জাতীয় কবির নামে স্থাপিত লন্ডনের কবি নজরুল প্রাইমারি স্কুল
উজ্জ্বল দাশ, লন্ডন থেকে : ‘ভিনদেশে জন্ম নিয়ে বাংলায় কথা বলতে পারছি। স্কুলে বাংলা পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এতে আমরা খুব খুশি।’ বলছিল পূর্ব লন্ডনের মালবোরি স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী রাইমা ইসলাম। ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া অধিকাংশ সন্তানের মা-বাবা চান, তাঁদের সন্তান বাংলায় কথা বলবে এবং পড়াশোনার সুযোগ পাবে। দূর পরবাসে নতুন প্রজন্মের কাছে স্বীয় জাতিসত্তার ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখতে মরিয়া সব ভাষাভাষী মানুষ। বাঙালিরাও তার ব্যতিক্রম নয়। ব্রিটেনে মাধ্যমিক স্কুলে ওঠার পর ছেলেমেয়েদের বাধ্যতামূলকভাবে বিষয় হিসেবে একটি দ্বিতীয় বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রথা দীর্ঘদিন থেকে চলছে। শুরুর দিকে দ্বিতীয় ভাষার ব্যাপারে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর ভাষা নিয়েই সবার প্রবল আগ্রহ ছিল। দুই দশকের ওপর হয়ে গেল জিসিএসই এবং পরবর্তী সময়ে এ লেভেলে বাংলা চালু করেছেন ব্রিটেনপ্রবাসী বাংলাদেশিরা। যেকোনো অভিবাসী সমাজের জন্য এটি বিরাট অর্জন। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে মূলধারার প্রায় ৭০টির বেশি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা, বঙ্গবীর ওসমানী, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্কুল। শুধু টাওয়ার হ্যামলেটসে নয়, বাংলাদেশি অধ্যুষিত ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে বাংলা নামের স্কুল। ব্রিটেনে দুই লাখ ২১ হাজারের মতো মানুষ বাংলায় কথা বলেন। ব্রিটিশ পরিসংখ্যান বিভাগের পরিচালিত জরিপ থেকে জানা যায়, দেশটিতে পঞ্চম স্থানে আছে বাংলা ভাষা। ২০১১ সালে পরিচালিত ব্রিটিশ আদমশুমারিতেও একই চিত্র দেখা যায়। এদিকে টাওয়ার হ্যামলেটসের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ দশমিক ১ শতাংশ বাংলাদেশি। পুরো ব্রিটেনে বাংলার প্রসার ঘটলেও বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের স্কুলগুলোতে সেভাবে বাংলার প্রসার হয়নি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রসারের জন্য স্কুলের নামকরণ বাংলায় করা হলেও স্কুলগুলোতে বাংলা শিক্ষা কার্যক্রম সেভাবে এগোতে পারেনি। মডার্ন ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ (এমএফএল) বা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, মান্দারিন, লাতিন অথবা গ্রিক—এই ভাষাগুলোকে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে সরকার। তবে এই সুপারিশের বাইরে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইচ্ছে করলে কিংবা স্কুলের শিক্ষার্থী অথবা বেশির ভাগ অভিভাবক চাইলে বাংলাকে মডার্ন ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ বিষয় হিসেবে নিতে পারেন। টাওয়ার হ্যামলেটসের স্মিদি স্ট্রিট প্রাইমারি স্কুলে ২০০৭ সাল থেকে একটি পাইলট প্রজেক্টের অধীনে মডার্ন ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে বাংলা পড়ানো হচ্ছে। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু প্রাইমারি স্কুল। স্কুলটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জড়িত টাওয়ার হ্যামলেটসের সাবেক কাউন্সিলর সেলিম উল্লাহ। বর্তমানে এই স্কুলটির প্যারেন্টস গভর্নরও তিনি। বাংলা ও বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই স্কুলের বাংলা নামকরণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বঙ্গবন্ধু প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা নেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন স্কুলের অনেক বাংলাদেশি অভিভাবক। প্রাথমিক স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা নেওয়ার জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষককে রাজি করাতে বাংলাদেশি অভিভাবকদের এগিয়ে আসা দরকার বলে মনে করেন শিক্ষক ও কবি শামীম আজাদ। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের উদ্যোগে মূলধারার প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করার জন্য বাংলাদেশ থেকে যে কজন প্রশিক্ষক আনা হয়েছিল, কবি শামীম আজাদ তাঁদেরই একজন। তিনি জানান, এখানকার প্রাথমিক স্কুলগুলোতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে অমর একুশে উদ্যাপন করা হয়। অভিভাবকেরা উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মডার্ন ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে বাংলা অনুমোদন করতে বাধ্য হবেন বলে মনে করেন তিনি।
এসো বাংলা শিখি এদিকে ‘এসো বাংলা শিখি’ নামে একটি সংগঠন টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রাইমারি স্কুলগুলোয় মডার্ন ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে বাংলাকে বিষয় হিসেবে নেওয়ার জন্য প্রচারণা চালিয়ে আসছে। সংগঠনটির প্রধান টাওয়ার হ্যামলেটসের সাবেক কাউন্সিলর গোলাম মর্তুজা। বাংলা চালুর পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের হাতে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁরা। কথা হয় টাওয়ার হ্যামলেটসের কালেক্টিভ অব বাংলাদেশি স্কুল গভর্নরসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহানুর খানের সঙ্গে। নানা কারণে এমএফএল হিসেবে বাংলা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষকদের উৎসাহ কম বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু তাই বলে চুপ করে থাকতে রাজি নন বাংলাপ্রেমী অভিভাবকরা। তাদেরই একজন কুতুব আহমদ। আট বছর বয়সী মেয়ে শর্মিকে তিনি ভর্তি করিয়েছেন বঙ্গবন্ধু স্কুলে। তিনি বলছিলেন, বিলেতে স্কুলে বাংলা পড়তে পারাটা ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের জন্য একটি বিরাট সুযোগ। আমরা সবাই চাই আমাদের সন্তানেরা নিজের মায়ের ভাষা আর দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে বেড়ে উঠুক। শাপলা স্কুলের শিক্ষার্থী আনহার মাহফুজ (৮) বলছিল, স্কুলে পড়তে গিয়ে জেনেছি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের দেশের ভাষার জন্যই হয়েছে। স্কুলে বাংলায় ক্লাসগুলো খুব উপভোগ করি। স্কুলশিক্ষিকা রায়হানা খাতুন স্কুলে বাংলায় পাঠদান প্রসঙ্গে বলেন, ‘ব্রিটিশ বাংলাদেশি নতুন প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি অস্তিত্বের সংকটে ভোগে। আর এই সীমাবদ্ধতা দূর করার মূল হাতিয়ার হচ্ছে ইংরেজির পাশাপাশি নিজ মাতৃভাষায় পাঠদান আরও বেগবান করা। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, শিশুরা খুব সহজেই নিজ মাতৃভাষা আয়ত্ত করতে পারে। আমি মনে করি, ভাষার শক্তি প্রবাসে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মকে নিজ সংস্কৃতির প্রতি আরও আন্তরিক করে তুলবে। ’ ছবি: সংগৃহীত/প্রথম আলো