পবিত্র সরকার : বাংলা বানান নিয়ে গোলাম মুরশিদ লিখেছিলেন ‘দুখিনী বাংলা বানান’। এবার লিখলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার, যিনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলা বানান নিয়ে গবেষণা করছেন।
আমার অতি শ্রদ্ধার্হ, প্রবীণ গবেষক গোলাম মুরশিদ সম্প্রতি (৫ অক্টোবর, ২০১২) প্রথম আলোতে ‘দুখিনী বাংলা বানান’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সেই নিবন্ধটি পড়ে আমার যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা-ই জানানোর জন্য এই লেখা। এ কথা আবার বলছি যে, তিনি আমার অতি শ্রদ্ধেয় গবেষক এবং জ্ঞানচর্চার নানা ক্ষেত্রে আমি তাঁর কাছে প্রার্থী হয়ে সমৃদ্ধ হয়েছি, ভবিষ্যতেও হওয়ার আশা রাখি। ফলে এ লেখাটি কোনোভাবেই সেই শ্রদ্ধাকে আঘাত করবে না, তাঁর এক ভক্ত, তুলনায় নগণ্য বাংলা-ভাষাশ্রমিক হিসেবে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করবে মাত্র। মুরশিদ সাহেবের লেখাটি আবেগপ্রবণ, কাজেই বাংলা বানানকে মানবী রূপ দিয়ে তিনি শুরুই করেছেন ‘আজকাল তোমার দিকে আর তাকানোই যায় না।’ আমার প্রথম প্রশ্ন, সত্যি কি ব্যাপারটা এত খারাপ দাঁড়িয়েছে? অজস্র বই ও পত্রপত্রিকা দুই বাংলা আর বিশ্বজোড়া বাঙালির নানা অবস্থান থেকে বেরোয়—তাতে বানান বা ছাপার ভুল হয়তো প্রায়ই থাকে, কিন্তু তাতে কোটি কোটি পাঠকের পড়া ব্যাহত হচ্ছে, কথাবিনিময়ে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে—এমন তথ্য কি নথিবদ্ধ? এমন হতেই পারে যে সব পাঠক মুরশিদের মতো বানান-সচেতন নন। বেদনাশীল নন—কিন্তু বানান-সংস্কারের ফলে মুদ্রণজগতে বাংলা বানানের দারুণ বিশৃঙ্খলা ঘটেছে—এমন তো দৈনিক পাঠের ফলে মনে হয় না। অবশ্যই বানান-রক্ষার মানের তারতম্য প্রতিষ্ঠানবিশেষে ঘটে থাকে। বড় সংবাদপত্র বা বাংলা একাডেমীর মতো প্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য নামী প্রকাশনার ক্ষেত্রে বেশি বানান বা ছাপার ভুল ঘটলে আমাদের কষ্ট হয়, কিন্তু এখনো এই মুদ্রণ-এলাকায় আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু ঘটছে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। প্রবন্ধটি পড়ে মনে হয়, তাঁর অভিপ্রায়, বানান তার স্বাভাবিক গতিতে বিবর্তিত হোক, তাতে কারও হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। তাঁর কথা, ‘ইংরেজি বানান চলেছে নদীর ধারার মতো।’ কথাটা আক্ষরিকভাবে ঠিক নয় হয়তো, কারণ তা চললে ব্রিটেন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কিছু বানান দুরকম হতো না। যত অল্পই হোক, হয়েছে। ou-র জায়গায়-o, অতীতকালে শেষ ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জন (focussed না করে focused) ইত্যাদি হয়েছে এবং পরবর্তী সংস্কারকদের অনেক প্রস্তাব জনমত গ্রহণ করেনি, তা তিনি নিজেই চমৎকার দেখিয়েছেন। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, ইংরেজি বানান নদীর ধারার মতো চলেছে বলেই কি তা আদর্শ অবস্থায় পৌঁছেছে? এমনকি ইংরেজিভাষীরাও যে তা নিয়ে সন্তুষ্ট নন তার ইতিহাস তো তিনি নিজেই দিয়েছেন। তাঁর লেখা থেকে অনুমান করি, অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত, অর্থাৎ যত দিন বাংলা মুদ্রিত হয়নি, পুঁথিতে লেখা হতো তত দিন বাংলা ‘নদীর ধারার’ মতো চলেছে। পুঁথিতে ‘জাওয়া’, ‘জখন’ লেখা হতো—সেটা হ্যালেড এসে আটকে দিলেন। কিন্তু তাঁকে আমার বলার দরকার আছে যে, পুঁথিতে শুধু উচ্চারণ অনুযায়ী বানানই হয়নি, সংস্কৃত শব্দের বানান ভক্তিভরে অনেক সময় সংস্কৃতের মতোই লেখা হতো—এখন যেমন হয়—আর বাংলা শব্দের বানানে কোনো শৃঙ্খলাই ছিল না। যেখানে ‘শুনিয়া’ ‘শুনীয়া’ ‘সুনিআ’ ‘সুণিয়া’ ‘ষুনিআ’ ‘ষুনীয়া’—যত রকম সম্ভাবনা আছে সবই মহোল্লাসে আমন্ত্রণ করা হতো। নদীর এই ধারাকে অব্যাহত রাখলে কার সুবিধে ছিল? হ্যালেড এবং শ্রীরামপুর-কলকাতার মুদ্রকেরা এসে এই ধারাতে বাঁধ দিলেন। শোনা যায় এ ব্যাপারে প্রুফ-পাঠক হিসেবে তাঁরা ভাটপাড়ার পণ্ডিতদের সাহায্য নিয়েছিলেন। তাঁরাই সংস্কৃত শব্দগুলোর সংস্কৃতানুগ বানান, বাংলা তদ্ভব শব্দেরও একই নীতিতে বানান (পাখী, চূণ, কাণ) এবং সাধু গদ্যের বাংলা ক্রিয়াপদগুলোর বানানে একটা শৃঙ্খলা আনলেন। সংস্কৃত শব্দের উচ্চারণ যে বাঙালির মুখে বীভৎসভাবে বদলে গেছে, বাঙালি পুরোহিত ব্রাহ্মণের সংস্কৃত উচ্চরণ যে ভারতের অন্যত্র উপহসিত হয়—তা সবাই বলেছেন, রবীন্দ্রনাথও এই তথাকথিত তৎসমগুলোকে বলেছেন ‘সংস্কৃতের ছদ্মবেশধারী’। ‘শ্রেণী’ বা ‘শ্রেণি’ যে বাঙালির মুখে ‘স্রেনি’—এ খবর ক্রমশ বেশি মানুষের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে।
২. সংস্কৃত শব্দের বানান বাংলায় কী হবে সে সম্বন্ধে আলোচনার আগে বানান সংস্কার বা সমতা-বিধানের মূল যুক্তিটা কী, তা একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি। এটা একদল লেখাপড়া জানা ‘পণ্ডিতের’ বাকি বিপুলসংখ্যক লেখাপড়া জানা লোককে বিপদে ফেলা বা জ্বালাতন করার কোনো প্রকল্প নয়। অর্থাৎ ঘটনা এমন নয় যে, মাঝে-মাঝে কিছু পণ্ডিত একসঙ্গে মিলে বসে ঠিক করলেন, এই যে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, এটা তো ভালো ঠেকছে না—তা হলে এসো এবার বানানে কিছু গন্ডগোল পাকিয়ে মজা দেখা যাক। প্রতিটি বানান-সংস্কার সমিতি তৈরি হয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটা তাগিদ থেকে। ১৮৭৮-৭৯-এর এক নিষ্ফলা সমিতির কথা বাদ দিলে ১৯৩৬-এর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতিই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। সবাই জানেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি পেয়ে তৎকালীন উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এটি সংগঠিত করেছিলেন, সভাপতি ছিলেন রাজশেখর বসু—যাঁর চলন্তিকা ১৯৩০-এ বেরিয়েছে। এর মূল দায়িত্ব ছিল, চলিত গদ্যের যে ব্যবহার ১৯১৪ থেকে অল্প অল্প শুরু হয়েছে, তার ব্যাপক ব্যবহার ১৯৩০ থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে—তাতে পুঁথির মতোই বাংলা ক্রিয়াপদের বানানে প্রচুর বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে। মনীন্দ্রকুমার ঘোষ দেখিয়েছেন যে এক ‘করল’ কথাটির বানান কতভাবে লেখা হচ্ছিল—করল, ক’রল, ক’র্ল, ক’রেলা, করলো, কোরলো, কোরেলা, কর্ল, কর্ল্ল, কোর্লো ইত্যাদি (তালিকা শেষ হয়নি) বহুতর রূপ পাচ্ছিল একটি ক্রিয়াশব্দ। এর মধ্যে আবার সবুজপত্র-কে দেওয়া সুনীতিকুমারের বানাননীতি এক নতুন জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। এটি পরে ১৯২৫-এ (কেন জানি না) প্রশান্ত মহলানবীশের নামে প্রবাসী পত্রিকায় নতুন বাংলা বানানের নিয়ম হিসেবে ছাপা হয় এবং বিশ্বভারতী কিছুদিন এই বানান গ্রহণ করে—পুনশ্চ-এর (১৯৩২) প্রথম সংস্করণ এই বানানে ছাপা হয়েছিল। সুনীতিকুমারের বানানের মধ্যে বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক বিবর্তন দেখানোর ঝোঁক ছিল—তার ফলে ‘ব’লেব’ ‘চ’লিত’ ‘আ’জ’ ‘কা’ল’ ইত্যাদি বানান তিনি সুপারিশ করেছিলেন। এতে ঊর্ধ্বকমা দিয়ে অপিনিহিত স্বর (ই) লুপ্ত হয়েছে। তা বোঝাতেন সুনীতিকুমার, আর হসন্ত দিয়ে উচ্চারণ। তখনকার হাত কম্পোজের প্রেসে এ এক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। রবীন্দ্রনাথও অচিরেই এ বানানে বিমুখ হয়ে শ্যামাপ্রসাদকে চিঠি লিখলেন। তাঁর ‘ভুল বানান’ গ্রহণ করানোর জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কার সমিতি বসিয়েছিল—এ তথ্য আমাদের কাছে খুবই নতুন। রবীন্দ্রনাথের ‘ভুল বানান’-এর কয়েকটি এ রকম নিদর্শন মুরশিদ সাহেব উদ্ধার করে দিলে (এত দিন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ) আমরা উপকৃত হতাম। তার অর্থ এই নয় যে, রবীন্দ্রনাথ লেখায় বানান ভুল করতেন না। পাণ্ডুলিপিতে তার দুএকটি দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই পাই। কিন্তু সেগুলোকে বৈধতা দেওয়ার জন্য তিনি সংস্কার সমিতিকে জোরজার করেছেন—এমন কোনো নজির আমাদের কাছে নেই। আমি জানি না—কী, মেছুনি, মুদিনি, বাঘিনিকে মুরশিদ সাহেব ‘ভুল বানান’ বলবেন কি না। বললে অন্য তর্কের অবকাশ ঘটবে।
৩. সংবাদপত্রগুলো কেন নিজেদের কিছু কিছু অভিনব বানান তৈরি করে সে ব্যাপারে তাদের নিজস্ব যুক্তি নেই তা নয়, আমরা তা মানি আর নাই মানি। কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকা সর্বভারতীয় কিছু নাম—পটনা, সচিন, গাওস্কর, মেরঠ, অজিণ্ঠা (অজন্তা), গ্বালিয়র ইত্যাদি নিজেদের মতো করে লিখেছে। তাদের যুক্তি হলো, এরা এদের এক কর্মী হিন্দিভাষী লেখক সিদ্ধেশের উপদেশ নিয়েছিল—‘এইসব নাম দেবনাগরিতে যা ছাপা হয় তারই বাংলা রূপ দাও।’ আমি এই উপদেশ দেওয়া বা শোনা সংগত হয়েছিল বলে মনে করি না। ফলে লক্ষ করবেন, সাধারণ বাঙালির অভ্যাসে এই নামশব্দগুলো এখনো গৃহীত হয়নি। আনন্দবাজার পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সুপারিশ করা শ্রেণি, কাহিনি, মফস্সল ইত্যাদি গ্রহণ করেছে; প্রথম আলোও দেখলাম ‘কাহিনি’ ব্যবহার করছে। তবু কলকাতায় খবরের কাগজগুলোর কোনো কোনোটি বানানের বিষয়ে কিছুটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে, অপ্রয়োজনীয় এবং বিভ্রান্তিকর হলেও। গণশক্তি অতীতের ‘ল’ আর ভবিষ্যতের ‘ব’ তে অকারণে ও-কার দেয়। অন্য কাগজ দেয় না। এই ও-কার অপ্রয়োজনীয়, এমনকি ‘হল’ ‘হত’-তেও দেওয়ার দরকার নেই। দু বাংলাতেই দেখি, উচ্চারণ বোঝাতে অনেকে ‘এতো, কতো, ততো, বোলে, কোরে’ ইত্যাদি লেখেন; আমাদের মতে তারও দরকার সেই। আবার প্রয়োজনে ও-কার দেনও না, যেমন এগোয় লেখেন ‘এগয়’, ‘পুরোনো’ লেখেন ‘পুরনো’, ‘শুকোয়’ লেখেন ‘শুকয়’। এখানেই সংস্কার নয়, সমতা-বিধানের কথাটা বড় হয়ে ওঠে। সমতা মানে এক শব্দের একটিই বানান হবে। কেন এটা দরকার তা বুঝতে হলে বানান-সংস্কারের সবচেয়ে জরুরি ভিত্তিটা আমাদের মনে রাখতে হবে, তা হলো শিশুর প্রথম ভাষা শিক্ষা। সে যখন পড়তে শিখবে তখন যেন একটি শব্দের একটি মাত্র বানান সে শেখে। বলা বাহুল্য, যেখানে কোনো সংস্কারই সবার দ্বারা গৃহীত হয়নি এবং যেটুকু হয়েছে রাতারাতি হয়নি—সেখানে এক শব্দের নানা রকম বানান পাশাপাশি চলবেই। শিশু যখন একটু বড় হয়ে পাঠ্যবইয়ের বাইরের কিছু পড়বে, তখন তার চোখে আরও বিকল্প, ভুল বা শুদ্ধ বানান পড়বে। এখানে দায়িত্ব শিক্ষকের। তিনি ছাত্রছাত্রীকে একটাই বানান শেখাবেন। সেটাই লিখতে বলবেন, কিন্তু সতর্ক করে দেবেন যে, অন্য বানানও তার চোখে পড়বে। তা দুই শ্রেণীর বিকল্প শুদ্ধ বানান যেমন-শ্রেণি/শ্রেণী; কিংবা ভুল বানান দন্ত্য ন-এ দীর্ঘ ঈকার শ্রেণী, দন্ত্য ন দিয়ে। শিক্ষকের দায়িত্ব বাড়ছে, তাঁকে এখনকার ঠিক বানানটি জানতে হবে, শুদ্ধ বিকল্পটি বা বিকল্পগুলো জানতে হবে, ভুলগুলোকে তো স্বতঃসিদ্ধভাবেই জানতে হবে।
৪. এই সমতাপ্রাপ্ত একটি শব্দের একমাত্র বানান ছাত্রছাত্রীর (এবং শিক্ষকের) জন্য তৈরি করে কে দেবেন? ভাষার বানান যদি ‘নদীর মতো’ নিজের পথে চলত তা হলে কি তা সম্ভব হতো? পুঁথিকরদের মতো একজনেই এক শব্দের পাঁচ রকম বানান লিখতেন—পাঁচজনে কত রকম লিখতেন তা তো হিসাবেরও বাইরে। এখনো অনেক প্রাপ্তবয়স্ক বাঙালি একটি শব্দের বানান সব সময় এক রকম লেখেন তা নয়—বইয়ের বা অন্যান্য পাণ্ডুলিপি দেখলেই তা বোঝা যায়। শিশুদের হাতে একটি শব্দের একটি মাত্র বানান তুলে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। কারণ সরকার আছে প্রাথমিক শিক্ষার আয়োজনে। কোটি কোটি বই ছাপিয়ে সরকার বিনা মূল্যে ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেয়। সেসব বইয়েই ‘এক শব্দের একটিমাত্র বানান’ থাকতে হবে। কাজেই বানানে সরকারকে নাক গলাতে বারণ করে মুরশিদ সাহেব ঠিক যুক্তি দিয়েছেন কি না, তা তিনি আর একবার নিশ্চয়ই ভাববেন। বানান সরকারের শিক্ষা-পরিকল্পনা ও শিক্ষা-ব্যবস্থাপনার অঙ্গ। অবশ্যই সরকার মানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী বা আধিকারিকেরা নন—তাঁরা বানান-নীতি নির্ধারণ করতে বসেন না। তাঁরা বা তাঁদের দ্বারা পোষিত কোনো স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, যেমন বাংলা একাডেমী, তার মাধ্যমে ডেকে আনেন স্বাধীন নাগরিক সমাজের ‘পণ্ডিত’দের, যাঁদের কারও কারও সম্বন্ধে বিতর্ক থাকতেই পারে। তাঁদের নানা মুনির নানা মত থাকলেও, নিজেদের মধ্যে (ধরে নিচ্ছি) সর্বক্ষণ ঝগড়াঝাঁটি চালালেও, শেষ পর্যন্ত তাঁরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছান—সেটা কিন্তু সবার সিদ্ধান্ত—সেখানে ঝগড়ার কোনো স্মৃতিচিহ্ন থাকে না। সেই বানান-নীতি মেনেই তৈরি হয় ভাষার প্রথম পাঠ—সেটাই এসব অনুশীলনের সবচেয়ে জরুরি কথা। মধ্যবিত্ত লেখাপড়া-করা পাঠক কোন বানান পছন্দ করছেন বা করছেন না, বাপ-দাদার আমলের বানান রাখবেন কি রাখবেন না, আমার মতে সেটা তুলনায় গুরুত্বহীন।
৫. মুরশিদসহ অনেকের মতে, এসব করার কোনো দরকার নেই—এমনকি বানান বদলানোরও দরকার নেই। ‘বাপ-দাদার আমলের’ কথা এবং ‘নদীর ধারার’ কথা তাঁরা একই নিঃশ্বাসে বলেন, এটা মনে রাখেন না যে, বাপ-দাদার আমলকে অতিক্রম করেই নদীর এবং জীবনের ধারা এগোয়। এর মধ্যে আবার একদল ভাষাতাত্ত্বিক বিলিতি গুরুর কাছে শেখা mental lexicon বলে একটা জুজুবুড়ির ভয় দেখান। আমাদের মাথায় একটা mental lexicon (মানসিক অভিধান) আছে, যাতে নাকি শব্দগুলোর বানানের ছবিটি দাগ কেটে বসানো আছে। বানান বদলালে নাকি আমাদের মানসিক বিপর্যয় ঘটবে। এ রকম ভ্রান্ত, ছদ্মবৈজ্ঞানিক এবং প্রশ্নহীন যুক্তি শুনে আমরা বিমূঢ় বোধ করি। ইংরেজি থেকে আমরা শব্দ নিয়ে মাথায় রাখি, কিন্তু প্রশ্ন বা বিবেচনা নিই না। মানসিক অভিধান শুধু শব্দের আছে নাকি, অন্য কিছুর নেই? দৃশ্যের নেই? বানানগুলো তো দৃশ্যই। বাপ-দাদারা লুঙ্গি, পাজামা বা ধুতি-কুর্তা পরতেন, এটাও একসময় আমাদের মানসিক অভিধান নোট করে রাখে। পরে তাঁরা এবং তাঁদের ছেলেপুলেরা সেসব ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট পরছে, মেয়েরা শাড়ি রেখে সালোয়ার-কামিজ পরছে—এও আমাদের পোশাকের মেন্টাল লেক্সিকন লক্ষ করে। লক্ষ করে, এবং মেনে নেয়। যেমন মেনে নিয়েছে রেফের নিচে একটা ব্যঞ্জন দুটোর জায়গায়। তার জন্য ঘরে ঘরে কান্নার রোল ওঠেনি। মানসিক অভিধান কোনো অনড় শালগ্রাম শিলা নয় যে তাতে যোগ-বিয়োগ অদল-বদল ঘটানো যায় না। একটা বানানের বদল ঘটলে মানসিক অভিধানে বিস্ফোরণ ঘটবে, তাতে লোকে অসুস্থ হয়ে পড়বে, এ আশঙ্কা অবজ্ঞেয়। এ রকম যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যখন আমরা ওপারে কিছু যুক্ত ব্যঞ্জন ভেঙে ব্যঞ্জনদুটিকে আলাদা করে চিনিয়ে দিয়েছিলাম, ‘ঙ্গ’-এর বদলে ‘ঙ্গ’ কিংবা ‘ক্ত’-এর বদলে ‘ক্ত’—এ রকম আরও কয়েকটি। ব্যঞ্জনে স্বরচিহ্নযোগেও স্বচ্ছতা এসেছিল—‘শু’ হয়েছিল ‘শু’, ‘গু’ হয়েছিল ‘গু’। তখন তাতেও বলা হয়েছিল ‘ঙ্গ’-এর ছবিটি না দেখলে শিশু মানসিক আঘাত পাবে। এ রকম হাস্যকর যুক্তি আমি কমই শুনেছি। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে এই স্বচ্ছ রূপগুলো দিব্যি চলছে এবং তাতে শিশুদের একটা যুক্তব্যঞ্জন দুবার করে ব্যাখ্যা করতে হয় না বলে শিক্ষকেরাও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
৬. ফলে পরিকল্পনা দরকার, অন্তত বাংলা ভাষার জন্য দরকার। মুরশিদ সাহেব অন্যান্য ভাষার পরিকল্পনার ব্যর্থতার কথা জানিয়েছেন, কিন্তু নরওয়ের সার্থকতার কথা জানাননি। ইন্টারনেটে উইকিপিডিয়া ঘাঁটলেই নানা দেশের বানান ও লিপি পরিবর্তনের খবর পাবেন। এমন যে ফ্রান্স, সেও ১৯৯০ সালে সরকারি আদেশে ২০০০ শব্দের বানান বদলেছে। হতে পারে এসব কোনোটাই মুরশিদ সাহেব অনুমোদন করেন না। কিন্তু নতুন ক্যানিউট হয়ে লাভ কী? আসলে একটা ভাষার চরিত্রের সঙ্গে আর-একটা ভাষার বাইরের দিক থেকে প্রচুর তফাত বলেই একটা ভাষার বানান-সংস্কারের সাফল্য বা ব্যর্থতা অন্য ভাষার বানান-সংস্কারের সাফল্য বা ব্যর্থতাকে সূচিত করে না। ইংরেজির বানান ইতিহাসের তুলনা তাই বাংলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক নয়। ইংরেজির বর্ণসজ্জা অ্যালফাবেটিক, সেখানে বাংলা লেখা আলফাসিনেবিক বা বর্ণ ও দললক্ষণ একসঙ্গে মিশিয়ে। আ-কার উ-কার যুক্তব্যঞ্জন ইংরেজি বা রোমক লিপিতে নেই। ফলে বাংলার ভাবনা পৃথক। বাংলা বানানের সমতা-বিধান হবে কি না তা বাংলাভাষীদের সাক্ষরতা শিক্ষাবিস্তারের প্রয়োজন, তাতে শিক্ষা-ব্যবস্থাপকদের মনোযোগ ইত্যাদি বিবেচনা থেকে নির্ধারিত হবে। আমরা চাই আর না-ই চাই—বাংলা বানানের সংস্কার এবং সমতা-বিধান গত শতাব্দী থেকেই শুরু হয়েছে—তার ফলাফলকে বিসর্জন দিয়ে আমরা হ্যালেডের আগে পুঁথির যুগে ফিরে যেতে পারি না। বাঙালি ‘পণ্ডিতেরা’ (মুরশিদ সাহেবের কাছে শব্দটা প্রশ্নসংকুল হতেই পারে—তাঁর সে স্বাধীনতা আমি স্বীকার করি) একভাবে চেষ্টা করেছেন। তার ফলে দুই বাংলার বানান এখন অনেক কাছাকাছি এসেছে, আমি মনে করি সেটা একটা অগ্রগতি। সংবাদপত্রগুলো যদি নিজেদের ‘ইগো’ বা অস্মিতা আর একটু খর্ব করতে রাজি হয়—বিশেষভাবে কলকাতার সংবাদপত্র—তা হলে আমরা আর এক ধাপ এগোতে পারি। তখন তাঁদের নিজেদের আলাদা বানান—আগে যেমন দেখিয়েছি—বর্জন করতে হবে। বঙ্গভাষী অঞ্চলের শিক্ষার্থী শিশুদের মুখ চেয়ে এটা করা দরকার। মধ্যবিত্ত লেখাপড়া-করা লোকেরা বানান নিয়ে খুনসুটি করুন, তাতে আমাদের তত দুর্ভাবনা নেই। শিশুরা এক শব্দের একটিমাত্র বানান শিখছে কি না সেটা অনেক বড় দুশ্চিন্তা। বানানের সমতা-বিধান হলে লোকে বানান ভুল করবে না—এ কথা যুক্তিযুক্ত নয়। ঠিক বানানটা যদি কেউ যত্ন করে না শেখে তা হলেই সে ভুল করতে থাকবে। এর সঙ্গে সংস্কার বা সমতা-বিধানের কোনো সম্পর্ক নেই। সংস্কার যাঁরা করেন তাঁরা বানান শেখান না। বড় জোর একটা অভিধান তৈরি করে দেন। কিন্তু সে অভিধান কজন দেখে? শিক্ষকদের ওপর মূল দায়িত্ব—তাঁরা ঠিক বানান (বা বানানগুলো) জানবেন—কী কী ভুলের সম্ভাবনা আছে তা দেখাবেন, তা হলে ঠিক বানানটা শিক্ষার্থীদের মনে গাঁথা হয়ে যাবে। মুরশিদ সাহেব জানেন, যে ভাষার বানান ‘নদীর ধারার মতো’ চলছে সেই ইংরেজির বানান ও ইংরেজিভাষী ছাত্ররা কম ভুল করে না, করত না অন্তত। আমার কাছে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশার্থী ছাত্রদের ইংরেজি সম্বন্ধে পুরোনো রিপোর্ট আছে। তাতে তাদের বানান ও ইংরেজির মান apalling বলা হয়েছে। এখন অবশ্য স্পেলচেকারের আবিষ্কারে কম্পিউটারে বানান ভুল শোধরানোর একটা উপায় হয়েছে। অপেক্ষা করুন বাংলাতেও ভালো স্পেলচেকার তৈরি হচ্ছে। হয়েছেও কিছু। আচ্ছা, এবার তা হলে এসব স্পেলচেকার কোন বানানের ওপর নির্ভর করবে? যেমন দেখছে তেমন বানান—নাকি কোনো সমিতির পরিকল্পিত নীতি অনুযায়ী বানান? পরিকল্পিত নীতি না হলে—একটি শব্দের একটি বানান না হলে তো স্পেলচেকার তৈরিরই কোনো অর্থ হয় না। আবার বলি, আমি গোলাম মুরশিদ সাহেবের আদ্যন্ত গুণমুগ্ধ। কিন্তু তাঁর এই লেখা একটু ব্যস্ত ও উত্তেজিত হয়ে লেখা—তাই আমার কাছে উসকানিমূলক মনে হয়েছে। ওই উসকানিমূলকতাকে যথোচিত সম্মান জানানোর জন্যই আমার এই আত্মপ্রক্ষেপ। পাদটীকা: বিদ্যাসাগর মশায়ের ব্যাকরণ কৌমুদী-তে ই-কারান্ত স্ত্রীলিঙ্গ শব্দের প্রথম উদাহরণই শ্রেণি। ‘কাহিনী’ সংস্কৃতি কথনিকা থেকে ‘কহনিআ’ হয়ে বাংলায় তদ্ভব ‘কাহিনি’ হয়েছে; তাতে দীর্ঘ ঈ-কার দেওয়ার কোনো জায়গা নেই। ‘বাহিনী’-র সঙ্গে এর কোনো গোত্রের সম্পর্ক নেই। ‘মফস্সল, হিস্সা, লসিস’ করা হয়েছে অসংস্কৃত শব্দে বিসর্গ বা য-ফলার ব্যবহার সীমাবদ্ধ করার জন্য—মফস্সলের সঙ্গে ‘রজঃস্বলা’-রও কোনো জ্ঞাতিসম্পর্ক নেই বলে।প্রথম আলো, [email protected], সাময়িক শিবির, ঢাকা।