Saturday - March 15, 2025 5:15 PM

Recent News

দুনিয়া কাঁপানো যত ভাষণ

নেতৃত্বের অন্যতম গুণ হলো অন্যকে নিজের মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করা। এ ক্ষেত্রে ভাষণ বা বক্তৃতার কোনো বিকল্প নেই। ধর্ম, রাজনীতি, সমাজগঠনসহ প্রতি ক্ষেত্রেই সফল নেতাদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে অবিস্মরণীয় এক বা একাধিক ভাষণ। বিভিন্ন কারণে এসব ভাষণের কোনো কোনোটি  আবার ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে। এসব ভাষণ ছিল আলোকবর্তিকার মতো, যা ক্রান্তিকালে মানুষকে দিয়েছে মুক্তির পথ। রাজনৈতিক কারণে অমর হয়ে থাকা এমন সাতটি ভাষণের কথা জানাচ্ছেন _ মেজর নাসির উদ্দিন আহম্মেদ (অব.)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
আজকের এই দিনে কানে ভেসে আসছে একাত্তরের ৭ মার্চে ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর বয়স আর ১০ দিন পর একান্ন পূর্ণ হবে। বাবা-মা, স্ত্রী, পাঁচ সন্তান নিয়ে এক সাধারণ জীবনযাপন করছিলেন এই মহান নেতা। তার কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বেশ বিচলিত। সত্তরের নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, ৩ মার্চে নির্ধারিত সংসদ অধিবেশন ভেঙে দেওয়া, দেশব্যাপী চলমান অসহযোগ আন্দোলন ও হরতাল, জনগণের প্রত্যাশার চাপ, সব মিলিয়ে জীবনের এক কঠিন দিন পার করছিলেন তিনি।
এরই মধ্যে ৭মার্চে তৎকালীন রেসকোর্স মাঠে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) আয়োজন করা হয় বিশাল জনসমাবেশ। এ দিন দুপুরে ভাত খেয়ে বিছানায় গেলেন একটু বিশ্রামের জন্য। প্রিয়তমা স্ত্রী পাশে বসলেন পানের বাটা নিয়ে। সহজ-সরল এই গৃহবধূ নিজ স্বার্থ আর সন্তানের মায়া ত্যাগ করলেন দেশের মায়ায়। বঙ্গবন্ধুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কাউকে ভয় করবে না। দেশের মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।
তোমার যা বলা উচিত তাই বলবে, নিঃসংকোচে বলবে, নির্ভয়ে বলবে। সঞ্জীবনী সুধার মতো কাজ করল প্রিয়তমা স্ত্রীর এই অনুপ্রেরণা। বেরিয়ে পড়লেন বঙ্গবন্ধু। রেসকোর্স ময়দান তখন লাখো মানুষের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ। চারদিকে গগনবিদারী স্লোগান। মঞ্চে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আবদুর রাজ্জাকের বর্ণনায় স্লোগান মুখরিত মঞ্চে বঙ্গবন্ধু সামনে এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘মাইকটা দে’। তারপর শুরু করলেন তার কিংবদন্তিতুল্য ভাষণ। প্রথমে তুলে ধরলেন তার দুঃখভরা হৃদয়ের কথা। কারণ দেশে বিভিন্ন শহরের রাজপথ তখন রক্তে রঞ্জিত আর আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত স্বাধীনতা, বেঁচে থাকা আর অধিকার আদায়ের কান্না। একে একে বর্ণনা করলেন প্রথম থেকে তার নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রস্তাব, যাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। বাহান্ন থেকে একে একে প্রায় প্রতিটি বছরে যে রক্তপাত ঘটিয়েছে তারা তারও বর্ণনা দিলেন। এই বর্ণনা থেকে বাদ যায়নি ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের কথাও। নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, জনগণের অধিকারই তার কাম্য। এই অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধু সর্বাত্দক হরতাল ও সর্বগ্রাহী আন্দোলনের ডাক দেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। তার অবর্তমানেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আর সবশেষে তার অগি্নঝরা কণ্ঠে ফুটে উঠে স্বাধীনতার ঘোষণা_ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মন্ত্রের মতো কাজ করে তার এই ঘোষণা। অচল হয়ে পড়ে সমগ্র দেশ, শুরু হয় প্রতিরোধ। এরই ধারাবাহিকতায় আসে ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় নয় মাসের মুক্তিযু্দ্ধ আর ৩০ লাখ জীবন, নারীর সম্ভ্রম, অমূল্য সম্পদ ধ্বংসের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী একদল  সৈন্যের হাতে শহীদ হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আব্রাহাম লিংকন
মাত্র তিন মিনিটে ২৭২ শব্দের এক ভাষণ দিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন। ১৮৬৩ সালের ১-৩ জুলাই তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়ার গেটিসবার্গে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে প্রায় আট হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। তাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে যুদ্ধের প্রায় চার মাস পর এক স্মরণসভায় লিংকন এই বক্তৃতা দেন। প্রচলিত নিয়মে অনুষ্ঠানের মূলবক্তা ছিলেন পেশাদার এবং বাকপটু অ্যাডওয়ার্ড এভার্ট, যিনি প্রায় দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। পরবর্তী সময়ে লিংকন বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করেন। ফটো সাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফাররা ঠিকমতো ক্যামেরা সেট করার আগেই তিন মিনিটের মাথায় তিনি বক্তৃতা শেষ করেন। বক্তব্যের শুরুতে তিনি স্মরণ করেন তার পূর্ব-পুরুষদের, যারা ৪৭ বছর আগে স্বাধীনতা ও সবার মাঝে সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকা মহাদেশের গোড়াপত্তন করেন। মাঝে তার কণ্ঠে ফুটে ওঠে গৃহযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির করুণ আর্তনাদ। আর বক্তৃতা শেষ করেন এক ঐতিহাসিক উক্তি দিয়ে, যা গণতন্ত্রের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা হিসেবে আজও বিবেচিত। তিনি বলেন_ জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার এবং জনগণের জন্য সরকার পৃথিবী থেকে কখনো হারিয়ে যাবে না। এই বক্তৃতার পর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন উপস্থিত জনতা। এমনকি হাততালি দিতেও ভুলে যান তারা। অনেকের ক্যামেরা সচল করার আগেই শেষ হয়ে যায় তিন মিনিটের বক্তৃতা অথচ আজ প্রায় দেড়শ বছর পরও রাজনীতি বিজ্ঞানের গবেষকরা বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন গণতন্ত্রের মোক্ষম সংজ্ঞা দাতা আব্রাহাম লিংকনকে। বাকপটু অ্যাডওয়ার্ড এভার্ট দুঃখ করে বলেন, আমি যদি আমার দুই ঘণ্টার বক্তৃতায় লিংকনের তিন মিনিটের বক্তৃতার মূল কথার কাছাকাছি কিছু বলতে পারতাম, তাহলে জীবন ধন্য হতো। ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল জন উইকস বোথ নামের এক রাজনৈতিক কর্মীর গুলিতে নিহত হন ইতিহাসের এই অমর বক্তা।

মহাত্দা গান্ধী
১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন মাঝপথে। বিশ্বযুদ্ধের দাবানলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে মানবসভ্যতা। পূর্ব থেকে পশ্চিম আর উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্র বাজছে যুদ্ধের দামামা। কেউ লড়ছে গণতন্ত্র রক্ষায়, কেউ নিজ ভূখণ্ড রক্ষায় আবার আগ্রাসী শক্তি ধ্বংসলীলায় মত্ত একের পর এক দেশ জয়ের নেশায়। এমনি এক প্রেক্ষাপটে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে দেখা গেল এক বিপরীত চিত্র। হিংসা নয়, বিদ্বেষ নয়, আক্রমণ নয়_ ত্যাগ আর ভালোবাসাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ব্রিটিশদের ভারত বর্ষ থেকে বিদায় করা এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে এক অভূতপূর্ব সংগ্রামের ডাক দিলেন মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী, যিনি মহাত্দাগান্ধী নামেই ইতিহাসে বেঁচে আছেন। জন্ম ২ অক্টোবর ১৮৬৯ সাল। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে ভারতীয় আইনে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি লাভ করে প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান ২৪ বছর বয়সে। সেখানকার বর্ণবাদ প্রথা তাকে তীব্রভাবে আঘাত করে। পরে ভারতে ফিরে আসেন ১৯১৫ সালে। জড়িয়ে পড়েন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধ শেষ হলেও অপরিবর্তিত থাকে ভারতীয়দের ভাগ্য। গান্ধী উপলব্ধি করেন পরাধীন জাতির ভাগ্যে কখনো পরিবর্তন ঘটে না। তাই শুরু করেন ‘ব্রিটিশ খেদাও’ বা ‘কুউট ইন্ডিয়া’ আন্দোলন। ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের উদাহরণ সৃষ্টি করতে ইংল্যান্ডের স্যুটকোট ফেলে গায়ে তুলে নেন দেশীয় চরকায় বোনা তাঁতের ধুতি ও চাদর। অনেকেই তখন ভেবেছিলেন গান্ধীর দর্শনে মহাপরাক্রমশালী ব্রিটিশদের কখনো বিতাড়ন করা যাবে না। তারা মনে করতেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের বিকল্প নেই। ব্রিটিশবিরোধী বিদেশি কিছু শক্তিও মদদ জোগায় তাদের। কিন্তু গান্ধী তার অহিংস আন্দোলনের প্রতি ছিলেন অবিচল। শত-সহস্র প্রতিকূলতা এবং হুমকির মুখেও নিজ দর্শন থেকে এক চুলও নড়েননি মহাত্দাগান্ধী। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ৮ আগস্ট ১৯৪২ সালে মহাত্দাগান্ধী তৎকালীন বোম্বের গাওলিয়া ট্যাক ময়দানে ব্রিটিশদের প্রতি ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানান, যা ভারত ছাড় বা কুইট ইন্ডিয়া বক্তৃতা নামে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে।  ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নথুরাম গডসে নামের এক হিন্দু জাতীয়তাবাদীর গুলিতে এই মহান নেতার মৃত্যু ঘটে।

নেলসন ম্যান্ডেলা
সর্বগ্রাসী বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সফল সংগ্রামের আরেক নাম নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার কুনু গ্রামে এক উপজাতীয় নেতার ঘরে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পরিণত বয়সে আইনের ছাত্র হিসেবে ম্যান্ডেলা আইন পেশাকে বেছে নিতে চাইলেও আইনেরই অপপ্রয়োগে তাকে দীর্ঘ প্রায় ২৮ বছর বরণ করতে হয় কারা জীবন। যার শুরু ১৯৬২ সালে আর শেষ হয় ১৯৯০ সালে। কৃষ্ণাঙ্গ এই নেতার মূল সংগ্রাম ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে। শাসকের রক্তচক্ষু, নির্যাতন, জেল-জুলুম এমনকি মৃত্যুকে উপেক্ষা করে তিনি কেবল নিজেই সংগ্রাম করেননি, বরং তার অপূর্ব বক্তৃতার দ্বারা উজ্জীবিত করেন পৃথিবীর সব শোষিত মানুষকে। তাই ম্যান্ডেলা কেবল দক্ষিণ আফ্রিকার নেতাই নন, যে কোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের এক সার্থক প্রতীক, এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক জীবনে তিনি বহু ভাষণ দেন, যা একাধিকবার শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে তোলে। কখনো সংগ্রাম, কখনো আত্দত্যাগ, কখনো বা একাত্দতার জন্য ক্ষমা করার আহ্বান সংবলিত তার প্রতিষ্ঠিত ভাষণ ইতিহাসের মূল্যবান সম্পদ। তবে ১৯৫৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি বা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলার বক্তৃতাটি স্মরণীয় হয়ে আছে অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে। এই বক্তৃতার অনেকটুকুই পরবর্তী সময়ে তার বিরুদ্ধে চলা আইনি যুদ্ধে কখনো তার নিজ কণ্ঠে আবার কখনোবা তার আইনজীবীদের কণ্ঠে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে। ম্যান্ডেলা ২১ সেপ্টেম্বরের এই বক্তৃতা শুরু করেন ১৯১২ সাল থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর চলমান শ্বেতাঙ্গদের নির্যাতনের কথা দিয়ে, যা সমালোচিত হয়েছে ঘরে-বাইরে, প্রাদেশিক ও জাতীয় সমাবেশে, ট্রেনে-বাসে, কল-কারখানায়, খেত-খামারে, গ্রামগঞ্জে, শহরে, স্কুলে এবং জেলখানায়। ছন্দময় এবং কাব্যিক এই বক্তৃতায় ম্যান্ডেলা শত প্রতিকূলতার মাঝেও জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নিজেদের শক্তি সম্পর্কে সচেতনতাকে তাদের জন্য এক বিজয় বলে উল্লেখ করেন। তবে সবচেয়ে বড় বিজয় বা স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে ম্যান্ডেলা উল্লেখ করেন তার অমর বাণী, ‘স্বাধীনতা অর্জনের কোনো সহজ পথ নেই।’

মার্টিন লুথার কিং
আজ ৭ মার্চ, দিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করেছে এক রক্তস্নাত দিন হিসেবে। ১৯৬৫ সালের ৭ মার্চ ছিল রোববার। বর্ণবাদের বিষবাষ্পে উত্তাল সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর অহিংস আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ জনতা শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে সেলমা থেকে এগিয়ে চলেছে প্রাদেশিক রাজধানী মন্টোগোমারীর দিকে। এমনি সময় প্রতিপক্ষ শ্বেতাঙ্গ আর পুলিশ বর্বরোচিত হামলা চালায় এই মিছিলের ওপর। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। আর ৭ মার্চ ১৯৬৫ দিনটি পরিচিতি পায় ‘ব্লাডি সানডে’ বা রক্তস্নাত রোববার হিসেবে। তবে যে ভাষণের জন্য মার্টিন লুথার কিং চির স্মরণীয় হয়ে আছেন, তা উচ্চারিত হয় ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরে। এ দিন মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় ওয়াশিংটন। কিং-এর সহকর্মী, বেকার যুবক, স্বাধীনতাকামী সাধারণ জনতা, ধর্মীয় নেতা, শ্রমিক নেতা এবং কৃষ্ণাঙ্গ নেতাদের নেতৃত্বে মানুষের ঢল নামে ওয়াশিংটন স্মৃতিসৌধ লিংকন স্কোয়ার পর্যন্ত। বব ডিলন আর জন বয়েজের বিপ্লবী গানের সুরে উত্তাল জনসমুদ্রে একে একে বক্তব্য রাখলেন অন্য নেতারা। সর্বশেষে এলো মার্টিন লুথার কিং-এর পালা। প্রথমে সন্তোষ প্রকাশ করলেন স্বাধীনতার জন্য আয়োজিত মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সমাবেশে যোগদানের সুযোগ পাওয়ার জন্য। তুলে ধরলেন শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণ আর কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর নির্যাতন ও বঞ্চনার কথা। বললেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোনো প্রাপ্তি নেই, যতক্ষণ নিগ্রোরা পুলিশের বর্ণনাতীত নির্যাতনের শিকার হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোনো প্রাপ্তি নেই, যতক্ষণ ভ্রমণক্লান্ত নিগ্রোরা শহরের হোটেল বা মোটেলে বিশ্রামের অধিকার পাবে। ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের প্রাপ্তি নেই, যতক্ষণ আমাদের শিশুরা ‘কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গদের জন্য’ লেখা সাইনবোর্ড দেখবে। আমি জানি, তোমরা কেউ এসেছ দূর-দূরান্ত থেকে। কেউ জেলের কুঠরী থেকে। কেউ পুলিশের টর্চার সেল থেকে। তোমরা যার যার ঘরে ফিরে যাও। কিন্তু কাদা পানিতে ডুব দিয়ে থেক না। হয়তো আজ বা আগামীকাল আমাদের জন্য সংকটময় হবে। তবুও আমি স্বপ্ন দেখি, এই স্বপ্নগাথা আছে আমেরিকার অস্তিত্বে। আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন এই জাতি জাগ্রত হবে এবং মানুষের এই বিশ্বাসের মূল্যায়ন করবে, সব মানুষ জন্মসূত্রে সমান। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টা ১ মিনিটে জেমসং আর্ল রে নামের এক আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান এই কৃষাঙ্গ মহানায়ক।

পেট্রিক হেনরি
মার্চ মাসটি স্মরণীয় হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বীপরাজ্য ভার্জিনিয়ার মানুষের কাছে। ১৭৭৫ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন ভার্জিনিয়া রাজ্যের শাসক পেট্রিক হেনরি রিমেন্ডের সেইন্ট জন চার্চে উপস্থিত স্থানীয় নেতা, আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন ও জর্জ ওয়াশিংটন এবং সর্বস্তরের জনগণের উদ্দেশে ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ডাক দেন। যুগ যুগ ধরে বিপ্লবের যে চেতনা ভার্জিনিয়াবাসীর হৃদয়ে ছাই-চাপা আগুনের মতো জ্বলছিল, তাই যেন স্ফুলিঙ্গ হয়ে ধরা দেয় পেট্রিক হেনারির এক উচ্চারণে_ ‘আমাকে স্বাধীনতা দাও, নয়তো মৃত্যু’। যুদ্ধের ডাক দেওয়ার আগে শান্তি প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে হেনরি বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠায় যা কিছু তিনি করেছেন, তা কাজ করেনি, কাজ করছে না এবং ভবিষ্যতেও করবে না। তাই সমাধানের একটাই পথ তিনি দেখেন_ তা হলো যুদ্ধ করা, যা অচিরেই নয় এখনই শুরু করতে হবে। কারণ যুদ্ধ এড়ানোর কোনো পথ নেই। তাই তাকে সাহসিকতার সঙ্গে আলিঙ্গন করতে হবে। এই যুদ্ধে পিছ-পা হওয়ার অর্থ দাসত্বকে মেনে নেওয়া। তাই হেনরি পরাধীনতার শিকলের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, এই শিকলে জং ধরে গেছে। শিকলের ঝন-ঝনানি শব্দ শোনা যাচ্ছে। অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে দুবার উচ্চারণ করেন, ‘তাকে আসতে দাও, তাকে আসতে দাও’। যুদ্ধরত অন্যদের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, আমাদের ভাইরা লড়াই শুরু করেছে। সুতরাং অলস বসে থাকার সময় নেই। ভদ্রতা দেখানোর সময় নেই। এরপর তিনি ছুড়ে দেন এক ঐতিহাসিক প্রশ্ন, ‘জীবন কি এতই প্রিয় আর শান্তি কি এতই মধুর যে, শিকল আর দাসত্বের দামে তাকে কিনতে হবে?’ এ প্রশ্নের স্বঘোষিত উত্তরই যেন তার অমর বাণী ‘আমি জানি না অন্যরা কোন পথ বেছে নেবে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বলব_ আমাকে স্বাধীনতা দাও, নয়তো মৃত্যু’। পেট্রিক হেনরির এই আবেদনে ব্যাপক সাড়া ফেলে উপস্থিত জনতার মাঝে। বৃথা যায়নি হেনরির সাহসী উচ্চারণ।

উইনস্টন চার্চিল
দুই আঙ্গুল উঁচিয়ে ভি বা বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন ইংল্যান্ডের দুবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং যুদ্ধকালের সফল রাজনৈতিক নেতা ও শাসক উইনস্টন চার্চিল। ইংল্যান্ডের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম ১৮৭৫ সালের ৩০ নভেম্বর। ইতিহাসের সফলতম এই রাষ্ট্রনায়ক ছাত্র হিসেবে সাফল্য লাভ করেননি। স্কুলের গণ্ডি পেরুতে তাকে তিনটি স্কুল বদলাতে হয়। আর সামরিক জীবনে প্রবেশ করতে পরীক্ষায় পাস করেন তিনবারের প্রচেষ্টায়। অথচ এক সময় তিনিই হলেন ওয়াশিংটন পোস্টের মতো পত্রিকার রিপোর্টার। তিনিই একমাত্র ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। সামরিক জীবনে চার্চিল যুদ্ধ করেন কিউবা, ভারত, সুদান, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও জড়িয়েছিলেন চার্চিল। সেনাজীবন ছেড়ে চার্চিল রাজনীতিতে যোগ দেন এবং সেখানে লাভ করেন ব্যাপক সাফল্য। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ এবং ১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ এই দুই মেয়াদে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন উইনস্টন চার্চিল। সামরিক জীবন এবং রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য বক্তৃতা দিলেও ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে তার ১৩ মে ১৯৪০ সালের ভাষণটি। উল্লেখ্য, এই ভাষণের প্রায় আট দিন আগে ৩ মে ১৯৩৯ সালে ইংল্যান্ড জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪০ সালে এই যুদ্ধ ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে এক নাটকীয় পরিবর্তন আনে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ১৯৪০ সালের  ১২ মে উইনস্টন চার্চিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চার্চিল আগ্রাসী ভূমিকা এবং একগুঁয়েমির কারণে জার্মানির সঙ্গে যে কোনো আপসের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেন এবং দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ১৩ মে নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সে চার্চিল প্রথম বক্তৃতা করেন। হাউস অব কমন্সে তখন বেশ উত্তেজনা। বিভিন্ন কারণে এক সময়ের প্রশংসিত প্রধানমন্ত্রী নিভাইল চেম্বারলিকে সরিয়ে যুদ্ধবাজ হিসেবে খ্যাত চার্চিলের দায়িত্ব গ্রহণকে সহজে মেনে নিতে পারেনি অনেকেই। এমনি এক প্রেক্ষাপটে চার্চিল শুরু করেন তার ভাষণ। বক্তব্যের শুরুতে তিনি তার নিজের এবং যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘ওয়ার ক্যাবিনেট’ এর দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। ঠিক সেই মুহূর্তে বিরাজমান যুদ্ধ এবং যুদ্ধ প্রস্তুতিরও বর্ণনা দেন চার্চিল। এক ফাঁকে ক্ষমা চেয়ে নেন পরিবেশনের কারণে প্রচলিত নিয়মে দীর্ঘক্ষণ বক্তৃতা দিতে পারবেন না বলে। যুদ্ধের জন্য সবার সমর্থনসহায়তা কামনা করে উচ্চারণ করেন সেই অবিস্মরণীয় বাণী, যার মূল কথা_ যারা এই সরকারে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন তাদের আমি বলেছি আর এই মহান সংসদকেও বলছি, ‘দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমার, আছে শুধু রক্ত, কষ্ট, অশ্রু আর ঘাম, আমাদের সামনে অগি্নপরীক্ষা, আমাদের মাসের পর মাস যুদ্ধ করতে হবে আর কষ্ট সইতে হবে। তোমরা যদি জিজ্ঞেস কর আমাদের নীতিমালা বা পলিসি কি, তাহলে বলব আমাদের একটাই নীতি; জল, স্থল ও আকশপথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, আমাদের সবটুকু সামর্থ্য আর ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তি নিয়ে আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেত হবে এক নিষ্ঠুর দানবের বিরুদ্ধে। এটাই আমাদের নীতি, আর যদি প্রশ্ন কর আমাদের লক্ষ্য কি? আমি এক কথায় উত্তর দেব_ বিজয়। পথ যতই দীর্ঘ কিংবা দুর্গম হোক, বিজয় ছাড়া আমাদের বাঁচার কোনো পথ নেই।’The Bangladesh Pratidin

0Shares