কথাবার্তা বলেছেনÑ তা হতে সংগৃহীত। এগুলো কোনো বিশেষায়িত বক্তব্য নয়। দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কথাবার্তার টুকিটাকি মাত্র। এসব কথাবার্তায় ছিল না কোনো পূর্বপরিকল্পনা, ছিল না কোনো সমীকরণ। নিতান্তই স্বাভাবিক, নিশ্বাসের মতো, প্রশ্বাসের মতো। সাধারণ কথাবার্তায় একজন লোকের প্রকৃত পরিচয় ফুটে ওঠে। মানুষ সভাসমিতিতে নিজেকে লুকিয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু স্বাভাবিকতা ভিন্ন। এ সব খোলামেলা কথাবার্তা ও আলাপচারিতায় ব্যক্তি, নেতা, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসক হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনের আদর্শ ফুটে উঠেছে। সংকলন প্রকাশের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ দিন যাবৎ তথ্যগুলো বিভিন্ন উৎস হতে সংগ্রহ করা হয়েছে।

নেতৃত্ব
কালকিনির লোক। মন্ত্রী মহোদয়ের সমবয়সী। কথাবার্তায় মনে হলো ঘনিষ্ঠ। মাঝে মাঝে তাকে দেখা যায় মন্ত্রণালয়ে। কি একটা তদ্বির নিয়ে এসেছেন। তদ্বিরের বিবরণ শুনে মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বললেন, ‘এটি আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ লোকটি বললেন, ‘আপনি মন্ত্রী, আপনার মন্ত্রণালয়ের কাজ। সম্ভব নয় কেন?’ মন্ত্রী বললেন: ‘তুমি একজন শিক্ষিত লোক। কোন কাজটি করা আমার উচিত, কোনটি উচিত নয় সেÑ বিষয়ে তোমার ধারণা থাকা উচিত। প্রত্যেকের সীমাবদ্ধতা আছে। ডব ধৎব ধষষ ংড়সবঃযরহম, নঁঃ হড়হব ড়ভ ঁং ধৎব বাবৎুঃযরহম.’ আপনি এত বড় নেতা, এত বড় পদে আছেন, বলে দেন, কাজ হয়ে যাবে। মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বললেন: খবধফবৎংযরঢ় রং ধপঃরড়হ, হড়ঃ ঢ়ড়ংরঃরড়হ. আমার দায়িত্ব কাজ, তদ্বির করা নয়। লোকটি বললেন: তদ্বির না-করলে হয় না। মন্ত্রী মহোদয় বললেন: যেগুলো হবার সেগুলোই আমি তদ্বির করি। যেগুলো হয় না, সেগুলো তদ্বির করি না।
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো
মন্ত্রী মহোদয়ের কক্ষ। বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্য উপস্থিত আছেন। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলছিল। মন্ত্রী মহোদয় এক সময় বললেন, ‘কেউ একদিনে বড় হয় না, হতে পারে না। আছাড় না-খেয়ে কেউ হাঁটতে শেখেনি। বিঘœ ছাড়া কেউ লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারেনি। একদিন আমাকে অনেকে উপহাস করেছে, ঢিল ছুড়ে আমার প্রত্যাশাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। আমি আমার প্রতি নিক্ষিপ্ত ইট দিয়ে সফলতার ভিত্তি বানিয়েছি। ঐ ইটগুলো আমাকে রক্তাক্ত করার জন্য নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আমি সযতেœ নিজেকে রক্ষা করেছি। প্রতিটি ইট সংগ্রহ করে আস্তে আস্তে ভিত মজবুত করেছি। যারা আমাকে ঢিল ছুড়েছিল তারা এখন ফুল ছোড়ে। এখন আমি তাদের দিয়ে আমার ভবনের বাকি কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছি। পৃথিবী ভয়ঙ্কর জায়গা, আমি জানি। তবে এটি খারাপ লোকদের জন্য নয়; বরং তাদের জন্য যারা কোনো কিছু না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তামাসা দেখে। সহনশীলতা ছাড়া এখানে টিকে থাকার কোনো উপায় নেই। যতবার আমি বাধাগ্রস্ত হয়েছি ততবার আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছি। যে আমার নিন্দা করেছে সে নিন্দার সূত্র ধরে আমি কাক্সিক্ষত পথ খুঁজে পেয়েছি। তাই আমি বিভিন্ন বক্তৃতায় প্রায় বলে থাকি:
‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো,
যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো।
যিনি আমার প্রশংসা করেন তাকে আমি অগ্রাহ্য করি না, যিনি নিন্দা করেন তাকে ঘৃণা করি না। দু’জন আমার দুটো দিক তুলে ধরেন। দুটোই আমার জন্য প্রয়োজন। প্রশংসা আমাকে উজ্জীবিত করে এবং নিন্দা করে সতর্ক।’

আত্মপরিবর্তন
রবি বার। নয়টা বাজার পনেরো মিনিট বাকি। ইতোমধ্যে মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী অফিসে এসে গেছেন। তিনি প্রত্যহ নয়টার আগে অফিসে আসেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ যাতে তাকে অনুসরণ করেন এ জন্য এ ব্যবস্থা। নিয়ম-নীতি ও ব্যক্তিচরিত্র সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে মন্ত্রীমহোদয় বললেন: পৃথিবীর সবাই পরিবর্তন চায়। কিন্তু অবাক হয়ে দেখি কেউ নিজেকে পরিবর্তন করছে না। তাহলে পৃথিবীর কীভাবে পরিবর্তন হবে! নিজেকে পরিবর্তন করলে পৃথিবীর পরিবর্তন স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যাবে। আসলে নিজেকে পরিবর্তন করা খুবই কঠিন। শিক্ষিত হলে মনের পরিবর্তন আসে। আমি মনে করি শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনোভাবে আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন সম্ভব নয়। শিক্ষা এমন একটি শক্তিশালী অস্ত্র, যা আমরা অতি সহজে আমাদের মনমানসিকতা ও সমাজকে পরিবর্তন করার জন্য ব্যবহার করতে পারি। শুধু শিক্ষা যথেষ্ট নয়, প্রায়োগিক শিক্ষা প্রয়োজন। শিক্ষা জ্ঞান দেয় বটে; তবে জ্ঞান আমার লক্ষ্য নয়, আমার লক্ষ্য প্রয়োগ। গ্রন্থগত বিদ্যার মতো প্রয়োগহীন জ্ঞানও অর্থহীন।

চাওয়া-পাওয়া
সৈয়দ আবুল হোসেন তখন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী। মানুষের চাওয়া-পাওয়া, প্রত্যাশা ও লোভ সম্পর্কে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বললেন, আমি তা-ই করি যা করতে পারি, তা-ই চাই যা আমার আছে, আমি তা হতে চাই যা আমি ইতোমধ্যে হয়ে আছি। এর বেশি কিছু চেয়ে হতাশ হতে চাই না। হতাশা মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব নষ্ট করে দেয়। আমি হতাশ হই না, কারণ আমি হতাশ হবার মতো কোনো উচ্চাকাক্সক্ষায় নিজেকে জড়াই না। তাই আমি সবসময় প্রফুল্ল থাকি। আমার হাসি আমার প্রফুল্লতার প্রকাশ। আমাকে আমার কর্ম দ্বারা বড় হতে হবে। আপনাকে কেউ বড় হবার জন্য অনুগ্রহ করবে না। আপনার দক্ষতাই আপনাকে সহায়তা দেবে। আমার পিতামহ কত লম্বা ছিল সেটি কোনো বিষয় নয়, আসল বিষয় আমি কতটুকু লম্বা হতে পেরেছি। আপনার বোঝা আপনাকে বহন করতে হবে। আপনার শরীরের কষ্ট আপনার নিজের। কেউ এর ভাগ কখনও নেয়নি, নেবে না এবং নিতে পারে না।১

সমালোচনা
সৈয়দ আবুল হোসেন বাস্তববাদী মানুষ। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষ মাত্রই ভুল করবে। এর ব্যত্যয় ঘটতে পারে না। ভুল আছে বলে কোনো কিছু পরিপূর্ণ নয়, কোনো কিছু ভুলের ঊর্ধ্বে নয়; তাই কোনো কিছু সমালোচনার ঊর্ধ্বেও নয়। আমি সমালোচনাকে ভয় করি না। আমি যে কাজ করছি সমালোচনা তা প্রকাশ করে। আমি যদি সমালোচনা এড়াতে চাই তাহলে আমার উচিত কিছু নাÑকরে বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকা। এটি আমার পক্ষে সম্ভব নয়। লাশের পক্ষে সম্ভব। কীর্তিমানের লাশও সমালোচনায় পড়ে। তাই বলে কি কীর্তিমানেরা চুপ করে ঘরে বসে থাকে! আমি সমালোচনাকে স্বাগত জানাই। ডরঃযড়ঁঃ ফবনধঃব, রিঃযড়ঁঃ পৎরঃরপরংস, হড় ধফসরহরংঃৎধঃরড়হ ধহফ পড়ঁহঃৎু পধহ ংঁপপববফ ধহফ হড় ৎবঢ়ঁনষরপ পধহ ংঁৎারাব.২

কাজের কোনো শেষ নেই
প্রত্যেক মানুষ নিজস্ব বলয়ে একজন শিল্পী। শিল্পীর কাজ কখনও শেষ হয় না। একজন শিল্পী যখন তার একটি শিল্পকর্ম শেষ করেছেন বলেন তখন মূলত তা তিনি এটি সাময়িক বন্ধ রাখেন কিংবা পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন মাত্র। যতদিন জীবন ততদিন কাজ। কাজহীন মানুষ লাশের নামান্তর। কাজ করতে গেলে ভুল হয়। ভুল কাজের অংশ। তার ভুল হয় না, যে কোনো দিন কোনো কিছু করেনি। তাই আমি ভুলকে সৃষ্টির অনিবার্য অংশ মনে করি। তবে দেখতে হবে ভুল যেন মাত্রাতিরিক্ত না-হয়। এ জন্যই প্রয়োজন জ্ঞান, অধ্যয়ন, বিচক্ষণতা এবং সততা। তাড়াহুড়ো চিন্তার সময়কে সীমিত করে, বাড়িয়ে দেয় ভুলের মাত্রা। ফলে অনেকে মাঝপথে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। আমি ধীরে হাঁটি তবে পিছু হাঁটি না। যদি কখনও পিছোই তাহলে ধরে নিতে হবে আগুয়ান হবার জন্য পরিকল্পনামাফিক পিছু হাঁটি।৩

পরিবর্তন ও প্রগতি
নেতা হতে হলে পরিবর্তনশীল মানসিকতা থাকতে হবে। সংস্কার মানেই পরিবর্তনশীলতা। তবে এটিও মনে রাখতে হবে, সকল আন্দোলন যেমন উন্নয়ন নয় তেমনি সকল পরিবর্তনও কল্যাণকর নয়। আমার যা পছন্দ হয় না, তা আমি পরিবর্তন করার চেষ্টা করি। যা আমি পরিবর্তন করতে পারি না, তা আমি গ্রহণ করার জন্য নিজের মনকে পরিবর্তন করে ফেলি। তবে যেটি পরিবর্তন করলে আমার ভালো লাগলেও অধিকাংশ লোকের ক্ষতি হয়, সেটি আমি পরিবর্তন নাÑ করে মেনে নেয়ার চেষ্টা করি। আমি জানি যা আসার তা আসবেই। একটি শক্তিশালী সেনা আক্রমণকে রোধ করা যায় কিন্তু একটি ধারণা যার আসার সময় হয়ে গেছে তা কোনোকিছু দিয়ে রোধ করা যায় না। সুতরাং অনড়তা নয় বরং বিচক্ষণ পরিবর্তনশীলতাই প্রগতির লক্ষণ।

সকল শান্তির উৎস
পরিবারের শান্তি সবচেয়ে বড় শান্তি। একজন মানুষ যতই ধনী হোক না কেন, অসুস্থ হলে কোনো শান্তি উপভোগ করতে পারে না, কিছুতে আনন্দ পায় না। তেমনি একজন লোক যতই ধনী, যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, পারিবারিক শান্তি নাÑথাকলে তার সবকিছু ব্যর্থ হতে বাধ্য। আমি পারিবারিক জীবনে একজন সুখী মানুষ। আমার সুখের বিনির্মাতা আমি, আমার স্ত্রী, আমার দুই কন্যা। আমি তাদের পর্যাপ্ত সময় দেই, ভালবাসা দেই। তারাও দেয়। এটি বিনিময় নয়, মর্যাদার অনুভবে ভালোবাসায় সন্তরণ। যেখানে মর্যাদা নেই সেখানে ভালোবাসা নেই। আমি আমার স্ত্রীর প্রতি সর্বদা বিশ্বস্ত এবং মর্যাদাশীল আচরণে অভ্যস্ত। সন্তানদের প্রতি আমি সবসময় সুন্দর ব্যবহার করি। আমি জানি আমার মৃত্যুর পরই তারাই আমার শেষ ঠিকানা স্থির করবে। আমার স্ত্রী-পুত্র আমার আনন্দ, বেঁচে থাকার প্রেরণা। এমনকি মৃত্যুর পরও।৪
সূর্য ও জীবন
প্রতি সেকেন্ড আমার কাছে নতুন, প্রতিটি নতুন সূর্য আমাকে একটি নতুন জীবন উপহার দেয়। তাই আমি বর্তমানকে গুরুত্বের সাথে বরণ করি, আনন্দের সাথে উপলব্ধি করি। প্রতিটি মুহূর্তকে অবস্থা বিবেচনায় অভিযোজনীয় কৌশলে উপভোগ্য করে তুলি। শিশুকাল, কৈশোর, যৌবন ও বৃদ্ধকালÑ প্রতিটির আনন্দ আছে, সার্থকতা আছে। আমার উপলব্ধিই আমার উপভোগ। মানুষ এককভাবে বাস করতে পারে না। প্রত্যেককে নিয়ে আমি, আমাদের নিয়ে সমাজ, দেশ ও জাতি। আজ যাকে পাব কাল তাকে নাও পেতে পারি। তাই আমার সাথে যারা আছে, যাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, সবাইকে জীবনের অংশ মনে করে যথাযোগ্য গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করি।

রাগ পাশবিকতার আগুন
আমার মা আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে ধৈর্য ধারণ করতে হয়, রাগ সংবরণ করতে হয়। এক সেকেন্ডের রাগ কারও পুরো জীবনকে বিষিয়ে তুলতে পারে। যে ব্যক্তির ধৈর্য নেই, তার আত্মাও নেই। যার আত্মা নেই সে মানুষ নয়। রাগ পাশবিকতার নামান্তর। অধৈর্য মানুষকে পশুতে পরিণত করে। মানুষ কেন রাগে? মানুষ যখন ভুল করে এবং সে ভুল স্বীকার করে না, স্বভাবতই তখন সে রেগে যায়। অগভীর মানুষের রাগ বেশি। রাগ অশান্তিকে প্রসারিত করে। রাগের জন্য মানুষের শাস্তি হয় না, তবে রাগ শাস্তি দিয়েই ছাড়ে। তাই আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার অভ্যাস রপ্ত করে নিয়েছি। আমার পিতামাতা এভাবে আমাকে গড়ে তুলেছেন। ভদ্রতা দিয়ে মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। মহাত্মা গান্ধীর ভাষায় বলতে পারি: ওহ মবহঃষব ধিু, ুড়ঁ পধহ ংযধশব ঃযব ড়িৎষফ. রাগ পোশাকের নিচে লুকিয়ে থাকা বিষধর সাপের মতো। এটি পরিহার করতে পারলে নিরাপত্তা ও শান্তি দুটো বহুলাংশে নিশ্চিত হয়ে যায়।

ন্যায় বিচারের গুরুত্ব
এমনভাবে কাজ করবেন, যাতে কোনো ব্যক্তি অযথা হয়রানির স্বীকার না-হয়। আমাকে যে বিষয় কষ্ট দেবে, যা করলে আমার ক্ষতি হবে; তা যেন অন্যের বেলাতেও নাÑহয়। সহকর্মীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন। এটিই ন্যায়বিচার। আমরা যদি ন্যায়বিচারের মাধ্যমে অন্যকে রক্ষা নাÑকরি, তাহলে ন্যায়বিচারও আমাদের রক্ষা করবে না। যে ফাঁদে আমি অন্যকে আটকাব সে ফাঁদে একদিন আমিও আটকে যাব। মনকে বড় করতে হবে। বড় মন ছাড়া ক্ষমতা, অর্থ, বিত্ত সব কুৎসিত ভিক্ষুকের প্রতিচ্ছবি। ন্যায়বিচার যারা লঙ্ঘন করে, তারাও একদিন অন্যায়ের শিকারে পরিণত হয়। তাই আমাদের উচিত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।৫
সংশয়ে সতর্কতা
এক প্রকৌশলী যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে বললেন: আপনি নিশ্চিত থাকেন আমি সফল হব স্যার। জীবনে এ পর্যন্ত কোনো কাজে ব্যর্থ হইনি। মন্ত্রী বললেন: আমি নিজেও একজন ব্যবস্থাপক। আমার প্রতিষ্ঠানে আপনার মতো অনেক প্রকৌশলী কাজ করে। দেখুন, চিন্তাভাবনা করে আমাকে বলুন। পরে যেন লজ্জায় পড়তে নাÑহয়। যারা জীবনে ব্যর্থ হয় নি তারা জীবনে কোনো কাজই করেনি। প্রকৌশলী বললেন: আমি পারব স্যার। মন্ত্রী মহোদয় বললেন: আমার মনে হয় আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। কেন স্যার? প্রকৌশলীর প্রশ্নের জবাবে মাননীয় মন্ত্রী বললেন: কারণ যে নিশ্চিত হয়ে অগ্রসর হয় তার সমাপ্তি ঘটে সংশয় আর পরাজয়ে; যে সংশয় নিয়ে শুরু করে তার শেষ হয় নিশ্চয়তা আর সাফল্যে। কারণ সংশয় তাকে সব সময় সতর্ক থাকার কথা স্মরণ করিয়ে। প্রকৌশলী সাহেব বললেন: আমি স্যার সতর্ক থাকব। আপনাকে যথাসময়ে কাজটি করেই দেবো।” কিন্তু বেচারা কাজটি যথাসময়ে সম্পন্ন করতে পারলেন না। সামান্য কারণে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। মন্ত্রী বললেন: আমি আপনাকে প্রথমেই বলেছিলাম। আপনার নিশ্চয়তা এবং কথা দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি পারবেন না। অ ফড়ম রং হড়ঃ পড়হংরফবৎবফ ধ মড়ড়ফ ফড়ম নবপধঁংব যব রং ধ মড়ড়ফ নধৎশবৎ. অ সধহ রং হড়ঃ পড়হংরফবৎবফ ধ মড়ড়ফ সধহ নবপধঁংব যব রং ধ মড়ড়ফ ঃধষশবৎ.

শত্র“ বিনাশের উপায়
ওয়ান-ইলেভেনের সময় পুরো বাংলাদেশ একটি নরকে পরিণত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। মানবাধিকারের বালাই ছিল না। তবু আমি আশা ছাড়িনি। কারণ আমি জানি পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকারও ছোট্ট একটি মোমবাতির আলোকে ঢেকে রাখার সামর্থ্য রাখে না। এ সময় আমাকে অনেকে বিপদে ফেলার জন্য চেষ্টা করেছে। এমন অনেকে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে যাদের আমি একদিন উপকার করেছিলাম। আমি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। আমি জানি ঞযব নবংঃ ধিু ঃড় ফবংঃৎড়ু সু বহবসু রং ঃড় সধশব ঃযবস সু ভৎরবহফ. শত্র“কে বন্ধু বানিয়ে নেয়া মানে শত্র“কে শেষ করে দেয়া। ওয়ান ইলিভেনে যারা আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে তাদের সবাইকে আমি জানি। আমি প্রতিশোধ নেব না। প্রতিশোধ এক ধরনের বন্যবিচার, পাশবিকতা। আমি ভালোবাসার মাধ্যমে প্রতিশোধ নেব। এমন প্রতিশোধের পরিণতি খুবই মধুর হয়। শত্র“তা কখনও শেষ হয় না। কারও জীবন শেষ করে দেয়ার জন্য একজন শত্র“ই যথেষ্ট। তবে শত্র“ এমন একটা শক্তি যে, এটাকে শত্র“তা দিয়ে কোনোদিন শেষ করা যায় না। শত্র“ বিনাশের একমাত্র উপায় তাদের বন্ধু বানিয়ে নেয়া।
সহনশীল রাজনীতি, সন্ত্রাস ও শিক্ষাঙ্গন
উন্নয়নের জন্য, শিল্পায়নের জন্য, গণতন্ত্রের সুফল পরিপূর্ণভাবে পরিব্যাপ্ত করার জন্য রাজনীতিক সহনশীলতা অত্যাবশ্যক। রাজনীতি থাকবে রাজনীতির স্থানে। সমাজের বিনির্মাণে রাজনীতির কৌশল প্রতিফলিত হবে; তবে তা হবে দলমতের ঊর্ধ্বে। যদি চোখের বদলে চোখ, হাতের বদলে হাত নীতি বিদ্যমান থাকে তাহলে পৃথিবীর সব মানুষ অন্ধ ও ল্যাংড়া হয়ে যাবে। তাই আমি সহনশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সন্ত্রাসী জনপদ হতে সুশীল সন্তান পাওয়া যায় না। তাই আমি শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাস ও রাজনীতিমুক্ত রেখে আমার প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছি। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে কাউকে ক্ষমা করি না। সহনশীল রাজনীতি, সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ ও এ দু’য়ের পরিচর্যায় শিক্ষাঙ্গন পরিচালনা করা গেলে একটি জাতির আর কিছুর প্রয়োজন হবে না।৬

নিরাপত্তা বনাম শান্তি
বুদ্ধিমান লোক সবার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়। জ্ঞানী ব্যক্তির উদ্দেশ্য শান্তি নিশ্চিত করা নয়, কষ্টকে এড়িয়ে চলা। কষ্টকে এড়িয়ে চলা সম্ভব হলে শান্তি আপনা-আপনি জেগে ওঠে। ক্ষোভকে প্রশমন করা গেলে বিচক্ষণতা আসে। আর বিচক্ষণতা এমন একটি গুণ যা মানুষকে সচেতন ও সজীব রাখে, বিপদ হতে উদ্ধার করে। তাই সবার উচিত আগে নিরাপত্তার দিকটা ভেবে দেখা। নিরাপত্তার সাথে যোগাযোগের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কারণ যোগাযোগ পারস্পরিক বিনিময়, সহায়তা ও সম্মিলনের পথকে প্রসারিত করে।৭

যোগাযোগ ও উন্নয়ন
যোগাযোগ ছাড়া কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। মানুষ যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সভ্যতার দেখা পেয়েছে। যোগাযোগ শুধু প্রতিষ্ঠা করলে হবে না। প্রকৃত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষ যখন নিজেকে নিরাপদ মনে করবে তখনই প্রকৃত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা পাবে। এ জন্য আমি নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। আপনারা আমাকে সহায়তা দেবেন। কারণ যোগাযোগ কোনো একক বিষয় নয়, অনেকগুলো বিষয়কে সমন্বয় করে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কোনো সংস্থার পক্ষে এককভাবে প্রকৃত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যোগাযোগ প্রত্যেকের জন্য, প্রত্যেকের উন্নয়নের জন্য কোনোরূপ সন্দেহ ব্যতিরেকে সার্বজনীন। তাই সবার উচিত সাবলীল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা।৮
লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু
সৈয়দ আবুল হোসেন বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। এককভাবে শতাধিক বার চিন ভ্রমণ করেছেন। জাপান, আমেরিকা, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, লন্ডন, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ডÑ অনেক অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন: মানুষের চেয়ে বড় সম্পদ আর নেই। জাপানের প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু তারা এখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী দেশ। আমি মনে করি পৃথিবীতে সম্পদ পর্যাপ্ত নয়। আমি মনে করি ঞযবৎব রং বহড়ঁময ভড়ৎ বাবৎুনড়ফু’ং হববফ, নঁঃ হড়ঃ বহড়ঁময ভড়ৎ বাবৎুনড়ফু’ং মৎববফ. লাভ পাপ আনে, পাপ মৃত্যু ঘটায়। লোভ সংবরণ করা গেলে পাপ কমে যাবে। পাপ কমে গেলে শান্তি প্রসারিত হবে। আপনারা যদি কোনো কিছু প্রকৃতই করতে চান তাহলে অবশ্যই করতে পারবেন। যদি নাÑচান, তাহলে পাবেন একটি অজুহাত।৯

সফলতার অন্ত নেই
প্রবীণ এক রাজনীতিবিদ মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রীকে বললেন: আপনি একজন সফল ব্যক্তি। আর কী চাওয়ার আছে আপনার, আল্লাহ আপনাকে সব দিয়েছেন।
স্মিত হাস্যে মাননীয় মন্ত্রী বললেন: সফলতা গন্তব্যস্থল নয়। ভ্রমণের প্রারম্ভ মাত্র। তাই সফলতা মানুষকে আরও সক্রিয়, আরও সাবধান, আরও অধিক পথ পরিক্রমায় দায়বদ্ধ করে তোলে। যারা সফলতার সন্তুষ্টি নিয়ে আত্মতুষ্টিতে আত্মহারা হয়ে থেমে যান তারা পক্ষান্তরে প্রাপ্ত সফলতাকে গলা টিপে মেরে ফেলেন। সফলতা সন্তানের মতো। একে প্রতিনিয়ত আপত্য স্নেহে লালন করতে হয়।

শিক্ষক ও শিক্ষা
অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষক, আবার খোয়াজপুর সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। এক সাক্ষাৎকারে সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পর্কে অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন বললেন, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে খুব ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, বিশ্বাস করেন। তার মতে, আমি নাকি ভালো শিক্ষক। আমি মনে করি, সে ভালো ছাত্র বলেই আমি ভালো শিক্ষক।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি আমাকে এত শ্রদ্ধা করো কেন?’
সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছিলেন, ‘আপনি আমার শিক্ষক।’
আমি বলেছিলাম, ‘তোমার তো আরও অনেক শিক্ষক আছে।’
এর উত্তরে সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছিলেন, ‘তিনিই শিক্ষক যিনি কঠিন জিনিস সহজভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। তিনিই শিক্ষক যিনি শিক্ষক-ছাত্র দূরত্বকে জ্ঞানের রশ্মি দিয়ে একাকার করে দেন। আপনার সে যোগ্যতা আছে।’১০

অন্যায় যে করে
তদ্বির আর তদ্বির। মাঝে মাঝে তদ্বিরকারীদের জ্বালায় মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রাত্যহিক জরুরি কাজেও সময় দিতে পারেন না। তদ্বিরের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি আমার স্বাধীন চিন্তায় বিঘœ ঘটায়। আমি ম্যানেজার এবং লিডার। তার চেয়ে বড় কথা আমি পরবর্তী জেনারেশনকে আমার জেনারেশনের চেয়ে আরও প্রগতিশীল, উন্নত এবং আকর্ষণীয় দেখতে চাই। গধহধমবসবহঃ রং ফড়রহম ঃযরহমং ৎরমযঃ; ষবধফবৎংযরঢ় রং ফড়রহম ঃযব ৎরমযঃ ঃযরহমং. আমি ঠিক কাজটাই করব। কোনো প্রভাবের কাছে মাথা নত করব না। একজন প্রকৃত আওয়ামী লীগার কখনও অন্যায় প্রভাবের কাছে মাথা নত করেন না। বঙ্গবন্ধু করেননি, আমার নেত্রী শেখ হাসিনা করেননি। আমি তাঁদের অনুসারী। আমিও করব না। তবে আমি এ সমাজের একজন মানুষ। সমাজকে উপেক্ষা করে চলতে পারি না। তবু যেটি আমি উচিত নয় বলে মনে করি সেটি নাÑকরার চেষ্টা করি। যেটি অন্যায় বলে মনে হয় সেটি প্রতিহত করার চেষ্টা করি। আমি যে সব পারি বা পারব তা নয় কিন্তু তাই বলে আমাকে চুপ মেরে বসে থাকলে চলবে না।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।

দেশের চেয়ে বড় কিছু নেই
আলোচনা হচ্ছিল বিভিন্ন বিষয়ে। এক সময় আলোচনায় চলে আসে রাজনীতি ও গণতন্ত্র। আলোচনাক্রমে চলে আসে রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কের কথা। মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বললেন, আমি রাজনীতি করি সেজন্য রাজনীতিবিদ। তবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আমি শুধু রাজনীতিবিদ নয়, স্টেটসম্যানও বটে। তাই আমাকে আমার ভোটার, পরবর্তী নির্বাচন ও পরবর্তী প্রজন্ম তিনটার দিকে লক্ষ রাখতে হয়। অ ঢ়ড়ষরঃরপরধহ ষড়ড়শং ভড়ৎধিৎফ ড়হষু ঃড় ঃযব হবীঃ বষবপঃরড়হ. অ ংঃধঃবংসধহ ষড়ড়শং ভড়ৎধিৎফ ঃড় ঃযব হবীঃ মবহবৎধঃরড়হ. আমার রাজনীতি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, বর্তমানের জন্য এবং ভবিষ্যতের জন্য। আগে দেশ, তারপর রাজনীতি, নেত্রী আমাকে এ শিক্ষাই দিয়েছেন। দেশের উন্নতি ঘটলে জনগণের উন্নয়ন আসবে। বঙ্গবন্ধুর জীবন হতে আমি এ শিক্ষা পেয়েছি যে, দেশের চেয়ে বড় কিছু নেই, তাই দেশকে গড়ার লক্ষ্যে আমি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছি।
ক্ষমতা
ক্ষমতার বহু সংজ্ঞা আছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। দাতা, শিক্ষানুরাগী, রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এবং সর্বোপরি ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার হিসেবে তিনি বহুমাত্রিক ক্ষমতার অধিকারী। এরূপ ব্যক্তিবর্গ সাধারণত ক্ষমতাকে সুসংহতরূপে ব্যবহার করতে পারেন না। সৈয়দ আবুল হোসেন প্রাত্যহিক জীবনে ক্ষমতার প্রয়োগ ও ব্যবহারে যেমন সচেতন তেমনি জনকল্যাণমুখী। তিনি মনে করেন- চড়বিৎ রং ঃযব ধনরষরঃু ঃড় ফড় মড়ড়ফ ঃযরহমং ভড়ৎ ড়ঃযবৎং.
শফিকুল ইসলাম ইউনুছ : সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা; সেক্রেটারি জেনারেল, অল্টারনেট মাস মিডিয়া, স্বত্বাধিকারী, ঢাকা প্রকাশন।

১. এল জি আর ডি প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন অফিসারদের সাথে অনানুষ্ঠানিক আলাপে।
২. কালকিনিতে জনগণের বিশাল সংবর্ধনা দেয়ার পর পত্রিকায় সমালোচনা হলে তদপরিপ্রেক্ষিতে আলাপ প্রসঙ্গে।
৩. মন্ত্রণালয়ে কয়েকজন অফিসার ও রাজনীতিবিদদের সাথে আলাপ প্রসঙ্গে।
৪. কমিউটর ট্রেইন উদ্বোধনের লক্ষ্যে নারায়নগঞ্জ যাবার পথে ট্রেইনে কথাপ্রসঙ্গে আলাপক্রমে।
৫. মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সৈয়দ আবুল হোসেন।
৬. মন্ত্রণালয়ে নিজস্ব অফিস কক্ষে, ৯/৬/২০১০ খ্রিস্টাব্দ।
৭. গোপালগঞ্জ যাবার পথে গাড়িতে।
৮. বসিলায় তৃতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আাসার পূর্বে কয়েকজন নেতা ও প্রকৌশলীগণের সাথে আলাপ।
৯. আবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
১০. অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন, সাক্ষাৎকারে।

সময়ের পরশপাথর

“যেদিক দিয়ে বিবেচনা করা হোক না, সৈয়দ আবুল হোসেন একজন খাঁটি মানুষ, খাঁটি বন্ধু, যাঁর চিন্তা চেতনা তাঁর হাসির মতোই আকর্ষণীয়”Ñ সৈয়দ আবুল হোসেনকে এভাবে প্রকাশ করলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক অজয় দাশগুপ্ত। ‘রাজনীতি হতে শুরু করে জীবনের প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডে সৈয়দ আবুল হোসেন মানবিক মূল্যবোধ দ্বারা সজ্জিত। গ্রহণের অসামান্য উদারতা তাঁকে আলোর মতো নিবিড় আর আকাশের মতো অপরিমেয় শ্রদ্ধায় মহান করে তুলেছে। ‘সময় জীবনের অবয়ব, কর্ম তার অলঙ্কার’Ñ প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট ডাঃ হাসমত আলী, পিএইচডি সাহেবের এ মন্তবের সাথে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন বলে মনে হয় না। প্রখ্যাত আইনজীবী ড. একেএম আখতারুল কবিরের ভাষায়, ‘সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে জীবন প্রকৃতির দান কিন্তু উন্নত জীবন-যাপন কর্মের উপহার। তাই তিনি জীবনকে শুধু সময় দিয়ে নয়, কর্ম ও অধ্যবসায়ের সমন্বিত প্রাঞ্জলতায় বিভূষিত করার প্রত্যয়ে দৃপ্ত রাখাকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার উপায় মনে করেন।’ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ছেলে প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী মনে করেন, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন একজন ভালো বন্ধু। আদর্শ মানুষ না হলে কারও পক্ষে ভালো বন্ধু হওয়া সম্ভব নয়। কাজ, আনন্দ, বিশ্রাম ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলÑ সর্বত্র তিনি সাবলীল আর নান্দনিক।’ প্রাক্তন সচিব ‘সৈয়দ আলমগীর ফারুক চৌধুরীর মতে, ‘এত উদার, নিরহঙ্কার, অমায়িক ও সজ্জন ব্যক্তি বর্তমানে বিরল।’ প্রাক্তন সচিব হাসনাত আবদুল হাই-এর ভাষায় বলা যায়, ‘তাঁকে অনুকরণ করার ইচ্ছা হবে অনেকের, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে তাঁকে অনুকরণ করা যাবে না। তিনি একজন অনন্য ও ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, যাদের জীবন ও কর্ম উৎসাহের এবং প্রেরণার উৎস।’ সৈয়দ আবুল হোসেন সম্পর্কে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আবদুল মান্নানের অনুভূতি- ‘খরভব রং ংযড়ৎঃ, নঁঃ ঃযবৎব রং ধষধিুং ঃরসব বহড়ঁময ভড়ৎ পড়ঁৎঃবংু.’ এর মার্জিত রূপ দেখা যায় সৈয়দ আবুল হোসেনের চরিত্রে।
ছাত্রজীবন হতে সৈয়দ আবুল হোসেন মেধাবী, বুদ্ধিমান ও অমায়িক ছিলেন। তিনি যেমন ছিলেন বিনয়ী, তেমনি ছিলেন ধীর। শান্তশিষ্ট অথচ তীক্ষè মেধার অধিকারী। তার স্মরণশক্তি ও গ্রহণ ক্ষমতা ছিল অবিশ্বাস্য। একবার কোনো কিছু শুনলে কিংবা দেখলে সহজে ভুলতেন না। স্কুলজীবনে শিক্ষকগণ তাঁকে চলন্ত অভিধান ডাকতেন। পুরো ডিকশনারি ছিল তার নখদর্পণে। গৌরনদী কলেজের অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মো. তমিজ উদ্দিনের ভাষায়, ‘তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। মাথা নিচু করে অথচ সটান রাজপুত্রের মতো চলাফেরা করতেন। তাঁর কণ্ঠ ছিল মোলায়েম ও মার্জিত। কারও সাথে রূঢ় ভাষায় কথা বলতেন না। বিনয়ের সাথে রাজকীয় জৌলুসের মিশ্রণ সৈয়দ আবুল হোসেনকে বিরল মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছিল।’১
অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষক। তাঁর ভাষায়, “মানুষ হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেন অত্যন্ত সজ্জন। তিনি নিজের ক্ষতি করতে পারেন, তবে অন্য কারও নয়। সৃষ্টির সব কিছুর প্রতি তিনি মমত্বশীল। আমাদের চারিপাশে যা আছে সব কিছুতে তার দৃষ্টি আলোর মতো অবিরাম, বৃষ্টির মতো স্নাত, বিকেলের রোদের মতো ঈষদুষ্ণ।”২ সৈয়দ আবুল হোসেনের ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনের বন্ধু আব্দুল কাদের সাহেবের ভাষায়, “সৈয়দ আবুল হোসেন সবসময় উচ্ছল, সবসময় আন্তরিক, কথা ও কাজে তাঁর বিন্দুমাত্র ফাঁক থাকে না।” বন্ধু হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ড. এম মান্নান বলেছেন, ূ‘ঋৎরবহফংযরঢ় রিঃয ড়হবংবষভ রং ধষষ রসঢ়ড়ৎঃধহঃ নবপধঁংব রিঃযড়ঁঃ রঃ ড়হব পধহহড়ঃ নব ভৎরবহফং রিঃয ধহুনড়ফু বষংব রহ ঃযব ড়িৎষফ.”৩
কৃতজ্ঞতাকে মানবতার সর্বোৎকৃষ্ট প্রকাশ বলা হয়। সৈয়দ আবুল হোসেন কৃতজ্ঞতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কেউ তাঁর সামান্য উপকার করলে তিনি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন না। তিনি মনে করেন, এৎধঃরঃঁফব রং ঃযব ভধরৎবংঃ নষড়ংংড়স যিরপয ংঢ়ৎরহমং ভৎড়স ঃযব ংড়ঁষ. তিনি প্রতিটি মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি গভীর কৃতজ্ঞ। হয়ত তাই কারও ক্ষতি করতে পারেন না।
এশিয়া এন্ড প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. কবীর কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন রাজনীতিবিদ হয়েও পরম নিরপেক্ষতার ভূষণ। তিনি যখন মন্ত্রীর চেয়ারে বসেন তখন আদর্শ প্রশাসক। পেশাদার প্রশাসকের মতোই নিরপেক্ষ। রাজনীতি বা দলের প্রতি অনুগত থেকে কীভাবে দেশের উন্নয়ন করা যায় সেটিই তাঁর মুখ্য বিষয়। এরূপ নিরপেক্ষতা কেবল বিচারের নিক্তিতে পরিমাপ্য। রাজনীতিক পরিমণ্ডলে রাজনীতিক পদ বিন্যাসে কোনো দেশের সংসদের স্পিকারকে সবচেয়ে বেশি নিরপেক্ষ থাকতে হয়। সৈয়দ আবুল হোসেন স্পিকার নন, তবু তাঁর নিরপেক্ষতা সর্বাঙ্গীন সুন্দর। তাঁর ভাষা, কথা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব অসাধারণ। যে কোনো মুহূর্তে যে কোন বিষয়ের উপর যে কোনো প্রশ্নের এমন উত্তর দেন যা প্রশ্নকারী, শ্রোতা এবং পক্ষ-বিপক্ষ সবাইকে সন্তুষ্ট করার উপাদানে ভরপুর থাকে। কারও প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ পায় না।’ ছাত্রজীবনেও তিনি ছিলেন ন্যায়বান ও নিরপেক্ষ। ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কোনো ঝগড়া হলে সবাই সৈয়দ আবুল হোসেনকে বিচারক মানত এবং তিনি নিরপেক্ষভাবে ন্যায়ভিত্তিক সমাধান দিতেন।৪ এ গুণটা তাঁর মাঝে এখন আরও বেশি পরিদৃষ্ট হয়। সন্ত্রাসী সে যেই হোক না কেন, নিজের ভাই হলেও ছাড় দেন না। ফলে তার নির্বাচনী এলাকায় কোনো সন্ত্রাস নেই বা দলবাজি কিংবা কোন্দল নেই।
কালকিনিতে তিনি অজাতশত্র“। মাদারীপুরে অবিসংবাদিত নেতা। মন্ত্রণালয়ে দূরদর্শী মন্ত্রী, বিচক্ষণ প্রশাসক এবং সমগ্র বাংলাদেশে মার্জিত চরিত্রের অধিকারী একজন সৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রাক্তন সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম কোতোয়ালের মতে, ‘দলের প্রতি নিবেদিত এমন নেতা খুব কম আছে। গৌরবময় কর্মের মাধ্যমে তিনি সতত উজ্জ্বল।’ কালকিনির সংখ্যালঘুরা তাকে বলেন দেবতা; বিরোধী দলের লোকেরা মনে করেন বন্ধু, নিরাপদ আশ্রয়। তিনি আওয়ামী লীগ করেন। আওয়ামী লীগ কারও নিজস্ব দল নয়, আমজনতার দল। বঙ্গবন্ধু এভাবে চিন্তা করতেন। বঙ্গবন্ধুর নিবিড় অনুসারী হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে দল নয়, দেশই বড়। মানুষ নয়, কর্মই বিবেচ্য।৫
সহানুভূতি মানব জীবনের একটি অনবদ্য গুণ। খুব কম প্রাণীর মধ্যে এটি দেখা যায়। একজন মানুষের মনুষ্যত্ব যে বিষয়টা দিয়ে সবচেয়ে বেশি পরিস্ফুট হয়, সেটি সহানুভূতি। সৈয়দ আবুল হোসেন সহানুভূতির এক অনুপম দৃষ্টান্ত। এ প্রসঙ্গে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়- অশীতিপর বৃদ্ধ মবিন হাওলাদার লাঠিতে ভর করে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায়। এ সময় সৈয়দ আবুল হোসেনসহ অনেক শিশু ডাসার প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে বাড়ি ফিরছিল। বৃদ্ধের পতন দেখে সবাই হেসে ওঠে। সৈয়দ আবুল হোসেন হাসলেন না, তার চোখ জলে ছল ছল করে উঠল। বইগুলো মফিজুল হকের হাতে দিয়ে লোকটাকে তুলে দিলেন।৬
এ রকম আর একটি ঘটনা সৈয়দ আবুল হোসেনের স্কুলজীবনের সঙ্গী লাল মিয়ার জবানিতে শোনা যেতে পারেÑ এলাকায় সৈয়দ আবুল হোসেনের পরিবার ছিল তুলনামূলকভাবে সচ্ছল। খরচার জন্য টাকা দিলে সে নিজে খরচ করত না। গরিবদের দিয়ে দিত। যাদের বই নেই তাদের বই কেনার জন্য সাহায্য করত। একদিন আমরা ঝড়ে আম কুড়োচ্ছিলাম। সে তিনটা আম পেয়ে বাড়ির দিকে চলে আসছে। এ সময় একটা ছেলে আম পায়নি বলে কাঁদছিল। আবুল হোসেন তা দেখে সবগুলো আম ছেলেটিকে দিয়ে দিয়েছিল। ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে। তখন আবুল হোসেন ক্লাশ ফাইভে। এক জেলের কাছ হতে মাছ কিনল। জেলে দাম বলল: ‘দাম দশ টাকা।’ জেলের কথামতো আবুল হোসেন জেলের হাতে দশ টাকা দিয়ে বলল: ‘আপনার আর কোনো পাওনা আছে?’ জেলে অবাক হয়ে আবুল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তুমি একদিন অনেক বড় হবে।’ জেলের আশীর্বাদ ফলেছে।৭ তিনি বিবাহের পূর্বেই হজব্রত পালন করেছিলেন। সাথে ছিলেন প্রাণপ্রিয় জননী। মক্কা-মদিনার দীর্ঘপথে বাসে একজন যাত্রী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। পথিমধ্যে ঐ অসুস্থ যাত্রীকে হাসপাতালে নেয়ার ঝামেলা কেউ গ্রহণ করতে আগ্রহ দেখালেন না। যুবক সৈয়দ আবুল হোসেন মাঝপথে নেমে ঐ অসুস্থ যাত্রীর চিকিৎসার দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।৮
সময়বোধ ও কর্তব্যপরায়ণতার উজ্জ্বল আলেখ্য সৈয়দ আবুল হোসেন। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব সফিক আলম মেহেদির ভাষায়, “এত চেষ্টা করেও মন্ত্রী মহোদয়ের পূর্বে অফিসে আসতে পারিনা। তিনি আসেন সাড়ে নয়টায়, অথবা যখন আসার কথা তখন; এক সেকেন্ড এদিক ওদিক হয় না। রাজনীতি করেন, নিজস্ব অফিস করেন, সভা-সমিতি করেন, দর্শনার্থীদের সময় দেন; পরিবার-পরিজন দেখেনÑ এতকিছুর পরও সবকিছু কীভাবে যথাসময়ে করেন ভেবে বিস্মিত হই।” তাঁর সময়ানুবর্তিতার একটি ঘটনা সড়ক ও রেলপথ বিভাগের যুগ্মসচিব জনাব মো. মোস্তফার ভাষায় শোনা যেতে পারেÑ ২০০৯ এর সেপ্টেম্বর/অক্টোবর-এর দিকে মন্ত্রী মহোদয় সরকারি সফরে দক্ষিণ কোরিয়া হতে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করলেন। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে হতে রাত প্রায় তিনটা। বিমানবন্দরে আমাদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। আমরা অনেকেই ধরে নিয়েছিলাম যে হয়ত তাঁর পরের দিন নিত্যকার অভ্যাসমতো সকাল নয়টার মধ্যে সকল কর্মকর্তাদের সাথে মন্ত্রী মহোদয়ের যে দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা হওয়ার কথা, তা হবে না। ফলে আমার মতো বেশ কয়েকজন রাতের ক্লান্তি-শ্রান্তির কারণে সকাল নয়টার বেশ পরে মন্ত্রী মহোদয়ের কক্ষে উপস্থিত হই। আর তখনই বিস্ময়ের ধাক্কা। জানলাম, মন্ত্রী মহোদয় নিত্যকার অভ্যাসের কোনো ব্যত্যয় ঘটাননি। অর্থাৎ তিনি সকাল নয়টার পূর্বেই অফিসে উপস্থিত হয়েছেন। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যিনি সর্বদাই কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে চলে এসেছেন সাফল্যের সোনালি সবুজ হরিণ তো তাঁরই করায়ত্ত্বে থাকবেÑ এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।৯
অনেক লোক আছে তাদের সবসময় ব্যস্ত দেখা যায়, অথচ কাজের মতো কোনো কাজ থাকে না, করে না। সৈয়দ আবুল হোসেন মনে করেন, ব্যস্ততা কাজের অনুষঙ্গ। এটি দেখানোর কিছু নয়, কাজ করতে করতে ব্যস্ততা নীরবে চলে আসে। তাই সব কিছু ধীরস্থিরভাবে করা উচিত। প্রথমে বেছে নিতে হবে পছন্দ। তারপর বিবেচনা, অতঃপর সিদ্ধান্ত এবং সবার শেষে কার্য। সৈয়দ আবুল হোসেন মনে করেন, ঞযবৎব রং হবাবৎ বহড়ঁময ঃরসব ঃড় ফড় বাবৎুঃযরহম, নঁঃ ঃযবৎব রং ধষধিুং বহড়ঁময ঃরসব ঃড় ফড় ঃযব সড়ংঃ রসঢ়ড়ৎঃধহঃ ঃযরহম. তাই তিনি অসংখ্য কাজের মধ্য হতে গুরুত্বপূর্ণগুলো বেছে নেন।
কর্মে তিনি গণিতের মতো আক্ষরিক, চিন্তায় সময়ের মতো গতিশীল, ভালোবাসায় প্রকৃতির মতো লাস্যময়, স্নেহে পিতার মতো সুবিনয়; বিপদে ধরিত্রীর মত ধৈর্যশীল। তিনি আগামীকালের অপেক্ষায় থাকেন না, ওটি কখনও আসে না। আবার সাফল্যের জন্যও অপেক্ষা করেন না। সাফল্যের জন্য অপেক্ষা করার সময় তাঁর নেই। তাই সাফল্য ছাড়াই তিনি এগিয়ে চলেন। বাধ্য হয়ে সাফল্যই তাঁর পিছু নেয়। তিনি লক্ষ্যে স্থির। কোথাও তাড়াতাড়ি পৌঁছার চেষ্টা করার আগে কোথায় যেতে হবে এবং কীভাবে যেতে হবে সেটিই আগে স্থির করে নেন। তাই তাঁর লক্ষ্য চ্যুত হয় না, সময় অপচয় হয় না। তিনি অতীতের জন্য আফশোস করেন না এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে অস্থিরও হন না। তাই সর্বক্ষণ অবিচল থাকতে পারেন। সৈয়দ আবুল হোসেন মিতভাষী। অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন না। কর্ম, জয়-পরাজয় ও ত্যাগ এ ত্রয়ী সমন্বয়ে জীবনের প্রতিটি বিষয়কে উপভোগ করেন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের নির্মল আনন্দে। লক্ষ্য ভেদকে সৈয়দ আবুল হোসেন গন্তব্যস্থল মনে করেন না, মনে করেন পরবর্তী যাত্রার হাতছানি। পথ যত লম্বা হোক তার নজর সেদিকে পড়ে না। তিনি বিশ্বাস করেন, যার আরম্ভ আছে তার শেষও আছে। অসীমতার শুরু বিন্দু হতে। যেখানে পুরাতনের শেষ সেখানে নতুন কিছুর শুরু। পুরাতনের জন্য অহেতুক কান্না সময় নষ্ট ছাড়া কিছু নয়। যা হবার হবে, এতে বিচলিত হয়ে লাভ কী!
জীবনকে কর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে সততার সাথে পরিচালনা করেন বলে তাঁর মুখে হাসির ছটা বৈকালিক প্রহরের মতো লেগে থাকে। তাঁর কাজ মমতায় জীবন্ত, শাসনবিন্দু রূপোলি আলোর মতো মুগ্ধকর। রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, কলামিস্ট, সমাজ-সংস্কারক, শিক্ষানুরাগী, সংগঠক, লেখক, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এতগুলো প্রত্যয়কে নিয়েও তিনি পথ চলেন স্বাচ্ছন্দ্যে। ব্যাঘাত ঘটে না সংসার জীবনের। সময় দেন সবাইকে যার যেমন প্রাপ্য। উপস্থিত হন যেখানে প্রয়োজন। সৈয়দ আবুল হোসেনের কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মপ্রবণতার উদাহরণ টানতে গিয়ে তরুণ তপন দেওয়ান বলেছেন, ‘যেখানে এক পদ্মা সেতুই যে কোনো লোকের ঘুম হারাম করে দিতে পারে, সেখানে পদ্মা সেতুর বাড়তি চাপ নিয়ে এত বড় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বহুমাত্রিক কাজের মনিটরিং করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। অথচ তিনি (সৈয়দ আবুল হোসেন) তা খুবই চমৎকারভাবে করে যাচ্ছেন। এত কর্মযজ্ঞের মাঝেও মুখের হাসির মলিনতা নেই।১০ এর কারণ হচ্ছে ডগবার্ট ডি রিউনেস এবং জর্জ স্যান্ড এর ন্যায় তিনিও মনে করেন- ডড়ৎশ রং সধহংদং সড়ংঃ হধঃঁৎধষ ভড়ৎস ড়ভ ৎবষধীধঃরড়হ.ডড়ৎশ রং হড়ঃ ঢ়ঁহরংযসবহঃ. ওঃ রং ৎবধিৎফ, ংঃৎবহমঃয ঢ়ষবধংঁৎব.
সময়কে যদি কর্মের মাধ্যমে প্রগতিভূত সৃষ্টির প্রতি অনুগত রেখে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য অধ্যবসায়-প্রসূত অদম্যতা বিমূর্ত করা যায়, তাহলে সে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির কাছে কোনো কিছু অসম্ভব নয়। কাজের প্রতি নিষ্ঠা, সময়ের প্রতি সতর্কতা শেখার প্রতি আগ্রহ, সৃষ্টির প্রতি প্রেম, মানুষের প্রতি ব্যবহার দিয়ে যদি কোনো ব্যক্তিকে বিচার করা হয়, তাহলে সৈয়দ আবুল হোসেন নিঃসন্দেহে একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ।১১ আমি মনে করি, তিনি এমন একটি বড় মনের অধিকারী যিনিÑ ডব হববফ হড়ঃ ঃযরহশ ধষরশব ঃড় ষড়াব ধষরশব.Ñ প্রবাদটি অনুক্ষণ মনে রেখে পথ চলেন। নইলে এমন উদারতা কীভাবে বর্ষণ করা একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব! তিনিও তো অন্যান্য মানুষের মতো রক্তমাংশের অধিকারী।
সৈয়দ আবুল হোসেন দেশপ্রেমিক। জাতির দুঃসময়ে আপন বলয়ে সামর্থ্যরে পূর্ণ ডালা নিয়ে এগিয়ে যান মানুষের প্রয়োজনে, জাতির কল্যাণে। উজাড় করে দেন নিজের সামর্থ্য। মানিকগঞ্জ ও সাটুরিয়া এবং ১৯৮৮ ও ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে মহাবন্যায় দুর্গত মানুষের প্রতি উজাড় করে দিয়েছিলেন বিত্ত ও চিত্ত। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির প্রতি অবিচল আস্থা এবং প্রগাঢ় শ্রদ্ধা তাঁর অস্থিমজ্জার অংশ। এ বিশ্বাসে অবিচল থেকে দেশের কল্যাণে, মানুষের মঙ্গলে উদাত্ত মাধুরিমায় স্বাধীনতার স্বাদকে পরিপূর্ণ আনন্দে উপভোগের ক্ষেত্র প্রস্তুতে তিনি প্রতিনিয়ত ঐকান্তিক। শিক্ষাবিস্তারকে তিনি জাতি বিনির্মাণের মূল নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শিক্ষা ছাড়া উন্নয়ন, উন্নয়ন ছাড়া সভ্যতা এবং আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা ছাড়া স্বাধীনতা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায় না। তাই সৈয়দ আবুল হোসেন শিক্ষাবিস্তারে নিজেকে বিছিয়ে দিয়েছেন প্রকৃতির মতো অশেষ বিভবে।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার অনাবিল সম্মান, শ্রদ্ধাময় ভালোবাসা ও অবিচ্ছিন্ন সহানুভূতি মুক্তিযুদ্ধের পরও থেমে থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পর অনেক মুক্তিযোদ্ধা চরম আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন। সৈয়দ আবুল হোসেন উদার মমতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের পাশে ছুটে এসেছিলেন। গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়েছিলেন গৃহ, বস্ত্রহীনে বস্ত্র, খাদ্যহীনে খাদ্য। চিকিৎসার জন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধা দিনের পর দিন বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছিলেন। অনেকে টাকার অভাবে সোমত্ত মেয়ের বিয়ে দিতে পারছিলেন না। সৈয়দ আবুল হোসেন নিজ তহবিল হতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের সকল অভাব পূরণ করেছিলেন। সে সময় তিনি অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের হারানো মনোবলকে চাঙ্গা করেছিলেন। বীরমুক্তিযোদ্ধা এস্কান্দর শিকদারের ভাষায়, ‘আমরা ভেঙে পড়েছিলাম। আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন আমাদের পাশে বটবৃক্ষের ন্যায় দাঁড়িয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন- ভয় নেই, আমি আপনাদের পাশে আছি। তিনি এখনও আমাদের পাশে আছেন। আমরা প্রতিনিয়ত তার নেতৃত্বে জাতির উন্নয়নের জন্য নতুন আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধ করে যাচ্ছি। এ যুদ্ধ উন্নয়নের, শিক্ষার, প্রগতির এবং অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোয় উৎসারিত হবার।১২
কর্মস্থলে তিনি অমায়িক বাৎসল্যে পরিশুদ্ধ একটি আলোকবর্তিকা। সৈয়দ আবুল হোসেনের সংস্পর্শ সবাইকে পরশপাথরের মত বদলে দেয়, গড়ে তুলে নতুন ভাবনার চিরন্তন সৌকর্যে। তিনি বলেন কম, প্রকাশ করেন অধিক। শোনেন বেশি, শুনান কম। আইন-কানুন, বিধি-বিধান, রাষ্ট্র ও প্রশাসন সম্পর্কিত খুঁটিনাটি বিষয়ে তার সম্যক জ্ঞান রয়েছে। যা প্রয়োজন হতে পারে তা তিনি পূর্বাহ্নে হৃদয়ঙ্গম করে আলোচনায় আসেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাবার আগে প্রয়োজনীয় সকল অস্ত্র নিয়ে নামেন। পরাজয় স্বাভাবিক, তাই বলে পরাজয়কে বিনা প্রতিরোধে মেনে নেয়ার পাত্র তিনি নন। পরাজয় তাঁকে আহত করে না, বরং নব-প্রত্যয়ে দীপ্ত করে। ভুল হতে শিক্ষা নিয়ে ভুলের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন অবলীলায়। তাঁর ভাষায়, ‘আই এ্যাম এ সেল্ফমেইড ম্যান, আই থিংক এভরিওয়ান ক্যান রিচ, হোয়ার আই এ্যাম; শো আই হ্যাভ রেসপেক্ট ফর অল।’১৩

জননেত্রী শেখ হাসিনার নিবিড় সান্নিধ্য সৈয়দ আবুল হোসেনের অনুপ্রেরণা। বঙ্গবন্ধু তাঁর আদর্শ, শেখ হাসিনা রাজনীতিক গুরু এবং আদর্শিক অভিভাবক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত ও শেখ হাসিনার স্নেহধন্য সৈয়দ আবুল হোসেন আওয়ামী লীগকে নিজের চেয়েও পরম মমতায় লালন করেন। ওয়ান-ইলিভেনের পর আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য তাঁর ভূমিকা ও বুদ্ধিমত্তা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাকানো ষড়যন্ত্রে অংশ নাÑনেয়ায় তাঁকে অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। তবু তিনি মাথা নোয়াননি। তাঁর পরিষ্কার উক্তি, জীবন দেবো তবু নেত্রীর প্রতি আনুগত্য হতে এক চুল নড়ব না।১৪ আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলকে প্রচুর অর্থ আর উপদেশ দিয়ে সহায়তা করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার লক্ষ্যে তার নিরলস শ্রম ও ব্যয় চোখে নাÑদেখলে বিশ্বাস করা যায় না।১৫ দেশ গঠনে সৈয়দ আবুল হোসেনের ভূমিকা বিশাল পরিব্যাপ্ততায় নির্ভরতার বৈপ্লবিক অহঙ্কার।
মার্জিত ভাষা ও সুললিত কণ্ঠের অধিকারী সৈয়দ আবুল হোসেনের কণ্ঠ যেমন মুগ্ধকর তেমনি অনাবিল, মধুময়। প্রতিটি বাক্য অকাট্য যুক্তির নির্যাস; স্পষ্ট এবং অর্থবহুল। অপ্রয়োজনীয় কথা বলাকে তিনি অপ্রয়োজনীয়ভাবে বুলেট ছোড়ার সামিল মনে করেন। যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান ও ব্যক্তি নির্বাচনে তাঁর জুড়ি নেই। প্রাক্তন সচিব সৈয়দ আলমগীর ফারুক চৌধুরীর ভাষায়: কোনো ব্যক্তিকে কি দায়িত্ব দিতে হবে তা তিনি লোকটিকে এক পলক দেখেই বুঝে নিতে পারেন।
নিরহঙ্কারী মানুষ ও সহনশীল রাজনীতির প্রবক্তা সৈয়দ আবুল হোসেন স্বল্প সময়ের মধ্যে সবার নজরে নমস্য বিমূর্ততায় অভিভূত হয়ে উঠেছেন। বহুমুখী তার যোগ্যতা। তিল তিল পরিশ্রমে সাকো ইন্টারন্যাশনালের মতো বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েও নিতান্তই অনাড়ম্বর। ব্যবসার মতো রাজনীতিতেও ঈর্ষণীয় সাফল্যের অধিকারী। তবু নির্লোভ। যার লোভ নেই, তিনি সবার কাছে লোভনীয়, আকর্ষণীয়। মন্ত্রণালয়ে সচিব হতে শুরু করে পিয়ন, গ্রামে ধনী হতে শুরু করে ভিক্ষুকÑ সবার প্রতি সমভাবালুতা সৈয়দ আবুল হোসেনের মহানুভবতার অনাবিল প্রমাণ।১৬
সৈয়দ আবুল হোসেন আপাদমস্তক পরিচ্ছন্ন। অনুপম শৈলীকলার সহনশীল সমসত্তায় নিগূঢ় তাঁর প্রতিভা। তবে কিছুটা লাজুক; নিভৃতচারী ও প্রচার-বিমুখ। কর্মে তিনি এত বিশ্বাসী যে, প্রচার নামক বিষয়টি তেমন দাগ ফেলতে পারে না। কাঠ নিজে পুড়ে অন্যকে আলো দেয়, ফুল-ফল ও সবুজের সম্ভার মাটির অবদান। কিন্তু মাটির খবর কেউ রাখে না। ঠিক তেমনি সৈয়দ আবুল হোসেন। অনেক কিছু করেও তিনি নিজেকে সাধারণ ভাবেন। শিক্ষা, উন্নয়ন, সংগঠন, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, পরিবেশ, প্রশাসন ইত্যাদিসহ আর্থসামাজিক পরিমণ্ডলের সর্বক্ষেত্রে তাঁর অবদান কীর্তিময়তায় ধ্র“ব। জাতীয় পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ নাÑকরার শর্তে বললেন, তিনি যেখানে যান সেখানে একটি পরম আবহ সৃষ্টি করেন, সৃষ্টি করেন অনুকূল পরিসঞ্চালন। মানুষের মন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় মোহনীয় হয়ে ওঠে। তাই তিনি অসাধারণ হয়েও সাধারণ, সাধারণ হয়েও অসাধারণ।’১৭ ‘বাতাস ছাড়া মানুষ এক মুহূর্ত বাঁচতে পারে না। কিন্তু বাতাস আছে বলে আমরা তাঁর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারি না। বাতাস না থাকলে বোঝা যেত, এটি কী। ঠিক তেমনি সৈয়দ আবুল হোসেন দেশের জন্য আমাদের কালকিনির জন্য কত প্রয়োজন এটি সেদিনই অনুধাবন করা যাবে যেদিন তিনি থাকবেন না।’
সারা বাংলাদেশে সৈয়দ আবুল হোসেন একটি পরিচিত মুখ। শিক্ষা বিস্তারে তাঁর উদার একাগ্রতা সর্বমহলে প্রশংসিত। শিক্ষার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন সৈয়দ আবুল হোসেনের অনুধ্যায়ী চেতনার উজ্জ্বল প্রকাশ। তৃতীয় বিশ্বে তাঁর মতো উদার লোক খুব কম আছে। বাংলাদেশে অনেক লোক আছে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি বিত্তের অধিকারী কিন্তু তাঁর মতো চিত্তের অধিকারী নাÑহলে তো আর নিজের কষ্টার্জিত অর্থ এমন মহান উদারতায় দান করা যায় না। সার্বিক কর্মকাণ্ড বিবেচনায় আমেরিকার বায়োগ্রাফিক্যাল ইন্সটিটিউট আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনকে গবফধষ ড়ভ ঃযব গরষষবহহরঁস তথা শতবর্ষের শ্রেষ্ঠ মানুষ পদকে ভূষিত করে। শিক্ষা বিস্তারের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি শেরে-বাংলা পদক, জাতীয় পুরস্কার, অতীশ দীপঙ্কর পদক এবং মোতাহার হোসেন পদক ছাড়াও অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
সৈয়দ আবুল হোসেনের কথা, আচরণ কিংবা ব্যবহারে প্রতিপক্ষ কখনও আহত হন না। তিনি কাউকে কষ্ট দিয়ে কোনো কথা বলেন না। সংসদে, মাঠে, রাজনীতিক মঞ্চে, অফিসে, মন্ত্রণালয়েÑ সবখানে তিনি অমায়িক, মার্জিত। কেউ তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেও তিনি ক্ষুব্ধ হন না। তিনি ‘রাগ ও ক্ষুব্ধতাকে’ পাগলামির নামান্তর মনে করেন। অনেক সময় অনেকে তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হন। তিনি থাকেন সাবলীল, সহাস্য। এরূপ হাসি দিয়ে তিনি কত রাগান্বিত লোকের হৃত স্বাভাবিকতা পুনরায় ফেরত দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। কৃতজ্ঞতা তাঁর চরিত্রের আর একটি বিশেষ গুণ। কেউ তাঁর সামান্য উপকার করলে তিনি তা কথা, কাজ আর নিষ্ঠা দিয়ে অসংখ্যভাবে ফেরত দিয়ে দেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, যাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল আকাশের চেয়ে বিশাল, সে মহামানবের কন্যার মন্ত্রীসভার সদস্য এবং তাঁর পাশে বসে দেশ পরিচালনায় অংশ নিতে পারার সুযোগকে তিনি পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন।১৮ এ মর্যাদা অক্ষুণœ রাখার প্রত্যয় তাঁকে প্রতি মুহূর্ত সচেতন রাখে, সতর্কতায় বিচক্ষণ রাখে।
শিক্ষক সমাজকে তিনি সবসময়েই অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকেন। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ১৯৯৪ সালের ঢাকার রাজপথে অবস্থান ধর্মঘটের সময়ে তিনি তাদের জন্য তাঁবু ও খাবার-দাবারের আয়োজন করেন। একজন শিক্ষক ইন্তেকাল করলে তিনি তার সন্তান-সন্ততির শিক্ষা ও পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে অর্থায়নের ব্যবস্থা করেন। যা দেশবাসীর সামনে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। মন্ত্রী হলেও তিনি তাঁর শিক্ষকদের দেখলে এখনও পায়ে ধরে শ্রদ্ধা জানান। তাঁর শিক্ষক ভক্তি দেখে আপ্লুুত হয়ে তার এক শিক্ষক বলেছেন, “জানি না পৃথিবীর ইতিহাসে কয়জন শিক্ষক সক্রেটিস হইবার জন্য আলেকজান্ডার পাইয়াছেন তবে আমি পাইয়াছি। আমি সক্রেটিস না হইতে পারি, আমার ছাত্র সৈয়দ আবুল হোসেন আমার জন্য বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার।” শিক্ষকদের অবদান তিনি অত্যন্ত সম্মানের সাথে স্মরণ করে থাকেন এবং প্রায়শ বলেন :
গুরু যদি এক বর্ণ শিষ্যরে শিখায় কোনোদিন,
পৃথিবীতে নেই দ্রব্য যা দিয়ে শোধ দিবে ঋণ।১৯
অনেকে রাজনীতি করেন ক্ষমতার জন্য, ভোগের জন্য। সৈয়দ আবুল হোসেন রাজনীতি করেন ত্যাগের জন্য, উন্নয়নের জন্য। রাজনীতিতে আসার পর তিনি রাজনীতি হতে এক পয়সাও লাভবান হননি বরং তাঁর আগমন বাংলাদেশের রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে, পরিশুদ্ধ করেছে। পরের ধনে পোদ্দারি কি রাজনীতি? আমাদের দেশে রাজনীতি মানে পরের ধনে পোদ্দারি, ছোট ছোট জনগণের বিন্দু বিন্দু ক্ষমতা জড়ো করে অধিকাংশ রাজনীতিক জনগণের উপর পোদ্দারি করেন। সৈয়দ আবুল হোসেন এমন একজন মানুষ যিনি জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে দিয়ে পুরো নিঃস্ব হবার প্রত্যয়ে দৃপ্ত। নিপাট অধ্যবসায়, প্রগাঢ় মনোনিবেশপ্রসূত অভিজ্ঞান ও কৃতজ্ঞতার তিলোত্তম মহিমায় বিভূষিত এবং অভাবনীয় অন্তর্দৃষ্টি ও যৌক্তিক মিথষ্ক্রিয়ার মাঝে সত্য-মিথ্যা ও বাস্তবতাকে চিহ্নিত করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার এক অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে সৈয়দ আবুল হোসেনের। তাই তিনি পা হতে মাথা পর্যন্ত মননে-দর্শনে পরিপূর্ণ আদর্শের অনুসরণীয় একজন আকর্ষণীয় নেতা।
সৈয়দ আবুল হোসেন রাজনীতিবিদ, তবে গতানুগতিক নন। তিনি যুক্তিতে অমিয়, বস্তুনিষ্ঠায় অনুপম। বাংলাদেশে তিনি সহনশীল রাজনীতির প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত। রাজনীতির মাঠেও প্রতিদ্বন্দ্বীর গলা জড়িয়ে ধরতে পারেন পরম ভালোবাসায়, নিবিড় শ্রদ্ধায়। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় কোনো দলবাজি নেই। উন্নয়ন ছাড়া তিনি কিছু বোঝেন না, ভালোবাসা ছাড়া কিছু অনুভব করেন না। তাঁর ভোটারগণও তাঁর প্রতি অনুরূপ অনুরক্ত। তারা সৈয়দ আবুল হোসেন ছাড়া আর কিছু বোঝেন না। তাই নির্বাচনী এলাকায় নাÑগিয়েও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে আসেন। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচন ছিল তাঁর জীবনের প্রথম সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন প্রচারণার জন্য শুধু একদিন এলাকায় গিয়েছিলেন। তাতেই প্রতিপক্ষকে বিপুল ভোটে হারিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রাক্তন সংসদ সদস্য অধ্যাপক মো. ওয়ালীউল্লাহর ভাষায়, ‘আমাদের চাঁদ প্রয়োজন। তবে চাঁদকে কোলে নিয়ে বসে থাকার জন্য নয়; জ্যোৎস্নার জন্য। সূর্য নয় সূর্যের আলো সবার কাম্য। সূর্য দূরে না কাছে, এটি বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য হচ্ছে আলো। তেমনি সৈয়দ আবুল হোসেন এলাকায় কম যান নাকি বেশি যান সেটি আলোচ্য হতে পারে না। আলোচ্য বিষয় তিনি এলাকার জন্য কি করেছেন এবং করছেন। তিনি তাঁর অবস্থান থেকে অর্জিত উর্বরতা কালকিনিতে প্রতিনিয়ত সরবরাহ করছেন। সূর্যের মতো তাঁর আলো সতত বিস্তৃত সর্বত্র।’
আবেগের কাছে নয় বরং আবেগই তাঁর বশ্য। আবেগ যাঁর কাছে বশ্যতা স্বীকার করে তিনি অসাধারণ। এমন মানুষ ঋদ্ধতার আকাশ, উদারতার মুগ্ধতায় সবুজ প্রান্তর আর ফুলেল চাদরে আবৃত রাশ রাশ প্রশান্তি। সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা অধিকাংশ রাজনীতিবিদের স্বাভাবিক চরিত্র। সৈয়দ আবুল হোসেন কখনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন না। বরং সিদ্ধান্তই তাকে বাস্তবতার বিমূর্ত বিকেলের মতো নন্দিত করে তোলে। তাই তাঁর সিদ্ধান্তগুলো সব সময় নিবিড় মাঠের গভীর মাটির সোঁদা গন্ধের মতো নান্দনিক হয়ে ওঠে। যুক্তিগ্রহণ মানসিকতা, ঔদার্যময় প্রেরণা ও যথামূল্যায়নের কার্যকর দক্ষতা তাঁকে সংকট মোকাবেলায় অলৌকিক ব্যক্তিত্বে রূপায়িত করেছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মতো বিশাল ও স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও এ পর্যন্ত তাঁর আচরণ ও কথাবার্তায় কোনো অহংবোধ কিংবা অশালীনতা প্রকাশ পায়নি। ঙহবদং ধঃঃরঃঁফব ফবঃবৎসরহবং ড়হবদং ধষঃরঃঁফব.
ধর্ম সম্পর্কে তাঁর ধারণা, অভিব্যক্তি ও বিশ্বাস যেমন উদার তেমনি প্রজ্ঞাময়। তিনি মুসলমান, বিয়ের পূর্বে হজ করেছেন। নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। তাঁর শরীরে হযরত আলীর রক্ত। তবে তিনি অসাম্প্রদায়িক। তাঁর ভাষায়, ‘চূড়ান্ত বিশ্লেষণে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলেই একই স্রষ্টার সৃষ্টি। মানবতার চেয়ে বড় ধর্ম আর নেই। আমি সে মানবতায় বিশ্বাসী। চিন্তা ও চেতনায়, কাজে ও কর্মে একজন মানবতাবাদী ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে আমার অবস্থান। সে ভাবেই আমি শিক্ষা পেয়েছি। সেভাবেই জীবন গড়েছি। মনুষ্যত্বের পরিচয়েই আমি মানুষকে বিচার করে থাকি। আমার কাছে সবসময় মানুষই বড়। আমার ব্যবহারিক জীবনেও এ আদর্শই আমি সবসময়েই অনুসরণ করে আসছি।’২০ তিনি আরও বলেন, ‘একটি অসাম্প্রদায়িক খাঁটি বাঙালি পরিবেশে আমি মানুষ হয়েছি এবং সেই শিক্ষাই ধারণ করে চলেছি। সেই শিক্ষাই ধারণ করে চলব আমৃত্যু। সেই শিক্ষাই আমাকে প্রণোদিত করেছিল, উদ্বুদ্ধ করেছিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে।’২১ তাঁর দৃঢ় ঘোষণা, ‘ডযবহ ও ফড় মড়ড়ফ, ও ভববষ মড়ড়ফ; যিবহ ও ফড় নধফ, ও ভববষ নধফ. ঞযধঃ’ং সু ৎবষরমরড়হ.ঞযধঃ’ং সু ওংষধস ভধরঃয ঃড় ধষসরমযঃু অষষধয.’
নারীর ক্ষমতায়ন ও মর্যাদা রক্ষায় সৈয়দ আবুল হোসেনের আন্তরিকতা সতত প্রশংসনীয়। নারী শিক্ষার প্রসারে তিনি নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজ। ঐ কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের যাবতীয় ব্যয়ভার সৈয়দ আবুল হোসেন নিজেই বহন করেন। নারী ও নারীশিক্ষার প্রতি সৈয়দ আবুল হোসেনের দরদ প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁর এক বাল্যবন্ধু বলেন, ‘কোনোদিন তাকে আমি কোনো মেয়ের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে দেখিনি। কোনো মেয়ের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কটাক্ষ করতেও দেখিনি। সে এগুলো প্রচণ্ড ঘৃণা করত। নারীর প্রতি এত মর্যাদা দিতে আর কোনো মানুষকে আমি দেখিনি। নারী শিক্ষার জন্য তাঁর আগ্রহ নারীর প্রতি মর্যাদা ও তাদেরকে আর্থসামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহের প্রমাণ বহন করে। সে এখন নারীশিক্ষার জন্য অনেক স্কুল কলেজ ও কর্মমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে।’২২
অর্পিত দায়িত্ব পালনে তিনি এত সচেতন এবং এত নিষ্ঠাবান যে, কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর সকল পথ অবারিত হয়ে যায়। তিনি যা বলেন মেপে, যা করেন ভেবে। প্রত্যেকটি কাজ নিবিড় পর্যক্ষেণ ও বুদ্ধিমত্তার সাথে সম্পন্ন করেন। তিনি বিনয়ী, ভদ্র ও মার্জিত। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হয় কোমল; প্রকৃতপক্ষে আপোষহীন চেতনায় অনড় একটি ভীষণ হিমালয়, যদি সত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যত্যয় ঘটে। তাঁর জীবনের অনেক ঘটনা এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।২৩ বাংলাদেশে তাঁর চেয়ে অনেক ধনী ব্যবসায়ী, অনেক বড় রাজনীতিবিদ আছেন; কিন্তু কে কয়টা সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মতো আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন!
সৈয়দ আবুল হোসেনের সমাজ চিন্তার মতো পরিবার চিন্তাও অত্যন্ত উদার এবং নিবিড়। তিনি মনে করেন, ঞযব ভধসরষু রং ঃযব হঁপষবঁং ড়ভ পরারষরুধঃরড়হ. রাজনীতিক ও সামাজিক জীবনের মতো পারিবারিক জীবনেও তিনি সফল। তিনি একজন আদর্শ স্বামী, স্নেহশীল পিতা। সৈয়দ আবুল হোসেন পিতা-মাতাকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি আত্মীয়স্বজনদের পর্যাপ্ত সময় দেন। ধনী-গরিব সব প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবর রাখেন। দাম্পত্য জীবনে তিনি একজন সুখী মানুষ। সকালে ওঠেন, দশটার মধ্যে শুয়ে পড়েন। তিনি জানেন, ঊধৎষু ৎরংরহম রং ধষংড় বংংবহঃরধষ ঃড় ঃযব মড়ড়ফ মড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ধ ভধসরষু. অ ষধঃব নৎবধশভধংঃ ফবৎধহমবং ঃযব যিড়ষব নঁংরহবংং ড়ভ ঃযব ফধু, ধহফ ঃযৎড়ংি ধ ঢ়ড়ৎঃরড়হ ড়ভ রঃ ড়হ ঃযব হবীঃ, যিরপয ড়ঢ়বহং ঃযব ফড়ড়ৎ ভড়ৎ পড়হভঁংরড়হ ঃড় বহঃবৎ.
সৈয়দ আবুল হোসেন ঠাণ্ডা মেজাজের লোক। কষ্ট বা রাগে হয়ত বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়, তবু মাথা ঠাণ্ডা রাখেন। কোনো অবস্থাতে মাথা গরম করেন না। ফলে কথাবার্তা কখনও শালীনতার পর্যায়কে অতিক্রম করতে পারে না। তাই যে কোনো বিপদে তিনি অস্থির নাÑহয়ে চিন্তা ভাবনা করে অগ্রসর হতে পারেন। তাহলে কি তিনি রাগেন না? হ্যাঁ, রাগেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর জবাব কতই না বিচক্ষণ- ও ধস ধহমৎু হবধৎষু বাবৎু ফধু ড়ভ সু ষরভব, নঁঃ ও যধাব ষবধৎহবফ হড়ঃ ঃড় ংযড়ি রঃ; ধহফ ও ংঃরষষ ঃৎু ঃড় যড়ঢ়ব হড়ঃ ঃড় ভববষ রঃ, ঃযড়ঁময রঃ সধু ঃধশব সব ধহড়ঃযবৎ ভড়ৎঃু ুবধৎং ঃড় ফড় রঃ.
তিনি আপাদমস্তক কুশলী ও বিচক্ষণতায় মোড়া। এমনভাবে বলেন, যাতে কেউ কষ্ট না-পায়, এমনভাবে দেখেন যাতে কারও মনে দুঃখ বা ভীতির সঞ্চার না হয়; বরং আনন্দ জাগে। কারও সমালোচনা করার সময়ও শালীনতাবোধ বজায় রাখেন। তিনি তর্কে যৌক্তিক, চেতনায় উদার। কথা বলার সময় কোটেশনের পর কোটেশন দিতে পারেন। কথার মাঝে কিছু রস থাকে। যা কথাগুলোকে উপভোগ্য এবং হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। তবে ব্যক্তিত্বের হানি হয় না। তিনি বধংু রহ সধহহবৎ নঁঃ হড়ঃ পযবধঢ়. রাগ সম্পর্কে তাঁর একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সেটি হল-মোহাম্মদ আমীন

অহুনড়ফু পধহ নবপড়সব ধহমৎু, ঃযধঃ রং বধংু; নঁঃ ঃড় নব ধহমৎু রিঃয ঃযব ৎরমযঃ ঢ়বৎংড়হ, ধহফ ঃড় ঃযব ৎরমযঃ ফবমৎবব, ধহফ ধঃ ঃযব ৎরমযঃ ঃরসব, ধহফ ভড়ৎ ঃযব ৎরমযঃ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব, ধহফ রহ ঃযব ৎরমযঃ ধিু, ঃযধঃ রং হড়ঃ রিঃযরহ বাবৎুনড়ফু’ং ঢ়ড়বিৎ ঃযধঃ রং হড়ঃ বধংু. এতগুলো প্রত্যয়কে সমন্বয় করে রাগ করা পৃথিবীর খুব কম মানুষের পক্ষে সম্ভব। তাঁর চাইতে নিজের রাগকে গোপন রাখাই সর্বোত্তম।
শুধু রাজনীতিক জীবনে নন, সংগঠক হিসেবেও তিনি অনন্য। যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানে সোনা ফলেছে। সৈয়দ আবুল হোসেন চিন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশসহ এশিয়ার চব্বিশটি দেশ নিয়ে গঠিত অর্থনীতিক সহযোগিতা ফোরাম ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি এ ফোরামের স্পোকসম্যান নির্বাচিত হন। ঢাকা বাণিজ্য ও শিল্প অনুষদ এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-এর উন্নয়ন ও বিকাশে সৈয়দ আবুল হোসেনের অবদান অনস্বীকার্য। ন্যাশনাল ম্যানেজম্যান্ট এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা বিভাগ এলামনি এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন তিনি স্থানীর সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের সংসদ নির্বাচনে মাদারীপুর-৩ সংসদীয় এলাকা হতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আর তাঁকে হারানো কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন, ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর এবং ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও তিনি তাঁর সংসদীয় এলাকা মাদারীপুর-৩ আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি এসেছেন, দেখেছেন এবং জয় করেছেন। তাঁর গুণে জনগণ এতই মুগ্ধ যে, সাধারণ জনগণ প্রত্যেকে নিজেকে সৈয়দ আবুল হোসেনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেন। তিনি তার কর্ম দিয়ে জনগণের সাথে এমন এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপন করেছেন, যা ছিন্ন করার সাধ্য কারও নেই।
কালকিনির সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, খোয়াজপুরের সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ, ডাসারের শেখ হাসিনা উইমেন্স একাডেমি এন্ড কলেজ, ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এন্ড কলেজে শিক্ষাক্ষেত্রে অহঙ্কারের নৈবদ্যিক সংযোজন। তাঁর বৃত্তিতে প্রতি বছর হাজার হাজার ছাত্র লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল হোসেন সাধারণ পারিপার্শ্বিকতায় বেড়ে ওঠা অসাধারণ একজন মানুষ। যার শেকড় পাতালে, মস্তক কল্পনার আকাশ ছুঁয়ে স্তম্ভিত অপলক।
কেন তিনি শিক্ষাবিস্তারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় এত ব্যাকুল? অনেকে নামের জন্য, প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠান করেন। তবে সৈয়দ আবুল হোসেনের মানসিকতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেন তিনি শিক্ষার প্রসারে এত উদগ্রীব তা তাঁর জবানিতেই শোনা যাক :
টলস্টয় বলেছেন- ‘বিদ্যালয়ই উন্নতির মাধ্যম। বিদ্যালয়ই মানুষকে সভ্য করে তোলে।’ এলজিা বফ চমৎকার কথা বলেছেন। তার মতে, ‘বয়স্কদের জন্য কারাগার অথবা ফাঁসিমঞ্চ নির্মাণ করার প্রয়োজন কমে যাবে যদি উত্তম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায়।’ আমি মনে করি এর চেয়ে সত্য কথন আর হয় না। বিদ্যালয়ে জ্ঞান অর্জন করলে চরিত্র গঠিত হয়। ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য বোঝা যায়। অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পায়। তাহলে আর কারাগার বা ফাঁসির মঞ্চের প্রয়োজন রইল কোথায়? সুতরাং আমি মনে করি কারগার নির্মাণে মনোযোগ দেয়ার চেয়ে অধিক হারে বিদ্যালয় নির্মাণে, শিক্ষার প্রসারে মনোযোগ দেয়া দরকার। সে কারণেই আর একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছেন, ‘স্কুল তৈরির মতো মহৎ ও কল্যাণকর কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই’। এই চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি আমার সাধ্যমতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় আত্মনিয়োগ করেছি। আমি মনে করি, এটা আমার সামাজিক অঙ্গীকার। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি আমার কর্তব্য। আমি সিক্ত আমার এলাকার মানুষের ভালোবাসায়। তাদের কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। সেটা আমি শোধ করতে পারি শিক্ষার আলো জ্বেলে বা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ব্যক্তিকে সাহায্যদানের আবেদন সব সময়ই সাময়িক। প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আবেদন কালজয়ী।’
তাহলে গ্রামে কেন? তিনি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রামকে কেন বেছে নিয়েছেন? এর উত্তরও তাঁর জবানিতে শুনতে পারি :
গ্রামই আমাদের আসল ঠিকানা। অথচ এই গ্রাম আজ অবহেলিত। শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। কিন্তু গ্রামের লোকের লেখাপড়ার প্রতি কারও তেমন মনোযোগ নেই। গ্রামের জনগোষ্ঠীর শিক্ষার বিপুল চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যেই আমার প্রয়াস।
আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষক ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ মো. তমিজ উদ্দিন বলেছেন, “অনেক কর্মপ্রাণ লোক আমি দেখিয়াছি। তাহারা কাজ করিতে করিতে রুক্ষ হইয়া যায়। কাজ করিতে করিতে নিজেরাই যন্ত্র হইয়া যায়। সৈয়দ আবুল হোসেন তেমন ছিল না। সে কাজ করিতে করিতে আরও প্রফল্ল হইয়া উঠিত। কাজ ছিল তাহার প্রাণ তবে সে প্রাণে ছিল স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, হাসি-কান্না, রস, কৌতুক, বিশ্রাম এবং সুকুমার চিত্ত। ছোট বেলা হইতে দেখিয়াছি জীবন তাহার কাছে কাজের সমষ্টি ছাড়া কিছু নয়। কর্মহীন জীবন তাহার কাম্য নয়। তাই সে কাজকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়া থাকে। কাজের সাথে আর একটি জিনিসকে সে অবিচ্ছেদ্য রাখে, সেইটি হইল নিষ্ঠা। কর্ম আর নিষ্ঠার মিশ্রণ ঘটাইয়া সে এমন এক শরবত তৈয়ার করিয়াছে, যাহা কেহ পান করিলে পরশপাথর হইয়া যায়। ঐ পরশপাথর যাহারা ধরে, তাহারা আপন মহিমায় হইয়া ওঠে সাফল্যের বর, সাধনার নির্ঘণ্ট।”
সৈয়দ আবুল হোসেন শুধু রাজনীতিক নন, লিডারও বটে। তথাকথিত নেতা নন, নেতার সকল প্রায়োগিক ও তাত্ত্বিক উপাদানে পরিপূর্ণভাবে বিদুষিত একজন মহান নেতা। প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা আলহাজ্ব উপাধ্যক্ষ মুহাঃ জালাল উদ্দিনের ভাষায়, একজন নেতার যে সকল গুণাবলী থাকা প্রয়োজন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নেতার যে সকল গুণাবলীকে অনিবার্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে তার সবটাই সৈয়দ আবুল হোসেনে বিদ্যমান। তিনি কৃতজ্ঞতায় আকাশ। যাদের ভালোবাসায় সিক্ত তাদের জন্য রিক্ত হতে প্রস্তুত। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তাঁর অনাবিল চরিত্রের নিখাদ অলঙ্কার। তিনি মনে করেন, এৎধঃরঃঁফব রং ৎরপযবং. ঈড়সঢ়ষধরহঃ রং ঢ়ড়াবৎঃু. কারও প্রতি অভিযোগ নয়, বরং কারও প্রতি বিরক্ত হলে তিনি কৃতজ্ঞতায় সিক্ত হয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন।২৪
বন্ধু হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অবলোকন করলে সে বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে যায়- ফ্রেন্ড ইজ বরন, নট মেইড। সৃষ্টিকর্তা তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে সেরা জীবন উপভোগের জন্য যে সকল ঐশ্বর্র্য দিয়েছেন তন্মধ্যে বন্ধুই সর্বশ্রেষ্ঠ- সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে বন্ধুত্ব হলে এটিই সবার মনে হবে।২৫ এ মুহূর্তে এডগার ওয়াটসন হো এর একটি কথা আমার মনে পড়ছে: ডযবহ ধ ভৎরবহফ রং রহ ঃৎড়ঁনষব, ফড়হ’ঃ ধহহড়ু যরস নু ধংশরহম রভ ঃযবৎব রং ধহুঃযরহম ুড়ঁ পধহ ফড়. ঞযরহশ ঁঢ় ংড়সবঃযরহম ধঢ়ঢ়ৎড়ঢ়ৎরধঃব ধহফ ফড় রঃ. এ রকম দেখেছি আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে। সাধারণত কেউ বিপদে পড়লে শুভাকাক্সক্ষীরা এগিয়ে এসে প্রয়োজনের কথা জানতে চান; জানতে চান কী প্রয়োজন, কতটুক প্রয়োজন। সৈয়দ আবুল হোসেনকে আমি এমন সাধারণ শুভার্থীর মতো আচরণ করতে কখনও দেখিনি। কেউ বিপদে পড়লে তিনি এসে যা প্রয়োজন তা করে দিয়ে যান স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো প্রশ্ন নাÑকরে। এটি বন্ধু ছাড়া আর কেউ করতে পারে না।
সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো বিশাল এক ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ অবয়ব রচনা দূরে থাক, তার কর্মকাণ্ডের একটি মুহূর্তের প্রকাশও স্বল্প সময়ে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। একদিন আমার একটা কথার জবাব দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ঈড়ৎৎবপঃরড়হ ফড়বং সঁপয, নঁঃ বহপড়ঁৎধমবসবহঃ ফড়বং সড়ৎব. এরপর আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করি তা পালনের। পারি না। দূর হতে দেখতে দেখতে কোন্ সময় কখন কিভাবে নিবিড় হৃদ্যতায় একাত্ম হয়ে গেছি, হারিয়ে গেছি জানি না। অতঃপর বুঝতে পারলাম : অমন পরিশুদ্ধ বিশালতায় হারিয়ে যাবার কষ্ট কত আনন্দের। তার প্রত্যয়ী পরিভাষার কোমল লাস্যে প্রেমের সাথে মধুময় জীবনের প্রত্যাশা বৃষ্টির মতো শ্যামল করেছে আমাদের চেতনা ও রাজনীতির জটিল ক্ষেত্র। রাজনীতিক সন্ত্রাস, সংকীর্ণ স্বার্থ, হানাহানি, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সৈয়দ আবুল হোসেনের অবস্থান বাংলাদেশের রাজনীতিকে বহুলাংশে পরিশীলিত করতে সক্ষম হয়েছে। অন্তত তাঁর সংসদীয় এলাকার রাজনীতিকে সম্পূর্ণ কুষমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর এলাকায় সকল দল, সকল মত, সকল ধর্ম অভিন্ন হৃদ্যে একাকার। তিনি ব্যবহারে বিনয়ী, কর্মে নিষ্ঠ, সিদ্ধান্তে বলিষ্ঠ, আচরণে শিষ্ট, বিচক্ষণতায় ঋদ্ধ, ব্যবস্থাপনায় মার্জিত এবং কৃতজ্ঞতায় অনুপম। পৃথিবীতে এমন কিছু ব্যক্তিত্বের শুভাগমন ঘটে যারা সূর্যের সাথে হাসে, বৃষ্টির সাথে কাঁদে, ঝর্ণার সাথে গান গায় প্রতি প্রহরে, খেলায় জীবনের চৈতালী সাজাতে চায়। সৈয়দ আবুল হোসেন এমন চরিত্রের অধিকারী একজন বিরল মানুষ।
মানবতাবাদী সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাকোর কর্মকর্তা-কর্মচারীগণকে নিজের পরিবারের সদস্যের মতো মূল্যায়ন করে থাকেন। তিনি তাদের সুখ-দুঃখ ও হাসি-বেদনার সার্বক্ষণিক সাথী। কর্মচারীদের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা রূপকথার গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর। যে ব্যক্তি সাকো ইন্টারন্যাশনালে বিশ বছর চাকুরি করেন তাকে তিনি উপযুক্ত মানের একটি ফ্লাটবাড়ি কিনে দেন। এটি কেন করেন এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন: যে ব্যক্তি জীবনের বিশটি বছর আমার সাথে কাটিয়ে দেন, তাঁর আর নিজের জন্য কিছু থাকে না। সরকারি কর্মচারীরা পেনশন পান, বেসরকারি কর্মচারীরা কিছু পান না। চাকুরি জীবনের শেষে একটা ফ্লাট পাচ্ছেন এ নিশ্চয়তা তাদের কর্মস্পৃহা ও প্রতিভাকে বিকশিত করবে, পারিবারিক জীবন হবে আনন্দময়, সংগতকারণে তারা নিশ্চিত মনে প্রতিষ্ঠানের সেবা করে যাবার উদ্দীপনায় আনন্দঘন পরিবেশে কাজ করার মানসিকতা পাবে। একজন মানুষ কত দূরদর্শী এবং কত মানবপ্রেমী হলে এমন করতে পারেন, তা সহজে অনুমেয়।
ভিনস্ লেম্বর্ডির একটা কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছেন- ঞযব সধহ ড়হ ঃড়ঢ় ড়ভ ঃযব সড়ঁহঃধরহ ফরফহড়ঃ ভধষষ ঃযবৎব. পাহাড়ের চূড়োয় কেউ পতিত হয় না। পাহাড়ের চূড়োয় উঠতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন শ্রম, মেধা আর প্রয়াস। সৈয়দ আবুল হোসেন খ্যাতির চূড়োয়। তিনি ওখানে পতিত হননি। তলা হতে আস্তে আস্তে চূড়োয় উঠেছেন। এ আরোহণে তিনি কারও সাহায্যের অপেক্ষায় থাকেননি। নিষ্ঠা, শ্রম, মেধা আর একাগ্রতার মাধ্যমে জয় করেছেন শৃঙ্গ।
বাংলা সাহিত্যের দিকপাল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন খুবই শ্রদ্ধেয় এবং একজন বিরাট মাপের মানুষ।’ তিনি সময়, মানুষ, রাজনীতি, পারিপার্শ্বিক বলয়, আর্থসামাজিক অনুরণন ও স্বীয় জীবনকে পরিশীলিত মাধুর্যে সমন্বয় করে আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রকে অমিয় মহিমায় উদ্ভাসিত করতে সক্ষম একজন পরিপূর্ণ মানুষ।২৬ সময়কে তিনি আধুনিকতার সাথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাই তিনি সময়ের পরশপাথর।

মোহাম্মদ আমীন : লেখক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও ইতিহাসবেত্তা।

১. অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন, সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষক।
২. অধ্যক্ষ তজিম উদ্দিন, সৈয়দ আবুল হোসেনের শিক্ষক, গৌরনদী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
৩. ড. এম এ মান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক, সৈয়দ আবুল হোসেনের বন্ধু।
৪. মো. মফিজুল হক: ডাসার ইউনিয়নের মেম্বার। সৈয়দ আবুল হোসেনের বাল্যবন্ধু।
৫. ওসমান গণি, প্রকাশক, গবেষক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
৬. মো. মফিজুল হক: ডাসার ইউনিয়নের মেম্বার। সৈয়দ আবুল হোসেনের বাল্যবন্ধু।
৭. ঐ
৮. সতত বিভাময়, মোহাম্মদ মোস্তফা: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম-সচিব।
৯. ঐ
১০. তরুণ তপন দেওয়ান, প্রাক্তন প্রধান প্রাকৗশলী, সওজ; কনসালটেন্ট এডিবি।
১১. আলহাজ্ব উপাধ্যক্ষ মুহাঃ জালাল উদ্দিন, ইতিহাসবেত্তা ও গবেষক।
১২. কমান্ডার এস্কান্দর শিকদার, যুদ্ধকালীন কমান্ডার ও কমান্ডার কালকিনি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল।
১৩. উইটিসি সেন্টারের সাকো অফিসে কথা প্রসঙ্গে, তারিখ- ৩১/৭/২০১০ খ্রিস্টাব্দ।
১৪. আবুল হাসান চৌধুরী।
১৫. অজিত কুমার সরকার, সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক।
১৬. মোস্তফা মোহাম্মদ ফারুক, হাসনাত আবদুল হাই, মো. মোজাম্মেল হক খান (সচিব), ড. কবির।
১৭. এ নেতা আওয়ামী লীগ করেন না, তবে সৈয়দ আবুল হোসেন যথারীতি তাঁর কাছেও গ্রহণযোগ্য।
১৮. মন্ত্রী মহোদয়ের অফিস কক্ষে অফিসারদের সাথে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে।
১৯. অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মো. তমিজ উদ্দিন: সৈয়দ আবুল হোসেনের কলেজ জীবনের শিক্ষক, ছয়টি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, ইতিহাসবেত্তা, শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসেবে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত, লেখক ও গবেষক
২০. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ১১৬।
২১. মাদারীপুরের কালকিনি থানার শশীকরে অনুষ্ঠিত হিন্দু সম্প্রদায়ের কীর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতা, ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৯৫ (গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন গ্রন্থের ১১৮-১১৯ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।
২২. মো. মফিজুল হক: ডাসার ইউনিয়নের মেম্বার। সৈয়দ আবুল হোসেনের বাল্যবন্ধু।
২৩. এ প্রসঙ্গে জানতে হলে পাঠক এ গ্রন্থের তেজময় অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
২৪. নেতার মতো নেতা, আলহাজ্ব উপাধ্যক্ষ মুহাঃ জালাল উদ্দিন: ডাঃ আফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ, ইতিহাসবেত্তা, সাহিত্যিক ও গবেষক।
২৫. বন্ধু আমার উদার নিদাঘ আকাশ, আবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
২৬. অধ্যক্ষ তমিজ উদ্দিন, ইতিহাসবেত্তা ও কলামিস্ট।

সৈয়দ আবুল হোসেনের বাণী
এস এম আবীর চৌধুরী মীম
আমার বাবার লাইব্রেরিতে সৈয়দ আবুল হোসেনের লেখা অনেক গ্রন্থ, পেপার কাটিং ও শুভেচ্ছা বাণী রয়েছে। নিম্নের বাণীগুলো আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেন রচিত গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট, স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রভৃতি গ্রন্থ এবং তার বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত ভাষণ, পেপার কাটিং, শুভেচ্ছা বাণী ও অন্যান্য লেখা হতে সংগ্রহ করা হয়েছে।
সমাজ, সভ্যতা ও প্রগতির নিয়ামক হচ্ছে রাজনীতি। মহত্তর ও উন্নততর জীবনের সন্ধানেই মানুষ রাজনীতি করে থাকে। রাজনীতির পেছনে থাকে সুনির্দিষ্ট আদর্শ। যদি তা না হতো, তাহলে মানুষ রাজনীতি করতে গিয়ে জেল-জুলুম সহ্য করত না, বুলেট বেয়নটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারত না।১

্ গণতন্ত্র মানে জনগণের অংশীদারিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা।২

্ গণতন্ত্রের জন্য মানুষ দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করে আসছে। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে চলেছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত সে গণতন্ত্র আজও অ-ধরা রয়ে গেছে। জনগণের বিজয় বারবার ছিনতাই হয়ে যায়। যেমন হয়েছে পঁচাত্তরে।৩

্ গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন সমার্থক এবং পরস্পর গভীরভাবে সম্পৃক্ত। একে অপরের নির্ভর করে এদের সাফল্য।

্ বাংলাদেশের সমস্যা গুড গভর্নেন্স, সুষ্ঠ ও সৎ শাসন ব্যবস্থা নাÑ থাকা।
্ ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মৌলবাদ, কুসংস্কার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধী কার্যকলাপ, দলীয়করণ, যুক্তিহীন সমালোচনা ইত্যাদি কারণে সুশাসন বিকাশ হতে পারছে না।
একটি সৎ ও সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারই কেবল এ সব সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সুশাসনের অন্যতম পূর্বশর্ত। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সুশিক্ষিত ও প্রজ্ঞাময় মানুষ এবং দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন।

্ শিক্ষকতা একটি মামুলি পেশা নয়। শিক্ষকতা একটি ব্যতিক্রমধর্মী সম্মানিত পেশা। 
শিক্ষকতাকে অভিহিত করা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্রত ও মহানতম আদর্শ পেশা হিসেবে। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (দঃ) বলতেন, তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মানব জাতির শিক্ষক। গ্রিক দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ প্লেটো শিক্ষাকে তুলনা করেছিলেন অন্ধকার গুহার মধ্যে অজ্ঞতার শিকলবদ্ধ মানুষের কাছে আলোক রশ্মির আকস্মিক বিকিরণের সাথে। সে অর্থে শিক্ষা হচ্ছে তিমির অভিসারী ও আলো বিতরণকারী। শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার রূপকার। মহাবীর আলেকজান্ডার বলেছিলেন, আমার জীবনের জন্যে, আমার জন্মের জন্যে আমি আমার পিতা-মাতার কাছে ঋণী। কিন্তু আমার বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের জন্যে, কৃতিত্ব, বীরত্ব ও গৌরবের জন্য ঋণী হচ্ছি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এরিস্টটলের কাছে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হয়ে সন্তুষ্ট থাকেননি। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তিনি নিজেকে একজন নিবেদিত প্রাণ আদর্শ শিক্ষকে রূপান্তরিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। আধুনিক চিনের প্রতিষ্ঠাতা মাওসেতুং প্রায় সময় বলতেন, তিনি একজন শিক্ষকমাত্র। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক হোয়াইটহেড বলেছিলেন, ঘড় ংুংঃবস ড়ভ বফঁপধঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ ধ ঃবধপযবৎ. অর্থাৎ কোনো শিক্ষা ব্যবস্থাই শিক্ষকের চেয়ে উন্নত নয়। শিক্ষকই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণ। শিক্ষা প্রক্রিয়ার অন্তঃস্থলে শিক্ষকদের অবস্থান। দার্শনিক বার্টাণ্ড রাসেলের কথায়- শিক্ষক সমাজ হচ্ছে প্রকৃতই সমাজ ও সভ্যতার বিবেক। এজন্য শিক্ষকদের বলা হয় সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ার বা সমাজ নির্মাণের স্থপতি।৪

্ ‘দেশের প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবন ও দেয়াল যেন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থক ছাত্র সংগঠনসমূহের রাজনৈতিক বিপণনের বিজ্ঞাপন বা বিলবোর্ডে রূপান্তরিত হয়েছে।৫
্ ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ। আগামী দিনের নেতৃত্ব আসবে তাদের কাছ থেকেই। ছাত্রদের ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক কোন্দল, হানাহানি ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দিলে শিক্ষাব্যবস্থা যেমন হবে বিপর্যস্ত, তেমনি বিকশিত হতে পারবে না জাতির আগামী দিনের সম্ভাবনাময় তরুণ মেধা ও প্রতিভা।৬

্ শিল্পায়ন ছাড়া জনগণের জীবনধারণের মান উন্নয়ন করা যায় না। শিল্পায়ন ছাড়া বেকার সমস্যার কার্যকর ও ফলপ্রসূ সমাধান সম্ভব নয়। এক কথায় শিল্পায়নই হচ্ছে সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির সোপান। কৃষির মাধ্যমে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ ভূমির একটি সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এ কারণেই আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই।৭

্ একজন নেতা বা নেত্রীকে কথায় ও কাজে কেবল পারফেক্ট হলেই চলবে না, তাকে অনুকরণীয় গুণাবলীর অধিকারীও হতে হবে। তার কাছ থেকে মানুষ প্রেরণা পাবে। তিনি হবেন আদর্শ স্থানীয়। মানুষ তাকে অনুসরণ করবে। তাকে দেখে শিখবে, উজ্জীবিত হবে। সে জন্যে একজন নেতা বা নেত্রীকে মেপে মেপে কথা বলতে হয়। তিনি যা বলছেন তার তাৎপর্য, মর্ম এবং জনগণের মনে তা কি সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সে সম্পর্কে তার সঠিক ধারণা থাকতে হবে। কারণ রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তার প্রতিটি কথারই গুরুত্ব রয়েছে। তাই দৃষ্টি নন্দনের চেয়ে তাকে হতে হবে বেশি মাত্রায় উক্তি নন্দন। তাকে সবসময় স্মরণ রাখতে হবে তার অসংলগ্ন বা বল্গাহীন উক্তি তার ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে পারে।৮

্ চূড়ান্ত বিশ্লেষণে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলেই একই স্রষ্টার সৃষ্টি। মানবতার চেয়ে বড় ধর্ম আর নেই। আমি সে মানবতায় বিশ্বাসী। চিন্তা ও চেতনায়, কাজে ও কর্মে একজন মানবতাবাদী ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে আমার অবস্থান। সেভাবেই আমি শিক্ষা পেয়েছি। সেভাবেই জীবন গড়েছি। মনুষ্যত্বের পরিচয়েই আমি মানুষকে বিচার করে থাকি। আমার কাছে সবসময় মানুষই বড়। আমার ব্যবহারিক জীবনেও এ আদর্শই আমি সবসময়েই অনুসরণ করে আসছি।৯

্ একাত্তরের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণতন্ত্রসম্মত অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ে তোলা। যেখানে সকল ধর্মের, সকল সম্প্রদায়ের লোকজন সুখ ও শান্তিতে বসবাস করবে। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আদর্শ।
্ বাংলাদেশের শতাধিক রাজনীতিক দল তথাকথিত ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে রাজনীতিতে সক্রিয়। তথ্যগতভাবে তাদের সবার উদ্দেশ্য ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম মর্মে প্রকাশ করা হলেও একদল অন্যদলকে সহ্য করতে পারে না, মুরতাদ ডাকে; কখনও কখনও আরও বেশি কিছু। কিন্তু ইসলাম অভিন্ন একটি ধর্ম, ইসলামি শাসনতন্ত্র ও অভিন্ন একটি প্রত্যয়। তাহলে শতাধিক রাজনীতিক দল কেন? কারণ, তাদের উদ্দেশ্য ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, ইসলামে বিভেদ সৃষ্টি করে ইসলামের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করা, ফেতনা সৃষ্টির মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা।

্ একটি অসাম্প্রদায়িক খাঁটি বাঙালি পরিবেশে আমি মানুষ হয়েছি এবং সেই শিক্ষাই ধারণ করে চলেছি। সেই শিক্ষাই ধারণ করে চলব আমৃত্যু। সেই শিক্ষাই আমাকে প্রণোদিত করেছিল, উদ্বুদ্ধ করেছিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে।১০

্ হাজার বছর ধরে বাংলার হিন্দু মুসলমান পরস্পর পাশাপাশি ভাইয়ের মতো বসবাস করছে। মসজিদের আযান আর মন্দিরের শঙ্খধ্বনি কিংবা ঈদ আর পূজোয় স্ব স্ব সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের মধ্যে দিয়ে উদযাপন করছে। সেভাবেই তা তাদের মনে রেখাপাত করেছে। বাংলার স্বাধীনতার জন্য নবাব সিরাজউদদৌলার সাথে সাথে তার সেনাপতি মোহনলাল ও মীরমদন অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।

্ আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, “সমগ্র মানবমণ্ডলী এক জাতি”১১ তাহলে কেন রাষ্ট্রের অজুহাতে, সরকারের নামে, রাজনীতির আড়ালে একদল অন্যদলকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখে শোষণ করবে?

নবীনবরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ, জানুয়ারি, ১৯৯৩
নিম্নলিখিত বাণীগুলো সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর নির্বাচনী এলাকা কালকিনির ছাত্রছাত্রী আয়োজিত নবীনবরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ হতে গৃহীত। এ ভাষণটি তার রচিত গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন গ্রন্থে তারুণ্য ও শিক্ষা নামক প্রবন্ধ হিসেবে চয়ন করা হয়েছে।

্ ফসলের জন্য যেমন জমি কর্ষণ করতে হয়, বীজ রোপণ করতে হয়, পরিচর্যা করতে হয়, তেমনি নেতৃত্বের যোগ্যতাও অর্জন করতে হয়। নেতৃত্ব আপনাআপনি আসে না। আকাশ থেকে পড়ে না। মাটি ফুঁড়ে গজায় না। তার জন্যে পরিশ্রম করতে হয়। সাধনা করতে হয়। অধ্যবসায়ী হতে হয়। ইসলামের মহান দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) যথার্থই বলেছেন, নেতা ও দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য বিদ্যার্জন অপরিহার্য।১২
্ পবিত্র ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ। এ অর্থে কোনো খাঁটি মুসলমান কখনও নিরক্ষর বা অশিক্ষিত থাকতে পারে না।

্ শিক্ষার বিকল্প নেই, জ্ঞানের চেয়ে বড় পুঁজি আর নেই।

্ আমি সিক্ত আমার এলাকার মানুষের ভালোবাসায়। তাদের কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। সেটা আমি শোধ করতে পারি শিক্ষার আলো জ্বেলে বা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ব্যক্তিকে সাহায্যদানের আবেদন সাময়িক। প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আবেদন কালজয়ী।

্ নতুনের প্রতি মানুষের আকাক্সক্ষা ও আগ্রহ চিরন্তন। সে কারণেই বলা হয় মানুষ নতুনের পূজারী। সে পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়নি। পুরাতন হচ্ছে জীর্ণতা ও স্থবিরতার প্রতীক। আর নতুন হচ্ছে স্বপ্নময়, কর্মময় ও উদ্দীপনাময়। যেমন মানুষের জীবনে তেমনি প্রকৃতির মধ্যেও আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই।১৩

্ গ্রামই আমাদের আসল ঠিকানা। অথচ এই গ্রাম আজ অবহেলিত। শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। কিন্তু গ্রামের লোকের লেখাপড়ার প্রতি কারও তেমন মনোযোগ নেই। গ্রামের জনগোষ্ঠীর শিক্ষার বিপুল চাহিদা মেটানের লক্ষ্যেই আমার এ প্রয়াস।

্ সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ডামাডোলে পড়ে সংঘাত সন্ত্রাসে জড়িয়ে জীবন বরবাদ করে দিলে নাÑ হবে দেশের উপকার নাÑ হবে নিজের উপকার।

্ আমার আরাধ্য পুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছাত্রছাত্রীদের খুবই আদর করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট ছাত্র সমাজের প্রতি লক্ষ করে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন- বাবারা, একটু লেখাপড়া শেখ। যতই জিন্দাবাদ আর মুর্দাবাদ কর, ঠিকমতো লেখাপড়া না শিখলে কোনো লাভ নেই।

্ শিক্ষা নাÑথাকলে জাতির অস্তিত্বই অর্থহীন হয়ে পড়ে।১৪
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট গ্রন্থ হতে
সৈয়দ আবুল হোসেনের নিম্নবর্ণিত বাণী তার লেখা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট গ্রন্থ হতে গৃহীত। এ লেখাগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রকাশকাল ঃ ফেব্রচ্ছারি, ১৯৯৬ এবং প্রকাশক আব্দুল কাদের।

্ জনগণের স্বাধীন ইচ্ছা অভিরুচি অনুযায়ী জীবন ধারণকে গণতন্ত্র বলে।

্ গণতন্ত্র সবসময়ই বাংলাদেশের মানুষের কাছে অধরা রয়ে গেছে।

্ যেখানে ভোটের স্বাধীনতা নেই, সেখানে ভাতের স্বাধীনতা থাকতে পারে না।

্ সমস্যার কথা অনেকে বলে থাকেন কিন্তু সমাধানের রূপরেখা দানের ব্যাপারে অনেকে পক্ষপাতিত্ব করে থাকেন।

্ জাতির অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হচ্ছে আত্মশক্তি।

্ ওড়ার জন্য দু’টি ডানার উপর ভর করতে হয়। এক ডানায় ওড়া যায় না।

্ কৃষ্টি কখনও আপনাআপনি গড়ে ওঠে না। এটা সযতেœ চর্চার বিষয়।

্ সহাবস্থান ও সহনশীলতাই গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু।

্ অন্যের দোষত্র“টি অযথা বড় করে নাÑ দেখে ভালো দিকগুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে।

্ ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, আরবি মাধ্যমÑ এ ধরনের মাধ্যমের ছড়াছড়ি কোনো উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে নাই। তিন ধরনের ভাষার ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি করছে। যার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া পড়ছে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে।

্ ক্ষমতায় যাবার আগে যাদের অনেকের সংসার চলতো কষ্টে সৃষ্টে, অন্যের কাছ থেকে চাঁদা তুলে, ক্ষমতায় যাওয়ার সাথে সাথে রাতারাতি তাদের অবস্থা হয় আঙুল ফুলে কলাগাছের মতো।
্ আমরা যদি উন্নয়ন চাই, অগ্রগতি চাই দারিদ্র্যের বৃত্ত ভাঙতে চাই, তাহলে আমাদের সৎ, দক্ষ, মেধাবী ও সুশিক্ষিত নেতৃত্ব বেছে নিতে হবে, যারা বুঝতে পারবে দেশের আসল সমস্যা কী, কীভাবে হবে তার সমাধান, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কী চায়, কীভাবে তাদের সক্রিয় সমর্থন ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যায়।

্ নবান্ন বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীনতম ঐতিহ্য। এটি ধর্ম নিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমতার লালিত্য প্রেরণায় আকীর্ণ চেতনার মধুময় নির্যাস। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ত্রয়ী প্রেরণার সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও বাঙালি জাতিকে নবজীবন দান করেছেন।১৫

্ আমাদের লক্ষ্য স্থির, তবে অসীম ও দুর্বার। প্রাপ্তির লক্ষ্যে আমাদের প্রত্যাশা মহাপ্রাপ্তির প্রেরণায় উজ্জীবিত। ক্লান্তিহীন চেষ্টা ও সময়ানুবর্তিতার মাধ্যমে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।১৬

্ যোগাযোগের রথ বেয়ে আদিম মানুষ সভ্যতার জগতে উৎসারিত হয়েছে।১৭

্ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের আধুনিক, সুষম ও নিবিড় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোক্তা। নবযুগের স্বপ্নদ্রষ্টা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনকের এ উদ্যোগে পরিপূর্ণ প্রাণ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর।১৮
এস এম আবীর চৌধুরী মীম: জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশু শিল্পী। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ লেখক হিসেবে খ্যাত। একাধিক বই প্রকাশিত।

১. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ২৯।
২. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রকাশকাল ফেব্রচ্ছারি, ১৯৯৬।
৩. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রকাশকাল ফেব্রচ্ছারি, ১৯৯৬।
৪. শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থা, গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন গ্রন্থের প্রবন্ধ, লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ২২।
৫. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব উন্নয়ন গ্রন্থের প্রবন্ধ, লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা- ৩০।
৬. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, পৃষ্ঠা ৩৪
৭. শিল্পায়ন ও অর্থনীতির বিকাশ, সৈয়দ আবুল হোসেন, গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, পৃষ্ঠা ৩৮)
৮. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব, ও উন্নয়ন গ্রন্থের প্রবন্ধ, লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা- ৪১।
৯. গণতন্ত্র নেতৃত্ব ও উন্নয়ন, লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ১১৬।
১০. মাদারীপুরের কালকিনি থানার শশীকরে অনুষ্ঠিত হিন্দু সম্প্রদায়ের কীর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতা, ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৯৫ (গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন গ্রন্থের ১১৮-১১৯ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।
১১. আল কোরআন- (২ ঃ ২১৩)।
১২. তারুণ্য ও শিক্ষা, সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ৯৫।
১৩. সৈয়দ আবুল হোসেন, তারুণ্য ও শিক্ষা, পৃষ্ঠা ৯৪, ।
১৪. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন গ্রন্থের প্রবন্ধ, লেখক সৈয়দ আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা- ৩১।
১৫. মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক জাতীয় কৃষি দিবস/২০০৯ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় সৈয়দ আবুল হোসেন।
১৬. অগ্রযাত্রার এক বছর, ২০০৯ যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থে সৈয়দ আবুল হোসেন।
১৭. অগ্রযাত্রার এক বছর, ২০০৯ যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থে সৈয়দ আবুল হোসেন।
১৮. অগ্রযাত্রার এক বছর, ২০০৯ যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থে সৈয়দ আবুল হোসেন।

তৃ তী য় অ ধ্যা য়

সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ
মানবাধিকার
অরুণাভ সরকার
এক.
আজ সূর্য খুব বড় হবার কথা
আমি সেই সূর্যকে বারবার অভিবাদন করি
বলি স্বাগতম, বলি আসুন, আসুন
আমি অনুমান করি
আজ তার বর্শার ফলা
আরও বেশি তীক্ষè ও উজ্জ্বল
আজ কোথাও নিম্নচাপ নেই
আকাশ আজ পাপড়ি বর্ষণ করছে
নিচে ম-ম করছে তার ঘ্রাণ
আজ উত্তর বলছে, ‘আলোয় ভুবন ভরা’
এই ঐকতান পূর্ব ও পশ্চিমে
ঈশানে, নৈঋতে
বায়ু বলছে, আর অন্ধকার নয়
অগ্নি বলছে তাকে নির্বাসন দাও
আজ তাই হলুদ বৃষ্টিও ঝরবে না
ট্রিগার থেকে ফিরে যাবে সমস্ত আঙুল
আজ শুধু নবান্ন উৎসব
আজ সূর্যের দিন, শুধু আলো আর আলো।

দুই.
আকাশ-ঢাকা ধোঁয়ার মেঘে সূর্য গেছে ডুবে
ভূতপ্রেতরা নেচে বেড়ায় পশ্চিমে ও পুবে
উত্তরে আজ তুষার ঝড়, দক্ষিণে সাইক্লোন
যায় না বোঝা ঊর্ধ্ব, অধ এবং চতুষ্কোণ।
এর মানে তো অন্ধকার, কোথায় সেই আলো
আলো-সবার বুকের মধ্যে, এক্ষুনি তা জ্বালো।

অরুণাভ সরকার : কবি, সাংবাদিক ও গবেষক।

এক স্বপ্নজয়ী মানুষের জন্য
আসাদ মান্নান

অবশেষে দস্যুদের পরাজয়ে কৃষকের মাঠ জুড়ে ফসলের কানাকানি শুরু,
যমুনা প্রাণের টানে বহে যাচ্ছে সমুদ্রের অথই উজানে
বানে ভাসা সন্তানেরা খুঁজে পায় নূহের কিস্তির মতো ভাসতে থাকা
হাজার বছরের সেরা জনকের উদ্ধারতরীটি :
চাষার বাড়িতে আসে আশার নায়ক, কামারের ঘরে বসে কুমার বান্ধব।
পাড়ার মাসীরা সবে গোল হয়ে বসে বসে পান চিবুচ্ছেন মুনসীদের আঙিনায়,
মাঝি ও মাল্লার দল জলের কেল্লায় দল বেঁধে গান গাইছে :
এবার পুজোর রাতে বাড়িতে অতিথি আসে পূর্ণিমাকে ছেড়ে দাও
ওকে আজ বেঁধে রাখা দায় হবে, ওকে আজ তুলে দাও
স্বপ্নজয়ী কর্মপ্রিয় মানুষের হাতে, যে-মানুষ স্বপ্ন গেঁথে গেঁথে
সেলাই করছে আজ পদ্মাপাড়ের দরিদ্র মানুষদের বিচ্ছিন্ন জীবন :
ট্রয়ের সৈনিক তিনি, সময়ের সফল সন্তান। বুঝলে হেলেন !
বাড়িতে যে-অতিথি এলেন। লোকে তাঁকে জানে :
এক ক্লান্তিহীন স্বপ্নজয়ী আবুল হোসেন,
যদিও সৈয়দ তিনি, চাষার বাড়িতে এসে পিড়িতে বসেন।

২.
ঘুমের ভেতরে নাকি যৌবনের উৎসমূলে অপরূপ সব কাণ্ড ঘটে!
মুহূর্তেই বদলে যায় স্বপ্নের অদৃশ্য ভাষা, কখনওবা মরুদ্যানে বৃষ্টি নামে :
কিশোর হঠাৎ আর কিশোর থাকে না, পাল্টে যায় ঘুম আর ঘুমের বিছানা;
সেই এক আলোকিত দেবদূত তাঁর হাতে তুলে দেয় অচেনা আলোর খোঁপা,
স¦প্ন আর যুদ্ধজয়ী নাঙা তলোয়ার;
বাঁকা খাপে ঢাকা হলো রক্তমাখা গোধূলির রাঙা অভিসার :
জয় ভাসে পূর্ণিমায় মেঘের ভেলায়; মাঝিদের আঙিনায়
ভেলায় চড়িয়া আসে আলোর সোয়ারি এক স্বপ্নজয়ী আবুল হোসেন,
যদিও সৈয়দ তিনি, মানুষেরে ভালোবেসে মাঝে মাঝে মাটিতে বসেন।

৩.
অবরুদ্ধ মানচিত্রে রক্ত আর স্বপ্ন দিয়ে তৈরি হলো এক প্রজাতন্ত্র;
নতুন বীজের গন্ধে নড়ে ওঠে শহীদের লাশ বুকে কবরের ঘাস আর মাটি।
সূর্যের কিশোর আভা আর পূর্ণিমার মিলনসঙ্গীত গেয়ে ওঠে
নির্বাসিত গায়িকা কোকিল’ ‘জয়বাংলা …বাংলার জয়’
আবার চাষার ঘর ভেসে যাচ্ছে আশার আলোয়;
রক্তের অক্ষর দিয়ে আবার কি লেখা হবে শৈশবের প্রিয় সাথী
রাম আর রহিমার প্রেমের কাহিনী?

৪.
অজস্র মৃত্যুর ফাঁদ পরিত্যক্ত পথে পথে; তবু চারিদিকে জীবনের মুগ্ধ কোলাহল
সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়; আকাশের সমান উঁচুতে বসা
অবিনাশী জনকের কণ্ঠে বাজে জীবনের জ্বলন্ত ঝংকার।

কিছুতেই যায় না ভোলা কিছু কিছু রক্তচিহ্ন; মনে পড়লে
চৈতন্যের বেলাভূমি ডুবে যায় শোকের জোয়ারে : আমাদের
সকল অস্তিত্ব জুড়ে চির বহমান সেই জনকের স¥ৃতি 
কী করে দস্যুর দল মুছে ফেলবে!

তেত্রিশ বছর ধরে যারা বেঁচেও মৃতের মতো ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে রেখেছে 
‘স¦াধীনতা’ Ñ এই প্রিয় শব্দটিকে,
তাদের হৃদয়ে পুনর্বার জাগালেন যিনি, মৃত্যুভয় জয় করে বিস্ময় বেদনা আর 
কুয়াশার জাল ছিঁড়ে যিনি আজ
দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথের গানে আর বাঙালির প্রাণে, 
তাঁর রক্তে জনকের রক্ত আর আত্মা বহমান।
জাতিকে পিতার স্বপ্নে নতুন প্রত্যয়ে জাগালেন জনক দুহিতা;
মহিমা নামের সেই কিশোরীকে স্নেহের আঁচলে ঢেকে রাখলেন বুকের ভেতর;
তাঁর পাশে অবিনাশী চেতনায় অনেকের মধ্যে যিনি প্রকৃত মৌলিক
বুঝলে হেলেন! সময়ের আগে তিনি সময়ে চলেন।
আসাদ মান্নান : কবি।

তুমি
মো. মনিরুজ্জামান

কেউ আমাকে স্পর্শ দেয় নি মায়াময়, বৃষ্টি ছাড়া।
জল ছাড়া কারও ছোঁয়া মুগ্ধ করে নি
তৃষ্ণার্ত নিরালায়। হাহাকার করে ঘুরেছি,
ঘুরেছি প্রান্তরে সবুজে সবুজে ছায়ায় ছায়ায়।
মেলে নি কারও দেখা।
ক্রুর চোখে শুধু তাকায় সবাই।
আলো ছাড়া কেউ উষ্ণতা দেয় নি; পৌষ-মাঘের
খসখসে চামড়ায় ভাঁজ, কঠোর ঘর্ষণে ঘর্ষণে
দ্বিধান্বিত হয়েছি, বার বার তামাটে হয়েছি, দলিত হয়েছি
কেউ চোখ তোলে নি ঘৃণা ছাড়া নিঃসঙ্গতায়।
ফুল ছাড়া কেউ দেয় নি সুভাস, রূপায়নহীন চোখ,
নদী ছাড়া কারও আঙিনা ভরায় নি পাথুরে বন্ধ্যা বুক।
মোহময় বিকেলে রূপোলি আভায়
নিদাঘ বসন্তে পতপত বাতাসে, মায়া মায়া ছায়ায়
কেউ ফিরেও তাকায় নি
আমার দিকে আকাশের তারা ছাড়া।
পাখি ছাড়া সুর, বন ছাড়া মন, মাটি ছাড়া ধন
এ ছিল সহায়, এ ছিল চারিদিক বিরান শূন্যতা।
পৃথিবীটা জল-ফল, আকাশ-বাতাস আর আলোহীন
ভেবেছি আজন্ম-তুমি আসার পূর্ব পর্যন্ত।
তুমি দিয়েছ সুর, সুভাস, উষ্ণতা, ছন্দ
নিপাট মন, অবারিত ভালোবাসা, কলহাস্য
ছোঁয়া, অনুভূতি আর আনন্দ।
তাই আমি আকাশ বলতে বুঝি তুমি;
মাটি, পাখি, বসন্ত, আলো-জল-বাগান,
তটিনী, সুভাস, আদর, ভালোবাসা- মমতা
শিশির ভেজা ভোর- প্রমুগ্ধ আহবান।
মো. মনিরুজ্জামান : কবি ও কথাসাহিত্যিক।

চিরগঙ্গাতীরে
মুহম্মদ নূরুল হুদা

ঘন রসাবৃত স্রোত, এই পলিধারা
অশ্বমেধযজ্ঞে তবু বাজায় নাকাড়া
অশোক যায় না ধীরে, ফিরে ফিরে হাসে
পুনর্জন্মপ্রাপ্ত যারা, জলপাখি, ডানার বিন্যাসে
কারো পায়ে চিহ্ন-সুতো, কারো মুখে খড়
বালিতে-কাদায় কেউ তোলে কাল-ঝড়
কেউ হাসে আলো-ঘরে, কেউ খোঁজে পথ
হিমাদ্রি শিখর ছেড়ে নাচে ভগীরথ
মানুষ জলের ধারা, মাটি খায় চিরে
মা-হুয়ান, কাল-সাখ্য, চিরগঙ্গাতীরে।

মুহম্মদ নুরুল হুদা : কবি।

ভালো মানুষ
আলম তালুকদার

ভালো মানুষ কারে কয়
যার কাছে কথা থেকে
কাজ করা বড় হয়।
ভালো মানুষ কারে কয়
অন্যকে বড় করে
নিজে যে ছোট রয়।
ভালো মানুষ তারে কয়
যার ইচ্ছা ধীরময়
কল্যাণে নির্ভয়,
ভালোবাসায় মৃন্ময়।
ভালো মানুষ তারে কয়
যার কথায় কালো দিন
হয়ে ওঠে আলোময়।
ভালো মানুষ তারে কয়
যার কাছে সব মানুষ
সমাদরে এক হয়।
ভালো মানুষ সে হয়
যার কাছে মিথ্যার
নির্জলা হার হয়,
সত্যের জয় হয়।
ভালো মানুষ কারে কই
যার আছে হইচই,
ভালোবাসে আলো মই
ভালোবাসে ভালো বই।

আলম তালুকদার : শিশু সাহিত্যিক, ছড়াকার।

মুঠোগুলো খাঁচা হয়ে যায়
মাহমুদ কামাল

মুষ্টিবদ্ধ হাত প্রতিবাদ যতোটা স্বাধীন
মুঠোবন্দি ততোই অলিক
মুঠোর বাইরে থেকে স্বাধীনতা যতোটা লৌকিক
মুঠোর ভেতরে ততো অবিদ্যমানতা।
সরলীকরণ এ জীবন প্রবাহ
পরিশুদ্ধ করতে করতে আমাদের সকল অর্জন
জটিলের মাঝে ঢুকে যায়।
মুঠোর ভেতর থেকে খাঁচা ভেঙে স্বাধীনতাকামী
পরাধীনতার সকল শৃঙ্খল অবমুক্ত করে
নতুন মুঠোর জালে দ্রুত বন্দি হয়
পুঁজি ও ধর্মের অপার সংশ্লেষে
সাম্য-অসাম্যের বিপরীত স্রোতে
ঢেউগুলো মুঠোর ভেতরে গিয়ে শৃঙ্খলিত হয়
আমাদের মুঠোগুলো এভাবেই খাাঁচা হয়ে যায়।

মাহমুদ কামাল : কবি।

ধৃতিতত্ত্ব
রহমান হেনরী

আমরা কতো না যতেœ আপামর জীবনের স্মৃতি
উদ্ধৃতি চিহ্নের কাছে জমা রেখে, অন্য কোনোখানে
লৌকিক বাস্তবে ফিরে যাই; অথবা তা’ ফেরা নয়…
শুধু চলে যাওয়া… প্রতিটি প্রতিমা হলে হাওয়া…
তিমির পিঠের মতো উঁকিমারা এই দিন, সর্পিনী দুপুর,
একা একা জেগে থেকে যে-সব দুঃখের কাছে নত;
সেই সব প্রতœরীতি মানুষেরই জীবনের মতো
পৃথক পালঙ্ক হয়ে যায়। ফলে, আমরা শায়িত
প্রভৃতি ভুলের মাঠেÑ অতএব চিৎপাট হয়ে এই
আকাশঘনিষ্ঠ শুয়ে থাকা আর অন্তরালে গান;
পৃষ্ঠতলে পিষ্ঠ যত দূর্বাদল কিলবিল জাগে
আকাশে-অরণ্যে-মঠে, অগোচরে ভুলের ভূভাগে…
ভালোবাসা অথবা ঘৃণায় কিংবা প্রেমে-পরাজয়ে
আমরাও কখনও বা স্মৃতি;
ইতি ও নেতির জলে দ্রবীভূত হতে হতে, ডুবে-ভেসে
কেউ কেউ হয়েছি উদ্ধৃতি।

রহমান হেনরী : কবি।

এই এখনো
নাসির আহমেদ

একাত্তরেই যুদ্ধ যদি শেষ হতো
সেটাই স্বাধীন দেশের জন্য বেশ হতো
একাত্তরে হলো না তো যুদ্ধ শেষ
স্বাধীনতা বিরোধিরা ক্রুদ্ধ বেশ।
পঁচাত্তরে সেই ক্রোধেরই বিস্ফোরণ
আজও তোরা বিরোধীতায় দিস্ ফোঁড়ন
জাতির জনক খুন হলেও চার নেতা
ছিলেন বাকি। প্রশ্ন ওদের কার নেতা?
ঠিক করে নেয় তাদের খুনের দিন তারিখ
জেলখানাতেই নভেম্বরের তিন তারিখ
খুন করে চার নেতাকে কোন ঘাতকরা
সবাই চেনেন কোথায় সেসব পাতকরা।
তাঁরাই যদি থাকেন বেঁচে কী করে
দেশকে নেবে পাকিস্তানের শিকড়ে
তাইতো খুনের নেশায় ওদের মন্ত্রণা
এই এখনো দেশের জন্য যন্ত্রণা।

নাসির আহমেদ : কবি ও সাংবাদিক।

সেদিন
প্রকাশ চন্দ্র নাগ
(১)
সেদিন ঊষায় নব রক্তরাগে
দীপ্ত তেজে উঠেছিল জেগে
বিভাবসু। জানাতে তার অরুণিমায়
এ মহাবিশ্বে এসেছে এক জ্যোতির্ময়।
লতা-গুল্ম-বৃক্ষ মিলে সবে
সেজেছিল নব পুষ্পপল্লবে।
ভোরের নির্মল বাতাস
ভরে দিয়েছিল কুসুম সুবাস।
পাখিরা মধুর কণ্ঠে ধরেছিল কলতান,
শোনাতে তার আগমনী গান।
আসিলে ধরায় বিজয় তিলক পরে কপালে,
আপন মহিমায় জ্ঞানের আলোয় ভুলোক ভরিলে।
হে সুন্দর, প্রণমি তোমায় শতবার,
যুগে যুগে ফিরে; ফিরে এসো বার বার।

(২)
কে, কি বলে, কিবা আসে যায়!
তোমার কীর্তি অমর করবে তোমায়।
তুমি চিরন্তন অনাগত মহাকালের,
শিক্ষা-প্রেমী মহানায়কÑ
এ বাংলার প্রতিটি প্রাণের।
হে বিধাতা, দাও, তাকে আরও দাও
আমৃত্যু মানবসেবার তরে।
প্রতিটি তৃণ, গুল্ম, বৃক্ষ-লতা
কজনই বা আসে বলো এ ধরায়
অকৃপণ পরহিত করে
অনাগত প্রজন্ম, আবাল বৃদ্ধবনিতা,
স্মরিবে তোমায় চিরকাল শ্রদ্ধাভরে,
অকুণ্ঠ চিত্তে বাসিবে ভালো অবনত শিরে।
প্রকাশ চন্দ্র নাগ : কবি ও শিক্ষাবিদ।

যাঁর মন আছে
এস এম নুর মোহাম্মদ
আমি যতবার তোমায় দেখেছি,
ততবারই শুধু মনে হয়
যেন সাধারণ মানুষ নও তুমি!
মহামানব কিংবা দেবতা কিনা
তাও জানি না, বুঝিও না।
তবে তুমি মানুষ
এমন মানুষ যে মানুষের প্রাণের সঙ্গে
সুনিবিড় অন্তরঙ্গে মিশে আছে মহৎ মন।
আমি তোমার হাসি দেখেছি
যে হাসিতে নেই কোনো কপটতা
উপহাস কিংবা ছলনা
আছে শীতের সকালের সোনাঝরা রোদ,
আরামপ্রদ মিষ্টি স্নিগ্ধতা।
আমি তোমার চলনভঙ্গি দেখেছি,
যে ভঙ্গিমায় নেই কোনো দাম্ভিকতা, অহঙ্কার।
আছে সুন্দর, সাবলীল মানবীয় গুণাবলীর
অভিনব, অদ্ভুত প্রকাশ।
আমি তোমার মুখের কথা শুনেছিÑ
যে কথায় নেই কোনো অর্থহীনতা, শঠতা
আছে বিমোহিত করার সম্মোহন শক্তি।
আমি তোমার অন্তর দেখেছি, হৃদয় দেখেছি। 
যে হৃদয়ে নেই কোনো কুটিলতা,
নেই জটিলতা, হিংসা কিংবা ঘৃণা।
যেখানে আছে সবার প্রবেশাধিকার।
তাই, তোমাকে যখন আমি দেখিÑ
গভীর মনোযোগে একান্ত আপন নিরিখে
শ্রদ্ধাভারে অবনত হইÑ ব্যক্তিত্বের রশ্মিতে।

(ঈষৎ পরিবর্তিত)
এস এম নুর মোহাম্মদ : প্রভাষক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ।
তোমার নি®প্রাণ ছবিটি
মো. বরকত উল্লাহ্ পাঠান

কি এমন শক্তি আছে তোমার নি®প্রাণ ছবিটির যে,
আমার চোখে পড়লেই মনে হয়,
মাথা নত করি শ্রদ্ধাভরে।
একি ভয়? না তোমার আদর্শের কাছে
মাথা নত করা। আমার কাজের টেবিলের উপরে
দেয়ালে আটকানো নজরুল-রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে
তোমার কি সুন্দর সহাবস্থান।
তুমি পূর্ণ শশীর মতো রজনীর
সব আঁধারকে ধরণীর বুক থেকে
মুছে দিতে চাও নিঃশেষে।
অশিক্ষার অন্ধকারে পড়ে থাকা মানুষের কাছে
শিক্ষার আলো জ্বালাতে তোমারÑ
কি ব্যাকুল বাসনা।
তোমার কর্ম দিয়ে, ত্যাগ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে
চিরকালের মতো আসন করে নিয়েছোÑ
মানুষের হৃদয় মসনদে।
তোমার গড়া শিক্ষায়তনে অসংখ্য প্রাণচঞ্চল
শিক্ষার্থীর হৃদয়ে তুমি মহান দেবতা।
অসংখ্য দুঃখী মানুষের কাছে তুমি স্বপ্নের হাতেম তাই,
তোমার কীর্তি তোমাকে এ নশ্বর পৃথিবীতে
অবিনশ্বর করে রাখবে নিশ্চিত, চিরদিন।
বিদ্যান্বেষণের সাথে সাথে মানুষ
তোমার নামটি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
যেদিন তোমার রক্তমাংসের দেহ,
পৃথিবীতে থাকবে না; তখন তোমার
‘নি®প্রাণ ছবিটি, প্রাণের বন্যা ছড়াবে
সবার হৃদয়ে হয়ে আলোর স্ফুরণ।
(ঈষৎ পরিবর্তিত)
মো. বরকত উল্লাহ্ পাঠান : শিক্ষক প্রকৌশল অংকন ও ওয়ার্কস প্র্যাকটিস বিভাগ।

হে শ্রদ্ধাভাজন
রোমেনা আফরোজা

সকালের সূর্যোদয়ে মনে হলো
প্রকৃতি আজ অন্য রকম।
বাগানে প্রজাপতির মেলাÑ
ফুলে ফুলে সুরভিত লতাকুঞ্জ।
তোমার শিরে দেদীপ্যমান রাজমুকুটÑ
সূর্যের সমস্ত রঙ ছড়িয়ে গেছে লোকালয়ে,
অরণ্যে ফসলের সমারোহে।
তাই আজ শিশুর মুখে হাসি
যুবকের পরিবর্তনে সংকল্প।
শাদা পায়রা ডানা ঝাপটায়
ছোড়া পালে, মাঝি ধরে দূর পাল্লা।
তোমার প্রাপ্তি, তোমার সম্মান হে শ্রদ্ধাভাজন।
নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এল আমাদের আঙিনায়।
আমরা তোমাকে ভুলব না, ভুলব না কোনো দিন।
হে শ্রদ্ধাভাজন অনুপম, অমলিন।

রোমেনা আফরোজা : প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ, 
খোয়াজপুর।

সুহৃদ প্রাজ্ঞ বিদগ্ধ জন
ফয়সল শাহ
সুহৃদ, প্রাজ্ঞ, বিদগ্ধ জন
সৈয়দ আবুল হোসেন
অধ্যবসায়ের দীপশিখা নিয়ে
স্বপ্রতিভায় জীবনের শেকড়ে
জনহিতকর একান্ত আপন জন
সৈয়দ আবুল হোসেন।
দেশ মাতৃকার উন্নয়নের আধার
সঞ্জীবনী সুধার প্রবাহ অপার
জনতায় বিলীন হিরন্ময় আত্মা
মানবতার পরম সত্তা।
ঐশী আকর্ষণে প্রাণের সঞ্চালনে
স্রষ্টার সন্ধানে বিভোর মননে
বাঙালি হৃদয়ের একান্ত আপন
সৈয়দ আবুল হোসেন।
তুমি ধন্য, তুমি মহান
আপন মহিমায় সদা বিভাময়; চির অম্লান
অশিক্ষার অমানিশায় নিরন্তন আলো
কে পারে তোমায় হে মহানÑ
না বাসিয়া ভালো!
শ্রদ্ধা, প্রীতি; হিত কামনাতে
তোমায় স্মরে যাব শ্রদ্ধার সাথে।
তুমি ধন্য, তুমি মহান
আপন মহিমায় সদা বিভাময়;
যুগ যুগ জ্যোতি, পল্লব প্রীতি, চির অম্লান
অশিক্ষার অমানিশায় তুমি, নিরন্তন আলো
কে পারে তোমায় হে মহানÑ
না বাসিয়া ভালো!

ফয়সল শাহ : কবি ও সরকারি কর্মকর্তা।

হৃদ্যিক চয়ন
সিন্থিয়া অণুপ্রভা

নব পল্লবে পল্লবিত
কর্ম তোমার রঙ্গন; সদা
পূর্ণ বিকশিত।

(২)
মানবতার প্রশান্ততায় চিরন্তনের সোপান
প্রজন্মেরই প্রমুগ্ধতা
সৈয়দ আবুল হোসেন।

(৩)
চেতনার ধারক সুস্মিত প্রকাশ
আগামীর হাতছানি
উন্নীত বিকাশ
জন্মের ঋদ্ধতা বরেণ্য বরেণ
শিক্ষার দিশারী
সৈয়দ আবুল হোসেন।

(৪)
আকক্সক্ষার সীমানায় প্রত্যাশার গান
অনবদ্য মাধুর্য অমায়িক প্রাণ
উর্বরিত মননে অসীম রণেন
শিক্ষার কুশীলভ সৈয়দ আবুল হোসেন।

সিন্থিয়া অণুপ্রভা : কবি।

অনিমেষ সদাসয়
আহম্মদ কামাল

ছিল না রাস্তা হাঁটার
ছিল না নিবাস শান্তিতে
দু’দণ্ড কোথাও বসার’
ছিল না স্কুল, ছিল না কলেজ
সামান্য কিছু শেখার।
বড় কষ্ট ছিল মনে,
বড় দুঃখ ছিলÑ আর কতদিন উপেক্ষা!
হঠাৎ একদিন রাস্তা, স্কুল, কলেজ
তোমার ছোঁয়ায়, আলাদীনের প্রদীপের মতো
বিহ্বল অনিমেষ।
কষ্ট নেই আর, দুঃখ নেই কারও
আমাদের পিতা মূর্খ ছিল, পিতামহও
অনাগত প্রজন্ম মূর্খ থাকবে না আর
হাঁটতে পারবে বুক ফুলিয়ে।
বাড়ির পাশে কলেজ, আঙিনায় বিশ্ববিদ্যালয়।
লতার মতো ছড়ানো রাস্তা, পাকা।
তুমিই করেছ সবÑ হে সদাশয়।
মহামহিম সৈয়দ আবুল হোসেন
মূর্খ থাকার সব পথ
রুদ্ধ করে দিয়েছ চিরতরে।
আমরা তোমাকে আযুগ স্মরণ করে যাব
হৃদয়ের মণিকোঠায়, বিহ্বল শ্রদ্ধাভরে।

আহম্মদ কামাল : কবি ও শিক্ষাবিদ।

পহেলা আগস্ট
এস এম আবীর চৌধুরী মীম

গাঁয়ের নামটি ডাসার
সে গাঁয়েরই বাসিন্দা এক সৈয়দ আতাহার
সুফিয়া খাতুন স্ত্রী তাঁর অতি পুণ্যবান
পূর্বপুরুষ ইরাকবাসী শাহ ওসমান
ধর্মপ্রাণ মানুষ তিনি কর্মে মর্মে সৎ
পিতা ছিলেন তাহার; নাম-সৈয়দ আজমত।
ঊনিশ-শো একান্ন
কালকিনির ইতিহাসে
নব সূচনাÑ
সৌরভে বিভূষিত
শ্যাম নবান্ন।
আগস্টের এক। রাত নিশু নিশু
সুফিয়ার কোলে হাসে
ফুটফুটে শিশু।
কপালে চুমো খায় আলী আতাহার
স্বর্গীয় জ্যোৎস্নায় ভাসে চারিধার।
ভরে ওঠে আনন্দে
অতৃপ্ত বুক
ফেরেশতারা গেয়ে যায় গান-
অচিরে ঘুচে যাবে
কালকিনির
দুঃখ।
শিশুটির নাম?
আপনারা জানেন
মহান দাতা তিনি সৈয়দ;
আবুল হোসেন।

এস এম আবীর চৌধুরী মীম : কবি ও লেখক।

মহামহিম
রফিকুল ইসলাম

জানালাটা খুলতেই
ভোরের আলো;
স্বপ্নের আঙিনায় শ্রমের ঘাম, নিষ্ঠার আশ্বাস
মাঝিদের ভাটিয়ালি গান
স্নেহের পরশ, প্রত্যাশার হাতছানি সৃষ্টির উল্লাস।
সুরে সুরে ছন্দ। আগামীর আহবান দোলা দিয়ে যায়
অস্তিত্বের শেকড়ে শেকড়ে।
আড়িয়াল খাঁ ছুটে চলে পদ্মায়
পল্লবিত সবুজ, অরণ্যে অরণ্যে মুকুরে।
পদ্মাও থেমে নেই, সমুদ্রের পানে উন্মুখ-
ক্লান্তিহীন অবিরাম। পৌঁছোতে হবে
সেই স্বপ্নের কাছে, কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে-
যেভাবেই হোক।
আকাশে অনেক তারা সূর্য একটাই
অনেক মানুষ, হাজার হাজার
তিনি একজনই, আর কই পাই?
যিনি সবার কথা ভাবেন
সমুদ্রের মতো, সূর্যের মতো
মহামহিম সৈয়দ আবুল হোসেন।

রফিকুল ইসলাম: কবি ও শিক্ষাবিদ।

চ তু র্থ অ ধ্যা য়

সৈয়দ আবুল হোসেনের কলম থেকে

বঙ্গবন্ধু ও ইসলাম
সৈয়দ আবুল হোসেন
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অতি ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন শেখ আউয়াাল। কিংবদন্তি যে মুঘল আমলে তিনি পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য বাগদাদ থেকে চট্টগ্রাম ও সোনারগাঁয়ে আসেন। পরবর্তীকালে তাঁরই উত্তর পুরুষরা অধুনা গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ায় বসতি স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন ইসলাম প্রচারক শেখ আউয়ালের সপ্তম অধস্তন বংশধর। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের সুখ্যাতি ছিল সুফি চরিত্রের অধিকারী হিসেবে। বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। ইসলামি আদর্শ, আকিদা, তাহজিব ও তমুদ্দন প্রতিষ্ঠা ও সমুন্নত রাখতে তিনি ছিলেন তৎপর।
প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ ড. এনামুল হক বলেছিলেন-“বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন দু’হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের মহান স্থপতি। স্বাধীনতার অবিসংবাদিত রূপকার ও মহান ঘোষক। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম ও শ্রেষ্ঠতম কাণ্ডারি। সেই সাথে তিনি ছিলেন পবিত্র ধর্ম ইসলামের একজন শ্রেষ্ঠ সেবক। সমকালীন বাংলাদেশে ইসলামি মূল্যবোধ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
১৯৭০ সালের নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে বেতার-টেলিভিশনে ভাষণদান প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন “আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্যÑ লেবেল সর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রসুলে করিম (দঃ)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ ও বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদের বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলমান সে দেশে ইসলমা বিরোধী আইন পাশের কথা ভাবতে পারেন তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফারস্থা করে তোলার কাজে।”
’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের সময় ইসলামের বিধানের প্রতি জাতির জনকের অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ এবং ইসলাম ও সুন্নার পরিপন্থী কোনো আইন পাশ নাÑ করার অঙ্গীকারের দৃষ্টান্ত হিসেবেই এই স্মরণীয় উক্তির উদ্ধৃতি। এটা তাঁর ইসলাম প্রীতিরই একটি অনন্য নজির হয়ে থাকবে।
স্বাধীনতার অনেক আগেই বঙ্গবন্ধু বিদগ্ধ আলেমদের সমন্বয়ে গঠন করেছিলেন আওয়ামী উলেমা পার্টি। উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র পরিচালনা ও নীতি নির্ধারণে ইসলাম সম্পর্কে যাতে উলেমায়ে কেরামদের সুচিন্তিত অভিমত ও সুপারিশ পাওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে অনেকেই অপব্যাখ্যা করে থাকেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার উৎস ছিল ইসলামরে মহান নবি হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর ঐতিহাসিক মদিনা সনদ। প্রয়াত কবি গোলাম মোস্তফা রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ “বিশ্বনবী” থেকে উক্ত সনদ-এর অংশ উদ্ধৃত করছিঃ

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
রসুল মুহাম্মদ বিশ্বাসীদিগকে এবং যারাই তাঁর সাথে যোগ দিবে সকলকেই এই সনদ দিচ্ছেন। মদিনার ইহুদি নাসারা পৌত্তলিক এবং মুসলমান সকলেই নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউই বিনা অনুমতিতে কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কেউই হযরত মুহাম্মদের বিনা অনুমতিতে কারও সাথে যুদ্ধ করতে পারবে না। নিজেদের মধ্যে কোনো বিরোধ উপস্থিত হলে আল্লাহ ও রসুলের মীমাংসার উপর সকলকে নির্ভর করতে হবে। বাইরে কোনো শত্র“র সাথে কোনো সম্প্রদায় গুপ্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে না। মদিনা নগরীকে পবিত্র মনে করবে এবং যাতে তা কোনোরূপ বহিঃশত্র“র দ্বারা আক্রান্ত না-হয়, সে দিকে লক্ষ রাখবে। যদি কোনো শত্র“ কখনও মদিনা আক্রমণ করে, তবে তিন সম্প্রদায় সমবেতভাবে তাকে বাধা দেবে। যুদ্ধকালে প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজেদের ব্যয়ভার নিজেরা বহন করবে। নিজেদের মধ্যে কেউ বিদ্রোহী হলে অথবা শত্র“র সাথে কোনোরূপ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে তার সমুচিত শাস্তি বিধান করা হবেÑ সে যদি আপন পুত্র হয়, তবু তাকে ক্ষমা করা হবে না। এই সনদ যে ভঙ্গ করবে সে বা তাদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত।”
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পদার্পণ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল সমাবেশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেনÑ “বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না। আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিতে চাই: আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের কৃষক শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।”
এখানেই শেষ নয়। তার কিছু দিন পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গণপরিষদে এক ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন: “বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না।” অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এখন আবার ধর্মের বেসাতি ও ধর্মের নামে রাজনীতি চলছে। চলছে রাজাকার-আলবদরের দৌরাত্ম্য। জেনারেল জিয়াই হচ্ছেন এর জন্যে দায়ী। তিনি সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ রদ করেন।
গণপরিষদে দেশের খসড়া সংবিধানের উপর ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালনে জনগণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানে তার সরকারের দৃঢ় সংকল্পের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে ৪ অক্টোবর ১৯৭২ আবারো ঘোষণা করেনঃ “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের সবার ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানেরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নেই। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেয়ার ক্ষমতা নেই। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচারÑ এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।”
এর ৮ দিন পর ১২ অক্টোবর, ১৯৭২ গণপরিষদে আবারও ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যাদান প্রসঙ্গে সেই একই ভাষায় তাঁর সরকারের সদিচ্ছার কথা ঘোষণা করে বলেন: “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে তবে বাংলার মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করবে, এ বিশ্বাস আমি করি।”
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, বঙ্গবন্ধু ইলমামের চেতনা ও মূল্যবোধ এবং ইসলামের নবির (দঃ) আদর্শে একটি সত্যিকার ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনে ব্রতী হয়েছিলেন। কেবল ঘোষণা বা বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি।
নবি করিম (দঃ) বিদায় হজের ভাষণে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না-করার উপদেশ দেন। আল্লাহ পাক কোরআনের সূরা কাফেরুনে বলেছেন: “লাকুম দ্বীনুকুম অলিয়াদ্বীন।” অর্থাৎ যার যার ধর্ম তার তার কাছে।
নবি করিম (দঃ)-এর মদিনা সনদ, বিদায় ভাষণ এবং আল্লাহর পাক কালাম থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুও একইভাবে বিভিন্ন সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
আগেই বলেছি, ব্যক্তিজীবনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন খাঁটি ঈমানদার মুসলমান। তিনি বাংলাদেশে ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ইসলামের বিধানের পরিপন্থি মদ, জুয়া তিনি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেন। মদ, গাঁজা, আফিম ইত্যাদির উপর বঙ্গবন্ধু আরোপিত নিষেধাজ্ঞা পরবর্তীকালে বিএনপি সরকারের আমলে তুলে নেয়া হয়। এগুলো এখন অবাধে বিক্রি হচ্ছে, পান করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যাত্রা অনুষ্ঠানে প্রিন্সেসদের নাচানোর নাম করে অশ্লীলতা ও অপসংস্কৃতি গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাদেরই উত্তরসূরিরা ম্যাডোনা আমদানি করে রাজধানীর হোটেলে অশ্লীলতার যে তাণ্ডব করে তা আজও কেউ ভোলেনি। সেই সাথে প্রসার সাধন করা হচ্ছে ভিসিআর অপসংস্কৃতির। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বঙ্গবন্ধুর আর একটি অমর কীর্তি। মাদ্রাসা শিক্ষা প্রসারের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডও তিনি গঠন করেছিলেন। পবিত্র হজের পর মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমাবেশ তাবলিগ জামাতের জন্য তিনি ঢাকার অদূরে টঙ্গীতে জমি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত এ জমিতেই দেশ-বিদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেদের উপস্থিতিতে প্রতি বছর সগৌরবে তাবলিগ জামাত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর পর স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রেডিও-টেলিভিশনে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পবিত্র কোরআন ও তাফসির প্রচার শুরু হয়।
তিনিই প্রথম বাংলাদেশকে ইসলামী উম্মার সাথে অঙ্গীভূত করার মানসে ইসলামি সম্মেলন সংস্থা ঙওঈ সম্মেলনে যোগদান করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে এই সংস্থাভুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর সময়ে হজব্রত পালনের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তী সরকারগুলো এ অনুদান বন্ধ করে দিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আজ দেশে অনৈসলামিক ও শরিয়ত বিরোধী আচরণের ক্ষেত্রে সরকারি মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতা চলছে। অবক্ষয় হচ্ছে মূল্যবোধের। এ অভিযোগ স্বয়ং আলেম সমাজেরও। বিএনপি সরকার তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে নাটক করলো। কিন্তু যখন একজন কবি মহানবী (দঃ) সম্পর্কে কটুক্তি করেছিল, বঙ্গবন্ধু তখন তাকে কারারুদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও বিএনপির ইসলাম প্রীতির মধ্যে এই হলো পার্থক্য। বঙ্গবন্ধু কোরআন ও সুন্নাহর আদর্শের প্রতি সব সময়ই ছিলেন আন্তরিক আর বিএনপি ইসলামকে নিয়ে রাজনীতি করে আসছে।

সৈয়দ আবুল হোসেন : রাজনীতিবিদ; এম পি; মন্ত্রী, লেখক, কলামিস্ট ও রাজনীতিক বিশ্লেষক। প্রবন্ধটি আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের লেখা ‘স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নামক গ্রন্থ হতে গৃহীত, রচনাকাল আগস্ট, ১৯৯৪।

খেলার সাথী থেকে জীবন সাথী১
সৈয়দ আবুল হোসেন
জেলার নাম গোপালগঞ্জ। গ্রামের নাম টুঙ্গিপাড়া। সেই নিভৃত টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই টুঙ্গিপাড়াতেই জন্ম হয়েছিল বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের। সেদিন ছিল ৮ আগস্ট ১৯৩০। এক আগস্টে তাঁর জন্ম, অন্য আগস্টে তিনি শহীদ হন। তাঁর পিতার নাম ছিল শেখ জহুরুল হক। মাতার নাম হোসেনে আরা বেগম। বেগম ফজিলাতুন্নেসার ডাক নাম ছিল রেণু। তাঁরা ছিলেন দুই বোন। রেণু ছিলেন ছোট। তাঁর বড় বোনের নাম ছিল জিন্নাতুন্নেসা। ফজিলাতুন্নেসার বয়স যখন ৫ এবং জিন্নাতুন্নেসার বয়স ৭, তখন তাঁদের মা ইন্তেকাল করেন। এর আগে মাত্র তিন বছর বয়সে বঙ্গমাতা পিতৃহারা হয়েছিলেন।
মাত্র তিন বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সাথে। এই বিয়ের কাজ সমাধান হয়েছিল রেণুর দাদা শেখ কাশেমের একান্ত আগ্রহে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁর একান্ত আত্মীয়। তাঁরা উভয়েই একই বংশজাত। উভয়ের পারিবারিক উপাধি হওয়ার পর বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ী। বঙ্গবন্ধুর ও তাঁর ভাই বোনদের সাথে তিনি একই পরিবারের সদস্য হিসেবে বড় হতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর পিতামাতা তাঁকে নিজের সন্তানের মতোই লালন-পালন করেন। ছেলে-মেয়েদের সাথে একই সাথে তিনি যেমন খেলাধুলা করতেন, তেমনি একই সাথে লেখাপড়া করতেন। বঙ্গবন্ধুর খেলার সাথী থেকে তিনি হয়েছিলেন তাঁর জীবন সাথী। জীবনে যেমন মৃত্যুতেও তেমনি তাঁদের বন্ধন ছিল অবিচ্ছিন্ন, অটুট। বেগম ফজিলাতুন্নেসা গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে প্রাথমিক বিদ্যা শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি তাঁর নিজের প্রচেষ্টায় এবং গৃহশিক্ষকের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন। বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে বলা যায় স্বশিক্ষিত। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি মাত্রই স্বশিক্ষিত হয়ে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের ছিলেন ।
জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর শ্রদ্ধেয় মাতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেনÑ মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ বাঙালি নারী। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এই রমণী অসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেন। জীবনে তার কোনো চাহিদা বা মোহ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর মতেই বঙ্গমাতা অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। গরীব আত্মীয় স্বজনদের তিনি মুক্তহস্তে সাহায্য করতেন। সাহায্য করতেন সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা এবং ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য তাঁর দারস্থ হলে কেউ শূন্য হাতে ফিরে যেত না। অনাথ এবং এতিমদের তিনি সবসময় সাহায্য করতেন। ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর যখন বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হতো, তিনি বিনা দ্বিধায় তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে স্বামীর জন্য তা পাঠাতেন। ছয় দফা আন্দোলনের সময় তিনি নিজের অলঙ্কার বিক্রি করে সংগঠনের জন্য আর্থিক সাহায্য করেন। বঙ্গমাতার স্মরণশক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর মতোই প্রখর। নেপথ্যচারী হলেও বঙ্গবন্ধুর জীবনের সংগ্রাম এবং আন্দোলনের সকল ঘটনাই তিনি স্মরণ করতে পারতেন। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলতে পারতেন, কবে কখন কোন ঘটনা ঘটেছিল। বঙ্গমাতা তাঁর দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামালকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠান। মায়ের প্রেরণায় ও পিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা উভয়েই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাই তাঁরা উভয়েই বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার লড়াকু সৈনিক।
জননেত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন- ‘‘২৭ মার্চ ১৯৭১ বাড়ি আক্রমণ হবার সঙ্গে সঙ্গে বেগম মুজিব পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। হানাদার বাহিনী তাঁকে খুঁজতে থাকে। দিনের পর দিন তিনি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় লুকিয়ে লুকিয়ে থাকেন। অবশেষে একদিন হানাদার বাহিনী তাঁকে মগবাজারের একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে এনে বন্দি করে রাখে। বন্দি অবস্থায় ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনেক মানসিক যন্ত্রণা ও অত্যাচার ভোগ করার পর মুক্তি লাভ করেন। মুক্তি লাভের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির উপরে হানাদার বাহিনী কর্তৃক টাঙ্গিয়ে রাখা পাকিস্তানি পতাকা ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে পা দিয়ে মাড়ান এবং আগুন লাগিয়ে দেন। নিজেই জয়বাংলা শ্লোাগান দিতে শুরু করেন । এ সময় হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে একে একে জামাল ফিরে আসে, পরে কামাল আসে। তখনও বঙ্গবন্ধুর কোনো খবর জানা যায় নাই। এক বুক ব্যথা ও আশংকা ভরা মন নিয়ে তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন।”
জননেত্রী আরো লিখেছেন- “অবশেষে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ বিবিসি রেডিওর মাধ্যমে প্রথম জানা গেল যে, বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন। বাসায় জরুরি ভিত্তিতে টেলিফোন লাগানো হলো। ফোনে তিনি প্রথম বঙ্গবন্ধুর গলার আওয়াজ শুনলেন, তারপর থেকে স্বদেশে ফিরে আসা পর্যন্ত হাতে তসবিহ ও জায়নামাযে সময় কাটালেন। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন, প্রথমেই গেলেন তাঁর প্রিয় জনতার মাঝে, পরে এলেন পরিবার পরিজনের কাছে। বেগম মুজিব আশ্রয় পেলেন স্বামীর বিশাল বুকে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দেশ যেমন বিধ্বস্ত হয়েছিল, তেমনি জাতির জনকের সংসারও বিপর্যস্ত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বিধ্বস্ত দেশকে নতুনভাবে গড়ে তুলেছিলেন। আর বঙ্গমাতা তাঁর বিপর্যস্ত সংসারকে আবার নতুনভাবে পরম যতেœর সাথে সাজাচ্ছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস পালন করা হয়। জন্মদিবসে বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের গলার পুষ্পমাল্য স্বহস্তে হাসিমুখে পরিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গমাতাকে। ‘এ মণিহার তাঁকেই মানায়’ বলতে হয় কবির ভাষায়। বঙ্গবন্ধু যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন- এ মালা আসলেই বঙ্গমাতাকেই মানায়, তাঁর প্রাপ্য। ১৯৭২ সালের মার্চে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বঙ্গমাতার সাথে তাঁর আলাপ হয়েছিল। তাঁর সরলতায় ইন্দিরা গান্ধি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ইন্দিরা গান্ধিকে বলেছিলেন- ইন্দিরা যেন বঙ্গবন্ধুকে বলেন সময়মতো আহার করতে, নিজের শরীরের যতœ নিতে। বঙ্গমাতার অনুযোগ শুনে ইন্দিরা গান্ধি হাসি মুখে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেনÑ “আপনি সারাক্ষণ কাজ করেন, সময়মতো আহার করেন না, নিজের যতœ নেন না­Ñ এটা বড় খারাপ কথা।” এমনি স্বামী অন্তপ্রাণ ছিলেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই আবর্তিত হতো তাঁর সকল চিন্তা ও চেতনা। বঙ্গবন্ধুই ছিলেন তাঁর ধ্যান জ্ঞান, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাস্তবায়নই ছিল তার আনন্দ এবং সাধনা। জননেত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়- “ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের সময়েও বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী মরণকালেও সঙ্গী হয়ে রইলেন।” এমনকি মৃত্যুও তাঁদের বন্ধন বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি।

সৈয়দ আবুল হোসেন : রাজনীতিবিদ; এম.পি.; মন্ত্রী, লেখক, কলামিস্ট ও রাজনীতিক বিশ্লেষক। প্রবন্ধটি আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের লেখা ‘ বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা গ্রন্থ ও সাপ্তাহিক মতান্তর পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, ফেব্রচ্ছারি-মার্চ, ২০১০ সংখ্যার সৌজন্যে।
১. সাপ্তাহিক মতান্তর পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, ফেব্রচ্ছারি-মার্চ, ২০১০ সংখ্যা প্রকাশিত।

অন্তরঙ্গ আলোকে শেখ হাসিনা
সৈয়দ আবুল হোসেন
নিতান্ত শৈশব থেকেই আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের অনুসারী। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহেনার স্বামী ডঃ শফিক সিদ্দিকী বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার সতীর্থ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার জীবনের প্রথম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দলের আমি ছিলাম একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য। এ সুবাদে গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোগ ও সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁর মতো সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী, ভদ্র, সজ্জন, মিষ্টভাষী, দয়াদ্রচিত্ত, গভীর প্রজ্ঞামণ্ডিত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, জনদরদি, বাগ্মী এবং মানবিক গুণাবলী সম্বলিত নেত্রী এ দেশে আর দ্বিতীয় জন জন্মগ্রহণ করেনি। আমি তার ব্যক্তি জীবনের কিছু খণ্ডচিত্র এখানে বিধৃত করছি।
জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে আমার একবার দেখা হয় ১৯৮৫ সালে। আমি তখন দিল্লিতে মেরিডিয়ান হোটেলে অবস্থান করছি। এক সূত্রে খবর পেলাম শেখ হাসিনাও দিল্লি রয়েছেন। নৈনিতালে তার ছেলে ও মেয়ে তখন লেখাপড়া করছিল। তাদের দেখার জন্যেই তার দিল্লি আসা। দু’জনই যখন দিল্লতে তখন শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করে তার প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আমার শ্রদ্ধা জানানোর এই সুযোগ গ্রহণের উদগ্র বাসনা জাগলো মনে। ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করলাম। তিনি উঠেছেন কনিস্ক হোটেলে। তার সাথে যোগাযোগ করলাম এবং বললাম, দেখা করতে চাই।
তাঁর অন্তরঙ্গতা ও অকপটতা, মুহূর্তে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা এবং ব্যবহারে অবিকল বঙ্গবন্ধুর মতো উষ্ণতা ও সারল্য আমাকে মুগ্ধ করল। আমি তখন আমার অভিপ্রায় জানালাম। বললাম, আপা, আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আগামীকাল সকালে আপনার হোটেলে আপনার সাথে ব্রেকফাস্ট করতে আসবো।’
স্নেহের স্বরে জবাব দিলেন, ‘ বেশ তো। সকালে চলে এসো। এক সাথে ব্রেকফাস্ট সেরে নেয়া যাবে।’
পরদিন সকালে আমি তার হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হলাম। কনিস্ক একেবারেই সাধারণ একটি হোটেল। আর এই অতি সাধারণ হোটেলে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু দুহিতা বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ভেবেছিলাম নিচে হোটেলের রেস্তোরাঁয় নাস্তা করবো। রিসেপসনে খোঁজ নিতে গেলে আমাকে বলা হলো তার রুমে যেতে। দরজায় টোকা দিতে শেখ হাসিনা আমাকে সাদরে তার রুমে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ আগে স্নান করেছেন। মাথার চুলে তোয়ালে জড়ানো। লক্ষ্য করলাম, খাটের একপাশে জায়নামাজ বিছানো এবং তার ওপর তসবিহ্। মনে হলো কিছুক্ষণ আগে ফজরের নামাজ সেরেছেন। টেবিলে ব্রেকফাস্টের বিভিন্ন আইটেম ও সরঞ্জাম। তিনি আমাকে বসিয়ে নিজ হাতে টোস্টে জ্যাম ও জেলি মাখিয়ে দিলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয় অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন। তার সহজ সরল অমায়িক ব্যবহারে আমার মাথা আপনা আপনি নত হয়ে আসলো। এরপর একজন দলীয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি তার আরো কাছাকাছি এসেছি। তার সাথে ১৯৯৪ সালের প্রথমার্ধে জাপান ও সিঙ্গাপুর সফর করেছি। তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে অনেক বার আলাপ হয়েছে। প্রতিবারই আমি তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছি। প্রতিবারই তাকে একই রকম সহজ সরল অনাড়ম্বর দেখেছি। বাস্তবিকই শেখ হাসিনার উদারতা, সরলতা, অকপটতা ও মমত্ববোধের কোনো তুলনা হয় না। কোনো দিন তার মধ্যে কেউ অহঙ্কারের লেশমাত্র দেখেনি।
এক ভদ্রমহিলা শেখ হাসিনা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সাথে লেখাপড়া করেছেন। তারপর প্রায় দু’যুগ তাদের দেখা সাক্ষাৎ নেই। একবার ভদ্রমহিলার স্বামীর একটা অসুবিধে দেখা দিল। তিনি জানতে পারলেন শেখ হাসিনা সুপারিশ করলে হয়ত কাজ হবে। স্ত্রী শেখ হাসিনার গল্প প্রায়ই করতেন। স্ত্রীকে বললেন, নেত্রীকে টেলিফোন করে দেখতে, যদি বিশ বছর আগের বান্ধবীকে তিনি চিনতে পারেন, তার কাজটা যদি করে দেন। ইতস্তত করে স্বামীর কথামতো ভদ্রমহিলা জননেত্রীকে টেলিফোন করে নিজের পরিচয় দিলেন। আপনি করে তাকে সম্বোধন করায় নেত্রী তাকে স্নেহের স্বরে ধমক দিলেন: “কী আপনি আপনি করছিস? তুই করে বলতে পারিস না? যেমন ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় করতি। কর্তাকে নিয়ে এক্ষুণ চলে আয়”। ভদ্রমহিলা তার বাসায় গেলে তাকে সোজা বেডরুমে নিয়ে গিয়ে পুরোনো দিনের মতো অনেক গল্প করলেন। তার স্বামীর কাজটা করে দিলেন। তারপর এক সাথে দু’জনে দুপুরের খাবার খেলেন। তার অন্তরঙ্গতা দেখে আবেগে, কৃতজ্ঞতায় ভদ্রমহিলার চোখে পানি এসে গেল। তিনি ভাবতেই পারেননি শেখ হাসিনা তাকে চিনতে পারবেন। এত বছরেও তিনি এতোটুকু বদলাননি।
এবার একজন সাংবাদিকের প্রসঙ্গ। সুযোগ পেলেই শেখ হাসিনাকে খোঁচা দিয়ে লেখা হচ্ছে এই সাংবাদিকের অভ্যাস। একবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে মুখোমুখি পড়ে গেলেন তিনি শেখ হাসিনার। ভদ্রলোক ভেবেছিলেন শেখ হাসিনা হয়ত তার উপর কুপিত হয়ে আছেন। রাগারাগি করবেন। তার পরিচয় পেতেই শেখ হাসিনা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন, আপনার লেখা আমি মন দিয়ে পড়ি। খুব ভালো লেখেন আপনি। তার উদারতা ও মহানুভবতায় সাংবাদিক ভদ্রলোক মুগ্ধ।
পিতার মতোই বাংলার দুঃখী মানুষকে শেখ হাসিনা ভালোবাসেন। তাদের আপদে-বিপদে তিনি তাদের কাছে ছুটে যান। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস ও সান্ত্বনা দেন। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনসহ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজের আরাম-আয়েশ ত্চ্ছু করে অনেক সময় জীবনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে তিন আর্ত মানবতার সাহায্যার্থে এগিয়ে গিয়েছেন। ১৯৯৩ সালে সিলেট অঞ্চলে বন্যার্তদের সাহায্য করতে গিয়ে প্রবল ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েক দিন তাকে ভোগান্তি পোহাতে হয়।
১৯৯৪ সালের আগস্টে চাঁদপুরের মর্মান্তিক লঞ্চডুবির পরে স্বজনহারা মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান শেখ হাসিনা। এ সম্পর্কে ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকার পহেলা সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ সংখ্যার একটি প্রতিবেদন হুবহু তুলে দেয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। “স্বজন হারাদের স্বজন” এই শিরোনামে ইনকিলাব লিখেছে:

“চাঁদপুরের মেঘনায় ৩ শতাধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চডুবিতে মর্মান্তিকভাবে নিহত স্বজন-হারাদের পাশে দাঁড়াতে এবং তাদের সমবেদনা জানিয়ে শোকের সাথী হতে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও ছুটে যান চাঁদপুরে। এসেই তিনি জয় করে নিলেন চাঁদপুরবাসীকে। ২৮ আগস্ট সকাল ৯ টায় ঢাকা থেকে যাত্রা করে নন্দনপুর বিশ্বরোড হয়ে মোজাফফরগঞ্জ বাজারের পথসভা শেষে জগতপুর পৌঁছতেই জগতপুরের ছাত্র-শিক্ষক-জনতা পথ আগলে দাঁড়ালেন শেখ হাসিনার। তাদের আকুল আবেদন, তারা জগতপুর হাইস্কুল ময়দানে তার বক্তৃতা শুনবেন। তাদের থামিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বললেন, “ আমি আজ শোক ভারাক্রান্ত, মেঘনার পাড়ে আমার স্বজন-হারানো ভাই-বোনদের কাছে আমি ছুটে যাচ্ছি। ফুলের পাঁপড়ি আজ নয়, আজ আমাদের সাথী শোকাশ্র“।” জগতপুর হাইস্কুল ময়দানে ছাত্র-শিক্ষকদের চোখ অশ্র“সিক্ত হয়ে উঠলো। সেখান থেকে চাঁদপুর নতুন সার্কিট হাউসে বিকেল সাড়ে ৩ টায় তিনি পৌঁছলেন। সেখানে জোহরের নামাজ পড়ে চাঁদপুর রেলগেটে স্বজন-হারাদের শোকসভায় তিনি রওয়ানা দিলেন। জেলাপ্রশাসনের কর্মকর্তারা তাকে খেতে অনুরোধ করলেন। শুষ্ক মুখে মৃদু স্বরে শেখ হাসিনা বললেন, “ আমাকে স্বজনহারা মা-বোনদের কাছে যেতে দিন আগে। তিনি নাÑখেয়ে চলে গেলেন। সার্কিট হাউসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তার গন্তব্য পথের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন। চাঁদপুর রেলস্টেশনের বিশাল শোকসভায় শেখ হাসিনাকে দেখামাত্র স্বজন-হারা ভাই-বোনেরা কেঁদে লুটিয়ে পড়লো। শোকসভায় শোকবিহবল জনতা ডুকরে কেঁদে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যে সেখানকার বাতাস শোকার্ত জনতার কান্নায় ভারী হয়ে উঠলো। স্বামী ও সন্তানহারা চাঁদপুরের খুরশিদা, মোমতাজ বেগম, লতিফা বানু ও শরিয়তপুরের ফাতিমা বেগমকে আপনজনের মতো বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলেন শেখ হাসিনা, তখন আর নিজের চোখের পানি চেপে রাখতে পারলেন না। লঞ্চডুবিতে একমাত্র সন্তান শাহাদাতকে হারিয়ে পাগলিনীর মতো চাঁদপুরের লতিফাবানু শেখ হাসিনার বুকে মুখ রেখে অঝোর নয়নে কাঁদলেন আর বললেন, “শেখ সাহেব নেই, আর এদেশে আমাদের দেখার কেউ নেইগো মা, কেউ নেই”, দু’হাত দিয়ে দু’চোখ মুছিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বললেন, “আমি আছি মা, আমরা আছি”। শোক সমাবেশ শেষে চাঁদপুর নতুন সার্কিট হাউসে যখন ফিরলেন তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। ফিরে তিনি আসরের নামাজের পাটিতে দাঁড়ালেন, তখনো তিনি মুখে দানা-পানি তোলেননি। সার্কিট হাউসে কর্তব্যরত সকলে মুগ্ধ বিস্ময়ে নিচু স্বরে একথা একে অপরকে বলতে লাগলেন। সার্কিট হাউসে কর্তব্যরত বরিশালের অধিবাসী জনৈক বয়োজ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি নয় মাস পূর্বে খুলনা থেকে চাঁদপুর বদলি হয়ে এসেছেন, তাকে রুমাল দিয়ে নীরবে চোখ মুছতে দেখা গেল। অশ্র“সিক্ত নয়নে আদ্রস্বরে তিনি বললেন, “সত্তর সালে বঙ্গবন্ধু যেমন স্বজনহারাদের পাশে দাঁড়াতেন, তেমিন আজ তার মেয়ে চাঁদপুরে স্বজন-হারাদের পাশে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর রুহু বেহেশত থেকে দেখছেন যে, তাঁর মতো তাঁর মেয়েও আজ স্বজন-হারাদের চোখ মুছিয়ে দিচ্ছেন।”
প্রতিদিনের শেখ হাসিনা

একটি বড় রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার সারাদিন খুবই কর্মব্যস্ততার মধ্যে কাটে। প্রতিদিনই দলের অনেক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে হয়। তাদের কথা শুনতে হয়, কাউকে ডেকে কথা বলতে হয়। এর বাইরে থাকে দলীয় বিভিন্ন সভা, বৈঠক, জনসভাÑ এর সব কিছুতেই তাকে সময় দিতে হয়। এর ভেতরেই নিজের জন্য সময় বের করতে হয়। শেখ হাসিনা প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। খুব বেশি প্রয়োজন না-হলে দশটার আগে দোতালা থেকে নিচে নামেন না। সকালে নামাজ পড়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়েন। প্রতিদিন সকালে পবিত্র কোরআন তেলওয়াত করা তার প্রতিদিনের অভ্যাস। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা টেলিফোনে কথা বলেন। নিকটাত্মীয় বা পরিচিত, দলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে দেখা করে। ভোর থেকে ৯/১০ টা পর্যন্ত কয়েক দফা চা পান করেন, কখনো দু’একটা বিস্কুটও।
সকাল দশটা নাগাদ দোতালা থেকে নিচে নামার জন্য তিনি তৈরি হন। সে সময় রান্না-বান্নার জন্য নিযুক্ত লোকদের কি রান্না করবে কখনো কখনো সেই নির্দেশ দেন। যিনি বাজারে যাবেন, তাকেও নিজের পছন্দের থাকলে বিশেষ কিছু বাজার থেকে আনার জন্য বলেন। এরপর নাস্তা খান। অনেক সময় ব্যস্ততার কারণে নাস্তা খাওয়া হয়ে ওঠে না। চা পান করেই নিচে নেমে যান। এরপর সাধারণত গভীর রাত ছাড়া আর নিজের ইচ্ছায় তার সময় কাটে না। দল নেতা ও নির্ধারিত সময়ের অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে তাকে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। দোতলা থেকে নেমে নিচতলায় অপেক্ষমাণ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন, দর্শনার্থীদের কথা শোনেন।
তিনি দিনে অন্তত একবার ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে পিতার বাসায় যান। এটা প্রায় প্রতিদিনের রুটিন। ৩২ নম্বরের সামগ্রিক খোঁজ খবর নেন। দুপুর ২টা আড়াইটার দিকে তিনি ২৯ নম্বর মিন্টো রোডে ফিরে আসেন। দুপুরের খাবার খান। তিনি সাধারণত বাইরে খুব কম খাওয়া-দাওয়া করেন। গুরু পাক খাবার তিনি একদমই খান না। দুপুরে তাঁর খাবার তালিকায় থাকে সাধারণত ভাত, বেগুন-ভাজি ভর্তা, চিংড়ি মাছ, সব্জি, ছোট মাছ ইত্যাদি। ভাতের সঙ্গে ছোট মাছ তাঁর খুব প্রিয় খাবার।
বিকেলে সংসদ অধিবেশন থাকলে সংসদে যান। দলীর জনসভায় বৈঠক থাকলে তাতে যোগ দেন। বিকেলে এক ফাঁকে চা, মুড়ি ভাজা অথবা হাল্কা নাস্তা খান। চা পান করেন দুধ চিনি ছাড়া।
শেখ হাসিনা পারিবারিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দেন। যোগ দিতে নাÑপারলে ফোন করেন। তবে অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় দলীয় কাজকর্মের জন্য পারিবারিক অনুষ্ঠানাদিতে নির্ধারিত সময়ে যেতে পারেন না। কাজকর্ম সেরে অনেক রাতে অনুষ্ঠান আয়োজকদের সঙ্গে হয়ত দেখা করতে যান। কবি সুফিয়া কামালের জন্মদিনে কবির বাসায় গেছেন, কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিনে তাকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
শেখ হাসিনার ছেলে-মেয়ে দু’জনই সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বিদেশে লেখাপড়া করে। যে কারণে ছুটিছাটা ছাড়া ওরা দেশে আসতে পারে না। ফলে শেখ হাসিনা ছেলেমেয়েকে খুব একটা কাছে পান না। তাই ছেলেমেয়েদের জন্য সময় বের করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে ওরা দেশে বেড়াতে এলে শেখ হাসিনা ওদের সময় দেয়ার চেষ্টা করেন। শোবার আগে তিনি পত্র-পত্রিকা-বই পড়েন। গান শোনেন, ডায়েরি লেখেন। লেখালেখি করেন।
শেখ হাসিনা অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করেন। আর চাল-চলনও সাধারণ। তিনি সাধারণ বাঙালি মহিলাদের মতো সাধারণ শাড়ি কাপড়ে অভ্যস্ত। টাঙ্গাইল ও জামদানি সুতি শাড়ি তার প্রিয়। ব্যক্তিজীবনে শিশুদের খুব ভালোবাসেন। সভা-সমাবেশ ছাড়া সর্বত্র কথাবার্তায় তিনি খুব আড়ম্বরহীন। হাসতে হাসতে অনেক কথা বলেন। একজন টোকাইকে তিনি ৩২ নম্বরে রেখে পড়াশুনা করাচ্ছেন। বিভিন্ন ট্যুরে গেলে টোকাই-ভিক্ষুকদের সাহায্য করা, সংশ্লিষ্টদের বকশিস দেয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। শেখ হাসিনা ব্যক্তিজীবনে তার চারপাশের মানুষদের কাছে খুব প্রিয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা কেবল তার নিজ দলের কর্মী ও সমর্থকদের প্রতি সহানুভূতিশীলই নন, অন্যান্য দলের নেতা ও কর্মীদের প্রতিও সমান শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল। একবার ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে বহু ছাত্রদল কর্মী আহত হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। কোনো বিএনপি নেত্রী বা নেতা তাদের দেখতে যাননি। কিন্তু শেখ হাসিনা তাদের শয্যাপাশে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তাদের সান্ত্বনা জানিয়েছিলেন, মনোবল যুগিয়েছিলেন। যা ছাত্রদলের এ সব আহত নেতা-কর্মীদের ভাষায়, ‘তারা কোনো দিন ভুলতে পারবে না।’
শেখ হাসিনা, আগেই বলা হয়েছে, সহজ-সরল জীবনে অভ্যস্ত। উগ্র সাজসজ্জা বা প্রসাধন ইত্যাদি তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না। চিরন্তন বাঙালি মহিলাদের মতোই তার চালচলন। ঢাকার বাইরে কোথাও গেলে শেখ হাসিনা প্রবীণ ও বয়বৃদ্ধ নেতাকর্মীদের খোঁজ খবর নেন। প্রয়াত হলে পরিবার পরিজনদের সাথে দেখা করেন। তাদের কুশল জানার চেষ্টা করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাই করতেন। পিতার কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি এই গুণটি পেয়েছেন। সহজ সরল আটপৌরে জীবনযাপনের জন্যে তিনি সহজেই সকলের সাথে মিশে যেতে পারেন। আগেই বলা হয়ছে, তিনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। কঠোরভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত পড়েন। সকালে কোরআন তেলওয়াত করেন ও অজিফা পড়েন। এটা তার বাল্যকালের অভ্যাস। সারা রমজান মাস রোজা রাখেন। পবিত্র ঈদের দিন দলীয় নেতা-কর্মী ও আত্মীয় স্বজনের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে শেখ হাসিনা প্রতিদিন দেশের দূর-দূরান্ত থেকে অগণিত চিঠি পেয়ে থাকেন। এসব চিঠিতে অনেক সময় বিভিন্ন অভাব অভিযোগ থাকে। তিনি নিজে এগুলোর উত্তর দেন এবং অভাব-অভিযোগের সুরাহা করতে সচেষ্ট থাকেন। বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি বুদ্ধিজীবীদের মতামত নেন। বই পড়া ও লেখালেখি তার প্রধান শখ। পত্রিকায় বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তিনি নিয়মিত নিবন্ধ লিখে থাকেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন : যোগাযোগ মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, রাজনীতিবিদ, রাজনীতিক বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও লেখক। প্রবন্ধটি তাঁর লেখা ‘শেখ হাসিনা সংগ্রামী জননেত্রীর প্রতিকৃতি’ নামক গ্রন্থ হতে নেয়া হয়েছে।

নেতৃত্ব ও উন্নয়ন
সৈয়দ আবুল হোসেন
মালয়েশিয়ায় ‘আমনো বারিসান’ বা কোয়ালিশন সরকারের শাসন চলছে সাঁইত্রিশ বছর ধরে, অর্থাৎ ১৯৫৭ সালে দেশটির স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে। সিংগাপুরে ‘পিপলস একশন পার্টি’ বা চঅচ-এর একাধিপত্য চলছে পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে। ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো রাষ্ট্রপতি হয়েছেন প্রায় আটাশ বছর হলো। ইন্দোনেশিয়ার মানবাধিকার রেকর্ড খুব একটা সন্তোষজনক নাÑহলেও, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ তিনটিতে নিয়মিত নির্বাচন হয়। মানুষ বার বার ক্ষমতাসীনদেরই ভোট দেয়। কারণ, তারা শান্তি, স্থিতিশলিতা ও উন্নয়ন চায় বা তারা শাসক দলদের কাছ থেকে বারবার পেয়ে আসছে। সিংগাপুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উন্নয়ন ও অগ্রগতি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এসব দেশে সূচিত হয়েছে এৎড়ঃিয ঞৎরধহমষব বা প্রবৃদ্ধির ত্রিকোণ।
অথচ বাইশ বছর আগে আমরা যখন স্বাধীনতা অর্জন করি, তখন এই দেশ তিনটার অবস্থা অনেকটা আমাদের মতোই ছিল। আজ তারা শনৈ শনৈ উন্নতির শিখরে আরোহণ করছে আর আমাদের হচ্ছে অধোগতি। তারা ক্রমেই উপরে উঠছে আর আমরা কেবলই তলিয়ে যাচ্ছি। এর কারণ মূলত একটাই, আর তা হচ্ছে নেতৃত্ব। একটি জাতির জন্যে নেতৃত্ব হচ্ছে আশীর্বাদ। মাও সেতুং জাগিয়েছিলেন চীনবাসীদের। আর দে জিয়াওং পিং তাদের নিয়ে চলেছেন সমৃদ্ধির পানে। চীনের প্রবৃদ্ধির হার বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ। শতকরা বারো এরও বেশি।
আমাদের ব্যর্থতার জন্যে মূলত দায়ী আমাদের নেতৃত্ব। যে মহানায়ক একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কঠিন কঠোর দায়িত্ব নিলেন, দীর্ঘ সংগ্রাম ও সাধনার মাধ্যমে একটি নতুন জাতিসত্তা নির্মাণ করলেন, বিশ্বের মানচিত্রে স্থাপন করলেন একটি নতুন দেশের, তাকে তার আরাধ্য দায়িত্ব পালনের আগেই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। তারই ফলে আজকের দেশময় অশান্তি, অস্থিতিশীলতা, ক্রমাগতভাবে দারিদ্র্যের বৃদ্ধি ও বেকারত্ব। সে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অভিশাপ আজও বয়ে বেড়াচ্ছে জাতি।
দেশের মূল সমস্যা কোথায়? এ প্রশ্নের জবাব অনেকে অনেকভাবে দেবেন। আমি বলব: আমাদের অনগ্রসরতার প্রধান কারণ হচ্ছে দুর্নীতি ও অপচয়। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, অপচয় ও অনিয়ম ছড়িয়ে পড়েছে বলেই আমরা ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছি অচলায়তনের বৃত্তে। এ কারণেই আইনের শাসনের প্রতি আস্থা নেই। এ কারণেই সন্ত্রাস, অশান্তি ও অস্থিতিশীলতা। আধুনিক সিংগাপুরে জনক লি কুয়ান ইউ-এর ভাষায়: ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ যধং ফবংঃৎড়ুবফ সধহু ফবাবষড়ঢ়রহম পড়ঁহঃৎরবং রহ অংরধ, অভৎরপধ ধহফ খধঃরহ অসবৎরপধ. দুর্নীতি আফ্রিকা-এশিয়া-লাতিন আমেরিকা বহু দেশকে ধ্বংস করেছে। দুর্নীতির কারণেই আমরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছি। এটা আজ প্রমাণিত সত্য।
দুর্নীতি দূর করতে হলে কী করতে হবে? আইন প্রণয়ন করে কোনো দেশে কোনো কালে দুর্নীতি রোধ করা যায়নি। দুর্নীতি রোধ করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন দৃষ্টান্ত স্থাপন। কথায় বলে মাছের পচন ধরে মাথা থেকে। সুতরাং দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে নেতাদের, যারা ক্ষমতায় রয়েছেন তাদের। সৎ সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রয়োজন সৎ ও চরিত্রবান নেতৃত্ব। কেবল ভালো সিস্টেম বা পদ্ধতি থাকলেই উত্তম সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় না।
হোসেন শহীর সোহরাওয়ার্দী বা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কখনও উত্থাপিত হয়নি। কারণ, তারা সৎ ও চরিত্রবান ছিলেন। সুশিক্ষিত ও মেধাবী ছিলেন। তাদের বিবেক ছিল জাগ্রত। তাই ক্ষমতার অপব্যবহার তারা করেননি। নিজের বা পরিবারের স্বার্থের কথা না-ভেবে তারা দেশ ও জনগণের কথাই ভাবতেন। আজকাল যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা করেন সম্পূর্ণ উল্টো। ক্ষমতায় যাবার আগে যাদের অনেকের সংসার চলত কষ্টেসৃষ্টে, অন্যের কাছ থেকে চাঁদা তুলে, ক্ষমতায় যাওয়ার সাথে সাথে রাতারাতি তাদের অবস্থা হয় আঙুল ফুলে কলাগাছের মতো। কথায় বলে, একবার মন্ত্রী হতে পারলে তিন পুরুষ নাকি বসে খাওয়া যায়। গত আঠারো বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যারা কোনো-না-কোনো সময় মন্ত্রী ছিলেন, তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই পরবর্তীকালে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে সাধারণভাবে মানুষ রাজনীতিবিদদের প্রতি, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। রাজনীতিবিদ তথা নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সৎ, মেধাবী, দক্ষ ও সুশিক্ষিতদের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। রাজনীতিতে মেধার আমদানি করতে হবে। মালয়েশিয়ায় মাহাতীর তার উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচিত করেছেন আনোয়ার ইব্রাহিমকে। আনোয়ার ছাত্রজীবনে মাহাতীর মোহাম্মদের কট্টর সমালোচক ছিলেন। দীর্ঘ দুই বছর তাকে জেলেও কাটাতে হয়েছে। কিন্তু আনোয়ারের ক্ষুরধার মেধায় আকৃষ্ট হয়ে মাহাতীর তাকে নিজ দলে ভেড়ান ও মন্ত্রী করেন। সিংগাপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা অধ্যাপক ও ছাত্রদের রাজনীতির প্রতি সযতেœ আকৃষ্ট করে তোলা হয়। আমাদের এখানে কদর পেশি শক্তিধারী ও অস্ত্রবাজদের। এই প্রবণতা চলতে থাকলে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি, তথা সরকার কিছুতেই আশা করা যায় না।
পৃথিবী ছুটছে মেধার পেছনে। আমরা বিপরীত স্রোতে চলতে পারি না। বিপরীত স্রোতে চললে ফলও হবে বিপরীত। যেমন হয়েছে আমাদের ক্ষেত্রে। আমরা যদি উন্নয়ন চাই, অগ্রগতি চাই, দারিদ্র্যের বৃত্ত ভাঙতে চাই, তাহলে আমাদের সৎ, দক্ষ, মেধাবী ও সুশিক্ষিত নেতৃত্ব বেছে নিতে হবে। যারা বুঝতে পারবে, দেশের আসল সমস্যা কী, কীভাবে হবে তার সমাধান, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কী চায়, কীভাবে তাদের সক্রিয় সমর্থন ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যায়। এ ধরনের নেতৃত্ব যেদিন আমাদের দেশে গড়ে উঠবে, সেদিন আমরাও সিংগাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো উন্নতির ও অগ্রগতির পথে দ্রুত ধাবিত হব।

সৈয়দ আবুল হোসেন : যোগাযোগ মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, প্রবন্ধটি তাঁর লেখা ‘গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট’ নামক গ্রন্থ হতে নেয়া হয়েছে। বইটি ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে।

তারুণ্য ও শিক্ষা
সৈয়দ আবুল হোসেন
নতুনের প্রতি মানুষের আকাক্সক্ষা ও আগ্রহ চিরন্তন। সে কারণেই বলা হয় মানুষ নতুনের পূজারী। সে পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় না। পুরাতন হচ্ছে জীর্ণতা ও স্থবিরতার প্রতীক। আর নতুন হচ্ছে স্বপ্নময়, কর্মময় ও উদ্দীপনাময়। যেমন মানুষের জীবনে তেমনি প্রকৃতির মধ্যেও আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই। কিউবায় একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, ঞযব হবি ঢ়ষবধংবং ধহফ ঃযব ড়ষফ ংধঃরংভরবং. নতুন দেয় আনন্দ, পুরাতন দেয় তৃপ্তি। তৃপ্ত হবার পর কোনো কিছুর প্রতি সাধারণত আকর্ষণ থাকে না। তখন আমরা হই নতুনের জন্য উন্মুখ। নতুন কিছু প্রাপ্তির জন্যে হই উদগ্র, থাকি উন্মুখ হয়ে।
সকল কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিকই নতুনভাবে নতুনের জয়গান গেয়েছেন, নতুনের বন্দনা করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নতুনের প্রতি আবাহন বাস্তবিকই আমাদের আলোড়িত করে।

“আয়রে নতুন সঙ্গে করে নিয়ে আয়
তোর সুখ, তোর হাসি গান”

বস্তুত কবির কাছে নতুন হচ্ছে সুখ, হাসি ও গানের প্রতীক।
সচরাচর নতুন বলতে আমরা তরুণদেরই বুঝে থাকি। তরুণরাই আগামীর আশা-ভরসা। তারাই আমাদের স্বপ্ন দেখায়। চীন বিপ্লবের পিতৃপুরুষ চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর একটা কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন: ওহ ঃযব ভরহধষ ধহধষুংরং, ঃযব ড়িৎষফ নবষড়হমং ঃড় ঃযব ুড়ঁঃয. অর্থাৎ চূড়ান্ত বিশ্লেষণ বিশ্ব হচ্ছে তরুণদের। জুডাইজম বা ইহুদি ধর্মে বলা হয়, ঞযব মষড়ৎু ড়ভ ুড়ঁহম সধহ রং ঃযবরৎ ংঃৎবহমঃয. তরুণদের গৌরব তথা অহঙ্কার হচ্ছে তাদের শক্তি। তাদের কর্ম উদ্দীপনা। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা এর সত্যতা দেখতে পাব। দেখতে পাব অতীতে সকল দিগি¦জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে তরুণরা-ই।
আলেকজান্ডার যখন মিশর-ব্যাবিলন-ইরান পদানত করে ভারতে দিগি¦জয়ীর বেশে প্রবেশ করেন, তখন তার বয়স কত ছিল? ৩০/৩২ বছরের বেশি নয়। কাশেম যখন সিন্ধু বিজয় করেন, তখন তিনি ১৮/২০ বছরের তরুণ। মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর যখন জন্মভূমি ফাগানার সিংহাসনে বসেন, তখন ছিলেন কিশোর বালক। তেমনি ছিলেন মহামতি আকবর।
সমসাময়িক ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা তারুণ্যের এমনি জয় জয়কার দেখতে পাই। প্রেসিডেণ্ট বুশের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। ডেমোক্র্যাট দলের কেউই সাহস পাচ্ছে না তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার। সব চেয়ে ক্ষুদ্র ও দরিদ্র রাজ্য আরকানসাসের অখ্যাত অজ্ঞাত তরুণ গভর্নর বিল ক্লিনটন এগিয়ে এলেন। জয় করে নিলেন আমেরিকা। তাই বলা হয়, অসম্ভবকে সম্ভব করার নামই তারুণ্য।
দূরে দেখবার দরকার নেই। নিজেদের দেশের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাব তারুণ্যের বিক্রম ও বিজয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব কারা দিয়েছিল? ছাত্ররা অর্থাৎ তরুণরা। ‘৬৯-এর ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে কারা আয়ুব খানকে হটিয়েছিল? সেই তরুণ অর্থাৎ ছাত্ররা। মুক্তিযুদ্ধে কারা ছিল সামনের কাতারে? তরুণরাই। এরশাদ শাহীর নয় বছরের ক্ষমতার মঞ্চ কারা ধূলিস্যাৎ করেছিল? দামাল তরুণরাই।
এই গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ও অফুরন্ত সম্ভাবনার কথা স্মরণ রেখে তরুণদের, নবীনদের নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। অবক্ষয়, সহিংসতা ও দিক-নির্দেশনাহীনতার স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে চললে কেবল নিজেরই সর্বনাশ হবে না, জাতিরও সর্বনাশ হবে। কারণ, আগামী দিনের নেতৃত্ব তো তাদেরই দিতে হবে।
ফসলের জন্য যেমন জমি কর্ষণ করতে হয়, বীজ রোপণ করতে হয়, পরিচর্যা করতে হয়, তেমনি নেতৃত্বের যোগ্যতাও অর্জন করতে হয়। নেতৃত্ব আপনা আপনি আসে না। আকাশ থেকে পড়ে না। মাটি ফুটে গজায় না। তার জন্যে পরিশ্রম করতে হয়। সাধনা করতে হয়। অধ্যবসায়ী হতে হয়। ইসলামের মহান দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) যথার্থই বলেছেন, ‘নেতা ও দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য বিদ্যা অর্জন অপরিহার্য’।
বিদ্যা ও জ্ঞান অর্জন

পৃথিবীর সকল ধর্ম, সকল সমাজ সব সময়ই সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে এসেছে জ্ঞান অর্জনের উপর। সকল দেশে সকল কালে সার্বজনীন সত্য হচ্ছেÑ জ্ঞানই উন্নতির সোপান। পবিত্র ইসলামে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য বিদ্যাশিক্ষা ‘ফরজ’ বা অবশ্য কর্তব্য’। এ অর্থে খাঁটি মুসলমান কখনও নিরক্ষর বা অশিক্ষিত থাকতে পারে না।
পবিত্র কোরআন-এর শব্দগত অর্থ হচ্ছে বুক অব রিডিং বা পাঠ্য-গ্রন্থ। মহানবি (দঃ)-এর কাছে প্রথম যে সুরা নাজেল হয়েছিল, তা হচ্ছেÑ ‘ইকরা বিসমি’ বা পাঠ করো। হাদিসে উল্লেখ আছেÑ ‘বিদ্যার মতো চক্ষু আর নেই, সত্যের চেয়ে বড় তপস্যা আর নেই, আসক্তির চেয়ে দুঃখ আর নেই, ত্যাগের চেয়ে সুখ আর কিছুই নেই। বিদ্বানের কলমের কালি শহিদের রক্তের চেয়েও পবিত্র।’ মাছির নাকি মাথা ভর্তি শত শত চোখ। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, বিদ্যা অর্জন করলে এ রকম শত শত চোখের উন্মীলন হয়।
একজন জ্ঞানী ব্যক্তির কোনো কিছুতেই আসক্তি থাকে না। সর্বস্ব ত্যাগ করতে তিনি দ্বিধান্বিত হন না। এই প্রসঙ্গে গ্রিসের মহাজ্ঞানী আর্কিমিডিসের একটি কাহিনী বলি। আর্কিমিডিস একদিন মাটির উপর তার তত্ত্ব নিয়ে আঁকিবুঁকি করছিলেন। কারণ তখন কাগজের প্রচলন ছিল না। শত্র“সৈন্যরা তাকে ঘিরে ধরল। তিনি তাদের বলেছিলেন- তোমরা আমাকে হত্যা করো কিন্তু আমার আবিষ্কারকে ধ্বংস করো না। জ্ঞানই এ সাহস দেয়। মহাজ্ঞানী সক্রেটিসকে বিষপানে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। তার মধ্যে এতটুকু ভয়ভীতি বা বিকার দেখা যায়নি। নিজের হাতে হাসিমুখে তিনি হ্যামলক বিষ পান করেন। সুলতান মাহমুদ ছিলেন গজনীর মহাপরাক্রমশালী বাদশাহ। সতেরো বার ভারতে হামলা চালিয়েছিলেন। তার ভয়ে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে পানি খেতো। সেই সুলতান মাহমুদ কবি ফেরদৌসীকে নির্দেশ দিলেন শাহনামা লিখতে। একেকটি চরণের জন্য একেকটি স্বর্ণমুদ্রা বা আশরফি। সুলতান পরে যখন কথা রাখলেন না, তখন ফেরদৌসী তাকে ব্যঙ্গ করে তার বিরুদ্ধে কবিতা লেখেন। জ্ঞানই তাকে এ সাহস দিয়েছিল।
লর্ড হ্যালিকাস বলেছেন- ‘বিদ্যা মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু। সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করে পরিত্যাগ করলেও, বিদ্যা কখনও পরিত্যাগ করে না।’ অন্য সম্পদ চুরি বা খোয়া যাওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু বিদ্যা এমন অমূল্য সম্পদ, যা কেউ চুরি ডাকাতি বা লুট করতে পারে না। একজন প্রাচীন কবি বলেছেন, ‘বিদ্যাই হলো ভোগের বস্তু। বিদ্যাই এনে দেয় যশ ও কল্যাণ’। আজকের প্রাচুর্যশীল বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা এর সত্যতা দেখতে পাব। যে দেশে যত বেশি শিক্ষিত, সে দেশ, সে জাতি তত বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধশীল।
আজকের বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ জাপান। জাপানের প্রাকৃতিক সম্পদ তেমন নেই। তা সত্ত্বেও দেশটি এত ধনী, প্রাচুর্যশীল ও উন্নত হলো কী করে? সব সম্পদের বড় সম্পদ বিদ্যা ও জ্ঞানের জোরে। সিংগাপুর, তাইওয়ান, হংকং, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের উন্নতির চাবিকাঠি শিক্ষা আর জ্ঞান। সুতরাং শিক্ষার বিকল্প নেই। বিদ্যার চেয়ে বড় পুুঁজি আর নেই।
এই জ্ঞান জিনিসটা কী রকম। গ্রিক দার্শনিক প্ল্যাটোর দৃষ্টান্ত দেই। অন্ধকার গুহার মধ্যে শিকল বন্দি পড়ে আছে একজন। পেছনে আলোর প্রপাত। সে উঠে সেদিকে তাকানোর চেষ্টা করছে। এই আলোই জ্ঞান। আর অন্ধকার এবং শিকল হচ্ছে অজ্ঞতার রূপক। গ্রিক পুরাণে প্রমিথিউস একটি বীর চরিত্র। দেবতাদের সাথে সংগ্রাম করে সে ছিনিয়ে এনেছিল আগুন। এই আগুন হচ্ছে জ্ঞানের প্রতীক।
হিন্দুশাস্ত্রে বিদ্যাকে জ্যোতির বা আলোর সাথে তুলনা করা হয়েছে। সে আলো তিমিরবিদারী বা অন্ধকারকে বিনাশ করে। মানুষ আখলাকুল মাখলুকাত বা জীবকুলের শ্রেষ্ঠ। সেটা তার বিদ্যা বা জ্ঞানের জোরে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আদম (আঃ})কে সৃষ্টি করে জ্ঞান দান করেন। ফেরেশতাকুল সে জ্ঞানের কাছে পরাভূত হয়। তখন আল্লাহ তাদের নির্দেশ দেন তোমরা আদমকে সেজদা করো। অর্থাৎ জ্ঞানের কাছে নত হও। শয়তান সেজদা করেনি। কারণ, সে অজ্ঞতা ও অন্যায়ের প্রতীক।
প্রায় এক কোটি বছর ধরে মানুষ টিকে আছে পৃথিবীর বুকে। পৃথিবীকে সে পদানত করেছে। মহাশূন্যে সে অভিযান চালিয়েছে। এক কোটি বছরে কত প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্ত হয়েছে ডায়নোসোরের মতো অতিকায় জীব। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মানুষের এই সারভাইব্যালের রহস্য কী? চার্লস ডারউইনের থিউরি অব ইভলুয়শন অনুযায়ী প্রাণিকুলের মধ্যে সে ফিটেস্ট। কারণ, জ্ঞান তার করায়ত্ত।

বিদ্যালয়
এতক্ষণ এই যে, জ্ঞান বা বিদ্যাশিক্ষার কথা বললামÑ এর জন্য প্রয়োজন অবকাঠামোর। এই অবকাঠামোর নামই বিদ্যালয়। টলস্টয় বলেছেনÑ ‘বিদ্যালয়ই উন্নতির মাধ্যম। বিদ্যালয়ই মানুষকে সভ্য করে তোলে।’ এলজিা বফ চমৎকার কথা বলেছেন। তার মতে, ‘বয়স্কদের জন্য কারাগার অথবা ফাঁসিমঞ্চ নির্মাণ করার প্রয়োজন কমে যাবে, যদি উত্তম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায়।’ আমি মনে করি এর চেয়ে সত্য কথন আর হয় না। বিদ্যালয়ে জ্ঞান অর্জন করলে চরিত্র গঠিত হয়। ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য বোঝা যায়। অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পায়। তাহলে আর কারাগার বা ফাঁসির মঞ্চের প্রয়োজন রইল কোথায়? সুতরাং আমি মনে করি কারগার নির্মাণে মনোযোগ দেয়ার চেয়ে অধিক হারে বিদ্যালয় নির্মাণে, শিক্ষার প্রসারে মনোযোগ দেয়া দরকার। সে কারণেই আর একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছেন, ‘স্কুল তৈরির মতো মহৎ ও কল্যাণকর কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই’। এই চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি আমার সাধ্যমতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় আত্মনিয়োগ করেছি।
আমি মনে করি এটা, আমার সামাজিক অঙ্গীকার। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি আমার কর্তব্য। আমি সিক্ত আমার এলাকার মানুষের ভালোবাসায়। তাদের কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। সেটা আমি শোধ করতে পারি শিক্ষার আলো জ্বেলে বা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ব্যক্তিকে সাহায্যদানের আবেদন সব সময়ই সাময়িক। প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আবেদন কালজয়ী।
এ প্রসঙ্গে একটা চীনা প্রবাদ আমার মনে পড়েছে। কেউ যদি মাছ চাইতে আসে তাহলে উচিত হবে তাকে মাছ ধরতে শিক্ষা দেয়া। তাহলে সে আর মাছ চাইতে আসবে না। মাছ ধরা শিখে নিয়ে স্বাবলম্বী হতে পারবে। শিক্ষাই স্বাবলম্বিতা আনে। জ্ঞান তাপস আবুল ফজল যথার্থই বলেছেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতির শিক্ষিত তৈরির কারখানা আর রাষ্ট্র ও সমাজদেহের সব চাহিদার সরবরাহ কেন্দ্র।’
গ্রামই আমাদের আসল ঠিকানা। অথচ এই গ্রাম আজ অবহেলিত। শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। কিন্তু গ্রামের লোকের লেখাপড়ার প্রতি কারও তেমন মনোযোগ নেই। গ্রামের জনগোষ্ঠীর শিক্ষার বিপুল চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যেই আমার প্রয়াস।
প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ঐতিহ্য থাকে। ঐতিহ্য গড়তে হয়। ঐতিহ্য আছে অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ড এবং আইটির। তোমাদেরও পড়তে হবে। সে ঐতিহ্য হবে শিক্ষার। সংস্কৃতির। সেরা ফল প্রদর্শনের। দেশ ও সমাজের কল্যাণ চিন্তাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ডামাডোলে পড়ে সংঘাত সন্ত্রাসে জড়িয়ে জীবন বরবাদ করে দিলে না হবে দেশের উপকার, না নিজের উপকার।
আমার আরাধ্য পুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছাত্র ছাত্রীদের খুবই আদর করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট ছাত্র সমাজের প্রতি লক্ষ করে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেনÑ ‘বাবারা, একটু লেখপড়া শেখো। যতই জিন্দাবাদ আর মুর্দাবাদ করো, ঠিকমতো লেখাপড়া নাÑশিখলে কোনো লাভ নেই।’
জাতির জনক শ্লোগান সর্বস্ব রাজনীতি পরিহার করে জ্ঞানার্জনের উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই’। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার মানুষ হতে হবে তোমাদের। তোমাদের অভিভাবক, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী এবং দেশবাসীর সাথে আমিও তোমাদের কাছে এটা চাই। তাহলেই সার্থক মনে করব শিক্ষা প্রসারে আমার সকল প্রয়াস।
সৈয়দ আবুল হোসেন : যোগাযোগ মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, লেখক, শিক্ষানুরাগী, শিল্পপতি, কলামিস্ট, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, সমাজ-সংস্কারক। এ লেখাটি আলহাজ্ব সৈয়দ আবুল হোসেনের নির্বাচনী এলাকা কালকিনির ছাত্রছাত্রীদের আয়োজিত নবীন বরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ, জানুয়ারি, ১৯৯৩।

একুশের নতুন প্রেক্ষিত : ভাষানীতির স্বপক্ষে
সৈয়দ আবুল হোসেন
আমাদের জাতিসত্তা বিনির্মাণে মহান একুশে ফেব্রচ্ছারি আলোকবর্তিকার কাজ করেছে। একুশ আমাদের চেতনার স্মারক, আমাদের প্রেরণার উৎস। একুশের বিজয় আমাদের নতুন শক্তিতে উদ্দীপিত করেছে, উজ্জীবিত করেছে নবতর সংগ্রামে। আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়েছি। একুশ থেকে একাত্তর, তাই একই সূত্রে গাঁথা।
স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে চড়াই উতরাই পেরিয়ে আমরা কম অর্জন করিনি। এসব অর্জনকে সুসংহত করতে হলে এখন আমাদের নতুন ভাবনা ও চিন্তা-চেতনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা মুখের ভাষার জন্যে বুকের রুধি প্রবাহিত করেছি। অথচ আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ভাষানীতি গ্রহণ করতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে কোনো তোড়-জোড়ও পরিলক্ষিত হয়নি গত তেইশ বছরে। তাই ভাষার ক্ষেত্রে এখনও কমবেশি বিতর্ক রয়ে গেছে। এরশাদ আমলে সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারে সংসদে একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহিত হয়েছিল। কিন্তু সেটা প্রয়োগের ক্ষেত্রে না অতীতে না বর্তমানে আদৌ কোনো আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়নি। খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে একটি সার্কুলারের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইংরেজি রপ্ত করার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তি ছিল ইংরেজি হচ্ছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাষা। ইংরেজিকে অবহেলার কারণে আমরা ইংরেজিতে পিছিয়ে পড়েছি। তাই জাতীয় স্বার্থে ইংরেজির উপর জোর দিতে হবে। তা নাÑহলে আমরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব।
গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বকরণ প্রক্রিয়ার বর্তমান প্রবণতার প্রেক্ষাপটে আমাদের আশে-পাশের দেশগুলো অধিকমাত্রায় ইংরেজির দিকে ঝুঁকছে। এমন কি গণচীনেও ইংরেজি রপ্ত করার হিড়িক পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ-প্রযুক্তি ও যোগাযোগের জন্যে এছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। অগ্রগতি অর্জনের জন্যে আমাদেরও এর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। কিন্তু সেটা কতটুকু এবং কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে তার সুস্পষ্ট সীমা নির্ধারণও সেই সাথে প্রয়োজন। সেটা নিশ্চয়ই মাতৃভাষাকে অবহেলা করে নয়। বাংলার বদলে ইংরেজির প্রসার হবে আত্ম-হননের সামিল।
এ কারণেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমাদের একটি ভাষানীতি প্রয়োজন। এই ভাষা নীতি বাংলা ও ইংরেজির একটি সমান্তরাল সহ-অবস্থান নিরূপণ করবে এবং তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করবে। ভাষানীতি নাÑথাকার কারণে আমরা সকল ক্ষেত্রে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা প্রত্যক্ষ করছি। সরকারি দপ্তরগুলোতে যে যার মর্জি মতো কেউ ইংরেজিতে, কেউ বাংলায় নোট চিঠিপত্র লিখছেন। সবচেয়ে বেশি নৈরাজ্য চলছে শিক্ষায়তনগুলোতে। ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, আরবি মাধ্যম- এ ধরনের মাধ্যমের ছড়াছড়ি কোনো উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে নেই। তিন ধরনের ভাষার ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে, যার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া পড়েছে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে। এতে করে সমাজের সংহতি ও ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এটা জাতীয় সম্পদ ও অর্থের বিপুল অপচয়ও বটে। একটি জাতীয় ভাষানীতি থাকলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য ও নৈরাজ্য চলত না। ভাষা নীতি নাÑথাকার কারণে শিক্ষানীতিও অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।
প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ভাষানীতি রয়েছে। তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই তারা তা প্রণয়ন করেছে, অনুসরণ করে চলেছে।
একটি জাতীয় ভাষানীতির জন্যে প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য। এই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে জাতীয়তাভিত্তিক উদ্যোগ আবশ্যক। ভাষানীতি প্রণয়নের জন্যে একটি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এ ধরনের জাতীয় কমিটি শিক্ষাবিদ, প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি কর্মকর্তা ও কূটনীতিবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী, ছাত্র-ছাত্রী এবং আগ্রহী সাধারণ নাগরিকদের মতামত গ্রহণ করবে। এই মতামতের ভিত্তিতে কমিটি জাতির সম্মুখে তার প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে। অতঃপর এ বিষয়ে দেশব্যাপী পূর্ণাঙ্গ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে। বিতর্কের পরে সকলের সুপারিশের ভিত্তিতে জাতীয় ভাষানীতি গৃহিত হবে এবং তার প্রয়োগ হবে বাধ্যতামূলক। ভাষা সংক্রান্ত এই জাতীয় কমিটির দ্বিতীয় কাজ হবে জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে ভাষানীতি কতটুকু প্রয়োগ হচ্ছে তা মনিটর করা বা লক্ষ রাখা।
আমরা যদি তা করতে পারি, তাহলে ইংরেজি ও বাংলার ব্যবহার নিয়ে বর্তমানে যে জট পাকানো অবস্থা বিরাজ করছে, তার আশু অবসান হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে যে বৈষম্য ও বৈপরীত্য রয়েছে, তা দূর করা সম্ভব হবে। সর্বোপরি, এতে যেমন ইংরেজির চর্চা হবে, তেমনি বাংলা ভাষারও প্রসার হবে।
একুশ আমাদের আবেগ তাড়িত করে। আমরা উচ্ছ্বসিত হই। আবেগ বা উচ্ছ্বাস আসলে অন্তর্নিহিত শক্তিরই বহিঃপ্রকাশ। এই শক্তিকে যদি ধরে রাখা যায়, তাহলে গঠনমূলক ও সৃজনশীল অনেক কিছুই করা সম্ভব। একটি ভাষানীতি প্রণয়নে উদ্যোগী হয়ে আমরা আমাদের আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে গঠনমূলক ও সৃজনশীল করে তুলতে পারি। একুশে ফেব্রচ্ছারিতে এই হোক আমাদের প্রত্যয় ও সংকল্প।

সৈয়দ আবুল হোসেন : যোগাযোগ মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, গবেষক, লেখক, কলামিস্ট, রাজনীতিক বিশ্লেষক; প্রবন্ধটি তাঁর লেখা ‘গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট’ নামক গ্রন্থ হতে নেয়া হয়েছে।

সত্য ও ন্যায়ের দাঁড়িপাল্লায় আমি নির্দোষ
সৈয়দ আবুল হোসেন
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকার ও দুদকের উপর অনেক অযাচিত, অন্যায় ও অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করেছে। আমাকে অহেতুক ও যুক্তিহীনভাবে পদ্মা সেতুর অনিয়মে সম্পৃক্ত করা চেষ্টা করছে। প্রমাণহীনভাবে অন্যায় কাজে আমাকে সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে বিশ্বব্যাংকের মুখ রক্ষার জন্য সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেল চেয়ারম্যান একটি ফরমায়েসী রিপোর্ট দিয়েছেÑ যা যে কোন বিচারে অগ্রহণযোগ্য। বিশ্বব্যাংকের কাল্পনিক অভিযোগ নিয়ে দেশের কতিপয় পত্রিকাও অসত্য রিপোর্ট করেছে। সামগ্রিক বিষয়টি দেশবাসীকে জানানোর জন্য, আমার নির্দোষীতা প্রমাণে সত্য প্রকাশের জন্য এ খোলা চিঠি লেখা।

সত্যের দাঁড়িপাল্লায় আমি নির্দোষ 
া আমি জীবনে কোন অন্যায় ও অনিয়ম করিনি। এরপরও আজ বিভিন্ন ইস্যুতে অসত্য অভিযোগ ও অপসংবাদের এক অনাক্সক্ষাখিত বোঝা বহন করে চলেছি। এ বোঝা আরোপিত ও উদ্দেশ্যমূলক। এ বোঝা পরিকল্পিত। জেনেশুনে অন্যায়ভাবে, অসত্য বিষয় সামনে এনে মিডিয়ার মাধ্যমে, অপসাংবাদিকতার পথ অনুসরণ করে, নানাভাবে আমাকে দোষারোপ ও হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা চলছে। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে ও সেতু নির্মাণ বিষয়ে আমাকে জড়িয়ে গত তিন বছর ধরে যে বিতর্ক হয়েছেÑ তাতে আমি আদৌ সম্পৃক্ত নই। আমার সম্পৃক্ত হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। 
া আমি নিশ্চয়তা দিয়ে জানাতে চাই, স্বচ্ছতা, নিয়ম বজায় রেখে, জবাবদিহিতার পথ অনুসরণ করে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তুতিমূলক কাজ করা হয়েছে এবং মূল সেতু নির্মাণ ও পরামর্শক নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এ কার্যক্রমে কোন গোপনীয়তা ছিল না। কাউকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যও ছিল না, সুযোগও ছিল না। বিদ্যমান আইন-বিধি ভঙ্গ করা হয়নি। ঋণদাতা সংস্থার তদারকিতে পদ্মা সেতুর প্রস্তুতির কাজ তরান্বিত হয়েছে। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন নির্ধারিত সময়Ñ ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৩ এর মধ্যে শেষ করার প্রত্যাশা নিয়ে কাজ অগ্রসর হয়েছে। যেখানে বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রস্তুতি কাজ করতে ১০ বছর লেগেছে, সেখানে মাত্র দু’বছরে আমরা পদ্মা সেতুর প্রস্তুতির কাজ শেষ করেছি। এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, সেতুর কাজ যথানিয়মে, কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের কাছে কিছু লোকের অসত্য অভিযোগের ভিত্তিতে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। এই সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা মন্ত্রী হিসেবে আমাকে জড়িয়ে অসত্য খবর প্রকাশ করে আমার মর্যাদাক্ষুণœ করে। সত্য জানার পরও একইভাবে নেতিবাচক সংবাদে আমাকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়। অথচ পদ্মা সেতুর কাজে সত্য ও ন্যায়ের দাঁড়িপাল্লায় আমি নির্দোষ।

মেগা প্রকল্প ও মন্ত্রীর দায়িত্ব
া সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন, পদ্মা সেতুর ন্যায় মেগা প্রকল্পগুলো দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় কিভাবে বাস্তবায়িত হয়। এক্ষেত্রে কিভাবে অর্থায়ন হয়, কিভাবে প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন হয়। কিভাবে প্রকল্পের সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রীর প্রকল্প বাস্তবায়নে তাগিদ থাকে, কিন্তু পিপিআর, বিধি ও আইন অনুযায়ী কোন হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকে না- এর কারণ, এক্ষেত্রে মন্ত্রী মূল্যায়ন কমিটির সদস্য নয়, ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ নয় এবং অনুমোদনকারীও নয়। বাংলাদেশের পিপিআর ও সরকারি আইনে মন্ত্রীকে পদ্মা সেতুর দরদাতা নির্বাচন ও পরামর্শক নিয়োগের কোন সুযোগ দেয়া হয়নি, ক্ষমতা দেয়া হয়নি। প্রকল্প পরিচালক, মূল্যায়ন কমিটি এবং দাতাগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তই প্রকল্পের কাজকে এগিয়ে নিয়েছে। মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রী হিসেবে আমি শুধু আনুষ্ঠানিকতাটুকু পালন করেছি, ফেসিলিটরের ভূমিকা পালন করেছি। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে যে পর্যন্ত কাজ হয়েছেÑ তাতে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাথে মতবিনিময়ের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া মন্ত্রী হিসেবে পরামর্শক নিয়োগের মূল্যায়নে আমার কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। আর এই স্বাভাবিক ও সৌজন্যতাকে পুঁজি করে পরামর্শক নিয়োগে আমার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তোলা এবং দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সাথে আমাকে জড়ানোর পরিকল্পিত নাটকও উদ্দেশ্যমূলক। এখানে উল্লেখ্য, ক্রয়নীতি অনুযায়ী যে কোন প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তি মূল্য সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তি মূল্য সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত হলে, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অনুমোদন দিতে পারেন। চুক্তিমূল্য এর বেশি হলে তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রীর সুপারিশসহ দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়ন রিপোর্ট সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত্র মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপন করতে হয়। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের আনুমানিক চুক্তিমূল্য ৩শ’ কোটি টাকার বেশি। তাই এ চুক্তি অনুমোদনের ক্ষেত্রে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আমি কোনভাবেই বিশ্বব্যাংকের দাবী অনুযায়ী চূড়ান্ত অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ নই। এক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ। কাজেই “মন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদনকারী”Ñ এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমার জড়িত থাকার অভিযোগ কোনক্রমেই সঠিক নয়, আইনসম্মত নয় এবং যুক্তিসঙ্গতও নয়। উল্লেখ্য, সরকারি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রী হিসেবে আমার কাছেও মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়ন মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রেরণের জন্য উপস্থাপন করা হয়নি। 
পদ্মা সেতুর অভিযোগের মূল প্রেক্ষাপট
া প্রথমে বলা হয় যেÑ পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক পরবর্তীতে বলে দুর্নীতি হয়নি, দুর্নীতির চেষ্টা হয়েছে। এরপর বলে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। একটু লক্ষ্য করবেন, একথাগুলো বিশ্বব্যাংক বলেছে তখন, যখন বিশ্বব্যাংক একটি চীনা কোম্পানিকে মূল সেতুর ঠিকাদারী পেতে মূল্যায়ন কমিটি দ্বারা যোগ্য করতে ব্যর্থ হয়। নানা অজুহাত, বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং ব্যাখ্যা চেয়েও যখন কোম্পানিটিকে মূল্যায়ন কমিটি দ্বারা যোগ্য করা যায়নি, যোগ্য করা সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি একটি প্রতারণার জালে ধরা পড়ার পরই প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের প্রতিযোগিতা থেকে ডরঃযফৎধি করে নেয়। এরপর মূল সেতুর টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আমার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান সাকো’র বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে। অভিযোগ তদন্তে সাকো’র কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে মূল সেতু নির্মাণের পরামর্শক নিয়োগে অহেতুক দুর্নীতির আশঙ্কার অভিযোগ এনে পুরো ঋণচুক্তি বিশ্বব্যাংক বাতিল করে দেয়। অথচ পরামর্শক নিয়োগে প্রতিটি পদক্ষেপ বিশ্বব্যাংকের সরাসরি তদারকি ও অনুমোদন সাপেক্ষে অগ্রসর হয়েছিল। পরামর্শক নির্বাচনে সর্বশেষ পর্যায়ও বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক এসএনসি-লাভালিন দ্বিতীয় থেকে প্রথম হয়। 
বিশ্বব্যাংক প্যানেল রিপোর্ট : অসত্য ও অযৌক্তিক বিষয়গুলো
া সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্যানেল চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছে। অধিকাংশ জাতীয় কতিপয় পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এসব রিপোর্টে আমাকে নিয়ে নতুন করে সমালোচনা ও দোষারোপের চেষ্টাও বিদ্যমান। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের রিপোর্টটি একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে দেখবেন, বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চূড়ান্ত রিপোর্টের মধ্যে কোন নতুনত্ব নেই। যুক্তি, প্রমাণ, সততা, ইন্টিগ্রিটি এবং জুরিসপ্র“ডেন্স নেই। বিশ্বব্যাংক এক্সটারনাল বিশেষজ্ঞ প্যানেলের এ রিপোর্ট আন্তর্জাতিক আইন, ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ও একটি সার্বভৌম স্বাধীন দেশের প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানের প্রতি অবজ্ঞার সামিল। এ রিপোর্ট আন্তর্জাতিক দাদাগিরির এক উজ্বল দৃষ্টান্ত বলে প্রতীয়মান। পরামর্শক নিয়োগে আমার কোন সম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়ে ঢাকা সফরের সময় বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সম্মানিত চেয়ারম্যান লুইস মোরেনো ওকাম্পো দুদক ও বাংলাদেশ সরকারের উপর আমাকে হয়রানিমূলকভাবে তাদের কথিত অভিযোগে অন্তর্ভুক্ত করার যে যুক্তিহীনভাবে প্রবল চাপ দিয়েছিলÑ বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের এ চূড়ান্ত রিপোর্ট তারই পুনরাবৃত্তি। রিপোর্টের একাংশে এফআইআর-এ আমাকে আসামী না করায় “দুদক-এর তদন্ত পরিপূর্ণ ও সঠিক হয়নি” বলা হয়। বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞদের প্যানেলের চাপিয়ে দেয়া এ মতামত অগ্রহণযোগ্য এবং যে কোন যুক্তি, আইন ও বিচারে ভুল বক্তব্য। তালগাছটা আমারÑ এ ধরনের কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া যে কোন দেশের আইনে অগ্রহণযোগ্য ও আপত্তিকর। 
এসএনসি-লাভালিনকে মন্ত্রী পরামর্শকের কাজ পেতে সুযোগ করে দিয়েছে- এটা সত্য নয়
া পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আমি মন্ত্রী হিসেবে এসএনসি-লাভালিনকে সুযোগ করে দিয়েছি এবং অনৈতিক সুযোগ দাবী করেছিÑ রিপোর্টের এ বক্তব্য সম্পূর্ণ অসত্য। স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, সত্যতা ও যথার্থতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে একটি ভুল সংকেত। আমরা সবাই জানি, পরামর্শক নিয়োগের মূল দায়িত্ব টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির। মূল্যায়ন কমিটি ও বিশ্বব্যাংক সমন্বয়ের মাধ্যমে পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ার সুপারিশ চূড়ান্ত করে। আর্থিক দরপত্র খোলার পর দেখা যায় যে, এসএনসি-লাভালিন দ্বিতীয় দরদাতা হয়। বিষয়টি সেতু বিভাগের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংককে অবহিত করা হলে বিশ্বব্যাংক দুইটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়নের জন্য নির্দেশনা দেয়। বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করায় মূল্যায়নে এসএনসি-লাভালিন দ্বিতীয় থেকে প্রথম হয়। এমতাবস্থায়, এসএনসি-লাভালিনকে দ্বিতীয় থেকে প্রথম করতে কোন অনিয়ম বা ব্যত্যয় হয়ে থাকলে তা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের উক্ত নির্দেশনার কারণে, মূল্যায়ন কমিটির তরফ থেকে। মূল্যায়নের কোন পর্যায়েই আমি সম্পৃক্ত ছিলাম না। ফলে কোন যুক্তিতেই আমাকে পরামর্শক নিয়োগের অনিয়মের সাথে জড়ানো যাবে নাÑ এটা ভেবে দেখার জন্য সবাইকে আহবান জানাচ্ছি।

মন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ নয়
া বিশ্বব্যাংকের এক্সটারনাল বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চূড়ান্ত রিপোর্ট অনুযায়ী মন্ত্রী হিসেবে আমি অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ এ ধারণা একেবারে সম্পূর্ণ ভুল, উদ্দেশ্যমূলক এবং পক্ষপাতমূলক। এ মন্তব্য অসত্য এবং পরামর্শক নিয়োগে আমাকে জড়ানোর একটি অশুভ হাতিয়ার। এ বিষয়টি ওকাম্পোর মত বিজ্ঞ আইনজ্ঞ বুঝবেন না বা বুঝতে পারেননি- এটা হতে পারে না। ওকাম্পোকে ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে, ভুল বুঝানো হয়েছে। পরামর্শক নিয়োগে মন্ত্রী হিসেবে আমি চূড়ান্ত ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ নই, চূড়ান্ত অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ নই। মন্ত্রী হিসেবে আমি মূল্যায়ন কমিটির সদস্যও নই। এক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ। পরামর্শক নিয়োগের বিষয়টি সরকারি অনুমোদনের জন্য সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপনের লক্ষ্যে আমার পর্যায়ে মন্ত্রী থাকাকালীন উত্থাপিত হয়নি। তাহলে আমি মন্ত্রী হিসেবে এ নিয়োগের সুপারিশের সাথে জড়িত হলাম কেমন করে? বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেল মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়নে কোন ত্র“টির কথা বলেনি। মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ সঠিক হয়নি বলে কোন মন্তব্যও করেনি। মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের উপর আমি মন্ত্রী হিসেবে প্রভাববিস্তার করেছিÑ এ ধরনের কোন অভিযোগও বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেল উত্থাপন করেনি। মূল্যায়ন কমিটির কোন সদস্যও বলেননি যে, আমি তাদের কাছে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য তদবির করেছি। তাহলে বিশ্বব্যাংক পরামর্শক নিয়োগে আমার সম্পৃক্ততা খোঁজা এবং এফআইআর-এ মন্ত্রী হিসেবে আমার নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য বিশ্বব্যাংকের চেষ্টা ও চাপ কেন? এটা নিঃসন্দেহে একটি অসৎ উদ্দেশ্য বলে প্রতীয়মান। কোন অজানা (ঐরফফবহ) উদ্দেশ্যে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করে সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করা, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা। বাংলাদেশ ও বিশ্ববাসীকে আমার সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা দেয়ার জন্য এ উদ্দেশ্যমূলক অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। ইচ্ছে করে আমার সুনামক্ষুণœœ করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে দরপত্র মূল্যায়ন নিরপেক্ষ হয়েছে এবং সেটি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কোন অভিযোগ নেই, সেখানে মন্ত্রী হিসেবে আমার সম্পৃক্ততা আসে কিভাবে?

দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সাথে মন্ত্রীর সম্পৃক্ততার কথা বলা উদ্দেশ্যমূলক

াপ্যানেলের চূড়ান্ত রিপোর্টে উল্লেখিত জাতিসংঘের দুর্নীতি বিরোধী কনভেনশনে ঘুষের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছেÑ তাতে মন্ত্রী হিসেবে আমাকে কোনভাবেই সম্পৃক্ত করা যায় না। এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা ডাইরি লেখার বিষয়ে প্যানেল রিপোর্টে কোন সুনির্দিষ্ট বক্তব্য নেই। যদি এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ শাহ কিছু লিখে থাকেন, কিছু অনৈতিক চিন্তা করে থাকেন, সেটা তাঁর বিষয়। তাঁর কাছে আমি কোন অনৈতিক দাবী করিনি। তিনি বা তাঁর কোন প্রতিনিধি কোন অনৈতিক প্রস্তাব আমায় দেননি। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে এ যাবত পত্রিকায় যত অসত্য রিপোর্ট হয়েছেÑ তাতে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তার বরাত দিয়ে কেউ লেখেনি যেÑ রমেশ শাহ বলেছেন তাঁর কাছে আমি অনৈতিক দাবী করেছি। রমেশ শাহ’র ডাইরির লেখা তাঁর নিজের। কেউ যদি আমার নাম ব্যবহার করে কাউকে ব্লাকমেইল করে কিংবা আমার নাম ভাঙ্গিয়ে কোন অনৈতিক কিছু দাবী করে থাকেÑ সেজন্য আমি দায়ী নই। অনেক সময় পত্রিকায় বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে চাঁদা দাবীর খবর দেখা যায়Ñ এর অর্থ এই নয় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি চাঁদাবাজ। সত্য-মিথ্যা জানিনা, পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, দুদকের প্রাক্তন চেয়ারম্যানের নামে কোন ব্যক্তি টাকা তুলেছেন এবং টাকা ব্যাংকে জমা রেখেছেন। সেই ব্যক্তিটি ধরাও পড়েছে। এ বিষয়ে দুদকের সম্মানিত চেয়ারম্যানকে ভুল বোঝা সমীচিন নয়। চেয়ারম্যানকে বিতর্কিত করাও উচিত নয়। আমার ক্ষেত্রে এরকম কিছু ঘটে থাকলে তাতে আমি দায়ী নই। শুধুমাত্র জাতিসংঘের দুর্নীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী নয়, কোন আইনেই আমি কারো ডাইরি লেখার কারণে অভিযোগে জড়িত হই না।

মন্ত্রীকে কেন আসামী করা হবে?

াকেন দুদক আমাকে মন্ত্রী হিসেবে, মন্ত্রণালয়ের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে আসামী করেনিÑ এটাই প্যানেলের চূড়ান্ত রিপোর্টের মূল বক্তব্য। আমার প্রশ্ন, মন্ত্রী হওয়ায় আমাকে কেন আসামী করা হবে? মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়ন সঠিক হয়নিÑ বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের কোন অভিযোগ নেই। অর্থাৎ এটা পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়ন সঠিক হয়েছে। মন্ত্রী কার্যাদেশ প্রদানে চূড়ান্ত অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ নয়, চূড়ান্ত অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত- মন্ত্রিসভা কমিটি। মন্ত্রী মূল্যায়ন কমিটির সদস্য নয় এবং টেন্ডার মূল্যায়নে কাউকে সুযোগ দেয়ার কোন অথরিটিও নয়। মন্ত্রী হিসেবে কোন নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আমি মূল্যায়ন কমিটির কাউকে প্রভাবিত করেছি, তদবির করেছিÑ বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের কোন অভিযোগও আমার বিরুদ্ধে নেই, সম্মানিত প্যানেলও এ ধরনের অভিযোগ করেননি। বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণ করতে গিয়ে মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়নে হলক্রোর পরিবর্তে এসএনসি-লাভালিন প্রথম হয়। এটা প্রমাণ করে- এসএনসি-লাভালিনের ব্যাপারে মন্ত্রী হিসেবে আমার কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। তাহলে কোন যুক্তিতে, কোন কারণে মন্ত্রী হিসেবে আমাকে মামলায় আসামী করা যাবে। বিশ্বব্যাংক বলেছেÑ বলেই কি আমি মন্ত্রী হওয়ার কারণে আমাকে দোষী হতে হবেÑ এ প্রশ্ন আপনাদের সবার কাছে সবিনয়ে রাখছি।
অর্থায়ন স্থগিত করা যে ভুল হয়েছে- তা বিশ্বব্যাংক বুঝতে পেরেছে

া বিশ্বব্যাংক দাতা সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার। কাজ করতে গিয়ে কোন দাতাসংস্থা ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। আমি মনে করি, অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল যে বিশ্বব্যাংকের ভুল সিদ্ধান্ত, এটা তারা বুঝতে পেরেছেন। বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রশাসনের বাংলাদেশের জন্য সর্বোত সহযোগিতাই তাই প্রমাণ বহন করে। তাই হয়তো, পদ্মা সেতুর জন্য প্রতিশ্রুত সমপরিমাণ অর্থ অন্য প্রকল্পে দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক প্রস্তাব দিয়েছে। শুধু মুখ রক্ষার জন্য তারা দুদকের তদন্তে শুধুমাত্র আমাকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের চূড়ান্ত রিপোর্ট বিশ্লেষণ করলে দেখবেনÑ রিপোর্টে তারা প্রমাণ দিয়ে নয়, পরোক্ষভাবে দুদকের তদন্তে সহায়তা অব্যাহত রাখবেন। এর মানে তাদের কাছে কোন অকাট্য প্রমাণ নেই। বিশ্বব্যাংকের এ ভুল সিদ্ধান্তে মন্ত্রী হিসেবে আমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে, বাংলাদেশকে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে- এ বিষয়টি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য, নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য- এ ফরমায়েসি চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। একজন আন্তর্জাতিক সম্মানিত বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে এ ধরনের ফরমায়েসি ও উদ্দেশ্যমূলক রিপোর্ট কাম্য ছিল না।

এসএনসি-লাভালিনের মিস কন্ডাক্টের সাথে মন্ত্রীর সম্পর্ক নেই
া বিশ্বব্যাংক এসএনসি-লাভালিনকে ‘মিস কন্ডাক্ট’ করার দোষে দোষী সাব্যস্ত করেছে। আমি মন্ত্রী হিসেবে কোনক্রমেই এসএনসি-লাভালিনের মিস কন্ডাক্ট-এর সাথে সম্পৃক্ত নই। এসএনসি-লাভালিনের যেসব কর্মকর্তা সৌজন্যমূলকভাবে আমার সাথে দেখা করেছেন- তাঁরা বলতে পারবেন না, আমি তাঁদের কাছে অনৈতিক দাবী করেছি। সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী যিনি তাঁদের সাথে আমার দেখা করিয়েছেন- তিনিও বলতে পারবেন না আমি তার কাছে, তাঁর উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের কাছে কোন অনৈতিক দাবী করেছি এবং সেতু বিভাগের কোন কর্মকর্তাও বলতে পারবেন না যে আমি কারো কাছে কোন অনৈতিক দাবী করেছি। কাজেই এসএনসি-লাভালিনের কোন কর্মকর্তার কাছে আমার অনৈতিক দাবীর প্রশ্ন অবান্তর, অসত্য ও প্রতারণা।

এসএনসি-লাভালিনের কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী বিতর্কিত
া আপনারা জানেন, এসএনসি-লাভালিন শুধু বাংলাদেশে নয়, লিবিয়া, ভারত, কম্বোডিয়ায় ব্যবসা করতে গিয়ে অসদাচরণ করেছে। পদ্মা সেতুসহ সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কোম্পানিটির সাথে বিশ্বব্যাংকের সমাঝোতার ভিত্তিতে এসএনসি-লাভালিন দোষ স্বীকার করেছে এবং শাস্তি মেনে নিয়েছে। উল্লেখ্য, এ সমঝোতা হয়েছে শর্তসাপেক্ষে এবং শর্ত গোপনীয়। কতিপয় পত্রিকার সংবাদে দেখা যায়, এসএনসি-লাভালিনের রমেশ শাহ ও ইসমাইলের মধ্যে একজন রাজসাক্ষী হচ্ছেন- এটা গোপনীয় শর্তের একটা কিনা- কে বলবে? বিশ্বব্যাংক ও এসএনসি-লাভালিনের সমঝোতায় প্রমাণ হয় না যে, আমি পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের আশঙ্কার সাথে সম্পৃক্ত। এ ধরনের একটি সেনসেশনাল, অসত্য ও বানোয়াট খবর বাংলাদেশের কতিপয় পত্রিকা প্রচার করে। কতিপয় পত্রিকার এ প্রচারণা আমার এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ করেছে। সরকারকে একটি অন্যায় কাজে সম্পৃক্ত করতে চাইছে। দুদকের উপরও অন্যায় চাপ সৃষ্টি করছে। নানা অসত্য সংবাদ প্রচার করে দুদককে বিভ্রান্তিতে ফেলার অপচেষ্টা করছে। এ ধরনের অপচেষ্টা পরিকল্পিত বলে আমার কাছে প্রতীয়মান- এ দিকটি একটু ভেবে দেখার জন্য সবাইকে সবিনয় অনুরোধ করছি।

বাংলাদেশের কতিপয় পত্রিকার নেতিবাচক প্রচারণা মন্ত্রী হিসেবে আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ করেছে
াপদ্মা সেতুতে দুর্নীতির আশঙ্কায় আমাকে জড়ানো যে পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক বা বিশ্বব্যাংকের ঋণ না দেয়ার একটি অযুহাত- তা আমার পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও আমাদের দেশের মিডিয়ার কেউ আমার কথায় কর্ণপাত করেননি। আমাদের কতিপয় জাতীয় পত্রিকা সত্যের দিকে ধাবিত না হয়ে বরং বিশ্বব্যাংকের অন্যায় সিদ্ধান্তে আমাকে জড়িয়ে কার্টুন প্রচার করে, গল্প লেখা শুরু করে। বরং আমাদের পত্রিকাগুলোর লেখায় আমাকে আরো অতিমাত্রায় জড়ানোর চেষ্টা করে। বিশ্বব্যাংকের ইচ্ছের সাথে আমাকে সম্পৃক্ত করে ফেলে। কোন অন্যায়, কোন অনিয়ম না করা সত্বেও আমার দিকে সন্দেহের তীর ছোঁড়া হয়। বিনা বিচারে আমার ট্রায়াল চলে পত্রিকায় এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এটা যে কত দুঃসহ বিড়ম্বনা, কত সীমাহীন অপমান- তা ভুক্তভোগীরা ভাল জানেন। 
া কানাডিয়ান কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনের ওপর বিশ্বব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও এসএনসি-লাভালিনের ‘মিস কন্ডাক্ট’ বিষয়ে দোষ স্বীকারের যে সূত্র ধরে দেশের অধিকাংশ পত্রিকা অসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পত্রিকাগুলো কাল্পনিকভাবে, বিশ্বব্যাংকের পূর্বের অসত্য অভিযোগ টেনে এনে মন্ত্রী হিসেবে আমার নাম ব্যবহার করে লাল অক্ষরে ব্যানার করেছে। কারো সাথে হোটেলে বৈঠক, কারো মুখোমুখি কথা বলা, নৈশ্যভোজে অংশ নেয়া ইত্যাদি কল্পনাপ্রসূত বিষয় নতুনভাবে সংযুক্ত করে খবর প্রকাশ করেছে। অথচ আমি কারো সাথে এককভাবে বৈঠক করিনি, কারো সাথে কোন হোটেলে দেখা করিনি। কোন ক্লাবে কারো সাথে ডিনার করিনি। উল্লেখ্য, আমি কোন ক্লাবের মেম্বার নই। কোন ধরনের ক্লাবে যাওয়ার অভ্যাস আমার নেই। টাকা হলে মানুষের যে বদঅভ্যাস দেখা দেয়- এর কোনটাই আমাকে আজও স্পর্শ করতে পারেনি। তবুও কতিপয় পত্রিকা নেতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশ ও সম্পাদকীয় লেখে আমাকে দোষী সাব্যস্ত- ও বিচারে ট্রায়াল করে ফেলেছে। এ ধরনের খবর ইতোপূর্বেও প্রকাশ করে পত্রিকাগুলো জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস নিয়েছে। আমাকে অনাহুত ও পরিকল্পিতভাবে পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতির আশঙ্কা সাথে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ করা সত্বেও, বিবৃতি দিয়ে, চিঠি দিয়ে সত্য ঘটনা জানানো হলেও একইভাবে নেতিবাচক খবর প্রকাশ অব্যাহত রাখা নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যমূলক, বিভ্রান্তিমূলক এবং সাংবাদিকতার নৈতিকতাকে অমান্য করার সামিল।

কানাডার ১০০০ পৃষ্ঠার পুলিশ রিপোর্টে বাংলাদেশের পত্রিকার কাটিং সংযুক্ত
াএটা লক্ষণীয় যে, আমি যোগাযোগমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর অভিযোগ তৈরির সেই স্বার্থান্বেষী মহল থেমে ছিল না। তারা বরাবরই আমার খুঁত ধরার কাজে লেগেছিল। বেনামি চিঠি অব্যাহত ছিল। কতিপয় পত্রিকা আমার বিরুদ্ধে অসত্য রিপোর্ট প্রকাশও অব্যাহত রেখেছিল। অতীতের অসত্য রিপোর্টগুলো কতিপয় পত্রিকা নতুনভাবে প্রকাশ করে। এবারও অসত্য খবর প্রকাশ অব্যাহত ছিল। কোন একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক আমাকে অবহিত করেছিলেন, পদ্মা সেতুর বিষয় নিয়ে কানাডার আদালতে যে শুনানি হয়েছে তাতে ১০০০ পৃষ্ঠার পুলিশ রিপোর্টে আমার বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে যেসব অসত্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তার সংবাদ ইংরেজি অনুবাদ করে ও ইংরেজি পত্রিকার কাটিংসহ অন্তর্ভুক্ত আছে। শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা টেনে এনে মিথ্যা অভিযোগে সেতু নির্মাণে অর্থায়ন স্থগিত করে। পদ্মা সেতু নির্মাণকে বিলম্বিত করে। কোন দুর্নীতি হয়নি, অথচ দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের আশঙ্কায় ঋণ সহায়তা বন্ধ বিশ্বব্যাংকের ইতিহাসে, পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম। আমি মনে করি, অসত্য অভিযোগ ও বাংলাদেশের কতিপয় পত্রিকার অপসংবাদে প্রভাবিত হয়ে বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া সঠিক হয়নি।

গণতন্ত্রের মতো সুরুচি, সুনীতি ও সুচিন্তার যোগফল হলো সাংবাদিকতা
াআজ বাংলাদেশে গণমাধ্যম বড় শক্তি, শিক্ষার অন্যতম বাহন। প্রিন্টমিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে পত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধ লেখা, সংবাদ ও টকশো আলোচনা শিক্ষার বাহন হিসেবে কাজ করছে। এসব লেখা ও আলোচনায় প্রায়ই বিজ্ঞ ও সিনিয়র সাংবাদিকদের বক্তব্যে বর্তমান মিডিয়া জগতের উন্নয়নের কথা যেমন শুনি, তেমনি কতিপয় সাংবাদিক ও মিডিয়ার অপসংবাদের কথাও জানি। সিনিয়র সাংবাদিকদের বক্তব্যের মূল মর্মবাণী হলো- বর্তমানে সংবাদপত্রের বিকাশের পাশাপাশি সংবাদপত্রে এক ধরনের অপসংবাদ ও সাংবাদিকতা দেশের সংবাদপত্র জগতকে বিতর্কিত করছে। সংবাদপত্র জগতে এক ‘অপ সংস্কৃতি’র জন্ম দিচেছ। কতিপয় সাংবাদিক, সাংবাদিকতার সত্য পেশাকে কলুষিত করে একে অন্যায় ও অবৈধ আয়ের উৎস হিসেবে গ্রহণ করছে, মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করছে। সুরুচি, সুনীতি ও সুচিন্তার যোগফল যেমন গণতন্ত্র, তেমনি এই গণতন্ত্রের পুরোপুরি প্রয়োগই সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও দেশের উন্নয়নের নিয়ামক শক্তি। অসত্য ও ব্ল্যাকমেইলিং রিপোর্টের প্রভাব সমাজ, দেশ ও ব্যক্তির জন্য কতটুকু ক্ষতিকর ও এর প্রভাব কতটুকু বিস্তৃত ভেবে দেখার জন্য আপনাদের অনুরোধ করছি। আমি মূলত অপসংবাদ ও অপসাংবাদিকতার শিকার হয়েছি।
সংবাদপত্র উন্নয়নের নিয়ামক
া আমরা জ্ঞান হওয়ার পর থেকে শুনে এসেছি- সংবাদপত্র ও সাংবাদিক জাতির বিবেক। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির নিয়ামক। শিক্ষার পথপ্রদর্শক। দেশের সংস্কৃতি বিকাশের বাহক। দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নের হাতিয়ার। সত্য প্রকাশে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাই আমরা যখন দেখি, কতিপয় সংবাদপত্র ও সাংবাদিক অসত্য খবর প্রকাশ এবং এ অসত্য খবরকে উপজীব্য করে ধারবাহিকভাবে ও ক্রমাগত লিখে চলেছেন, টকশো’তে অবলীলাক্রমে অসত্য লেখার উপর ভিত্তি করে কথা বলেন, আলোচনা চালিয়ে যান- তখন সত্যি অবাক হই, চিন্তিত হই। দুঃখ-বেদনায় ভারাক্রান্ত ও আহত হই। ভাবি, অসত্য কি পৃথিবী নাচিয়ে বেড়াবে? সত্যকে কি কেউ সহায়তা করবে না? শক্তিশালী মিডিয়ার কাছে আমার অর্জিত সুনাম কি নষ্ট হবে? অসত্য বক্তব্য রাজত্ব করবে? ভাবি, এটাই মনে হয়, ইয়োলো জার্নালিজম। ইয়োলো জার্নালিজমের ফাঁদে আমাকে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকেই সফলও হয়েছেন। আবার ভাবি, মনে করি, সেই প্রবাদের কথা- ঞৎঁঃয ংযধষষ ঢ়ৎবাধরষ.

আমি অসত্য খবরের ভিকটিম
া আমি বিশ্বাস করি, সাংবাদিকতা একটি দায়িত্বশীল পেশা। আমি সাংবাদিকদের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। এ প্রসঙ্গে- ভলটেয়ার এর একটি বিখ্যাত উক্তি টেনে আমি বলতে চাই- ও ফরংধঢ়ঢ়ৎড়াব ড়ভ যিধঃ ুড়ঁ ংধু, নঁঃ ও রিষষ ফবভবহফ ঃড় ঃযব ফবধঃয ুড়ঁৎ ৎরমযঃ ঃড় ংধু রঃ. ভল্টেয়ার-এর বিখ্যাত উক্তিটি আমি সমর্থন করি, ব্যক্তিগতভাবে আমি অনুসরণ করি। মানুষের কথা বলার অধিকার আছে, পত্রিকায় খবর প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, সেটা সত্য হোক আর অসত্য হোক। কিন্তু অন্যায়, অসত্য ও ভিত্তিহীন খবর প্রচার না করাই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের শিষ্টাচার বলে মনে করি। অসত্য সংবাদের প্রতিবাদের অধিকার সবার রয়েছে। উইলিয়াম সেক্সপিয়ারের ভাষায়- ঞযব হধঃঁৎব ড়ভ নধফ হবংি রহভবপঃ ঃযব ঃবষষবৎ. অনৈতিক খবর বা ইয়োলো জার্নালিজম যেমন সংবাদপত্রের সুনাম, সুখ্যাতি নষ্ট করে, তেমনি উন্নয়ন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে। দেশের অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা উন্নয়ন কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়। দেশের সার্বিক উন্নয়ন তরান্বিত করে। সংবাদপত্র একজন মানুষের ইমেজও তৈরি করতে পারে। দেশের উন্নয়নে ব্যক্তির ইমেজকে কাজে লাগাতে পারে। আবার এই সংবাদপত্র একজন নির্দোষ, নিরাপরাধী মানুষকে দোষী ও অপরাধী হিসেবে তাকে উপস্থাপন করতে পারে। তা করে তার ইমেজও নষ্ট করে। আমি নিজে পত্রিকার সেই নেতিবাচক ও অসত্য খবরের ভিকটিম।

মন্ত্রীর অফিস সংস্কার ও গাড়ি ক্রয় নিয়ে পত্রিকার অসত্য রিপোর্ট এবং আমার সম্পর্কে জনমনে ভুল ধারণা 
াপ্রকৃতপক্ষে দেশের কতিপয় পত্রিকার পরিকল্পিতভাবে পুন:পুন: অসত্য রিপোর্ট প্রকাশ করে আমার সম্পর্কে জনমনে ভুল ধারণা সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। যোগাযোগ মন্ত্রী হওয়ার পর, যোগাযোগ মন্ত্রীর অফিস মেরামত ও গাড়ি ক্রয় নিয়ে অসত্য রিপোর্ট প্রকাশ করে আমাকে বিতর্কিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মন্ত্রীর অফিস মেরামত ছিল একটি রুটিন ওয়ার্ক। গণপূর্ত বিভাগ আমাকে জানিয়েছিল, অফিস মেরামত বাবদ ব্যয় হয়েছিল আনুমানিক ৭ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। অথচ কতিপয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এই ব্যয় ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। আর যে গাড়ি নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সে গাড়ি আদৌ ক্রয় করা হয়নি।

পত্রিকার অসত্য রিপোর্ট নিয়ে সংসদে উত্তপ্ত আলোচনা
াআপনাদের মনে আছে, জাতীয় সংসদের স্পীকার কতিপয় পত্রিকার ভুল রিপোর্টের প্রেক্ষিতে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে সংসদের একটি অনাকাক্সিক্ষত বিষয় রুলিং দিয়ে নিস্পত্তি করেছেন। পত্রিকার ভুল রিপোর্ট সংক্রান্ত কিছু বিষয়- আমার বেলায়ও ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। কতিপয় পত্রিকার অসত্য খবরের উপর ভিত্তি করে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ- সমালোচিত হয়েছেন, এরকম মিথ্যা সমালোচনার শিকার আমি নিজেও। অনেকেই জানেন, ১৮ আগস্ট, ২০১১ তারিখে সংসদে পত্রিকার একটি ভুল রিপোর্ট নিয়ে আমাকে দোষারোপ করা হয়েছিল। সংসদে উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে। অথচ এ দোষারোপের বিষয়ে আমার কোন ভুল ছিল না। অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দের কারণে গত বছর সড়ক উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কারের অনেক কাজ সময়মত শেষ করা যায়নি। অতি বর্ষার কারণে কিছু সড়কে যাতায়াতে সাময়িক অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছিল। এ নিয়ে সংসদে আলোচনার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি সারসংক্ষেপ পাঠাই। ঐ সারসংক্ষেপের বিষয়ে কতিপয় পত্রিকা অসত্য খবর পরিবেশন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো সারসংক্ষেপে কারো প্রতি কোন অসৌজন্যমূলক কথা ছিল না। সারসংক্ষেপের মূল কপিটি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আছে। এর একটি ছায়ালিপি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংরক্ষিত আছে। আমি যখন যোগাযোগ মন্ত্রী, সে সময়ে আমার সম্পর্কে কতিপয় পত্রিকা ঢালাওভাবে অসত্য খবর প্রকাশ করে। এ অসত্য খবরকে ভিত্তি করে টকশো’তে আলোচনা হয়। পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা হয়। অথচ খবরটি সঠিক ছিল না। অসত্য খবরই পরবর্তীকালে আবার খবর সৃষ্টি করে বের করা হয়েছে। মনে হয়েছে- এটা আমার বিরুদ্ধে একটি সংঘবদ্ধ প্রপাগান্ডা।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আমাকে দায়ী করে পত্রিকায় রিপোর্ট

া আমি যোগাযোগ মন্ত্রী থাকাকালীন সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে কতিপয় পত্রিকা বহু লেখা লিখেছে, কার্টুন ছেপেছে, সম্পাদকীয় লিখেছে। এখনো সড়ক দুর্ঘটনা হয়, দুর্ঘটনা ঘটে- কিন্তু পত্রিকাগুলো এ নিয়ে এখন আর তেমন লিখে না। সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বের সর্বত্র ঘটে থাকে। আফ্রিকার পরে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার বেশি। এ নিয়ে আলোচনা, উদ্যোগ সর্বত্র পরিলক্ষিত। সড়ক দুর্ঘটনা কারো কাম্য নয়। আপনারও না, আমারও না। মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মিশুক মুনীর মারা যাওয়ার পর কতিপয় সুধীজনরা যেভাবে টিভির পর্দায় আমাকে জড়িয়ে কথা বলেছেন- তা আজও আমার মনে আছে। যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে কতিপয় বিশিষ্ট সুধীজন আমার পদত্যাগ চেয়েছিলেন। শেষাবধি আমি পদত্যাগও করেছি। কিন্তু যে দুর্ঘটনার কারণে তাঁরা আমার পদত্যাগ চেয়েছেন- সেজন্য আমাকে কি সরাসরি দায়ী করা যায়?। তদন্তে দেখা গেছে, দুই গাড়ির ড্রাইভার দু’জনের অসর্তকতা ও অতিবৃষ্টির কারণে ভিজিবিলিটি না থাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঐ সড়কে কোন খানা-খন্দক কিংবা গর্ত ছিল না, কোন সমস্যা ছিল না। যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে আমাকে দায়ী করে পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে। গুরুত্ব বাড়াতে শহীদ মিনারে ঈদের দিনে শিশুদের গলায় ‘মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই’- ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। একথা ঠিক দেশের দুই বিশিষ্ট ব্যক্তির অকাল মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। সেজন্য আমি মর্মাহত হয়েছি। দুঃখ পেয়েছি। যে ঈদের আগে মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে, পরের ঈদে দেশে এর চেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু পরের ঈদে দুর্ঘটনার হার বেশি এবং মর্মান্তিক হলে তা নিয়ে হৈ চৈ হয়নি। তাহলে কেন বা কি উদ্দেশ্যে আমি যোগাযোগ মন্ত্রী থাকাকালীন এতো বাড়াবাড়ি, এতো লেখালেখি করা হয়েছে? বিষয়টি দেশবাসীকে ভেবে দেখতে সবিনয়ে অনুরোধ করছি। উল্লেখ্য, আমার বাবা-মা, ছাত্রজীবনে আমার কোন শিক্ষক কখনো আমার গায়ে হাত দেননি। অথচ কতিপয় পত্রিকা মিডিয়ার শক্তির অসৎ ব্যবহার করে আমার বিরুদ্ধে অসত্য সংবাদ প্রকাশ করেছে, আমার সুনাম নষ্ট করেছে। আমাকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করেছে।

বিশ্বের জনপ্রিয় ব্যক্তিদের দুর্ঘটনার মৃত্যুতে কোন মিছিল হয়নি

া বিশ্বের অনেক জনপ্রিয় ব্যক্তিবর্গ-বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির, ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরি, নাইজেরিয়ার নেতা এডোগোক আদেলাবুর, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জুসেলিনো কুরিটসেক, সোভিয়েতের নেতা ম্যাসহরেভ, নভোচারী পিট কনবার্ড ও প্রিন্সেস ডায়না সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেও সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কেউ পদত্যাগ চায়নি। হৈ চৈ করেনি। শিশুদের গলায় পদত্যাগ চাই ব্যানার ঝুলায়নি। শহীদ মিনারে যায়নি। কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক মিশুক মুনীর দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর শহীদ মিনারে গিয়ে যোাগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে আমার পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের এক সময়ের ডাকসাইটে অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমান সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরও বুদ্ধিজীবী বা খোদ বিরোধীদল বিএনপি’র কেউ যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ চায়নি। আমি জানি, সড়ক দুর্ঘটনার একটি মৃত্যু, একটি পরিবারকে নিঃস্ব করে দেয়। এ দুঃখবোধ ও ক্ষতি একটি পরিবারকে সারাজীবন বহন করতে হয়। তাই সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। আইনের প্রয়োগ নির্বিঘœ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আন্দোলন আমার, আপনার আন্দোলন। আমাদের সবার আন্দোলন। 
কালকিনি-তে ‘অতিথি ভবন’ নির্মাণ নিয়ে পত্রিকায় ব্যানার হেডলাইন করে অসত্য খবর প্রকাশ
া আমার বাড়ি মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার ডাসার থানায়। আমি পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করি। স্বভাবতঃই গ্রামের বাড়ি আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। দীর্ঘদিন ধরে আমি এ বিষয়ে খুব একটা মনোযোগ দেইনি। ডাসার গ্রামটি এখন আর আগের দূরাবস্থায় নেই। এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। বিশাল বিলের জায়গায় রাস্তা হয়েছে। কুপির জায়গা বিজলী বাতি অবস্থান নিয়েছে। ডাসারে আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সহায়তায় গড়ে উঠেছে স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা। এসব প্রতিষ্ঠান আবাসিক মর্যাদা নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাজার হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলার সুষ্ঠু প্রয়োগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ডাসার থানা। ফলে, এলাকা এখন উন্নয়নের ছোঁয়া পেয়ে কর্মতৎপর হয়ে উঠেছে। ডাসারের এই উন্নয়নে দেশ-বিদেশের বহু গুনীজন এলাকায় যায়। সরকারি বড় বড় কর্মকর্তারা স্কুল-কলেজ পরিদর্শনে আসে। সার্বিক অবস্থায় এলাকার গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এছাড়া, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের কারণে রাজধানী ঢাকা থেকে কালকিনি যেতে সময় খুব কমই লাগে। সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নেই- ডাসারে একটি অতিথি ভবন নির্মাণের। মানে আমি যখন বাড়ি যাবো, তখন এই ভবনে বাস করবো- নিজের জন্য হলেও, বাকী সময়ে দেশের প্রখ্যাত ব্যক্তিগণ আমার এলাকায় গেলে এই অতিথি ভবনে থাকবেন। এই উদ্দেশ্য নিয়ে ডাসারে বাড়ি নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এই বাড়ি নির্মাণ ২০০৫ সালে শুরু হয়ে ২০১২ সালে সমাপ্ত হয়। এ বাড়ি নির্মিত হয়েছে শেখ হাসিনা একাডেমী এন্ড উইমেন্স কলেজের পাশে। এ বাড়ি নির্মাণের ব্যয় আমি কর পরিশোধিত অর্থ থেকে বহন করেছি। যা আমার আয়কর রির্টানে প্রতিফলিত রয়েছে। ডাসারে আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে একটি বাড়ি নির্মাণের সামর্থ আমার আছে- এটা নিশ্চয়ই দেশবাসী বিশ্বাস করবেন। অথচ এই বাড়ি নির্মাণ নিয়ে দেশের একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ব্যানার হেডে, বাড়ির ছবি দিয়ে আমার সম্পর্কে নেতিবাচক পন্থায় নাতিদীর্ঘ রচনা লিখেছে। পুরো রিপোর্টে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। 
সাকো’র ব্যবসা জড়িয়ে পত্রিকার অসত্য রিপোর্ট

া প্রায়শঃই অসত্য তথ্য দিয়ে আমার প্রতিষ্ঠিত সাকো এবং আমাকে জড়িয়ে পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশন করা হয়। মিডিয়ার শক্তিকে ব্যবহার করে মানুষকে, পাঠককে বিভ্রান্ত করা হয়। সংবাদ এমনভাবে পরিবেশন করা হয়- যাতে পাঠকের কাছে অসত্য খবরও বিশ্বাসযোগ্য হয়। আমি অনেক সময় লক্ষ্য করেছি, পত্রিকার পরিবেশিত সংবাদ অসত্য তথ্যের উপর তৈরি। বিদ্যুৎখাতে চায়নার কোন প্রতিষ্ঠান বিড করলেই আমার নাম, সাকো’র নাম জড়িয়ে রিপোর্ট করা হয়। বিদ্যুৎখাতে সাকো’র প্রতিটি টেন্ডার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার আগে এমনভাবে রিপোর্ট করা হয়, যাতে প্রক্রিয়াটি ভণ্ডুল হয় এবং এর মাধ্যমে অন্য দরদাতার স্বার্থ অর্জিত হয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, পত্রিকা প্রভাবিত হয়ে, অন্যের জন্য কাজ করে এবং আমার প্রতিষ্ঠান ও আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমার এবং আমার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের সুনামকে বিনষ্ট করে।

আমার সম্পর্কে পত্রিকার আনা অন্যান্য অভিযোগ

া কোন কোন পত্রিকা লিখেছে, প্রথম জীবনে আমি নাকি সরকারি চাকরি হারিয়েছিলাম। তা আদৌ সত্য নয়। আমার অধঃস্তন কর্মকর্তার অসর্তকতার কারণে একটি তথ্যগত ভুলের অভিযোগ উঠলে, তদন্তে ও চূড়ান্ত বিচারে তা প্রমাণিত হয়নি। পরবর্তীতে আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় এসেছি। আমার প্রটোকল অফিসারের অসর্তকতার জন্য পাসপোর্ট নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছিল তাতে আমি বিতর্ক এড়াতে পদত্যাগ করলেও, তখন কেউ আমার প্রশংসা করেনি। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এসবি’র যে অনুসন্ধান রিপোর্ট খুঁজে বেরা করা হয়েছিল তাতে দেখা যায়, ভুলটি হয়েছিল- আমার প্রটোকল অফিসারের অজ্ঞতার কারণে।

স্বাক্ষর জাল বা সুপার ইম্পোজ করে আমার নামে অপপ্রচার

া ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের সময় আমার স্বাক্ষর জাল করে, সুপার ইম্পোজ করে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী একটি অপপ্রচার শুরু করে। আমার স্বাক্ষর জাল করা চিঠিটি নিয়ে যে এ সময় বাংলাবাজার পত্রিকায় রিপোর্ট করা হয়। এই চিঠির বিষয়টি বিএনপি আমলে প্রণীত শ্বেতপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চিঠিতে আমি চায়নার একটি কোম্পানিকে লিখেছি যে, আমার সাথে যোগাযোগ করলে বাংলাদেশের যে কোন কাজ পাওয়া যাবে। আমার সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। এ ধরনের প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্য আমাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নেতিবাচক উপস্থাপন এবং জনগণের কাছে মেসেজ দেয়া যে আমি অন্যায়ভাবে কাজে পারদর্শী। এই চিঠি নিয়ে তদন্তে আমার সম্পৃক্ততা নেই- বলে প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ উল্লেখিত স্বাক্ষর আমার ছিল না। আবার ১/১১-এর সময় আমার স্বাক্ষর ইম্পোজ করে আওয়ামী লীগ থেকে আমার পদত্যাগপত্র প্রচার করা হয়। এবার ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতুর মূল কাজের ঠিকাদার নিয়োগ নিয়েও সাকো’র এক কর্মকর্তার স্বাক্ষর ইম্পোজ করে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়। আমাকে বিভিন্ন অবৈধ কাজের সাথে সম্পৃক্ত করার অপচেষ্টা নেয়া হয়। শেষোক্ত বিষয়ে চিঠিটি নিয়ে তদন্ত করেও বিশ্বব্যাংক কিছু পায়নি। এ ধরনের নেতিবাচক চিঠি প্রকাশের আগে পত্রিকা আমার বা সাকো’র কোন বক্তব্য নেয়নি। মনে হয়, চিঠিটি প্রকাশ তাদের উদ্দেশ্য বেশি ছিল। অথচ সেই মিথ্যা স্বাক্ষরের অভিযোগ আজও আমাকে বইতে হচ্ছে। এটা কোন ধরনের বিচার, এটা কোন ধরনের অভিযোগ? ন্যায়বিচারের স্বার্থে কতিপয় সংবাদপত্রের এ অসত্য খবর প্রকাশ কি বন্ধ হবে না। বন্ধ করা যায় না?

বিভিন্ন সরকারের সময় তদন্ত

া বিভিন্ন সরকারের সময়ে আমাকে নিয়ে দুর্নীতি দমন ব্যুরো/দুদক একাধিকবার তদন্ত করেছে। ২০০১ সালে বিএনপি সরকারে এসে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন করে। শ্বেতপত্রে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে, পেপারকাটিংসহ আমার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। উল্লেখ্য, বিএনপি’র তৈরি শ্বেতপত্রে আমার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ পত্রিকার রিপোর্টের ভিত্তিতে করা হয়। বিএনপি সরকারের ৫ বছরে শ্বেতপত্রে অন্তর্ভুক্ত অভিযোগগুলো নিয়ে তদন্ত হয়। তদন্তে পত্রিকার সকল খবর অসত্য বলে প্রমাণিত হয়। আমি অভিযোগ থেকে মুক্তি পাই। অথচ এবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আমি যোগাযোগমন্ত্রী হলে পূর্বের কতিপয় পত্রিকা আগেকার অসত্য খবরগুলো আবার নতুন করে প্রকাশ করা শুরু করে। শ্বেতপত্রে প্রকাশিত পত্রিকার অভিযোগগুলো টেনে এনে আমাকে প্রতিনিয়ত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়, হচ্ছে। এ মিথ্যা রিপোর্টের অবসান হওয়া উচিত।

১/১১-এ আমার নামে নানা অভিযোগ

া ১/১১ ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি দুর্যোগপূর্ণ সময়। এ সময় বাংলাদেশকে একটি সঙ্কটকাল কাটাতে হয়েছে। অপরাজনীতি দিয়ে রাজনীতি বন্ধে অপচেষ্টা করা হয়েছে। নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। টোপ দিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দলের নেয়ার চেষ্টা হয়েছে। এ থেকে আমিও বাদ যাইনি। ১/১১ কুশীলবদের ডাকে সাড়া না দেয়ায় আমাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। এ সময় গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা আমাকে নতুন দল গঠনে ভূমিকা পালনে বাধ্য করার চেষ্টা করে। আমার আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেছি, আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুগত নই- এ ধরনের একটি জাল চিঠিও বের করা হয়, আমাকে ফাঁদে ফেলানোর জন্য। তখন আমি ১/১১ এর কুশলীদের বলি, “বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আমাকে রাজনীতিতে এনেছেন, যতদিন বেঁচে থাকবো- তাঁর সাথে থাকবো।” ফলশ্র“তিতে বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতার সাথে সন্দেহভাজন দুর্নীতির তালিকার দ্বিতীয় দফায় আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমার জন্মকাল থেকে ১/১১- পর্যন্ত আমার নামে নামে-বেনামে উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগসহ বিএনপি’র ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-০৭ মেয়াদের তদন্ত করা সব বিষয়ে অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগ আনা হয় বিএনপি’র সময় তৈরি ডযরঃব ঢ়ধঢ়বৎ-এর অন্তর্ভুক্ত মিথ্যা বিষয়গুলোর ওপরও। ১/১১ এর সময় এসব অভিযোগ তদন্তে একাধিক টীম কাজ করে। দীর্ঘ তদন্তে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হই। সকল অভিযোগ থেকে মুক্তি পাই। বিষয়টি পত্রে দুদক আমাকে জানিয়ে দেয়।

সর্বশেষ তদন্তে আমি নির্দোষ প্রমাণিত

া সর্বশেষ, ১/১১ তদন্তে আবার আমার সততা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। জন্ম থেকে ১/১১ পর্যন্ত বেনামে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাসহ নানা বিষয়ে উত্থাপিত অভিযোগ থেকে আমি মুক্তি পাই। আমার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা প্রমাণিত হয়। এরপরও এ বিষয়গুলো রেফারেন্স হিসেবে লেখা কি যুক্তিযুক্ত? অথচ কতিপয় সংবাদপত্র এ সত্যের দিকে না যেয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে অসত্যকে বারবার তুলে আনছেন। এটা কোন ধরনের নৈতিকতা।

মন্ত্রী থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ নিয়েও পত্রিকায় সমালোচনা

া পদ্মা সেতুর তদন্তের স্বচ্ছতার জন্য, মিডিয়া, সুধীজন ও শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে আমি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করি। গণতান্ত্রিক বিধান ও কনভেশনকে গুরুত্ব দেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে পদত্যাগের জন্য বলেননি। অথচ পদত্যাগের পর পত্রিকায় লেখা হলো- আমি দোষী না হলে পদত্যাগ করলাম কেন? পদত্যাগ করলেও দোষ না করলেও দোষ! যেখানে পদত্যাগের জন্য আমার প্রশংসা হবে, সেখানে এ ধরনের লেখা কিভাবে নেবেন। এর ভিত্তিতে টকশো’র আলোচনা কিভাবে দেখবেন? পত্রিকার ও মিডিয়ার এ ভূমিকা কতটুকু গ্রহণযোগ্য- বিষয়টি নতুনভাবে ভেবে দেখার আপনাদের অনুরোধ করছি।

বিভিন্নজনের কটাক্ষপূর্ণ বক্তব্য

া অনেক বিজ্ঞজন, সুধীজন মন্ত্রিসভা থেকে আমার পদত্যাগের আগে দম্ভোক্তি করে বলেছেন “আমরা কেউ ধোয়া তুলসী পাতা নই।” আমি ধোয়া বা আধোয়া তুলসি পাতা কিনা- জানিনা, এতটুকু জানি, আমি জীবনে কারো অপকার করিনি। কারো বিরুদ্ধে গিবত করিনি। কারো চরিত্র হনন করিনি। কাউকে গালাগাল করিনি। কারো বিরুদ্ধে মন্দ বলিনি। কারো বিরুদ্ধে অশোভন কথা বলিনি। কারো কোন ক্ষতি হোক- এরকম কাজ করিনি। জীবনে অন্যায় ও অসত্যের পথে হাঁটিনি। আবার সাম্প্রতিককালে অনেকে কটাক্ষ করে বলেছেন, “পদ্মা সেতুর অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে চাই না”। পদ্মা সেতুর অতীত ঘাটাঘাটি করলে দেখা যাবে, পদ্মা সেতু কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়িত হয়েছে। যেখানে বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রস্তুতি কাজ করতে ১০ বছর লেগেছে সেখানে পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে ২ বছরে সে কাজ শেষ করা হয়েছে। শুধুমাত্র একটি ষড়যন্ত্র পদ্মা সেতুকে ২০১৩ সালে চালু করার পথকে রুদ্ধ করেছে। এছাড়া আমি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে বিগত তিন বছরে যে কাজ করেছি- ১০০ বছরের মধ্যে ৫ বছর মেয়াদি যে কোন সরকারের সময় তা করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে যে প্রকল্পগুলো উদ্বোধন হচ্ছে- কার্যক্রম চলছে- তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমার প্রচেষ্টায় গৃহীত প্রকল্প। এ প্রকল্পগুলো এখন আমার বন্ধু বর্তমান যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং রেলমন্ত্রী এ্যাডভোকেট মুজিবুল হক উদ্বোধন করছেন, বাস্তবায়ন কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। আমি ব্যবসা করে সম্পদ অর্জন করেছি। নিয়মিত সরকারকে কর দেই। আমি দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলি। সৎভাবে ব্যবসা করে সম্পদ অর্জন কি অন্যায়? দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমি বর্তমান অবস্থানে এসেছি। রাজনীতি করি। এর অর্থ এই নয়, সব ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা অন্যায় পথে চলেন। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদও যে সৎ ও নৈতিকতাসম্পন্ন লোক হতে পারেন- তা কি বিশ্বাসযোগ্য নয়? শুধুমাত্র বিদেশি বা বিদেশি সংস্থা- বিশ্বব্যাংক কিছু বললে সত্য হবে, আর আমরা বললে সত্য হবে না- এ মানসিকতা পরিবর্তন দরকার। আমরাও পারি। আমরা সততা ও স্বচ্ছতার অধিকারী। আমি স্বচ্ছ ও সৎ মানুষ- এটা উচ্চস্বরে বলতে পারি।

সংবাদপত্র ও সাংবাদিক সমাজের কণ্ঠস্বর

া সংবাদপত্র ও সাংবাদিক সত্যের কণ্ঠস্বর। সমাজের বিবেক। সংবাদপত্র রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। যেখানে পরামর্শক নিয়োগে কার্যাদেশ দেয়া হয়নি, অর্থের ছাড় হয়নি- আমি কোন মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় জড়িত নই, যেখানে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক সম্পৃক্ত- সেখানে কিভাবে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সাথে আমার সম্পৃক্ততা খোঁজা হয়। প্রথমে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করে পদ্মা সেতুর মূল ঠিকাদার নিয়োগে আমার পূর্বতন প্রতিষ্ঠান সাকো জড়িত। তদন্তে তা অসত্য প্রমাণিত হয়। বিশ্বব্যাংকও নিজস্ব পদ্ধতিতে এ বিষয়ে খোঁজ নেয়। ফলে সে অভিযোগ থেকে বিশ্বব্যাংক সরে আসে। পরবর্তীতে পরামর্শক নিয়োগে আমার সম্পৃক্ততা খোঁজে। যেখানে মূল্যায়নে আমি সম্পৃক্ত নই- সেখানে আমি কিভাবে সম্পৃক্ত হই। যেখানে মূল্যায়ন সঠিক হয়েছে- যেখানে মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক সঠিক মনে করে- সেখানে আমার সম্পৃক্ততা খোঁজা কি উদ্দেশ্যমূলক ও অন্যায় নয়? বিষয়গুলো পূর্বাপর বিশ্লেষণ করলে দেখবেন- এটা একটি আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় একটি ষড়যন্ত্র। কতিপয় পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে অসত্য লেখাও এক্ষেত্রে কাজ করেছে। আমি গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। 
অর্থ দান করেছি- কারো কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নেইনি

া আমি সারাজীবন সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সর্বোচ্চ ইন্টিগ্রিটির সাথে দায়িত্ব পালন করেছি। পৃথিবীর বড় আদালত মানুষের বিবেক। এই বিবেককে সমুন্নত রেখে আমি দায়িত্ব পালন করেছি। অনেক সামাজিক ও কল্যাণমূলক কাজ করেছি। এলাকায় বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছি। কখনো কারো কাছে আর্থিক সাহায্য চাইনি। কেউ বলতে পারবে না- কারো কাছ থেকে, এমনকি নির্বাচনের সময় অর্থ সাহায্য নিয়েছি। বরং সব সময় অন্যকে, অসহায়দের আর্থিক সাহায্য করেছি, আর্থিক সাহায্য করে চলেছি। যোগাযোগ মন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর তিন বছরে পদ্মা সেতুর নির্মাণসহ অনেক ফাইওভার, সেতু, সড়ক ও রেলের উন্নয়নে নানা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতু চালু করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে গেছি। যেখানে বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে ১০ বছর লেগেছে, সেখানে ২ বছরে পদ্মা সেতুর প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করেছি। মূল সেতু নির্মাণের ঠিকাদার নিয়োগের কার্যক্রমও প্রায় শেষ করে এনেছিলাম।

আমি ইতিবাচক রাজনীতিতে বিশ্বাসী

া আমি ইতিবাচক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন ও সহমর্মিতার রাজনীতি করি। আমি উৎপাদন ও কল্যাণের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। আমার রাজনৈতিক জীবনে জনকল্যাণে নিবেদিত একজন মানুষ হিসেবে, জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করে চলেছি, করছি এবং ভবিষ্যতে করবো ইন্শাল্লাহ। গতানুগতিক রাজনীতির ধারায় আমি বিশ্বাসী নই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে একটি সুস্থ ও সেবামূলক ধারা আমি আমার এলাকায় গড়ে তুলেছি। জনসভা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দলীয় কোন্দলের ঊর্ধ্বে থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য দলের নেতাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন গড়ে তুলেছি। তাদেরকে সহঅবস্থানে, একমঞ্চে বসা ও বক্তৃতা দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। মাও সে তুং এর ভাষায়Ñ “শত পুষ্পের বিকাশ সম্ভব হোক, শত মতের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা চলুক”Ñ এ কথায় বিশ্বাস করি। আমি রাজনীতির নামে এলাকায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে দেইনি। কাউকে জ্বালাও, পোড়াও এর নামে এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ করতে দিইনি। আমি আমার এলাকার সকল রাজনৈতিক সহকর্মী এবং প্রতিপক্ষের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করেছি। সকল মতাদর্শের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল থেকে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টির জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করেছি। আমি আমার কাজের এই ধারা অব্যাহত রেখেই ভবিষ্যতেও কাজ করবো। অপরাজনীতি করা আমার পক্ষে অসম্ভব। ডিসরেলির ভাষায়- “ঞযবৎব রং হড় মধসনষরহম ষরশব ঢ়ড়ষরঃরপং.” আমি মহান আল্লাহকে হাজির নাজির মেনে বলছিÑ আমি শান্তিতে বিশ্বাসী। আমি পরম সহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী। আমি আমার নির্বাচনী এলাকার রাজনীতিতে এই উদার ও পরম সহিষ্ণু ধারা প্রবর্তনে সক্ষম হয়েছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও জননেত্রী শেখ হাসিনার ঐক্যমতের রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় আমি কাজ করে চলেছি।

মানুষের বড় শত্র“ মানুষ

া সৎভাবে, স্বচ্ছভাবে ব্যবসা করা এবং নিজেকে সমাজে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠা, সরকারি কাজে সততা ও স্বচ্ছতা প্রতিপালন, এলাকার শিক্ষা প্রসারে কাজ করা, এলাকার উন্নয়ন, ঐক্য ও পরমসহিষ্ণু রাজনীতি প্রবর্তন এগুলো মুখের কথা নয়, মুখের বুলি নয়, একথাগুলো বক্তৃতার জন্যও নয়, এগুলো বাস্তবায়ন করে, প্রদর্শন করে আমি প্রমাণ রেখেছি। আমার পুরো জীবন স্বচ্ছতার মোড়কে প্রতিষ্ঠিত। অথচ রাজনীতির কুটিল চরিত্র, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, ব্যক্তি বিদ্বেষী কতিপয় লোকের ষড়যন্ত্র, কতিপয় পত্রিকার অসত্য রিপোর্টে আমার এই সত্য, সুন্দর চরিত্রকে কালিমায় লিপ্ত করার অপপ্রয়াস চলছে। প্রবাদ আছে, “মানুষের সবচেয়ে বড় শত্র“ হচ্ছে মানুষ।” সাময়িকভাবে তাঁরা সফলও হয়েছেন। তবে সুবোধ ঘোষের ভাষায় বলবো- “মিথ্যা কথা শেষ পর্যন্ত কারো ক্ষতি করতে পারে না।” অন্য কথায়, ঞৎঁঃয চৎবাধরষং. আমাকে একজন বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ তাদের ষড়যন্ত্রে আমি যেভাবে চিত্রিত হচ্ছি, আমি আসলে সেই ব্যক্তি নই।

অসত্য খবর দ্রুত প্রচার পায়

া কার্যত নেতিবাচক খবর দ্রুত ছড়িয়ে যায় এবং অসত্য হলেও মানুষ তা বিশ্বাস করতে শুরু করে। আমি পদ্মা সেতুর কোন কার্যক্রমেই অনিয়ম করিনি। তবুও আমি এবং পদ্মা সেতু- অপসংবাদ, অপসাংবাদিকতা ও অপপ্রচারে আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। এতে আমার দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনাম বিনষ্ট হয়েছে। আমি এই অপবাদ থেকে মুক্তি চাই। আমি আবারো আপনাদের নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে চাই, পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগসহ কোন অনিয়মে আমি জড়িত নই। পদ্মা সেতুর কাজটি দ্রুত এবং ডিসেম্বর/২০১৩ এর মধ্যে চালু করার টার্গেট বাস্তবায়নে কাজ করেছি। বলতে দ্বিধা নেই, পদ্মা সেতুর কার্যক্রম দ্রুত এগুতে থাকলে এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা অন্তত তিনবার আমাকে ধীরগতিতে কাজ করতে অনুরোধ করেন। বিষয়টি আমি গুরুত্ব দেইনি। অনেক কথা বলা যায় না- তবুও বলছি- আমি কোন অনিয়ম করিনি।

একদিন আমার নির্দোষিতা বিশ্বব্যাংক ও মিডিয়া বুঝবে

া আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে আমি কাউকে কোন সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করিনি। আমি নির্দোষ, তা একদিন বিশ্বব্যাংক ও মিডিয়া বুঝতে পারবে। বিশ্বাস করি, আমি একদিন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ, মিডিয়ার অব্যাহত অপসংবাদ, অপসাংবাদিকতা ও অপপ্রচার থেকে মুক্ত হবো। আমি আরো বিশ্বাস করি, মহান আল্লাহ আমাকে এ অন্যায় দোষারোপ ও অপবাদ থেকে উদ্ধার করে আমাকে আরো সম্মানিত করবেন।

যৌথ স্বাক্ষরে পত্রিকায় প্রকাশিত অপসংবাদের তদন্ত

া যেসব পত্রিকা নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে আমার সুনামক্ষুণœœ করেছে সেসব পত্রিকার সম্মানিত সম্পাদকদের প্রতি আমি আহবান জানাতে চাই, ১৯৯১ সালে রাজনীতিতে যোগদানের পর থেকে এ যাবত আমার ব্যক্তিগত বিষয় এবং পদ্মা সেতুসহ যত বিষয়ের ওপর আমাকে অন্যায়ভাবে জড়িয়ে সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় অনাকাক্সিক্ষত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে- সেসব পত্রিকার সম্মানিত সম্পাদক চাইলে আমার এবং সংশ্লিষ্ট সম্পাদকের যৌথ স্বাক্ষরে দুদক দিয়ে তদন্ত করাতে পারি। আমি চাই, আমার সম্পর্কে নেতিবাচক প্রতিবেদনগুলোর নিবিড় তদন্ত হোক। আমি অন্যায় ও অহেতুক অপবাদের বোঝা বইতে চাই না। এ বিষয়ে আমি অভিযুক্ত হলে যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নিতে বাধ্য থাকব। এ বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অসত্য প্রমাণিত হলে তার দায়-দায়িত্ব নিতে সংশ্লিষ্ট সম্পাদকের প্রস্তুত থাকতে হবে। অপসংবাদ ও অপসাংবাদিকতা গ্রহণ করা যায় না। সংবাদপত্র ও মিডিয়া জগতের জন্য, দেশের জন্য অপসংবাদ ও অপসাংবাদিকতা শুভ নয়। আমি পত্রিকার সম্মানিত সম্পাদকদের প্রতি অনুরোধ করবো, অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া বিশ্বব্যাংক প্যানেলের ফরমায়েসি রিপোর্টটি যথাযথভাবে পড়ে দেখুন, সত্য অনুধাবন করুন এবং আমাকে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের আশঙ্কার সাথে সম্পৃক্ত করার অনৈতিক প্রচেষ্টা ও আমার বিরুদ্ধে অসত্য প্রচারণা বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করুন। আমি আপনাদের সহযোগিতা চাই, সত্য মনের প্রতিফলন চাই।

পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে আমি কোনক্রমেই জড়িত নই
া আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, আমি সততা, নিষ্ঠা ও স্বচ্ছতার সাথে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করেছি। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের কোন অনিয়মের সাথে আমি কোনক্রমেই সম্পৃক্ত নই। বিশ্বব্যাংক ভুল তথ্যের ভিত্তিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে দোষী করার চেষ্টা করছে। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে স্বেচ্ছায় আমি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলাম। তারপরও বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতুর ঋণ প্রদানে গড়িমসি ও ঋণদান স্থগিত করা নজিরবিহীন। এধরনের কোন কারণে বিশ্বব্যাংক কোথাও ঋণদান বন্ধ করেনি। আমি দেশের একজন সাধারণ ও সচেতন নাগরিক। আমি দেশের এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সঠিক ও যথাযথ যে কোন তদন্তে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হবো- ইন্শাল্লাহ।

সৈয়দ আবুল হোসেন : যোগাযোগ মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, লেখক, শিক্ষানুরাগী, শিল্পপতি, কলামিস্ট, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, সমাজ-সংস্কারক।

কালকিনি : আমার প্রেম
সৈয়দ আবুল হোসেন
আমার কালকিনি সুন্দরের প্রতীক। প্রাচুর্যের অমিয় মোড়কে সৌম্য-শান্ত সৌন্দর্যের কুহুর আর জল-মাটির নিবিড় দা¤পত্য রহস্যে বিধুর মিলনের এক অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক মেলা। নদীপ্রধান এ এলাকাটি মিঠে মিঠে রোদের অফুরন্ত প্রেমের নিবিড় ফসল। কৃষকের চিরঞ্জীব কোলাকুলি আর রূপোলি মাছের কলহাস্যে অমিয় হয়ে থাকে সারাক্ষণ। এখানকার ধবল প্রহর আর নিকষ কালো রাত সৌন্দর্যের স্বাগত নিবেদনে প্রকৃতির অনুপম বিনোদন। আকাশ আর মাটি; সর্বত্র ছড়িয়ে মদিরতার উল্লাস। সপ্রাণ উচ্ছ্বাসের উৎপ্রাস উচ্ছলতার নিটোল তন্ময়ে মাটি-জলের চিরসখ্য নিস্তব্ধ জলসায় উতলে ওঠে সুখে। অসীম মনোলোভা নিপাট মূর্ছনা হৃদয়ে তোলে তুমুল কাকলি। অভিষিক্ত প্রকৃতির প্রতিটি মোড়ে ব্যাকুল ব্যাকুলতায় ঝরে পড়ে নান্দনিক অলঙ্কারের বিহ্বল গর্বÑ

খাল-নদী বিল
চিক-চিকে নীল
গ্রীষ্মের কড়া রোদ
বর্ষার ঝিল।

রমণীয় বেণীর সর্পিল প্রকাশে কালকিনি অহঙ্কারের তিমির বিদিশা। গ্রাম আর গ্রাম, নদীর পর নদী, খালের পর সবুজ; সবুজের আনত কপাল আর কপোলে ফুল-ফলে নিগূঢ় সমাহার। অসংখ্য কাঁচা-পাকা পথের হারিয়ে যাওয়া লুকোচুরি স্মৃতির অতলান্ত পরিসম্পতাÑবিল আর ঝিলে উ™£ান্ত বিভবের আকাশচুম্বী হাসি। চোখের শেষ পরিবিন্দু পর্যন্ত থম্কে থাকে রাশি রাশি সবুজের নীল নীল অর্ঘ্য।ে বৃষ্টির ফোঁটায় ভরে ওঠে প্রকৃতি-মুকুলিত উষ্ণতার আবেগে হতবাক হয়ে ওঠে চিত্ত। প্রণয় উদ্যানের মতো সুষমার তুলতুলে নিগড়ে সাজানো লক্ষ্মী রমণীর রমণীয় উদরের মতো দুলে ওঠে আঁকাবাঁকা পথÑ সবুজ ক্ষেত আর রূপোলি জল। ইচ্ছে করে কালকিনির আদুরে দোলানো অবয়বের তিমির-আলোর আদর-সোহাগে বর্ষা করে দেই সারা বিস্তৃতি-

শরতের আলুথালু
মুক্তো শিশির
লাবণ্য বিধুর আর
মায়াময় ধীর।

পদ্মা-মেঘনা- আড়িয়াল খাঁ আর পলারদির অসংখ্য খালের নিগূঢ় মিলনের বিহবল ভূমি কালকিনি। যেন অমৃতের শিশির, মহিমার বিজয় ললাট। কপালে নীল-সবুজের সমারোহ, কপোলে ফুলেল আলপনা। যেন নান্দনিক বিশালত্বকে তুচ্ছ করে দিগ্বিদিক বিন্যাসের তুমুল আগ্রহে বিলীন হতে উন্মুখ। প্রকৃতির সুষমায় ছেয়ে যায় সারা অবয়ব। বসন্তে সবুজে সবুজে একাকার হয়ে যায় কালকিনি, আশপাশ সর্বত্র। অনুরাগ শ্রম, নি®পাপ সারল্য আর ভালোবাসার বর্ধিত প্রয়াস মিশে কালকিনি যেন সত্যি হারিয়ে যায় নীলাসীমে। জল-স্থল, সবুজ-নীল আর রবি শস্যের দুমড়ে পড়া ফুলে-ফলে কালকিনির বাঙ্ময় বিদিশার প্রগাঢ় অনুস্বরে কিশোর-কিশোরীর মতো চঞ্চল হয়ে ওঠে প্রান্তর। চোখ পড়তেই আটকে যায় ঐ সে আকাশ; এই সে দিগন্ত। নদীতে অসংখ্য নৌকা। রাতের বেলা মাঝিদের ক্ষুদে ক্ষুদে অগণিত নৌকা আর ভাসমান হারিকেনগুলো তারার মতো মিটমিট হাসিতে বাক্সময় হয়ে ওঠে। মনে হয় নীলাকাশ নীলজলে জলকেলি। পু®পভারনত সবুজের মহাবিনয় আর নিঃসীম গভীরতার ব্যাকুল আবেশ উদ্বেল হয়ে ওঠে মনÑ

ছয়মাস মৎস্য, ছয়মাস শস্য
রূপে রূপে মহিমা নীলাম্বর লাস্য
প্রীতম বিভাস তিথি
অণুপ্রভা মম ক্ষিতি
পদ্মার মোহনায় মেঘনার বাণী
বিস্মিত বিস্ময় মনো কালকিনি।

মাদারীপুরের রসাতুল মাটি, ঘন সবুজ কারুকাজ, সবুজে পল্লবিত বৃক্ষ, বর্ষার ভরা যৌবন যে কারও ভ্রমণের আনন্দে সঞ্চার করে বিরল অভিজ্ঞতার নিটোল অনুভব। সুপ্ত রম্যতা জেগে ওঠে বুদ্বুদের মতো অবিরাম। রাস্তার দু’পাশে সবুজ খাল, খালের ভেতর জল আর জলের ভেতর রূপোলী স¤পদের চিকচিকে ঐশ্বর্যে নেচে ওঠে মন। গাছের সারি আর খেজুরের বাবরি দোলানো পত্রপুট মহা ভাবালুতার নিদাঘ মৌনতা। থরে থরে সাজানো শান্ত সমাহিত মহিমার খাজুর তলা এখনও পত পত করে বিভোর বিহ্বলে। নারিকেল, মেহগিনি আরও কত কি। হলুদ জাগানিয়া সরিষা ক্ষেতের পাশে মসুর, সূর্যমুখীর পাশে মরিচ, তার পাশে গম, কাশবন, পাটের নিপাট দ্যোতনা উদারতার বন্যা তুলে দেয়। বৃক্ষ ঘেরা প্রতিটা বাড়ি যেন সপ্নবিলাস, সবুজ তপোবনে নীপবনের সোহাগÑ

আকাশে তারা, নদী মিটিমিটি
তুলতুল বাট, নিসপিস মাঠ
কত পরিপাটি।
পতপত সবুজে আলুথালু বেনি
নিবিড় সোহাগ ভরা প্রিয় কালকিনি।

কালকিনির উর্বরা মাটির প্রতিটি কণা সোনায় সোনায় বিভাস। মদিরতায় উৎপ্রাস। নদীর উছলে পড়া ঢেউয়ের অবিরাম কোলাকোলি মন নেচে ওঠে। বিস্ময় বি¯েফারিত আনন্দে শিউরে ওঠে প্রাণ, মমতার সিঁদুরে নেচে নেচে কান। নদীর তীরে চিকচিকে বালির রাশি রাশি সারি যেন শিল্পীর কারুকাজ। অগণিত রূপোলি ইলিশ আছড়ে পড়ে বিমল আনন্দে- জেলেদের জালে আর নগরের গালে। রূপকথার রূপোলি পরীর মতো ইলিশের রূপোলি শাড়ির সুড়সুড়ি প্রভাত করে দেয় গভীর রাত। অদ্ভুত পরিচ্ছন্নতার নির্মল প্রকাশ কালকিনির সর্বত্র। পুকুর আর পুকুর, খাল আর খাল, বিল আর বিল যেন শেষকেও শেষ হতে দেয় না। এত সমৃদ্ধি কীভাবে আটকে রাখে কালকিনি তার অবয়বে! ঘাস আর ফসলের সবুজ আস্তরণ শ্রেষ্ঠ মখমলের চেয়েও শ্রেয়তর মসৃণতায় মুগ্ধ করে রাখে অন্তরাত্মা। ছবির মতো গ্রামগুলোর নিপুণ প্রকাশের সুবিন্যস্ত সারি থমকে রাখে চোখ। ব্যতিক্রমী আদলে কাব্যিক স্বপ্নীলতায় গাঢ় হয়ে ওঠে চিন্তাÑ

জানি আমি জানি,
ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যে ভরা
প্রিয় কালকিনি।
প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অসীম কুহক কালকিনির মাদকতা। প্রতিনিয়ত বদলায় এর আমেজ। এখানে ছয় মাস মাছ, ছয় মাস চাষ। ছয় মাস অনন্ত, বস্তুত পুরোটাই বসন্ত। অরুণ-অনুরাগ প্রীতিতে ছেয়ে অসংখ্য ভাস্বর। সকালের কালকিনি সুবর্ণ কাশবন সবুজ নিগাঢ়, দুপুরে মনোহর কাননে চক্চকে প্রবাল। বিকেলে দিগন্তের আকুতিতে জীবনের উচ্ছ্বাস। সন্ধ্যায় নিঝুম নিস্তব্ধতা যেন সুখের ছোট ছোট শিশু। পুরোটাই এক অপ্রকাশিত অনুভব। আজানের পুত শব্দে নদীর কাকলি আর সবুজের প্রার্থনা স্রষ্টার ভাবনার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। প্রকৃতির অরূপ সম্ভারে সমৃদ্ধ অনুপম সৌন্দর্যের নিলয় বিন্যাস কালকিনি। স¤পদ, ঐশ্বর্য এবং সম্ভাবনার মধুর বন্দনায় সমুজ্জ্বল কালকিনি নিপাট অহংকারের মৃন্ময় প্রতীক। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন মাদারীপুর বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অংশের সাথে দক্ষিণ-মধ্যের যোগাযোগ মণি হয়ে উঠবে। এ অলৌকিক ভূখণ্ডটি বাংলাদেশের অহংবোধের নির্বাণ পরিচর্যা ও আলোড়িত গানের পু¯িপত বাসর হয়ে দেশকে অচিরে সমৃদ্ধ করে তোলার যোগ্যতা অর্জনের পথে।
কালকিনির চঞ্চল নিঝুমতা পদ্মা-মেঘনার উল্লাস বিলাস। গভীর রাতেও নিঝুমতা বার বার প্রাণ ফিরে পায়। বিশাল্যের মন্দিরে জেগে ওঠে মায়াবী মন্দিরা- মন মিশে যায় শূন্যে। ইচ্ছে করে ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে চর দৌলত খান দিয়ে ডলফিন হয়ে শুশুকের কাছাকাছি চলে যেতে। ধেয়ে চলা নৌকা, মাছ ধরার যান দিকচক্রবাল অমানিশার ঘোরে জীবনের সঞ্চরণ ঘটায় মুহূর্তে মুহূর্তে। মেঘনার বুক চিরে হাজার হাজার জেলের শৈল্পিক সাঁতার আশ্চর্য মৃন্ময়তায় অধীর করে তোলে। সাঁতারের শৈল্পিক নান্দনিকতার মাঝে বলাকার নির্বাস অবহেলা উদাস কণ্ঠে ধেয়ে চলার সারল্যকে ক্ষণিকের জন্য সঙ্কুচিত করে তোলে। যদি তার মতো হওয়া যেত, যদি পারা যেতÑ তার মতো দিতে একটা দৌড়; কিংবা অবহেলে পোশাকে একটি চটপটে সাঁতার! দূরবর্তী চরগুলোর সলিল অবয়ব আর সবুজ গামছায় ঢাকা। যেন কুল বধূর বোরকায় লুকিয়ে আজন্ম লালিত রূপ-রস-লজ্জায় ডাসার। তাকাতে তাকাতে চোখের কোণে জমে ওঠে জল, অশ্র“ নয়, শিশির, শরৎ ও চৈতালীর মিলন কোড়কে লক্ষ্মীপুর। লগ্ন হাসির রোদেলা বিকেলের বাঁশগাড়ি, প্রত্যুষের মাধুরীখঞ্জÑ এটিই প্রকৃতি, মনোলোভা কালকিনি।

রমজানপুর, আলী নগর, ডাসার, নবগ্রাম;
কাজী বাকাই, লক্ষ্মীপুর, চর দৌলত খান।
গোপালপুর, বলিগ্রাম, মুগ্ধ কয়ারিয়া;
এনায়েত নগর বাঁশগাড়ি ঝাউতলা নিয়া।
সাহেব-রামপুর সাহেব রামে কাঙ্খিত বাণী
মদির মদিরা রূপ; প্রিয় কালকিনি।

সৈয়দ আবুল হোসেন : যোগাযোগ মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, লেখক, শিক্ষানুরাগী, শিল্পপতি, কলামিস্ট, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, সমাজ-সংস্কারক। 
গ্রন্থালোচনা

সময়ের পরশ পাথর গ্রন্থটি প্রকাশ হবার পর অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যে সবগুলো কপি শেষ হয়ে গিয়েছে। কেউ পত্র দিয়ে, কেউ ই-মেইলে আবার অনেকে ফোন করেও আলোচনা করেছেন। সামনাসামনিও অনেকে বইটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইচ্ছা ছিল সবগুলো মন্তব্য দ্বিতীয় সংস্করণে তুলে ধরব। গ্রন্থের কলেবর নিয়ন্ত্রণের জন্য তা করা সম্ভব হল না। তবে মন্তব্য ও গ্রন্থালোচনা নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে। এ সংস্করণে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গ্রন্থালোচনা এবং অতি প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক্তন পরিচালক ও টিসিবিতে চাকুরিকালীন সৈয়দ আবুল হোসেনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মোবারক এ মোল্লার মন্তব্য প্রকাশ করা হল।

সময়ের পরশ পাথর
শওকত হোসেন

(৪/৩/২০১৩ খ্রিস্টাব্দ তারিখ, সোমবার, প্রথম আলো প্রকাশিত বুক রিভিউ)

আর দশটা বইয়ের সঙ্গে এই বইকে মেলানো যাবে না। কারণ, এ ধরনের বইয়ের সহজে দেখা পাওয়া যায় না। বইটির নাম সময়ের পরশপাথর। ড. মোহাম্মদ আমীন সম্পাদিত। এটি একটি স্মারকগ্রন্থ। সাধারণত মৃত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এ ধরনের গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করা হয়। এদিক থেকেও বইটি ব্যতিক্রম।
স্মারকগ্রন্থটি যাকে নিয়ে, ‘তিনি রাজনীতিক, এমপি এবং মন্ত্রী। বিত্ত ও চিত্তে আকাশের মতো উদার। খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক, বিচক্ষণ বিশ্লেষক। বংশে বড়, কর্মে পরিচ্ছন্ন। চৌকস কাজে, বিনয়ী ব্যবহার। দর্শনে স্বচ্ছ।’ (পৃষ্ঠা, ৯৪)
এ রকম একজন ব্যক্তিত্ব নিয়ে যে বই, তা নিয়ে আলোচনা করা সহজ নয়। ‘হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক, আজকে এমনই একজনকে নিয়ে ভাবছি, যাঁকে ব্যক্ত করার ভাষা, চিন্তা-চেতনা সত্যি আমার খুব দুর্বল এবং আমার সাহস হচ্ছে না, না জানি আমার বর্ণনায় এত বড় এবং মহৎ ব্যক্তিত্বের কোনো অমর্যাদা হয়ে যায়।’ (পৃষ্ঠা ৪৩৬, লেখক অধ্যক্ষ মো. জসিম উদ্দিন, অধ্যক্ষ, ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি অ্যান্ড কলেজ, কালকিনি মাদারীপুর)
এবার ব্যক্তিটির পরিচয় বলা প্রয়োজন। বই থেকেই ধার করে বলা যায়, ‘কিছুটা দ্বিধা ও দোদুল্যমানতা। কারণ, যে ক্ষণজন্মা ব্যক্তির প্রভা ও বৈভব এবং হৃদয়ের ঐশ্বর্য আলোকপাতের জন্য লেখনীর এই ক্ষুদ্র প্রয়াস, তাঁর সূচনা করব কিভাবে? অঙ্কুরোদগম হতে বিশাল মহিরুহে রূপান্তরিত এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিটি হলেন সৈয়দ আবুল হোসেন।’ (পৃষ্ঠা, ২৯৭, লেখক মোহাম্মদ মোস্তফা, যুগ্ম সচিব)।
জীবিত একজন ব্যক্তিকে নিয়ে কেন এই স্মারক গ্রন্থ? ভূমিকায় এর একটি কৈফিয়ত দিয়েছেন বইটির সম্পাদক। তিনি লিখেছেন, ‘দেশে অনেকের স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; তাঁদের কয়জনই বা সার্বিক বিবেচনা ও চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো চিত্ত, বিত্ত ও মননশীলতায় তাঁর কাছাকাছি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, সে বিষয়ে আমার ভালো ধারণা আছে। যেসব গুণ মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক, তার সব গুণ সৈয়দ আবুল হোসেনে বর্তমান।’
বইটিতে চারটি অধ্যায় রয়েছে। অধ্যায়গুলো হলো সৈয়দ আবুল হোসেন : জীবন ও কর্ম, সময়ের পরশপাথর, সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ এবং সর্বশেষ অধ্যায়টির শিরোনাম সৈয়দ আবুল হোসেনের কলম থেকে।
প্রথম অধ্যায়ের নির্দিষ্ট কোনো লেখক নেই। বরং সংকলন বলা যায়। এই অধ্যায়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবন ও কর্ম নিয়ে বিস্তারিত রয়েছে। শুরু জন্মস্থান ও পূর্বপুরুষের বৃত্তান্ত দিয়ে। এরপর শিক্ষা ও কর্মজীবনের বিস্তারিত বিবরণ। এখান থেকে কিছু কথা তুলে দিলে পাঠকেরা সৈয়দ আবুল হোসেন সম্বন্ধে একটি ভাল ধারণা পাবেন। যেমন অধ্যাপক মনোরঞ্জন দাস বলেছেন, ‘সৌম্যকান্ত চেহারা, অনেকটা আমাদের সুদর্শন দেবতা কার্তিকের মতো। গোলাকার মুখে হাসি পুরো লেপ্টে। চোখে নিষ্পাপ যোজনায় সারল্যের মুখরতা।’ (পৃষ্ঠা. ৭৭)
শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজ এর বাবুর্চি লুৎফর রহমান হাওলাদার। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল : সৈয়দ আবুল হোসেন কেমন মানুষ? আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন মানুষ নয়, ফেরেশতা।’ (পৃষ্ঠা. ৯৫)
আবার খুলনা নিবাসী শেখ হাসিনা একাডেমি এন্ড উইমেন্স কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শিবপদ মণ্ডলের মতে, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন একজন আদর্শ মানুষ। তাঁর চরিত্রে যে গুণাবলি রয়েছে তার সহস্রাংশও কারও মধ্যে প্রকাশ পেলে তিনিও মহামানব হয়ে উঠতে পারেন।’ (পৃষ্ঠা. ৯৬) এনায়েতনগর ইউনিয়নের মাঝেরকান্দির মনির হোসেন একজন সাধারণ লোক। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো : আপনি ‘সৈয়দ আবুল হোসেনকে চেনেন? আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘ওই দেখুন আকাশ। ওটাকে চেনেন? তিনি আমাদের জীবনের আকাশ, আমাদের বাতাস। তাঁকে ছাড়া আমরা কিছু বুঝি না।’ (পৃষ্ঠা. ৯৭) একই প্রশ্ন করা হলে মীরা বাড়ির আনিসুর রহমান বললেন, ‘তিনি এত ভালো যে কেন ভালো লাগে বলতে পারব না। তিনি আমাদের চামড়ার মতো, আমাদের মাংসের মতো, আমাদের রক্তের মতো, চোখের মতো।’ (পৃষ্ঠা. ৯৬) বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য এই অধ্যায়ের তিনটি অংশ আছে। এর মধ্যে একটি হলো, ‘সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনের মহামানবীয় কয়েকটি ঘটনা।’ সাধারণত মহামানবদের জীবনীতে যে ধরনের ঘটনার বর্ণনা আমরা পাই, এই অংশেও তেমনটি পাওয়া যায়। পরের অংশের শিরোনাম ‘সৈয়দ আবুল হোসেন : তেজময় সিংহপুরুষ’। এরশাদ আমলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলেজকে এমপিওভুক্ত না করার জন্য সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রীকে তিনি বদলে ফেলেছিলেন। সেই ঘটনার বর্ণনা আছে এই অংশে। আর শেষ অংশটির শিরোনাম হলো, ‘আলাপচারিতায় দার্শনিক নান্দনিকতা’। ‘সৈয়দ আবুল হোসেনের বিভিন্ন সময়ের বলা কথার সংকলন। তিনি যে একজন দার্শনিক, তার অনেক চিত্র পাওয়া যাবে এই অংশে। গ্রন্থটির দ্বিতীয় অধ্যায় মূলত সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লেখা। তালিকাটি বেশ দীর্ঘ। লেখাগুলো দুই ধরনের। যেমন সৈয়দ আবুল হোসেনের লেখা বিভিন্ন বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন বেগম সুফিয়া কামালসহ অনেকেই। সেসব যেমন সংকলিত করা হয়েছে, তেমনি সম্পাদকের অনুরোধেও অনেকে লিখেছেন। এই তালিকায় সদ্য প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও আছেন। সচিবরা লিখেছেন। তালিকায় তাঁর সহপাঠী এমনকি শিক্ষকেরাও আছেন। বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে কয়েকটি শিরোনাম বলা যায। যেমন : রাজনীতিক আতাউর রহমান খান কায়সারের লেখাটির শিরোনাম ‘সুশোভিত সুমন’, আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ‘একজন স্বয়ংসিদ্ধ মানুষ সম্পর্কে’, সাবেক সচিব এম মতিউর রহমানের লেখার শিরোনাম ‘সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা’, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী লিখেছেন ‘বন্ধু আমার উদার নিদাঘ আকাশ’, রাজনীতিক মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ লিখেছেন ‘মহাঋত্বিক’, সরকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোস্তফার লেখার শিরোনাম ‘সতত বিভাময়’, আরেক সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ফরহাদ রহমান লিখেছেন ‘ম্যাগনেটিক ব্যক্তিত্ব’, প্রকাশক ওসমান গনি বলেছেন ‘মহান এক মানুষ’, অধ্যাপক নির্মল চন্দ্র পাল তাঁকে নিয়ে লিখেছেন, ‘মননশীল ভাষা বিজ্ঞানী’ ইত্যাদি।

এই অধ্যায়ে রয়েছে এস এম আবীর চৌধুরী মীমের লেখা ‘সৈয়দ আবুল হোসেনের বাণী’। মূলত বিভিন্ন লেখা বক্তব্য থেকে সংগৃহীত বাণীর একটি সংকলন। এর মধ্যে দুটি বাণীর কথা বলা যায়। যেমন ‘ওড়ার জন্য দুটি ডানার ওপর ভর করতে হয়। এক ডানায় ওড়া যায় না।’ ‘যোগাযোগের রথ বেয়ে আদিম মানুষ সভ্যতার জগতে উৎসারিত হয়েছে।’
লেখক তালিকার একটি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি হচ্ছেন ডা. হাসমত আলী। পরিচয় অংশে লেখা আছে তিনি যানজটের দিন সৈয়দ আবুল হোসেনের হেঁটে যাওয়ার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। এই অধ্যায়ের সব লেখার সারাংশ পাওয়া যাবে সৈয়দ আবুল হোসেনের বন্ধু আবদুল কাদেরের লেখাটির শেষ বাক্যে।
তিনি বলেছেন, ‘এ দীর্ঘ সময়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনে সামান্য খুঁতও খুঁজে পাইনি। ভেবে পাই না, তিনি মানুষ না দেবতা, নাকি তারও বড়!’
সবশেষে সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিয়ে লেখা একটি কবিতার একটি ছোট অংশ।
‘যে মানুষ স্বপ্ন গেঁথে গেঁথে
সেলাই করছে আজ পদ্মাপারের দরিদ্র
মানুষদের বিচ্ছিন্ন জীবন :
ট্রয়ের সৈনিক তিনি, সময়ের সফল সন্তান।
বুঝলে হেলেন!
বাড়িতে যে অতিথি এলেন। লোকে তাঁকে 
জানে :
এক কান্তিহীন স্বপ্নজয়ী আবুল হোসেন,
যদিও সৈয়দ তিনি, চাষার বাড়িতে এসে
পিঁড়িতে বসেন।’
(এক স্বপ্নজয়ী মানুষের জন্য-আসাদ মান্নান, পৃষ্ঠা. ৫৪২) তবে বইয়ের ছোট্ট দুটি ত্র“টির কথা বলা যায়। যেমন তিনি যখন প্রতিমন্ত্রী তখন সচিব ছিলেন হাসনাত আবদুল হাই। তিনি লিখেছেন, সারাদিন মন্ত্রণালয়ের কাজ করে সৈয়দ আবুল হোসেন চলে যেতেন তাঁর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সাঁকোর অফিসে। আমরা জানি যে মন্ত্রী হিসেবে তিনি এটা করতে পারেন না। আরেকটি ঠিক ত্র“টি নয়, বলা যায় অভাব। যেমন সৈয়দ আবুল হোসেনের সব সময়ের সঙ্গীদের কথা বইটিতে আছে। কিন্তু টিসিবিতে চাকরিকালীন কোনো সহকর্মীর কোনো স্মৃতিচারণা এখানে নেই। সবশেষে বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

Syed Abul Hossain

Mobarak A. Molla

প্রাক্তন পরিচালক, টিসিবি ও সদস্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, (বর্তমান আমেরিকা প্রবাসী) 
ই-মেইল : [email protected] ; তারিখ : ২৩ মে, ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ

Dear Dr Mohammad Amin:

It was nice of you to send me an anthology of writings on Syed Abul Hossain and some related articles. I planned to write to you about its receipt after reading it a little, which has been delayed by my preoccupation in a foreign land.  I must say that your book is very well edited, enriched as it is by the contributions of some people prominent in their fields. The cover page of the book with a very impressive photograph is well done.

Incidentally, I must also gratefully acknowledge the telephonic call of Hon’ble Syed Abul Hossain to me, preceding the dispatch of your book.

You have kindly invited me to write about Syed Abul Hossain in what must have been his first public sector job as a junior officer in the Trading Corporation of Bangladesh (TCB). 

The corporation had been established in the wake of independence, in order to import and distribute various consumer goods to alleviate widespread shortages. I worked at TCB about this time for a short period of time on deputation and had the pleasure of knowing Syed Abul Hossain. He was bright and efficient and looked to be very promising.  But, he was destined to do greater things in life and rightly left TCB’s employ. 

TCB still exists but in the face of a growing market economy, its role and influence has been greatly diminished. Its performance in the recent years even at Ramadhan, has been far from satisfactory. Therefore, it no longer has a niche in the country’s commerce and trade and to today’s students of economy, it is hardly known. 

All considered, I am of the opinion that your anthology can do without a piece on Syed Abul Hossain at TCB, not to speak of any irregularities or corruption allegations against him at the time. Syed Abul Hossain, a successful politician has gone a long away forward. Polite and soft spoken, he easily reaches out to people. This quality alone will take him a long way.  And of course, in his parental home of Kalkini, his support to education and other charities has made him a legend.      

Again, I am thankful to you for your invitation. I would have liked to endorse a copy of this to Hon’be Syed Abul Hossain, but unfortunately I do not have his E-mail address.  Perhaps you could forward him a copy?

With the best wishes.

Sincerely, Mobarak A. Molla

447Shares