নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশী ফোরামের মতবিনিময় সভা : অন্তরবর্তী সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি, যা বললেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব খালেদ মুহিউদ্দীন (ভিডিও সহ)
ইউএসএনিউজঅনলাইন.কম : নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশি ফোরামের ব্যানারে বাংলাদেশের অন্তরবর্তী সরকারের কাছে প্রবাসীদের পক্ষে ১৩ দফা দাবি পেশ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ৮ সেপ্টেম্বর রোববার বিকেলে সিটির জ্যাকসন হাইটসের জুইশ সেন্টারে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখারও প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয় সভা থেকে।
প্রবাসী বাংলাদেশি ফোরামের আহ্বায়ক ফখরুল আলমের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব খালেদ মুহিউদ্দীন। বিশেষ অতিথি ছিলেন অ্যাসালের ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ও প্রতিষ্ঠাতা মাফ মিসবাহ উদ্দিন, আশা হোম কেয়ারের প্রেসিডেন্ট আকাশ রহমান, অ্যাটর্নি শেখ সেলিম, কমিউনিটি বোর্ড ৯ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এন মজুমদার, ড. মহসীন আর পাটোয়ারি, ইঞ্জিনিয়ার রায়হানুল ইসলাম চৌধুরী এবং ডা. ওয়াদুদ ভূঁইয়া।
যৌথভাবে অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সাংবাদিক আশরাফুল হাসান বুলবুল এবং কমিউনিটির এক্টিভিস্ট শামীম আহমেদ। সভায় শহীদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। স্বাগত বক্তব্য দেন ফখরুল আলম।
সভায় ১৩ দফা দাবি উপস্থাপন করেন কমিউনিটির এক্টিভিস্ট আহসান হাবীব। দাবিগুলো হলো: ১. জাতীয় সংসদে ও রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রবাসীদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা। ২. নিউইয়র্ক-ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে বিমানের সরাসরি ফ্লাইট চালু। ৩. নিউইয়র্কসহ সারা বিশ্বের বাংলাদেশ কনস্যুলেট ও দূতাবাসের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র (ন্যাশনাল আইডি কার্ড) চালু করা, যা ইতিমধ্যে ব্রিটেনে চালু হয়েছে। ৪. নিউইয়র্কসহ সারা বিশ্বের বাংলাদেশ কনস্যুলেট ও দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোট প্রদান করার ব্যবস্থা করা। ৫. দেশের ভূমিদস্যুদের হাত থেকে প্রবাসীদের রক্ষা, বিশেষ করে চুক্তি মোতাবেক ক্রয় করা জমি, প্লট, অ্যাপার্টমেন্ট সহজে সংশ্লিষ্ট প্রবাসীর কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। ৬. ঢাকাস্থ হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধ করা। ৭. দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে হয়রানি বন্ধ করা। ৮. বাংলাদেশের অফিস-আদালতে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বন্ধ করা ও প্রবাসীদের জন্য ঢাকায় চালু করা ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ কার্যকর করা। ৯. প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থে গড়ে ওঠা অর্থনীতির লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার বন্ধ করাসহ পাচারকারীদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। ১০. বাংলাদেশ সফরকালে প্রবাসীদের জানমালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। ১১. বাংলাদেশে প্রবাসীদের ঘর-বাড়ি ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষার ব্যবস্থা করা। ১২. কনস্যুলেট সেবা বৃদ্ধি করে প্রবাসীদের পাসপোর্ট নবায়ন, জন্মসনদ, মৃত্যুসনদ, দেশের সম্পত্তি হস্তান্তরে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি প্রদানের মতো কাজগুলো সহজ করা এবং ১৩. যেকোনো প্রবাসী বাংলাদেশির মরদেহ বিনা খরচে দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
অনুষ্ঠানে অতিথিরা ছাড়াও অন্যদের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন ৮৫ বছর বয়সী সালেহা কাদির, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট আবু নাসের, সোলায়মান ভুইয়া, আব্দুর রহিম হাওলাদার, মোহাম্মদ আলী, কাজী আজহারুল হক মিলন, শাহজাহান শেখ, বদরুল হক, হাকিকুল ইসলাম খোকন, অ্যাডভোকেট মজিবউর রহমান, হাজী আব্দুর রহমান, এনামুল হায়দার, হানিফ মজুমদার, খুরশীদ চৌধুরী, ডা. নাফিজ, মোহাম্মদ আবুল কাশেম, আমিন খান জাকির, কামরুজ্জামান বাচ্চু, ইঞ্জিনিয়ার আলতাফ চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন লিটন প্রমুখ। মতবিনিময় সভায় বিভিন সংগঠনের নের্তৃবৃন্দসহ প্রবাসীরা উপস্থিত ছিলেন।
অধিকাংশ বক্তা দাবিগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করেন। কয়েকজন বক্তা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু দাবিও তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে ৮৫ বছর বয়সী সালেহা কাদির প্রবাসীদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সন্তানসহ আমি এখানে থাকি। তারপরেও তারা দেশে জমি ক্রয় করে। তা নিয়ে সমস্যার মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশে দুর্নীতি চলে, অনেকে প্লট বা ফ্লাট ক্রয় করে ২০/২৫ বছরে পায় না। অথচ দেশ চলে এই প্রবাসীদের অর্থে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী, এমপি এবং সন্ত্রাসীদের বিচার হয় না। তিনি বলেন, এসব দাবি আদায় করতে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
একজন বক্তা দেশ থেকে বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত নিয়ে দেশের ঋণ পরিশোধ করার কথা বলেন। একজন বক্তা বলেন, আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। আমার বাবা-মা বাংলাদেশি। আমি আমেরিকান সিটিজেন হয়েছি। আমার কেন বাংলাদেশে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিতে হবে। তিনি বলেন, আমরা আমেরিকান নাগরিকত্ব নিলেও আমাদের এখানে জন্ম নেওয়া সন্তানেরাও যাতে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পায়, সেটাও দেখতে হবে। আরেকজন বক্তা বলেন, আমরা এ দেশে থাকলেও এখানে বেড়ে ওঠা আমাদের সন্তানেরা যাতে বাংলাদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আমাদের অবর্তমানে দেখা-শোনা ও ভোগ করতে পারে, সেই বিষয়টিও দেখা প্রয়োজন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, সব সময় বলা হয় জনগণ ক্ষমতার উৎস। সংবিধান দেখলে দেখবেন, জনগণ ক্ষমতার মালিক। আর যারা দেশ পরিচালনা করেন, তারা কর্মচারী। যারা দায়িত্ব নেন, তারা কর্মচারী। কর্মচারীরা কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, এ জন্য তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। তাদেরকে প্রশ্ন করতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন কর্মচারী হয়েছেন, আমরা জনগণ ক্ষমতার মালিক। প্রধান অতিথি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পুরস্কার নিয়েও কথা বলেন।
খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, যেকোনো দাবি-দাওয়া আদায় করতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কথা বলতে হবে। কোনো ইস্যুতে ঐকমত্য হতে না পারলে কাঙ্খিত সাফল্য আসে না। আজকে আপনারা ১৩ দফা দাবি তুলেছেন, সেসব দাবি ড. ইউনূসকে জানাতে পারেন। তিনি সুইট টকার। তবে তিনি দাবি মেনে নিলেও লাভ হবে না। দাবিদাওয়ার মধ্যে রাষ্ট্রের প্রায়োরিটি কতখানি, তা দেখতে হবে। আপনারা যেসব দাবি করেছেন, আমি মনে করি সব দাবি পূরণ করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন। তার সঙ্গে দেখা হলে আমি আপনাদের দাবি-দাওয়ার কথাগুলো তাকে বলতে পারি। তবে এ নিয়ে আমি এত বেশি আশাবাদী হতে পারছি না।
খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, আপনারা বিমানের ফ্লাইট চালু করার কথা বলছেন। কিন্তু কাদের দোষে বিমানের ফ্লাইট বন্ধ হলো, সেটা আগে জানা দরকার। আবার কেন এখনো চালু হচ্ছে না, সেটাও জানতে হবে। বিমানের ফ্লাইট চালু হলেও যে আবার বন্ধ হবে না, এর নিশ্চয়তা কী? আপনারা এখানে যারা আছেন, তাদের অর্থে বাংলাদেশের এক বছরের সমান একটি বাজেট হয়ে যাবে। তাই আপনারা ইচ্ছা করলে নিজেরাই বিমানের ফ্লাইট চালু করে ফেলতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, আমি আইন বিষয়ে রিপোর্ট করতাম। সেটি করতে গিয়ে দেখেছি, বাংলাদেশের দেওয়ানি আদালতে ৯০ শতাংশ মামলাই বাবা-মা, ভাই, বোন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। চাচাতো ভাই জমি নিয়ে গেছে কিংবা বোনের জমি দেয়নি।
ফখরুল আলম বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছেন। স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকারই প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বার্থরক্ষার কথা বলে, নানা ধরনের প্রতিশ্রুতিও দেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি তারা প্রবাসীদের কোনো স্বার্থই রক্ষা করেনি। তিনি বলেন, প্রবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে প্রতিটি সরকারকে আমাদের ১৩ দফা দাবি নানা সময়ে উপস্থাপন করেও কোন ফল পাইনি। বর্তমানে দেশে অন্তরবর্তী সরকার। ছাত্র-জনতার প্রত্যাশিত রাষ্ট্র সংস্কারের সরকার। যে সরকার প্রতিষ্ঠায় প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও বিরাট ভূমিকা ছিল। তাই আশাবাদী এ সরকার আমাদের দাবিসমূহ পূরণ করবেন। আমরা প্রবাসীদের দাবিগুলো অন্তরবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কাছে পাঠাব। আশা করি, তারা আমাদের দাবিগুলো দেখবেন এবং পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।