Friday - March 14, 2025 8:44 PM

Recent News

বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংশয় গার্ডিয়ানের

সরকারের অনড় অবস্থান আর বিরোধীদের তত্ত্বাবধায়কসহ বিভিন্ন দাবির প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান।
পত্রিকাটির গতকাল মঙ্গলবারের অনলাইন সংস্করণে ‘ভায়োলেন্স অ্যান্ড প্রোটেস্ট কুড ডিরেইল বাংলাদেশ ইলেকশন’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ব্যাপারে অবিচল থাকলেও সহিংসতা আর বিক্ষোভের কারণে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ব্যাহত হতে পারে।
গত মাসে রাজপথে ঘটা সহিংসতা এবং সামনে বিরোধী দলের আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি চলমান গরম আবহাওয়াকে আরো উত্তপ্ত করতে পারে মন্তব্য করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ঘটনায় অনেকের ধারণা নির্বাচনের আগেই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে পড়বে বিশ্বের অষ্টম জনবহুল এই দেশটি।
এ প্রসঙ্গে ছয় বছর আগে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুতে সংঘটিত সংঘাতময় পরিস্থিতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সে সময় সহিংসতা ও হরতালের কারণে জাতীয় নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায় এবং সহিংস পরিস্থিতি এড়াতে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে।
এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্দেশে গঠিত ‘বিতর্কিত’ আদালতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়ার পর গত ফেব্রুয়ারিতে দেশজুড়ে ঘটা সহিংসতায় ৭০ ব্যক্তি নিহত হওয়া এবং এ ঘটনায় রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রসঙ্গও তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনটিতে গত এপ্রিলে সাভারে রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩০ শ্রমিকের নিহত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয়, এ ঘটনায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছে, সামনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে এই শিল্প ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
সুষ্ঠু নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছাকে অবশ্য অস্বীকার করা হয়নি প্রতিবেদনটিতে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সঙ্গে কথা হয় গার্ডিয়ানের। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের পথেই রয়েছে বাংলাদেশ, প্রস্তুতিতেও ঘাটতি নেই।’ আর চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পর্কে তিনি বলেন, অতীতে নানা কারণে এই বিচার শুরু সম্ভব না হলেও মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পরে পাওয়া রায় দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করছে। তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিছু বাধা-বিপত্তি থাকলেও সংবিধানসম্মতভাবে সময়মতো নির্বাচন হবে।’
তবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবির বিষয়টি উল্লেখ করে গার্ডিয়ান বলেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এখনো ‘অনেক’ বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে।
রিজভী গার্ডিয়ানকে জানান, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচনকালে সব নির্বাহী ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার কাছে ‘যথেষ্ট নয়’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বিএনপির এক নেতার আশঙ্কা উদ্ধৃত করে বলা হয়, তাদের দলের নীতিনির্ধারকরা বিশ্বাস করেন, শেখ হাসিনা ও তাঁর দল বিএনপিকে নির্বাচন বয়কট করতে বাধ্য করে ‘একদলীয় নির্বাচনের’ মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার পরিকল্পনা করছে। ওই বিএনপি নেতার দাবি, ‘বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনরা সব সময় হারে। সরকার জানে, তারা নির্বাচনে হারবে তাই ক্ষমতা ধরে রাখতে তারা যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত।’ তিনি গার্ডিয়ানকে জানান, পরীক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে এত দিন কর্মসূচি না দিলেও আগামী সপ্তাহ থেকে রাজপথে বিক্ষোভ শুরু করতে যাচ্ছে বিএনপি। এ কর্মসূচি চলবে জুলাইয়ে রোজা শুরুর আগ পর্যন্ত।
এ কর্মসূচি আর সরকারের অবস্থান বিশ্লেষণ করে গার্ডিয়ানের মন্তব্য, (রোজার আগের) এই সময়টা উভয় পক্ষের জন্যই হচ্ছে শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ। এরপর (ঈদের পরে) শরতে শুরু হয়ে যাবে দুই পক্ষের ‘মূল লড়াই’।
গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিতে পারে। সেগুলো হলো : ইসলামী দলগুলোর ভূমিকা, চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং তরুণ ভোটারদের সংগঠিত হওয়া। এ বিষয়গুলোও পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বিএনপির জোটের প্রধান শরিক দল জামায়াতে ইসলামী একই সঙ্গে প্রধানতম ইসলামী দল এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারে এই দলেরই বেশির ভাগ নেতা অভিযুক্ত। নেতাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোকে ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক’ হিসেবে দাবি করলেও সরকার তা বরাবর অস্বীকার করে আসছে।
এ বছর জামায়াতে ইসলামীর বাইরে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামের মাদ্রাসা শক্তি সংবলিত নতুন একটি ইসলামপন্থী শক্তি দেখা দিয়েছে। প্রতিবেদনে গত ৫ মে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে পুলিশি অ্যাকশনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলা হয়, ‘হেফাজতে ইসলাম গত মাসে রাজধানীতে বড় ধরনের বিক্ষোভ করে, যার সমাপ্তি ঘটে পুলিশের হাতে বেশ কিছু বিক্ষোভকারী নিহত হওয়ার মাধ্যমে।’ দলটির অন্যতম নেতা ও খেলাফত আন্দোলনের আমির শাহ আহমেদুল্লা আশরাফি তাদের জানিয়েছেন, দাবি পূরণ না হলে হেফাজতের নেতা-কর্মীরা আবারও রাজপথে নামবে।
অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্তদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে চলতি বছরের শুরুতে যে তরুণরা শাহবাগে জড়ো হয়েছিল, তারাও শিগগিরই নতুন কর্মসূচিতে যাবে। জামায়াতকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ দাবি করে দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে এই মঞ্চের মাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছে তারা।
তবে ফেসবুকের মাধ্যমে শাহবাগের এই আন্দোলনকে সংগঠিত করলেও এর প্রধান সংগঠক ইমরান এইচ সরকার এখন আত্মগোপনে আছেন বলে জানানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, আত্মগোপন অবস্থায় ইমরান তাদের জানিয়েছেন, শিগগিরই নতুন প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চ।
তবে আসন্ন নির্বাচন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে জামায়াতও নতুন পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক। গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, ‘রাজপথে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকার সবারই আছে।’
এই পরিস্থিতিতে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনের শেষ মন্তব্য : ‘মনে হচ্ছে, একটা বিষয়েই সব পক্ষ একমত; তা হচ্ছে সংগ্রাম, যার জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে রাজপথেই।’
গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিবাদ : ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’-এ বাংলাদেশে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চার সিটি নির্বাচন ও গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে প্রকাশিত নিবন্ধের প্রতিবাদ জানিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার এক লিখিত বিবৃতিতে এ নিবন্ধের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানান।
বিবৃতিতে ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘নিবন্ধের ১৫তম অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ‘সো-কলড ট্রাইব্যুনাল’ হিসেবে উল্লেখ করে গার্ডিয়ান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত হেনেছে। তারুণ্যের দুর্বার আন্দোলন যখন জামাত-শিবির নিষিদ্ধকরণ ও তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চিহ্ন করার প্রত্যয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তখন গার্ডিয়ানের এ নিবন্ধ গণমানুষের চেতনার পরিপন্থী। গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে এ নিবন্ধের ভিত্তিহীন ও দূরভিসন্ধিমূলক অংশের প্রতিবাদ করছি।’
‘গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার আত্মগোপনে আছেন’ নিবন্ধের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে ইমরান বলেন, ‘এ ধরনের বক্তব্য ভিত্তিহীন, অমূলক ও অনভিপ্রেত।’ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে ইমরান আরো বলেন, দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূলকেন্দ্র এই ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গার্ডিয়ান গণমাধ্যম হিসেবে তাদের নেতিবাচক অবস্থানের প্রমাণ দিয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
উল্লেখ্য, গতকাল গার্ডিয়ানে জেসন বার্কের ‘ঠরড়ষবহপব ধহফ ঢ়ৎড়ঃবংঃং পড়ঁষফ ফবৎধরষ ইধহমষধফবংয বষবপঃরড়হং’ শিরোনামে বিতর্কিত নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়।কালের কণ্ঠ
0Shares

COMMENTS