ভালোবাসা এই মেঘ, এই রোদ্দুর

অনলাইন ডেস্ক : চোখের দেখা, ক্ষণিক ভালো লাগা, অভিসার আর শারীরিক সম্পর্ক তৈরির পর শেষ হয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার এক অধ্যায়। এ-সম্পর্কে মনের কোনো যোগ নেই। নতুন প্রজন্মের এই ভালো লাগা-ভালোবাসা সম্পর্কের নতুন এক সংজ্ঞা দাঁড় করাচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের পাশের দেশ ভারতের নতুন প্রজন্মের এই ভালো লাগা-ভালোবাসা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘ইনডিয়া টুডে’।
১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভ্যালেনটাইন ডে বা ভালোবাসা দিবস। দিনটি ঘিরে অনেক তরুণ-তরুণীর মধ্যে এখন ‘সাময়িক’ ভালো লাগা জন্ম নেয়। সাময়িক এই ভালো লাগার বিষয়টি ঘিরে অনেকেই এখন রঙিন স্বপ্ন বোনেন, আবার সাময়িক ভালোবাসায় মনের সংস্পর্শ না থাকায় অনেকেই বিষয়টি দেখছেন নেতিবাচক হিসেবে।
অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে ১৪ ফেব্রুয়ারি হচ্ছে নতুন সঙ্গী বাছাইয়ের দিন, নতুন সম্পর্কের বাঁধনে জড়ানো আর উদযাপনের দিন। দিনটিকে নিয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের ভাষ্য, ‘১৪ ফেব্রুয়ারি আমরা নাইট ক্লাবে যাই, আনন্দ-ফুর্তি করি, ফোন নম্বর দেওয়া-নেওয়া হয়। অনেক সময় দেখা যায়, কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও হয়ে যায়। কিন্তু তার নাম আর তার অনুভূতির কথা জানা হয়ে ওঠে না।’
নতুন প্রজন্ম, তাঁদের নতুন একটা যুগ। এ যুগটাকে মনস্তত্ত্ববিদেরা বলছেন, সাময়িক ভালো লাগা আর সম্পর্কের দ্রুত ইতি টানার যুগ। এ যুগে ‘ডেট’ বা সাক্ষাত্ মানে পার্টিতে আনন্দ করার পর সবকিছু ভুলে যাওয়া। এখন আর কোনো ছেলে-মেয়ে সাবেকি প্রেমে পড়েন না। তাঁরা কেবল একটা সম্পর্কে জড়ান, অভিসারে যান। যখন সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তখন তাঁদের ফেসবুক স্ট্যাটাসে বা মন্তব্যে দেখা যায় ‘ইন আ রিলেশনশিপ’। আর যখনই সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়, তখন ফেসবুক স্ট্যাটাসে ওঠে ‘কমপ্লিকেটেড’। সম্পর্ক ভেঙে গেলে শুধু স্ট্যাটাসটা বদলে আবার ‘সিঙ্গেল’ হয়ে যায়। হৃদয় ভাঙার সঙ্গে এ-সম্পর্কের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে না।
সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে নতুন নতুন অনেক সুযোগ তৈরির ফলে এখন মফস্বলের অনেক তরুণ-তরুণীই সম্পর্ক ভাঙা-গড়ার পরীক্ষা চালিয়ে দেখছেন। যখন কেউ শুনছেন যে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবী কোনো রকম সম্পর্কে না জড়িয়েই অভিসারে গেছেন, তাঁর কাছে বিষয়টি মোটেও আর অবাক করা কিছু মনে হচ্ছে না। অথচ একটা সময় ছিল, যখন বিয়ে ছাড়া এ ধরনের সম্পর্কের কথা ভাবাও যেত না। কার্ড ছাপানো থেকে শুরু করে নানা অনুষ্ঠান আর উপচারে বিয়ে হতো আর তারপর হতো ছেলেমেয়ের জানাশোনা। কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে ছেলে হয়তো মেয়েটির বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা করত। এ সময়ে ‘ভালোবাসা’ ছিল কঠিন বিশ্বাস আর ভালো লাগা-ভালোবাসায় মোড়ানো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সময়ে ভালোবাসার সংজ্ঞা দাঁড়িয়েছে, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত পছন্দের ব্যক্তিটিকে যথেষ্ট জানা-বোঝা না যাচ্ছে, ততক্ষণ তাঁকে মনের ঘরে বসানো যাবে না।’
অভিসারের নতুন নিয়মকানুন
বর্তমান সময়ে ডেটিং বা অভিসারের নতুন মন্ত্র হচ্ছে ‘মাচা’মন্ত্র। মালয়ালম ভাষার ‘মাচা’ শব্দটির বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’। যারা ‘মাচা’য় বিশ্বাসী তাঁরা কিছু দিন, কিছু সময় বা এক রাতের জন্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু হন। তাঁরা আবেগ বা মনের সংশ্লিষ্টতা এ অভিসারের সঙ্গে আনেন না। সম্পর্কে মন জড়ানোর বিষয়টি তাঁদের কাছে ‘বোঝা’। মুম্বাইয়ের ২৪ বছর বয়সী অ্যানিমেশন আর্টিস্ট সুপ্রিয়া খোরানা এ প্রসঙ্গে বলেন, এখনকার ডেটিং হচ্ছে সব ধরনের নতুন সুযোগগুলো পরখ করে দেখা। অচেনা কারও সঙ্গে নাচ, তাঁর ট্যাবলেট কম্পিউটার সঙ্গে নিয়ে সময় কাটানো। একসময় ট্যাবলেট কম্পিউটারটি উঠিয়ে নিয়ে সরে পড়া। এর পর আর কোনো যোগাযোগ বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো ঝামেলায় না পড়া। ভারতের মনোবিদেরা বলছেন, অনেকের কাছেই মনের আবেগ এখন শুধুই ‘ফালতু’ একটি বিষয়। একে মজা হিসেবেই গ্রহণ করছেন এখনকার তরুণেরা। অনেক তরুণ এখন গর্বের সঙ্গেই বলেন, কয়েকটি সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এরপর একসময় তাঁর ফেসবুকের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে ‘কমপ্লিকেটেড’ লেখাটি ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ‘কমপ্লিকেটেড’ অবস্থা থেকে ‘সিঙ্গেল’ হতে বড়জোর ঘণ্টা খানেক সময় লাগে। মুম্বাইয়ের ডিস্ক জকি অনুজা সিংয়ের ভাষ্য, কে এত মানসিক ঝামেলার বোঝা টানতে যাবে? এমনিতেই প্রেমে অনেক চাপ, কান্নাকাটি, ঝগড়াঝাঁটির কী দরকার?
বর্তমানের এ প্রজন্ম ছেড়ে যদি ফ্ল্যাশব্যাকে কিছুটা পেছনে যাওয়া যায় তবে দেখা যাবে যে, পুরোনো যুগের তরুণ-তরুণীরা ভাবতেন, অভিসারে নদীর ধারে দুজন হাত ধরাধরি করে যদি হাঁটতে পারতাম! বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এখন বিয়ে-বিষয়ক ওয়েবসাইটে যাচ্ছেন পাত্র-পাত্রী খুঁজতে। কিন্তু যাচ্ছেন কখন? সম্পর্ক যখন তেতো আর বিতৃষ্ণায় গিয়ে ঠেকছে, তখনই বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজতে বসছেন এসব ওয়েবসাইটে। তার আগে সম্পর্কের সব দিকগুলোতে নিজেতে ঝালাই করিয়ে নিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের অনেকেই। বেঙ্গালুরুর প্রকৌশলী জয়ন্ত শ্রীবাস্তব বলেন, সব মজা শেষে যখন ঘর বসাতে মন চাইছে আর পরিবারে একটা বউ চাইছে, তখনই বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজার পালা।
সম্পর্ক পরিবর্তনের নিয়ামক
উপমহাদেশে প্রথাগত ধারায় সম্পর্কের বিষয়গুলোতে পরিবর্তন ঘটে গেছে। আর এই পরিবর্তন ঘটিয়েছে হলিউড ও বলিউডের চলচ্চিত্রের বিশেষ দৃশ্যগুলো। চলচ্চিত্রে ‘প্লেবয়’ ধরনের ছেলেদের বিশেষায়িত করায় তা বর্তমান প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছে। এখন আর এক সম্পর্ক থেকে আরেক সম্পর্কে যেতে কেউ ভীত নয়। একজন গেছে তো আরেকজন আসবে! এটাই তরুণদের ভাবনা।
ট্যাবলেট আর স্মার্টফোনের এই যুগে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুক, টুইটারও প্রভাব ফেলছে ক্ষণিকের সম্পর্ক তৈরির প্রভাবক হিসেবে। যারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মনের মানুষ জোগাড়ে ব্যর্থ, তাঁদের জন্য তৈরি হচ্ছে ডেটিং সাইট ও অ্যাপ্লিকেশন। সম্পর্ক এখন ইন্টারনেট নামের জালে আটকানো।
অক্ষর ১৪০
১৪০ অক্ষরের টুইট। ব্যস! সম্পর্কের ইতি। এখন নতুন প্রজন্ম একটা টুইটে ঘোষণা করছে, ‘আমি আর তোমার নেই’। আবার নতুন পছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে স্ট্যাটাস বা টুইট করা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তাতে সাড়া দিয়ে পড়ছে ‘লাইক’। মুম্বাইয়ের জাসমিত তাঁর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন এভাবে, ‘আমার মামাতো বোনের সঙ্গে সাত বছরের জানাশোনা, সম্পর্ক।’ অথচ তাঁর পছন্দের গান বাজাতে পারে এমন একজন ফেসবুক বন্ধুর জন্য ফেসবুকের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস বদলে ‘সিঙ্গেল’ লিখেছে তাঁর আত্মীয়টি।
মনস্তত্ত্ববিদেরা অবশ্য এ বিষয়টিকে সময় ও প্রযুক্তির পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন। তাঁদের মতে, এখনকার তরুণেরা সম্পর্কের বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখে, ঘন ঘন সম্পর্ক বদলায়। এতে সম্পর্কের গভীরতা আর রোমাঞ্চের ঘাটতি বাড়ছে।
মা-বাবা চিড়ে-চ্যাপটা
পরিবর্তনের এ যুগে মা-বাবা কী করবেন? দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাবা ও মা নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছেন। সন্তানদের এ ধরনের আচরণকে তাঁরা প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের বন্ধু বাছাইয়ের জন্য এবং ভালো বন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে কি না বা সম্পর্কের কোন পর্যায়ে তারা যাবে—সে বিষয়ে মা-বাবার ভূমিকা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ে ‘বিগড়ে’ গেলে বাবা-মা তাঁর বিয়ের জন্য উত্কণ্ঠায় ভোগেন। তাই শুরু থেকেই সন্তানের প্রতি মা-বাবার দৃষ্টি থাকা উচিত।
পুরোনো সেই দিনের কথা
মন হবে সমুদ্রের মতো বড়। কেউ একজন অসীম হৃদয়ের প্রেম নিয়ে আসবে তারই অপেক্ষায় নতুন প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়ে অপেক্ষা করেন। এ প্রজন্মের অনেকেই স্বপ্নের রাজকুমার বা রাজকুমারীর জন্যও অপেক্ষা করছেন। তাঁরা এখনো সেই পুরোনো যুগের প্রথাতেই বিশ্বাস করেন। সাইবার ডেটিং বা দ্রুত সম্পর্ক বদলে ফেলার এ যুগে এসেও অনেকে এখনো অপেক্ষা করেন ‘ভালোবাসা’ খুঁজে পেতে। তাঁরা কি সেকেলে? একবার প্রেমে ব্যর্থ হওয়া দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পী রায় ঘোষণা দিয়েছেন, আর তিনি ‘ইলেকট্রনিক’ সম্পর্কে জড়াবেন না। তাঁর মতে, যে সম্পর্ক একটি এসএমএস বার্তায় ভেঙে যাওয়ার ভয় থাকে, যে সম্পর্ক ফেসবুক চ্যাটের পর শেষ বা একবার শারীরিক সম্পর্ক হলে আর টান নেই—এ ধরনের সম্পর্ক ‘ভালোবাসা’ নয়। শিল্পী বলেন, ‘আমি আত্মিক একটা সম্পর্কের খোঁজ করি। আমার এ ধ্যান-ধারণার জন্য আমাকে অনেকে “সেকেলে” বলে। তবে আমি প্রথায় বিশ্বাস করতেই ভালোবাসি।’ কলকাতার মেয়ে সুরভি ব্যানার্জি বলেন, ‘আমার একটি ছেলের সঙ্গে চার বছরের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কারণ, আমি তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে যেতে চাইনি। এ সময় ছেলেটি অন্য মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক করে বেড়িয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি ভালোবাসা হৃদয়ঘটিত।’
বলিউডের চলচ্চিত্র
সম্পর্কের এই টানাপোড়েন, সাময়িক এ ভালোবাসাকে উসকে দিচ্ছে বলিউডের চলচ্চিত্রগুলো। ‘শয়তান’, ‘ইশকজাদা’ নামের সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে সাময়িক সম্পর্কের বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। সর্বশেষ যশরাজ ফিল্মসের ‘যব তক হ্যায় জান’ চলচ্চিত্রে আনুশকা শর্মাকে তুলে ধরা হয়েছে এই প্রজন্মের সেই মেয়েটির আদলে; যার কাছে সম্পর্ক মানেই ‘এই মেঘ, এই রোদ্দুর’।প্রথম আলো