আবু জাফর মাহমুদ : ২০২৪ এর অভ্যুত্থানে আমি শুধু কৈশোর পেরুনো তারুণ্যের ঝড় দেখিনি, উচ্ছ্বসিত হয়েছি শিশুর মুখে ফুটে ওঠা দেশপ্রেমের অমোঘ উচ্চারণে। সেখানে দেশপ্রেমের যে তীব্র গভীরতা এবং প্রখর উত্তাপ তা যেন আমাদের আগামী বিপ্লবের শক্তিকে স্পষ্ট করে। বাংলাদেশের এই শিশু বংশধররাই এশিয়া মহাদেশ জুড়ে চিন্তা, মনন এবং মানবিক আদর্শের জগতে অনুকরণীয় পাঞ্জেরি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও সমাজে এরাই ভবিষ্যতের বাতিঘর। সর্বভয় জয় করার মহাশক্তি। অমানবিক হিংস্র দানবদের অস্তিত্ব বিনাশের মহাপ্রলয়। তথাকথিত প্রচলিত সকল তত্ত্বকে ছাড়িয়ে যে জাতির নয়াপ্রজন্ম রাষ্ট্র এবং সমাজজীবনের
মুখোশধারী শত্রুদের ঘৃণা করতে জেনে গেছে। অপশক্তির সর্বগ্রাসী আঞ্চলিক ও বিশ্বথাবার নীচে থেকেও নিরস্ত্র অথচ প্রত্যয়ী দৃঢ়তায় অগ্রাহ্যের তুফান জাগিয়ে কম্পন তুলেছে শত্রুর সামরিক শিবিরে। তছনছ করে দিয়েছে অহংকারীর কূটকৌশল। নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে ঘাতকদের অত্যাধুনিক বলে পরিচিত সকল মারণাস্ত্র। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ছড়িয়ে লুকিয়ে থাকা বিশাল বিস্তৃত কম্যান্ডো জাল নীরবে পালিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে। কখন কিভাবে বাড়ীর উঠান থেকে শুরু করে কেজি, প্রাইমারি মাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মাদ্রাসা সর্বত্র তারা বেড়ে উঠেছে জালেম শাসকদের রক্তচক্ষু ও প্রাণনাশী ঘৃণ্য নৃশংসতা সমুলে রুখে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে। এই শিশুরাই আছে নিয়ম গড়ার উদ্ভাবনে। ওরাই আছে রাষ্ট্রশক্তির বিডিআর হয়ে, ওরাই হচ্ছে আইন শৃঙ্খলার রক্ষক, ওরাই হতে চলেছে দেশরক্ষার আস্থা ভরসার দুর্ভেদ্য কান্ডারী। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে হায়েনার শাসনতলে থেকে বেড়ে ওঠা এই বিজয়ী তারুণ্যে কি তাহলে দেখা মিলছে এক একজন মুসা, যে ফেরাউন বিলোপে বেড়ে উঠেছিলো তারই আখড়ায়? প্রতিটি ফেরাউন আসে নিজের অজান্তে তারই ধ্বংসের প্রতিপক্ষ নিয়ে। ফেরাউনরা বিলুপ্তি পায় পরবর্তীদের শিক্ষার ঘৃণ্য মডেল হয়ে। বাংলাদেশের আকাশে আমি আলোকিত বিশ্বধারায় অনাগত পরাশক্তির আভাস দেখি। তাই,আবর্জনার ধ্বংসস্তুপে আগুনের উত্তাপ শেষে নতুন পরাশক্তির নিশ্চিত উত্থান ঘিরে যেনো অচিরেই আয়োজন হয় বিশ্বশক্তির মহামেলা। মিলিটারি বেইজ। দিকে দিকে বাজতে শুরু করেছে দুঃশাসন প্রতিরোধের দামামাঅমিত সাহস এর জন্য পৃথিবীবাসীর সামনে এখন এক দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। লাল সবুজের পতাকার সঙ্গে এখন গভীরভাবে যুক্ত হয়ে গেছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। পৃথিবীর যেখানে দৃঃশাসন সেখানেই এই একই ভাষায় প্রতিবাদ, একই শক্তির ঝাণ্ডা উড়িয়ে প্রতিরোধ “তুমি কে আমি কে, ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’। যেমন করে পাকিস্তানে, ভারতে এবং এর ধারাবাহিকতায় নেপালে। এ যেন সময়েরই দাবি, ভূ পৃষ্ঠের বুক চিরে উত্থিত এক প্রতিবাদী হাতিয়ার। এই সময়ে কার বুকের ভেতর থেকে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়নি? আমরা নতুন করে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে শুনলাম, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিপ্লব জাগ্রত করা সুর শব্দের গোলা। “দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ। এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।” নব্য উপনেবিশেকতার অস্বাভাবিক বল প্রয়োগে পথহারা শাসকগোষ্ঠী যখন ভোগ বিলাসিতা ছাড়া সম্মুখে কিছু দেখছে না, অর্থ সম্পদ যখন কোনো কিছুর শেষ সমাধান নয়, সমরাস্ত্র যখন নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিতে ব্যর্থ, ঐশ্বর্যরে অহংকার যখন শুধুই ধংসের পথ দেখাতে থাকে তখন মানুষ খুঁজতে থাকে বুকের ভেতর থেকে উৎসরিত সাহস। যে সাহসের চূড়ায় কোনো সুসজ্জিত বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তোলা যায় না, সেই অমিত সাহস ম্যালথাসের থিওরির মতো প্রকৃতি থেকেই উৎসারিত। আমাদের শিশু, কিশোর তারুণ্যের রক্তে সঞ্চারিত জীবনীশক্তি। যা পথ দেখাতে পারে শুধু আমাদের দেশ বা অঞ্চল নয়, পথ দেখাতে পারে গোটা বিশ্বকে।
-লেখক: একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা,আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশি আমেরিকান রাজনীতিবিদ।