শিক্ষা নিতে হয় ভুল থেকে – ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটার ব্রায়ান লারা

ব্রায়ান লারা : ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটার ব্রায়ান লারা জন্মগ্রহণ করেন ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোব্যাগোতে, ১৯৬৯ সালের ২ মে। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ৫০১ রান ও টেস্ট ক্রিকেটে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ৪০০ রানের মালিক লারা।
আমার ধারণা, টি টোয়েন্টি ক্রিকেটের কারণেই খেলায় তৈরি হয়েছে বৈচিত্র্য। এর মাধ্যমে দর্শক ও পৃষ্ঠপোষকদের কাছে ক্রিকেটের কদর বেড়েছে আগের থেকে অনেকখানি। এখন পৃষ্ঠপোষকরা টি টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেন। এই পৃষ্ঠপোষকরা কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের জন্য এত আগ্রহী না। এত জৌলুশ, এত আলোকচ্ছটার পরেও টেস্ট ক্রিকেটই এখনো সেই আগের মতোই উঁচু শিখরে অসীন। আমি নিজেকে একজন টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে দেখতেই পছন্দ করি। আমি ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছি টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছায়। অস্ট্রেলিয়ায় যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলতে যেত তখন আমাদের ওখানে গভীর রাত হয়ে যেত। আমি রাত জেগে জেগে রেডিওতে খেলার ধারাভাষ্য শুনতাম। বাবা যখন দেখতে আসতেন আমি ও আমার ভাই ঘুমিয়েছি কি না, তখন আমি রেডিও লুকিয়ে নাক ডাকার ভান করতাম। টি-২০ খেলার বেশ কিছু ভালো দিক আছে। এর মাধ্যমে ক্রিকেটাররা ছয় সপ্তাহে তিন কোটি ডলারা পর্যন্ত উপার্জন করতে পারে। ক্রিকেটের মহারথীদের একজন ভিভ রিচার্ডস। তিনি ২০ বছর ক্রিকেট খেলেছেন। কিন্তু তিনি কখনোই তিন কোটি ডলার উপার্জন করতে পারেননি। আমি মনে করি, টেস্ট ক্রিকেট ও টি-২০ একসঙ্গে চলতে পারে। আমরা খেলার সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি। কিন্তু এখন অনেকে আছে, যারা ক্রিকেট খেলা কী তা জানে না। যারা কখনোই ক্রিকেট খেলা দেখেনি, তাদের জন্য টি-২০ বেশ উপভোগের। যারা আগে টেস্ট ক্রিকেট দেখত, এখনো তারা টেস্ট খেলা উপভোগ করে। টি-২০ নতুন ধরনের দর্শক তৈরি করেছে। আমি যদি আগামীকাল সকালে উঠে দেখি টেস্ট ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়ে গেছে, তাহলে আমি ভীষণ কষ্ট পাব। আমার ব্যাটিং স্টাইল কখনোই নির্ভুল নয়। আমারও খুঁত আছে। জীবনে অনেকবার আমি টের পেয়েছি আমার ব্যাটিংয়ে খুঁত আছে। কিন্তু আমার বড় একটি সুবিধা আছে। আমি খুব দ্রুতই আমার ভুলগুলো শুধরে নিতে পারি। যে মৌসুমে ক্রিকেট খেলা থাকত না সেই মৌসুমে আমার ভুল শোধরানোর জন্য মাঠে সারাক্ষণ পড়ে থাকতাম। আমি ২২ গজের পিচকে বাড়ি বানিয়ে ফেলতাম। আমি স্পিন বলে বেশ ভালো খেলি। কারণ, ত্রিনিদাদে ছোটবেলা থেকেই আমি স্পিন বল খেলতাম বেশি। আমাদের ওখানে ব্রিটিশ আমলে ভারত থেকে অনেক মানুষ অভিবাসিত হয়, যার কারণে ভারতীয়দের মতো ত্রিনিদাদের লোকজন স্পিন বোলিংয়ে ভালো করে। কিন্তু বারবাডোজ, জ্যামাইকার লোকজন দ্রুতগতির ফাস্ট বোলিং করতে অভ্যস্ত ছিল। আমি ওখানেও মানিয়ে নিয়েছিলাম। আমার দেখা সেরা ফাস্ট বোলার ছিল ওয়াসিম আকরাম আর স্পিনে শেন ওয়ার্ন। মুরালিও বেশ ভালো বোলিং করে। আমাকে শেন ওয়ার্ন ও মুরালির মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বললে আমি ওয়ার্নকেই বেছে নেব। মুরালির থেকে ওয়ার্নি বেশ স্থিরভাবে বোলিং করত। ফাস্ট বোলার হিসেবে ওয়াসিম আকরাম ছিল দুর্ধর্ষ। আমার ১৯৯২ সালের কথা মনে আছে। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের খেলার কিছুদিন আগে আমাকে জানানো হয় আমি ওপেনিংয়ে ব্যাটিং করব। কিন্তু আমি তো সচরাচর ওপেনিংয়ে ব্যাটিং করি না। আমাকে কেউ কিছুই জানায়নি। আমি বেশ চিন্তিত ছিলাম। বল নিয়ে সুইং করতে পারাটা যে কত খানি ভয়ংকর হতে পারে তা আকরাম জানত। গর্ডন গ্রিনিজ আমাকে ফাস্ট বোলার মোকাবিলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আকরামের মতো ফাস্ট বোলারকে মোকাবিলা করার জন্য বোলিং প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকাটাই নিরাপদ। সে জন্য আমি প্রথম বলেই এক রান নিয়ে বোলিং প্রান্তে চলে যাই। কিন্তু ছক পাল্টে যায়, যখন গর্ডন গ্রিনিজ নিজেই এক রান নিয়ে আমাকে পুনরায় ব্যাটিংয়ে পাঠান। সেই ওভার যে কীভাবে শেষ হয়েছিল আমার মনে নেই। আমি ওভার শেষে গর্ডনকে ধরলাম, কেন আমাকে সে বিপদে ফেলল। গর্ডনের নীরস উত্তর ছিল, ‘আমি যা বলি সেটা আমাকে শুনতেই হবে, এমন কোনো কারণ কি আছে?’ আমি প্রত্যুত্তরে বলেছিলাম, ‘বেঁচে ফিরতে পারলে আমি আর জীবনেও ওপেনিং করব না।’ আমার আরেকটি ঘটনা সব সময় মনে পড়ে। ক্রিকেটার ম্যালকম মার্শাল ক্রিকেটের অন্যতম সেরাদের একজন। ১৯৯১ সালে স্থানীয় এক ক্রিকেট ম্যাচে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি বোধ হয় সেদিন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলাম। তিনি যখন বোলিং করতে আসেন, আমি তাঁর বলে একটি ছক্কা হাঁকাই। ম্যালকম শুধু আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। তাঁর মুখে আমি স্পষ্ট লেখা দেখেছিলাম, আমার শেষ তিনি দেখেই ছাড়বেন। বছর খানেক পরে তাঁর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয় এক ক্রিকেট ম্যাচে। সে ম্যাচে তিনি আমাকে আমার শেষ একটু হলেও দেখিয়ে ছেড়েছিলেন। ভাগ্যিস আমি হেলমেট পরেছিলাম। নইলে তাঁর বল কখন আমার মাথা ছাতু করে দিয়ে চলে যেত। দ্বিতীয় সুযোগের প্রতীক্ষায় আমি কখনোই বসে থাকি না। তার ওপর, আমাদের জীবন কোনো নাট্যমঞ্চ নয় যে এখানে মহড়ার সুযোগ আছে। আমাকেই আমার জীবন নিয়ে বাঁচতে হবে। আমাদের ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটে সেই আগের মতো ধার নেই। আমার মতে, এই সমস্যার মূল কারণ হলো আমাদের ক্রিকেট প্রশাসন। আমাদের ক্রিকেটারদের প্রশাসন তেমন সুযোগ-সুবিধা দিতে চায় না। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের তুলনায় আমাদের ক্রিকেটাররা বঞ্চিত। ১৯৯৬ সালে যখন শিবনারায়ণ চন্দরপল ক্রিকেট জগতে পা রাখে, তখন তার আর রিকি পন্টিংয়ের মধ্যে তেমন পার্থক্য ছিল না। দুজনেই ভালো ক্রিকেটার। কিন্তু শিব পন্টিংয়ের মতো উন্নত সুযোগের অভাবে সেরা ক্রিকেটারদের দলে নাম লেখাতে পারেনি। আমার মতে, ওয়েস্ট ইন্ডিজেই বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবী ক্রিকেটাররা খেলে। কিন্তু অন্য দেশ যেখানে সাধারণ ক্রিকেটারদের সেরা ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলে, আমরা সেখানে সেরা ক্রিকেটারদের সাধারণ মানে নামিয়ে দিই। ১৯৮৯ সালে আমি যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলে ক্রিকেট খেলা শুরু করি, তখন আমি ছিলাম ১৯ বছরের তরুণ। আমি আমার চোখে নায়ক ক্রিকেটার ভিভ রিচার্ডস, গ্রিনিজদের সঙ্গে খেলার সুযোগে ছিলাম অভিভূত। আমি চিন্তা করেছিলাম, তাঁরা আমার কাঁধে হাত রেখে উৎসাহ দেবেন। কিন্তু বাস্তবে আমি তাঁদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাইনি। কারণ, এই ক্রিকেটাররা তখন ক্যারিয়ারের একেবারে শেষ পর্বে ছিলেন। নিজেরা অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছিলেন। আমাকে সবাই আমার সেরা ইনিংসটির কথা জিজ্ঞেস করে। আমার সেরা ইনিংসটি খেলেছিলাম জ্যামাইকার কিংস্টনে। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের দলের অবস্থা তেমন সুবিধার ছিল না। আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিলাম। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আমরা ২-২-এ টেস্ট সিরিজ ড্র করি। আমি একটি দ্বিশতক ও তিনটি শতকের মাধ্যমে ৫৪৬ রান করেছিলাম সেবার। কিংস্টনে আমি ২১৩ রান করেছিলাম। আমার সব সময়ের চেষ্টা ছিল ধারাবাহিকভাবে খেলে যাওয়া। আমি সব সময়ই চেষ্টা করতাম আমার দল যেন আমার ওপর ভরসা রাখতে পারে। আমি সবকিছুতে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে যাই। আমিও মাঝে মাঝে ভীষণ বড় আকারের ভুল করে থাকি। কিন্তু ভুলগুলোকে অবহেলা করা চলবে না। আমি সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিই। ৭ নভেম্বর ২০১১ সালে থার্ডম্যান ক্রিকেটকে দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে লিখেছেন জাহিদ হোসাইন খান/প্রথম আলো