Wednesday - May 1, 2024 11:02 PM

Recent News

ছিলেন পুরুষ, হয়ে গেলেন নারী : নাম ছিল আবদুস সামাদ, হয়ে গেল হোসনে আরা

ছিলেন পুরুষ, হয়ে গেলেন নারী : নাম ছিল আবদুস সামাদ, হয়ে গেল হোসনে আরা

মনিজা রহমান : আপনার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট কী? বেশির ভাগ সফল মানুষ কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন না। কিন্তু ড. হোসনে আরা বেগম পারলেন। ওভারিতে টিউমার আর তার অপারেশন, এরপরে পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তর এই ঘটনাই ছিল তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে আসার ওই সময়ে নিজেই নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বাকি জীবনটা মানুষের সেবা করে কাটাবেন।
প্রস্তুত ছিল লাশ নেবার খাট। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন তিনি আর বাঁচবেন না। সেই তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলেন।
কিন্তু এ কেমন ফেরা! ছিলেন পুরুষ, হয়ে গেলেন নারী।নাম ছিল আবদুস সামাদ, সেই নাম হয়ে গেল হোসনে আরা। ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লতিফ হলে। চলে আসতে হলো মন্নুজান হলে। স্বাধীন জীবন যাপনের পরিবর্তে মেনে নিতে হলো শৃঙ্খল জীবন। কি দুঃসহ বেদনা, আজন্ম বাধাবন্ধনহীন জীবন হয়ে পড়ে বন্ধ। সবাই তাকে দেখত, মনে হতো তিনি যেন কোনো মানুষ নন, বুঝি কোনো চিড়িয়াখানার প্রাণি! প্রাণে বেঁচে এলেও প্রতিনিয়ত মানুষের তীর্যক দৃষ্টি তাকে আহত করতো। কিন্তু এ দৃষ্টি তাকে অন্য পথ দেখায়। জেগে ওঠার পথ বাতলে দেয়।
ছোটবেলা থেকে তিনি লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পুরুষ হিসেবে। তাঁর অধ্যয়নের বিষয় ছিল বোটানি। ১৯৭৫ সালে মাস্টার্স শেষবর্ষে তাঁর জীবনের এই রূপান্তর ঘটে। যেটা নিয়ে সিরিজ প্রতিবেদন করেছিল সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন বিচিত্রা। এত কিছুর মধ্যেও হোসনে আরা বেগম মাস্টার্সে ভালো ফলাফল করেন।

প্রথম শ্রেণি নিয়ে পাস করেন তিনি সরকারি কলেজে অধ্যপনার চাকরি পান হোসনে আরা বেগম। বিয়ে করেন এক বন্ধুকে। সরকারি চাকরি, নতুন বিয়ে, আনন্দে-ফূর্তিতে ভালোই ছিলেন তিনি। অবসরে ক্যারোম খেলতেন। দাবা খেলতেন। আর দশজন মানুষের মতো জীবনটা কাটিয়ে দিতেন হয়তো। হঠাৎ তাঁর মনে হলো, মৃত্যুমুখে নিজেকে দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা। মনে পড়ল, তিনি বঞ্চিত অসহায় নারীদের নিয়ে কিছু করবেন! জন্মাবধি পুরুষ জীবনে অভ্যস্ত হবার কারণে নারী জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে গিয়ে হোসনে আরা বেগম বুঝতে পেরেছিলেন, কত পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের নারীরা!

এভাবেই একদিন তিনি শুরু করলেন ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের কাজ। ১৯৮০ সালে ভিক্ষুকদের মুষ্টি চালের মাধ্যমে গঠন করা এই সংগঠনটি এখন সারা বিশ্বের বিস্ময়। সমপ্রতি ইয়েল ইউনিভার্সিটি ড. হোসনে আরা বেগমকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এই বিষয়ে পেপার প্রেজেন্টেশনের জন্য। নিউ ইয়র্কে আসার পরে ওনার সম্মানে ১৭ই অক্টোবর বাঙালি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন সিনিয়র সাংবাদিক আকবর হায়দার কিরন। ওখানে আরো ছিলেন আরেক সিনিয়র সাংবাদিক ফারুখ ফয়সাল, যিনি বর্তমানে ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ সংক্ষেপে টিএমএসএসের একজন উপদেষ্টা।

ড. হোসনে আরা বেগম শৈশব থেকেই ছিলেন প্রতিবাদী। অন্যকে সাহায্য করতে কোর্টে যেতেন। এই অফিস থেকে অন্য অফিসে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। নির্যাতিতা মেয়েদের হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। তাঁর স্বামী বলতো, তোমার এত মানুষের কাজ করার কি দরকার! আত্মীয়রা বলতো, তুমি না সরকারি কলেজের প্রফেসর! তোমার কি এসব মানায়! কিন্তু তিনি নিজেকে ঘরে আটকে রাখতে পারতেন না।

এভাবেই একদিন জন্ম হলো ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের। ড. হোসনে আরা বেগম সেই ইতিহাস বলতে গিয়ে জানান, ‘১২৬ জন মহিলাদের একটি সংগঠন একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। ওদের বেশিরভাগ ভিক্ষুক। কেউ কেউ দেহকর্মী। ওরা বলল, আমরা মানুষের বাড়িতে ঝি-চাকরের কাজ করি। তাদের ঘর মুছে দেই, ঝাড়ু দেই। কাজে সামান্য গাফিলতি হলে ওরা আমাদের কিল-ঘুষি মারতে আসে। কিন্তু আমরা কি খাই, কিভাবে থাকি, সেই খবর ওরা রাখে না। এখন আপনিই পারেন আমাদের উদ্ধার করতে।’ হোসনে আরা এদের ঐক্যবদ্ধ করলেন। বললেন, ‘স্বাবলম্বী হতে হলে আমাদের মধ্যে ঐক্যগঠন করতে হবে। শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। যদি কেউ বড় হতে চায়, সেই জন্য নিজের মধ্যে স্বপ্ন সৃষ্টি করতে হবে।’

১২৬ জন ভিক্ষুকের মুষ্টির ২০৬ মণ চাল নিয়ে শুরু করা সেই সংঘের এখন মোট সম্পদের পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকা। বেতনভুক্ত জনবল ৩১ হাজার। উপকারভোগী পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫৩ লাখ। টিএমএসএসের আছে হাজার বেডের হাসপাতাল, ৫টি প্রাইমারি স্কুল, সরকার অনুমোদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৩২টি, শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠান ২৪টি, পাঁচতারা হোটেল কাম রিসোর্ট আছে একটি, উন্নতমানের হোটেল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে ৩০টি। হেলিকপ্টার আছে দুটি। রিয়েল এস্টেট এপার্টমেন্ট আছে। আছে মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম, সিএনজি লিমিটেডসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।

ড. হোসনে আরা বেগম বর্তমান ব্যস্ততা ওনার এলাকায় বগুড়াতে একটি আন্তর্জাতিক মানের থিম পার্ক স্থাপনের বিষয়ে। ওয়াশিংটন ও ফ্লোরিডায় কয়েকটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় ও আমেরিকার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলেছেন তারা। আঠারোশ শতক একরের ওপর এই থিম পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হবে।

ড. হোসনে আরা বেগমের দুরদর্শী নেতৃত্বের ফসল বগুড়ার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের নামে সৃষ্ট ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের বিশ্বময় পরিচিতি। তার দুরদর্শীতার আরো একটি প্রমাণ মিলল আরেকটি ঘটনায়। কক্সবাজারে দি প্রিন্সেস নামে তাঁর ফাইভ স্টার হোটেলে পর্যটকদের বিনামূল্যে থাকার সুযোগ করে দেবেন তিনি। তাদের কাজ হবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবেতর জীবন যাপন স্বচক্ষে দেখা। এই কাজটি তিনি মানবিক দৃষ্টভঙ্গি নিয়ে করলেও, এর পিছনে একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যও আছে। ফিলিস্তিনের রামাল্লায় প্রতিবছর বহু মানুষ যায় শরণার্থী প্যালেস্টাইনিদের দেখতে। বাংলাদেশেও এখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা দশলাখের ওপরে। তাদের ঘিরে বিশ্বমিডিয়ার ব্যাপক আগ্রহ। তাই তাদের বোঝা মনে না করে রোহিঙ্গাদের ঘিরে এভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ আছে বাংলাদেশের। বেসরকারিভাবে সেই উদ্যোগই নিয়েছে টিএমএসএস। বগুড়ার গর্ব প্রাচীন পুন্ড্র নগরের সভ্যতা পরিদর্শনের ব্যবস্থা আছে টিএমএসএসের।

এত অর্জনের পরে অত্যন্ত সাধাসিধে পোশাকে ঘরোয়া জীবনযাপন ড. হোসনে আরা বেগমের। বড় বোনের মেয়ে আয়শা বেগম, যিনি টিএমএমএসের কোষাধ্যক্ষও, যিনি তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। নিউ ইয়র্কে এসে উঠেছেন ব্রঙ্কসে আরেক বোনের মেয়ের বাসায়। সবার প্রতি স্নেহময় দৃষ্টি তাঁর। জীবনের বহু উত্থান-পতন আর বাঁক পরিবর্তনেও তিনি নিজের সাদামাটা-আন্তরিক রূপটি পরিহার করেননি। ভুলে যাননি বাংলাদেশের বঞ্চিত নারীদের কথা। যে কারণে তাঁর সংগঠনের সব সদস্যই নারী।
প্রথম যখন পুরুষ থেকে নারী হন, শুরুতে অবাক হতেন কোনো বাড়িতে গেলে নারীদের কেন অন্দর মহলে পাঠিয়ে দেয়া হয় সেই ভেবে। ড্রইংরুমে বসে পুরুষদের আড্ডায় তাদের প্রবেশাধিকার নেই। তাদের খেতে হয় সবার পরে। সমাজে-সংসারে সর্বত্র পুরুষদের অগ্রাধিকার। নারীরা সবসময়ই অবহেলিত। তাইতো ড. হোসনে আরা বেগমের গড়া ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ শুধু সেই দিনই না, আজো আছে সেই বিপন্ন নারীদের পাশে, আগামীতেও থাকবে।

2Shares