Sunday - May 5, 2024 10:28 AM

Recent News

মনে প্রশ্ন জাগে দুই হাজার এক চল্লিশ সালের মধ্যে কি আমরা বড় ভাইদের নিয়ন্ত্রনমুক্ত হতে পারবো? : নিউইয়র্কে কাজী হায়াৎ

মনে প্রশ্ন জাগে দুই হাজার এক চল্লিশ সালের মধ্যে কি আমরা বড় ভাইদের নিয়ন্ত্রনমুক্ত হতে পারবো? : নিউইয়র্কে কাজী হায়াৎ

আমি এখন আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে। প্রায় তিন মাস হয়ে গেল এখানে আছি। এর আগে আরো দুই বার এসেছিলাম, তখন একবার তেরো দিন, একবার পাঁচদিন ছিলাম। তখন আমেরিকাকে বেশী ভাববার কিছু ছিলনা কারণ ঐ স্বল্প সময়ে আমেরিকার বেশী কিছু দেখা ও জানা সম্ভব ছিল না। এখনও এই বিশাল দেশের কিছুই ভালো করে জানতে পারিনি। তবুও এই সামান্য সময়ে যতটুকু চোখে দেখে জেনেছি তাতে মাঝে মাঝে মনে হয় যে দেশটিতে আমি কয়েকদিন পরে আবার ফিরে যাবো সে দেশটি কি কখনো এমন সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থানে যেতে পারবে? আমাদের দেশের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ২০৪১ সাল নাগাদ আমরা একটি উন্নত দেশে পরিণত হব। ২০৪১ সাল পর্যন্ত হয়ত বাচবোনা তবে দুই হাজার একুশ পর্যন্ত সময় ছিল মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার। ইতিমধ্যে দুই হাজার আটারোতেই তাই মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর প্রচেষ্টায় আমরা জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। উন্নত দেশ হলে কেমন হবে আমার জন্মভূমি আমি জানিনা, তবে প্রশ্ন জাগে মনে আমেরিকার মত এমন কি হবে? থাকবে কি শতকরা নব্বই ভাগ পরিবারের এক থেকে একাধিক গাড়ী? নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে গাড়ী গুলি চলবে কি? কোথাও কোন প্রকার শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটলেই পুলিশ এসে হাজির হবে কি? নিয়ম ভাঙ্গার অপরাধে পুলিশ কোন প্রকার অনুরোধ উপরোধ মন্ত্রী মিনিষ্টারের টেলিফোনের তোয়াক্কা না করে জরিমানা করে দিয়ে যাবে কি?
কি অপূর্ণ আমার দেশে যা ভাবা যায় না, একখানা গাড়ীতেও এক্সট্রা বাম্পার নেই, লক্ষ লক্ষ গাড়ী রাস্তার পাশে পার্কিং করে রাখা আছে। কখনো শোনা যায় না একটি গাড়ীর লুকিং গ্লাস, বাম্পার অথবা ষ্টিকার চুরি হয়েছে। ছেলের বাসায় যেখানে থাকি সেখানে রাস্তা খুড়ে, গ্যাসের পাইপ বসানোর কাজ চলছে। কি সুন্দর ভাবে সিটি করর্পোরেশন থেকে জায়গা নির্দিষ্ট করে নোটিশ দিয়ে যায়। এখানে এই পর্যন্ত কোন গাড়ী আগামী এত তারিখে এতটার থেকে এতটা সময় পাকিং করা যাবে না। নির্ধারিত তারিখে, নির্ধারিত সময়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে যায় রাস্তা যতটুকু খোড়া হয় ততটুকু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের কাজ সেরে আবার গাড়ী চলাচল এবং পার্কিং এর উপযোগী করে রেখে যায়। এখন বসন্ত কাল, শীতটা একটু কমেছে তাই অনেক বাড়ী সংস্কারের কাজ চলছে। কখনো শুনতে পেলাম না কোন বাড়ী সংস্কার করতে গিয়ে কোন ঠিকাদারকে এলাকার বড় ভাই অথবা মাস্তানকে বলতে হয়েছে, অথবা চাঁদা দিতে হয়েছে। কখনো শুনিনি ঐ এলাকা অমুক বড় ভাই নিয়ন্ত্রন করে, মনে প্রশ্ন জাগে দুই হাজার এক চল্লিশ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কি আমরা বড় ভাইদের নিয়ন্ত্রনমুক্ত হতে পারবো?
আন্তর্জাতিক মা দিবসে আমার ছেলেটা তার মাকে নিয়ে গেল নিউইয়র্ক বেশ দূরে আরেকটি স্টেট কানেকটিকাট ঘুরে দেখাতে, ওর মা দেখতে চেয়েছিল এখানকার গ্রাম, সেই গ্রাম দেখতে গিয়েছিলাম স্বপরিবারে একরাত সেখানে হোটেলেও ছিলাম। দীর্ঘ এই পথ অতিক্রম করে কানেটিকাট পৌঁছে জঙ্গলের মধ্য দিযে অনেক সরু সরু রাস্তা দিয়ে অনেক ঘুরেছিলাম। রাস্তার পাশে জঙ্গলের মধ্যে অনেক বাড়ীঘর দেখেছিলাম। সেগুলো ঝুপড়ি বা বস্তি নয় নিউইয়র্কের মতই উন্নত ঘরবাড়ী, তবে আশ্চর্য্যরে বিষয় হল এই বিশাল দুরত্ব অতিক্রম করে যাওয়া আসা কোন সময়ই রাস্তার পাশে হাটতে অথবা বসে থাকতে একটা মানুষকেও দেখিনি। দেখিনি রাস্তার পাশে চায়ের দোকান, হাটবাজার, গণি চাচার মত টুপি মাথায় দিয়ে কাউকে হাটতে দেখলাম না, আক্কেল আলীর মত কাউকে পুইশাক আর ধুন্দোল নিয়ে হাটে যেতে দেখিনি। কোথাও দেখলাম না আমাদের দোলেনাকে চৌদ্দ বছরে বিয়ে হয়ে যে মাত্র বত্রিশ বছরে নানী হয়েছে। কঙ্কাল সার দোলেনা সাদা পাতা দিয়ে পান খেতে খেতে দাতগুলো কালো করে ফেলেছে। দোলেনা এখন একটা অসুখের ডিপো, প্রায় প্রতিদিন সকালে মেঠো পথ দিয়ে এসে হাইওয়ে পার হয়ে দোলেনাকে যেতে হয় সমীর ডাক্তারের বাড়ী। বাজারে বড় একটা ঔষুধের দোকান আছে সমীর ডাক্তারের ঔষুধ বিক্রি করতে করতে সে এখন এলাকার বড় ডাক্তার, ঔষুধ নিয়ে ফেরার সময় সেদিন অল্পের জন্য ইজিবাইকের ধাক্কা খায়নি, ইজি বাইকটা দোলেনার খারাপ লাগে কারণ ঐ গাড়ীটায় একদমই শব্দ হয় না, দোলেনারাকি কখনো জ্যামাইকা হাসপাতাল অথবা মাউন্ট সিনাই এর মত হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পাবে, দোলেনারা কি কখনো রিক্সা, ভ্যান নসিমন, ইজিবাইকমুক্ত রাস্তা পাবে।
কানেটিকাট থেকে আসার পথে একটি এক্সিট নিয়ে ঢুকে আমার ছেলেটা একটা খাবার দোকানে নিয়ে গেল। দোকানে ঢুকে বুঝতে পারলাম এটা আমেরিকার রাস্তার পাশের চায়ের দোকান। শুধু আমরা না, দেখলাম সেখানে আরো অনেক গাড়ী আসছে যাচ্ছে। কিন্তু সেই রেষ্টুরেন্টে মোকছেদ মিয়াকে দেখলাম না। যিনি সম্প্রতি বড় মিয়া হয়েছেন। বড় মিয়ার ছেলেটি বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করে এখন ঢাকায় পুলিশের এএসপির চাকুরী করে। এ কারণেই থানায় গেলে বড় মিয়াকে ওসি সাহেব খুব সমাদর করে চেয়ারে বসতে দেন। বড় মিয়া প্রতিদিন রাস্তার পশে চায়ের দোকানে চা সিগারেট খেতে আসেন। বড় মিয়া এখন এলকার রাজনীতি ছাড়া বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে অনেক কথা বলেন। প্যালেষ্টাইন, কাশ্মীর, সিরিয়ার সমস্যার সমাধান প্রায় প্রতিদিনই তিনি করে দেন। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় কোন দেশ বিশ্বকাপ নিয়ে যাবে বড় মিয়া তা বেশ আগেই বলে দিয়েছেন , বড় মিয়ার কথার কেউ প্রতিবাদ করে না কারণ বড় মিয়াার ছেলে এএসপি, সেদিন বড় মিয়ার সাতে একটা ছেলে বেয়াদবি করেছিল বলে সাথে সাথে থানায় ফোনকরে পুলিশ দিয়ে ছেলেটাকে এ্যারেষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের দেশের গ্রামবাসীরা কি কখনো এমন বড় মিয়া মুক্ত হতে পারবে?
মাত্র দুই দিন পরেই শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা, আমি জানি আমার দেশের গ্রামে গঞ্জে চলছে বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনা প্রস্তুতি চলছে কে কোথায় খেলা দেখবে। ইতিমধ্যে বাজি ধরা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এখানে কোন বাঙালীর মুখেও এ পর্যন্ত শুনিনি বিশ্বকাপ নিয়ে কোন আলোচনা, কেন এমনটি হচ্ছে বুঝতে একটু কষ্ট হয়, তবুও যেটা সহজে বুঝি প্রথমত দেশের কয়েক কোটি লোক বেকার এবং তারা বিনোদন প্রিয়। তাই যদি হয় তাহলে কতদিনে এই বেকার সমস্যার সমাধান হবে?
হয়ত নিশ্চয়ই আমাদের দেশ একদিন উন্নত দেশে পরিণত হবে, সমাধান হয়ে যাবে সমস্ত সমস্যার।
আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণ হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত সেই উন্নত দেশ হয়ত আমি দেখে যেতে পারবো না, তবে যারা দেখবেন এবং তখন যারা আমার বাংলাদেশের নাগরিক থাকবেন তাদের প্রতি রইল আমার অগ্রিম শুভেচ্ছ। কয়েকদিন পরেই আমাকে ফিরে যেতে হবে বড় ভাই আর বড় মিয়ার দেশে, সে দেশ আমার জন্মভূমি। যেদেশের স্বাধীনতার জন্য আমি যুদ্ধ করেছি।
১৯৭১ সালের সেই নয় মাসের মধ্যে কখনোই মনে হয় নাই বেঁচে থাকবো। কিন্তু বেঁচে ছিলাম এখনও আছি। ১৯৭১ সালে যখন আমরা পাক বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছি আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমরা আমাদের দেশকে একদিন বড় মিয়া-বড় ভাই মুক্ত করতে পারব। আমরা হব প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের উন্নত দেশ। দোলেনারা একদিন বত্রিশ বছরে নানী হবে না, সমীর বাবু ওষুদের দোকানদার বলে ডাক্তার হতে পারবে না, দোলেনাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হবে। অনেক আশা অনেক স্বপ্ন আমারও সেই স্বপ্ন আর আশা নিয়ে ফিরে যাবো দেশে। সেসব বাঙালী ভাইরা এই উন্নত দেশের নাগরিক হয়েছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ মাতৃভূমিকে ভুলে যাবেন না। মাতৃভূমির উন্নয়নে আপনাদেরও সহযোগিতার প্রয়োজন আছে। দয়া করে ভুলে যাবেন না, আপনার স্বাধীনতার প্রতীক জাতীয় পতাকার কথা, ভুলে যাবেন না আপনার জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম লাইন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

0Shares

COMMENTS