Saturday - May 18, 2024 7:49 PM

Recent News

কেন প্রবাসী হইনি

মতিউর রহমান চৌধুরী : প্রবাসী হবার কথা ছিল। হয়ে গেলাম সাংবাদিক। আরও নিবিড়ভাবে চিন্তা করলে রাজনীতিক হওয়ার ষোলআনা সম্ভাবনা ছিল। শুরু করেছিলাম রাজনীতি দিয়ে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, ওবায়দুল কাদেরদের সঙ্গে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সরব ছিলাম। রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলে আমিও হয়তোবা কোন পদে আসীন হতে পারতাম। যদিও ’৭৪ সনে রাজনীতিকে গুডবাই জানিয়েছি। রাজনীতি আমাকে কখনও কাছে টানেনি। কোন আকর্ষণই ছিল না আমার কাছে। সাংবাদিকতাকেই জীবনের একমাত্র পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। গোড়াতেই বলে রাখি পারিবারিক ঐতিহ্যেই প্রবাসী হতে বার বার আমার ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ ছিল। বাবা ছিলেন প্রবাসী। পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য বিলেতেই কাটাচ্ছেন চার যুগেরও বেশি সময় ধরে। আমি যে একবার বিলেতে থাকতে যাইনি তাও কিন্তু বিলকুল ঠিক নয়। কিন্তু কেন জানি বিলেত আমাকে ধরে রাখতে পারেনি। অথবা আমি বিলেতকে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনি। দৈনিক সংবাদের রিপোর্টার থাকাকালে সত্তর দশকে একবার চাকরি ছেড়ে লন্ডন চলে গেলাম। যদিও স্থায়ীভাবে থাকবো এটা ভাবনার মধ্যে ছিল না। বড় ভাইয়ের ইচ্ছায় তিন মাস থাকলাম। ঢাকায় তখন চাকরি চলে গেছে। এর মধ্যে পরিবারের সদস্যরা লন্ডনী এক কন্যার সঙ্গে বিয়ের আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করলেন। তাদের ধারণা, আমি এতে মত দেবো। এক সকালে ভাবীকে বললাম, আমার পাসপোর্ট দাও। আমি আগামী সপ্তাহেই দেশে ফিরে যাবো। সে কি! ওদিকে তো সবাই একটি মেয়েকে পছন্দ করে ফেলেছেন। ওরা দেখতে আসবে। না ভাবী আমার পক্ষে আপাতত সম্ভব নয়। কোনমতে বুঝাতে সক্ষম হলাম। দেশে ফিরে চাকরি খুঁজতে থাকলাম। সংবাদ সম্পাদক প্রয়াত আহমেদুল কবির সংবাদে পুনরায় চাকরি দিতে রাজি নন। প্রয়াত বজলুর রহমান, সন্তোষ গুপ্ত এবং আবদুল আউয়াল খানের কোন আপত্তি নেই। তিনজনই সংবাদের নেপথ্যের মূল কারিগর। সংবাদের অন্যতম পরিচালক সৈয়দ নূর উদ্দিনও আমার পক্ষে মত দিলেন। একদিন প্রেস ক্লাবে বসে আছি। হঠাৎ একটি ফোন এলো সংবাদ থেকে। বজলু ভাই কথা বলবেন। ফোনে হ্যালো বলতেই তিনি বললেন কালই যোগ দেন। কি যে আনন্দ। বিলেতে আর ফিরতে হবে না। এত কষ্টের জীবন বেছে নিতে হবে না। বিলেতে দেখেছি, কি যে কষ্ট। নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়। তখন ভালো মনে হতো না। এখন দেখি এটাইতো ভাল। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয় না। সাংবাদিকতায় দীর্ঘ ৪২ বছর পর এখন আমি হিসাব মেলানোর চেষ্টা করি। নামদাম যথেষ্ট হয়েছে। খ্যাতিও পেয়েছি। কিন্তু পাইনি শান্তি। ঘর থেকে বের হলে কখন বাড়ি ফিরবো সে নিয়ে মহা চিন্তা। পরিবারের সদস্যরাও চিন্তায় থাকেন সারাক্ষণ। এখন আবার মধ্যরাতের কাজ নিয়েছি টেলিভিশনে। টক শো উপস্থাপনা করি। বাড়ি ফিরতে অনেক রাত। জীবন বাজি রেখে কথা বলি। বাড়িও ফিরতে হয় জান হাতে নিয়ে। প্রবাস জীবনে এই ভয়টা অন্তত নেই। প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী এখন পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। যাদের শ্রমে-ঘামে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমি। আমরা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে বড়াই করি। কিন্তু তাদের মূল্যায়ন করি না। খোঁজ নেই না, কে কোথায় কিভাবে আছে? এক অসুস্থ রাজনীতির ধারায় আমরা খণ্ড-বিখণ্ড। পৃথিবীর যে অঞ্চলেই যাই না কেন প্রবাসীদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজেকে জড়াই। জানার চেষ্টা করি তারা কেমন আছেন। যত ভালই থাকুন না কেন দেশের জন্য তাদের মন কাঁদে। তারা চান দেশের উন্নয়ন আর শান্তি। তারা চান, এমন এক বাংলাদেশ যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটবে না। সুশাসনের হাওয়া বইবে ঘরে ঘরে। এটাইতো চাওয়া। এর বাইরে কারো চাওয়া-পাওয়ার নেই। অনেকেই ফিরতে চান প্রবাস জীবনের ইতি ঘটিয়ে। দেশের অবস্থা দেখে তারা হতাশ হন। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। কাতারে একজন প্রবাসী আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা আপনারা যে টেলিভিশনের পর্দায় নানা স্বপ্নের কথা বলেন। বাস্তবে তো আমরা তা দেখি না। তাকে বলেছিলাম, জবাব আসলে নেই। আমরা ব্যর্থ, রাজনীতিকদের খেয়াল-খুশির কাছে। দম্ভ, অহমিকা আর প্রতিহিংসায় আমাদের স্বপ্ন বার বার ভেঙে যায়। মায়ামি প্রবাসী জামান আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারিনি। তাই ছুটে এলাম। আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসা জানাতে। দেশের প্রতি আপনাদের যে ত্যাগ সেটা দু’কলম লিখে প্রকাশ করা যায় না। মানবজমিন আপনাদের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও পত্রিকাটি গণমানুষের কথা বলে যাচ্ছে। সাদাকে সাদা বলছে। কোন রক্তচক্ষুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেনি।
ভালো থাকবেন সবাই। জয় হোক প্রবাসীদের।মানবজমিন 

0Shares

COMMENTS