ইউএসএ নিউজ অনলাইন, নিউইয়র্ক : সাখাওয়াত হোসেন সেলিম, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি: ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর নিউইয়র্কে দেয়া বক্তব্যের অংশবিশেষ অতিরঞ্জন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর রোববার নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে পালকি পার্টি সেন্টারে টাঙ্গাইল জেলা সমিতির এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী হজ, তাবলিক জামাত, টক শো এবং প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় কে নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে বলেন,“জয় কে? জয় সরকারের কেউ নন‘। সজীব ওয়াজেদ জয় স্ক্রংান্ত বক্তব্যকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং প্রচার মাধ্যমে অতিরঞ্জন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার চালানো হচ্ছে, মন্ত্রী বলেছেন সজীব ওয়াজেদ জয় প্রতি মাসে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা বেতন পায়। তিনি নিজে সই করে প্রতি মাসে সজীব ওয়াজেদ জয়কে উল্লেখিত অর্থের চেক দেন। টাঙ্গাইল সমিতির ওই সভায় মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী সজীব ওয়াজেদ জয়কে প্রতি মাসে সই করে চেক প্রদান করেন-এ কথাটি বলেছেন বলে এর কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। ধারন করা খন্ডিত ভিডিও চিত্রের সাথে সভায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন এমন সব ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেও এর কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। সভায় শুরু থেকে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা, বিজ্ঞানী ড. নুরান নবী, ড. জিনাত নবী এবং ফারাক্কা আন্তর্জাতিক কমিটির চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান সালু। ড. নুরান নবী স্পষ্ট করেই বলেন, টাঙ্গাইল সমিতির সভায় আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী সজীব ওয়াজেদ জয় প্রতিমাসে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা বেতন পান এবং সজীব ওয়াজেদ জয়কে প্রতি মাসে নিজে চেক সই করে দেন-এ কথাটি বলেননি। এ প্রসঙ্গে ড. জিনাত নবীও একই কথা বলেন। আতিকুর রহমান সালু বলেন, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর হজ, তাবলিক জামাত সংক্রান্ত বক্তব্যে তিনি মঞ্চে বসেই হতবম্ভ, কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়েন। সজীব ওয়াজেদ জয় প্রতিমাসে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা বেতন পান এবং মন্ত্রী প্রতিমাসে চেক সই করে দেন-এমন বলেছেন বলে আতিকুর রহমান সালুও নিশ্চিত নন বলে জানান। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগের নেতা কাজী কয়েস বলেন, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী পবিত্র হজ, তাবলিক জামাত নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করেছেন। প্রধান মন্ত্রীর আইটি বিষয়ক উপদেষ্টা এবং পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে সরকারের কেউ নন বলে বলেছেন। কিন্তু সজীব ওয়াজেদ জয় প্রতিমাসে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা বেতন পান এবং জয়কে প্রতি মাসে নিজে চেক সই করে টাকা দেয়ার কথা বিরোধীরা অতিরঞ্জন করে প্রচারনায় নেমেছেন বলে কাজী কয়েস মন্তব্য করেন। সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে বক্তব্যের ব্যাপারে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্য জানা যায়নি।
তবে সভায় উপস্থিত সকলেই হযরত মুহাম্মদ (স.), হজ ও তাবলীগ জামাত সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করায় বিতর্কিত লতিফ সিদ্দিকীকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া সরকারের উচিত বলে মত ব্যক্ত করেন।
এদিকে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মেক্সিকো থেকে আবার নিউইয়র্কে এসেছেন। নিউইয়র্কে এসেই তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। মেক্সিকো থেকে নিউইয়র্কে ফেরার সংবাদ সর্বত্র চাউড় হলেও সরকারিভাবে কেউ মুখ না খুলছেন না। একাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি তাকে একটি ভাড়া গাড়িতে চড়ে জেএফকে বিমানবন্দর থেকে নিউইয়র্ক সিটির কুইন্স এলাকায় আসতে দেখেছেন বলে জানান।
একজন প্রবাসী বাংলাদেশি জানান, স্থানীয় সময় ৩ অক্টোবর শুক্রবার সকালে মেক্সিকো থেকে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে নামেন লতিফ সিদ্দিকী। এক সপ্তাহ আগেও মন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করা এই আওয়ামী লীগ নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে কেউ বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন না। সরকারি কোনো গাড়িও দেখা যায়নি। ভাড়া করা একটি গাড়িতে করে তাকে নিউইয়র্ক সিটির কুইন্স এলাকায় যেতে দেখা গেছে বলে একাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, “লতিফ সিদ্দিকী জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন না। এজন্যে তার সফর সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।”
নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেল শামীম আহসান বলেন, “মন্ত্রী মহোদয় ২৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক থেকে মেক্সিকো গেছেন। এরপর সরকারিভাবে আমাকে আর কিছু জানানো হয়নি।”
টাঙ্গাইল সমিতির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত ক’দিন ধরে নিউইয়র্কে প্রবাসীদের বিভিন্ন সংগঠন লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। এ কারণে তিনি ফেরার পরও তার অবস্থান সম্পর্কে কাউকে কিছু জানানো হচ্ছে না।
লতিফ সিদ্দিকীর মেক্সিকো থেকে নিউইয়র্কে ফিরে আসার ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা সমিতির সভাপতি আপেল ‘কিছুই জানেন না’ বলে দাবি করেন। তবে টাঙ্গাইল সমিতিরই আরেক সদস্য বলেন, “লতিফ সিদ্দিকী নিউইয়র্কে এসেছেন। তার মেয়ে কানাডায় থাকেন।
এদিকে লতিফ সিদ্দিকীর কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়ার কথা ভাবছেন বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। মন্ত্রিত্ব থেকে বরখাস্তের সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির পরই তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে লতিফ সিদ্দিকীর ঘনিষ্ট কারো মাধ্যমে এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
লতিফ সিদ্দিকী ঐ সভায় হজ, রাসুল (সা.), তাবলিগ জামাত ছাড়াও প্রবাসীদেরকে নিয়েও অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করেন, প্রবাসের সংবাদপত্রকে টয়লেট পেপার হিসেবে অভিহিত করেন। এজন্যে প্রবাসীরাও প্রচন্ডভাবে ক্ষুব্ধ তার ওপর। একইসাথে ঐ সভামঞ্চে থাকা যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানও লতিফ সিদ্দিকীর ঐসব মন্তব্যের সময় কোন প্রতিবাদ কেন জানাননি-তা নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার পুত্র ও আইটি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে যখন আপত্তিকর বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখনও ড. সিদ্দিকুর রহমান নির্বিকার ছিলেন। লতিফ সিদ্দিকীর ঐসব ঔদ্ধত্বপূর্ণ বক্তব্যের সময় যারা পাশে বসেছিলেন তারা সে সময় কোন উচ্চবাচ্য করেননি বলে জানা গেছে। ঐ বক্তব্য মিডিয়ায় আসার পরপরই ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ড. সিদ্দিকুর রহমান জরুরী সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। ফারাক্কা আন্তর্জাতিক কমিটির চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান সালুও ৪ দিন পর ২ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে লতিফ সিদ্দিকীর শাস্তি দাবি করেন।
নিউইয়র্কে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সংগঠন সভা সমাবেশের মাধ্যমে লতিফ সিদ্দিকীর শাস্তি দাবি করে আসছেন। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে উত্তাল নিউইয়র্ক।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গত ২২ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরপরই মেক্সিকোয় তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক এক বিশ্ব সম্মেলনে পুরস্কার নিতে যাওয়ার পথে নিউইয়র্কে যাত্রাবিরতি নেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে পালকি পার্টি সেন্টারে টাঙ্গাইল জেলা সমিতির এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, “আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী।” তিনি বলেন, বিপুল সংখ্যক মানুষ হজে যাওয়ায় দেশের অর্থ আর শ্রম শক্তির ‘অপচয়’ হয়। উৎপাদনে প্রভাব পড়ে। তার ওই বক্তব্যের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার পর সমালোচনার ঝড় ওঠে।
ওই মন্তব্যের পর সরকারের পক্ষে পুরস্কার নিতে মেক্সিকোর গুয়াদালাহারা শহরে যান মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, তার সঙ্গে ছিলেন প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তবে শেষ পর্যন্ত ৩০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক ওই বিশ্ব সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী পলকই সরকারের পক্ষ থেকে ‘গ্লোবাল আইসিটি এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ নেন বলে মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।